#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১৫
#Tasfiya_Nur
সকালে ঘুম ভেঙে জান্নাতকে নিজের বুকে পেয়ে হাসি ফুটে ওঠে আরমানের। জান্নাত তার একহাতের উপর মাথা দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে অন্য হাত নিজের উপর দিয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে।আরমান জান্নাতর মাথা বালিশে রেখে হাতটা বের করে নেয়। পাশ ফিরে বেড সাইড টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে সময়টা দেখে নেয়।সকাল দশটা বেজে আসছে অথচ ওদের কেউ ডাকেনি।এটা ভেবেই অবাক হলো আরমান।জান্নাতকে মৃদু স্বরে ডাক দেয়।জান্নাত আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। তা দেখে আরমান হালকা ধাক্কা দিতে দিতে ডাকে।জান্নাত আরমানের এহেন কাজে দুম করে উঠে বসে।তারপর মাথাটা চেপে ধরে রাগী চোখে আরমানের দিকে তাকায়।আরমান একহাত নিজের মাথার নিচে দিয়ে তখনও শুয়ে ছিলো।জান্নাত তাকাতেই ভ্রু কুচকায় সে।জান্নাত রেগে বেড সাইড টেবিল থেকে পানির জগ থেকে পানি নিয়ে আরমানের মুখে ছুড়ে বিছানা থেকে নেমে দেয় দৌড়।আরমান হুট করে এমন হওয়ায় বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে জান্নাতের দিকে।জান্নাত ততক্ষণে দরজা খুলে বাইরে চলে যায়।আরমান বিছানা ছেড়ে উঠে।ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে কাধে টাওয়াল ঝুলিয়ে ব্রাশ করতে করতে বাইরে চলে যায়।বারান্দায় বেরুতেই দেখে জান্নাত বাড়ির বাকি বউঝির সাথে গল্প করছে আর ব্রাশ করছে।বাকিরা শীতকালের পিঠা বানাতে ধানের আটা তৈরির জন্য আলো চাল(রোদে শুকানো সিদ্ধ ছাড়া ধানের চাল)ধুচ্ছে আর সেগুলোয় ছোটো ছিদ্রের ডালায় তুলে পানি ঝড়াতে দিচ্ছে।নাজমা বেগম তাড়া দিচ্ছে সবাইকে।আরফাজ নাকি সকালে বাড়িতে বলে দিয়েছে আগামিকাল বাড়িতে নবান্নের পিঠাপুলির উৎসব হবে। যত আত্মীয় স্বজন আছে সবাইকে দাওয়াত করা হবে।এই কথায় বাড়ির সবার মুখে মুখে। আরমানের পিঠে কারোর ছোয়া পেয়ে পিছন ফিরে তাকায়। আরফাজকে হাসিমুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সেও হাসে।বাড়ির সবার মুখে হাসি যেন লেগেই আছে।আরফাজ আরমানকে বলে উঠে,
‘বউ পেয়ে উঠতে ইচ্ছে করেনা তাইনা ভাই?’
আরমান বড় ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনে লজ্জা পাওয়ার অবস্থা।শতহোক বড় ভাই তো।আরফাজ আরমানকে মিইয়ে যেতে দেখে জোড়ে হেসে ফেলে।তারপর বলে,
‘ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই বুঝছিস।যা ফ্রেশ হয়ে নে।মহুয়া খাবার সার্ভ করে দিয়েছে টেবিলে।মা তোদের ডাকতে চেয়েছিলো আমার ডাকতে দেইনি।’
‘বাহ মহু ভাবী কি করে সব খবর রাখো দেখছি!’
ভাইকে কথাটা বলেই আরমান কেটে পরে ওখান থেকে।আরফাজ ‘থ’ মেরে দাড়িয়ে রয়।শেষ অব্দি ছোটো ভাই তাকে লজ্জায় ফেললো।নিজের পাতা ফাদে নিজেই পড়লো।আরফাজ মাথা চুলকে সেখান থেকে। মহুয়া রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে দুভাইয়ের মজা করা দেখছিলো।ইশ সব যদি এমন ঠিক থাকতো কিন্তু কাল যে কি হবে! ভাবতেই বুক কেপে উঠে মহুয়ার।মহিমার সাথে কথা হয়েছে তার।শাহদিয়াত সহ মহুয়াও আসবে সেদিন এটা কেউই জানেনা।আরফাজ শুধু তাকেই বলেছে।রাহাদকে বলা হয়েছে মহিমারা রাহাদের মেয়েদের ফেরত দিয়ে ওরা চলে গিয়েছে ওদের ঠিকানায়।কিন্তু এসবের পিছনে আসল কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিটা যখন সামনে আসবে কি হবে ভাবতেই শরীর কেপে উঠে মহুয়ার।রিঠীর যে কি হবে এত চিন্তা ভালো লাগে না আর মহুয়ার।জান্নাত এসে মহুয়ার কাধে হাত রাখলে মহুয়ায় চিন্তা বাদ দিয়ে হাসিমুখে তাকায় তার দিকে।জান্নাত মুখ ফস্কে বলে উঠে,
‘তা বড় জা ভাসুরের সাথে রাতে রোমান্স কেমন হলো?’
‘বড় জা হই এটা একটু মানো।কি সব বলো এগুলো?’
‘হয়ে গেলো ফরমালিটি রাখো।আমি বড় বোন হই একহিসেবে হুহ।’
‘তা বড় বোন কি ছোটো বোনদের এমনে বলে।এতক্ষণ বড় ভাই তার ছোটো ভাইকে খোচালো, এখন বড় বোন আসছে ছোটো বোনরে খোচাতে।’
‘মানে কি?’
‘আরফাজ আরমান ভাইয়াকে খোচালো।আর তুমি এসে আমায়।সমান সমান হয়ে গেলো।খাবে এসো,আমার দেবরের আদর খেয়ে তো আর পেট ভরবেনা।ভাত খেতে হবে।এসো বলছি।
কথাগুলো ঝাড়ি মেরে বলে মহুয়া খাবার টেবিলের দিকে পা বাড়ায়।জান্নাত পুরো ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে মহুয়ার পিছন পিছন ছুট লাগায়।আরফাজ আর আরমানকে খাবার টেবিলে দেখে কিছু বলেনা।চুপচাপ খেতে বসে।নাজমা বেগম আর মনিরা বেগম বাইর উঠোনে সিদ্ধ ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে সেগুলোয় নজর রাখছেন।
💞💞
শান্তনা বেগম তার পুত্রবধূ সায়রাকে নিয়ে এসেছে আরিফুল শিকদার দাওয়া করে আসায়।আরিফুল শিকদার আর সাইফুল শিকদার দুই ভাই পাশাপাশি বাড়ি হলেও আলাদা সংসার বলে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রতিদিন মুখোমুখি হলেও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা দাওয়াত করলেই হয়।আর আরফাজ শিখাকে পালাতে সাহায্য করেছিলো এটা সবাই জানার দুবাড়ির মাঝখানে মেলামেশা কমই হয়ে গিয়েছিলো।সমস্যাটা যেখানে আরফাজ করেছিলো সেই সমস্যা আরফাজ নিজেই মিটিয়ে নিয়েছে।নিজে ফিরার সাথে সাথে জেঠু-জেঠিকে বুঝিয়ে শিখা আর রিহানকে মন থেকে মেনে নেওয়ায়ছে।শিখা রিহান বর্তমানে বাচ্চাটাকে নিয়ে শিখার বাবার বাসায় নিজের রুমে আছে।রিহানের মা রিহানের চাচার বাসায় বিকালে শিখা আর রিহান গিয়ে আমবে।নারকেল কুড়ানো হচ্ছে। রাতে দুধচিতই পিঠা,পাটিসাপ্টা,দুধপুলি আরও হরেক রকম গ্রাম্য পিঠা বানানো হবে।তাতে নারকেল লাগেই।তাই নারকেল কুড়ানো হচ্ছিলো আর সসেখানে বসে শান্তনা বেগম বাকি মহিলার সাথে এসব গল্পই করছিলেন।পাশে আরও মহিলারা ঢেকিতে আটা বানছিলো।
দুপুরের রান্না করতে হবে বলে মহুয়ায় গোসল সেড়ে নিতে যায়।
জান্নাত, আরমান,আরফাজ আরমানের রুমে বসে আরমানকে সব ঘটনা খুলে বলে। আরমান এতকিছুর কিছুই জানতোনা সে।তাই জানিয়ে সব প্রমান আরমানের সামনে সাজাচ্ছে।রাহাদের সাথে সকালে দেখা করে কথা বলেছে আরফাজ।সব প্রমান তুলে দিয়েছে রাহাদকে বিশ্বাস করাতে কিন্তু জান্নাতের কাছে যেগুলো রাখা ছিলো সেগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে আরফাজ।আরমান তো তব্দা মেরে বসে আছে এসব শুনে।মহুয়াকে এতদিন শুধু শুধু দোষারোপ করে কারণে অকারণে কথা শুনিয়েছে আরমান নিজেও।আফসোস হচ্ছে যদি একটু খতিয়ে দেখতো তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও সত্যি জানতো সে।জান্নাত সবটা জানে এটা রাহাদ জানেনা।জান্নাত পরিবারে নতুন সদস্য তাই তার উপর সন্দেহের তীরটা আসেনি রাহাদের। আর আরফাজ সব প্রমানের একটা করে কপি জান্নাতের কাছে রেখে রাহাদকে মূল প্রমান দিয়েছে আর মহিমা তো রাতেই মেয়েগুলোকে রাহাদের হাতে হস্তান্তর করেছে।আর সেগুলো রাহাদ তাদের সামনেই রাহিবকে দিয়েছে।আর রাহিব তো মহুয়ারই লোক তাই ততটা প্রেশার কেউ নিচ্ছেনা আপাতত।
💙💙
‘তোমার জন্য পাপের কর্ম করতে করতে আমার জীবনটা শেষ মিঃ সারিফ হোসেন।আপনার শত্রুতার সূত্রপাত ঘটেছিলো সেই বাইশ বছর আগে। আর আপনি আমায় ঘুটি করে আপনার শত্রুর ধ্বংস দেখতে আমার জীবনটাই ধ্বংস করে দিলেন।’
‘সাট আপ রাহাদ।ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার বাবা। সম্মান দিতে শিখো। ‘
‘বাবা মাই ফুট মিঃ সারিফ হোসেন ।আপনি সেই বাবা যে সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি বা নিজের ব্যবসায় না ঢুকিয়ে ব্যবসার নামে মানুষের ক্ষতি করা শিখিয়েছে। ইভেন এখনও সেই কাজ চলছে।আপনি কোন জন্মে আরিফুল শিকদারের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন আপনার ছাত্রজীবনে সেই অপমানের জের ধরে আপনি আমাকে আরফাজের সাথে লাগিয়ে রাখতেন।ওর মনে জায়গা করিয়ে নিয়ে ওর বোন বাচ্চা একটা মেয়ে তাকে বিয়ে করালেন।দ্যান কি হলো আরফাজের মতো ভালো একজন মানুষকে মারার কথা বলে এতকিছু ঘটালেন এখন আবার তাদের সম্পত্তি দখল করাতে উঠে পরে লেগেছেন।আপনি বাবা নাকি বাবা জাতির কলঙ্ক। ‘
‘জাস্ট সাট আপ রাহাদ।চুপ করো তুমি চুপ করো।নয়তো মনে আছে তোমার মা।তাকে কি করবো তুমি জানো তো।’
‘হ্যা যে নিজের স্ত্রীকে খুন করতে সবসময় লোক লাগিয়ে রাখতে পারে তার সন্তানের প্রতি আর কত কেয়ার থাকবে বলুন।আপনার মতো স্বার্থপর মানুষ হয়না জানেন। ‘
‘হ্যা আমি স্বার্থপর রাহাদ।আমি স্বার্থপর।কোনটাকে সাধারণ অপমান বলছো তুমি?আমি আরিফুলের বোনকে ভালোবেসেছিলাম আর আমার বাবা গরীব কৃষক ছিলো বলে সাধারণ ঘরে বিয়ে দিতে চায়নি।ওর বোনটাও আমাকে ভালোবাসতো বলে কলেজ লাইফে ঐ নাজমা বেগমের সাথে ষড়যন্ত্র করে আমাকে ওর বোন ববিতার সামনে অশ্লীলতার দায়ে খারাপ বানিয়ে জেলে অব্দি পাঠিয়েছে। অভিযোগ ছিলো আমি নাজমা বেগমকে নাকি রেইপ করতে গিয়েছিলাম।গরীব বাবার সন্তান বলে ওদের মিথ্যা অভিযোগের দায়ে জেল খেটেছি।আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায় সেখানেই।বাবার স্বপ্ন ছিলো আমায় একজন শিক্ষক বানাবে।অথচ জেলখানায় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে পরিচয় হয়ে কি থেকে কি হয়েছি।সবকিছুর পিছনে ঐ আরিফুল শিকদার আছে।আমার সাজানো গোছানো জীবনে কালবৈশাখীর ঝড় তুলে দিয়েছিলো ওরা দুভাই।ওদের জীবনটাও ছাড়খার না করে ছাড়বোনা।সাইফুল শিকদার মিথ্যা সাক্ষী জোগার করেছিলো বলে ওর মেয়েকে ছাড় দেইনি।জেল থেকে ছাড় পেয়ে ঐ সাক্ষীদের থেকে জেনেছি সব।এবার ওদের ক্ষমতাটা গেলে বুঝতে পারবে টাকা না থাকলে কতটা অসহায় লাগে। কষ্ট লাগে বাপ।ভালোবাসা মরণের বিষ।বৌমাকে ভালোবাসলে সেটা আর বাড়াস না, আরিফুলের শিকদারকে মেয়ের কষ্টটা উপলব্ধি করিয়ে বুঝাবো ভালোবাসা হারালে কষ্ট লাগে।গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়ে নাজমা আরিফুল নিজের কাজে ওকে ব্যবহার করে নাজমার জীবনটাও শেষ করে দিয়েছে।’
রাহাদ তার বাবার কথা শুনে থমকে যায়।তার বাবার অতীতটাও এতটা জঘন্য। আসলেই খারাপ হওয়ার পিছনে কিছু কিছু থাকেই।কেউ যেচে খারাপ হতে যায়না।রাহাদের এসব ভাবনার মাঝে সারিফ হোসেন আবারও বলে উঠেন,
‘অনেক কষ্টে আরিফুল শিকদারের কাছে নিজেকে ভালো হিসেবে প্রকাশ করেছি।তারপর রিঠীকে তোর হাতে দিয়েছে।এখন বাবা তুই আমার অপমানের বদলা নিবি। বাবা হিসেবে এটাই আমার শেষ দাবী তোর কাছে।আদেশও বলতে পারিস। ‘
সারিফ হোসেন কথাগুলো বলে রাহাদের লঞ্চ থেকে চলে যান।উনি এসেছিলেন ছেলের হাত থেকে প্রমান নিয়ে যেতে।তখনই বাবা ছেলের কথোপকথন হয়।রাহাদ বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহিবকে ডাক দেয়।নতুন করে আজ ড্রাগস সাপ্লাই হবে সেগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়।আসলেই টাকার উপর কিছু হয়না।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১৬
#Tasfiya_Nur
উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যস্ত হয়ে উঠছে শিকদার বাড়ির প্রতিটা সদস্য। আজমল শিকদার আর আরিফুল শিকদার অসুস্থ অবস্থায় বারান্দায় বসে সবার আনন্দঘন মুহুর্ত গুলো উপভোগ করছেন।তাদের সাথে বসে আছে সারিফ হোসেন আর
টুকটাক গল্প চলছে তাদের মাঝে।সাইফুল শিকদার সবকিছুতে উপস্থিত থাকলেও উনি বাজারে তাদের সারের দোকানে গিয়েছেন।সকালবেলায় সবাইকে দুধচিতই পিঠা,দুধপুলি খাওয়ানো হয়েছে। এখন সময়টা বিকেল। নাজমা বেগম,শান্তনা বেগম,ববিতা বেগম আর রেহানা বেগম রিঠীর শ্বাশুড়ি বাড়ির উঠোনে বসে তরকারি কাটছে।রাতের খাবার রান্না করা হবে।মহুয়া আর জান্নাত মিলে সন্ধ্যার খাবার রেডি করতেছে।আরফাজ,আরমান,সাইফ সোহান,সাদিক, রিহান,রাহাদ বারান্দায় বসে গল্প করছে।রাহাদের এসবে মনোযোগ নেই।তার দৃষ্টি রান্নাঘরের দরজার ফাক গলিয়ে মহুয়ার প্রতি।তার মনের মধ্যে ফাকাফাকা লাগছে আজ।যদি এসব পাপ পথে না আসলে সে হয়তো মহুয়াকে বিয়ে করে নিয়ে সংসার করতে পারতো।আজ এতগুলো বছর পর মনিরা বেগমের মুখে তৃপ্তির হাসি। তার একমাত্র মেয়ে ববিতা বেগম তার সাথে তার দুই ছেলে সোহান আর সাদিক নিয়ে শিকদার বাড়িতে পা দিয়েছেন। আরফাজ গিয়ে পায়ে ধরে অনুরোধ করে এনেছে সে তার ফুফুকে।জোড় করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়েছিলো বলে সে বিয়ের পর আর আসেনি বাপের বাড়ি।আর আজ এসেও সেই অতীতেরই মুখোমুখি হয়ে একটু অসস্তি হচ্ছে এটা বুঝতে পারছে মনিরা বেগম।আজমল শিকদারের পাশে বসে সবার হাসিমুখ দেখে যাচ্ছিলো মনিরা বেগম।মেয়েকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই উনার।রিঠীও দাদীর পাশে বসে ভাপা পিঠা ছিলো সেগুলো খাচ্ছিলো।সবার ভীরে শিখাকে কোথাও না দেখে কপালে চিন্তার ভাজ পরলো মনিরা বেগমের।তার চিন্তার মাঝে উঠোনের গেটে শিখাকে পুলিশে সহ উপস্থিত হতে দেখে হতভম্ব হয়ে তাকান উনি।উনি হন্তদন্ত হয়ে উঠে শিখার উদ্দেশ্যে বলে উঠেন,
‘একি শিখা তুই পুলিশ রে বাড়িতে আনলি ক্যা রে?পাগল হইছোসনি?বাড়িতে এত মানুষ আর তুই পুলিশ আনলি যে?’
মনিরা বেগমের কথায় সবাই অবাক হয়ে গেটের দিকে তাকায়।সবাই একই প্রশ্ন নিয়ে হইচই শুরু করে।রাহাদ রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আরফাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।আরফাজের ঠোটে বাকা হাসি।আরমান বড় ভাইয়ের দিকে একবার তাকাচ্ছে তো একবার শিখার দিকে।তারা তো প্ল্যান করেছিলো সব মিটে গেলে পুলিশকে ইনফর্ম করবে।কিন্তু এসব কি হচ্ছে মাথায় ঢুকছেনা আরমানের।জান্নাত আর মহুয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। গেটের সামনে শিখাকে পুলিশসহ দেখে মহুয়ার আত্মায় ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায়।জান্নাত হা হয়ে তাকিয়ে সব দেখছে।বাড়িতে আজ ঝামেলা হবে বলেই কি আরফাজ তাকে আরমানকে সাথে নিয়ে মহুয়ার বাবা -মা, ভাই,মহিমা আর শাহদিয়াতকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে যেতে বলছিলো যেন এখানে কিছু হলে তাদের উপর কোনো বিপদের আচর না আসে!রাহাদ যেন কাউকে নিজের কাছে বন্দী করে ভয় দেখাতে না পারে সেজন্যেই কি তাদের পাঠাতে চেয়েছিলো কাল বিকেলে!প্রশ্নে প্রশ্নে মাথায় চিন্তা গিজগিজ করছে জান্নাতের।সে তো সবাইকে তার বাবার বাসায় রেখে আরমানকে সাথে নিয়ে সকালে ফিরে এসেছে।বাড়িতে এত আনন্দ তার মন টিকছিলোনা সেখানে।যেতেও তো চায়নি কিন্তু আরফাজ জোড় করে পাঠিয়েছিলো।বাড়ির কেউ রাজীও ছিলোনা কিন্তু সবাইকে তোর্ষা আর সুজন তালুকদার সহ সবাইকে আনতে ওদের পাঠাচ্ছে এটা বলে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়।পরে নিজেই রাতে ফোন দিয়ে আসতে মানা করে। আরফাজ সব বলতে চেয়েও যে বলেনি। মূলত সুযেগ হয়নি বলার বাড়িতে এত মানুষ থাকায় সাথে কাজ তো আছেই। জান্নাতের সাথে বাকিরা যাচ্ছে এটা শিকদার বাড়ির কেউ জানতোনা।ওনাদের বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলো ওরা।তবে আরফাজের কথার অবাধ্য হয়ে ফিরে এসে আরমানের বিপদ বাড়ালো নাকি সে!চিন্তা করেও বুঝতে পারলোনা জান্নাত।তার এসব ভাবনা চিন্তার অন্ত ঘটে রাহাদের চিল্লাচিল্লিতে।রাহাদ পুলিশকে দেখে তার নিজের সেট করা লোকদের চিল্লিয়ে ডাকছে।রাহাদ চিল্লিয়ে ওর লোক ডাকছে তাদের আদেশ দিচ্ছে সবাইকে মারতে।তারা লাঠি দিয়ে আক্রমণ করতে আসলে পুলিশ সবাইকে আটকাতে গোলাগুলি শুরু করে।আরফাজ আর সাইফও উঠোনে ওদের আটকাতে নেমে পরেছে।মহুয়া স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে তার পাশেই।সে মহুয়াকে হ্যাচকা টানে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে নজর রাখে।আরমান বাড়ির বড়দের একসাইডে ডেকে রুমে ঢুকতে বলে।কিন্তু আজমল শিকদার সবাইকে ধমকে বলে উঠে,
‘তোমরা খোলাশা করবে সব একটু।শিখা পুলিশ আনলো।তা দেখে রাহাদ কেনো চিল্লিয়ে বাড়িতে মানুষ ঢুকালো।তারা কেনো এভাবে আক্রমণ করছে আমাগো উপরে?’
আজমল শিকদারের ধমকে তার দিকে লক্ষ্য করে তাকায় সবাই। রাহাদ মারামারির এক পর্যায়ে তার লোকদের থামতে বলে।বারান্দায় ধপ করে বসে হো হো করে জোড়ে হেসে দেয়।সবাই অবাক হয়ে রাহাদকে দেখে যাচ্ছে।সারিফ হোসেন তার ছেলের এমন ব্যাবহারে স্তম্ভিত হয়ে যায়।বাড়িতে উপস্থিত সবার লক্ষ্য রাহাদের উপর।রাহাদ হাসি থামিয়ে বলে উঠে,
‘কি আরফাজ শিকদার!এত চালাকি?শেষ অব্দি সবার সামনে আমার মুখোশ খুলতে এত উঠে পরে লেগেছো।প্ল্যান ভালো ছিলো তোমার। কিন্তু কি বলো তো আমিও রাহাদ হোসেন এতটা বোকা না যে তোমার সব কথা চোখ বুজে বিশ্বাস করে নেবো।অপেক্ষা করো ধামাকা পাবে।পুরো বাড়ি পুলিশ দিয়ে ঘিরিয়ে দিয়েছো।পুলিশকে মেরে এই শিকদার পরিবার ধ্বংস করে আমার বাবার অপমানের বদলা নিয়ে এই বাড়ি ছাড়বো। এটা এই রাহাদ হোসেনের প্রমিজ।তা বাড়ির সবাইকে বলো আমার গুণকীর্তন। সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা।’
আজমল শিকদার ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে আরফাজের দিকে তাকায়।সবার দৃষ্টি আরফাজের দিকে ঘুরে যায়।মহুয়া জান্নাতকে সরিয়ে দরজা খুলে বাইরে আসে।আজমল শিকদার সবার দিকে নজর বুলিয়ে আরফাজকে ধমকের সুরে বলে উঠে,
‘কি হয়ছে এবার একটু খোলশা করো।সবার চিন্তায় তো পরাণ যাওয়ার অবস্থা।’
ততক্ষণে গ্রামের মানুষেরও হুমড়ি খেয়ে বাড়ির ভিতরে আসা শুরু হয়ে গেছে। আরফাজ উঠোনের ফটক বন্ধ করে দিয়ে নিজের দাদুর সামনে দাড়ায়।একে একে রাহাদের করা সব অন্যায়ের কথা বলতে থাকে। সবাই সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে বসে পরে বারান্দায়।পুলিশ ততক্ষণে সবার কোমড়ে দড়ি বেধে ফেলছে।আর শিখা সে আরফাজের রুমে ঢুকে নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে।আরমানকে ঘর থেকে সব প্রমাণ আনতে বলে আরফাজ।আরমান ল্যাপটপ সহ সব প্রমাণ আনলে একটা একটা সবাইকে সবটা দেখানো হয়।রাহাদ আর সারিফ হোসেন বারান্দায় বসে দেখছে সব।পুলিশ রাহাদকে ধরতে আসলে সে সময় চেয়ে বসে আছে।আরিফুল শিকদার সবটা দেখে রাহাদের সামনে এসে দাড়িয়ে জিগাসা করে বসে,
‘এমন কেনো করলে রাহাদ?আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট কেনো করলে?আমার মেয়েটা তো নির্দোষ ছিলো!’
‘এখনও বুঝতে বাকি আছে কেনো করেছি এসব?মিঃ আরিফুল শিকদার আমার বাবাও তো নির্দোষ ছিলো তাইনা?’
রাহাদের উত্তরে নাজমা বেগম আর আরিফুল শিকদারের মুখটা চুপসে যায়।নিজেদের অতীতে করা অন্যায়ের পাতাটা ভেসে উঠে চোখের সামনে।আরফাজ,আরমান,মহুয়া,জান্নাত, রিঠীসহ উপস্থিত বাকিরা রাহাদের কথার মানে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাড়িয়ে রয়।মনিরা বেগম নিজের মেয়েকে জড়িয়ে বারান্দার এককোণে দাড়িয়ে ছিলো। তিনি এগিয়ে এসে রাহাদকে জিগাসা করে,
‘একটু খোলশা করবা নাতজামাই?আমরা বুঝবার পারতেছি না।’
রাহাদ অসভ্যের মতো হেসে একটা একটা করে আরিফুল শিকদার, নাজমা বেগম আর সাইফুল শিকদারের করা অন্যায়ের কথা বলতে শুরু করে।রেহানা বেগম নিজের স্বামী সম্তানের পাপের কর্ম শুনে এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। কিন্তু রাহাদের মুখে সব শুনে এবার চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে।ববিতা বেগম নিজের ভাইদের কীর্তি শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। আরফাজ,আরমান ওরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নিজেদের বাবা মায়ের দিকে তাকায়।তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের মা-বাবা এমন কিছু করেছে।আরফাজ নিজের বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠে,
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা বাবা তুমি এমন কিছু করেছো।একবার বলো বাবা এসব মিথ্যা!’
আরমানও এগিয়ে এসে তাল মিলায় আরফাজের সাথে।মহুয়া আর জান্নাতও বিস্ফোরিত চাহনীতে তাকিয়ে সবটা দেখছে।শান্তনা বেগম,সাইফও কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেছে এসব কাহীনি শুনে।তার মেয়ে এসবে যুক্ত।সাইফুল শিকদারের পাপের শাস্তি তার মেয়েটা পাবে।শান্তনা বেগম দৌড়ে নিজের মেয়ের কাছে যায়।শিখা তার ছেলেকে বসে ছিলো। তিনি গিয়ে নাতী আর মেয়েকে ধরে কেদে দেন।শিখা হাসে তা দেখে।কি-ই বা আর হবে জেল হাজত। তার ছেলেকে মায়ের হাতে তুলে দেয়।দেখে রাখতে বলে।আজ তার শ্বাশুড়ি আসেনি।অসুস্থ মানুষ বেশি মানুষের মাঝে থাকতে পারেনা বলে আসেনি।তার চাচাশ্বশুরের বাড়িতেই থেকে গেছে।শিখা তার মাকে বুঝিয়ে বাইরে এসে দাড়ায়।পুলিশের সামনে এসে দাড়ায়।ওকে গ্রেফতার করতে বলে।সবার দৃষ্টি এতক্ষণ রাহাদ আর ওর বাবা,আরিফুল শিকদার, নাজমা বেগমের দিকে থাকলেও শিখার উপস্থিতিতে সবাই ওর দিকে মনোযোগ দেয়।রিহান শিখাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।পুলিশ শিখার হাতে হাতকোড়া পড়াতে আসলে রিহান কেদে ফেলে। শিখাকে সে যেতে দেবেনা বলে জিদ করে।সবাই হতবিমূড় হয়ে তাকিয়ে আছে।গ্রামের মানুষজন যারা যারা বাড়ির ভিতর ছিলো তারা এসব শুনে হায় হায় করছে। আরফাজ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বারান্দায় ধপ করে বসে পরে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে গেলো।মহুয়া আরফাজকে বসতে দেখে পুলিশেরে দিকে এগিয়ে যায়।রাহাদকে এরেস্ট করতে বলে আরমানের হাত থেকে প্রমান সব নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।রাহাদকে পুলিশ ধরতে গেলে রাহাদ চিল্লিয়ে বলে উঠে,
‘রিহাব,কোথায় আছিস? তোকে যে আশেপাশে থাকতে বললাম।সামনে আয় এবার।’
মহুয়া ধীর পায়ে রাহাদের সামনে এসে দাড়ায়।তারপর মৃদু স্বরে বলে উঠে,
‘আসবেনা রিহাব ভাই।উনি আমাদের আয়ত্তে।আপনার লঞ্চ, আপনার সাথে কাজ করা লোকদেরও আটক করা শেষ।’
রাহাদ হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়।বুঝতে পারে তার আর কিছু করার মতো কিছুই নেই।পুলিশের সঙ্গে যাওয়ার আগে রিঠীর সামনে দাড়ায়।মাফ চায় রিঠীর কাছে।রিঠী তো নিজের মাকে ধরে দাড়িয়ে ছিলো।রাহাদকে সামনে পেয়ে ওর বুকে আছড়ে পরে কেদে দেয়।রাহাদ রিঠীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘জীবনটা পরে আছে রিঠী।আমার মতো মানুষের জন্য থমকে থেকোনা। বাচ্চা মেয়ে তুমি আবারও পড়াশোন করে জীবন সাজিও।’
কথাটা বলেই রাহাদ পুলিশের সাথে চলে যেতে ধরে।পুলিশ সারিফ শিকদারও এসবে জড়িত দেখে তাকে এরেস্ট করতে এগিয়ে গেলে উনি নিজের পান্জাবির পকেট থেকে পিস্তল বের করেন।উনার হাতে পিস্তল দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়।উনার দিকে পুলিশ আগাতে ধরলে উনি আরিফুল শিকদারের দিকে পিস্তল তাক বলে উঠেন,
‘আমি জেলে পচে মরবো আর তুমি শান্তিতে ঘরসংসার করবে, তা হবেনা আরিফুল শিকদার।জেলে পচে মরার আগে তোমাকে মেরেই যাবো।’
উনার কথা শুনে উপস্থিত আটকাতে বলে পুলিশকে। পুলিশ অফিসার উনাকে ধরতে যাওয়ার আগেই পিস্তল থেকে গুলি করে দেন।মহুয়া নিজের শ্বশুরকে বাচাতে দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মারে।আরফাজ বসা থেকে দাড়িয়ে এতক্ষণ সারিফ হোসেনকে আটকাতে যাবে তার আগেই এসব দেখে চিৎকার করে বলে উঠে,
‘মহুয়া!
চলবে?
(