মনোহরিণী পর্ব -১৩+১৪

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
মেয়েদের কাছে লজ্জা এক ভয়ানক শব্দ। তারা লাজুকতা। অল্পতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তা কা’টিয়ে উঠতে দ্বিগুণ সময় নেয়। এজন্যই বোধ হয় এই লাজুকলতাদের কেবল স্ত্রী বাচক শব্দই আবিষ্কার হয়েছিল। লজ্জাবতী। গত দুদিন ধরে লাজুকতা আমায় এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে যে, কোনোভাবেই সেই প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। কবে হবে তা-ও জানি না। শুধু জানি ভুল করেও ওই নির্লজ্জ মানুষটার মুখোমুখি হওয়া যাবে না, একদমই না। সেদিনের সেই কথাগুলো মনে পড়লেই লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে হয় আমার। এ কারণেই গত দুদিন ধরে ইচ্ছে করেই তাজ ভাইয়ের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকেছি। ভুল করে সামনে পড়ে গেলেও এড়িয়ে গেছি। উনি বাসায় ফেরার আগেই রাতের খাবার খেয়ে রুমের দরজা লাগিয়েছি। সকালেও ওনার আগে খাবার খেয়ে নিয়েছি। বরাবরের মতো অর্ধেক পড়া উপন্যাসের বই গায়েব হবার পরও তা খুঁজতে ওনার রুমে যাইনি। এড়িয়ে চলার এত পন্থা অবলম্বন করার পরও শেষ রক্ষা হলো না। হুট করে আজ জুম্মান ভাইয়া জানালেন উনি আজ ভার্সিটি যাবেন না। তার না কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ আছে। অথচ তখন আমি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছি। আম্মি বলল আজ তাজ ভাই আমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে সে তাজ ভাইকে বলেও রেখেছে। কথাটা শুনেই আমি ঢোক গিলে না, না করে উঠলাম। বললাম,
“জুম্মান ভাইয়া না যেতে পারলে আজ আমিও যাব না। একদিন কামাই করলে কোনো ক্ষতি হবে না। তার চেয়ে বরং আজ বাড়িতেই থাকি।”
কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। তাজ ভাই রুম থেকে বেরিয়ে আমার কথাটা শুনে ফেললেন। ফলস্বরূপ ভাগ্যে জুটল এক রামধমক। অসহায় মুখে আম্মির দিকে তাকিয়েও রক্ষা মিলল না। বাধ্য হয়ে আমি তাজ ভাইকে পেছনে ফেলে আগেভাগেই নিচে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। উনি এলেন তার মিনিট পাঁচেক পর। কিন্তু ওনাকে ড্রাইভিং সিটে না বসে ঘুরে এসে আমার সিটের পাশের দরজা খুলতে দেখে অবাক হলাম। আমার অবাক মুখশ্রী তোয়াক্কা না করে উনি চোখের পলকে আমার হাতের বাহু ধরে একপ্রকার টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলেন। হকচকিয়ে উঠে ‘কী হয়েছে’ উচ্চারণ করতে-করতেই আবার পেছনের দরজা খুলে আমাকে ঠেলে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব আমি পূর্বের সকল লজ্জা ভুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বিস্মিত কন্ঠে শুধালাম,
“এটা কী হলো?”
“পেছনের সিট খুব পছন্দ না তোর? পছন্দের সিটেই বোস, সমস্যা কী?”
সোজাসাপ্টা উত্তর। লোকটার মুখে কিঞ্চিত রাগের আভাসও নেই। একদম স্বাভাবিক মুখোভাব। তবে এমন রূঢ় আচরণের মানে কী? আশ্চর্য! ওনার উত্তর শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না সেদিনের রাগের শোধ আজ এভাবে তুললেন। দুদিন ধরে রাগ পুষে রেখেছেন নিশ্চয়ই। আমার বিস্ময়ের মাঝেই উনি গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করেছেন। আমি আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। এত সহজ পদ্ধতিতে রাগের শোধ তুলে অবশ্য আমার নিজেরই সুবিধা করে দিয়েছে। ওনার পাশে বসে ভার্সিটি অবধি যাওয়ার আগেই হয়তো আমি পূর্বের লজ্জায় ম’রে যেতাম। রাগকুমার নিজের অজান্তেই আমার উপকার করল। আহারে! গাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতার ছড়াছড়ি। উনি চুপচাপ ড্রাইভিং করছেন। এদিকে আমি পেছনে বসে ওনার বোকামির কথা ভেবে আপন মনেই হাসছিলাম। অতিশয় বুদ্ধিমান ডিটেকটিভ সাহেবও তবে এত সামান্য বিষয়ে বোকামি করে! ইশ্! আমার খুশির স্থায়িত্ব খুব বেশি হলো না। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে হুট করেই গাড়িটা থেমে গেল। উনি ভরাট গলায় বললেন,
“সামনে আয়।”
আমি চুপসানো বেলুনের মতো মুখ করে প্রশ্ন করলাম,
“কেন?”
“খুশির মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গেছে দেখলাম। সামনে এসে ভাগাভাগি করে নে। আমিও একটু ভাগ নিই। জলদি আয়।”
বাঁদরটা নিশ্চয়ই লুকিং মিররে আমার হাসিটা দেখে ফেলেছে। তা-ও সহ্য হয়নি। ঠিকই ব্যাঘাত ঘটিয়ে বসেছে।
“একবার পেছনে, আরেকবার সামনে, কী শুরু করলেন? বসলেই হয় এক জায়গায়। আমি পেছনেই ঠিক আছি। চলুন আপনি।”
ঈষৎ বিরক্তিতে আপত্তি জানালাম আমি। সঙ্গে-সঙ্গেই সেই অতি পরিচিত ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হলো। কাঠ-কাঠ গলায় ছুঁড়ে মা’রা হলো এক বাক্য।
“এক্ষুনি সামনে এসে বোস, নইলে এখানেই ফেলে রেখে চলে যাব। তারপর মাঝ রাস্তা থেকে কিডন্যাপ হলে তার দায়ভার আমার না।”
চোয়াল শক্ত করে পেছনের সিট থেকে নেমে, ধুপধাপ পা ফেলে পুনরায় গিয়ে সামনের সিটে ধপ করে উঠে বসলাম। চোয়াল শক্ত করে ওনাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বিড়বিড় করলাম,
“সুযোগ বুঝে বাঁশ সব আমাকেই দেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার, হুঁহ্। এর চেয়ে বাসে ঝুলে একা যাওয়াও হাজার গুণ ভালো ছিল।”
“হ্যাঁ, খুবই ভালো ছিল। যে কোকাকোলার ক্যান খুলতে গিয়ে সামান্য ঠোঁট সামলাতে পারে না, সে আস্ত নিজেকে সামলাবে! হাস্যকর!”
ওনার ঠাট্টার ছলে কটাক্ষ শুনে মেজাজ তিরিক্ষি হলেও, তা মুহূর্তেই লজ্জার নিচে পি’ষ্ট হয়ে গেল। অসভ্য লোকটা আবার সেই কথা মনে করিয়ে ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জায় ফেলল। ওই কথা কর্নগোচর হওয়ার পর সেই যে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম, ভার্সিটি গেইটের সামনে গাড়ি থামার পরও আর দৃষ্টি ফেরালাম না। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমেই কোনোদিকে না তাকিয়ে পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। দুটো চোখ এই যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে, না কি দৃষ্টি ফিরিয়ে চলে গেছে তা দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগল। কিন্তু সব ইচ্ছেকে যে আশকারা দিতে নেই। তাই না চাইতেও ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিতে হলো।
ভার্সিটি শেষে আমাকে নিতে এলেন জুম্মান ভাইয়া। ওনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ। ফেরার পথে আমি জানতে চাইলাম কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন উনি, যা দুপুরের আগেই শেষ হয়ে গেল। জুম্মান ভাইয়া কোনোরূপ ইতিউতি করলেন না। সত্যি বললেন।
“রাজ ভাই আসার পর ওনার সাথে জুয়েলারি শপে গিয়েছিলাম, ভাবির জন্য আংটি কিনতে।”
রাজ ভাইকে সাথে নিয়ে আজ বড়োরা গিয়ে জেনিফার ভাবিকে আংটি পরিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলে আসবে। কিন্তু আমার জানামতে রাজ ভাইয়ের সাথে আংটি কিনতে যাওয়ার কথা ছিল তাজ ভাইয়ের। কারণ রাজ ভাই নিজেই তাজ ভাইকে বলেছিলেন, ওনার পছন্দ খুব একটা ভালো না। তাজ ভাইয়ের পছন্দ ভালো, বিধায় ওনাকেই সাথে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ কথা আমি গতকাল রাতেই আম্মির মুখে শুনেছিলাম। তাহলে ওনার বদলে জুম্মান ভাইয়া গেল কেন? প্রশ্নটা মুখে প্রকাশ করতেই তারও উত্তর মিলে গেল। জুম্মান ভাইয়া বললেন,
“বড়ো ভাইয়েরা হয় ধান্দাবাজ, বুঝছিস? ছোটো পেয়ে আমাদের খাটিয়ে নিজেদের কাজ উসুল করে নেয়। রাজ ভাইয়ের সাথে জুয়েলারি শপে যাওয়ার কথা ছিল তাজ ভাইয়ের। অথচ সে নিজের কাজের বাহানায় আমাকে রাজ ভাইয়ের সাথে লাগিয়ে দিয়ে নিজে কে’টে পড়েছে। মাঝখান থেকে আমার ক্লাস মিস গেল। অথচ আবার সেই ভার্সিটিতে আসতেই হলো তোকে নিতে। দৌড়ানিগুলো সবই আমার ওপর পড়ল। না জানি রাজ ভাইয়ের বিয়েতে আমাকে কত খাটিয়ে মা’রে! কেন যে ছোটো হলাম!”
জুম্মান ভাইয়ার আতঙ্কিত বদন দেখে আমি বেশ মজা পেলাম। শব্দ করে বিস্তর হাসলাম। জুম্মান ভাইয়া প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ হাস, হাস। তোদেরই তো দিন। সবকটা রানি সেজে ঘুরে বেড়াবি, প্রজাগিরি তো করতে হবে আমাদের। আহারে জীবন! আহারে! কেউ দুঃখ বোঝে না। এই দুঃখের সঙ্গী বানাতে হলেও জরুরী ভিত্তিতে একটা বউ দরকার।”
“চাপ কিসের? বিয়েতে রাজ ভাইয়ের সুন্দরী শ্যালিকাদের মধ্যে একটাকে বেছে একই মজলিসে নিজের শুভ কাজটাও সম্পন্ন করে ফেলবেন। খরচ কম, লাভ বেশি।”
জুম্মান ভাইয়ার পুরোনো ক্ষ’ত যেন তাজা হয়ে উঠল। আফসোস করে বললেন,
“ধুর! রাজ ভাইয়ের আপন শ্যালিকাটাই তো সেরা। অথচ আমার দিকে একটু অ্যাটেনশন দিলো না। উলটো তাজ ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়ল।”
গত দুই দিনে জুম্মান ভাইয়ার মুখে এই এক বাক্য হাজারবার শোনা হয়ে গেছে। জেসিকা আপু তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়নি বলে ও বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর হতে আহাজারি শুরু হয়েছিল। আহাজারি শুনতে-শুনতে আমাদের কানে তালা লাগার জোগাড়। এদিকে আমরা যখনই বলি জেসিকা আপু তার সিনিয়র, তখনই আরও শক্ত গলায় বলে, ‘চেষ্টা করতে দোষ কী? সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম দ্বিগুণ মিষ্টি হয়।’ বিকেলের দিকে রাজ ভাইসহ বড়োরা গেল জেনিফার ভাবিদের বাসায়। এবার আমাদের ছোটোদের গ্যাং পুরোটাই ফেলে রেখে গেল। কারো অনুরোধ ধোপে টেকেনি। উলটো ধানি লঙ্কা অলি বুড়িকেও আমাদের কাছে আমানত রেখে গেছে। অবহেলিত হবার দুঃখে সবাই যার-যার মতো দুঃখ বিলাস করছে। সৌরভ ভাইয়া নিজের কুখ্যাত স্বভাব বজায় রেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় উপুড় হয়ে পড়ে ফোনে ডুবে ম’রছেন। জুম্মান ভাইয়ার হদিস নেই। হয়তো বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুর-ঘুর করছেন। আমিরা আপু পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছে। আর মিনহা আপু তার রুমের মেঝেতে এক গাদা নোটস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তার মাঝে অসহায়ের মতো বসে আছে। কারণ সামনে তার পরীক্ষা। ভাইয়ের বিয়ে আর নিজের পরীক্ষা, দুইয়ের চিন্তায় এখনই তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। বিয়ের প্ল্যানিং করতে বসলে পরীক্ষার চিন্তায় পাগলপ্রায়, আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বসলে বিয়ের চিন্তায় পাগলপ্রায়। এই পাগলদের ভীড়ে আমি আর অলি পড়ে গেলাম একাকীত্বে। তা-ও অলি একটু পরপর টিভি দেখছে, সৌরভ ভাইয়ার পিঠের ওপর চড়ে বসে তাকে নানাভাবে বিরক্ত করছে, আবার এসে যত ঘ্যান-ঘ্যান সব আমার কানে ঢালছে। ওর ঘ্যান-ঘ্যান রীতিমতো আমাকে বিরক্ত করে তুলেছে। বিরক্তিতে যৎসামান্য স্বস্তি মিলল তাজ ভাইয়ের আগমনে। উনি আসামাত্রই অলি ওনার রুমে ছুটেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি নিশ্চিন্তে বসে একটু অনলাইনে ঢুঁ মা’রতেই আবার অলি এসে উপস্থিত হলো। এবার আমার হাত আর ওড়না টানতে-টানতে চেঁচানো গলায় তাড়া দিলো,
“ইলোপু, ছাদে নিয়ে চলো। মেজো ভাইয়া ছাদে গেছে। আমিও যাব। তাড়াতাড়ি চলো।”
“তোমার মেজো ভাইয়ার সাথে গেলে না কেন?”
“মেজো ভাইয়া ফোনে কথা বলতে-বলতে আমাকে রেখে চলে গেছে। মনে হয় ভুলে গেছে,” ঠোঁট ফুলিয়ে থেমে-থেমে বলল অলি।
এই মেয়েকে নাকচ করলে যে কেঁদেকেটে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট মাথায় তুলবে, তাতে বিন্দুমাত্র অনিশ্চয়তা নেই। এই মুহূর্তে ছাদে যাওয়ার ন্যূনতম ইচ্ছে আমার নেই। তাই কায়দা করে বুঝাতে চাইলাম।
“সৌরভ ভাইয়াকে দিয়ে আসতে বলো, অলি বুড়ি। ভাইয়া দিয়ে আসবে। ইলোপুর পা ব্যথা করছে।”
অলি গোল-গোল চোখে একবার আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“লিফটে গেলে পা ব্যথা হয় না। সৌরভ আলী ডিমের হালি পচা। কথা শোনে না। চলো নাআআআ।”
কোনোভাবেই অলিকে বুঝানো গেল না। সে কিছুতেই সৌরভ ভাইয়ার সাথে যাবে না। ঘাড়ত্যাড়া বংশের মেয়ে যে! শেষে বাধ্য হয়ে অলিকে নিয়ে ছাদে চললাম।‌ ভেবেছিলাম অলিকে পৌঁছে দিয়েই আমি ফিরে যাব। কিন্তু ছাদে পা রেখে এক দৃশ্য দেখামাত্রই ফিরে যাওয়ার কথা মাথা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গেল। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত তাজ মশাই। অথচ তার কয়েক হাত দূরেই এক নির্লজ্জ মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। কে জানে? হয়তো খেয়াল করেও ঢং করে ফোনে ডুবে থাকার নাটক করছে। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী। পরনে একটা শার্ট আর ট্রাউজার। কাঁধের নিচ অবধি খোলা চুলগুলো ছড়ানো। চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে অচেনা, অজানা এক পুরুষকে। হুট করেই আমার মেজাজ অত্যধিক খারাপ হয়ে গেল। ছাদে এসে এত সুন্দর গোধূলি বেলার প্রতি মুগ্ধ হতেও ভুলে গেলাম। প্রকৃতির প্রতি নজর না দিয়ে সম্মুখের মানব দুটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর নিক্ষেপ করলাম। অলি ততক্ষণে তাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে অদূরে যে তিনটা বাচ্চা খেলা করছে, ওদের কাছে চলে গেল। আমি দ্রুত পা চালিয়ে গিয়ে তাজ ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটা হয়তো আমার এহেন কান্ডে অনেকটাই বিরক্ত হলো। তবু দমে না গিয়ে ঘাড় কাত করে তাজ ভাইকে দেখতে লাগল। তাজ ভাই ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আড়চোখে ওপাশের মেয়েটার দিকেও একবার তাকালেন। তারপর ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দুহাত রেলিংয়ে ঠেকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
“আয়নায় চেহারা দেখে এসেছিস? পেত্নীর মতো লাগছে। ভাগ্যিস ছাদে অন্য কোনো ছেলে নেই। থাকলে নির্ঘাত ভয়ে বেহুঁশ হত, কিংবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে উ’ষ্ঠা খেয়ে পড়ত।”
আমি আড়চোখে ওপাশের মেয়েটার হাবভাব লক্ষ্য করছিলাম। উনি ঝুঁকে দাঁড়ানোর দরুন মেয়েটা পুনরায় নির্দ্বিধায় চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। চরম বিরক্তি নিয়ে আমি উত্তর দিলাম,
“শহুরে মেয়েদের মতো ওভার স্মার্ট হয়ে কারো নজর কাড়ার সাধ নেই আমার। কার কাছে পেত্নী, কার কাছে পরী এসব নিয়েও মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো ফা’লতু কাজটা অন্তত আমাকে দিয়ে হয় না।”
উনি হয়তো আমার টিপ্পনীপূর্ণ কথাটার উদ্দেশ্য ধরতে পারলেন। কেমন ভ্রু বাঁকিয়ে একবার আমার দিকে, আরেকবার ওপাশের মেয়েটার দিকে তাকালেন। ঠোঁট কামড়ে হেসে আমার মাথায় মৃদু চাটি মে’রে বললেন,
“গাধা প্রকৃতির মেয়েদের কোনো প্রতিভাই থাকে না। তুই তাদের মধ্যে অন্যতম। দেখা যাবে বিয়ের পর তোর কপালপোড়া জামাই বাসর ঘরে বসেও দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে জীবন বরবাদ করে দিবে। আর যাই হোক, চুমু খেতে গিয়ে ঠোঁট কা’টার রহস্য না বোঝা বউকে নিয়ে তো আর বেচারা আজীবন পার করতে পারবে না। প্রথম ধাপেই বউয়ের গাধামি দেখে হয়তো সেঞ্চুরি মা’রার আগ্রহ হারিয়ে বসে থাকবে। আহারে! অগ্রীম সমবেদনা বেচারার গাধা মার্কা সোহাগ রাতের জন্য।”
লজ্জায় আমার কান ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। মনে হচ্ছে কান দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ কুঁচকে ঢোক গিললাম। এতটা নির্লজ্জ স্বভাব বোধ হয় একমাত্র এই মানুষটাকে দিয়েই আশা করা যায়। নির্দ্বিধায় ফটাফট কী বা’জে কথা আওড়াল! ভাগ্যিস ওই মেয়েটা দূরে দাঁড়ানো। নয়তো এতক্ষণ ধরে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার তার সুদর্শন পুরুষের মুখে এই কথা শোনার পর, বেচারি হয়তো নিজের মুগ্ধতাকে বলি দিতে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ত। আমি নিজেই যে মুখ লুকানোর জায়গার অভাবে ভুগছি। পূর্বের আর এখনকার, উভয় লজ্জার সংমিশ্রণে এই নির্লজ্জ ব্যক্তির সামনে টিকে থাকা আর সম্ভবপর হলো না। বিধায় এই মুহূর্তে মানে-মানে কে’টে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভাবতে-ভাবতেই চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা ক্ষুনাক্ষরেও টের পাইনি। আমার চমকিত মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,
“সরি, সরি। ভয় পেলে?”
আমি ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“না, ঠিক আছি।”
“আমি এসে দাঁড়ানোমাত্র তুমি ঘুরে দাঁড়িয়েছ তো, সেজন্যই হয়তো চমকে উঠেছ। যাইহোক, তোমরা কয় তলায় থাকো?”
“সাত তলায়।”
“আমি পাঁচ তলায় থাকি। এখানে নতুন এসেছি। তোমরা কবে থেকে থাকছো?”
“এক বছর।”
“ওহ্! উনি কি তোমার ভাই?” তাজ ভাইকে ইশারায় দেখিয়ে প্রশ্ন করল মেয়েটি।
আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। উনিও তখন ফিরে তাকিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, হয়তো উত্তর শোনার অপেক্ষা। এ পর্যায়ে এসে হঠাৎ আমার মনে এক পৈশাচিক আনন্দ জাগল। মিষ্টি হেসে আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ, আপনি একা এসেছেন?”
মেয়েটার হাসি এবার আরও দীর্ঘ হলো। আমার ভাইয়ের প্রতি নিশ্চিত একটা চান্স পাবে ভেবে হয়তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। মিষ্টি হাসি মুখে ঝুলিয়ে বাচ্চাদের দিকে আঙুল তাক করে একজনকে দেখিয়ে বলল,
“ওই তো আমার বোন। খেলতে নিয়ে এসেছি ওকে। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”
“অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। আপনি?”
“ফাইনাল ইয়ার। আর ভাইয়া কী করেন?”
তাজ ভাইকে প্রশ্ন করতেই উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। বললেন,
“কোনোরকমে নাম লেখা শিখেছিলাম।”
মেয়েটা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
“ধুর! মজা করছেন আপনি।”
আমি বললাম,
“ডিটেকটিভ।”
মেয়েটা বোধ হয় এবার আরও বেশি গলে গেল। চোখ বড়ো করে চমৎকৃত হয়ে বলল,
“ওয়াও! বিশাল ব্যাপার। তোমার ভাইয়াকে নিয়ে আমাদের বাসায় যাবে একদিন। এখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই তো। আম্মু খুব খুশি হবে।”
আমি হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম,
“যাব, আপনারাও যাবেন আমাদের বাসায়।”
“অবশ্যই যাব। কিন্তু তোমার ভাইয়া তো তেমন কথাই বলছে না।”
তাজ ভাই এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। অলিকে একবার কাছে ডেকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,
“মিস, সম্পর্কের জগাখিচুড়ি করবেন না। আপনি কি খেয়াল করেছেন আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির ঠোঁটে কা’টা দাগ?”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। এই মেয়েকে এসব কথা বলছে কেন? ওনার কথা বলার সাথে আমার ঠোঁটের কা’টা দাগের কী সম্পর্ক? আচমকা বাঁ হাতের বাহুতে শক্ত হাতের স্পর্শে হকচকিয়ে উঠলাম। উনি আলতো করে এক হাতে আমাকে আগলে ধরেছেন। আমার হাত-পা জমে গেল। এভাবে কখনও স্পর্শ করেননি যে। ওনার ভাবলেশহীন দৃষ্টি সামনের মেয়েটির দিকে। মৃদু হেসে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনাকে দেখে অতটাও বোকা মনে হচ্ছে না। অবিবাহিতা মেয়েদের ঠোঁট কা’টার রহস্য নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার শুধু একটা বড়ো ভাই আছে। এই ল্যামব্রেইন মেয়েটা আমার আব্বুর বন্ধুর মেয়ে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
আমি রসগোল্লার মতো চোখ করে কিঞ্চিত হা করে ওনার দিকে তাকালাম। বিস্ময়ে কথা বলতেও ভুলে গেলাম। মেয়েটাও চুপ মে’রে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমি মিথ্যে বলেছি ভেবে ভীষণ অবাক হয়েছে বা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তার দুঃখ দেখার অভিলাষ নেই আমার। লজ্জায়, জড়তায় আমি ওনার কাছ থেকে প্রায় ছিটকে সরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে পা চালালাম। একবারের জন্যও আর পেছন ফিরে তাকালাম না। সোজা ফ্ল্যাটে চলে এলাম। ওনার কথার অর্থ বুঝে যতটা লজ্জা লাগছে, তার চেয়ে বেশি রাগ লাগছে। মেয়েটার থেকে নিজেকে বাঁচাতে এভাবে একটা মিথ্যে ইঙ্গিতে আমার মান-সম্মানের ফালুদা করে দিলো। ছিঃ! কোন কথা ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কোন কথায় নিয়ে গেল! মেয়েটা কী ভাববে আমায়? নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে-মনে হাজারবার নির্লজ্জ ট্যাগ দিয়ে বকে চলেছে। ইয়া খোদা, ওই মেয়ের সাথে এটাই যেন প্রথম এবং শেষ দেখা হয় আমার। দ্বিতীয়বার আবার মুখোমুখি হলে মুখ লুকানোর জায়গা কোথায় পাব আমি? লোকটার এই ঠোঁট কা’টা স্বভাবের জন্য গত দুদিন পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম। আজ যা একটু স্বাভাবিক হয়েছি, তারও মাথা কামিয়ে দিলো। ঘুরেফিরে সেই আগের পরিস্থিতিতেই ফিরিয়ে দিলো। আবার তবে শুরু হবে লুকোচুরি খেলা। আমি যে তার মতো নির্লজ্জ হতে পারি না। ওই মানুষটা নির্লজ্জ বলেই হয়তো সমস্ত লজ্জারা এসে আমার ঝুলিতে মুখ লুকিয়েছে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এই লুকোচুরি খেলা আমার কাছে অতিশয় বিরক্ত লাগে। এক বাসায় থেকে কারো থেকে পালিয়ে বেড়ানো কারই বা ভালো লাগবে? লোকটা আর আমায় শান্তি দিলো না। নিজের এই নির্লজ্জ স্বভাবের কারণে কবে যেন আমার সম্পূর্ণ শান্তির থলেটাই কেড়ে নিবে।
হিমেল কাকারা ফিরে এলেন রাতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে আগামী সপ্তাহে। আজ থেকে ঠিক আট দিন পর। এরমধ্যে আম্মির হাস্যোজ্জ্বল মুখের আরও এক ভয়ানক সংবাদ আমার অর্ধ শান্তির মস্তিষ্কে সুনামি বয়ে আনল। আগামী তিন দিনের মধ্যে আফরা আপু তার পরিবারের সাথে ঢাকায় আসছে।
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
মনোহারিণী,
জানো কি? নারীর ওষ্ঠাধরে সব পুরুষের নেশা হয় না। কিছু পুরুষের নেশা হয় ব্যতিক্রম। এই যে তুমি নিজের ওষ্ঠাধরকে কারণ করে লুকোচুরি খেলছো, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। ওই ওষ্ঠাধরে যে আমার মোহ নেই। এত স্বাভাবিক নেশা আমায় কাবু করার ক্ষমতা রাখে না। আমার নেশা অভিন্ন। অতি ক্ষুদ্র; তবে সুবিশাল অনুভূতি মিশ্রিত। লজ্জাবতী ইলুরানি, তোমার কোমল ওষ্ঠে আমার নেশা নেই। আছে ডান গালে রাজত্ব করা ওই মিশমিশে কালো তিলটায়। ওষ্ঠের মাদকতা যার সৌন্দর্যের কাছে অকাতরে হার মানে। রোজ ওই মাদকতায় আসক্ত হই আমি। এর নাম মাদকাসক্তি নয়, তিলাসক্তি। অদ্ভুত না? অবশ্য তোমার চোখে গোটা আমিটাই তো অদ্ভুত। অদ্ভুত মানুষের আসক্তিও অদ্ভুত। এই অদ্ভুত আসক্তিটাই আমার বিশেষ প্রশান্তি।
ইতি
তোমার তিলাসক্ত অদ্ভুত মানব

এই অবধি এটাই একমাত্র চিরকুট, যা পড়তে গিয়ে আমি বারবার থমকে গেছি। লজ্জায় কুঁকড়ে পড়েছি। দৃষ্টির লক্ষ্য গুলিয়ে ফেলেছি। ডান গালের তিলটাকে ছুঁয়ে লাজুক হেসেছি। সবশেষে চিরকুট হাতে থম মে’রে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দৃষ্টি ওই সৌভাগ্যবান তিলটার ওপর। অথচ দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, শত খুঁজেও চোখের এক ইঞ্চি নিচে গালের ওই বিশেষ তিলের বিশেষ কোনো সৌন্দর্য পেলাম না। আমার চোখে বোধ হয় সৌন্দর্য উপভোগের পাওয়ার কমে গেছে। হতাশ হওয়ার অবকাশ পেলাম না। মা’রাত্মূক লজ্জা লাগছে। এই মানুষটা বোধ হয় রোজ আমায় নতুন-নতুন পদ্ধতিতে লজ্জায় ফেলার চিন্তাতেই নিজের রাতের ঘুম হারাম করে। দু-দুবার ঠোঁট নিয়ে লজ্জায় ফেলল, এখন আবার তিল নিয়ে। লজ্জা কা’টিয়ে ওঠার ফুরসতটুকুও দেয় না। এই তো আজ তিন দিন হলো আমি পুনরায় তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। নিজের কাজ আর রাজ ভাইয়ের বিয়ের বিভিন্ন প্ল্যানিংয়ের চাপে পড়ে সে-ও হয়তো কারো লুকোচুরি গল্পে নজর দেওয়ার ফুরসত পায়নি। আজ বুঝি সূয্যিমামা ভুল করে পশ্চিমাকাশে উদয় হয়েছে। তাই তো ঘুম থেকে উঠে এই অদ্ভুত চিরকুট জুটে গেল। চিরকুটের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটালাম। মানুষটা কি আমায় লজ্জা কা’টিয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র সুযোগ দিবে না? এই তো এবার আরও এক ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিলো। অথচ আজ তার আশেপাশে থাকাটা আমার জন্য অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠেই শুনেছি আফরা আপু এসেছে। ঘুমুচ্ছে হয়তো। আমি নিশ্চিত তাজ ভাইয়ের সাথে সে এবার ওই অভিশপ্ত চিরকুট নিয়ে কথা তুলবেই। কখনও না কখনও তো অবশ্যই তুলবে। একবার হলেও তুলবে। এত বছর পর মুখোমুখি হলে পুরোনো কথা মনে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার আগেই পাজি লোকটা এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে। না কি আমাকে এভাবে লজ্জায় ফেলে সরিয়ে রেখে সুন্দরী মেয়ে পটানোর ধান্দা? একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। কত প্রমাণই তো পেলাম। এমনিতেই কি আর মেয়েরা দেখামাত্রই বরফের মতো গলে যায়? আমার ভ্রু দ্বয়ের মাঝে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। বহুকষ্টে লজ্জা তাড়ানোর চেষ্টা চালালাম। ভাবলাম কোনোভাবেই এই লজ্জার খ’প্পরে পড়ে পালিয়ে বেড়ানো চলবে না। এই সময়টা অতি ভয়ানক। আশেপাশে থাকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই চিরকুটের কথাগুলো যেকোনোভাবে আমায় ভুলে থাকতে হবে। খাবার টেবিলে যখন ডাক পড়ল, তখনই পড়ে গেলাম ফ্যাসাদে। তাজ ভাই আগেই ডাইনিংয়ে বসে ছিলেন। গত দিনের মতো আজও নিজের খাবার নিয়ে রুমে পালানোর পাঁয়তারা করতেই আফরা আপুর আগমন ঘটল। আমাকে দেখে মুচকি হেসে সে নিজে থেকেই কুশল বিনিময় করল। আমিও হাসিমুখে কথা বললাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেয়েটাকে দেখেই আমার হাত নিশপিশ করছে। তাজ ভাইয়ের সাথে আমার যত গণ্ডগোলের মাথা এই মেয়ে। ইচ্ছে করে আমাকে ফাঁ’সিয়েছিল। মনে-মনে পণ করলাম তাজ ভাইয়ের চোখে আমাকে বিষ বানিয়ে তার কী এমন সুফল হয়েছিল, তা এবার জেনেই ছাড়ব। আফরা আপু তাজ ভাইয়ের দিকে পা বাড়িয়েছে দেখেই আমি তার উদ্দেশ্য ধরে ফেললাম। তাজ ভাইয়ের ওপাশে রাজ ভাই বসেছে, আর এপাশের চেয়ার ফাঁকা। খাবার নিয়ে রুমে পালানোর চিন্তাটা ফুস করে মাথা থেকে উবে গেল। আফরা আপু চেয়ারের কাছাকাছি আসার কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আমি ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লাম। তাজ মহাশয় ভাবলেশহীনভাবে খাচ্ছিলেন। তার মাঝে কোনোরকম হেলদোল দেখা গেল না। ওদিকে আফরা আপু আমার চেয়ারের পাশে মনক্ষুণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে দেখলাম চোখ দিয়ে আমাকে ভষ্ম করে দেওয়ার জোগাড়। তার দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে আমি হাসিমুখে পাশের চেয়ারটা টেনে দিয়ে বললাম,
“আপু, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
সে আমার পাশের চেয়ারে বসল না। রেগেমেগে গিয়ে তার বাবার পাশে বসে পড়ল।
“গাধার মুণ্ডুতে দেখছি বুদ্ধি জন্মেছে।”
পাশ থেকে চাপা স্বরের কটাক্ষ শুনে ভ্রুকুটি করে আড়চোখে তাকালাম। সঙ্গে-সঙ্গেই আরও এক লাইন শ্লেষ উপহার পেলাম।
“তোদের মেয়ে জাতির হিংসুটে স্বভাব তো অতি ভয়ঙ্কর রে। কেমন লজ্জা-শরমেরও মাথা খে’য়ে ফেলে! বাহবা হিংসুটে রমণীর জাতি।”
সেই যে আমি প্লেটে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। খাওয়ার ইতি টানা অবধি ভুল করে আড়চোখেও আর পাশ ফিরে তাকালাম না। তাজ ভাইও আর বিরক্ত করলেন না। বড়োদের সামনে ভদ্র মানুষটি সেজে রইলেন। কিন্তু আফরা আপুর ওপর ইতোমধ্যেই আমার ভীষণ বিরক্তি এসে গেছে। খাওয়ার মাঝে তার সেই পুরোনো বিখ্যাত স্বভাব বজায় রেখে বারবার যেচে পড়ে তাজ ভাইয়ের সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তাজ ভাই নিজে থেকে বিশেষ কোনো আগ্রহ না দেখালেও সে অযথা কথা বাড়িয়েছে। তাজ ভাইদের বংশধর না হলেও, এই মেয়েকেও নিঃসন্দেহে ওভার অ্যাক্টিংয়ের দলের সদস্য বলা যায়। যেহেতু তাজ ভাইয়ের একমাত্র ফুপির মেয়ে, সেহেতু কোনো না কোনোভাবে একটু হলেও রক্তের সম্পর্ক আছে বলা চলে। যদিও ফুপি একদমই ওমন না। নূর আঙ্কেলসহ তার ভাই-বোনরা সবাই খুব বেশিই ভালো। যত গণ্ডগোল তাদের পরবর্তী বংশধর বিচ্ছুগুলোর ভেতর।
বিয়ের বাকি আর মাত্র পাঁচ দিন। ভেবেছিলাম জুম্মান ভাইয়া আজ ভার্সিটি যাবেন না। কিন্তু সে নিজেই আমাকে তাড়া দিলেন ভার্সিটি যাওয়ার তাগিদে। ফাঁকিবাজ বাসায় থাকতে চায় না কাজের ভয়ে। বাসায় থাকলেই যে তাকে বারবার এটা-ওটা আনতে বাজারে যাওয়া লাগে। সৌরভ ভাইয়ার সাথে এই নিয়ে রীতিমতো খোঁচাখুঁচি বেঁধে যায় তার। নিজের বদলে একজন আরেকজনকে খাটানোর ধান্দায় থাকে সারাক্ষণ। বাসায় মেহমানের আগমন আস্তে-আস্তে বাড়বে। তাই সে যেচে পড়ে নিজের ঘাড়ের বোঝা বাড়াতে চায় না, বিধায় ভার্সিটি গিয়ে কাজে ফাঁকি দেওয়ার মতলব। আম্মির অনেক ইচ্ছে ছিল তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে হবে। কিন্তু পাত্রীর পরিবার যেহেতু ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা, সেহেতু বাড়তি ঝামেলা বাড়ানোর ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে হয়েছে। নূর আঙ্কেল আম্মিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, এক ছেলের বিয়ে ঢাকা হলে সমস্যা নেই। আরেকজন তো এখনও বাকি আছে। তার বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান না হয় গ্রামেই হবে। আম্মিও তা-ই মেনে নিয়ে দুঃখ ভুলেছে।
রাতে তাজ ভাই বাড়ি ফেরার পরমুহূর্তেই খেয়াল করলাম আফরা আপু কোনো এক বাহানায় ওনার রুমে গেছে। সেই থেকে মনের ভেতর খচখচ শুরু হলো। এই খচখচানি সহ্যের মাত্রা ছাড়াতেই কোনোকিছু না ভেবে আমিও দ্রুত পায়ে ওনার রুমের সামনে চলে এলাম। আফরা আপু রুমে ঢোকার পর দরজা খোলাই ছিল। তাই আমিও নির্বিঘ্নে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আফরা আপু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টেবিলের একেকটা জিনিস ছুঁয়ে দেখছিল। তাজ ভাইকে রুমের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে না কি? আমার আগমন আফরা আপুর কাছে অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল।‌ আমাকে দেখেই সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তুই এখানে যে?”
আমিও কোনোরকম ইতিউতি ছাড়াই উত্তর দিলাম,
“প্রয়োজনে এসেছি। তাজ ভাই কোথায়?”
“আমাকে বসতে বলে সেই যে ওয়াশরুমে ঢুকল, এখনও বেরোনোর নাম নেই। ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছে কি না আল্লাহ্ জানে।”
আফরা আপুর কথা শেষ হতেই তাজ ভাই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন,
“আমার রুম গল্প করার জায়গা না। ড্রয়িংরুমে যান আপামনিরা।”
আফরা আপু বলে বসল,
“ওয়াশরুমে ঢুকে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাজ ভাই?”
“মশা বাবাজিরা আর ঘুমাতে দিলো কই? খোঁচাখুঁচি করে ঠিকই বের করে ছাড়ল।”
“ইলো বোধ হয় কোনো প্রয়োজনীয় কাজে এসেছে আপনার কাছে।”
তাজ ভাই এক ভ্রু কিঞ্চিত উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনার চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি সরালাম। আফরা আপু পুনরায় আমাকে বলল,
“এই ইলো, তুই কিন্তু নক না করেই রুমে ঢুকে পড়েছিস। সেই খেয়াল আছে? না কি তুই এই কাজটা সবসময় করিস? এই স্বভাবটা কিন্তু একদম ভালো না। সবার একটা প্রাইভেসি আছে। এমন ভুল আর করবি না, বুঝলি? স্বভাব পালটানোর চেষ্টা করবি।”
আমি প্রত্যুত্তর করার জন্য মুখ খুলতেই তাজ ভাই ঘাড়ে হাত বুলাতে-বুলাতে ফট করে বলে উঠলেন,
“আফরা, এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? মাথাটা ধরেছে। বাইরে থেকে এসেছি তো।”
আফরা আপু হয়তো এই মুহূর্তে প্রস্থান করতে চাইছিল না। মুখটা একটু চুপসে গেল। আমার দিকে একবার সরু চোখে তাকিয়ে ‘আনছি’ বলে অনীহা নিয়েই রুম থেকে চলে গেল। তার প্রস্থানে স্বস্তি পেলেও, পরমুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেলাম। তাজ ভাইয়ের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। লজ্জা, দ্বিধা দুটোই একসঙ্গে ভর করল। এবার যদি উনি আমার প্রয়োজনীয় কাজের কথা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কী উত্তর দিব? ওটা তো অযথা ঢপ ছিল। চিন্তায় জবুথবু হয়ে চলে যাওয়ায় কথা মাথায় আসার আগেই বাঁধা পড়ল। উনি এগিয়ে এসে আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ট্রাউজারের পকেটে দুহাত পুরে সটান দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,
“প্রয়োজনীয় কাজ?”
কোনো অজুহাত ঠিক না করে চলে এলেও, হুট করে আরও এক মিথ্যে উত্তর মাথায় আসতে এক মুহূর্তও সময় নিল না আমার মস্তিষ্ক। প্রশ্নের জবাবে বললাম,
“গতকাল যে বইটা এনেছিলেন, ওটা নিতে এসেছি।”
“কিন্তু গতকাল তো আমি কোনো বই আনিনি।”
ব্যস, হাতেনাতে ধরা খাওয়ার কাজ সারা। এরপর ফের কোনো বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে মাথায় এল না। চুপসানো মুখে আমতা-আমতা করতে লাগলাম। উনি তখনও আমার মুখ থেকে দৃষ্টি সরাননি। শেষমেষ বলে বসলাম,
“ওই, আগের দিনের বই। ভুলে গিয়েছিলাম আমি।”
“নিজের জিনিস নিজে খুঁজে নিতে শেখ।”
কথাটা বলেই উনি সরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলেন। ওনার ত্যাড়ামি কথায় এবার আর বিরক্তি এল না। অতি সন্তর্পণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বই খুঁজতে লেগে পড়লাম। পেয়েও গেলাম খুব সহজেই। যেহেতু বই পেয়ে গেছি, সেহেতু আর এখানে দাঁড়ানো যাবে না। কিন্তু আফরা আপু যে আবার আসবে। এই অসভ্য লোক তো সুন্দরী মেয়ে পটানোর পেছনেই পড়ে থাকে। গোমড়া মুখে একবার আয়নার দিকে তাকালাম। উনি তখন আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের দিকেই সরু চোখে তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই বললেন,
“বই পেয়েও দাঁড়িয়ে আছিস কোন মতলবে? নিজের রুমে জায়গা নেই? না কি এখানেই রাত পার করার ধান্দা? আমার রুমে ভাইয়ার শেয়ার আছে, ইউ হ্যাভ নো চান্স। গিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে শুয়ে পড়।”
আমি বিনা প্রতিক্রিয়ায় কথা ঘুরিয়ে ফেললাম।
“কাল এয়ারপোর্টে কে কে যাবে?”
উনি আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চুলের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে উত্তর দিলেন,
“ছেলেরা যাবে। তোরা মেয়েরা হলি একেকটা সাংঘা’তিক সুবিধাবাদী। বাইরে গেলেই শুধু খাই-খাই করিস। একটাকেও নিব না। যেচে পকেট খালি করার সাধ নেই।”
“আমি কবে খাই-খাই করলাম?”
“তুই তো জাতীয় ধান্দাবাজ। নিজে ফাঁসবি না। অন্যগুলো কাজ হাসিল করবে, আর তুই ফ্রি সার্ভিস নিবি। ধান্দাবাজ গাধী।”
আফরা আপু চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। হয়তো তার ধারণা ছিল আমি অনেক আগেই চলে গেছি। তাজ ভাইকে বলে রুমে ঢুকে চা এগিয়ে দিলো। তাজ ভাই হাসিমুখে চা নিয়ে চুমুক দিতেই হাতটা শিরশির করে উঠল। গরম চায়ের কাপটা ওনার মাথার ওপর উলটে ধরার প্রবল ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমিয়ে রাখলাম। আফরা আপু জানাল সবাইকে ডিনারের জন্য ডাকছে। তাজ ভাই চায়ের কাপ হাতে নিয়েই হাঁটা দিলেন। আফরা আপুও তার পেছনে চলল। অগত্যা আমিও তাদের সাথে চললাম। আফরা আপু তাজ ভাইকে পাশ কা’টিয়ে আগেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই তাজ ভাই হাঁটার গতি কমালেন। আমিও ওনাকে পাশ কা’টিয়ে যাওয়া ধরতেই চাপা স্বর কর্ণগুহরে ধাক্কা খাওয়ায় থমকে গেল পা জোড়া। কানের কাছে বেজে উঠল,
“আমার সামনে তোমার যেকোনো মিথ্যে বিশ্বাসযোগ্য হতে অক্ষম। নিজের অক্ষমতা বুঝতে শেখো, ইলুপাখি।”
চকিতে চোখ তুলেও ওই স্বরের উৎপত্তিস্থল পেলাম না। ততক্ষণে মানুষটা রকেটের গতিতে গিয়ে চেয়ার দখল করে বসে পড়েছে। হাবলার মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কেবল ওই নতুন ডাক, নতুন সম্বোধন স্মরণ করলাম, অনুভব করলাম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হতেই বিচলিত পায়ে সোজা রুমে চলে গেলাম। রুমে ঢোকার আগে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম, মশাই কেবল এক চুমুক দেওয়া চায়ের কাপটা আলগোছে আম্মির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ইশারায় ওটা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছেন বোধ হয়। রুমে ঢুকেই ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। আহারে সাধের চা!
পরদিন সকাল হতে না হতেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরি হলো। কী কী রান্না হবে এই নিয়ে বড়োরা একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করে চলল। পরিবারের কর্তা আসছে যে আজ। মেয়েদের কাউকে এয়ারপোর্ট নেওয়া হবে না, এই নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেছে। বাসায় যারা উপস্থিত আছে তারা তো আছেই, সাথে আবার যোগ হয়েছে তাজ ভাইয়ের মামাতো বোন। তারা আজ বিকেলের মধ্যেই আসছে। উক্ত খবর জানামাত্রই ফোন করে-করে আমিরা আপুদের আন্দোলনে যোগদান করেছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সৌরভ ভাইয়া বারবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করছেন,
“ভাগ্যিস আমার আপু ম্যারিড। নইলে এই পাগলা গারদে আরও একটা পাগলি বাড়ত। যাক বাবা, একটা আপদ কমল।”
আমি হেসে জানতে চাইলাম,
“আপনার পরিবার কবে আসবে, ভাইয়া?”
“সম্ভবত বিয়ের আগের দিন। দেরী করে আসুক তা-ই ভালো। নইলে আমার আর সোফাতেও জায়গা হবে না। ফ্লোরে ঘুমাতে হবে। ফ্লোরে শুয়ে ফোন চাপতে বহুত কষ্ট হয় আমার।”
এদিকে তাজ ভাইকে কোনোভাবেই মানাতে না পেরে সবাই রাজ ভাইয়ের পিছু নিয়েছে। কোনোভাবে রাজ ভাইকে রাজি করাতে পারলেই হলো। যাওয়ার ইচ্ছেটা আমারও প্রবল। কিন্তু এখানকার হৈ-চৈ দেখে মুখ খুলতেও ইচ্ছে করছে না। মনকে বুঝালাম, সবাই যেতে পারলে আমিও যাব, না পারলে নেই। হুট করে তাজ ভাইয়ের গতকালের ওই কথাটা মনে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে আমার ভাবনার খবর জানতে পারলে হয়তো আরও একবার কটাক্ষ করে বলতেন, ‘এই তো আজ আবার ঠিকই ফ্রি সার্ভিস নেওয়ার ধান্দায় আছিস।’ কিন্তু পরমুহূর্তে বরাবরের মতোই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। তাজ ভাই রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছিলেন। আমি তখন ড্রয়িংরুম থেকে আসছিলাম। ওনার পাশ দিয়ে যাওয়া ধরতেই চুলের মুঠিতে মৃদু টান অনুভব করলাম। আকস্মিক বাঁধায় পা দুটোও থেমে গেল। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করার ফুরসত পেলাম না। ততক্ষণে মহারাজ চাপা স্বরের একটা বাক্য ব্যয় করেই চুল ছেড়ে চোখের পলকে হনহন করে হেঁটে সদর দরজা খুলে চলে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত কে’টে যাওয়ার পরও আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কথাটা সত্যি ছিল, না কি চাপাবাজি? পরক্ষণেই মনটা চেঁচিয়ে উঠল, তার চাপা স্বরে বলা কথাগুলো একটাও মিথ্যে না। এটা যে তার সত্য বলার অনন্য ধরণ। জুম্মান ভাইয়ার ডাকে গাঢ় ভাবনায় ছেদ পড়ল। উনি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য ডাকছেন। আমিও তড়িঘড়ি করে রওয়ানা হলাম। কিন্তু তখনও আমার মস্তিষ্ক ওই বাক্য স্মরণ করে সন্তর্পণে আনন্দিত হচ্ছে।
“সন্ধ্যায় এসে যেন রেডি দেখি। এক মিনিট লেট করলে এয়ারপোর্ট যাওয়ার ভিসা বাতিল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(🙃)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here