মনোহরিণী পর্ব -০৯+১০

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
প্রকৃতিতে ঝকঝকে দিনের বিদায়বেলার আয়োজন চলছে। সারাদিন ধরে প্রখঢ় তাপে উত্তপ্ত সূর্যটার তেজ কমে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। তেজবিহীন কমলা রংয়ের সূর্যের কিরণে ধরণীতেও কমলা রংয়ের আভা ছড়িয়েছে। অদূরেই পাশাপাশি দুটো বিল্ডিংয়ের মুখোমুখি বারান্দায় দুজন যুবক-যুবতি দেখা যাচ্ছে। চেহারা অস্পষ্ট হলেও তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা গল্পে মেতে উঠেছে বেশ। হাত নেড়ে কথা বলছে, কখনও মাথা কিংবা শরীর দুলিয়ে প্রাণখোলা হাসির পসরা সাজাচ্ছে। নিজের অজান্তেই কতটা সময় ধরে একলা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি এ দৃশ্য উপভোগ করছি হিসেব নেই। তাদের হাসতে দেখে অযথাই আমিও মুচকি হাসছি। অবচেতন মন সেই প্রথমেই ভেবে নিয়েছে ওই সুখী যুবক-যুবতী যুগল নিশ্চয়ই কপোত-কপোতী। পরিবারের চোখে ফাঁকি দিয়ে দারুণ আনন্দে দুজন প্রণয়ালাপনে মত্ত। আর তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে আমি মত্ত তাদের প্রণয়ালাপন উপভোগে। বিকেলের লুকোচুরি গল্প। কথাটা ভাবতেই আমার ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসির রেখাটা দীর্ঘ হলো।
“অন্যের প্রেমে বদ নজর না দিয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে ফোন লাগালেই পারিস।”
আমি খানিক চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালাম। তাজ ভাই সূক্ষ্ম চোখে সামনের বিল্ডিংয়ের কপোত-কপোতীদের দেখছেন। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কথায়-কথায় এই বয়ফ্রেন্ডটা কোত্থেকে টপকে আনেন আপনি?”
“বয়ফ্রেন্ড নেই বলে পনেরো বছর বয়সে যার আফসোসের অন্ত ছিল না, উনিশে এসে কি তার আফসোস শেষ হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?”
এই একটা কথাই আমার এত সুন্দর মুহূর্তটাকে গুড়েবালি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিরক্তির সুরে বললাম,
“আমার এসব আফসোস কোনোকালেই ছিল না। ভালোও লাগত না এসব।”
উনি এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। চোখের পলকে পকেট থেকে সেই অভিশপ্ত চিরকুট বের করে মেলে ধরলেন। এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“আমি কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না।”
আমার মেজাজ এবার সপ্ত আসমান ছুঁলো। ওনার হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনি চিরকুটটা হাতের মুঠোয় মুড়িয়ে সরিয়ে নিলেন। আমি গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। থমথমে গলায় বললাম,
“এই ফালতু চিরকুট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান কেন? আপনি এখনও বিশ্বাস করেন, আমি এটা লিখেছি?”
“না করার কারণ আছে?”
ওনার ত্যাড়া উত্তর শুনে আমি আর ফিরেও তাকালাম না। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলাম। কন্ঠনালিতে হাজারো শব্দের ভীড় জমেছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি উগড়ে দিতে। সবটাই চিরকুট বিষয়ক। এই পর্যন্ত তো আমার কাছে কম চিরকুট জমা পড়ল না! প্রেরক চিনেও চিনি না ভান ধরে পড়ে আছি দিনের পর দিন। মাঝেমাঝে নিজেকে সেই ছয় বছর আগের মতোই হাঁদারাম মনে হয়। প্রথম পাওয়া চিরকুটটার প্রেরক খুঁজতে গিয়ে কী বোকাটাই না হয়েছিলাম! তারপর অবশ্য ওই হাতের লেখা চিনতে আমার বেশি দেরী হয়নি। প্রতিটা চিরকুটে ওই হাতের লেখা দেখে-দেখে এখন আর বিভ্রান্ত হতে হয় না। আজকাল ওই হাতের লেখা চিরচেনা মনে হয়। এক নজর দেখলেই চিনে ফেলার মতো। সোজা কথায় বলতে গেলে মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রেরক চেনার পর আমার শান্তশিষ্ট মস্তিষ্কটা যতটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি জড়তায় আড়ষ্ঠ হয়েছে। একের পর এক কনফিউশন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। ওনার চিরকুট আর কর্মকাণ্ডের যে অদ্ভুত অর্থ আমার মন খুঁজে বের করে, তা বেপরোয়া মস্তিষ্ক মানতে নারাজ। এই অদ্ভুত লোকের, অদ্ভুত মনের, অদ্ভুত অর্থের সত্যতা কি আদৌ বিশ্বাস করার মতো? এই তো, বরাবরের মতো মাত্রই আবার কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিলো সে আজও আমায় অবিশ্বাস করে। তার মনে আজও আমায় নিয়ে ভুল ধারণা জেঁকে বসে আছে। সর্বোপরি সে আজও আমায় কিছুটা হলেও অপছন্দ করে। ঠিক কোন রূপটা বিশ্বাস করা উচিত আমার? প্রশ্নটা মাথায় এলেই ইচ্ছে করে সবকটা চিরকুট ওনার মুখের ওপর ছুঁড়ে মে’রে উত্তর জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু পরক্ষণেই আর সাহসে কুলায় না। একা মনে হাজারটা কথার ফুলঝুরি সাজালেও, ওনার সামনে দাঁড়াতেই সব গুলিয়ে ফেলি। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি, লজ্জা আর সংকোচে প্রশ্ন গুলিয়ে ফেলি। উত্তর আর আমার পাওয়া হয়ে ওঠে না। ইদানিং আর ওসব প্রশ্ন নিয়ে ভেবে ম’রি না। সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমি খুব করে টের পাই, এটাই হয়তো আমার কাল হবে। ওনার অদ্ভুত কর্মকাণ্ড আর জ্বালাতনের মাত্রা বাড়ার সাথে-সাথে যে আমার পুরোনো অনুভুতিটাও হুটহাট উঁকি মে’রে সাবধান বাণী ছুঁড়ে মা’রছে, এসব ঠেকানোর সাধ্য কি আমার আছে? সামনের বিল্ডিংয়ের কপোত-কপোতীদের মান-অভিমানের পালা এসেছে বোধ হয়। আগের হাসি, গল্প বন্ধ করে মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর ছেলেটা বোধ হয় প্রেয়সীর অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। মেয়েটা অভিমানের ঝুলি নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে চলে গেছে। ছেলেটা তাকে বার কয়েক উঁচু গলায় ডেকে সাড়া না পেয়ে চুপ মে’রে তাকিয়ে রইল প্রেয়সীর বারান্দায়। পাশ থেকে তাজ ভাইয়ের মৃদু হাসির শব্দ শুনে আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম। উনি সামনে দৃষ্টি রেখে হাসছেন। প্রশ্ন করলাম,
“হাসছেন কেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। সময় নিয়ে হাসি থামালেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললাম,
“আজকাল খুব পাঞ্জাবিপ্রেমী হয়ে গেছেন। এখন যদি বলি আপনার গার্লফ্রেন্ড পরতে বলেছে বলে সব ছেড়ে হুট করে পাঞ্জাবির প্রেমে পড়ে গেছেন?”
উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। তাচ্ছিল্য মিশে আছে বোধ হয়। দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আমার মুখে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বেশ অ্যাটিটিউড নিয়ে বললেন,
“ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার কারো মর্জিতে লাইফ লিড করে না। মাই লাইফ, মাই চয়েস।”
আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে মাথা দোলালাম। মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় সামনে দৃষ্টি ফেরালাম। সামনের বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে প্রেমিক পুরুষটাও চলে গেছে। পাশ থেকে তাজ ভাই চলে যাচ্ছেন টের পেয়ে ফিরে তাকালাম। ততক্ষণে উনি চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। স্লাইডিং ডোরের পাশের ফাঁকা চেয়ারে দৃষ্টি আটকাল। চকলেট বক্স। এগিয়ে গিয়ে বক্সটা হাতে তুলতেই চেয়ারে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখলাম। নিশ্চিত আরও একটা চিরকুট যোগ হলো। বক্সের নিচে চাপা দেওয়া ছিল। কাগজটা মুঠোয় নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। চকলেট বক্সটা কোলের ওপর রেখে চিরকুটের ভাঁজ খুলে চোখ বুলিয়ে চললাম।

চকলেট লাভার,
টিভিতে চকলেটের বিজ্ঞাপন দেখে ওভাবে ঠোঁট উলটে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকো না। বেচারা বিজ্ঞাপনদাতাদের পেটব্যথা হলে দায় কে নিবে? এবার চকলেট গলধঃকরন করে বেচারাদের উদ্ধার করো। বলা তো যায় না, যদি ওই বদ নজর লেগে যায়? সাবধান, সব একসঙ্গে সাবার করা নিষেধ।
ইতি
চকলেট হেটার্স

চিরকুট পড়ে আমি দাঁতে জিব কা’টলাম। ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। চকলেট লাভার, চকলেট হেটার্স! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! তাড়াহুড়ো করে চকলেট বক্স খোলা ধরতেই স্লাইডিং ডোরে টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দরজার ওপাশে দাঁড়ানো তাজ ভাই আদেশ জারি করলেন,
“আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ। কথার হেরফের যেন না হয়।”
আমি পালটা প্রশ্ন করার সুযোগটুকুও পেলাম না। উনি হুট করে যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই চলে গেলেন। আমার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। আদেশের মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ কেন। দুই ঘন্টা বাসার বাইরে কী হবে? আজব! তাছাড়া আমি তো বাসা থেকে বেরোলে আমিরা আপুদের বাসা ছাড়া একা কোথাও যাই না। তা-ও তো আমিরা আপুদের বাসা এই ফ্লোরেই। তাহলে? অনেক ভেবেচিন্তেও সন্তোষজনক কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। আমিরা আপুদের বাসায় গেলে কি জানতে পারব? তারা নিশ্চয়ই জানে বাইরে কী হচ্ছে। বেলকনি থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। দরজা বন্ধ, মানে বিপজ্জনক লোক এখন বেরোবে না। ছুটে গিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে চকলেট বক্স আর চিরকুটটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আবার ছুট লাগালাম। সদর দরজা খুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ মানে তো বাসার বাইরে পা রাখা যাবে না। আমিরা আপুদের বাসায় যেতে হলে তো বাইরে পা রাখতেই হবে। পরক্ষণেই ভাবলাম আমিরা আপুদের বাসায় গেলে কিছু হবে না। দরজা খুলে দ্রুত চললাম তাদের বাসায়। দরজা খুলে দিলো মিনহা আপু। আমাকে দেখে দরজার সামনে থেকে সরেও দাঁড়াল না। কেমন অসন্তুষ্ট সুরে বলল,
“আপু বাসায় নেই। কেন এসেছিস?”
আমি খানিকটা নয়, অনেকটাই অবাক হলাম। ইতঃপূর্বে কোনোদিন এই বাসায় আসার কারণ থাকা লাগেনি আমার। অযথা এলেও কেউ প্রশ্ন করেনি। অপ্রস্তুত হেসে বললাম,
“তোমাদের কাছেই এসেছি। সামনে থেকে সরবে না?”
মিনহা আপু একবার ভেতরে তাকিয়ে চুপসানো মুখে সরে দাঁড়াল। তাকে পাশ কা’টিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমার পা থেমে গেল। ড্রয়িংরুমে বসা মিনহা আপুর বন্ধুরা সবার দৃষ্টি তখন আমার দিকে। এদিকে আমি না পারলাম এগোতে, না পারলাম পেছোতে। ততক্ষণে মিনহা আপুর দুজন বন্ধু সোফা ছেড়ে উঠে হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে-করতে এগিয়ে এল। অগত্যা আমি কাঁচুমাচু মুখে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করলাম। আড়চোখে একবার মিনহা আপুর দিকে তাকালাম। সে এখনও চুপসানো বেলুনের মতো মুখ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনহা আপুর একজন বন্ধু কেমন অদ্ভুত হেসে বলল,
“শুনলাম আমাদের নামে নালিশ করেছ মিনহার ভাইয়ার কাছে? কেন গো সুইটি? তোমার কী ক্ষতি করেছি আমরা?”
আরেকজন সকৌতুকে বলল,
“ড্রিংকসই তো করেছি বাবু। এটুকুতেই নালিশ করে মিনহাকে বকা শুনালে? কিছু করলে না হয় মানা যেত।”
সোফায় বসা আরেকজন টিপ্পনী কে’টে বলল,
“এখন করে দিলে?”
সঙ্গে-সঙ্গে সবাই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। মিনহা আপু দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে বলল,
“তুই এখন বাসায় যা। পরে আসিস।”
সুযোগটা হাতছাড়া না করে আমি সায় জানিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই পেছন থেকে মিনহা আপুর উদ্ভট বন্ধুটা চোখের পলকে সামনে এসে দাঁড়াল। আমি হকচকিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলাম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা বাড়ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। বাসায় কি আর কেউ নেই? আন্টিকেও তো দেখছি না।
“আররে সুইটি, কিউট মুখটার এই অবস্থা হয়ে গেল কেন? ভয় পাচ্ছ না কি?”
এবার আমার পা-ও কাঁপতে লাগল। মিনহা আপু ব্যস্ত হয়ে বন্ধুদের থামতে বলল‌। তবু কেউ থামল না। অসভ্যের মতো বিভিন্ন কথা বলাবলি করতে লাগল। আমি অসহায় মুখে মিনহা আপুর দিকে তাকালাম এই আশায় যে, সে তার বন্ধুদের ধমক দিয়ে হলেও থামাবে। কিন্তু সে শান্ত স্বরে বুঝানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আমি কিছু বলতে পারছি না এই ভেবে যে, মিনহা আপু আবার আমার ওপর রেগে থাকবে। তার চেয়ে বরং এখান থেকে বেরিয়ে যাই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা সরছেও না। বেশিক্ষণ সুযোগ খুঁজলাম না। ছেলেটা পাশ কাটিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে ছেলেগুলো ডাকাডাকি করছে। সেদিকে আর কান দিলাম না। রাগে শরীর রি-রি করছে। এই অসভ্য ছেলেগুলোর সাথে মিনহা আপুর ফ্রেন্ডশীপ করার কি দরকার ছিল? দুনিয়াতে কি আর কোনো মানুষ ছিল না? বাসায় ঢুকতেই দ্বিতীয়বারের মতো আমার পা থমকাল। মুখের রাগী ভাব উধাও হয়ে কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। সোফায় বসা ডিটেকটিভ মহাশয়ের অগ্নিদৃষ্টি মুহূর্তেই বুকের ভেতর দামামা বাজাতে শুরু করল। অথচ মহারাজ না মুখ খুলছেন, না চোখ ফিরাচ্ছেন। গোবেচারা আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চোরের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে চলে যাওয়া ধরতেই উনি ঠান্ডা গলায় বললেন,
“নিষেধ করেছিলাম বাইরে বেরোতে।”
আমার আর পালানো হলো না। অপরাধীর মতো মুখ করে নিচু স্বরে বললাম,
“অন্য কোথাও যাইনি তো। ওই বাসায় গিয়েছিলাম।”
“তা কি এই বাসার ভেতরে?”
আমি অসহায় মুখে না-বোধক মাথা নাড়ালাম। এবার উনি উঠে দাঁড়ালেন।‌ দু’পা এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বললেন,
“লাফালাফি না করলে শান্তি পাওয়া যায় না? দুটো ঘন্টা বাসায় থাকতে বলেছি, তাতেও কৌতুহল সামলানো যায়নি? সমস্যা কী তোর? মিনহার ভদ্র বন্ধুগুলোর প্রতি এত টান?‌ তা, এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো কেন? কোলে তুলে আদর না করেই ছেড়ে দিলো?”
আমি মাথা নিচু করে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে আছি। উত্তর দিলেই নিশ্চিত মাথায় তুলে আছাড় মা’রবে। তবে এবার বুঝতে পারলাম যে, মিনহা আপুর বন্ধুরা এসেছে বলেই আমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। কারণটা তখন বললে কি আর আমি যেতাম? ব’দ লোক। এখন আবার আমাকেই ধমকাচ্ছে। আমার কী দোষ? ওনার ধমকা-ধমকির শব্দে আম্মি ছুটে এল। সঙ্গে-সঙ্গে আমি দ্রুত আম্মির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মি তাজ ভাইয়ের ধমকা-ধমকির কারণ জানতে চাইলে উনি বেশ রেগেমেগে কারণ বললেন। তবে মিনহা আপুর বন্ধুদের আমার সাথে করা আগের আচরণের কথাটা চেপে গেলেন। আম্মি তাজ ভাইকে থামানোর চেষ্টা করে বললেন,
“হয়েছে, এবার রাগ কমা। ও কি জানত তুই কেন বারণ করেছিস? জানলে তো যেত না। শুধু-শুধু মেয়েটাকে এভাবে বকিস না বাবা। ওর আব্বু-আম্মু শুনলে কষ্ট পাবে।”
উনি ত্যাড়াভাবে বললেন,
“আন্টি-আঙ্কেলকে আমি নিজেই জানাব। তারপর দেখব ও আঙ্কেলের বকা থেকে কীভাবে বাঁচে। আগামী দুই দিনে একবারের জন্যও বাসার বাইরে পা রাখলে পা ভেঙে রেখে দেবো।”
“আচ্ছা বলিস। এখন চুপ কর না।”
“কিসের চুপ করব? একটা কথাও শোনে তোমাদের আদরের দুলালি? ওকে তো দু ঘা লাগানো উচিত। দেখি সরো, পেছনে পালিয়েছে কোন সাহসে?”
“কে বলেছে শোনে না? ও এমনিতেই শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ইলো, চলো তো এই বাঁদরের কাছ থেকে।”
আম্মি আমার হাত ধরে টেনে ড্রয়িংরুম থেকে রুমে নিয়ে এল। বলল,
“তাজ রেগে গেলে ভুলেও আর কখনও ওর কাছে থাকবে না। জানো না ও কেমন? কখন এটা-ওটা ধরে ছুঁড়ে মা’রে, ঠিক নেই। একেকটা ভিন্ন প্রজাতির মানুষ নিয়ে আমার সংসার। সামনে যেয়ো না এখন। দেখি গিয়ে কী করছে।”
আম্মি চলে যেতেই আমি অন্ধকার মুখে গাল ফুলিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লাম। পা দুটো বিছানায় উঠিয়ে থম মে’রে রইলাম। মন খারাপ লাগছে। অকারণে এত বকার কী ছিল? ওনারই তো দোষ। ছোটো পেয়ে আমার ওপরেই অযথা রাগ ঝাড়ে। যাবই না আর সামনে। বিছানার একপাশে পড়ে থাকা চকলেট বক্স আর চিরকুটের দিকে তাকালাম। চিরকুটটা খুলে আবার পড়লাম। আমি কীভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম তা উনি দেখেছেন ভেবেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। কী বাজে ব্যাপার! চকলেট বক্সটা হাতে নিয়ে পরক্ষণেই আবার দুটো জিনিসই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম পূর্বের জায়গায়। এখন আমি খাবোও না, লজ্জাও পাব না। এটা অভিমানের সময়। চকলেট খেলে অভিমান কমে যাবে। ওসব পরে খাব। অনেকটা সময় পার হবার পর আর একভাবে বসে থাকা সম্ভব হলো না। পা দুটো ধরে গেছে। আম্মিও আর এল না। ড্রয়িংরুমে কুরুক্ষেত্র হলেও এ মাথায় আমার রুমে বসে তা শোনা যায় না। বাইরে যেতেও আর ইচ্ছে করছে না। পড়তে বসলে মনোযোগ আসবে না। ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটার পর ঘুমে দুচোখ বুজে এল। কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি হিসেব নেই। শেষে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ বন্ধ করেই মুখের আর গলায় ঘাম মুছতে লাগলাম। ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। লোড সেডিং হলো না কি? গরমটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পায়ের কাছে ওপাশ ফিরে বসে থাকা ব্যক্তিকে দেখেই লাফিয়ে উঠে বসলাম। উনি পেছন না ফিরেই বলে উঠলেন,
“দুই মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বের হ। কুইক।”
ঘুম থেকে উঠেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ধমকা-ধমকি করে এখন আবার নিজেই এসেছে আদেশ দিতে। তার ওপর আবার দেখলাম ফ্যানের সুইচ অফ করা। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করলাম। কপট রাগ দেখিয়ে আপন মনে বকবক করতে লাগলাম,
“খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই। গরমে অতিষ্ঠ করে আদেশ দিতে আসে। মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে।”
বিছানায় ফিরে এসে ফোনে সময় দেখলাম। রাত এগারোটা ছাব্বিশ বাজে। এতটা সময় ঘুমিয়েছি! আম্মি জাগাল না কেন? খেতেও ডাকেনি না কি? এমনটা তো কখনও হয় না। না কি আমিই ডাক শুনিনি? তা-ই হবে হয়তো।
“দুই মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে। বসে থাকতে বলিনি।”
তাজ ভাইয়ের কথায় আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কিঞ্চিত রাগত স্বরে বললাম,
“রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যাচ্ছে। এখন আমি আবার ঘুমাব। ফ্রেশ হয়ে কি করব এখন? ডিনার করব না আমি। আপনি এখানে বসে আছেন কেন?”
“যেতে বলেছি।”
আমি উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। উনি মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। তারপর হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে টেনে বিছানা থেকে নামালেন। নামিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি মোচড়া-মুচড়ি করেও ছাড় পেলাম না। ভেবেছিলাম খাওয়ার জন্য টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। অথচ উনি আমাকে নিয়ে ডাইনিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলেন। সদর দরজা খুলতে দেখেই আমি অবাক হলাম। ছাড় পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবে। ব’জ্জাত লোক মুখে কুলুপ এঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে সোজা লিফটে ঢুকে পড়লেন। অতঃপর আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার বিরক্তি, রাগ সব উগড়ে দিয়ে বারবার করে বললাম আমায় বাসায় রেখে আসতে। এই রাত-দুপুরে ওনার সাথে কোথাও যাওয়ার শখ নেই আমার। আমার হাজারটা কথায় উনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। উলটো আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে আমার পরনের ওড়নার একপাশ মাথায় তুলে দিতে-দিতে শান্ত স্বরে বললেন,
“চু’রি করতে নিয়ে যাচ্ছি না। নিশাচর হতে যাচ্ছি।”
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
আকাশে আজ মস্ত বড়ো এক চাঁদের রাজত্ব। চারপাশের মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো প্রজার মতো চান্দ্ররাজকে ঘিরে রেখেছে। রাজা হাসছে, প্রজারাও হাসছে। এ যেন এক ঝলমলে হাসির রাজ্য। এই মনকাড়া হাসির রাজ্যটা কি কিছু সময়ের জন্য দূরত্ব কমাতে পারে না? এই যে পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার। এতটা দূর থেকে তাকে কেবল দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই তার রাজ্যে অবতরণ করা যায় না। এর থেকে আফসোসের বিষয় আর কী আছে? তবু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এত দূর থেকে এ রাজ্যের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কতশত জল্পনা, কল্পনা, স্বপ্ন সাজাই! ওই আকাশ কি জানে, তার কত কদর? হয়তো জানে, হয়তো জানে না। তবু তো সে সৌন্দর্য বিলাতে এক ফোঁটাও কার্পন্য করে না। আহ্, কী নিঃস্বার্থ সৃষ্টি! মাথা তুলে বহুদূরের ওই আকাশ দেখা খুব বেশি সময় স্থায়ী করতে পারলাম না। পথ চলছি, কখন না আবার হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আকাশ থেকে মাটিতে দৃষ্টি ফেরাতেই চারদিকের অজস্র বৈদ্যুতিক বাতির ভীড়ে চাঁদের আলোর বড্ড অভাব বোধ করলাম। এই বাতিগুলোর কারণে চাঁদের আলো উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ইচ্ছে করছে এসব বৈদ্যুতিক বাতিগুলো বন্ধ করে দিতে। চারদিকে শুধু চাঁদের ঝকঝকে আলো ছড়িয়ে থাকত। দুহাত মেলে সে আলো কুড়িয়ে নিতাম। জ্যোৎস্না স্নানে গা জুড়াতাম। শরীর, মন স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যেত। কিন্তু হায়! এ সবের সাধ্য তো আমার নেই। নিছক কল্পনা করেই তুষ্ট থাকতে হবে। এসবের পরেও কিন্তু আজ আমার মন ফুরফুরে। মন খারাপ তাকে একদমই ছুঁতে পারছে না। এই যে গত আধঘন্টা যাবত পায়ে হেঁটে মধ্যরাতের শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি, মন খারাপের ফুরসত পাই কীভাবে? দিনবেলার সেই কানে তালা লাগানো কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ বলে বুঝানোর মতো নয়। রাস্তায় সাঁই-সাঁই করে একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে। পথচারীদের মধ্যে দিনবেলার মতো বাড়াবাড়ি রকমের তাড়া নেই। প্রত্যেকটা শপ, মার্কেট, রেস্ট্রন্টে ভীড় কিন্তু কমেনি। জায়গায়-জায়গায় লোকজনের আড্ডা। রাস্তার পাশের বিলবোর্ড, নিয়ন বাতির ঝকমকে আলোর নিচে আমরা পাশাপাশি পথ চলছি। মধ্যরাতের শহর ভ্রমণ। আহ্! কত কালের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ! ভাবতেই তাজ ভাইকে ইয়া বড়ো একটা ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না, জানাব না। আমি কি বলেছিলাম নিয়ে আসতে? নিজ ইচ্ছায় যখন নিয়ে এসেছে, তখন এসব ধন্যবাদ না পেলেও চলবে তার। আমি বরং উপভোগ করি। হুট করে মানসপটে অতিশয় সুন্দর এক মুহূর্ত ভেসে উঠল। এই যেমন, ঠিক এমন একটা মুহূর্তে আমি শাড়ি পরিহিতা আর ভ্রমণ সঙ্গী পাঞ্জাবি পরিহিত। দুজন হাতে হাত রেখে গন্তব্যহীন হাঁটব। কারো মুখে কোনো কথা থাকবে না। মনে-মনে হবে যত কথা। চোখে-চোখে হবে অনুভূতি আদান-প্রদান। দুজন চুপটি করে সুন্দর মুহূর্তটাকে উপভোগ করব। আম্মুর ভাষ্য অনুযায়ী, এসব জল্পনা-কল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে জামাইয়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। কপাল! আজকের ভ্রমণ সঙ্গী পাঞ্জাবি পরিহিত হলেও, আমি বেচারি শাড়ির অভাবে ভুগছি। হতে-হতে পূরণ না হওয়া আরেক স্বপ্নের জন্য মায়া হলো। আহারে! পাশে চোখ পড়তেই তাজ ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওনার দৃষ্টি দেখে আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। হঠাৎ এভাবে তাকানোর কী হলো?‌
“গোবরগাদা মাথাটা আজাইরা চিন্তায় নষ্ট না করে, সময়টা উপভোগ করতে শেখ। বলদ মাইয়া। আর তোর ধন্যবাদের আশায় আমি ম’রে যাচ্ছি না। দয়া করে নিয়ে এলাম বলে এত সুন্দর সময়টা উপভোগের সুযোগ পেলি। নষ্ট করলে তো পরে আফসোসে ম’রে যাবি।”
আমি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঠোঁট উলটালাম। এই মহাবিপদ যে মাইন্ড রিডিংয়ের প্রতিভার অধিকারী, তা ভুললে চলবে কী করে? তবু বললাম,
“প্রথমত আমার মাথা গোবরগাদা না। দ্বিতীয়ত আমি বলিনি আপনাকে দয়া দেখাতে।”
সঙ্গে-সঙ্গে তাজ ‌ভাই পা থামালেন। তাকে দেখে আমিও থামলাম। উনি সোজাসাপ্টা বলে দিলেন,
“তাহলে যা, বাড়ি ফিরে যা। আর নিব না তোকে। দয়া উঠিয়ে নিলাম।”
আমি হকচকিয়ে উঠে বললাম,
“এতদূর থেকে আমি একা ফিরব কীভাবে?”
“রিকশায় চড়ে।”
আমার উৎফুল্ল মনটা নিমেষেই খারাপ হয়ে গেল। কত দিনের ইচ্ছা আজ পূরণ হলো, অথচ এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে? আমার তো আরও অনেকটা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। বাড়ি ফিরলে মনের অবস্থা যা-তা হয়ে যাবে। উনি সত্যি সত্যিই একটা রিকশা দাঁড় করালেন। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মামা, যাবেন?”
“কই যাইবেন?”
“ডি ব্লক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স বিল্ডিংয়ের সামনে।”
“না মামা, যামু না,” নাকচ করে দিলেন রিকশাওয়ালা।
আমি কাঁদো-কাঁদো মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রিকশাওয়ালা চলে যেতেই ভদ্র মেয়েটির মতো বললাম,
“এসেই যখন পড়েছি, তখন ঘুরেফিরেই যাই। এখন ফিরলে যেখানে যাব, পরে ফিরলেও সেখানেই যাব। তাছাড়া এই মধ্যরাতে একা ফিরতে আমার ভয় লাগে।”
উনি আমার মাথায় চাটি মে’রে শ্লেষের সুরে বললেন,
“ঢং শিখেছিস? সারা শহর টাইটাই করে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে, তা বলতে লজ্জা করছে? ফাজিল। চল, হাঁটা দে।”
ওনার ঝাড়ি শোনার পরও আজ আমার রাগ উঠল না। বরং বাড়ি ফিরতে হবে না বলে খুশি হয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু এবার খানিকটা পথ হাঁটা দিতেই বুঝলাম আমি হাঁপিয়ে উঠছি। এতটা পথ হাঁটার অভ্যাস নেই যে। হাঁটতে না পারলে ঘুরব কী করে? ধীরে-ধীরে আমার হাঁটার গতি মন্থর হয়ে পড়ার সাথে মনটাও খারাপ হতে চলল। তাজ ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“এ পিচ্চি, হাঁটতে জানিস না, অথচ ঘোরাঘুরির শখ মাথায় ঢুকিয়ে বসে থাকিস কোন আক্কেলে? আমি তোর বয়ফ্রেন্ড লাগি না যে, কোলে তুলে হাঁটব। হাঁটতে যখন পারিস না, তখন বাইরে বেরোনোর সময় ওয়াকার সাথে নিবি। বাচ্চা পোলাপান নিয়ে যত জ্বালা!”
“আমার অভ্যাস নেই বলে হাঁপিয়ে গেছি। এটা নিয়েও আপনার পচাতে হবে?”
“ভালো পিচ্চিদের পচানো যায়। তোকে আর কী পচাব? তুই কি নিজেকে ভালো ভাবিস?”
“আমাকে কোন দিক থেকে খারাপ মনে হয় আপনার?”
“বলব?”
“শুনি।”
উনি চোখ ঘুরিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
“থাক, বললে এই পাবলিক প্লেসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতে পারিস। তারপর দেখা গেল পাবলিক তোকে পাগল ভেবে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর সব ঝামেলা এসে পড়েছে আমার মাথার ওপর। আমি এসব মেয়েলি ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমি অতি ভদ্র, নির্ভেজাল একটা ছেলে। তোর জন্য নিজের প্রেস্টিজ পাংচার করার প্রশ্নই আসে না। সো, অফ যা পিচ্চি।”
আমি ত্যাড়াভাবে প্রতিবাদ করে বললাম,
“ফালতু কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? আমাকে কেন খারাপ বললেন, তা আমাকে শুনতে হবে না? আপনার কোন অ’নিষ্ট করে বসে আছি আমি?”
উনি ভ্রু দ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে মুখটা খানিক এগিয়ে এনে বললেন,
“বলব?”
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মাথা ঝাঁকালাম। উনি হাসিমুখে বললেন,
“ভেবে বলিস কিন্তু। হতে পারে কথাটা শোনার পর তুই লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে পড়বি। রিস্ক নিতে রাজি নই আমি।”
“ধুর!”
আমার চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে উঠতেই উনি হাসির রেখা দীর্ঘ করলেন। মাথাটা আরও একটু এগিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“ওই পিচ্চি, দুনিয়ার সব মানুষের সামনে তো সাধু সেজে থাকিস। আমার সাথে ঝগড়া করিস কোন মতলবে, হুঁ? আসলেই কি তুই সবার বেলায় চেঞ্জ হয়েছিস, না কি কেবল আমার বেলাতেই?”
উনি ভ্রু নাচালেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কপট রাগত স্বরে বললাম,
“আপনার বেলায় আমি চেঞ্জ হয়েছি, এমনটা ভাবার কোনো মানে হয় না। সাড়ে পাঁচ বছর আগের মতো আপনার আজাইরা বকা শুনে বোকার মতো কেঁদেছিলাম বলেই যে এখনও কাঁদব, এমনটা ভাবছেন বুঝি? বয়সের সাথে পরিবর্তনটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মিথ্যে বিষয় নিয়ে কষ্ট পাওয়ার সময়টা এখন আর নেই, ডিটেকটিভ সাহেব।”
কয়েক মুহূর্ত তাজ ভাইয়ের কোনো জবাব পাওয়া গেল না। পেছন ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করল না। উনি কি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? ভাবতে ভাবতেই মাথায় গাট্টা পড়ল। সেই সাথে তাজ ভাইয়ের ব্যঙ্গপূর্ণ বাক্য।
“যতই জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলিস, আসলে তুই আজীবন বলদই থেকে যাবি। গাধি।”
আমি হাতের তালুতে মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে বিরক্ত চোখে চাইলাম। তাতে ওনার ভ্রুক্ষেপ নেই। উনি পাশের শপের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,
“কিডন্যাপ হতে না চাইলে চলে আয়।”
অগত্যা ওনার পিছু নিলাম। বিরক্তিটা এড়ানোর চেষ্টা করলাম। এই সুন্দর মুহূর্তটা ভেস্তে দেওয়ার জন্য ওই তাজ নামক আপদ একাই যথেষ্ট। জীবনে প্রথমবারের মতো একটা জামাইয়ের ভয়াবহ অভাববোধ করলাম। মহাশয় থাকলে নিশ্চয়ই আজ আমায় এই বিপজ্জনক লোকের জ্বালাতন সহ্য করতে হত না। মধ্যরাতের এই ভ্রমণটাতে বিরক্তি আসত না। যে শপটাতে ঢুকলাম সেটা বাইরে থেকে সাধারণ মনে হলেও, ভেতরে রেস্ট্রন্টের মতো ব্যবস্থা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এখানে চিপস, বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট জাতীয় খাবারগুলো বিক্রি করা হয়। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ফাস্টফুডের সমাহার দেখে আমি মনে-মনে দারুণ খুশি হলাম। খাবার দেখেই পেট জানান দিলো সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। এখানকার টেবিলগুলো গোল আকৃতির এবং ছোটো। এক টেবিলে দুজন কিংবা তিনজন বসতে পারবে। আমরা একটা টেবিল দখল করে বসলাম। খাবার অর্ডার দেওয়া হলো আমার পছন্দমতো। আজ আর তাজ সাহেব তেমন বাঁধা দিলেন না। ছেলে ভালো হয়ে গেছে, হুঁহ্। খেতে-খেতে উনি বললেন,
“কদিন আগেই দলসুদ্ধ সবকটাকে খাওয়ালাম, আজ আবার তুই। নাহ্, তোদের মতো খাদক নিয়ে আর বাইরে বেরোনো যাবে না। দেখা যাবে অচিরেই আমাকে থালা নিয়ে পথে বসতে হবে।”
আমি ঝোপ বুঝে কো’প মা’রলাম। ভাবলেশহীন উত্তর দিলাম,
“আমি কিন্তু যেচে আসিনি, আর যেচে খেতেও চাইনি। দায়টা আপনার নিজেরই। আমাকে দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই।”
“হ্যাঁ, দায়টা আমার নিজেরই। দশ দিনের অনাহারীর মতো দোকানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে পেটে হাত দিয়ে ঠোঁট উলটেছিলাম তো আমি। তাই না? তোর কি ক্ষুধা পায় না কি? তুই তো মানুষ না, এলিয়েন,” বিদ্রুপ করে বললেন উনি।
আমি দপ করে নিভে গেলাম। চোখ দুটো ছানাবড়া করে লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। উনি এটাও খেয়াল করেছেন! কী লজ্জার ব্যাপার! কিন্তু আমি তো ড্যাবড্যাব করে দোকানের দিকে তাকাইনি। আড়চোখে তাকিয়ে ছিলাম। লোকটা আমাকে পচানোর সময় মুখে লাগাম টানতে জানে না। খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার শুরু হলো পথ চলা। একসময় আমি ইতস্তত করে বললাম,
“এতরাতে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর কথা আম্মি জানলে কী ভাববে?”
“কী ভাববে?”
ওনার ভাবলেশহীন উত্তরে আমি কেবল কাঁধ ঝাঁকালাম। উনি পুনরায় স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
“ভাবার মতো বিশাল কিছু হয়নি যে ভাববে। আর আমার আম্মি সস্তা মেন্টালিটির মানুষ না।”
আসলেই কি ভাবার মতো কিছু হয়নি? এ খবরটা আমিরা আপু পেলে কি সে সহজভাবে নিতে পারবে? অবশ্যই বিশাল কিছুই ভাববে। সবকিছু কেবল এই অদ্ভুত মানবের ক্ষেত্রেই অতিশয় সহজ। হাঁটতে-হাঁটতে আমি রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাজ ভাই প্রয়োজন ব্যতীত তেমন কোনো কথা বলছেন না। ফলস্বরূপ মুহূর্তটা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারছি। আমার অবস্থা দেখে তাজ ভাই উলটো পথ ধরলেন। অর্থাৎ এবার ফেরার পালা। আমার মোটেও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সারারাত যদি এভাবে কাটাতে পারতাম, অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হত। কিন্তু তা হবার নয়। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া মেয়ে আমি। আজকের মতো এতটা দীর্ঘ পথ শেষ কবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলাম, মনেও নেই। তাজ ভাইয়ের মধ্যে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। সেই প্রথম থেকে এই অবধি ফুল এনার্জি সমেত হেঁটে চলেছেন। মর্নিং ওয়াকে অভ্যস্ত উনি। তাছাড়া যে পেশায় আছেন, তাতে এটুকুতেই ক্লান্তি আসা দুরূহ ব্যাপার। এদিকে আমার হাঁটার গতি মন্থর হতে-হতে ঠেলাগাড়ির মতো অবস্থা। এত হাঁটার ফলে গরম তাপমাত্রাটাও বেশ গায়ে লাগছে। রীতিমতো ঘামছি আমি। তাজ ভাই দুটো আইসক্রিম কিনে একটা আমাকে দিলেন, আরেকটা নিজে নিলেন। ভেবেছিলাম ফিরতি পথে ঠেলাগাড়ির মতো পা ঠেলে ঠেলেই ফিরতে হবে। ভাগ্যিস দয়ালু মহারাজ একটা সিএনজি নিয়েছেন। নইলে আমার পা দুটো আজ অকালে অক্কা পেত। আইসক্রিম খেতে-খেতে ফিরতি ভ্রমণটাও মন্দ কা’টেনি। মনে হচ্ছে পথটা এবার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা? এটাই শুরু, এটাই শেষ? এই পথটা কি কোনোকালে আরও একটু দীর্ঘ হতে পারে না?

_________________

সকাল-সকাল মিনহা আপু এল। ধপ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমিই আগে প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে, আপু? মন খারাপ?”
“তাজ ভাইয়ের কাছে নালিশ করাটা কি তোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে, ইলো?”
আমি বুঝতে পারলাম আপু গতকালের কথা বুঝাচ্ছে। কিন্তু আমি কখন ওনার কাছে নালিশ করলাম?
“আমি ওনার কাছে কিসের নালিশ করেছি, আপু? বুঝলাম না।”
“না বুঝার কী আছে? গতকাল আমার ফ্রেন্ডসরা তোর সাথে মজা করেছে বলে তুই তাজ ভাইয়ের কাছে নালিশ করিসনি?”
আমি দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“না।”
মিনহা আপু চটে গেল। এক পা বিছানায় তুলে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“মিথ্যে বলবি না, ইলো। তুই নালিশ না করলে তাজ ভাই ওসব জানল কীভাবে? তুই আমাদের বাসা থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তো তাজ ভাই গেল। আগেরবারের শুধু আমাকে বলেছিল। আর এবার আমার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলসহ বকেছে। আমাকে ওদের কারো সাথে মিশতে দিবে না বলে দিয়েছে। কত কথা বলে অপমান করেছে ওদের, জানিস? এখন আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে লাগাতার কথা শুনিয়ে চলেছে। কেউ আর আমার সাথে মিশবে না জানিয়ে দিয়েছে। সব তোর জন্য হয়েছে। তোকে কি আমি ডেকে নিয়েছিলাম? তুই যেচে গেলি কেন? গেলি তো গেলি, আমি তোকে চলে আসতে বলিনি? প্রথমেই তো বলেছিলাম। তুই নিজেই শুনিসনি। যেচে ওদের সামনে গিয়েছিস, তারপর ওরা একটু মজা করেছে বলেই এসে নালিশ করতে হলো?”
আমি হতবাক হয়ে মিনহা আপুর কথা গিলছি। উনি যে এই কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছেন, তার ক্ষুনাক্ষরও তো আমি জানতাম না। কিন্তু এখানে নালিশের কথা এল কোত্থেকে? আমি তো ওনাকে বলিইনি মিনহা আপুর বন্ধুরা আমার সাথে আবার খারাপ ব্যবহার করেছে। এমনকি উনি নিজেও এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাননি। তাহলে? উনি ভেতরের কথা জানলেন কীভাবে? আশ্চর্য! মিনহা আপু বেশ ক্ষেপেছে। আমি কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে ভাবুক গলায় প্রশ্ন করলাম,
“তাজ ভাই কি বলেছেন যে, আমি ওনার কাছে নালিশ করেছি?”
“বলা লাগবে? আমি কিছু বুঝি না?”
আমি মাথা নেড়ে ঠোঁট উলটে বললাম,
“আমি সত্যিই ওনাকে কিচ্ছু বলিনি।”
“ঢং করবি না তো। তুই না বললে উনি জানলেন কীভাবে? স্পাই লাগিয়েছিলেন তোর পেছনে? আমাকে কি বোকা মনে করিস?”
মিনহা আপু না চাইতেও জোরে চেঁচিয়ে ফেলছে। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। মিনহা আপু পুনরায় মুখ খুলতে যেতেই দরজার ফাঁক দিয়ে হুট করে একটা মাথার উদয় হলো। বিরক্ত ঝাড়ল,
“কী সমস্যা? সকাল-সকাল মাছের বাজার বসেছে? আরেকটু আগে বসালে তো মাছের জন্য কষ্ট করে বাইরে যেতে হত না।”
মিনহা আপু সটান উঠে দাঁড়াল। কাঁদো-কাঁদো মুখে করে আপনমনে কী যেন বিড়বিড় করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ফটাফট বলে উঠল,
“ভার্সিটি যেতে হবে রে ইলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার, টাটা।”
দরজার সামনে গিয়েও আবার দুপা পিছিয়ে এল। যাওয়ার পথ না পেয়ে বেচারির মুখে অসহায়ত্ব। তাজ ভাই যে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে একটু ফাঁক দিয়ে শুধু মাথাটা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তা-ও আবার মিনহা আপুর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভয়ে বেচারির মরি-মরি অবস্থা। না চোখ তুলে তাকাতে পারছে, আর না পালাতে পারছে। বাধ্য হয়ে আমিই বলে বসলাম,
“আপনি সরছেন না কেন, তাজ ভাই? মিনহা আপুর দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
তাজ ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মিনহা আপুর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। জিজ্ঞেস করলেন,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে?”
মিনহা আপু আড়চোখে তাকিয়ে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
“ওই ব’দমাশগুলোর সাথে আবার মিশতে যাবি?”
অগত্যা মিনহা আপু দুদিকে মাথা দোলালো।
“সত্যি?”
এবারে আবার ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
“মনে থাকবে?”
ভুলবশত মিনহা আপু দুদিকে মাথা দুলিয়ে ফেলল। পরক্ষণেই খেয়াল হতেই চোখ দুটো ছানাবড়া করে দ্রুত ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
তাজ ভাই বাঁকা হেসে দরজা আরেকটু খুলে সরে দাঁড়ালেন। মিনহা আপু যেন প্রাণ ফিরে পেল। ডানে-বায়ে না তাকিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে প্রস্থান করল। আমি ভাবলাম তাজ ভাইও চলে গেছেন। এগিয়ে গিয়ে আধখোলা দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই পূর্বের ন্যায় আবার হঠাৎ সেই মাথাটা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মা’রল। অকস্মাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি বুকে হাত দিয়ে দুপা পিছিয়ে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই কটাক্ষ করে হেসে বললেন,
“ওরে সাহসী নারী রে! ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের বাসায় কি না আস্ত এক গাধা বাস করে, কী লজ্জার ব্যাপার!”
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। বললাম,
“আপনি এভাবে ভয় দেখালেন কেন? আমি কি জানতাম আপনি এখনও যাননি?”
উনি গলা উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আম্মি, বাসায় পানি পড়া রাখো না? ঢালীর মেয়ে বাঘ দেখে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে গেছে। থাকলে কাজে লাগাও তাড়াতাড়ি।”
আম্মি হয়তো ডাইনিং রুমেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো,
“তুই আবার ওকে ক্ষেপাচ্ছিস? খেতে আয় বাপ। ইলোকেও আসতে বল।”
উনি দাঁত কেলিয়ে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালেন। ঠাট্টার ছলে বললেন,
“মহারাজ আতাহার ঢালীর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা ইলু ঢালী থুক্কু, রাজকন্যা ইলোরাবতী, আপনার আহার গ্রহণের ডাক পড়িয়াছে। আহার গ্রহণ করিয়া আমার মমতাময়ী আম্মিজানকে উদ্ধার করুন।”
আমি ওনার বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই আবার হাসি থামিয়ে বললাম,
“আপনি কি মাইন্ড রিড করতে জানেন, তাজ ভাই?”
উনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“কেন রে? তোর বয়ফ্রেন্ডের খবর জেনেছি বলে এখন কৌশলে জানতে চাইছিস, আমি কীভাবে ওই গোবেচারার খবর জানলাম?”
আমি হতাশ গলায় বললাম,
“আবার বয়ফ্রেন্ড?”
উনি দরজাটা পুরোপুরি খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মাথা দুলিয়ে কাছে ডাকলেন,
“এদিকে আয়।”
আমি কিছু না বুঝে এগিয়ে গেলাম। ওনার মুখোমুখি দাঁড়াতেই মাথায় ভয়ানক এক চা’টি মে’রে নিচু স্বরে বললেন,
“নেক্সট টাইম চোখে চোখ রেখে কথা বললে চোখ তুলে নেবো, ডাকাত রানি।”
ওনার ওপর রাগ দেখানোর আর সময় দিলেন না। দ্রুত সরে গেলেন। আমি বিরক্ত হওয়ার সাথে অবাকও হলাম। মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখটা আয়নার একদম কাছাকাছি নিয়ে চোখ দুটো বড়ো করে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলাম। আবার একটু দূরে দাঁড়িয়ে পলকহীন চেয়ে রইলাম। কই? ডাকাতের মতো তো লাগছে না। অত বেশি বড়ো না কি আমার চোখ? সবাই তো আমার চোখের কত প্রশংসা করে। আমার প্রশংসা করতে গিয়ে অনেকেই সর্বপ্রথম আমার চোখের প্রশংসাটা আগে করে। সবার প্রশংসা তো মিথ্যে হতে পারে না। এমনকি আমার নিজের কাছেও তো খারাপ লাগে না। জীবনের প্রথম কেউ আমার চোখের ব’দনাম করল। ব’জ্জাত লোক! আমার চোখ ডাকাতের মতো হলে, আপনার চোখ রা’ক্ষসের মতো। রা’ক্ষস ডিটেকটিভ। আচ্ছা, রাক্ষসের চোখ দেখতে কেমন হয়? বিছানায় বসা জেমির দিকে তাকালাম। ও নিজেও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে বসে বিছানায় থুতনি ঠেকালাম। জেমির চোখ দুটো মায়াবী। দেখলে মনে হয় গোল-গোল চোখ দুটোতে কেউ খুব যত্ন করে কাজল টেনে দিয়েছে। ও যখনই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, তখনই ওর সুন্দর চোখ দুটো দেখলেই ওকে আদর করতে ইচ্ছে করে। পাজিটা বোধ হয় আদর পাবার লোভে সারাক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। আমি জেমির মুখটা তর্জনী আঙুলে ছুঁয়ে বললাম,
“জিমজিম, আমার চোখ সত্যিই কি ডাকাতের মতো? তোর মতো সুন্দর না?”
জেমির উত্তর,
“মিয়াও।”
“ওহ্, তুই তো কথাই বলতে পারিস না। বল না রে।”
“মিয়াও।”
“এটা ‘হ্যাঁ’ ছিল, না কি ‘না’ ছিল?”
“মিয়াও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যেহেতু তোর মালকিন, সেহেতু তুই নিশ্চয়ই আমার বিপক্ষে কথা বলবি না, তাই না?”
“মিয়াও।”
“যাহ্, তোর উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ ধরে নিলাম। আমার পোষা বিড়াল হয়ে তুই আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তো আরেক বিপদ। অলরেডি এক বিপদ আমার জীবন বিপদে-বিপদে বিপদময় করে তুলেছে। এর বেশি আর চাই না, ভাই।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here