#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ৭
#Tasfiya_Nur
সকাল প্রায় সাতটা।শরীরে শাল জড়িয়ে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে জান্নাত।তাকে ঘিরে ধরে আছে রিঠি আর আরমানের কাজিন বোনরা।চুলগুলো দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে।ঠান্ডা লাগছে খুব তার।আরমানের উপর রাগও লাগতেছে।তাদের মাঝে তেমন কিছু হলোনা অথচ গোসল করিয়ে ছাড়লো বাকি সবাই কি ভাববে এটা বলে আরমান তাকে গোসল করতে বাধ্য করেছে।তারসাথে রাতে তো প্রচুর বিরক্ত করেছে।ছেলেরা নাকি গোমড়া হয়।কিন্তু আরমান তার পুরো উল্টো।একের পর এক কথা বলেই গেছে তার ব্যাপার নিয়ে।অথচ সে যা প্রশ্ন করেছিলো তা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে।তাই জান্নাতও আর ঘাটায়নি আরমানকে।কিন্তু মনের মধ্যে জানার আগ্রহ খচখচ করছে তার।সকালে রিঠিকে জিগাসা করলে সে বলে দিয়েছে এসব কথা যেন আর তোলা হয় বাড়িতে।তারপর থেকে সেই চেয়ারে থম মেরে বসে আছে সে।পুরো বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠানের ধুম লেগে গেছে। বসে বসে এসব দেখছিলো আর কথাগুলো ভাবছিলো জান্নাত।রিঠিরা বিভিন্ন কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছিলো কিন্তু তাতে তার মন নেই।
‘একি মহুয়া,কালো শাড়ি পড়ছো ক্যা?তোমারে তো কুনোদিন এমন শাড়ি পড়তে দেহি নাই।সাদা পড়ো ঠিক আছিলো,কিন্তু কালো পড়লা ক্যা?’
জেঠি শ্বাশুড়ির মুখে মহুয়ার নাম শুনে ডান দিকে তাকায় জান্নাত। সেখানে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে।তার সামনে দাড়িয়ে আছে নাজমা বেগমের বড় জা।জান্নাত ভালো করে দেখে না পারায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।ধীর ভাবে হেটে সেও মহুয়াদের সামনে যায়।রিঠি এসব দেখে পিছন পিছন এসে দাড়ায়।রিঠি মহুয়াকে কালো শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে বলে উঠে,
‘শুরু হলো আরেক নাটক।নাটকে আকাল নাই আজাকাল।দিনটাই মাটি।’
জান্নাত মহুয়ার মুখাপানে তাকায়।মেয়েটা সুন্দর বড্ড বেশিই সুন্দর। মেয়েরা ফর্ষা হয়, কিন্তু মহুয়া এত বেশি ফর্ষা কেনো গ্রামের মেয়ে হয়ে।তার থেকে বয়সে ছোটোও হবে তিন বছর।মহুয়ার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে জান্নাত। মহুয়া তার জেঠি শ্বাশুড়ি শিরিকে কৈফিয়ত দিতে ব্যস্ত।এক পর্যায়ে মহুয়ার নজর পড়ে জান্নাতের দিকে।সে চুপ করে যায়।তারপর জেঠি শ্বাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
‘বড়মা ইনি!আরমানের বউ কি?সাজগোজ তো তাই বলে!’
‘হ্যা মহারাণী, এটাই আরমানের বউ জান্নাত।আপনারে তো কাল রাতে ডেকেও তোলা যায়নি ঘুম থেকে।তাই জানবেন কি করে।বাপ তো আইছে, চইলা যাইতে পারোনা?আমাগো পোলা তো আর নাই যে তার লগে সংসার করবা।’
মহুয়ার কথায় খোচা মেরে কথাটা বলেন শিরি বেগম।মহুয়ার এতে তেমন কিছু মনে হলোনা।সে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
‘ছোটো জা হও,কিন্তু দেখো তুমিও সেই আমার দেবরের মতে বয়সে বড়।সম্পর্কে আমি তোমার বড় কিন্তু বয়সে ছোটো।সম্পর্কের সম্মানে হয়তোসবাই আপনি করে বলতে বলবে।কিন্তু তুমি আমায় তুমি বলবে কেমন!’
কথাটা বলেই মহুয়া সেই স্থান ত্যাগ করে। শিরি বেগম তাকে উপেক্ষা করায় রেগে যান খুব।তিনি হনহনিয়ে চলে যান রান্নাঘরে নিজের জা’য়ের কাছে।মহুয়ার নামে নালিশ দিবেন তিনি।কিন্তু গিয়ে দেখতে পান মহুয়া সবার সাথে টুকটাক কাজ করছে।তাই কাজের শান্তি নষ্ট করবেন না বলে নিজেও কাজে হাত লাগান।জান্নাত হতভম্বের ন্যায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে পরিস্থিতি দেখে গেলো। এতক্ষণ কি হলো সব মাথার উপর দিয়ে গেলো তার।এই বাড়ির একটা মানুষকেও তার সুবিধাজনক মনে হয়না।তখনই আরিফুল শিকদার ছোটো ছেলের বউকে বারান্দায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে জিগাসা করে বলেন,
‘কি হয়েছে আম্মা?এখানে এভাবে খাড়ায় আছো যে!’
‘কিছু হয়নি আব্বু,এমনিই কে কি করছে একটু দেখছিলাম।’
শ্বশুড়ের প্রশ্নে মুচকি হেসে জবাব দেয় জান্নাত।আরিফুল শিকদার তার ছোটো বউমার কথায় তাল মিলিয়ে মুচকি হাসেন। তারপর তিনি জান্নাতকে ঘরে যেতে বলে তিনি তার কাজে চলে যান।জান্নাতের কথামতো রুমে গিয়ে দেখে আরমান কম্বল মুড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।”আমার ঘুম নষ্ট করে নিজে ঘুমানো!বের করছি ঘুম।” কথাটা বিরবির করে বলে জান্নাত একটানে কম্বল সরিয়ে দেয় আরমানের উপর থেকে।আরমান শীত অনুভব হওয়ায় আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকিয়ে জান্নাতকে দেখে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আরমান মুখটা ইনোসেন্ট করে বলে উঠে,
‘সকাল সকাল ঘুমের দফারফা কেনো করলা বউ?’
আরমানের এমন কথায় ভ্রু কুচকায় জান্নাত।লোকটা কাল রাত থেকে তাকে বউ বউ করে যাচ্ছে।সে আরমানের কথা শুনেওনা শুনার ভান করে ড্রেসিং টেবিলে বসে চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপে আটকে নেয়।আরমান কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে।তারপর ব্রাশ নিয়ে কলপাড়ের দিকে যায়।জান্নাত আরমান যাওয়া পরই লাগেজ খুলে নিজের ফোনটা বের করে।তারপর অনলাইনে গিয়ে সব চেক করে আসে।মানুষটা তার মেসেজ সীনই করেনি।
“মরীচিকার পিছনে ছুটলে হতাশই হতে হয়।আপনার অস্তিত্ব আমার জীবনে রইলোনা আর।ভালো থাকবেন।”
বিরবির করে কথাটা বলতে বলতে জান্নাত তার ভালোবাসার মানুষটার আইডি ব্লক দিয়ে ফোন ছুড়ে মারে বিছানায়। লম্বা একটা দম নিয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।রাতে আরমানের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ চলছে তার।সে সময় চেয়েছে আর আরমান সময় দিতে চেয়েও তাকে আলাদা ভাবে ঘুমোতে দিবেনা বলেছে।এটা নিয়ে তর্কাতর্কি করতে করতে শেষে আরমানেরই বাহুডোরে ঘুমাতে হয়েছে তাকে।শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে ঘুমটা ঠিকঠাক হয়নি।তাই শুয়ে পড়তেই চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।আরমান ফ্রেশ হয়ে এসে জান্নাতকে ঘুমাতে দেখে জান্নাতের কাছে গিয়ে কম্বল ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে দেয়।তারপর কিছুক্ষণ জান্নাতের কাছে বসে একনজরে দেখে উঠে যায় বিছানা থেকে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে নাস্তা করতে বসে আড্ডা দিতে থাকে।
💖💖
সকাল এগারোটাবাড়ির বাইরের উঠোন টায় দাড়িয়ে আছে মহুয়া।বাসার ভেতরে থাকা যাচ্ছে না মানুষের কথায়।তার বাবা মাও কাল বিয়ের বাড়ি থেকেই তাদের বাড়িতে ফেরত চলে গেছে। বৌভাতের অনুষ্ঠানের সময় আসবে।তার বাবা তো তাকে বলেই দিয়েছে যে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে।কিন্তু সে এই পরিবারটাকে বিপদের মাঝে দাড় করিয়ে যাবে কিভাবে।আর বাড়ির বাকি সদস্যরা তো পারলে তাকে খুন করে দিতো।তাদের আদরের ছেলে আজ তাদের কাছে নেই। পুরো একটা বছর হলো নেই সে।মহুয়াই বা কি করতো,তার পরিবারকে বাচাতে গিয়ে এই পরিবারে এসেছে সে। নয়তো খারাপ লোকটা তার বাবা -মা, ভাইকে মেরে ফেলতো। কিন্তু তখন তো শুধু আরফাজকে এই শহর থেকে সরানোর কথা ছিলো কিন্তু কে জানতো লোকটার নজর এই শিকদার বাড়ির সম্পত্তির উপরেও লোভ আছে।আরমানের জীবনটা সবথেকে বেশি বিপদে পরে আছে।আর রিঠি তো পরের বাড়িতে, সে থেকেও যা না থেকেও তাই। অদূরে ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত কয়েকজন কামলার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে এসব ভাবছিলো মহুয়া।সবাই বিয়ের কাজে ব্যস্ত বাড়িতে আবাদ-ফসল এসেছে সেদিকে কারোর খেয়াল নাই।তাই সে নিজেই দাড়িয়ে সবটা খেয়াল করছিলো।পিছন থেকে কেউ একজন তার কাধে হাত রাখে।মহুয়া পিছন ফিরে তাকায়।রিঠির স্বামী রাহাদকে দেখে মহুয়া মুচকি হাসে।রাহাদ রাগে দাঁতে দাত পিষে বলে উঠে,
‘কাল রাতে লঞ্চের মেয়েরা নিখোজ হলো কিভাবে মহুয়া?আবার লঞ্চে কাউকে ঢুকতেও দেখা গেছে। সারারাত ছিলে কোথায় তুমি?বেশি উড়ছো কিন্তু তুমি!’
‘তাই নাকি রাহাদ ভাই!আমার কাছে তো সব ঠিকই আছে। বেশি বাড়াবাড়ি আপনি করছেন।কাল রাতে কি কি হয়েছে সেটা আমাকেই বুঝতে দিন।বেশি বাড়াবাড়ি কাকে বলে এবার বুঝবেন।’
রাহাদের কথায় আবারও মুচকি হাসি দিয়ে জবাবট দেয় মহুয়া।তারপর পা বাড়ায় বাড়ির দিকে।রাহাদ ওখানেই কিয়ৎক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। রাগে শরীর কাপছে তার।মহুয়া যেতে যেতে বলে উঠে, “আমার আরফাজ সাহেব আমারই আছে রাহাদ ভাই।আমার পরিবারকেও আমি বাচাবো, এই বাড়ির মানুষগুলোকেও বাচাবো।বেশি বাড়াবাড়ি করবেন তো আপনার পাপের সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে।আপনার নদীপথে মাদক ব্যবসা,জেলায় জেলায় ড্রাগস সাপ্লাই মাছের বাক্সের মাধ্যমে,গ্রামের মেয়েদের ধরে আপনার ডিলারদের মনোরঞ্জন করা সব বের করবো আমি।আরফাজ আপনার কাজে বাধা ছিলো বলে সরিয়ে দিতে আমায় ব্যবহার করেছেন।সবগুলো অপরাধের হিসাব তোলা রইলো।সময় মতো সব ধ্বংস হওয়ায় অপেক্ষায় থাকুন।আপনার গুণধর সহযোগীকে আগে খুজে পাই তারপর ধ্বংস করতে দুবার ভাববো না।” কথাটা শেষ হতে মহুয়া চোখের আড়াল হয় রাহাদের।
রাহাদ অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে।এই বোকাসোকা মেয়েটা এত চালাক হলো কবে।দাড়িয়ে দাড়িয়ে এটাই ভাবছে সে।
মহুয়া রুমে এসে বিছানার নিচ থেকে ফোনটা বের করে ফোন দেয় একজনের কাছে।ঐপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই থমথমে গলায় বলে উঠে,
‘মেয়েগুলো ঠিক আছে তো আপা।ওদের কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।ঘুম থেকে উঠার আগেই রুমে আটকে দিস।তারপর আমি আসি,রাহাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলাতে হবে ওদের।’
‘সব ঠিক আছে চিন্তার করিস না।আমি আর তোর দুলাভাই সামলে নিবো।’
মহুয়া জবাব পেতেই ফোন কেটে বিছানায় বসে পড়ে।মাথাটা চেপে ধরে দুহাত দিয়ে।রাতে একফোটা ঘুম হয়নি,একে টেনশন তার ভিতর নদীর ঠান্ডা বাতাস সব মিলিয়ে অবস্থা খারাপ আপাতত।ঘুম দরকার।লেপ টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মহুয়া।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ৮
#Tasfiya_Nur
অন্ধকার একটা গুদামঘরে চেয়ারে হাত পা বাধ অবস্থায় পরে আছে আরফাজ। মুখে কাপড় দিয়ে বাধা।হাতে পায়ে অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে তার।মোটা দড়ি দিয়ে বাধা অন্ধকারে বুঝতে না পারলেও সেটা বুঝতে পারছে সে। কারণ হাতের মাংসের মাঝে দড়িটা বসে যাচ্ছে এমন লাগছে আরফাজের।মুখ বাধা বিধায় চিল্লাতেও পারছেনা।বিকেল থেকে তার সাথে কি হলো সে নিজেও এখনও বুঝতে পারলো না।বিকেলে মার্কেটে গিয়েছিলো একটু টুকটাক নিজের জন্য কেনাকাটা করতে।আসার সময় বাসায় ঢুকতে একটা সরু রাস্তা দিয়ে আসতে হয়,সেই রাস্তায় বড়জোড় একটা প্রাইভেট কার ঢুকতে পারবে।রাস্তাটা বেশির ভাগ সময় নির্জন থাকে।আর কিডন্যাপার সেই সুযোগটা বুঝে আরফাজ বাসায় ফিরার সময় কয়েকটা গুন্ডা টাইপ লোক তার মুখে অজ্ঞান করার স্প্রে ছিটায়। তারপর তার সাথে কি হয়েছিলো জানা নেই আরফাজের।জ্ঞান আসার পর থেকে নিজেকে এমন আটকে বসে থাকা অবস্থায় দেখছে সে।চেয়ারে বাধা অবস্থায় বসে বসে বিকেলের ঘটনাই মনে করছিলো আরফাজ।এখন কয়টা বাজতে পারে তার ধারণা নেই।ক্ষুধায় অবস্থা খারাে তার।এমনিতে না খেয়ে থাকতে তার অভ্যাস আছে, কিন্তু এই মুহুর্তে এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে শরীরের শক্তিটা জরুরি।কিন্তু খাবার না পেলে খাবেই বা কি আর উঠে দাড়ানোর শক্তিই বা পাবে কোথায়।আরফাজের এসব আকাশ-কুসুম চিন্তার মাঝে গুদামঘরের দরজাটা হাট করে খোলায় শব্দ শুনতে পায় আরফাজ।ক্লান্তিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করে রেখেছিলো।কিন্তু দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকায় সে।দরজা দিয়ে এক চিলতে আলো ভিতরে প্রবেশ করে।অন্ধকারে এই হালকা আলোতেই আরফাজের চোখে ঝাপটা লাগে।অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারে থাকায় চোখে অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় হুট করে আলো পেয়ে চোখে সইলোনা তার।আবারও চোখটা বন্ধ করে নেয় আরফাজ।দরজা খুলে প্রবেশ করা ব্যক্তিটা আরফাজের কাছে এসে মুখে বাধা কাপটা খুলে দেয়।আরফাজ চকিতে চোখ মেলে তাকায়।চোখ মেলে তাকাতেই হাতে খাবারের প্লেট হাতে জিন্স-টপস,গলায় স্কার্ফ পেচানো, মাথায় ক্যাপ আর মুখে মাস্ক পড়া একটা মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় আরফাজ।শেষে কিনা একটা মেয়ে তাকে কিডন্যাপ করালো।আরফাজ মেয়েটার দিকে একনাগারে তাকিয়ে আছে।মেয়েটার বয়স কত হবে! ছাব্বিশ-সাতাশ।তা দেখে মেয়েটা শব্দ করে হেসে দেয়।তারপর মুখ ফুটে বলে উঠে,
‘আরফাজ শিকদার,নাও খাবারটা খেয়ে নাও।আমি কে বুঝার চেষ্টা করে লাভ নেই।আমি ধরা না দিলে ধরতে পারবেনা কেউ।’
💖💖
আরফাজ আশ্চর্য হয়ে শুধু তাকিয়েই আছে,কথা বলা যেন ভুলে গেছে। মেয়েটা হাতের ইশারা করে তার পিছনে দাড়ানো গার্ডকে আলোর সুইচ দিতে বলে।সে হাতের ইশারা দিতেই গুদামঘরটা আলোয় আলোকিত হয়।ঘরটা বিভিন্ন জিনিসের বস্তা দিয়ে ভরিয়ে রাখা।এসবের মাঝে একপাশে বিছানা সোফা আর ছোট্ট টেবিল রাখা।তাতে একটা ফল রাখার ঝুড়িতে আপেল,কমলা সহ আরও চারধরণের ফল পরে রয়েছে।তাতে ফলকাটার ছুড়িও রাখা। আরফাজ চারদিকে চোখ বুলিয়ে সামনে দাড়ানো মেয়েটার দিকে তাকায়।গলার স্বরটা তার চেনা চেনা লাগছে। মেয়েটার উচ্চতা,ওজন সব দেখে শুধু একজনের নামই তার মাথায় ঘুরছে।কিন্তু মুখ না দেখে কথাটা বলতে পারলোনা আরফাজ।মেয়েটা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে আরফাজের সামনে দাড়ায়।খবারের প্লেটে বিরিয়ানী দেখে চমকে উঠে সে।কেউ কিডন্যাপ করে এনে বিরিয়ানি খাওয়ায়!প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে আরফাজের।মেয়েটা হাত থেকে হাতের মোজা খুলে একজন গার্ডকে পানি এগিয়ে দেওয়ার আদেশ দেয়।আরফাজ কিছু না বলে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করতেছে,তাই চুপচাপ সে।গার্ডটা মেয়েটাকে পানির জগ আর গ্লাস এগিয়ে দিতেই মেয়েটা বিরিয়ানির প্লেটটা সাইডে রাখা আরেকটা চেয়ারে রেখে হাত ধুয়ে নেয় পানি দিয়ে।তারপর আবার প্লেটটা নিয়ে খাবার তুলে ধরে আরফাজের সামনে।আরফাজ অবাকের পর অবাক হয়েই যাচ্ছে।কিডন্যাপ করে এত আদর কেনো করছে!বুঝতে পারছেনা আরফাজ।তাই খাওয়া রেখে প্রশ্ন করে,
‘কিডন্যাপ করে এত আদর করে কেউ?কে আপনি পরিচয়টা দিন তো!’
‘বোকার মতো কাজ আমিও করছি,সাথে তুমিও করছো আরফাজ শিকদার।আমার বোকামি তোমায় আদর করে খাওয়াচ্ছি,আর তোমার বোকামি পরিচয় চাওয়া।পরিচয়ই দিবো কিডন্যাপ কেন করলাম?’
আরফাজ দমিয়ে যায় মেয়েটার কথায়।সত্যিই সেও তো বোকামি করছে।মেয়েটি কথা না বলে আবারও খাবার তুলে ধরে আরফাজের সামনে।আরফাজ থা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে।মেয়েটা খাওয়াতে খাওয়াতেই বলে উঠে,
‘তোমার বউ মহুয়ার কাছে আমাদের কাজের জন্য ব্যবহার করা মেয়েরা বন্দী আছে।তাদের ছেড়ে দিলেই তোমাকেও ছেড়ে দিবো।মহুয়া বিশ্বাসঘাতিনী জানো তো।আমাদের সাথে এককাজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তা সফল করেছে,তোমাকে তোমার পরিবার,ব্যবসা ছেড়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে সফল হয়েছে কিন্তু আমাদের চুক্তি অনুযায়ী এখনও শিকদার বাড়ি ছাড়েনি।তোমার পরিবারকে বাচাতে এখনও রয়ে গেছে সেখানে।এবার মহুয়া সহ তার পরিবার তো আছেই সাথে ওকে যে সাহায্য করছে তাকে খুজে বের করে মারবো।তুমি,তোমার পরিবার আমাদের আপনজন তাই এত আদর কিন্তু তোমাদের পথে বসাবো এটুকুই যা সমস্যা। তুমি মহুয়ার প্রাণভোমরা তাই তোমাকেই আটকে দিলাম আমাদের খাচায়।চিন্তা কইরোনা,সময় হলে মুক্তি পাবে।এখন ঘুমাও যাও।খাবার তো খাওয়ালামই।’
কথাটা বলতে বলতে আরফাজকে খাওয়ানো শেষ করে মেয়েটা।আরফাজ শুধু হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কি বলছে এই মেয়ে কিছুই বুঝতেছেনা সে।মেয়েটা ততক্ষণে হাত ধুয়ে প্লেট, জগ, গ্লাস দাড়িয়ে থাকা গার্ডকে দিয়ে আরফাজের মুখ পুনরায় বেধে দেয়।তারপর চেয়ারের সাথে আরফাজের বাধন খুলতে খুলতে বলতে থাকে,
‘মনে আছে রাহাদের মাদক ব্যবসার কথা।শহরে শহরে নদীপথে মাছের ব্যবসার সাথে ড্রাগস,হিরোইন,ইয়াবা সাপ্লাইয়ের কথা।অন্য দেশ থেকে এসব আমদানি করে আনতে গিয়ে ধরা পড়েছিলো তোমার কাছে।কারণ তুমি আর রাহাদ তো একসাথে নৌকা,জাল দিয়ে নদী থেকে লোক লাগিয়ে মাছ ধরে মাছের আরদ খুলে মাছের ব্যবসা করতে শেয়ারে। তোমাদের ব্যবসা আলাদা আলাদা ছিলো কিন্তু রাহাদের সাথে রিঠির বিয়ে হতেই তুমি প্রস্তাব দাও একসাথে করার।নতুন জামাই মুখ ফুটে মানাও করতে পারেনি।তাই ধরা পড়ে যায় তোমার কাছে।তুমি ওকে জেলে পাঠানোর কথা বলছিলে।রাহাদ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। তুমি হলে আপন মানুষে ভালো রুপে ভোলা মানুষ।যা বুঝালো তাই বুঝলে,চিন্তা করলে না কুত্তার লেজ সোজা হয়না।সেই রাহাদ মহুয়াকে লাগিয়ে তোমাকে ভালোবাসার ফাদে ফেলে মরার পথে এগিয়ে দিয়েছে। কারণ ভালোবাসা তো মরণফাদ বলো।’
আরফাজ আজ একটার পর ধাক্কা খাচ্ছে যেন।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।তারমানে মহুয়া রাহাদের কথায় তাকে বিষাক্ত কথা বলতো মরতে বলতো।কারণ ভালোবাসার মানুষের মুখে মরার কথা শুনলে এমনিই মানুষ আধামরা হয়।ভাবতে পারলে না আরফাজ।তার আগেই মেয়েটা আরফাজকে হাত,পা,মুখ বাধা অবস্থায় চেয়ার ছেড়ে গার্ডের সাহায্যে তুলে এনে বিছানায় ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল দিয়ে দেয়।তারপর বলে উঠে,
‘অতীত ভেবোনা আরফাজ।অতীতটা জঘন্য, রাহাদ ওর ব্যবসা আরও বড় করেছে।তার ঘুটি হিসেবে আমি ওর হাতের পুতুল হয়ে গেছি।তোমার চোখে ঘমণিত হবার ভয়ে পরিচয়টা লুকা লাম। যখন সময় হবে তখন না হয় ঘৃণা কইরো।আর হ্যা তোমার বোন তোমার জন্য চিন্তা করবেনা,তোমার ফোন থেকে টেক্সট করে দিয়েছি।আরাম মতো ঘুমাও।রাত একটা প্রায় বাজে।গুড নাইট।’
কথাটা বলেই মেয়েটা আবারও দরজা আটকে চলে যায়।আরফাজ বিছানায় শুয়ে বাকরুদ্ধের ন্যায় পড়ে আছে। এসব কি জানলো সে আজ।বুকের মধ্যে চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে তার।এই যন্ত্রণার উপশম কি?মহুয়াকে বড্ড মনে পড়ছে আরফাজে।ইশ আর একবার যদি জড়িয়ে ধরতে পারতো!চোখের পাতায় মহুয়ার মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো আরফাজের।চোখ বন্ধ করে নেয় আরফাজ।
💖💖
মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিছানায় উঠে বসে জান্নাত।হঠাৎই পানি তেষ্টা পাওয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেলো তার।এই শীতের রাতে পানি তেষ্টা পাওয়া কি যে বিরক্ত লাগছে জান্নাতের।বেড সাইড টেবিলে রাখা ফোন নিয়ে ফ্ল্যাশ ওন করে।জগের পানি ঠান্ডা বরফ দেখে বিছানা ছেড়ে নেমে আলনা থেকে গায়ের শালটা নিয়ে আরমানের দিকে তাকায় এক পলক।কম্বল মুড়িয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে আরমান।পরশু আরমানকে ঢাকায় ব্যাক করতে হবে।তাই আজ বৌভাত শেষে জান্নাতের বাবার বাড়িতে যাওয়ার নিয়ম থাকা সত্বেও আরমান সাত-পাঁচ বুঝিয়ে যায়নি।জান্নাত অবশ্য এতে একটু খুশিই হয়েছে। পরিবারের উপর চাপা অভিমান জমেছে তার।এতই বোঝা হয়েছিলো সে।দরজার কাছে দাড়িয়ে আরমানের মুখপানে তাকিয়ে এসব ভাবছিলো জান্নাত।পরে আস্তে করে দরজাটা খুলে বাইরে কলপাড়ের দিকে পা বাড়ায় সে।রান্নাঘর থেকে একটা গ্লাস নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে কল চেপে পানি খেয়ে বারান্দায় উঠে রুমে যাওয়ার জন্য। বৌভাত হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন নেই বললেই চলে।শুধু তার মামী শ্বাশুড়িরা আছে, এজন্যই অনেকে বারান্দায় খড় পেরে ঢালা বিছানা করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।জান্নাত বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো মহুয়ার রুমের জানালা খোলা।মহুয়ার রুম ক্রস করে তার রুমে যেতে হয় বলে আগ্রহবশত মহুয়ার রুমে উকি দেয় জান্নাত। বাড়িতে এত মানুষ, থাকার জায়গার অভাব অথচ কেউ মহুয়া একা থাকা সত্বেও কেউ ওর সাথে থাকেনা।সবাই ওকে অপমান করে,কিন্তু কেনো করে এসব!এগুলোর ব্যাপারে জানতেই মূলত আগ্রহ বশত উকি দেয় জান্নাত।কিন্তু এই রাতের দেড়টায় মহুয়াকে বিছানায় বসে ল্যাপটপ টিপতে দেখে আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা জান্নাতের।মেয়েটা ছোটো,যতটুকু শুনেছে তারমাঝে তার পড়ালেখা নেই বেশিদূর। তাহলে ল্যাপটপে করার মতো কাজও নিশ্চয় মহুয়ার নেই।তাহলে ল্যাপটপ ইউজ করছে যে।তার থেকে বড় কথা ল্যাপটপটা পেলো কোথায়?’
একসাথে এত গুলো সব চিন্তা জান্নাতের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশি চিন্তা নিতে পারেনা সে।জানালা ছেড়ে মহুয়ার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে দরজায় টোকা দেয়।
এতরাতে দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনে ভয় পায় মহুয়া।তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপটা ট্র্যাঙ্কে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজার কাছে দাড়িয়ে জিগাসা করে,
‘কে এতরাতে আমার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে টোকা দিচ্ছে?’
‘ভাবী আমি জান্নাত। দরজাটা খুলো,একটু দরকার ছিলো।’
এতরাতে জান্নাতের গলার স্বর শুনে চমকে যায় মহুয়া।জান্নাত কেনো তাকে এতরাতে ডাকছে?নতুন কোনো ঝামেলা হলো নাকি?এসব ভাবতে ভাবতেই রুমের আলো জালিয়ে কাপা হাতে দরজাটা খুলে দেয় মহুয়া।জান্নাত মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে দরজার সামনে।মহুয়া ভীতু গলায় জিগাসা করে,
‘এতরাতে জেগে আছো যে?কিছু দরকার জান্নাত আপু?’
বয়সে বড় বলে মহুয়া জান্নাতকে আপু বলে ডাকা শুরু করছে।মহুয়ার প্রশ্ন শুনে জান্নাত দায়সারা ভাবে উত্তর দেয়
‘ল্যাপটপে তোমার কি কাজ ভাবী?কোথায় লুকালে ওটা?’
জান্নাতের কথায় মুখটা থমথমে হয়ে যায় মহুয়ার।তবে কি সে বাড়ির সবার সামনে ধরা পড়ে যাবে এত তাড়াতাড়ি যে, সে যেমন বোকা হয়ে থাকে,অথচ সে অতটা বোকা না!কথাটা মাথার ভিতর ভনভন করতেছে মহুয়ার।জান্নাত দরজায় দাড়িয়ে মহুয়ার মুখপানে জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে।
চলবে?
।)