মনোহরিণী পর্ব -০৭+৮

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৭.
সন্ধ্যার পর সোফায় দু’পা তুলে আয়েস করে বসে ফোন ঘাঁটছিলাম। কোলের ওপর নুডলসের বাটি রাখা। অর্ধেকটা নুডলসও খেতে পারিনি এখনও। ঠিক তখন কলিংবেলের শব্দে বিরক্ত হলাম। ফোন আর নুডলসের বাটি সেন্টার টেবিলে রেখে উঠে গিয়ে লুকিং হোলে চোখ রাখলাম। তারপর মুখ ভেংচে দরজা খুললাম। সামনে থেকে সরে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভ্রুকুটি করে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ব্যক্তির দুহাত ভর্তি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, এতগুলো শপিং ব্যাগে কী আছে? তাজ ভাই গমগমে গলায় বললেন,
“পিলারের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সার্কাস দেখছিস? সর সামনে থেকে।”
আমি চুপচাপ সরে দাঁড়ালাম। উনি ভেতরে ঢুকেই হাতের ব্যাগগুলো সোফায় একরকম ছুঁড়ে মা’রলেন। নিজেও ধপ করে সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলেন। চোখে-মুখে দারুণ বিরক্তভাব। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে একা একাই বকতে শুরু করলেন,
“শা’লার জ্যাম। গাড়ি নিয়ে রোডে নামলেই দুনিয়ার সব গাড়ি ওই রোডে উপস্থিত হয়। যা অবস্থা, এখন মনে হচ্ছে জ্যামের জ্বালায় এই শহরে বিমান নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। গাড়িতে চলাফেরার সাধ একদম মিটিয়ে দিচ্ছে। মিনিটের আগায়-মাথায় জ্যাম।”
আমি মুখ টিপে হাসলাম। নিশ্চিত জ্যামের খপ্পরে পড়ে জানের দফারফা করে ফিরেছে। এরপরেই আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে তিক্ত মুখে বললেন,
“খালি গিলতে শিখেছিস? সেবা করতে শিখিসনি? ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়, যা।”
আমি কথা না বাড়িয়ে পানি আনতে চললাম। মহারাজ যা মেজাজ নিয়ে এসেছেন, ত্যাড়ামি করলে নিশ্চিত মাথায় তুলে আছাড় মা’রবে। ঠান্ডা পানি নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই তাজ ভাইয়ের মেজাজের তীব্রতা আমার কাছে স্থানান্তর হলো। আমার আধখাওয়া নুডলসের বাটি সাবার করে ফেলেছে রাক্ষসটা। পানির গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলে রেখে আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
“এটা আমার।”
ততক্ষণে উনি বাটির নিচে পড়ে থাকা নুডলসের শেষ অংশটুকুও গলধঃকরন করেছেন। আমার কথা শুনেও যেন শুনলেন না।‌ ফিরে তাকানো তো দূর, পাত্তাই দিলেন না। সেন্টার টেবিলের ওপাশে বসে জেমি নিজের ভাগের নুডলস্ খাচ্ছিল। ও খাওয়া রেখে গোলগোল চোখে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মালকিনের খাবার লুটের অপরাধে হয়তো মনে-মনে কয়েক ধাপ বকুনি দিচ্ছে। আফসোস! মুখে প্রকাশ করতে পারল না বেচারা। তাজ ভাই এতক্ষণে জেমিকে খেয়াল করলেন। চোখ দুটো সরু করে জেমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিরে বড়োলোক বিলাই? নুডলসও ছাড়লি না! মালকিনের মতোই খাদক হইছিস? দুটোই অকর্মা।”
জেমি লেজ নেড়ে দুবার ‘মিয়াও’ বলে ডেকে উঠে পুনরায় নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমি কপালে ভাঁজ ফেললাম। তীব্র আক্ষেপ নিয়ে বললাম,
“আমি খাদক? নিজের ট্যাগ আমাকে দিচ্ছেন কোন দুঃখে? পারলে তো গোটা দুনিয়াটা গিলে খান। আজাইরা আমাকে পচানোর চেষ্টা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপনার?”
উনি শুনেও যেন কিছুই শুনলেন না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গ্লাসের পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে পেটে চালান করলেন। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে শপিং ব্যাগগুলো পুনরায় হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন,
“আম্মি কোথায়?”
আমি থমথমে গলায় উত্তর দিলাম,
“রুমে, রাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।”
উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। ডাইনিং রুম দিয়ে যেতে-যেতে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আম্মি, ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু খেতে দাও।”
আমি এবার কপাল কুঁচকে ফেললাম। আমার নুডলসটুকু গিলে এখন আবার আম্মিকে বলছে খাবার দিতে! এই অসময়ে এর পেটে কোন রাক্ষস বাসা বেঁধেছে? আবার আমাকে বলে খাদক। নিজে তো খাদকদের রাজা। সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকা নিজের ফাঁকা নুডলসের বাটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটালাম। আহারে আমার সাধের নুডলস্! কত সাধ করে বানালাম! ধুর! এই রাক্ষসের সাথে মানুষ বসবাস করে? নুডলসের জন্য দুঃখ বিলাস করতে-করতে হুট করেই আমার মাথায় আরেক ভাবনা উঁকি মা’রল। তাজ ভাই হঠাৎ এত শপিং করলেন কেন? গত সপ্তাহেই তো দেখলাম উনি নিজের জন্য যথেষ্ট শপিং করেছেন। সপ্তাহ ঘুরতেই আবার শপিং! কী এত কিনেছেন? আগ্রহ নিয়ে আমি ওনার রুমের দরজায় দাঁড়ালাম। দরজা ভেজিয়ে রাখা। বাইরে থেকে এসে উনি সবসময় আগে ফ্রেশ হতে ঢোকেন। আজও হয়তো তার বিপরীত হয়নি।‌ দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি মে’রে ওনাকে দেখলাম না। শপিং ব্যাগগুলো বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। বুকে বেশ সাহস সঞ্চার করে দরজা ঠেলে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলাম। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজায় একবার সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পা টিপে-টিপে বিছানার পাশে এগিয়ে গেলাম। তারপর একটা শপিং ব্যাগ ফাঁক করে অতি সাবধানে ভেতরের প্যাকেট দেখলাম। দুটো পাঞ্জাবি দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম আজও লাট সাহেব নিজের জন্য শপিং করেছেন। টাকা-পয়সা উথলে পড়ে, হুঁহ্। আরও একটা শপিং ব্যাগে সন্ধান চালিয়ে আমি ভ্রুকুটি করলাম। এটাতেও পাঞ্জাবি! দ্বিগুণ উৎসাহে আমি অপর ব্যাগে সন্ধান চালালাম। ওমা! এটাতেও পাঞ্জাবি! অতঃপর একটা-একটা করে সবকটা ব্যাগে সন্ধান চালিয়ে পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছুই পেলাম না। আমি পুরোদস্তুর আহাম্মক বনে গেলাম। হা করে তাকিয়ে রইলাম ব্যাগগুলোর দিকে। এ তো পুরো একটা পাঞ্জাবির দোকান তুলে নিয়ে এসেছে! ডিটেকটিভিটি ছেড়ে কি এখন পাঞ্জাবির দোকান দিয়ে বসার পরিকল্পনা চলছে? না কি সবই নিজে পরবেন? অথচ আমার জানামতে এই লোক বিশেষ কারণ ছাড়া পাঞ্জাবি পরেন না। তাহলে হঠাৎ এই অদ্ভুত কাণ্ডের কারণ কী? এতগুলো পাঞ্জাবি দিয়ে কী করবেন উনি? আজব! ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ কানে আসতেই আমি চোখ বড়ো করে ঘুরে দাঁড়িয়েই এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সোজা ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লাম। আহাম্মকের মতো বার কয়েক পলক ঝাপটালাম। এতগুলো পাঞ্জাবির টাকা দিয়ে তো আরও কত শপিং করা যেত। পরক্ষণেই হুট করে মনে পড়ে গেল উনি সেদিন বলছিলেন ওনার বন্ধুদের কিছু গিফট করবেন। তাদের জন্যই কি এসব কিনেছেন না কি? তা-ই হবে হয়তো। অযথাই কনফিউশনে পড়লাম। ধ্যাত!

রাত দশটার দিকে অ্যাকাডেমিক বইয়ের পড়া শেষ করে গতকালের অর্ধেক শেষ করা উপন্যাসের বইটার সন্ধান চালাতে ব্যস্ত হলাম। শেলফ তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও যখন পেলাম না, তখন মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এ ঘটনা নতুন নয়। এই শেলফ আনার পর থেকেই এ ঘটনার জন্ম। যেই বইটাই অর্ধেক শেষ করে শেলফে কিংবা ঘরে রাখি, সেটাই ওই জায়গা থেকে উধাও হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত চু’রি বলা চলে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে গটগট করে হেঁটে গিয়ে চো’র বাবাজির ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজাটা শব্দ করে খুলে ভেতরে ঢুকে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা টেবিলের কাছে চলে গেলাম। টেবিলের আনাচে-কানাচে সন্ধান চালাতে-চালাতে ভেতরের রাগটা বুঝানোর তীব্র প্রচেষ্টায় আপনমনে বকবক শুরু করলাম,
“শেলফের আগাগোড়া বই দিয়ে ঠেসে রেখেছে, অথচ পড়ার সময় খুঁজে পায় আমার বইটাই। আর কোনো বই চোখে দেখে না। প্রতিদিনই এক বিরক্তিকর কাহিনি। তার থেকে শেলফ না থাকতেই শান্তি ছিল। ধুর!”
বই না পেয়ে এবার গরম মেজাজে কেরোসিন পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বিছানায় দায়সারা ভঙ্গিতে পা বিছিয়ে বসে ল্যাপটপে কারো সাথে বকবক করতে থাকা মহারাজের দিকে তাকালাম। কপট রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আমার বই কোথায়?”
উনি শুনেও যেন শুনলেন না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের কথোপকথন চালিয়ে গেলেন। আমি বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বার কয়েক একই প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পেলাম না। এই ঘরে এই বিছানার পাশে যে আস্ত একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা যেন কেউ দেখেইনি। অধৈর্য হয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে বালিশের কাছটায় খুঁজতে লাগলাম। ঠিক তখনই পুরুষালি কন্ঠস্বর শোনা গেল। আনন্দিত কন্ঠে কেউ ডেকে উঠল,
“হেই ইলোমিলো।”
আমি চকিতে ফিরে তাকালাম। ল্যাপটপের স্ক্রিনে শ্রেয়ান ভাইয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখা যাচ্ছে। তাজ ভাইয়ের পাশে চলে আসায় আমাকে দেখে ফেলেছে। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। তাজ ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম উনি গম্ভীর মুখে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন। শ্রেয়ান ভাইয়া পুনরায় ডেকে বললেন,
“কেমন আছো, ইলোমিলো?”
অগত্যা আমি আলগোছে বিছানায় বসে পড়লাম। ক্যাবলাকান্তের মতো মুখে হাসি টেনে বললাম,
“জি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। তোমার সাথে আড্ডার মুহূর্তটা কিন্তু আমি মিস করি। বেশ ভালো আড্ডা দাও তুমি। সব কথায় মুখে হাসি থাকে। আই লাইক ইট। ব্যস্ততা না থাকলে আমি যখন-তখন চলে যেতাম তোমার সাথে আড্ডা দিতে। যাইহোক, আগামীকাল আমি ফ্রি আছি। চলো আমরা বাইরে বেরোই। আড্ডাও হয়ে যাবে, সাথে ঘোরাঘুরিও হবে।”
আমি ইতস্তত করে মুখ খোলার আগেই তাজ ভাই থমথমে মুখে ফট করে বলে উঠলেন,
“এখন ওর পড়ার চাপ বেশি। কোথাও যেতে পারবে না। আঙ্কেলের নিষেধ আছে।”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। কোন আঙ্কেলের নিষেধ আছে? আর আমার পড়ার চাপই বা কোথায়? শ্রেয়ান ভাইয়া একটু আশাহত হলেন। বললেন,
“আঙ্কেল কে?”
“ওর বাবা,” তাজ ভাইয়ের স্পষ্ট উত্তর।
“আঙ্কেল জানবে কীভাবে? আমরা কি ঢাকঢোল পিটিয়ে বাইরে বেরোব? আন্টিকে বলে কিছু সময়ের জন্য তুই, আমি আর ইলোমিলো বেরোব। চাইলে জুম্মানদেরও নিতে পারিস।”
এমন একটা প্রস্তাব শুনে আমার আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। আমার আনন্দে ভাটা ফেলে তাজ ভাই পুনরায় আপত্তি জানালেন,
“কোনো প্রয়োজন নেই। আঙ্কেল যেখানে নিষেধ করেছে, সেখানে আম্মিও যেতে দিবে না। তোর এই ফাও প্যাঁচাল বন্ধ করে কাজের কথায় আয়।”
“আরে ভাই এমন করিস কেন? আন্টিকে আমি ম্যানেজ করে নিব, দেখিস।”
এবারে তাজ ভাই ত্যাড়ামি করার আগেই আমি চট করে বলে বসলাম,
“আমি যাব, শ্রেয়ান ভাইয়া। আপনি কাল সন্ধ্যায় চলে আসবেন। আমি জুম্মান ভাইয়াদেরও বলে রাখব। আমরা সন্ধ্যায় রেডি হয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”
শ্রেয়ান ভাইয়া চমৎকার করে হেসে আনন্দিত কন্ঠে বললেন,
“গ্রেট, ইলোমিলো। এটাই ফাইনাল। থ্যাংক ইউ সো মাচ। এই তাজ, দেখ শা’লা। তুই খামোখা-”
শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শেষও হলো না। তাজ ভাই আচমকা শব্দ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে ফেললেন। কোল থেকে একপ্রকার ছুঁড়ে পাশে ফেললেন ল্যাপটপটা। অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনার কাণ্ডে চমকে উঠলাম। হঠাৎ আবহাওয়া বদল হলো কেন? কী মুশকিল! এখন কি আমার ওপর সুনামি বয়ে যাবে না কি? দৃষ্টি তো তা-ই বলছে। আমি ভয়কে জয় করে ভ্রুকুটি করে বললাম,
“কী হলো?”
উনি বরাবরের মতো আমার চুলের মুঠিতেই রাগ ঝাড়লেন। আমি ব্যথাতুর শব্দ করে মুখ খোলার আগেই শ্লেষের সুরে বললেন,
“খুব শখ তোমার শ্রেয়ানের সাথে ঘুরতে যাওয়ার? এত শখ কেন? বয়ফ্রেন্ড জীবনে ঘুরতে নিয়ে যায়নি? আমি না বলার ওপরে আবার বাড়তি কথা বলতে গেছো কোন সাহসে?”
আমি চুলের মুঠি থেকে ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করে উলটো রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আপনার এত সমস্যা কিসের? চুল ছাড়ুন, ব্যথা লাগছে। যখন-তখন চুল টানাটানি করবেন না।”
ওনার মুঠো থেকে চুল ছাড়িয়ে পুনরায় বললাম,
“আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরি বা শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে। তাতে আপনার কী? আপনার ইচ্ছে না হলে আপনি যাবেন না। আপনাকে তো কেউ নেওয়ার জন্য মাথার দিব্যি দেয়নি।”
উনি সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখে। তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে টেনে বললেন,
“আশ্চর্যজনক পরিবর্তন!”
জবাবে আমিও হাসলাম। বললাম,
“আগের মতো সেই বোকাসোকা থাকলে খুব খুশি হতেন মনে হচ্ছে? অযথা কারণে কাঁদাতে পারতেন, খুশি হবারই কথা। কিন্তু কী বলুন তো? বয়সের সাথে যে আমার মাঝে পরিবর্তনটা এসেছে, এজন্য আমি খুব খুশি। অন্তত কেউ অকারণে কাঁদাতে পারবে না।”
“ইশ্ রে! এবার আমি পাঁচ বছর আগের ওই পুরোনো চিরকুট দিয়ে কী করি বল তো, পিচ্চি?”
আমি ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে রাগ দমন করলাম। আবার ওই অভিশপ্ত চিরকুট নিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাই বিছানা‌ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থমথমে মুখে বললাম,
“আমার বই দিন।”
তাজ ভাই যেন আমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলেন না। অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন,
“কিসের বই?”
“নাটক কইরেন না তো। তাড়াতাড়ি বই দিন।”
“তোর বই আমার কাছে আসবে কোত্থেকে?”
“ধুর, দিন তো। কোথায় রেখেছেন?”
“জানি না।”
“আপনার জন্য কি অন্য কোনো বই নেই? শেলফে এত-এত বই থাকতে আমারটাই পড়তে হবে কেন? আশ্চর্য! বালিশের নিচে রেখেছেন? দেখি সরুন, উঠুন না।”
তাজ ভাই ভ্রু দ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর হাত বাড়িয়ে আমার বাঁ গালটা জোরে টিপে দিয়েই দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। এই লোক কি সত্যিই আম্মি আর নূর আঙ্কেলের আপন ছেলে? রাজ ভাইয়ের আপন ভাই? আমার কেমন সন্দে-সন্দেহ লাগে।‌ আপন হলে সবার উলটো কেন হলো? পা’জি লোক! বালিশ সরাতেই বইটা পেয়ে গেলাম। বই নিয়ে আপনমনে তাজ ভাইকে বকতে-বকতে নিজের রুমে চলে এলাম।
রাতের খাবার খেতে বসে ঘটল আরেক কাহিনি। আমিরা আপু এল হাতে এক বাটি চিংড়ির মালাইকারি নিয়ে। খুব আনন্দিত মনে সহাস্যে জানাল এই ডিশটা সে নিজ হাতে বানিয়েছে। তাই স্পেশালি তাজ ভাইয়ের জন্য নিয়ে এসেছে। আম্মি তাকে আমাদের সাথে খেতে বসতে বলল।‌ কিন্তু সে খেয়ে এসেছে বলে সুযোগটা ফসকে গেল। মুশকিল হলো আমিরা আপু তাজ ভাইকে তার স্পেশাল ডিশ খাওয়ানোর আশায় বসে রইল। তাজ ভাই চিংড়ির মালাইকারি নিচ্ছেন না বলে অসহায় মুখ করে বারবার তাগাদা দিলো,
“তাজ ভাই, এটা নিন না। আমি কত কষ্ট করে বানিয়েছি। খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে। শুনেই আমি চলে যাব। পড়া ফেলে রেখে এসেছি। নিন না প্লিজ।”
তার অনুরোধ দেখে আম্মিও তাজ ভাইকে বললেন আমিরা আপুর ডিশটা খেয়ে দেখতে। তাজ ভাই সহাস্যে বললেন,
“তোর পড়া আগে জরুরি। যা, যা, পড়া শেষ কর গিয়ে। আমি খেয়ে নিব। কেমন হয়েছে তা কাল জানালেই তো হবে। যা, ব্যস্ত হতে হবে না। দেখছিস না আমি আমি রিল্যাক্সে খাচ্ছি?”
আমিরা আপুর মুখটা পাংশুবর্ণ ধারণ করল। মুখের ওপর এমন কথা শুনে তার আর বসে থাকাও হলো না। মুখ কালো করে অসন্তুষ্ট মনে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। আম্মি ডায়াবিটিসের রোগী বলে রাতে রুটি খায়। তার রুটি খাওয়া শেষ। তাজ ভাই চিংড়ির মালাইকারির বাটিটা হাতে নিয়ে একবার সূক্ষ্ম চোখে পরখ করে দেখলেন। তারপর কোনোরকম ইতিউতি ছাড়াই বাটি উলটো করে পুরো মালাইকারিটাই আমার প্লেটে ঢেলে দিলেন। ওনার এহেন কাণ্ডে আমি আর আম্মি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওনার দিকে তাকালাম। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
“আরে! সব ঢাললেন কেন?”
উনি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। যার প্রিয় সে-ই খাক।”
আম্মি গ্লাসে পানি ঢালতে-ঢালতে বলল,
“এক পিস অন্তত খেয়ে দেখতে পারতি। মেয়েটা এত কষ্ট করে বানিয়েছে।”
তাজ ভাই মুখ লটকে বললেন,
“হ্যাঁ, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখে বানিয়েছে নিশ্চয়ই। প্রচুর কষ্ট করেছে। সেজন্যই চিংড়িপ্রেমীকে খেতে দিলাম। সে ভালো রিভিউ দিতে পারবে। আমি আবার এত কষ্টের রান্নার রিভিউ দিতে এক্সপার্ট নই। তাছাড়া চিংড়ি-ফিংড়ি খেতে আমার ভালোও লাগে না, জানোই তো।”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“তাই বলে এতগুলো চিংড়ি সব আমার প্লেটে ঢালবেন? আমার পেট অলরেডি ভরে গেছে।”
উনি আয়েস করে নিজের খাবার খেতে-খেতে বললেন,
“সমস্যা কী? খেয়ে ফেল। তুই না খাদক?”
আম্মি বলল,
“ও আবার খাদক কবে থেকে? খাবারের পরিমাণ দেখেছিস? তোর থেকেও তো কত কম খায়।”
আমি মুখ টিপে হাসলাম। তাজ ভাই অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“কী মিন করতে চাইছো, আম্মি? আমি বেশি খাই?”
“আরে ধুর! তা কখন বললাম?”
“তোমার কথা তো তা-ই বলছে। বেশি খেয়ে তোমার স্বামীর টাকা-পয়সা কমিয়ে দিলে ডিরেক্টলি বলে দিবে, আমি নিজের টাকায় খাব। বাপের হোটেলে খাই বলে কথা শোনাচ্ছ। বুঝি, বুঝি। তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করব তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ছেলের খাবার নিয়ে খোটা দেয় কেন। তার উপার্জন কমে গেছে না কি?”
আম্মি হেসে ফেলল। তাজ ভাইয়ের বাহুতে হালকা করে থা’প্পড় মে’রে বলল,
“বাজে কথা বন্ধ করে চুপচাপ খাবার শেষ কর। পা’জি ছেলে।”
আমি ঠোঁট উলটে প্লেটের মালাইকারি চিবোচ্ছি। স্বাদ খুব বেশি ভালো না,‌ আবার খুব বেশি খারাপও না। মোটামুটি ভালোই হয়েছে। আমিরা আপুর জন্য মায়া হলো। আহারে বেচারি! যার জন্য কষ্ট করে রান্না করল, সে একটু চেখেও দেখল না। এ কথা শুনলে তো ওই বেচারি দেয়ালে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে আফসোসে ম’রে যাবে। এই ওভার অ্যাক্টিংয়ের গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়ে যে আমি আরও কী, কী হাস্যকর কাহিনির সাক্ষী হব, ওপরওয়ালা জানেন। হয়তো একেই বলে বিনামূল্যে রম্য নাটকের শুটিং উপভোগ করা।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
ঢাকা শহরে চব্বিশ ঘন্টা সজাগ রাস্তার মতো মানুষগুলোও বোধ হয় অক্লান্ত। কেমন এক মুহূর্তের জন্যও রাস্তাগুলো ফাঁকা পাওয়া যায় না! মানুষগুলোও যেন যান্ত্রিক। প্রতিটা মুহূর্তে ছুটে চলছে তো চলছেই। পেটের তাগিদ যে বড়ো তাগিদ। তার কাছে বুড়ো থেকে গুঁড়ো, সবাই হেরে যায়। কোলাহলে মুখরিত এই ব্যস্ত শহরে আমার ভালোলাগার মুহূর্ত হচ্ছে মধ্যরাত থেকে রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত। মানুষজনের ছোটাছুটি না থামলেও, এই সময়টাতে কোলাহল থেকে অনেকটা নিস্তার মেলে। জনমানুষের হৈচৈ থাকে না, থাকে শুধু সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলা যানবাহনগুলোর হর্ন। রাস্তা পেরোতে গিয়ে অন্তত অন্যান্য সময়ের মতো জানের দফারফা হয় না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই শহরে এটুকু সময়েই আমি একটু শান্তি খুঁজে পাই। অন্য সময় বাইরে বেরোলেই মনে হয় এই নিরন্তর ছুটে চলা জনমানব আর যানবাহনের মতো আমাকেও বুঝি ছুটতে হবে। এই ছুটোছুটির পাল্লায় পড়ে আমার আর বাইরের জগতের শান্তি উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। মধ্য রাতের ওই শান্তির সময়টুকুও উপভোগ করার সুযোগ নেই। সময়টাই যে বিশ্রামের। আজ যখন শ্রেয়ান ভাইয়ার অছিলায় ঘুরাঘুরির সুযোগ মিলল, তখন আমার খুব করে ইচ্ছে করল মধ্যরাতে ঘোরাঘুরি করার। কিন্তু হায়! এতগুলো মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সন্ধ্যায় ঘুরাঘুরি করার, তখন আমার একার ইচ্ছে সেখানে ফলাই কী করে? সবাই হয়তো সমর্থনও করবে না। আম্মুর সেই বিখ্যাত ভাষণটি মনে পড়ে গেল। দূরের কোনো জায়গার নাম মুখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা দিত, ‘বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে যাস।’ সুতরাং মধ্যরাতের শহর ঘোরার ইচ্ছেটাও এবার আমি আম্মুর কথামতোই জামাইয়ের আশায় তুলে রাখলাম। বাধ্য মেয়ে আমি, হাহ্। সবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার এখন ওই যানবাহন আর ব্যস্ত মানুষদের ভীড়ে একদমই নামতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনে হচ্ছে শ্রেয়ান ভাইয়ার প্রস্তাবে রাজি হওয়াটাই উচিত হয়নি। মন যেখানে সায় দেয় না, সেখানে গিয়েও কোনো শান্তি নেই। মনের সঙ্গে একধাপ লড়াই করে বেচারা মনটার অবস্থাও যা-তা করে ফেলেছি। এই মহা ঝামেলার মধ্যে আবার সর্বোচ্চ বিরক্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল আমিরা আপু আর মিনহা আপুর সাজগোজ। আমি রেডি হয়ে প্রায় আধঘন্টা যাবত তাদের বাসায় গিয়ে বসে রইলাম। এসে হতেই দেখলাম দুই বোন মেকআপ নিয়ে টানাটানি করছে। ড্রেস নিয়ে কনফিউজড হয়ে তব্দা খেয়ে বসে আছে। জুতা ম্যাচিং করতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচ্ছে। বান্দাদের রেডি হওয়া আর হয়ে উঠছে না। গোবেচারা আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গালে হাত দিয়ে বসে-বসে টানা আধঘন্টা তাদের চুলোচুলি দেখলাম। অতঃপর যখন বিরক্তির সীমা অতিক্রম হলো, তখন উঠে আবার তাজ ভাইদের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। আম্মি আমাকে দেখে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? মুখ অন্ধকার কেন?”
আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“ভালো লাগছে না।”
“কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
“নাহ্, এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“শ্রেয়ান বলার পর না কি তুমিই যেতে চেয়েছ? তাহলে এখন যেতে ইচ্ছে করছে না কেন?”
“রাস্তায় যেই জ্যাম! বাইরে গেলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
“সবার সাথে ঘুরলে ভালো লাগবে। আমিরা আর মিনহা রেডি হয়নি এখনও?”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এত তাড়াতাড়ি হবে না কি? সবে তো মেকআপ ঘঁষছে।”
আম্মি হাসল। বলল,
“তুমি সাজলে না কেন?”
আমি মুখে বিরক্তি ভাব টেনে বললাম,
“ধুর! আমি কি বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি না কি, যে ঘন্টা লাগিয়ে সাজব? আমার ওসব ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে।”
পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
“সাজ ছাড়াই তুমি কিউট, ইলোমিলো। কিউট মেয়েদের অত সাজা লাগে না।”
পেছন ফিরে শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখে মৃদু হেসে প্রশ্ন করলাম,
“আপনি কখন এলেন, ভাইয়া?”
“কিছুক্ষণ আগে।‌ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমিরাদের রেডি হওয়া হয়নি? তাজ কিন্তু ভীষণ রেগে গেছে। আমার ওপর চেঁচাচ্ছে এখন। আর একটু দেরী হলে বাইরে বেরোনোটাই ভেস্তে দিবে।”
আমি হতাশ গলায় বললাম,
“এত তাড়াতাড়ি তাদের রেডি হওয়া হবে না কি? সবে তো মেকআপ করছে।”
আম্মি বলল,
“আমি গিয়ে ডেকে নিয়ে আসছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বাঁধা দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না, আন্টি।‌ আমি যাচ্ছি।”
“আচ্ছা যাও।”
শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেলেন আমিরা আপুদের ডাকতে। আমি বিরক্তিতে হাত-পা তুলে সোফায় বসে রইলাম। তাজ ভাইয়ের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়ার ওপর অনবরত চেঁচাচ্ছেন উনি। সঙ্গে আমিরা আপু আর মিনহা আপুর মেকআপের গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করতেও ভোলেননি। ওনার এক কথা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে না বেরোলে আজকের পর আর কোনোদিন এই দল নিয়ে উনি বাইরে বেরোবেন না। জুম্মান ভাইয়া বোনদের সাজের পাল্লায় পড়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচামেচি করে নিচে চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। গিয়ে হতে একটু পরপরই ফোন করে রওয়ানা দেওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন। আমি ফোনটাকে কুশনের নিচে চাপা দিয়ে ফেলে রেখে সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। ফ্যানের বাতাসে শীতল আরামে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। প্রায় চার মিনিট পর হঠাৎ দুই কানের ওপর কিছুর স্পর্শ পেয়ে ফট করে চোখ খুললাম। চোখ খুলতেই সামনে তাজ ভাইকে নজরে পড়ল। একহাতে কানে ফোন ধরে, আরেকহাতে আমার চোখে চশমা পরিয়ে দিচ্ছেন। আমি হাত তুলে চশমা ধরার আগেই উনি একহাতে চশমাটা ঠেলে ঠিক করে দিলেন। তারপর আর আমার দিকে না তাকিয়ে নিজের ধ্যানে ফোনে কথা বলতে-বলতে পাশের সোফায় বসলেন। রেডি হওয়ার পর চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিলাম। চশমা ছাড়া বাইরে গেলে চোখের বারোটা বাজিয়ে ফিরতে হত আজ। যা ধূলিকণা! কিন্তু আমার চশমা তো রুমে ছিল। হয়তো ড্রয়িংরুমে এসে চোখে চশমা না দেখে নিজেই গিয়ে নিয়ে এসেছেন। বাব্বাহ্! কী যত্ন! আমি কি বলেছি আজাইরা যত্ন দেখাতে? আমাকে বললে নিজেই গিয়ে পরে নিতাম। এখন ভালোমানুষী করে যত্ন দেখাল; অথচ কান থেকে ফোনটা নামিয়েই নিশ্চিত এই নিয়ে দশ লাইনের একটা বয়ান শোনাতেও ভুলবে না। ব’দ লোক! আমি একবার আড়চোখে ওনার আপাদমস্তক পরখ করলাম। নতুন পাঞ্জাবি পরেছে! অফ-হোয়াইট পাঞ্জাবি। গতকাল এনেছিল সেগুলোর মধ্য থেকেই পরেছে বোধ হয়। পাঞ্জাবিটা এই বিলাই মার্কা শরীরে অমনভাবে না মানালে কি হত? সুইডিশ সুন্দরী রেখে এখন আবার বাংলাদেশী সুন্দরী পটানোর ধান্দা। মেয়েবা’জ লোক! মহাশয়কে দেখে যে আজ আমিরা আপু বিস্ময়ে হা করে আর মুখ বন্ধ করতে পারবে না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। আমিরা আপুর মুখে এই লোকের রূপের প্রশংসা শুনেই আজ আমার কানের অকালমৃ’ত্যু হবে। আহারে আমার বেচারা কান! তাজ ভাই কথা শেষ করে কান থেকে ফোন নামাতেই আমি তার বয়ান শোনার অপেক্ষা করলাম। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে উনি আমার চশমা নিয়ে কোনো কথাই তুললেন না। উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে উঁচু গলায় আম্মিকে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ আম্মি ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো। তাজ ভাই বললেন,
“আসছি।”
আম্মি সাবধানী সুরে বলল,
“আচ্ছা যা। ইলোকে দেখে রাখিস। ও কিন্তু একা রাস্তা পেরোতে পারে না।”
তাজ ভাই ত্যাড়াভাবে বললেন,
“আমাকে কি কোনোভাবে ওর বডিগার্ড মনে হয়? না কি নিয়োগ দিতে চাইছো? ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের অত আজাইরা সময় নেই, বডিগার্ড চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারো।”
“ফাজলামি রাখ। বের হ তাড়াতাড়ি, বেশি রাত যেন না হয়।”
তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ‘চল’ বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমিও আম্মিকে বলে ওনার পেছন-পেছন বেরোলাম। লিফটের সামনেই দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া, আমিরা আপু আর মিনহা আপু দাঁড়িয়ে আছে। দুই বোনের ঝাকানাকা সাজ দেখে রীতিমতো আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে জুম্মান ভাইয়ার সাথে সৌরভ ভাইয়াকেও দেখা গেল। তাকে দেখে আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম। তাজ ভাই সৌরভ ভাইয়ার পেটে হালকা করে ঘু’ষি মে’রে বললেন,
“কিরে ব্যাটা? মুখ্যম সময়ে কেমনে টপকালি?”
সৌরভ ভাইয়া হেসে বললেন,
“জুম্মান ভাইয়া ফোন করে আসতে বলল। সবাই না কি ঘুরতে বের হচ্ছে, আমি কেন বাদ যাব? সুযোগটা লুফে নিলাম।”
তাজ ভাই জুম্মান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুই ওকে ফোন করে হল থেকে ডেকে এনেছিস? এক কাজ কর, বড়ো একটা মাইক নিয়ে পুরো শহর অ্যানাউন্স করে দে।”
জুম্মান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আরে ভাই, আমরা আমরাই তো।”
সিদ্ধান্ত হলো গাড়ি নেওয়া হবে না। পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে। সিদ্ধান্ত মতোই আমরা নেমে পড়লাম রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে চেনা কোলাহলে আমার মাথাটা দপ-দপ করতে লাগল। আবার বিরক্ত লাগছে। তাজ ভাই আমার পাশাপাশি হাঁটছেন। আমিরা আপু ওনার পাশাপাশি হাঁটতে চেয়েও পারছেন না। এই জনমানুষের ভীড়ে তো আর সারিবদ্ধভাবে হাঁটা যায় না। তবে সুযোগ বুঝে আমিরা আপু আমার কানের কাছে তাজ ভাইয়ের রূপের প্রশংসা করতেও ভুলছে না। সাথে আছে মিনহা আপুর মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ার প্রশংসা। দুই বোন একটু পরপরই কানের কাছে এসে মাছির মতো ভনভন করছে। উচ্ছাসে যেন ফেটে পড়ছে। আমি বিরক্তি বোধ করলেও মিনহা আপু আমার সাথে আগের মতো মনখুলে কথা বলায় অনেকটা হালকা বোধ করলাম। পরিচিত মানুষগুলো কথা বন্ধ করে দেওয়ার অনুভূতিগুলো আমার কাছে খুবই তিক্ত মনে হয়। শ্রেয়ান ভাইয়া ফুচকার দোকানের সামনে এসে জানালেন ওনার পক্ষ থেকে সবাইকে ফুচকা খাওয়ানো হবে। এক্ষেত্রে যে যত প্লেট ইচ্ছে খেতে পারবে। কোনো বাঁধা নেই। এ কথা শুনে সবাই আনন্দে হৈ-হৈ করে উঠলেও মাঝখান থেকে বেঁকে বসলেন ঘাড়ত্যাড়া সাহেব। শ্রেয়ান ভাইয়াকে ধমকে উঠে বললেন,
“স্ট্রিট ফুড গলা অবধি খাইয়ে পেট খারাপ করানোর ধান্দা নিয়ে এসেছিস? সব কটাকে খালি মুখে বাসায় রিটার্ন পাঠাব।”
এই নিয়ে তাজ ভাইয়ের সাথে শ্রেয়ান ভাইয়ার একদফা তর্কযু’দ্ধ হলো। আমরা অসহায় মুখে দুই বন্ধুর যু’দ্ধ উপভোগ করলাম। শেষমেষ সবার জন্য এক প্লেট করে ফুচকা অর্ডার করা হলো। তা-ও আবার কড়া ঝাল দিয়ে। তাজ ভাই ঝাল খেতে পারেন না বলে উনি ওনারটাতে ঝাল দিতে বারণ করলেন। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। পরক্ষণেই লোকটা আমার প্লেটে কম ঝাল দিতে বলে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে আমি বললাম,
“আমি ঝাল খেতে পারি।”
আমিরা আপুও আমার সাথে তাল মিলাল। লাভ বিশেষ হলো না। উনি কটাক্ষ করে বললেন,
“তোর ওই হালকা ঝাল আর কড়া ঝাল এক না, পিচ্চি। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কড়া ঝাল খেয়ে রাস্তায় নেমে লাফালাফি করে মানসম্মান বাসের তলায় পি’ষ্ট করতে চাস? যেমন বলছি তেমন না খেলে বাড়ি গিয়ে ভাত খা, যা ভাগ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া এ পর্যায়ে এসে আর আমার পক্ষে কথা বললেন না। তাজ ভাইকে সমর্থন করে আমাকে বললেন,
“থাক ইলোমিলো। কড়া ঝাল যখন খেতে পারো না, তখন সবার সাথে পাল্লা দিয়ে এত ঝাল খেয়ো না। নিজেরই ক্ষতি হবে। হালকাই খাও।”
আমি গাল ফুলালাম। ঘুরতে এসেও শান্তি নেই। অবশ্য শান্তি প্রথম থেকেই পাইনি। এই বেত্ত’মিজের সাথে বাইরে এসে শান্তির আশা করা, আর ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গ্রামের মেঠো পথের শান্তি অনুভবের আশা করা একই ব্যাপার। দুটোই অসম্ভব। বাধ্য হয়েই আমি ওনাদের কথাই মেনে নিলাম। ফুচকা খাওয়ার সময় আমিরা আপু হঠাৎ আমার আর মিনহা আপুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এই দেখ, দেখ। তাজ ভাই বাড়তি ঝাল না নিয়েও মসলার সামান্য ঝালও খেতে পারছেন না। দুটো খেয়েই ঠোঁট কেমন লাল হয়ে গেছে। উফ্! কী লাগছে রে ভাই! আমার তো এখন উলটা-পালটা ভাবনা মাথায় আসছে।”
আমি আর মিনহা আপু চোখ দুটো ছানাবড়া করে আমিরা আপুর দিকে তাকালাম। তার মুখে লাজুক হাসি। আমি আহাম্মকের মতো একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সত্যি সত্যিই উনি দুটো ফুচকা খেয়ে এখন প্লেট হাতে নিয়ে ঝাল কমার অপেক্ষা করছেন। আমার হাসি পেলেও এই মুহূর্তে আমিরা আপুর কথা শুনে হাসতে পারলাম না। মিনহা আপু শ্লেষের সুরে বলেই বসল,
“ছিহ্! কী অশ্লী’ল চিন্তা-ভাবনা তোর! নজর সংযত রাখ আপু। দেখ, আমি কত ভদ্র মেয়ে। শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে কি আমি এমন অশ্লী’ল চিন্তা-ভাবনা করেছি? এই তুই তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকা।”
আমি এই অতি সাধু দুই বোনের পাশ থেকে আলগোছে কে’টে পড়লাম। সৌরভ ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি ফুচকা চিবোতে-চিবোতে নিচু স্বরে বললেন,
“কী আপু? ওই দুই পিশা’চিনী শান্তি দিচ্ছে না? তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াকে যেভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে, কখন যেন ফুচকা গলায় আটকে রাস্তায় গড়াগড়ি খায়।”
আমি মুখ টিপে হাসলাম। বললাম,
“এভাবে বলছেন কেন, ভাইয়া? আপনারই তো হবু ভাবি।”
জবাবে সৌরভ ভাইয়া এমনভাবে মুখ লটকালেন যে, আমি ফিক করে শব্দ তুলে হেসে উঠলাম। সবাই খুব মজা করে ফুচকা সাবার করলেও, তাজ ভাই পারলেন না। টেনেটুনে তিনটা খেয়েই দমে গেলেন। ফুচকার দোকান থেকে বেরিয়ে আবারও চলল পথ চলা। আমিরা আপু আর মিনহা আপু মাঝে-মাঝে সেলফি তুলছে, আবার সৌরভ ভাইয়াকে ফটোগ্রাফার বানিয়ে দিচ্ছে। সৌরভ ভাইয়া এতে দারুণ বিরক্ত। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের সবার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিলেন। ঘোরাঘুরি চলল বেশ। সবার সাথে গল্প করতে-করতে আমার বিরক্তি ভাবটা কখন উবে গেছে টেরই পাইনি। এরমধ্যে তাজ ভাইয়ের একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। বাসা থেকে বেরোনোর সময় আম্মির কথায় ত্যাড়ামি করলেও, প্রত্যেকবার রাস্তা পেরোনোর সময় ঠিকই স্ব-ইচ্ছায় আমার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে অতি সাবধানে রাস্তা পার করে দিয়ে, আবার আলগোছে ছেড়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত লোক! ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে ডিনারের উদ্দেশ্যে সবাই ঢুকে পড়লাম রেস্ট্রন্টে। যে যার মতো খাবার অর্ডার দিয়ে সবাই মিলে আকস্মিক চেপে ধরল তাজ ভাইকে। সবার দাবি, আজকের সম্পূর্ণ বিল তাজ ভাইকে দিতে হবে। এক কথায় তার থেকে ট্রিট আদায় করার ধান্দা। উনি নতুন ডিটেকটিভ হয়েছেন, অথচ ট্রিট দেননি; এ অবিচার কেউ মানতে নারাজ। তাজ ভাই বেঁকে বসে বললেন,
“কোন হিসেবে তোরা ট্রিট পাবি? টাকা খরচ করে পাড়ালো আমার বাপ, প্রত্যেক ধাপে টাকা খরচ করল আমার বাপ, আর ট্রিট নিবি তোরা! ফাজলামি পাইছোস? আমার বাপ এই পর্যন্ত আমার পেছনে যত টাকা খরচ করছে, তা সব কড়ায়-গন্ডায় হিসাব করে আগে তাকে ফেরত দে, তারপর ট্রিটের আশা করিস। শুধু ট্রিট না, পুরো রেস্ট্রন্টটাই তোদের জন্য ফ্রি করে দেবো, প্রমিস। রাজি হলে এক চাপ, না হলে রাস্তা মাপ।”
জুম্মান ভাইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“এটা কোনো কথা বললেন, তাজ ভাই? আপনি ডিটেকটিভ হয়ে আমাদের গোষ্ঠীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, আর ছোটো-খাটো একটা সেলিব্রেশন করে ট্রিটটুকু দিবেন না? এ-ও মানা যায়?”
“গোষ্ঠীর মুখ উজ্জ্বল করার মতো মহান কাজ করার বিনিময়ে তোদের সবার উচিত আমাকে আলাদা করে স্পেশাল ট্রিট দেওয়া। বাট’পারের দল।”
মিনহা আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“এমন করেন কেন, তাজ ভাই? আপনি কত বছর পর দেশে ফিরেছেন, অথচ ছোটো ভাই-বোনদের একটু আদর করে খাওয়াবেন না?”
উনি সকৌতুকে বললেন,
“ছোটো ভাই-বোনদের রেস্ট্রন্টে খাওয়াব কেন? তাদের তো কোলে তুলে ফিডার খাওয়াব। তুই খাবি?”
মিনহা আপু লজ্জা পেয়ে চুপ মে’রে গেল। পাশ থেকে আমিরা আপু ফট করে বলে বসল,
“আপনি কোলে বসিয়ে খাওয়াতে পারলে আমরা কেন খেতে পারব না?”
তাজ ভাই ভ্রুকুটি করলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“তাই না কি? দুই বাচ্চার মা হওয়ার বয়সে এসে ফিডার খাওয়ার শখ জাগছে তোর? এই সৌরভ, বাসায় ফেরার সময় মনে করিস তো। আমাদের আমিরা বাবুর জন্য একটা ফিডার আর ল্যাকটোজেন কিনে নিয়ে যাব। সবাই মিলে কোলে তুলে খাওয়াতে পারবি না?”
তাজ ভাইয়ের কথা শুনে টেবিল জুড়ে হাসির হিড়িক পড়ে গেল। হাসতে-হাসতে একজন আরেকজনের ওপর ঢলে পড়ার জোগাড়। আমিরা আপু মুখটা পাংশুবর্ণ করে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। বেচারি নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল। মনে-মনে হয়তো অপমান বোধ করল। খাবার থামিয়ে রাগ ঝাড়ল আমাদের ওপর। ধমকের সুরে বলল,
“রাক্ষসের মতো হি-হি করছিস কোন দুঃখে? হাসি থামাবি, না উঠে চলে যাব আমি?”
এতেও কারোর হাসি যেন থামতেই চাইল না। এরমধ্যে আবার শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“আহা আমিরা! রাগ করছো কেন? বাচ্চাদের এত রাগ করতে নেই। ললিপপ খাবে, বাবু?”
ব্যস, এতেই সবার দমফাটা হাসিতে ঘি ঢালা হয়ে গেল। আমি হাসি থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালালাম। ঠিক তখনই পাশ থেকে তাজ ভাই হুট করেই চটাস করে আমার মাথায় এক চা’টি মে’রে বসলেন। হাসির পাল্লায় পড়ে সবাই তা খেয়াল করল না। সঙ্গে-সঙ্গে আমি হাসি থামিয়ে হাতের তালুতে মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে মুখ কুঁচকে বিরক্ত চোখে ওনার দিকে চাইলাম। ওনার তাতে হেলদোল নেই, নির্দোষ ব্যক্তির মতো আমার দিকে তাকালেনও না। তবে আমার দিকে পানির গ্লাসটা ঠেলে দিয়ে চাপা স্বরে কড়া গলায় আদেশ করলেন,
“পানি খা। হাসতে-হাসতে হেঁচকি উঠলে চা’পড়ে মুখের সবকটা দাঁত ফেলে হাসি শিখিয়ে দেবো।”
আমি পানির গ্লাস ছুঁয়েও দেখলাম না। গাল ফুলিয়ে খাবার গলধঃকরন করলাম। ততক্ষণে হাসির হিড়িক কমেছে। তাজ ভাই সবার অগোচরে কড়া চোখে পানি খাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এবারেও আমি ত্যাড়ামি করলাম। কথায়-কথায় চুল টেনে ধরবে, চা’টি মা’রবে, আর আমি বাধ্য মেয়ের মতো তার আদেশ পালন করব? কখনোই না, হুঁহ্। তাজ ভাই আর আমায় জোর করলেন না। টেবিলের সবাই এখনও আমিরা আপুকে নিয়ে বিভিন্ন কথায় মজা করতে ব্যস্ত। বেচারি আমিরা আপু থেঁতো মুখে সবার সাথে লড়ে চলেছে। খাওয়ার আগে বিল নিয়ে মল্লযুদ্ধ করলেও, শেষে ঠিকই বিলটা তাজ সাহেবই দিলেন। এই লোকের কথার সাথে কাজের যদি এক ফোঁটাও মিল থাকত! অযথাই সবার সাথে ঝামেলা করল। সেই নিজেই তো দিলো। তো ঝামেলাটার কি দরকার ছিল? এন্টারটেইনমেন্ট এখানেই! রেস্ট্রন্ট থেকে বেরিয়ে আমিরা আপু জানাল তার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু মার্কেটে ঢুকতে একজনও রাজি নয়। আমিরা আপুর মুখটা চুপসে গেল। কাঁদো-কাঁদো মুখে সে বহু অনুনয়-বিনয় করে সবাইকে রাজি করল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সাথে সবার মার্কেটে ঢুকতে হলো। তবে তাকে দশ মিনিটের মধ্যে কেনাকাটা শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হলো। আমিরা আপু তাতেই সম্মতি জানাল। মার্কেটে ঢুকে অবশ্য একেকজন একেকটা নেড়েচেড়ে দেখতে ভোলেনি। কিনুক বা না কিনুক, মার্কেটে যখন ঢুকেছে তখন নেড়েচেড়ে দেখতে তো হবেই। শেষে দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া, তাজ ভাই, জুম্মান ভাইয়া আর মিনহা আপুও কিছু জিনিস কিনল। সৌরভ ভাইয়া হেসে আমাকে বললেন,
“আপু, খেয়াল করেছেন? একমাত্র আমরা দুজনই কিন্তু সাচ্চা ভদ্রলোক।”
জবাবে আমিও হাসলাম। এই ছেলেটা আমার চোখে সবসময়ই চমৎকার। বাসায় যখন ফিরলাম তখন কাঁটায়-কাঁটায় রাত বারোটা। দীর্ঘ সময়ের ঘোরাঘুরিতে মন ফুরফুরে হলেও, শরীর ক্লান্ত। আম্মি আমাদের দেখেই ছুটল ঠান্ডা শরবত বানাতে। তাজ ভাই নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে-বাড়াতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“সোফায় টাকা ফেলে রেখেছিস কেন? টাকা-পয়সা উথলে পড়ে না কি?”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। সোফায় কখন টাকা ফেললাম? বাসা থেকে বেরোনোর আগে পার্স থেকে পড়েছে না কি? পার্স চেক না করেই আমি দ্রুত পা চালিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম। সোফায় টাকার ট-ও পেলাম না; তবে ছোটো একটা প্যাকেট পেলাম। এখানে তো কোনো প্যাকেট ছিল না। প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা হাতে নিতেই ভেতরের বস্তুর মৃদু শব্দ কানে আসতেই আমার আগ্রহ দ্বিগুণ বাড়ল। দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলতেই অতিশয় সুন্দর এক মুঠো চুড়ি পেলাম। কালো রংয়ের চুড়ি। মার্কেটে ঢোকার পর আমি এই চুড়িগুলো একবার নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম; তবে কিনব-কিনব ভেবেও শেষে কিনিনি। হুট করেই মনটা ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠল। প্যাকেটটা নিয়ে রুমে এসে চুড়িগুলো হাতে পরে দেখার সময় চোখ পড়ল প্যাকেটের গায়ে। কলমের কালিতে সেই গুটি-গুটি অক্ষরে লেখা তিনটা লাইন,
“ওই হাত প্রিয় জিনিস ছুঁয়ে দিয়েও এড়িয়ে যাবার জন্য নয়, আঁকড়ে ধরার জন্য। প্রিয় জিনিস আঁকড়ে ধরতে শেখো, পিচ্চি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here