মনোহরিণী পর্ব -১৫+১৬

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
আমার ভাগ্যেরও ভাগ্যে তাজ পরেছে। দুর্ভাগ্যবশত ভাগ্যের মাথা নেই, তাই তার ভাগ্যেই তাজ পরেছে। কে পরিয়েছে তা মূখ্য বিষয় নয়, পরতে যে পেরেছে এটাই আপাতত মূখ্য। তবে এই ভাগ্য থেকে আদৌ তা মাথা পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না, সে বিষয়ে আমি নিজেই অবগত নই। সমস্ত ভূখণ্ডের মেয়েরা তাজ পরে নিজেদের মাথায়, আর আমার জুটেছে ভাগ্যে। মাথা পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে যে লুকোচুরির দেয়াল ভাঙতে হবে। ভাগ্যের বেলায় তো আর ওমন বাধ্যবাধকতা নেই। সে কোনো দেয়াল মানে না। তার হাজারো গল্প চলে আড়ালে আবডালে, অদ্ভুত কাণ্ডে। এই তো আজ ভাগ্যের জোরে কুখ্যাত ডিটেকটিভ মিস্টার আহনাফ তাজওয়ারের গ্যাংয়ের সাথে এয়ারপোর্ট অবধি পৌঁছে গেছি। অথচ কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমরা মেয়েরা কেউ তাদের সাথে যেতে পারব না। এই নিয়ে হ’রতালের শেষ পর্যায়ে তাজ ভাই মেয়েদের জন্য এক শর্ত দাঁড় করালেন। সেই শর্ত শুনে একেকজনের মাথায় আস্ত-আস্ত বজ্রপাত আছড়ে পড়েছে। রুদ্ধশ্বাসে থম মে’রে বসে কা’টিয়েছে কয়েক মুহূর্ত। তীব্র আক্ষেপ, আফসোস নিয়ে অনুরোধের বস্তা খুলে বসেছে। শর্ত হলো এয়ারপোর্টে কেবলমাত্র তারাই যেতে পারবে যারা রাজ ভাইয়ের বিয়ের কোনো প্রোগ্রামে মেকআপ ব্যবহার করবে না। অর্থাৎ বিয়ের কটা দিনের জন্য মেকআপকে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করতে হবে। নচেৎ কোনো মূল্যেই তাদের সাথে নেওয়া হবে না। শর্ত শুনে সর্বপ্রথম আহাজারি করে উঠল আমিরা আপু আর মিনহা আপু। বড়ো ভাইয়ের বিয়েতে মেকআপ ব্যবহার করতে পারবে না, এটা তাদের কাছে ফাঁ’সির রায় ঘোষণার সমান। তারপর শুরু হলো তাজ ভাইয়ের মামাতো বোন আনহা আপুর আহাজারি। আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে আমি বলে দিলাম আমার কোনো সমস্যা নেই। কারণ আমি এমনিতেও খুব একটা মেকআপ করি না। মাঝখান থেকে আফরা আপু চুপ মে’রে রইল। বহু চিন্তা ভাবনার পর বিনীতভাবে বলল সে একদমই সামান্য মেকআপ করবে, যেটুকু না করলেই নয়। প্রথমে কেউ রাজি না হলেও, পরে কী ভেবে তাজ ভাই মেনে নিলেন। শেষে তাদের সাথে আসার ভাগ্য হয়েছে আমার, অলির আর আফরা আপুর। এয়ারপোর্ট আসার পথে অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড ঘটল। যে আফরা আপু এসে হতে তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলছেন, সেই আফরা আপুকেই নিজের গাড়িতে নিজের পাশের সিটে ডেকে বসিয়েছেন তাজ ভাই। ওনার গাড়িতে আফরা আপু, রাজ ভাই আর ওনাদের মামাতো ভাই আদনান ভাইয়াকে বসালেন। জুম্মান ভাইয়ার গাড়িতে বসালেন আমাকে, অলিকে, হিমেল কাকাকে আর সৌরভ ভাইয়াকে। তখন থেকে পুরোপুরি আহাম্মদ বনে গিয়ে বসে আছি আমি। এখানেই থেমে যায়নি। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে যখন নূর আঙ্কেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, তখন দৃষ্টিগোচর হলো তাজ ভাই আফরা আপুর সাথে গুজ-গুজ করছেন। নিজেদের গুজগুজানি নিয়ে দুজন এতটাই ব্যস্ত যে, অন্য কোনোদিকে কারোর নজর নেই। আদনান ভাইয়াকে জুম্মান ভাইয়াদের সাথে বলতে শুনলাম গাড়িতে বসেও দুজন সারাটা পথ এমন গুজ-গুজ করেছে। হুট করেই আমার মনের কোথাও একটা অজানা শঙ্কা কড়া নাড়ল। বুকের ভেতর শুরু হলো মৃদুমন্দ শব্দের ধুকপুকানি। কোনো এক অমূল্য সম্পদ হারানোর ভয়ে কন্ঠনালি শুকিয়ে এল। বারবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখলাম। দ্বিতীয়বার আর ওই মানুষ দুটোর দিকে ফিরেও তাকালাম না। চুপচাপ জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়ার খোঁচাখুঁচি দেখলাম। নূর আঙ্কেলের দেখা পাওয়ার পর সবাই আনন্দে মেতে উঠলাম। হাসিমুখে সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর সবাই গাড়ির কাছে ফিরে আসতেই আঙ্কেল আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা বাইরে থেকে কিছু খেয়ে যাব কি না। রাজ ভাইয়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন ছোটোদের নিয়ে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করে পরে বাসায় ফিরতে। আর আঙ্কেল হিমেল কাকাকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন। বাকি সবাই এতে চাপা স্বরে হৈ-হৈ করে উঠলেও, আমি সঙ্গে-সঙ্গেই বলে দিলাম আমি আর বাইরে থাকতে পারব না। আঙ্কেলের সাথেই বাসায় ফিরে যাব। কারণ হিসেবে দাঁড় করালাম মাথা ব্যথাকে। তবু সবাই একটু জোরাজুরি করলেও নূর আঙ্কেল বাঁধ সাধলেন। আমাকে ওনাদের সাথে নিয়ে বাকি সবাইকে বললেন খাওয়া-দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। ফিরে আসার মুহূর্তে কারো স্থির, শীতল দৃষ্টি টের পেয়েও ইচ্ছে করে চোখে চোখ রাখলাম না। আঙ্কেল আর হিমেল কাকার সাথে চুপচাপ বাসায় ফিরে এলাম। নূর আঙ্কেলকে পেয়ে বাসায় উৎসবের আমেজ তরতর করে বেড়ে গেল। আমার মাথাব্যথার কথা শুনে আম্মি চটপট চা করে দিলো। চা খেয়েই আমি চুপচাপ রুমে চলে এলাম। এসেই ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। মস্তিষ্কের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু চোখ জোড়া বড়ো অবাধ্য হয়ে উঠল। কিছুতেই ঘুমের রাজ্যের দেখা মিলল না। এপাশ-ওপাশ করে রীতিমতো বিরক্তি বাড়ল। তবু চরম অলসের মতো বিছানায় পড়ে রইলাম। অনেকটা সময় পর চোখ জোড়া ক্লান্ত হয়ে বুজে এল। ঘুমের স্থায়িত্ব কতক্ষণ হয়েছে জানা নেই। কানে লাগাতার সুরসুরি অনুভব করায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে দারুণ অনীহা নিয়েই পিটপিট করে চোখ খুললাম। বিছানার পাশে দণ্ডায়মান গম্ভীরমুখো পুরুষটিকে দেখে চোখ কুঁচকে ফেললাম। চোখে চোখ পড়তেই সূক্ষ্ম এক অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ওপাশ থেকে ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর ভেসে এল,
“মাথাব্যথার ভং ধরে পড়ে থাকতে হবে না আর, উঠে পড়। খেতে ডাকছে।”
প্রথম কথাটা এড়িয়ে গিয়ে আমি থমথমে মুখে শেষ কথার উত্তর দিলাম,
“ক্ষুধা নেই, ঘুমাব আমি।”
“ত্যাড়ামি উত্তর শুনতে চাইনি। উঠতে বলেছি।”
“আমার ক্ষুধা পেলে আমি নিজেই যেতাম, ডাকতে হত না। আপনি গিয়ে নিজের ক্ষুধা মেটান।”
পাশে ধপ করে কিছু পড়ার শব্দ হতেই চোখ খুললাম। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম উনি পেছনে বসেছেন। কন্ঠে আফসোস নিয়ে বললেন,
“সব ক্ষুধা কি আর ভাতে মেটে রে গাধি?”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। লোকটা কখন কী উদ্দেশ্য করে কী কথা বলে নিজেই জানে না। কথার ধরণ! আমি পূর্বের ন্যায় বললাম,
“আপনি যান তাজ ভাই,‌ প্লিজ। আমার মাথাব্যথা কমেনি।”
“তোর মাথাব্যথা হয়েছে কখন যে কমবে? সত্য হলে এতক্ষণে কমে যেত, মিথ্যে বলে কমেনি। কমার কোনো চান্সও নেই।”
এবার আমি বিরক্তির সুরে বলে উঠলাম,
“কত সত্যই আমাদের আড়ালে ঘটে। আপনার কোনো বিষয়ে তো আমি ডিকটিভিটি করতে যাই না। আপনি কেন করতে আসেন? আমার সব বিষয়ে আপনাকে ডিটেকটিভিটি করতে ডাকিনি আমি।”
তারপর কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা চলল। সাড়া না পেয়ে আমি ভ্রুকুটি করলাম। এখনও পাশে বসে আছে, অথচ মুখে রা নেই কেন? কথাটা গায়ে লাগল বুঝি? বেশ হয়েছে। এবার বুঝুক মজা। হাতের কব্জিতে টান অনুভব করতেই চট করে ঘাড় ঘুরালাম। ততক্ষণে তাজ ভাই এক টানে আমাকে সটান বসিয়ে দিয়েছেন। আমি কিছু বলার আগেই রুষ্ট গলায় বললেন,
“নাম, আর একটা কথা বললে শুট করে খুলি উড়িয়ে দেবো। নাম, কুইক।”
ওনার মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে আমি বললাম,
“কী শুরু করেছেন আপনি? আজব! বললাম না আমার ক্ষুধা নেই? আমি খেলে কি আপনার পেট ভরবে? রোজ-রোজ খাবার নিয়ে আপনার এই টানাহেঁচড়া ভালো লাগে না আমার।”
উনি এবার ধমকে উঠলেন,
“থাপড়ে ত্যাড়ামি ঘুচিয়ে দেবো। সবাই খাচ্ছে বলে আমি ডাকতে এসেছি। এতক্ষণ অবধি তোর ত্যাড়ামি দেখতে আসিনি। পাছে সবাই না ভেবে বসে এতক্ষণ ধরে তোকে ওরে সোনা, ওরে ময়না বলে কোলে নিয়ে বসে ঘুম ভাঙাচ্ছি আমি। দেখ, আমি আগাগোড়া খুব বেশি ভদ্র ছেলে। তোর জন্য কোনো মিথ্যে অপবাদ নিতে পারব না। তারপর দেখা গেল সেই অপবাদ ঘোচাতে সবাই তোকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলো। তোর মতো আস্ত এক মাথামোটা, বলদ, ধান্দাবাজকে গলায় ঝুলিয়ে আমার শান্তিপূর্ণ জীবনটা বরবাদ করার কোনো শখ নেই।”
আমি অবাক হয়ে ওনার কথা শুনলাম। এত ছোটো একটা ব্যাপারকে টেনেহিঁচড়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল! সাধে কি একে বিপজ্জনক বলি? কপট রাগত স্বরে বললাম,
“কী সব বলছেন! সারাক্ষণ বাজে কথা ছাড়া টিকতে পারেন না আপনি? এই রাত-দুপুরে আমাকে বিরক্ত করে কী মজাটা পাচ্ছেন, শুনি? সবাই খাচ্ছে, আপনিও খান গিয়ে। আমার খাওয়া নিয়ে জোর করার কী দরকার ছিল? আপনার প্রাণপ্রিয় মানুষদের গলা দিয়ে খাবার নামবে না আপনাকে ছাড়া। দয়া করে যান।”
উনি শক্ত মুখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কথা শেষ হতেই আলগোছে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি ভাবলাম রেগেমেগে বুঝি চলে যাবে। কিন্তু তা হলো না। যা হলো তা দেখেই আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। আমার পাশেই জেমি আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে ছিল। নিষ্ঠুর, পাষাণ মানুষটা চোখের পলকে আমার পাশ থেকে জেমিকে নিজের দুই হাতে তুলে নিলেন। গভীর ঘুমের মধ্যে শূন্যে ভাসতেই হকচকিয়ে জেমির ঘুম ভেঙে গেল। নিজের অবস্থান দেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিয়াও, মিয়াও করে ডাকতে লাগল। আমি চকিতে রসগোল্লার মতো চোখ করে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম,
“আরে! ওকে এভাবে তুললেন কেন? ভয় পেয়েছে। দিন ওকে, ঘুমাচ্ছিল তো। এটা কেমন কাজ তাজ ভাই?”
উনি দুহাত তুলে জেমিকে আরও ওপরে উঠিয়ে বলল,
“আর একটা শব্দও যেন মুখ থেকে না বেরোয়। চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে গিয়ে ডাইনিংয়ে বসবি। নইলে তোর এই হীরার টুকরো বিলাই আমার হাত ফসকে পড়ে ফ্লোরে আছাড় খেলে, পরে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবি না।”
রাগে আমার মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। ডান পা দিয়ে মেঝেতে সজোরে আঘা’ত করে ধুপধাপ পা ফেলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখলাম উনি জেমিকে পূর্বের জায়গায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি খানিক অবাক হলাম। জেমিকে তো দুচোখে সহ্য করতে পারে না। তাহলে এভাবে কী দেখছে? লোকটা আসলেই অদ্ভুত! আমাকে দেখে উনি একগাল হাসলেন। আহা কী মিষ্টি হাসি! যেন কিছুক্ষণ আগে যা হয়েছে সবই তার অজানা। ওনার দিকে আর তাকালাম না। ঈষৎ রাগ নিয়েই চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। টেবিলে এসে দেখলাম আম্মি, ফুপি আর আফরা আপু এখনও খাচ্ছে। বাকিদের খাওয়া শেষ। আমাকে দেখে আম্মি খেতে বসতে তাড়া দিলো। আমি বসতেই আফরা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ ভাই না তোকে ডাকতে গেল? এতক্ষণ লাগে ডাকতে? কোথায় উনি?”
আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এজন্যই ওনাকে বলেছিলাম চলে আসতে। ঘাড়ত্যাড়া লোকটা কথা তো শুনলই না, এখন আমাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলল। আমি আম্মির হাত থেকে নিজের প্লেটটা নিয়ে বললাম,
“জেমির সাথে দুষ্টুমি করছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তো, প্রথমে ডাক শুনতে পাইনি।”
আফরা আপুর শকুন দৃষ্টি দেখে মনে হলো সে আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আম্মি গলা বাড়িয়ে তাজ ভাইকে ডাকতেই উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে টেবিলের কাছে উপস্থিত হলেন। আমার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে আম্মির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমাদের এই কুম্ভকূর্ণকে ঘুম থেকে তোলার কাজটা দয়া করে আর আমাকে দিবে না, আম্মি। একে তুলতে-তুলতে আমার নিজেরই ঘুম পেয়ে যায়।”
আমি খাবার চিবোতে-চিবোতেই সবার অগোচরে মুখ বাঁকালাম। উপস্থিত ব্যক্তিরা তো আর এই মিথ্যেবাদীর মধুর সুরের সত্যতা ধরতে পারবে না। গিরগিটি একটা! ফুপি খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। আম্মিও এঁটো বাসন রান্নাঘরে নিতে ব্যস্ত হলো। আফরা আপুর হাবভাব দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না সে ইচ্ছে করেই রিল্যাক্সে খাচ্ছে। এরমধ্যে তাজ ভাইয়ের সাথে গল্পও জুড়ে দিয়েছে। আমি চুপচাপ খাবারের সাথে আস্ত-আস্ত অভিমান গিলে চলেছি। অথচ যাকে ঘিরে এত অভিমানের মেলা, সে কি মাইন্ড রিড করতে ভুলে গেছে? এই তো কিছুক্ষণ আগেও আমার মিথ্যে মাথাব্যথার কথাটা অকপটে বলে দিলো। এখন সেই দৈব ক্ষমতা আফরা নামক তৃতীয় ব্যক্তির জন্য গায়েব হয়ে গেছে? হঠাৎ আফরা আপুর মুখ থেকে এক বিষ তীর ধেয়ে এসে কানে বিঁধতেই আমি চরম বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকালাম। সে বলে উঠল,
“ইলো, কথা বলছিস না যেহেতু, সেহেতু দ্রুত খাবারটা শেষ করে উঠে গেলেই পারিস। শুধু-শুধু গোঁ ধরে বসে থেকে কারোর মাঝে থার্ড পার্সন হয়ে তো কাজ নেই, তাই না? অবশ্য তোর তো আজীবনই থার্ড পার্সন হওয়ার অভ্যাস। বদ অভ্যাস থেকে বেরোতে পারিসনি আজও। তাড়াতাড়ি খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়।”
আমি হতবিহ্বল হয়ে একবার আফরা আপুর দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাজ ভাই তখন আফরা আপুর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আমার মৌনতায় উনিই আফরা আপুকে বলে উঠলেন,
“তুইও দেখছি মানুষকে ফাঁসানোর বদ অভ্যাসটা থেকে আজও বেরোতে পারিসনি। ফুপি হয়তো সময়মতো তোকে দু ঘা লাগাতে পারেনি। অ্যানি ওয়ে, আমি কিন্তু এনকাউন্টারটা খুব ভালোই জানি। ট্রেনিং প্রাপ্ত তো। তোর ওপর ট্রাই মা’রা যায়? ধাক্কা সামলে উঠতে পারবি তো?”
উনি মিষ্টি হাসিতে সুমিষ্ট সুরে যেভাবে কথাটা বললেন, আফরা আপুর সাথে আমি নিজেও বিশৃঙ্খলায় পড়ে গেলাম। এই মিষ্ট সুরে তিক্ত কথাটা আফরা আপুকে না রাগতে দিলো, না খুশি হতে দিলো। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জোরপূর্বক বোকা হেসে বলল,
“থাক, আপনার ডিটেকটিভিটি ডেস্ক, ফিল্ড অবধিই রাখুন। বাসায় দেখানোর দরকার নেই।”
এরপর আর আফরা আপু দেরী করল না। দ্রুত পানি পান করে টেবিল ছাড়ল। আমি কেবল নীরব দর্শকের মতো আফরা আপুর মুখের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখলাম। আফরা আপু দৃষ্টির আড়াল হতেই চাপা অভামানটা মনের দ্বারে ঠক-ঠক করে কড়া নাড়ল। খাবারটা পুরোপুরি শেষ না করেই একটু পানি মুখে দিয়ে উঠতে যেতেই আবার উনি পাশ থেকে খপ করে ডান হাতের কব্জি ধরে ফেললেন। বাঁধা পেয়ে আমার আর ওঠা হলো না। তাজ ভাই শক্ত গলায় বললেন,
“কী সমস্যা? খাবার শেষ না করে ওঠার অভ্যাস কবে থেকে হলো?”
আমি ওনার চোখে স্থির দৃষ্টি আটকে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললাম,
“থার্ড পার্সনদের দূরে থাকাই ভালো। যত কাছে থাকবে, তত অসুবিধা বাড়বে। আমি আসলে কখনোই কারোর মধ্যে এলাচি হতে চাই না। না বাসায়, না বাইরে।”
ওনার দৃষ্টি শান্ত হয়েই আমার মুখে নিবদ্ধ রইল। আমি হাত মোচড়াতে-মোচড়াতে বললাম,
“আমার খাওয়া শেষ। হাত ছাড়ুন। আরও আগে ওঠা উচিত ছিল বোধ হয় আমার। অজান্তেই এলাচি হয়ে গেলাম। ছাড়ুন।”
ওনার মাঝে হাত ছাড়ার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হলো না। বরং নিজের ডান হাতে তোলা খাবারটুকু হুট করে আমার মুখে পুরে দিলেন। আবার পুরোপুরি বোকা বনে গিয়ে আমি মুখের খাবারটুকু চিবোতে ভুলে গেলাম। এই লোকটার সাথে আদৌ কি পেরে ওঠা সম্ভব? এই যে এক সামান্য কাণ্ডে কারো চাপা অভিমানের পাহাড় এক নিমিষে ধ্বসে পড়েছে, সে খবর কি সে রাখে? মাইন্ড রিডার হয়েও কেন পারছে না? অবশ্য পারলেও কবে প্রকাশিত হলো? না হয়েছে, না হচ্ছে। ভবিষ্যতে হবে কি না, তা-ই বা কে জানে? এ যে গোটাটাই এক চরম অদ্ভুত মানব। ভেতরের অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে মেকি বিরক্তি প্রকাশ করতে যেতেই উনি পুনরায় স্বভাবসুলভ বাঁধ সেধে বসলেন। আমায় আরেক দফা বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় কৈফিয়তের সুরে বলে চললেন,
“আমাদের চোখের দেখার আড়ালে অনেক সত্য থাকে, যা ইচ্ছে করলেই আমরা দেখতে পারি। কিন্তু ওভার থিংকিংকে ওপরে রেখে যেচে নিজেদের দেখার চোখকেই অন্ধ করে ফেলি। নতুন একটা কেসের ইনভেস্টিগেশনে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশন দরকার ছিল। আফরার সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করেছিলাম। ও মেডিক্যালের স্টুডেন্ট তো, তাই ওর থেকেই ইনফরমেশনগুলো জোগাড় করার সুযোগ পেয়েছি। নাথিং এলস্।”
আমি ফট করে বলে বসলাম,
“তাহলে কি গত ছয় বছর আগে ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারও যেচে নিজের দেখার চোখকে অন্ধ করে ফেলেছিল?”
উনি মৃদু হাসলেন। ওনার এই অকৃত্রিম হাসিটা খুব সূক্ষ্মভাবে আমার সেই অতি পুরোনো অভিমানকে এলোমেলো করে দিলো। পরমুহূর্তেই এলোমেলো অভিমানের ভীত নড়বড়ে করে উনি আমার মুখে আরও এক লোকমা খাবার পুরে রহস্যময় এক বাক্য আওড়ালেন,
“ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের টার্গেট খুব সূক্ষ্ম, ইলুপাখি। ডেস্ক, ফিল্ড অর মাই হোম, অ্যানি প্লেস। আই অ্যাম দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ, ইউ নো?”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
আধ খাওয়া খাবার কেড়ে নেওয়া মানুষগুলো যতই আমাদের প্রিয় বা অপ্রিয় হোক না কেন। এদের ওপর প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত রাগ বা অভিমানটা সবারই জাগে। যৎসামান্য হলেও জাগে। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। একটা খাবার খাওয়ার সময় তার স্বাদের ওপর আস্তে-আস্তে আমাদের মনোযোগ চলে যায়। স্বাদটা ভালো হলে ওটা শেষ করা অবধি ওই মনোযোগটা সবাই ধরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝপথে যদি সেই মুখের খাবারটাই কেড়ে নেওয়া হয়, তবে রাগ বা অভিমান অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি উক্ত ঘটনার এক নিয়মিত ভুক্তভোগী। রোজ আমাকে এই অসহ্যকর ঘটনার শি’কার হতে হয়। যার ফলে রাগ, অভিমান আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে ফ্রেশ হয়ে সর্বপ্রথম চা খাওয়াটা আমার জন্য অতীব জরুরী। নচেৎ মাথাব্যথা আঠার মতো লেগে থাকে। তারমধ্যে আজ ঘুম থেকে উঠেই মাথাসহ চোখ ব্যথা শুরু হয়েছে। চোখ জোড়া হালকা জ্বলছেও। ভেতরের অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে মনে হচ্ছে জ্বর আসবে-আসবে করছে। এখনও সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। রান্নাঘরে আম্মি, ফুপি নাসিমা কাকি আর কুলসুম আপা সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুমের এক সোফায় সৌরভ ভাইয়া উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন, আরেক সোফায় আদনান ভাইয়া। জুম্মান ভাইয়া সিঙ্গেল সোফায় বসে-বসে ঝিমাচ্ছেন। তিনজন বোধ হয় গতকাল রাতে আড্ডা দিতে-দিতে এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চা নিয়ে আমি ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। মনে-মনে বারবার আল্লাহর নাম জপ করলাম, বেশি জ্বর যেন না আসে। রাজ ভাইয়ের বিয়ের আর মাত্র তিন দিন বাকি। আজ সবাই মিলে শপিংয়ে যাবে।
জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে আমি নিশ্চিত সবকিছু থেকে বাতিল হব। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গতকাল রাতের কথা ভাবতে লাগলাম। গতরাতে আফরা আপু দারুণ জ্বালিয়েছিল আমায়। আফরা আপু আর আনহা আপু আমার সাথে ঘুমিয়েছিল। আনহা আপু শোয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অথচ আফরা আপু না নিজে ঘুমিয়েছে, না আমায় ঘুমাতে দিয়েছে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে রীতিমতো জেরা করেছে, আর তার সবটাই তাজ ভাই বিষয়ক। সেই চিরকুটের কথা তাজ ভাই ভুলে গেছে কি না, সুইডেন থেকে ফেরার পর সেই বিষয়ে আমায় কিছু বলেছে কি না, এত বছর আমার সাথে যোগাযোগ না রেখেও এখন এত সহজভাবে কথা বলে কীভাবে, পূর্বের রাগ কমে গেছে কি না, কীভাবে কমেছে, আমি কীভাবে তার সাথে এত সহজভাবে কথা বলছি, আরও কত কী! আমি এসব প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে পারিনি। কারণ পূর্বের সেই ঘটনার বিষয়ে তাজ ভাইয়ের মনে ঠিক কী চলছে, সেসব আমি নিজেই এখনও জানতে পারিনি। তবে ওনার ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, ওই চিরকুট বিষয়ক দোষটা যে আফরা আপুর ছিল, তা উনি বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু মুখে কেন প্রকাশ করছেন না বা বিশ্বাস করার আগে ওনার মনে কী ছিল, সেসব বিষয়ে সত্যিই আমার কোনো ধারণা নেই। আফরা আপু হয়তো আশা করেছিল তাজ ভাই আজও আমার প্রতি পুরোনো রাগ পুষে রেখেছেন। কিন্তু নিজের ভাবনার ভুল প্রমাণ সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। তার কথাবার্তায় এটাও স্পষ্ট ছিল যে, তাজ ভাই আর আমার সঠিক সম্পর্ক নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। আকারে-ইঙ্গিতে আমার মাথায় এটাও বারবার ঢোকানোর চেষ্টা করছিল, তাজ ভাইয়ের প্রতি তার দূর্বলতা ঠিক কতটুকু। তাই তো এত জেরা। গতকাল রাতে আফরা আপুর ওপর মনে-মনে প্রচণ্ড রাগ উঠলেও, তা প্রকাশ করতে পারিনি। বিয়ের কটা দিনই তো থাকবে, এরমধ্যে কোনো ঝামেলা হোক, তা আমি চাই না। নিজে সব ঝামেলা পাকিয়ে উলটো আমাকেই জেরা করেছে। ওদিকে তাজ ভাই নিজেই যে তাকে বারবার এড়িয়ে চলে, সেসব তার মগজে ঢোকে না। বে’য়াদব মহিলা। তার এই আজাইরা বকবক শুনে রাত পৌনে তিনটার দিকে আমাকে ঘুমাতে হয়েছিল। গতকালের ঘটনার বদৌলতে এখন আমি এটুকু নিশ্চিত যে, আফরা আপু এখন ফেভিকল আঠার মতো আমার পেছনেই লেগে থাকবে। ওই মহিলার জ্বালাতন কোনোমতেই সহ্য হয় না আমার। আজ রক্ষা পাব কীভাবে? তাজ ভাই বাসায় থাকলে আফরা আপু তার সামনে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। কিন্তু তাজ ভাই তো একটু পরেই নিজের কাজের পেছনে দৌড় লাগাবে। সারাদিনে ওই মেয়ে আমায় পাগল বানিয়ে নিশ্চিত পাগলা গারদে পাঠিয়ে ছাড়বে। আজকের পরিস্থিতির কথা ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। এই মেয়ের এত প্যারা সইব কীভাবে আমি? ভাবনার মাঝে টেবিল থেকে চায়ের কাপটা উঠাতে হাত বাড়াতেই অবাক হলাম। মুহূর্তে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। টেবিলে চায়ের কাপটা নেই। এই তো কিছুক্ষণ আগেই আমি তিন-চারটা চুমুক দিয়ে সামনেই কাপটা রাখলাম। এরমধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে কাপ উধাও! চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পেছনে সেই রোজকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম। তাজ ভাই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ভীষণ আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। কিন্তু আমার সামনে থেকে যে কাপটা সরাল, আমি টের পেলাম না কেন? ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলাম! ধুর! বসা থেকে দাঁড়াতেই মাথাটা ভীষণভাবে ঘুরে উঠল। এই মাথার যন্ত্রণা থেকে একটু হলেও বাঁচা জরুরী। এমন একটা সময়ে তাজ ভাইয়ের কাণ্ডের ওপর আজ একটু বেশিই বিরক্ত হলাম। আওয়াজ যেন রান্নাঘর অবধি না যায়, এটা ভেবে চাপা স্বরে বিরক্তি ঝাড়লাম,
“আমার চা নিলেন কেন? খা’টাশের মতো আরেকজনের এঁটো চা নির্দিধায় খাওয়া শুরু করেন। নিজে চেয়ে খেতে পারেন না? সবসময় আমারটার ওপরেই নজর থাকে?”
উনি আমার কটাক্ষ গায়ে মাখলেন না। নিজেও চাপা স্বরে বললেন,
“তুই এই এক ভুল রোজ-রোজ করিস কেন রে বলদ? কাপের কোথাও তোর নাম লেখা আছে? জিজ্ঞেস করলে তো আর খুঁজে পাস না। কবে যে কিছু শিখবি। আফসোস! আমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের আশেপাশে থেকেও আজ পর্যন্ত কচুর মাথাও শিখতে পারলি না। তোর উচিত কচু গাছের মাথায় ডিরেক্ট ঝুলে পড়া।”
“আপনার বাজে কথা আপাতত বন্ধ রাখুন, তাজ ভাই। ভালো লাগে না। আমার মাথাব্যথা করছে বলে চা-টা খাচ্ছিলাম। না জেনে সবসময় উদ্ভট আচরণ করে বসেন।”
খিটখিটে মেজাজে আমি চলে যাওয়া ধরতেই উনি হাত টেনে আবার মুখোমুখি দাঁড় করালেন। কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ম চোখে আমার মুখটা নিরীক্ষণ করলেন। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে কপালে হাত ছুঁয়ে দিলেন। ঈষৎ চিন্তিত, কিন্তু মুখে বললেন,
“জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছিস? জ্বর তো কম, মাথাব্যথা বেশি? চোখ তো লাল হয়ে আছে।”
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম,
“জ্বরের থেকে মাথাব্যথা বেশি।”
“জ্বর কখন এসেছে?”
“রাতে।”
“আম্মিকে বলেছিস?”
আমি ডানে-বায়ে মাথা দোলালাম। উনি চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“শরীরে জ্বর নিয়ে রিল্যাক্সে বসে আছেন মহারানি ভিক্টোরিয়া। বিছানায় পড়ার পর জানানোর ইচ্ছে ছিল? দুদিন বাদে তোর বাপ এসে দেখবে তার মেয়ে জ্বরে ভুগছে। বদনামটা কার হবে, শুনি? আমাদের। চা’পড়ে দু পাটি দাঁত ফেললে তুই সোজা পথে হাঁটবি, মাথামোটা।”
আমি গাল ফুলিয়ে চাইলাম। অসুস্থতার কথা শুনে কোথায় একটু ব্যস্ততা দেখাবে, তা না। উনি রাগ ঝাড়ছেন। শক্ত মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বললাম,
“হালকা জ্বর, নাপা খেলেই কমে যাবে। আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
উনি শুনেও শুনলেন না। উলটো আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ওনার রুমে নিয়ে গেলেন। আমার কোনো বাঁধাই কাজে এল না। রুমে এসে বিছানায় বসিয়ে কড়া গলায় বললেন,
“এক পা-ও নড়বি না এখান থেকে। আমি এক্ষুনি যাব আর আসব। এসে যেন এখানেই দেখি।”
“কেন? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
আমার প্রশ্নের জবাব তো দূর, প্রশ্নটা বোধ হয় সম্পূর্ণ শুনলেনও না। হনহনিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখে চলে গেলেন। আমি মাথাটা জোরে ঝাঁকুনি দিলাম। মাথাব্যথা কমার বদলে তরতর করে বেড়ে চলেছে। এই ব্যথার সাথেই হয়তো জ্বর বেড়ে যাবে। শেষ আমার আনন্দ। সমস্ত আনন্দের মাথায় বাড়ি। এবার আমি শুধু ভিখারির মতো বসে-বসে সবার হৈ-হুল্লোড় দেখব। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসে মনে-মনে আফসোসের জাল বুনছিলাম। জাল কে’টে রুমে এল তাজ ভাই আর আম্মি। আম্মির হাতে খাবার। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার কপালে হাত রেখে বলল,
“হঠাৎ জ্বর বাঁধালে কী করে, আম্মু? আমায় বলোনি কেন?”
আমি বললাম,
“বেশি না, আম্মি। ব্যস্ত হয়ো না। মাথাটা বেশি ব্যথা করছে।”
“কম থেকেই বাড়বে। খাবারটা খাও, নাপা খেলে যদি না সারে তাহলে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।”
খাবার দেখে মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। অনিচ্ছুক চাহনিতে তাকিয়ে বললাম,
“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। পরে খাব।”
পাশ থেকে তাজ ভাই বিদ্রুপ করে বললেন,
“পরে খেতে-খেতে এই জ্বর তোকে গিলে খাবে। খাবার আর খাওয়া হবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।”
আম্মি পাশে বসে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“এখন খেলেই ভালো হবে। কষ্ট করে একটু খাও। নিজের হাতে খেতে পারবে? আমি হাতের কাজ ফেলে রেখে এসেছি।”
আমার আগে তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“পারবে, পারবে। তুমি কাজে যাও।”
আম্মি সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। তাজ ভাই গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন,
“আমার খাবারটা দিয়ো। বেরোতে হবে।”
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে খাবারের দিকে অনিচ্ছা ভরা চোখে তাকিয়ে ছিলাম। উনি এগিয়ে এসে সামনে বসে বললেন,
“খাবারের মধ্যে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য লুকানো আছে? এভাবে কী দেখছিস?”
“মুখে স্বাদ নেই। পরে খেয়ে নিব।”
উনি শুনলেন না। রুটি ছিঁড়ে মুখের কাছে ধরলেন। আমি অসহায় মুখে বললাম,
“ভালো লাগছে না। বলছি তো পরে খাব।”
“হা কর। উলটা-পালটা কথা বললে কানের দুই ইঞ্চি নিচে লাগাব। জ্বর বাপ, বাপ করে পালাবে।”
আমার কোনো অনিচ্ছাই ওনার কাছে গুরুত্ব পেল না। ধমকা-ধমকি করে ঠেসে-ঠেসে মুখে খাবার পুরলেন। মুখে স্বাদ না থাকায় খাবার বিরক্ত লাগলেও, এই মুহূর্তটায় কিছু একটা ছিল। কিছু সময়ের জন্য মনে হলো এমন হাজারো মুহূর্তগুলো থেমে থাকুক, আটকা পড়ুক দৈব কোনো ফ্রেমে। পৃথিবীর সমস্ত বদ নজরকে টেক্কা দিয়ে আমার মাথার ওপর এক তাজের ছায়া থাকুক আজ, কাল, চিরকাল। হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতিগুলোতে ছেদ পড়ল অভক্তিতে। অর্ধেকটা খাবার খাওয়ার পর আমার মুখ বাঁধ সাধল। উনিও আর জোর করলেন না। একটা নাপা হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি চুপচাপ তা গলধঃকরন করলাম। রাজ ভাইয়ের কথা মনে পড়ায় প্রশ্ন করলাম,
“রাজ ভাই কোথায়?”
“আব্বুর সাথে বাজারে গেছে। চা খাবি?”
“না, আর ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে চুপচাপ শুয়ে থাক।”
আমি দ্বিমত করলাম না। না শুলে এই ভয়ানক মাথাব্যথা থেকে রেহাই পাব না। আমি শুয়ে পড়তেই উনি দরজা ভেজিয়ে খেতে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। এই বিছানায় এর আগে শোয়ার ভাগ্য হয়নি। আজ প্রথম হয়েছে। কেউ একজন যেন মিশে আছে এখানে। একটা পরিচিত সুগন্ধ, একটা পরিচিত অনুভূতি। খাবার টেবিলের গল্প, আড্ডার গুনগুন শব্দ আমার কানে এল। নূর আঙ্কেল আসার পর এই আড্ডার রেশ বেশ বেড়েছে।‌ তাজ ভাই খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তো ভাবলাম এতক্ষণে মহারানি ঘুমে বেহুঁশ।”
ওনাকে পোশাক বের করতে দেখে বুঝলাম এখনই বেরোবেন। প্রশ্ন করলাম,
“অফিসে যাবেন, না কি কোনো ইনভেস্টিগেশনে?”
“আগে অফিসে যাব, ওখান থেকে ইনভেস্টিগেশনে। অফিসে বেশিক্ষণ থাকা হবে না। প্রচুর কাজ।”
উত্তর দিয়েই উনি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন। বেরোলেন ফর্মাল গেটআপে। ব্লাক জিন্স আর ডার্ক ব্লু শার্ট ইন করে পরেছেন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে ব্রাশ চালাতে ব্যস্ত হলেন। আমি তখন কাত হয়ে শুয়ে আয়নার প্রতিবিম্বে শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি। ওনার চোখে ধরা পড়ে গেলাম খুব সহজেই। উনি আয়নার ভিতরে আমার প্রতিবিম্বের দিকে একবার তাকিয়ে সহাস্যে কৌতুক করলেন,
“বয়ফ্রেন্ডকে ধোঁকা দিয়ে আমার প্রেমে পড়ার মতলব করছিস না কি? বদ নজর দিয়ে লাভ নেই। আমি পিওর সিঙ্গেল। তোদের মেয়ে জাতির আজাইরা প্যারা নেওয়ার মতো ভুল আমি করব না। করার হলে সুইডিশ সুন্দরীদের থেকেই একটা বেছে নিতাম। আমি আবার সুবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন সুপুরুষ। জেনেশুনে বি’ষ পান করি না।”
আমি কপাল কুঁচকে ঠোঁটের ফাঁকে হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। লোকটা জীবনেও শুধরাবে না। সবসময় অপ্রয়োজনীয় কথা বলে, আবার নিজেকে সুবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন সুপুরুষ বলেও দাবি করে। অসম্ভব মানুষ। ওনার কথার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলাম না আমি। কারণ আমার মাথায় তখন আফরা আপুর চিন্তা। একটা প্রশ্ন গলায় এসেও আটকে আছে।‌ করব, না কি করব না, এই নিয়ে দ্বিধায় পড়েছি। শেষে একটু নড়েচড়ে শুয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
“একদিন না গেলে কি সমস্যা হবে?”
উনি হাতঘড়ি পারছিলেন।‌ আমার প্রশ্নে থেমে গেলেন। আয়নার ভেতরে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।‌ হয়তো আমার এমন উদ্ভট প্রশ্নে অবাক হয়েছেন। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চোখ সরাতেই উনি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আমার মাথায় এক হাত রাখতেই আমি ফিরে তাকালাম। উনি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কিঞ্চিত নরম সুরে প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে?”
কোমল কন্ঠে আমি কেমন এলোমেলো হয়ে পড়লাম। দ্রুত ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,
“কিছু না। এমনি জানতে চেয়েছি।”
“আফরা কিছু বলেছে?”
আমি খানিক চমকাল। পুনরায় না-সূচক মাথা দুলিয়ে বললাম,
“কিছু হয়নি বললাম তো। যান আপনি।”
উনি দমে গেলেন না। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না, এতদিনে এটা তোমার বুঝার কথা। ফটাফট বলে ফেলো আফরা কী বলেছে। দুই মিনিট সময় দিলাম।”
ওনার কথার সুরে আমি বাক্য হারিয়ে ফেললাম। হুটহাট এই ‘তুমি’ সম্বোধনটা প্রতিবারই আমাকে চমকে দেয়। বক্ষপঞ্জরের ভেতরের বেপরোয়া যন্ত্রটা বড়ো অ’সভ্য আচরণ করে ওঠে। নিজেকে সামলে কোনোরকমে অজুহাত তুললাম,
“মাথাব্যথা করছে, ঘুমাব আমি। আপনি যাচ্ছেন না কেন?”
উনি কা’টকা’ট কন্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“দুই মিনিট দিয়েছি।”
আমার কন্ঠনালি কিঞ্চিত কেঁপে উঠল। ওই শক্তপোক্ত মুখ, আর ধারাল অ’স্ত্রের ন্যায় দৃষ্টির সামনে কথা আড়াল করার ক্ষমতা আমি রাখি না। অসহায় মুখে মিনমিনে কন্ঠে গতরাতে আফরা আপুর বলা সমস্ত কথা গড়গড় করে উগড়ে দিলাম।‌ এক লাইনও বাদ পড়ল না তার মধ্য থেকে। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলেন। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ছাড়া ওনার মুখে তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া আমার চোখে পড়েনি। এই মানুষটার মুখ দেখে মন পড়ার মতো বিশাল ক্ষমতা বোধ হয় আম্মি ছাড়া কারোরই নেই। অথচ উনি আমার চোখে চোখ রেখে কত সহজেই মনের কোণে লুকানো অবস্থাও বুঝে ফেলেন। আফরা আপুর সমস্ত কথা বলার পর সুযোগ বুঝে আমি নিজের মনের প্রশ্নটাও ব্যক্ত করে বসলাম।
“ছয় বছর আগের ওই বিষয়টা নিয়ে আপনার মনে ঠিক কী আছে বলুন তো? আমার কাছে আপনার সব কথাবার্তা কেমন ধোঁয়াশা লাগে। মুখে এখনও আমাকে দোষারোপ করেন, আর আচরণে তার উলটোটা।”
উনি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোনোর সময় শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলে গেলেন,
“ঘুমা, এই রুম থেকে বেরোনোর দরকার নেই। জ্বর বাড়লে বা খারাপ লাগলে আম্মিকে জানাবি। পাকামো করে বাইরে ঘুরঘুর করবি না। আমি আম্মিকে বলে যাব। আমিরাদেরও বলে যাব, ওরা এসে সময় দিবে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসব আমি। এসে যদি শুনি লাফালাফি করেছিস, বুড়িগঙ্গায় ডু’বিয়ে মা’রব।”
সব কথার শেষে একটা বাজে কথা থাকবেই। নইলে যেন তার খাবার হজম হয় না। মিষ্টি কথার মাঝে শান্ত স্বরের হু’মকি, বাহ্! উপায়ান্তর না পেয়ে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটানা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল, তখন চোখ মেলেই আপদ সামনে পেলাম। সঙ্গে আমিরা আপু, মিনহা আপু, আনহা আপু, জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়া। মাথাব্যথা একটু কম অনুভব করলাম। আফরা আপু বিছানায় পা তুলে পদ্মাসনের ন্যায় বসে ফোন ঘাঁটছিল। আমি উঠে বসতেই মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। হাসিহীন মুখে বলল,
“এই শুনি বছরের পর বছর কথা হয় না, আবার এখন ডিরেক্ট বিছানা দখল করে শুয়ে আছিস? আমার জানামতে তাজ ভাই তোকে একদমই সহ্য করতে পারে না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুই নিজেই ওনার পেছনে পড়েছিস।”
আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপু প্লিজ। আমার শরীর খুব খারাপ, এখন আপাতত এসব বাজে কথা বোলো না। শুনতে খারাপ লাগে। আমি কোনোকালেই ওনার পেছনে পড়িনি। তুমি তা ওনাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। অযথা আমাকে এসব বলা বন্ধ করো। আর এই বিছানায় আমি নিজের ইচ্ছায় ঘুমাইনি। অন্য কোনো রুম ফাঁকা ছিল না বলে উনি নিজেই এখানে ঘুমাতে বলে গেছেন।”
আমার উত্তরে সে সন্তুষ্ট হলো না। হয়তো আরও অনেক কটু কথা শোনানোর অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিল। পাশ থেকে আমিরা আপুরা বাঁধা দেওয়ায় সে মুখটা বাংলার পাঁচ করে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। সৌরভ ভাইয়া হাঁফ ছেড়ে বললেন,
“উফ্, বাঁচা গেছে। এই মহিলা সামনে থাকলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। খালি ছেলেদের পেছনে ঘুরঘুর।”
আমিরা আপু বলল,
“আচ্ছা? আমিও তো তাজ ভাইয়ের ওপর ফিদা। কিন্তু ওর মতো তো এভাবে পেছনে পড়ে থাকি না। আড়ালে আবডালে প্রেমে পড়ি। ও এসে হতে তাজ ভাইয়ের পেছনে পড়ে আছে। ওর মতিগতি আমার একদমই সুবিধার ঠেকছে না।”
আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
“সুবিধার হলে তো সুবিধার ঠেকবে। এসে হতে আমাকে কথা শুনিয়ে চলেছে।”
আনহা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ ভাইকে নিয়ে?”
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালাম। জুম্মান ভাইয়া রাগত স্বরে বললেন,
“এই আদিম যুগের কাহিনি নিয়ে এখনও পড়ে আছে কেন? আজব! মানুষের মন কি সবসময় একরকম থাকে? তাজ ভাই আগে একটা মিথ্যের জন্য রেগে ছিল বলে যে এখনও রেগে থাকবে, এমন কোনো কথা আছে? হয়তো সে চিন্তা করেছে, ছোটো একটা মেয়ের ওপর এভাবে রেগে থাকা ঠিক না। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওই গণ্ডগোলটা তো আফরা আপুই বাঁধিয়েছিল। এখন তাজ ভাই যে ইলোর ওপর থেকে রাগ উঠিয়ে নিয়েছে, এটা তার সহ্য হচ্ছে না।”
মিনহা আপু চোয়াল শক্ত করে বলল,
“বদ মহিলা।‌ কী দরকার ছিল ওমন ঝামেলা বাঁধানোর? ইলো তখন নাইনে পড়া ছোট্ট একটা মেয়ে। এমন তো নয় যে তার মতো ইলোও তখন তাজ ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। শুধু-শুধু ওর সাথে এমন শত্রুতা করার কোনো প্রয়োজন ছিল? ভেজাল ছাড়া বাঁচতেই পারে না।”
সৌরভ ভাইয়া বলল,
“এদিকে তোমরা বকবকানির ঠেলায় রোগীর খবর নিতেই ভুলে বসে আছো। খবরটা কি রাতে নিবে?”
এবার সবাই নড়েচড়ে বসল। আমার শরীরের অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। তাপমাত্রা একটু বেড়েছে জেনেই সবার মাথায় হাত পড়ল। হা-হুতাশ শুরু করল, সন্ধ্যায় সবার সাথে শপিংয়ে কী করে যাব আমি। অবশ্য এই নিয়ে আমার নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। হয়তো আমার যাওয়াই হবে না। সবাই শপিংয়ে যাবে, আর আমি বাসায় কম্বল মুড়ি দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাব। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন জ্বর বেড়ে চলল, তখন আম্মি অনেকক্ষণ অবধি জলপট্টি দিয়ে দিলো, মাথায় পানি দিলো। কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। শেষে রাজ ভাই আমায় টেনেহিঁচড়ে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেল। তখন বিকেল চারটা। ডক্টর পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে একগাদা ঔষধ ধরিয়ে দিলেন। সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এসেই নাকমুখ খিঁচে একটার পর একটা ঔষধ গলধঃকরন করতে হলো। তারপর আবার ঘুম। মাগরিবের সময় ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সবাই শপিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হতে তাড়া দেখাচ্ছে। আমি কোনোমতে নামাজ আদায় করে ঠাঁয় বসে রইলাম। ঔষধ খেয়ে ঘুম দেওয়ায় একটু হালকা বোধ হচ্ছে। কিন্তু মাথাটা এখনও ভার হয়ে আছে। এই অবস্থায় বাইরে গেলে মাথা ঘুরে-টুরে পড়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তারপর আমার জন্য সবার আনন্দ মাটি হবে। অগত্যা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিতে হলো। যে-ই আমাকে সাধল, তাকেই অনিচ্ছা প্রকাশ করলাম। সবাই রেডি হচ্ছে, অথচ তাজ ভাইয়ের খবর নেই। উনি কি ফিরেননি এখনও? সকালে তো ঠিকই বলে গিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আফরা আপু আর আনহা আপু রেডি হতে-হতে গল্প করছে। আমি আলগোছে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারদিকে আকাঙ্ক্ষিত মুখের খোঁজ চালালাম। কোথাও না পেয়ে কিছু না ভেবেই ওনার রুমের দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গেই একটা শীতল কন্ঠস্বর এতক্ষণের বিচলিত মনকে ঝুপ করে শান্ত করে দিলো।
“একটা অবিবাহিত ভদ্র ছেলের রুমে এভাবে উঁকি-ঝুঁকি দেওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এমন বদ অভ্যাসের কারণে দেখা যাবে আমার বাসর রাতে রুমের দরজার সামনে পাহারাদার রাখতে হবে।‌ কে কখন পুরোনো অভ্যাসবশত উঁকি দিয়ে আমার বউয়ের মান সম্মানের বারোটা বাজায়, তার তো গ্যারান্টি নেই।”
কথাগুলো বলতে-বলতে উনি এগিয়ে এলেন। ফাঁকা দরজাটা আরেকটু ফাঁক করে আমার হাত টেনে ভেতরে ঢুকালেন। ড্রেসআপ দেখে বুঝলাম শপিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। উনি আমায় বিছানায় বসিয়ে বললেন,
“জ্বর তো আরও বাড়িয়ে বসে আছেন। বিয়ের প্রোগ্রামে কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন? বিছানায় শুয়ে, বসে এনজয় করতে হবে।”
আমি মিনমিনে গলায় বললাম,
“বেশি না তো, কমে যাবে।”
“হ্যাঁ, কমে যাবে। তুই তো জ্বরের বাপ-মা। যেতে বললেই বাধ্য মেয়ের মতো চলে যাবে। আমি এখন ফিরিনি। মাগরিবের আগে ফিরেছি। জ্বরের অবস্থা দেখেছি। ভাইয়া ডক্টরের কাছে নেওয়ার আগেই আম্মি জানিয়েছিল আমায়। শুনলাম দুপুরে ঠিকমতো খাসনি?”
“খেয়েছি তো।”
“জানা আছে আমার। মাথাব্যথার কী অবস্থা?”
“একটু কম, কিন্তু পুরোপুরি কমেনি। ভার হয়ে আছে।”
“যাবি? এত হাঁটাহাঁটি করলে তো পরে অজ্ঞান অবস্থায় বাসায় আনতে হবে।”
আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। সবার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে আমার আছে, কিন্তু শরীরের কথাও তো ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। তাজ ভাই মৃদু হাসলেন। চুলে আলতো টান মে’রে বললেন,
“যেতে চাইলেও এখন নিব না। আগে সুস্থতা, তারপর সব। এতগুলো মানুষের শপিংয়ে অনেক সময় লাগবে। তার ওপর এতগুলো মহিলা নিয়ে যাচ্ছি। এদের তো আবার এক মিনিটের জায়গায় এক ঘন্টা লেগে যায়। কত রাত হয় তার ঠিক নেই। এই অবস্থায় এত দৌড়াদৌড়ি কূলাবে না।”
আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“কী আর করা? কপাল খারাপ।”
“উঁহু, যা হবার ভালোর জন্যই হয়। হয়তো বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তাই বাঁধা পড়েছে। বাসায় খারাপ লাগবে না। সায়মা আপুরা আসছে। আটটার মধ্যেই চলে আসবে।”
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
“সায়মা আপু আসছে? কই? আমি তো কিছু শুনলাম না।”
“সবাই জানে না। আম্মিকে ফোন করেছিল। আম্মি শুধু আমাকে আর আব্বুকে জানিয়েছে। আসার পর তো সবাই দেখবেই।”
“সৌরভ ভাইয়াও জানে না?”
“না,” হাসিমুখে উত্তর দিলেন উনি।
এতক্ষণ আমার মনটা একটু খারাপ হলেও, খবরটা শুনে তার চেয়ে বেশি আনন্দ লাগছে। তাজ ভাইয়ের কাজিন মহলের মধ্যে সায়মা আপু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার সাথে আমার সম্পর্কটা সমবয়সী বান্ধবীর মতো।‌ অনেক মাস বাদে দুজনের দেখা হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমরা দিন-রাত গল্প নিয়েই পড়ে থাকি। এত মাসের জমানো সব কথায় জমজমাট আড্ডা বসাই। সায়মা আপু সদা হাসিখুশি মিষ্টি একটা মেয়ে। তার হাসি মুখটা দেখলে ভালোবাসাটা আপনা-আপনি এসে যায়। আমার ধারণা সায়মা আপু আম্মির মতো হয়েছে। আম্মির স্বভাবের শতভাগ তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মায়ের মতো না হয়ে, খালামনির মতো হয়েছে। কথাটা বললেই সে হেসে উত্তর দেয়, কথায়ই তো আছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। দলবেঁধে সবাই শপিংয়ে বেরোনোর সময় আবার আমার মুখটা ভার হলো। এই দলের মধ্যে আমি থাকব না, মানা যায়? সৌরভ ভাইয়া যাওয়ার সময় দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,
“আপনার জন্য খারাপ লাগছে, আপু। এই অসুখটা আপনার না হয়ে, আফরা আপুর হলে ভালো হত। মহিলা সঠিক সময়ে উচিত শিক্ষা পেত। যাইহোক, মন খারাপ করবেন না। আপনার জন্য ফুসকা নিয়ে আসব।”
আমি মেকি হাসলাম। সে যে কত ফুসকা আনবে, জানা আছে আমার। ফোনের ভেতর ডুব দিতেই ফুসকার ফ-ও মনে থাকবে না। সায়মা আপুরা আসা অবধি প্রচণ্ড খারাপ লাগা নিয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। তারা এল সাড়ে আটটার দিকে। সৌরভ ভাইয়ার বড়ো দুই ভাই-বোন অনিক ভাইয়া, সায়মা আপু, সায়মা আপুর হাসবেন্ড আর আন্টি-আঙ্কেল এসেছেন। সায়মা আপুকে পেয়েই সব খারাপ লাগা কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার জ্বর শুনে তারা বেশ আফসোস করল। অনিক ভাইয়া এসেই বাইরে ছুটেছেন। সবার সাথে শপিংয়ের শেষ পর্বে যোগ দিতে চায় সে। সায়মা আপুর পরিবারের সাথে আমার সময়গুলো বেশ ভালোই কে’টে গেল। জ্বরের মাত্রা বাড়ছে টের পেয়েও হাসি, আড্ডায় সময় কা’টালাম। সবাই ফেরা অবধি অপেক্ষা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শরীরে কূলাল না। শপিংয়ে না গিয়ে কী যে ভালো করেছি, তা হারে-হারে টের পেলাম। গেলে এতক্ষণে আমায় নিয়ে হসপিটালে দৌড়াতে হত। আম্মি খাবারের জন্য জোরাজুরি করল। শেষে সায়মা আপু জোর করে একটু খাবার খেতে বাধ্য করল। ঔষধ খাওয়ার জন্য ওইটুকু খেতেই হয়েছে। জ্বরের খবর শুনে সকাল থেকে এই পর্যন্ত হাজারবার ফোন করেছে আব্বু-আম্মু। একবার আমাকে, তো আরেকবার আম্মিকে। মেয়ের অসুস্থতায় তাদের দুশ্চিন্তা এমন যে, পারলে এক্ষুনি এসে নিয়ে যেত। দূরে থেকে এই কষ্টটা আমিও বেশ গভীরভাবে অনুভব করি। এই অসুস্থতার সময়গুলোতে অন্তত ‘আম্মু’ নামক মানুষটাকে বড্ড বেশি প্রয়োজন। আম্মি কখনও আমায় আম্মুর থেকে কম ভালোবাসে না। সবসময় চেষ্টা করে আম্মুর অভাব পূরণ করতে। হাজার হলেও ওই মানুষটা আমার জন্মদাত্রী। আমার কাছে সে সবসময় আমার পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসার উর্ধ্বে ছিল, আছে এবং থাকবে। ক্লান্ত চোখ দুটোতে নিদ্রা ভর করল রাত এগারোটা বাজতেই। অথচ সবাই কত রাতে ফেরে তার ঠিক নেই। ঘুমানোর আগ মুহূর্তেও আমার মনে এক সূক্ষ্ম অভিমান নাড়া দিলো। এতটা সময় কে’টে গেল। অথচ একবার তো ফোন করে ওদিকের খবরটুকু জানাল না। জ্বরের অবস্থাও জানতে চাইল না। কত আনন্দের সময় কা’টাচ্ছে, হুঁহ্! আমার অনুপস্থিতিতে কি কারোর কিচ্ছু যায় আসে না?‌

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

(সবাই একটু রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন, প্লিজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here