মনোহরিণী পর্ব -১১+১২

#মনোহারিণী
লেখনীতে —ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
মনোহারিণী,
নিশ্চয়ই ভাবছো তোমার ওই হরিণীর মতো সুন্দর চোখ জোড়া ডা’কাতের সাথে কেন তুলনা করা হলো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ সেদিন চৈত্র মাস ছিল কি না জানি না; কিন্তু ডাগর-ডাগর চোখের মিশমিশে কালো দুটি মণির গভীরে আমার সর্বনাশ ছিল স্পষ্ট। সুদূর সুইডেনের ভিন্ন রংয়ের হাজারটা চোখের মণির ভীড়েও ওই মিশমিশে কালো দুটি মণি আমায় প্রতিটি মুহূর্ত তাড়া করে বেড়াত। তার কাছে যেন সুন্দরী বিদেশিনীদের আকর্ষণীয় চোখও ছিল অতিশয় তুচ্ছ। হরিণীর মতো গভীর চোখ জোড়ায় যে আমি কতশত বার ডুব দিয়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গভীর রজনীর তদ্রাঘোরেও যে চোখ জোড়া কাউকে তাড়া করতে সক্ষম, সে ডা’কাত না তো কী? ডা’কাত বলেই তো সে আমার এতবড়ো সর্বনাশের কারণ হলো। তবু ওই সর্বনাশা চোখেই আমার ভীষণ, ভীষণ দুর্বলতা। ওই ডাকাতের মতো চোখে চোখ রেখে আমি সেই দুর্বলতা প্রকাশ করতে বরাবরই ব্যর্থ। তবু এ আমার ব্যর্থতা নয়, ভীষণ প্রিয় এক স্বার্থকতা।
ইতি,
ডা’কাত রানির চোখের মায়ায় খু’ন হওয়া
এক নীরব মুগ্ধতা

চিঠিটা যতবার পড়লাম, তারচেয়ে বেশি পড়লাম ভীষণ আশ্চর্যজনক ওই লাইনটা, ‘সেদিন চৈত্র মাস ছিল কি না জানি না; কিন্তু ডাগর-ডাগর চোখের মিশমিশে কালো দুটি মণির গভীরে আমার সর্বনাশ ছিল স্পষ্ট।’ এই সেদিনটা আবার কোন দিন? তার ভাষ্য অনুযায়ী ভীষণ দুর্বলতা নিহিত চোখ দুটো দিয়ে বুঝি কেউ সজ্ঞানে অশ্রু ঝরাতে পারে? যে ইতিঃপূর্বে পেরে দেখিয়ে দিয়েছে, তার সর্বনাশের সেদিনটা ঠিক কবে ছিল? সময়টা কখন ছিল? ঠিক কোথায় ঘটেছিল? কীভাবে ঘটেছিল? আদৌ এটা কয়েক বছর আগে ঘটা সম্ভব? যতবারই আমার মনে নানান সন্দেহজনক প্রশ্ন উঁকি মা’রছে, ততবারই এই চিরকুটের প্রতিটা শব্দ জানান দিচ্ছে তারা কেউ ভুল নয়। ভুল-সঠিকের অনুসন্ধানে পড়ে আমার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। একটা মানুষের ভেতর এতটা প্যাঁচ কীভাবে থাকে? এ তো জিলাপির প্যাঁচের চেয়েও ঝামেলাযুক্ত। হুট করে ভাবলাম এক্ষুনি গিয়ে সামনে দাঁড়াব। এই চিরকুট দেখিয়ে মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবো। তাহলে উত্তর না দিয়ে পালাবে কোথায়? মনে বেশ সাহস জুগিয়ে হনহনিয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। আরও একবার প্রমাণ পেলাম আমি আসলে মনে-মনে বাঘের সাথেও যু’দ্ধ করে জয়লাভ করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে ওই চিড়িয়াখানার খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে দশহাত দূর থেকে ড্যাবড্যাব করে বাঘ মামার দিকে তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই আমার দৌড়। মূলত মনে-মনে আকাশ-কুসুম চিন্তা করলেও, বাস্তবে তার কিছুই ঘটাতে পারি না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, জড়তা আর লজ্জা আমার অন্যতম সমস্যা। বহু চিন্তা-ভাবনার পর ফলাফলের স্থানে ইয়া বড়ো এক শূন্য বসিয়ে চিরকুটটা ভাঁজ করে পূর্বের চিরকুটগুলোর সাথে রেখে দিলাম। তারপর এটা ভাবতে ভাবতেই কপাল চাপড়ালাম যে, এত বড়ো একটা প্রমাণ পেয়েও মামলায় সেই হেরেই গেলাম! এই দুঃখ রাখার জায়গা কোথায় পাই আমি? হায় রে! বাইরে থেকে আম্মির ডাক পড়তেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে ছুট লাগালাম। ভার্সিটি যেতে হবে। আম্মি আমাকে দেখে বলল,
“নিচে চলে গেছে। তাড়াতাড়ি যাও।”
অগত্যা আম্মিকে বিদায় জানিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলাম। গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসতেই আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। পাশ ফিরে তাকালেই হয়তো ভয়ানক কোনো কাণ্ড ঘটে যাবে। চোখে চোখ পড়লেই কিছুক্ষণ আগের ওই চিরকুট বিষয়ক প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে। মস্তিষ্ক বারংবার বিপদ সংকেত দিয়ে চলেছে। তারমধ্যে এক টিপ্পনীপূর্ণ বাক্য কানে এল,
“কাকে পছন্দ হয়েছে? রিকশাওয়ালা, না কি ফেরিওয়ালা?”
আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। তাজ ভাই হেসে বললেন,
“যেভাবে তাকিয়ে ছিলি, মনে তো হচ্ছিল নিজের জন্য জামাই পছন্দ করছিস। তো কাকে পছন্দ হলো?”
“আপনার কেন মনে হলো আমি রিকশাওয়ালা বা ফেরিওয়ালা দেখছিলাম?”
“কারণ তোর মতো গাধির কপালে এর চেয়ে ভালো জামাই জোটার সম্ভাবনা নেই।”
আমার ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত দূরত্ব সৃষ্টি হলো। কী অপমান রে ভাই! এই অপমানের প্রতিশোধস্বরূপ আমার উচিত এই গাড়ির নিচেই গর্দান দিয়ে সাধু ডিটেকটিভকে ফাঁ’সিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমি তা করব না। কারণ আমার ঘাড়ে কেবল একটাই মাথা। অকালে ম’রার সাধ নেই আমার। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকা অতীব জরুরী। এই ডিটেকটিভ নামক মা’ফিয়ার বউ বেচারির চাঁদপনা মুখখানি দেখার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে। বিরক্তি ঝেড়ে বললাম,
“সবসময় আপনার মুখে আজগুবি কথা ছাড়া ভালো কথা আসে না? আজকাল আপনি খুব বেশি অদ্ভুত হয়ে গেছেন, তাজ ভাই।”
“প্রতিভা, বুঝলি? অদ্ভুত হতেও প্রতিভা লাগে। সবার এই প্রতিভা থাকে না। আমি গ্রেট বলে আমার প্রতিভাও গ্রেট। তুই তো এক বলদ। এসব গ্রেট প্রতিভার মর্ম বুঝবি না।”
“বুঝতে চাইও না, ভাই। আপনি বুঝলেই হলো।”
ওনার সাথে তর্কযু’দ্ধ থেকে বাঁচতে ফোনে মনোযোগ দিলাম। অনলাইনে ঢুঁ মা’রতেই ভিডিয়ো কল এল। রিসিভ করে সামনে ধরলাম। স্ক্রিনে মিথির বিধ্বস্ত মুখটা ভেসে উঠল। ওকে নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন করলাম,
“কী সমস্যা? অনাহারীর মতো মুখ করে আছিস কেন?”
“মজা করিস না রে আপু। ভীষণ দুঃখে আছি।”
ওর দুঃখের ধরণ যে কেমন হতে পারে, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। অলস ভঙ্গিতে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
“আবার কে ছ্যাঁকা দিলো?”
“অটোওয়ালা।”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম।
“আমি ভার্সিটি যাচ্ছি, এখন তোর ফালতু কথা শুনতে পারব না। ফোন রাখ।”
মিথি ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আরে শোন না। তুই যদি ছেলেটাকে দেখতি, তাহলে বুঝতি। কী হ্যান্ডসাম, ভাই রে ভাই! প্রথমে দেখে তো আমি স্টুডেন্ট ভেবেছিলাম। একদম ফিদা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে হতচ্ছাড়া বলে বসল, ‘কোথায় যাবেন, আপা? ভাড়া কম নিব, আসেন।’ বিশ্বাস কর, আমার ইচ্ছে করছিল ওই অটোতেই মাথা ঠুকতে। এ-ও কী মানা যায়? একটা ক্রাশও ঠিকমতো খেতে পারি না আমি। মাঝপথেই ছ্যাঁকা খেয়ে বসে থাকি। এ দুঃখ কাকে বুঝাই?”
মিথির কাঁদো-কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে আমি খিলখিল করে হেসে চলেছি। হাসির মাঝেই একবার বললাম,
“শেষমেষ অটোওয়ালা?”
তাজ ভাই হঠাৎ ছোঁ মে’রে আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। একহাতে ড্রাইভ করতে-করতে মিথিকে বললেন,
“দুঃখ করিস না, মিথি। তোকে আমার মতো কিউট একটা বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে দেবো। আপাতত ওই অটোওয়ালাকে তোর এই মাথামোটা বোনের জন্য ঠিক করে রাখ। কষ্ট করে আর ওর জন্য ভালো জামাই খুঁজতে হবে না। নইলে পরে বিজ্ঞাপন দিয়েও পাওয়া যাবে না, বুঝলি? এবার গ্রামে গিয়েই শুভ কাজটা সেরে ফেলা যাবে। কী বলিস?”
সঙ্গে-সঙ্গে আমার মুখ থেকে হাসি উবে গেল। ওদিকে এবার মিথি আমার মতো হাসতে শুরু করেছে। হুঁ-হা করে হেসে বলছে,
“একদম ঠিক বলেছেন, তাজ ভাই। এটাই করতে হবে। এত সুন্দর একটা সাজেশন দেওয়ার জন্য এবার গ্রামে এলে আপনাকে খুব বড়ো একটা গিফট দেবো।”
“তুই আবার আমাকে কী গিফট দিবি, পুঁচকি?”
“সে দেখা যাবে সময়মতো। এখন রাখছি। আমার অনেক কাজ। আল্লাহ্ হাফেজ।”
“ঠিক আছে, ব্যস্ত আপা। আল্লাহ্ হাফেজ।”
কল কে’টে উনি আমার দিকে ফোন এগিয়ে ধরলেন। আমি না তাকিয়েই ওনার মতো ছোঁ মে’রে ফোনটা কেড়ে নিলাম। তারপর গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। মনে-মনে জুম্মান ভাইয়াকে কয়েক দফা বকাঝকা করলাম। বেড়াতে যাওয়ার আর সময় পেলেন না উনি? আমাকে এই আপদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নানাবাড়ি বেড়াচ্ছেন। কবে ফিরবেন খোদা জানে। না ফেরা পর্যন্ত ভার্সিটি যাওয়ার সময়টুকুও আমার শান্তি জুটবে না। জীবন ভাজা-ভাজা করে ফেলবে এই বিপজ্জনক লোক। হঠাৎ মাঝপথে তাজ ভাই গাড়ি থামালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছনের সিটে হুড়মুড়িয়ে দুজন লোক উঠে বসল। গাড়ি পুনরায় আগের মতো চলতে শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়েই উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলাম,
“আরে শ্রেয়ান ভাইয়া! কেমন আছেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া স্বভাবসুলভ হেসে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে।”
“ব্যস্ত ছিলাম একটু।”
“আপনাদের ব্যস্ততা মানেই তো ইনভেস্টিগেশন। ওই বাহানায়ও তো একবার বাসায় যেতে পারতেন।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে পাশের লোকটাও সশব্দে হেসে উঠল।
“তা ইলোমিলো, ওই বাসায় গিয়ে কোন কেসের ইনভেস্টিগেশন করতাম আমি?”
আমি হেসে দাঁতে জিব কে’টে বললাম,
“তা-ও কথা।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার পাশের লোকটাকে চুপচাপ দেখে বললাম,
“ওনাকে তো চিনলাম না।”
তাজ ভাই বলে উঠলেন,
“শ্রেয়ান বাদে গোয়েন্দা বিভাগের কজনকে তুই চিনে বসে আছিস, শুনি?”
আমি চোখ দুটো সরু করে বললাম,
“আমি কি করে জানব উনি আপনাদের টিমের লোক? ভেবেছিলাম অন্য কেউ।”
পেছন থেকে লোকটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ম্যাম, আমি নাসের।”
আমি মুখটা ছুঁচলো করে বললাম,
“ওহ্, আমাকে ম্যাম ডাকছেন কেন, ভাইয়া? আমি আপনার অনেক জুনিয়র।”
নাসের ভাইয়া হেসে বললেন,
“তাহলে কী বলে ডাকব?”
তাজ ভাই ফট করে বলে বসলেন,
“আপাতত ডাকাডাকি বন্ধ করো, নাসের। বেশি কথা শুনলে আমার ড্রাইভিংয়ে প্রবলেম হয়।”
নাসের ভাইয়া অনুগত ছাত্রের মতো বললেন,
“সরি স্যার।”
শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে বললেন,
“তোর এই নতুন সমস্যার জন্ম আবার কবে থেকে শুরু হলো? আমি জানতাম না তো।”
তাজ ভাই জবাব দিলেন না। আমি মুখ বাঁকালাম। অযথা ঢং। নাসের ভাইয়ার সাথে একটু পরিচিত হতে চলেছিলাম, তা-ও দিলো না। খারাপ লোক। হুট করে শ্রেয়ান ভাইয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত এক প্রশ্নে আমি বেশ অবাক হলাম। উনি ফোন ঘাঁটতে-ঘাঁটতে প্রশ্ন করে বসলেন,
“পাত্রীকে তোর কেমন লেগেছে রে তাজ?”
চকিতে গোলগোল চোখে তাকিয়ে আমি ফট করে বলে উঠলাম,
“তাজ ভাই বিয়ে করছেন না কি?”
তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,
“কথার আগামাথা না শুনে আগেই প্রশ্ন করে বসলে, স্টেয়ারিংয়ের সাথে গোবরগাদা মাথাটা এক বাড়ি মে’রে ফা’টিয়ে দেবো, ননসেন্স।”
আমি চুপসানো মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি হো-হো করে হেসে বললেন,
“রাজ ভাইয়ের আগে তাজ কেন বিয়ে করতে যাবে, ইলোমিলো?”
“তাহলে কি আপনার বিয়ে?”
“আরে না। রাজ ভাইয়ের।”
এবার আমি আরও বেশি অবাক হয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,
“কিহ্! রাজ ভাইয়ের বিয়ে? কই? আম্মিকে তো কিছুই বলতে শুনলাম না।”
“আন্টি জানলে তো বলবে।”
“অ্যাঁ! রাজ ভাইয়ের বিয়ে, অথচ আম্মিই জানে না!”
ভীষণ বড়ো কনফিউশন পড়ে আমি তব্দা খেয়ে বসে রইলাম। অসহায় চোখে এক ঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে একবার তাজ ভাই, তো আরেকবার শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকালাম।
তাজ ভাই স্টেয়ারিং সামলাতে-সামলাতে বললেন,
“শ্রেয়ান, কাকে কী শোনাচ্ছিস? ওভার থিংকিংয়ে পারদর্শী সে। এক্ষুনি বুঝিয়ে বল, নইলে পা’গল হতে দু মিনিটও লাগবে না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,
“রাজ ভাইয়ের পছন্দের এক মেয়ে আছে, বুঝলে? রাজ ভাই আন্টি-আঙ্কেলের কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তাজকে দিয়ে বলাতে চাইছে। ছবি পাঠিয়েছে তাজের কাছে। সেজন্যই ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম ওর কেমন লেগেছে। আমি এখনও দেখিনি।”
আসল ঘটনা জেনে আমি খুশিতে প্রশস্ত হাসলাম। দারুণ উৎসাহে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ না খুলতেই পা’জি লোকটা গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলেন,
“ছবি দেখতে চেয়ে লাভ নেই। দেখাব না। বাড়ি ফিরে আম্মিকে দেখাব। তার পছন্দ হলে তারপর সবাই দেখবে।”
আমি বিরস মুখে বললাম,
“আমাকে দেখালে কী হবে? রাজ ভাইয়ের বউ আমি দেখব না?”
“দেখবি না কখন বললাম? সময় হলে সবাই দেখবে। সাথে তুইও।”
শ্রেয়ান ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“আমাকেও দেখাবি না?”
“না,” তাজ ভাইয়ের স্পষ্ট উত্তর।
“অল রাইট। তাহলে তোর কেমন লাগল তা তো অন্তত বলতে পারিস।”
“কেন রে? বিয়ে কি আমি করব? না কি সংসার আমি করব? যে করবে তার পছন্দ হলেই হয়। আর তার কথামতো শুধু আম্মির পছন্দ হলেই হবে।”
আমি অনুরোধের সুরে বললাম,
“আমি দেখি না একটু। একটু দেখান, এই একটু। একবার দেখব শুধু।”
কোনো অনুরোধই ধোপে টিকল না। শেষমেষ হতাশ হয়ে আমি কপাল কুঁচকে, গাল ফুলিয়ে রইলাম। আরে ভাই একটা ছবিই তো দেখতাম। একবার দেখালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমি বুঝি খেয়ে ফেলতাম? যতসব ঢং!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
রাজ ভাইয়ের পছন্দের মেয়েকে আম্মির খুব পছন্দ হয়েছে। নূর আঙ্কেলের কাছেও ছবি পাঠিয়েছিল। তিনিও আপত্তি জানাননি। অবশেষে আমাদের বাকি সবার ভাগ্যেও ছবি দেখা জুটেছে। রাজ ভাইয়ের পছন্দের তারিফ করতে ভোলেনি কেউ। সবাই জানামাত্রই রাজ ভাইকে ফোনে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিয়েছে। রাজ ভাই দূরে থেকেও এতে খুব লজ্জায় পড়ে গেছেন। বেচারা আম্মি আর তাজ ভাই ছাড়া এখন আর কারো ফোনই রিসিভ করছেন না। পাত্রী ঢাকাতেই থাকে, তাই আম্মি বেশি দেরী করতে চাইছে না। তার তাড়া দেখে মনে হচ্ছে সে পারলে একদিনের মধ্যেই ঘরে বউ তুলে আনবে। নূর আঙ্কেল জানিয়েছেন, পাত্রীর পরিবারের সাথে কথা বলে তারপর গিয়ে পাত্রী দেখে আসতে। সব ঠিকঠাক হলে তবেই আঙ্কেল দেশে ফিরবেন। ইতোমধ্যে আম্মি পাত্রীর পরিবারের সাথে কথাও বলে ফেলেছে। হিমেল কাকাকে তাড়া দেখিয়ে বলেছে আজই গাড়িতে উঠতে। আগামীকাল সবাই মিলে পাত্রী দেখতে যাওয়া হবে। এই নিয়ে আজ বাসায় হট্টগোল বেঁধে গেছে। আমিরা আপুদের পুরো পরিবার এ বাসায় গেড়ে বসে এই নিয়েই আলোচনা করে চলেছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে স্বয়ং আম্মি। গোবেচারি আমাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। তখন থেকে বসিয়ে রেখে তাদের বিয়ে নিয়ে যত অগ্রিম আলোচনা কানে ঢালা হচ্ছে। অসহায় মুখ করে চুপচাপ এ অত্যাচার গলধঃকরন করছি আমিসহ আমিরা আপু, মিনহা আপু, জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়া। জুম্মান ভাইয়া বিয়ে নামক শব্দ শুনে আজই একপ্রকার উড়ে ফিরে এসেছেন নিজের নানাবাড়ি থেকে। এরপর এলেন সৌরভ ভাইয়া। এসেই খুব উৎফুল্ল চিত্তে জানালেন, রাজ ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে তার পক্ষে হলে শ্বাস নেওয়া আর সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না। তাই আজই ছুটে এসেছেন।‌ যেন বিয়েটা আজই হয়ে যাচ্ছে। অথচ রাজ ভাই জানিয়েছেন, পাত্রী দেখাদেখির ঝামেলা শেষ হলে তারপর উনি আসবেন। বলা চলে, ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া‌ পড়শির ঘুম নেই।’ ওদিকে গ্রাম থেকে মিনিটের আগায়-মাথায় ফোন আসছে। আম্মির মাঝে আজ ন্যূনতম বিরক্তিটুকুও নেই। কী সুন্দর অতি ধৈর্য সহকারে সে প্রত্যেকটা ফোন কল রিসিভ করে খুশিমনে কথা বলছে! পরিবারের বড়ো ছেলের বিয়ে বলেই সবার এত-এত উত্তেজনা। মাঝখান থেকে দুই ভাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
পরদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে পাত্রী দেখতে গেলাম। গাড়ি নেওয়া হলো দুটো। একটার ড্রাইভার তাজ ভাই, আরেকটার জুম্মান ভাইয়া। কিন্তু যখন ছোটোরা সবাই তাজ ভাইয়ের গাড়িতে উঠে বড়োদের জুম্মান ভাইয়ার গাড়িতে ঠেলে দিলো, তখনই জুম্মান ভাইয়া বেঁকে বসলেন। অর্থাৎ সে একা কেন বড়োদের মাঝে থাকবে? এই অবিচার কোনোভাবেই মানতে রাজি নন জুম্মান জহির। শেষে তাকে তাজ ভাইয়ের গাড়িতে পাঠিয়ে হিমেল কাকা ড্রাইভিং সিটে বসলেন। হিমেল কাকা, তার স্ত্রী নাসিমা কাকি, আমিরা আপুর বাবা-মা আর আম্মি এক গাড়িতে। অপর গাড়িতে তাজ ভাই, জুম্মান ভাইয়া, সৌরভ ভাইয়া, আমিরা আপু, মিনহা আপু, হিমেল কাকার ছোট্ট মেয়ে অলি আর আমি। আমিরা আপু আগেভাগেই অলিকে কোলে নিয়ে সামনের সিটে উঠে বসেছিল, তাজ ভাইয়ের পাশে বসার জন্য। তারপর আর তাকে জোর করেও পেছনে বসাতে পারেনি জুম্মান ভাইয়া। শেষমেষ পেছনের সিটে চারজন বসতে গিয়ে জুম্মান ভাইয়ার কোলো সৌরভ ভাইয়াকে বসাতে বাধ্য হয়েছে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে যত খোঁচাখুঁচি চলছে শুরু থেকেই। সৌরভ ভাইয়া মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করেই শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে বসছেন জুম্মান ভাইয়ার কোলে। আর জুম্মান ভাইয়া প্রতিবারই চেঁচিয়ে উঠছেন। একবার বলছেন,
“এই ড্রামকে কোলে তুলে গন্তব্য অবধি পৌঁছানোর আগেই আমার দশ থেকে বারো কেজি ওয়েট লুজ হয়ে যাবে। ভাই তুই কী খেয়ে দিন-দিন এমন শরীর বানাচ্ছিস?”
আবার আফসোসের সুরে বলছেন,
“এখন তোর জায়গায় একটা সুন্দরী মাইয়া থাকলে কি আমার এত আফসোস করা লাগত? দম বন্ধ কইরা সব কষ্ট সহ্য কইরা নিতাম। আহা, তবু তো একটু শান্তি মিলত। শা’লার গ’ন্ডারটা আমার পুরো জার্নিটাই নষ্ট কইরা দিলো। ধুর।”
সৌরভ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আরে ভায়া, ভাবি দেখতে গিয়ে তো দু-একটা সুন্দরী বেয়াইনও কপালে জুটে যেতে পারে। অন্তত ওই আশায় ধৈর্য ধরে এটুকু কষ্ট করো। কষ্টের ফল অতি মিষ্ট হয়।” আমাদের যাত্রাপথের বিনোদন ছিল এই দুজন। মাঝ থেকে অলি বলে উঠল,
“অ্যাই, সৌরভ আলী ডিমের হালি। তুমি ফোনের দিকে তাকিয়ে কথা বলো কেন? সবার দিকে তাকাও।”
সৌরভ ভাইয়া ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রুকুটি করে অলিকে বললেন,
“আবার তুই আমাকে এসব বলছিস? আন্টিকে বলব?”
অলি মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“তুমি পচা, সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকো। আম্মু আমায় বলেছে, ভালো ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ ফোন নিয়ে থাকে না, পড়াশোনা করে। তার মানে তুমি ভালো ছেলে না।”
আমি ফিক করে হেসে উঠে বললাম,
“এক জ্ঞানীকে আরেক জ্ঞানী জ্ঞান দিচ্ছে। অলি, সৌরভ ভাইয়া কিন্তু পড়াশোনায়ও খুব ভালো, তুমি জানো না?”
অলি কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বেশ ভাবুক গলায় প্রশ্ন করল,
“পড়াশোনা কখন করে?”
সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“ওই বুড়ি, তোর পাকা কথা বন্ধ কর। পাকা বুড়ি।”
অলি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“সৌরভ আলী ডিমের হালি।”
অলি রেগে গেছে বুঝতে পেরে সবাই হেসে উঠল। সবার হাসি দেখে অলি আরও রেগে গেল। পুনরায় চিৎকার করে বলল,
“তোমরা সবাই পচা। আমি আর তোমাদের সাথে গাড়িতে উঠব না। বাবার সাথে উঠব।”
তারপর তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ তুলল,
“অ্যাই ভাইয়া, ওদের বকা দাও। ওরা পচা।”
তাজ ভাই এক হাতে অলির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা বকে দেবো। সবাই পচা, অলি বুড়ি‌ একা ভালো। এখন ভালো মেয়ের মতো চুপটি করে থাকো তো। ভালো মেয়েরা চেঁচামেচি করে না, সোনা।”
ব্যস, অলি পুরোপুরি শান্ত বনে গেল। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সদা চঞ্চল বাচ্চা মেয়েটার দিকে। অলির বয়স পাঁচ বছর। নূর আঙ্কেলের বংশের সবচেয়ে ছোটো সদস্য সে। কথা বলা শেখার পর থেকেই এই মেয়েটা খুব চঞ্চল। সবার আদরে-আদরে তার চঞ্চলতা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। বাবা পাগল মেয়ে সে। কিন্তু মান্য করার বেলায় একমাত্র নিজের মা ছাড়া আর কারোর পাত্তা নেই তার কাছে। যাকে ভালো লাগে তার কথা শোনে মাঝে-মাঝে। তাজ ভাই সুইডেন যাওয়ার পর ওর জন্ম হয়েছিল। সেক্ষেত্রে সুইডেন থেকে ফেরার পর গ্রামে গিয়ে অলির সাথে তাজ ভাইয়ের প্রথম দেখা হয়, আর এবার দ্বিতীয়। এরইমধ্যে মেয়েটা এই পাজি লোকের এত ভক্ত হয়ে গেছে দেখে একটু বেশিই অবাক হলাম। আমার সাথে বাকি সবার-ও একই অবস্থা। আমিরা আপু বলেই ফেললেন,
“এই ধানি লঙ্কাকে কীভাবে বশ করলেন, তাজ ভাই?”
আমিও তাল মিলালাম,
“অলিকে বশ করা অত সোজা না। যা মেয়ে!”
তাজ ভাই বেশ গর্বিত ভাব নিয়ে বললেন,
“ইন্টেলিজেন্স, বুঝলি? এটাও একটা প্রতিভা, যা আমার প্রচুর আছে। গাধাদের এসব থাকে না। তাই তোরা বুঝবিও না।”
আমি ফুঁসে ওঠার আগেই আমিরা আপু গাল ফুলিয়ে বললেন,
“গাধাদের মানে কী, তাজ ভাই? আপনি আমাদের সবাইকে গাধা উপাধি দিলেন?”
“সবাইকে কেন? এখানে যারা সত্যিকার অর্থে গাধা, তারা এমনিতেই বুঝে গেছে। নাম মেনশন করার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
আমি আপন মনে ফুঁসে উঠে স্বগতোক্তি করলাম,
“আসছে বুদ্ধির জাহাজ। সে ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবাই শুধু গাধা। ফা’জিল লোক।”
গন্তব্যে পৌঁছে তবেই সবার স্বস্তি মিলল। পাত্রীর পরিবার বাড়ির সামনে থেকে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। তিন তলার ফ্ল্যাটে থাকে তারা। আপ্যায়ন করল জম্পেশ। জুম্মান ভাইয়া এসে হতে শুধু খেয়েই চলেছেন। মাঝে-মাঝে আবার দুঃখী মুখ করে ফিসফিস করছেন,
“কিরে ভাই, এখনও তো একখান সুন্দরী বালিকাও চোখে পড়ল না। বেয়াইন কি কপালে নাই? এমন হইলে কিন্তু রাজ ভাইয়ের বিয়েতে আমি ভিলেন হয়ে দাঁড়াব। বেয়াইনহীন ভাবি চাই না আমার।”
এদিকে তার মা বার-বার চাপা স্বরে ধমকাচ্ছেন,‌ “জুম্মান, তোর কি আক্কেল-জ্ঞান নেই? পাত্রী দেখতে এসে মানুষ এভাবে খায়?”
জুম্মান ভাইয়া অবাক হয়ে উত্তর দিলেন,
“কী আশ্চর্য! খাবার কি না খেয়ে সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছে, আম্মু? ওনারা এত আদর করে খেতে দিয়েছে, আদরের অসম্মান করি কীভাবে?”
সৌরভ ভাইয়া মুখ টিপে হেসে বললেন,
“এই লোক মনে হয় এমনভাবে খাওয়ার জন্য পেটে রা’ক্ষুসে ক্ষুধা নিয়ে এসেছে।”
পাত্রীকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে আসা হলো। বেবি পিংক কালার খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে সে। এসে হতে লজ্জায় মাথা নত করে বসে আছে। সালাম জানিয়েছে, কিন্তু আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ছবিতে যেমন মিষ্টি দেখতে ছিল, বাস্তবেও সে ততটাই মিষ্টি। বড়োদের মুখের হাসিই বলে দিলো এই মেয়েকেই তারা ছেলের বউ বানাবে। পাত্রীর নাম জেনিফার আনাম। পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে। তার নত মুখের লাজুক হাসিটা খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলাম আমি। এই হাসিটাই হয়তো রাজ ভাইয়ের মন কেড়েছে। কী মিষ্টি! বড়োরা কয়েকটা প্রশ্ন করেই পাত্রীকে ছেড়ে দিলো। তারা এখন পাত্রীর অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চলেছে। ছোটোদের মুখে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম বড়োদের এই আলোচনার মাঝে এরা কেউই আগ্রহী নয়। অবশ্য আমি নিজেও খুব একটা আগ্রহী নই। এখান থেকে বেরোতে পারলেই সবাই বাঁচে। আমিও মনে-মনে এটাই চাইছিলাম। আমাদের মনের কথা হয়তো পাত্রীর বাবা বুঝতে পারলেন। আমাদের সবাইকে বললেন আমরা এখানে বিরক্ত হলে যেন ভেতরে গিয়ে বসি। জেনিফার ভাবি নিজেই আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। নিয়ে বসালেন তার নিজের রুমে। বসার মুহূর্তেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড ঘটে গেল। বেলকনি থেকে এক অতীব সুন্দরী রমণী ছুটে এসে একপ্রকার হামলে পড়ল তাজ ভাইয়ের গায়ে। গলা জড়িয়ে ধরে অতিরিক্ত উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“হানিইইই…ওহ্ মাই গড! হোয়াট অ্যা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ! আই ক্যান্ট বিলিভ…আপ্পিইইই?”
আমি বসতে গিয়েও তড়াক করে পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমিসহ উপস্থিত সবাই মোটামুটি ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে। রসগোল্লার মতো চোখ করে তাকিয়ে আছে অচেনা গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েটির দিকে। তাজ ভাই নিজেও কম অবাক হননি। দুহাত কিছুটা ওপরে তুলে সে মেয়েটির মুখ দেখার চেষ্টা করলেন। মেয়েটা অবশ্য বেশিক্ষণ গলায় ঝুলে থাকল না। সঙ্গে-সঙ্গেই ছেড়ে দিলো। মেয়েটার চেহারা দেখতেই তাজ ভাইয়ের মুখের ভাব পালটে গেল। বিস্ময়ের সাথে কিঞ্চিত খুশিও যোগ হলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,
“জেসি! তুমি এখানে কীভাবে?”
“আমার বাসায় আমি থাকব না?”
“তোমার? মানে, তুমি ওনার কে হও?” জেনিফার ভাবিকে ইশারায় দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই। জেসি নামক মেয়েটার আগে জেনিফার ভাবি বলে উঠলেন,
“তোমরা একে অপরকে চেনো?”
তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ, জেসিকার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সুইডেনে। একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম আমরা। দেশে ফেরার পর আর যোগাযোগ হয়নি।”
জেসিকাও তাল মিলিয়ে বলল,
“আরে আপ্পি, ও তাজ। তোমাকে বলেছিলাম না তাজ আর শ্রেয়ানের কথা?”
জেনিফার ভাবি হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালেন। হেসে তাজ ভাইকে বললেন,
“বেশ তো! জেসিকা আমার ছোটো বোন। ভালোই হয়েছে তোমরা কেউ ব্যাপারটা জানতে না। তাহলে আর এমন সারপ্রাইজ পাওয়া হত না।”
“ইয়াহ্, আই ওয়াজ অলসো সারপ্রাইজড,” মাথা দুলিয়ে বললেন তাজ ভাই।
জেসিকা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ, রাজ ভাইয়া তোমার কে হয়?”
তাজ ভাই দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশন, ইউ উইল বি মাই ওয়ান অ্যান্ড অনলি বেয়াইন সাহেবা।”
জেসিকা আপু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
“তার মানে তুমি রাজ ভাইয়ার ছোটো ভাই, অ্যাম আই রাইট?”
তাজ ভাই ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন। জেসিকা এবার জেনিফার ভাবিকে জাপটে ধরে গদগদ কন্ঠে বলল,
“আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, আপ্পি। কত, কত সারপ্রাইজ পেলাম আজ! তাজের আম্মির অনেক গল্প শুনেছি ওর মুখে। অসাধারণ মানুষ সে। কয়েকবার কথাও হয়েছিল আমার সাথে। আমি বরং আন্টির সাথে দেখা করে আসি। তোমরা গল্প করো।”
বলা মাত্রই জেসিকা আপু এক ছুটে বাইরে চলে গেল। আড়চোখে আমাদের গ্যাংয়ের দিকে তাকালাম। জুম্মান ভাইয়ার মুখটা এখনও হা হয়ে আছে। অতীব সুন্দরী বেয়াইনের সাক্ষাৎ পাওয়ার ধাক্কাটা ঠিক সামলাতে পারছেন না বেচারা। সৌরভ ভাইয়া তাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মা’রছেন। আমিরা আপুর কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে জেসিকা আপুর গায়ে পড়া স্বভাবের ওপর সে চরম বিরক্ত। তা-ও আবার তাজ ভাইয়ের গায়ে পড়েছে মেয়েটা। ভাবা যায়! আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। বিরক্তিতে গা রি-রি করলেও, তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করছি না। ভেতরে-ভেতরে কেমন এক তিক্ত অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠল। সম্পূর্ণ বিরক্তিটা গিয়ে পড়ল তাজ নামক অসভ্য লোকটার ওপর। সুইডেনে বসে আর কত সুন্দরীদের হাত করেছে কে জানে? দেশে ফিরে সাধু সেজে থাকলেও, বিদেশে নিশ্চয়ই লোকটা নিজেই গায়ে পড়া স্বভাবের অধিকারী ছিল। নইলে এত সুন্দরী মেয়ে পটালো কী করে? এই তো কিছুক্ষণ আগেই জেসিকা আপুর সাথে কেমন দাঁত কেলিয়ে কথা বলছিল। কী মধুর সুরে কথা, হাহ্! ইচ্ছে তো করছে গলা টি’পে মধু বের করে দিই। জেনিফার ভাবি আমাদের সবার হাতে একটা করে কোকাকোলার ক্যান ধরিয়ে দিলেন। এটাই হলো আমার আজকের দিনের সবচেয়ে বড়ো আপদ। ক্যানের ক্লিপ খুলতে গিয়ে পড়লাম চরম বিপত্তিতে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে জোরেশোরে এক টান দিতেই, ক্লিপ খোলার সাথে-সাথে আমার ঠোঁটেরও বারোটা বেজে গেল। নিচের ঠোঁটের একপাশ কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। উপস্থিত কেউই অবশ্য ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। সবাই জেনিফার ভাবির সাথে গল্পে মগ্ন। ব্যথা পেলেও আমি কাউকে টের পেতে দিলাম না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চুপ মে’রে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসিকা আপুও চলে এল। সে আসার পর গল্প আরও একধাপ জমে উঠল। সুইডেনে তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে কাটানো সময় নিয়ে বিভিন্ন গল্প বলতে শুরু করেছে সে। ঠোঁটের ব্যথা ভুলে আমি চরম বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। জেসিকা আপু আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই সে আলগোছে আমার পাশে এসে বসল। কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
“হেই কিউটি, আর ইউ ম্যারিড?”
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“না তো। কেন আপু?”
“ওপস্, সরি। তোমার লিপস দেখে ভেবেছিলাম-”
সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে সরে পড়ল। আমার ঠিক পেছনেই তাজ ভাই বসে ছিলেন। আড়চোখে তাকাতেই উনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। বুঝলাম উনি জেসিকা আপুর প্রশ্নটা শুনে ফেলেছেন। তাই আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,
“বুঝলাম না, আপু হঠাৎ এমন প্রশ্ন করল কেন? বিবাহিতদের সাথে ঠোঁটের কী সম্পর্ক?”
তাজ ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো উনি খুব মজা পেয়েছেন আমার প্রশ্নটায়। কেমন ভ্রু বাঁকা করে মুচকি হেসে বললেন,
“বুঝতে চাস?”
আমি ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম।
“বুঝাব?”
“বুঝান।”
“শিওর?”
আমি এবার ভ্রুকুটি করলাম। তাজ ভাই অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“আ’ম পিওর ভার্জিন, ইউ নো? বুঝতে চাইলেও এখন বুঝাব না। অযথা আমার নিষ্পাপ, কিউট ঠোঁট দুটোর ভার্জিনিটি হারাতে চাই না। তারপরও বুঝতে চাইলে জরুরী ভিত্তিতে বিয়ে করে ফেল। অটোমেটিক বুঝে যাবি।”
আমি আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আসল ব্যাপারটা বুঝে উঠতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। হুট করে সেটা মাথায় আসতেই লজ্জায় আমার মাথা কা’টা গেল। হুড়মুড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে দম বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ভুল করেও দ্বিতীয়বার আর পেছন ফিরে তাকানোর সাহস করলাম না। কী বিশ্রী ব্যাপার! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! জেসিকা আপু হঠাৎ কথাটা তোলায় আসল অর্থটা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তাজ ভাইয়ের কথা মস্তিষ্কে ঢুকতেই খেয়াল হলো কতটা বোকামি করে ফেলেছি আমি। এখন তো লজ্জায় আমার মাথা তুলতেও অস্বস্তি হচ্ছে। পারলে এক্ষুনি এখান থেকে ছুটে পালাতাম। কিন্তু তারও যে জো নেই। এরইমধ্যে আবার পেছন থেকে বেশ ঠান্ডা কন্ঠ ভেসে এল ,
“যা পারবি না, তা নিয়ে পাকামো না করলে চলত না? না কি অন্য কাউকে বললে খুলে দিত না? বেশি পাকামো করার ফল এমনই হয়, গাধি।”
কথাগুলো আমার কানে ঢুকলেও আমি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া তো দূর, নড়চড়ও করতে পারলাম না। একইভাবে শক্ত হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। লজ্জা বাবাজি আজ ভালোভাবেই জব্দ করেছে। মনের ভেতর তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। রীতিমতো দ্বিধাদ্বন্দ্বের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এমন অযাচিত ঘটনার পর আমি এই লোকটার সামনে দাঁড়াব কী করে? তার দিকে তাকাব কী করে? চোখে চোখ পড়লেই তো লজ্জায় ম’রে যাব। ওনার সাথে কথা তো বাদই দিলাম, মুখোমুখি হওয়া নিয়েই তো আমি বিপদে পড়ে গেলাম। শেষমেষ কি না তাজ ভাইয়ের সামনেই এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হলো! এবার আমার কী হবে? এই পাজি লোকটা যদি এই নিয়ে সারাক্ষণ মজা নেয়, তখন? এত-এত লজ্জা আমি কোথায় রাখব? ইয়া মাবুদ, অদৃশ্য একটা সুরঙ্গের খুব বেশি প্রয়োজন বোধ করছি। প্লিজ হেল্প মি। হায়! আমার অসহায় মনের আকুতি কেউ শুনল না। বাড়ি ফেরার সময় তাজ ভাই আগেভাগেই হুকুম জারি করলেন, অলিকে নিয়ে যেন আমি সামনে বসি। আমিরা আপুর ড্যাবড্যাব চাহনি তার বিরক্তির কারণ হয়। যার ফলে ড্রাইভিং করতেও সমস্যা হয়। কিন্তু আমি সে কথা শুনেও শুনলাম না। মোটকথা মাথা তুলেও তাকালাম না। ত্যাড়ামি তো আছেই, সাথে নিজের লজ্জা লুকাতে আগেভাগে গাড়িতে উঠে সেই পেছনের সিটেই বসে পড়লাম। ফলস্বরূপ আমিরা আপু পুনরায় তাজ ভাইয়ের পাশে বসার সুবর্ণ সুযোগটা পেয়ে গেল। পুরো জার্নিতে ভুল করে মাত্র একবার ফ্রন্ট মিররে চোখ চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে এক জোড়া রক্তলাল চোখ আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিলো। নিমেষেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলেও, ক্ষণিকের ওই চাহনি বুকের ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মস্তিষ্ক সতর্ক বার্তা পাঠাল, “সাবধান ইলোনি, ভুল করেও আর ওই রা’ক্ষসের সামনে পড়ো না। পড়লেই তুমি শেষ।’

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here