মনোহরিণী পর্ব -১৭+১৮

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
নতুন দিন, নতুন প্রভাত, নতুন সূর্য। প্রকৃতির রোজকার রুটিনের কোনো হেরফের নেই। নিয়মের শিকলে আবদ্ধ সে। যেকোনো পরিস্থিতিতে এই নিয়মের এদিক-সেদিক মোটেও হবে না। দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে নতুন দিন আসবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য গভীর নিদ্রা শেষে আমরা নতুন দিনে জেগে উঠব। সে যখনই হোক। খুব ভোরে কিংবা সকাল বারোটায়, যেকোনো এক সময় উঠতেই হয়। একেক মানুষের জেগে ওঠার রুটিন একেক রকম। আমার জেগে ওঠার রুটিন দুটো। একই প্রভাতে দু-দুবার জেগে উঠি আমি। প্রথমত ফজরের সময় হলে, দ্বিতীয়ত নামাযের পর আরও এক শান্তির ঘুম দিয়ে। কিন্তু আজ আর দ্বিতীয়বার ঘুমানোই হলো না। শরীরের অবস্থার উন্নতি নেই। জ্বর একবার কমে তো আবার বেড়ে যায়। অস্বস্তিতে বিছানায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। ধীর পায়ে একবার ড্রয়িংরুমে উঁকি মে’রে এলাম। ম’রার মতো ঘুমাচ্ছে একেকজন। আম্মি আর নাসিমা কাকিকে শুধু রুমের বাইরে দেখলাম কাজে হাত লাগাচ্ছে। নূর আঙ্কেলও মসজিদ থেকে ফেরেননি। আম্মি আমার জ্বরের অবস্থা জেনে হায়, হায় করে উঠল। তাড়া দিয়ে বলল তাদের রুমে গিয়ে শুয়ে থাকতে। সবেমাত্র চায়ের পানি চুলায় বসিয়েছে সে। আমি তার কথা শুনলাম না। গিয়ে দাঁড়ালাম ডাইনিং রুমের লাগোয়া বেলকনিতে। সকালের শিথিল কোলাহল আর লালচে আকাশে মনোযোগ দিলাম। আজ রাজ ভাইয়ের মেহেদি উৎসব। সবাই কত আনন্দ করবে, মেহেদি পরবে। আর আমি? অসুস্থ শরীরের অস্বস্তিতে হয়তো উৎসবের আনন্দ থেকেই বাদ পড়ে যাব। সন্ধ্যার আগে জ্বরটা কমে গেলে ভালো হত। মিনিট পাঁচেক পর পাশে মানব অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকের স্নিগ্ধতায় মাখামাখি মুখটা থেকে সহসা চোখ ফেরাতে পারলাম না। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে খানিক কাত হয়ে এদিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে আছে সে। আমার চোখে চোখ পড়তেই খুবই শান্ত ভঙ্গিমায় ঠোঁটের কোণ ঈষৎ প্রসারিত করে হাসল। বিনিময়ে আমিও এক মলিন হাসি ফেরত দিলাম। ওই শান্তশিষ্ট, অতিশয় ঠান্ডা, সুগভীর দৃষ্টির কাছে এবারেও হার মানতে হলো। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়ল। দৃষ্টিসহ অসুস্থতার ছোঁয়া লাগা মনটাকেও সম্পূর্ণ এলোমেলো করে সে দূরের লালচে আকাশে দৃষ্টি রেখে ঠোঁট নেড়ে আপন মনে কয়েকটা লাইন আওড়াল। নজরুলগীতি ‘তুমি আমার সকাল বেলার সুর’ এর কয়েকটা লাইন।

তুমি আমার সকাল বেলার সুর
হৃদয় অলস-উদাস-করা অশ্রু-ভারাতুর।
ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়,
রাত্রি শেষের চাঁদ তুমি গো
বিদায় বিধুর।

অতিশয় শান্ত, কোমল সে সুমিষ্ট সুর। মনে নিদারুণ অভিলাষ জাগল এই মুহূর্তটাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার। এজন্যই বলি একটা দৈব শক্তির বড্ড বেশি প্রয়োজন আমার। এই যে এক দারুণ হাসির টুকরো আমার সকালটাকে এক ঝলকে এত মিষ্টি করে দিলো, শরীরের অসুখ ভুলিয়ে দিলো, এমন সুন্দর মুহূর্ত এক অজানা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখলে মন্দ হত না। যখন ইচ্ছে, তখনই চোখে চোখ রেখে দেখতে পারতাম এই প্রাণবন্ত হাসিটা। কপালে চার আঙুলের ছোঁয়ায় খানিক চমকে উঠলাম। উনি কপালে ভাঁজ টেনে চিন্তিত কন্ঠে আওড়ালেন,
“আবার বেড়েছে।”
পাশের চেয়ারে বসার নির্দেশ দেওয়ার সাথে-সাথে আমি বসে পড়লাম। কথা বলতে গিয়েও মুখ বন্ধ রাখলাম। গতকাল রাতের কথা ভুলিনি আমি। কত রাত করে এসেছিল কে জানে? উনি আমাকে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। বেলকনি থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম রান্নাঘরে ঢুকছেন। তারপর বেরিয়ে এলেন দুই কাপ চা হাতে। দেখেই আমি সোজা হয়ে বসে পড়লাম। বাইরে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুখ বাঁকালাম। এত চিন্তা গতকাল কোথায় ছিল? একটা কাপ আমার হাতে দিয়ে অন্যটা নিয়ে উনি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে এদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। আমি চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। অথচ মহাশয় নিজের চা হাতে ধরে ঠান্ডা করার পাঁয়তারা করছেন। নিজের চা রেখে আমার চা খাওয়া দেখছে। যেন আমি চা না, চাইনিজ খাচ্ছি।
“ফোন কোথায় তোর?”
এবার আমিও মুখ খুললাম। তবে ওনার মতোই শান্ত স্বরে ছোটো জবাব দিলাম,
“ফোনের জায়গাতেই আছে।”
“রাতে কখন ঘুমিয়েছিলি?”
“এগারোটায়।”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়ে পুনরায় ছোটো করে বললেন,
“চেক করিস গিয়ে।”
আমি চোখ তুলে তাকালাম। ফোন চেক করতে বলল কেন? ঘুমিয়ে পড়ার পর ফোন করেছিল না কি? ইচ্ছে করল এক্ষুনি গিয়ে ফোন চেক করি। কিন্তু নড়লাম না। এবার নিজেও প্রশ্ন করলাম,
“কখন ফিরেছিলেন?”
“সাড়ে বারোটায়।”
“ওহ্।”
মিনিট খানেক পরেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখনও চা শেষ হয়নি। উনি চটজলদি প্রশ্ন করলেন,
“উঠছিস কেন?”
“শরীর ভালো লাগছে না,” ধীর স্বরে বললাম আমি।
উনি দ্রুত আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিলেন। দুজনের কাপ চেয়ারে রেখে আমার হাত মুঠোয় পুরলেন। আমি বললাম,
“ধরতে হবে না, যেতে পারব।”
উনি যেন শুনলেনই না কথাটা। একহাত মুঠোয় নিয়ে, অপর হাতের বাহু আগলে নিয়ে চললেন। ওনার রুমের দিকে এগোনো ধরতেই আমি থেমে গেলাম। মিনমিনে গলায় বললাম,
“আমার রুমে যাব।”
ওনার রাশভারী উত্তর,
“অসুস্থ শরীরে দুজনের সাথে ঠেলাঠেলি করে শুয়ে এমনিতেও স্বস্তি পাওয়া যায় না। আমার রুমে দুই-তিনজন নেই ঠেলাঠেলি করার জন্য।”
“যাব না আমি।”
আফরা আপুর বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়ায় গোঁ ধরলাম আমি। উনি টু শব্দটি করলেন না। হাতের বাঁধন শক্ত করে একপ্রকার টেনে নিয়ে চললেন। কোনো বাঁধা শোনা তো দূর, একটা কথাও বললেন না। রুমে ঢুকে দেখলাম অলি বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে হিমেল কাকার ফোনে গেমসে মগ্ন। আমাদের দেখে উৎসুক দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বলল,
“ইলুপিকে এভাবে ধরে এনেছ কেন? পানিশমেন্ট দিবে? কী ভুল করেছে?”
তাজ ভাই আমাকে বিছানায় বসাতে-বসাতে অলির প্রশ্নের উত্তর দিলেন,
“তোমার ইলুপি আবার কোনো ভুল করতে জানে না কি? সে তো মহীয়সী নারী। সে শুধু জানে জগত উদ্ধার করতে। তাই তার সেবাযত্ন করে নিজেকে ধন্য করতে নিয়ে এলাম।”
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। ছোটো বাচ্চাটার সামনেও পচালো! অলি তাজ ভাইয়ের কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে গোল-গোল চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দারুণ ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
“ইলুপি, বুঝিনি।”
আমি ঠোঁট এলিয়ে মেকি হেসে বললাম,
“আমিও না।”
তাজ ভাই অলিকে বললেন,
“অলি, যাও তো, তোমার ইলুপির রুম থেকে তার ফোনটা নিয়ে এসো।”
অলি সঙ্গে-সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে ছুট লাগাল। আমি আলগোছে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। উনিও চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অলি এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে গেল। ফোনটা অন করতেই আমার দুই ভ্রু কুঞ্চিত হলো। দ্রুত ফোন আনলক করে নোটিফিকেশন চেক করলাম। পরপর দশটা মিসড কল আর পাঁচটা আনরিড ম্যাসেজ। ম্যাসেজ অন করে চোখ বুলাতে লাগলাম। প্রথম ম্যাসেজ রাত এগারোটা ষোলোতে।
‘শরীর কেমন আছে? জ্বর কমছে, না বাড়ছে? বেশি ঠান্ডা পানি গিলো না, ঠান্ডা লেগে যাবে।’
দ্বিতীয় ম্যাসেজ রাত এগারোটা বাইশে।
‘কী করছিস তুই? রিপ্লাই দিচ্ছিস না কেন? আপুকে পেয়ে দুনিয়া ভুলে বসে আছিস? এরপরও রিপ্লাই না পেলে আজ সারারাত বেলকনিতে দাঁড় করিয়ে রাখব।’
তৃতীয় ম্যাসেজ রাত এগারোটা ছত্রিশে।
‘কী আনব? চাইনিজ আইটেম, না বিরিয়ানি? না কি অন্য কিছু? তাড়াতাড়ি বলো।’
চতুর্থ ম্যাসেজ রাত এগারোটা উনত্রিশে।
“কী হচ্ছে এটা? এখনও রিপ্লাই নেই! আমি ফেরার আগে রিপ্লাই না পেলে কিন্তু তোর ফোনের মেয়াদ আজই শেষ।’
পঞ্চম এবং শেষ ম্যাসেজ বারোটা দুইয়ে।
‘ঘুমিয়ে পড়েছ? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’
মাথায় হাত দিয়ে আমি থম মে’রে শুয়ে ম্যাসেজগুলোর দিকেই তাকিয়ে রইলাম। এর একটা ম্যাসেজ যদি ঘুমানোর আগে করত, তাহলে তো এমনটা হত না। ইশ্! আম্মিকেও তো একবার ফোন করতে পারত। রেগে গিয়েছিল নিশ্চয়ই? কতক্ষণ রেগে ছিল? বাসায় ফিরেও কি রেগে ছিল? খোঁজ করেনি? হঠাৎ করেই মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। শরীর খারাপ ভাবটা আরও একটু পরে হলে কী হত? অন্তত একটা কল তো রিসিভ করতে পারতাম। তীব্র মন খারাপ নিয়েই দ্বিতীয় দফা ঘুমটা দিলাম। ঘুম থেকে উঠে রুমে কাউকে দেখলাম না। বেড সাইড টেবিলের ওপর ছোট্ট ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সকাল নয়টা। কিন্তু বিছানা ছাড়তে মোটেও ইচ্ছে করছে না। জ্বরে পড়ে এত মানুষের ক্যাঁচ-ক্যাঁচ একদমই ভালো লাগছে না। তার ওপর আবার আফরা আপু। আজও ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে আফরা আপু এসে উপস্থিত হলো। সাথে আনহা আপু। আফরা আপুর কালো মুখ আর কুঁচকানো কপাল দেখেই বুঝা হয়ে গেল এখনই আরেক দফা ঝড় উঠবে। আমি শোয়া থেকে আর উঠলাম না। মনে হচ্ছে উঠলেই মাথাটা চক্কর দিবে। এমনিতেই তাপমাত্রার আধিক্যে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। আফরা আপু দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“উঠেছিস তাহলে? কেমন হলো ঘুম?”
আমি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম,
“ভালো।”
“ভালো না হয়ে উপায় আছে? দ্য গ্রেট তাজ ভাইয়ের বিছানায় ঘুমিয়েছিস যে। তারপর? ভালোই তো ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছিস। ফিলিংস কেমন?”
আমি কপালে মৃদু ভাঁজ ফেলে বললাম,
“মানে?”
“ওহ্! বুঝতে পারছিস না? আহারে, বাচ্চা মেয়েটা! আমি তো ভেবেছিলাম শুধু বিছানা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিস। অথচ কাল যা দেখলাম, তাতে তো মনে হচ্ছে রীতিমতো পটানোর কাজও শেষ। তা কীভাবে পটালি, শুনি একটু? বিছানা দখল করতে এসে নিজেই দখলে চলে গিয়েছিলি না কি?”
শেষের কথাটার সুর এতটা বিশ্রী ছিল যে আমি তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। একহাতে কপাল চেপে ধরে মাথা ঝাঁকুনি দিলাম। নিচু স্বরে শক্ত গলায় বললাম,
“আপু, তুমি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছ। কাল পর্যন্ত যা বলেছ, চুপচাপ শুনে গেছি। ভেবেছিলাম তুমি কটা দিনের জন্য এসেছ, ঝামেলা পাকাব না। কিন্তু এত খারাপ মনোভাব কীভাবে পোষণ করলে তুমি? তুমি কি আমাকে চেনো না, না কি তাজ ভাইকে চেনো না? এমন একটা কথা কীভাবে বললে তুমি?”
আফরা আপু তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“চিনি বলেই বলতে পেরেছি। এসে হতে কীর্তিকলাপ দেখছি তো। প্রথমে তোর কাহিনি দেখলাম, আর গতকাল তাজ ভাইয়ের। বাপরে, শপিং থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে তোর রুমে দৌড়। আবার জ্বর বেড়েছে দেখে সেকি চিন্তা! চিন্তার ঠেলায় একেবারে নিজেই জলপট্টি দিতে লেগে পড়ল। যেন বাসায় আর কেউ ছিল না তোর চিন্তা করার জন্য। তাজ ভাই এমনি-এমনি পটে গেছে, এটা তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব ভেবেছিস? কোন রঙ্গ দেখিয়ে বশ করেছিস তুই-ই জানিস।”
গতকাল রাতে তাজ ভাই এসব কাণ্ড করেছে, সে সম্পর্কে মোটেও অবগত ছিলাম না আমি। তবে এই মুহূর্তে খবরটা জেনেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া এল না। কারণ আফরা আপুর বিশ্রী ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ভেতরটা রাগে-দুঃখে ফেটে যাচ্ছে। চোখ দুটোও ছলছল করে উঠল। রাগ ঝাড়ব ভেবেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। কারো কানে এই কথোপকথনের একটা শব্দ গেলে ব্যাপারটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যাবে। চোয়াল শক্ত করেই অনুরোধ করে বললাম,
“আফরা আপু প্লিজ। দয়া করে চুপ করো। এত খারাপ ইঙ্গিত কোরো না। তুমি যেসব ভাবছ, এসব কিছুই সত্য না। বিবেকে বাঁধছে এসব শুনতে।”
আফরা আপু থামল না। নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করল,
“খারাপ তো লাগবেই। খারাপ লাগার জন্যই তো বলছি। গোপনে খারাপ কাজ করে বেড়াবি, আর খারাপ কথা শুনবি না? ভাই তোর কি এই ঢাকা শহরে একজন আত্মীয়ও ছিল না যে, এই বাসাতেই এসে গেড়ে বসলি? না কি হল ছিল না? বাপের বন্ধুর বাসায় এসে দিনের পর দিন থাকছিস কীভাবে রে? লজ্জা করে না। ওপস্! লজ্জা থাকলে তো লজ্জা করবে। এখানে এসেছিলিই তো এই পরিবারে নিজের জায়গাটা পার্মানেন্ট করতে। ঠিক না? মামার টাকা দেখেছিস, তাজ ভাইয়ের বড়ো পদ দেখেছিস। তীরটা একদম সঠিক দিকেই তাক করেছিস। বাহবা তোকে।”
আমার আগে আনহা আপু রাগত স্বরে বলে উঠল,
“আপু, কী সব বলা শুরু করলে তুমি? ইলোর আব্বুর সাথে আঙ্কেলের কেমন সম্পর্ক, তা কি তুমি জানো না? না কি ওর প্রতি ফুপা-ফুপির টান সম্পর্কে জানো না? সবই তো জানো। শুধু-শুধু এই বাজে কথাগুলো কেন বলছো? ও কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছিল? ফুপা-ফুপির কথাতেই তো এসেছিল। তা-ও তো তুমি জানো। আর তাজ ভাই আর ওর সম্পর্কে এত খারাপ মনোভাব এল কীভাবে তোমার? চিন্তা-ভাবনা পজিটিভ করো, প্লিজ।”
আমি ধরা গলায় বললাম,
“দেখো আপু, এই খারাপ কথাগুলো তুমি না থামালে আমি সত্যিই ভুলে যাব তুমি আমার বড়ো, বা এই বাসা ভর্তি লোকজন আছে। মিথ্যে দিয়ে আমাকে বোকা বানানোর আর কথা শোনানোর বয়সটা কিন্তু এখন আর নেই। বিবেকটাকে একটু কাজে লাগাও। ঝামেলা বাঁধলে তোমারও কিন্তু খুব একটা ভালো হবে না।”
আজ আর আফরা আপুর মুখে লাগাম টানা গেল না। একের পর এক তীর ছুঁড়েই চলল। আমি আর আনহা আপু বহু চেষ্টা করলাম তাকে থামানোর। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কষ্টে চোখের পানি বাঁধ ভাঙলেও, ভেতরটা রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছে। কতটা খারাপ মানসিকতা হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে! ঝড়ের মাঝেই হঠাৎ পরিবেশ গুমোট ভাব টেনে উপস্থিত হলেন তাজ ভাই। সঙ্গে-সঙ্গে আফরা আপু ঝুপ করে থেমে গেলো। একপ্রকার পালিয়ে গেল রুম থেকে। তাজ ভাই প্রশ্নভরা অবাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুহাতে ধরা ট্রেটা বিছানার একপাশে রেখে প্রশ্ন করলেন,
“কী হচ্ছিল এখানে?”
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নীরবে চোখের পানি মুছলাম। আনহা আপু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“কাঁদিস না, ইলো। মাথাব্যথা আরও বাড়বে। ভুলে যা।”
তাজ ভাই এবার আনহা আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে রে আনহা?”
আনহা আপু বলতে চাইল না। কিন্তু তাজ ভাই রেগে যাওয়াতে চুপসে গেল। বাধ্য হয়ে আফরা আপুর বলা কথাগুলো সব গড়গড় করে বলে দিলো। তাজ ভাই সব শুনে আনহা আপুকে শুধু বললেন,
“গিয়ে আম্মিকে বল গতকাল ফ্রিজে রাখা খাবারগুলো গরম করতে।”
আনহা আপু চলে গেল। তাজ ভাই একই জায়গায় চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইলেন টানা দুই মিনিট। ওনার স্থির দৃষ্টি আমার মুখে। এরপর ধ্যান ভেঙে এগিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিলেন। মুখের রাগত, শক্ত ভাবটা বজায় রেগেই কন্ঠ যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন,
“চুপ, আর এক ফোঁটা পানিও যেন না গড়ায়। মুখের ওপর জবাব দিতে যখন পেরেছ, তখন শক্তও থাকতে শেখো। কান্না থামাও বলছি।”
আমি অধর কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। গাল থেকে ওনার হাত দুটো আলগোছে সরিয়ে দিলাম। সিক্ত গলায় নিম্ন স্বরে বললাম,
“একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা তার জন্য কতটা অপমানের, লজ্জার আর কষ্টের, তা শুধু ওই মেয়েটাই বোঝে। আপনার কাছে একটা অনুরোধ করি? রাখবেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। দৃষ্টি যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আমার চোখে। আমি বিরক্তির সহিত বললাম,
“মাইন্ড রিডিংয়ের চেষ্টা চালাবেন না, তাজ ভাই। আপনি আমার থেকে দূরে থাকবেন। আজ আমাকে এই বাজে অপবাদগুলো পেতে হত না, যদি না আপনার দৃষ্টিটা সবসময় আমার ওপর থাকত। সবসময় জেদ কেন দেখান, বলুন তো? টানা পাঁচ বছর আমি ছিলাম আপনার সবচেয়ে অসহ্যকর, অপ্রিয় মুখ। এখনও না হয় তা-ই ভাববেন। আপনার এই হঠাৎ পরিবর্তনগুলোর কারণেই আমি রোজ অন্যের মুখের বাজে কথা শুনছি।”
ওনার চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। রাগ দমাতেই হয়তো জোরে দম নিচ্ছে। কপালের শিরা ফুলে ঝড়ের পূর্বাভাস জানান দিচ্ছে। তবু উনি দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললেন,
“রাগ ঝাড়া শেষ হলে নিজের রুমে যাও।”
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম আমি। চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো বললাম,
“মিথ্যে অপবাদ আমার সহ্য হয় না। সব বোঝেন, এটা বোঝেন না? আবার অনুরোধ করছি, দূরে থাকবেন আমার থেকে। তা না হলে আপনার সব ধোঁয়াশা কা’টিয়ে আমার নাম নিবেন।”
গতকাল রাতে শপিং শেষে সবাই রেস্ট্রন্টে খাওয়া-দাওয়া করে বাসায় ফিরেছিল। বাসায় যারা ছিল তাদের জন্যও নিয়ে এসেছিল। আমার খাবারটা আম্মি ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। সেই খাবার গরম করে দেওয়া হলো ঠিকই, কিন্তু তা আর আমার গলধঃকরন করা হলো না। ইচ্ছেটাই ম’রে গেল। অজুহাত দিলাম তেতো মুখের বিস্বাদের। সারা দিনটা আমি ঠিক কিসের ওপর কা’টালাম, ভাবতেও ইচ্ছে করে না।‌ একদিকে মাথাব্যথার সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বর বাড়ল, অন্যদিকে মানসিক দুরবস্থা। না চাইতেও কান্নারা গলায় দলা পাকাল একটা অবাধ্য অনুভূতির কারণে। এক বেলার খাবারও ঠিকমতো খেতে পারলাম না। ওদিকে অ্যাপার্টমেন্টের মালিকপক্ষের সাথে আগে থেকেই সব কথাবার্তা ঠিক ছিল যে, রাজ ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে গ্রাউন্ড ফ্লোর আর ছাদ ডেকোরেশন করা হবে। বিশাল জায়গা জুড়ে অ্যাপার্টমেন্টটা তৈরি, বিধায় এই দুটো জায়গাই মানানসই। আজ সারাদিন সবাই ওদিকেই ব্যস্ত ছিল। সাথে চলল সন্ধ্যার মেহেদি উৎসবের জমজমাট প্রস্তুতি। কেবলমাত্র আমিই বদ্ধ ঘরের বিছানায় বেহুঁশের মতো পড়ে রইলাম। সময়ে-সময়ে সবাই এসে আমার খোঁজ নিল, শুধু দুজন মানুষ ছাড়া। অথচ শ্রেয়ান ভাইয়া পর্যন্ত এসে সবার আগে আমার অসুস্থতার খোঁজ নিয়েছে। আফরা আপু আর তাজ ভাই। আম্মি নিজের ব্যস্ততার মাঝেও আমার জ্বর কমানোর নানারকম চেষ্টা চালাল। আমিরা আপুরা বারবার এসে কাঁদো-কাঁদো মুখে আফসোস করল। সবার একটাই চাওয়া, সন্ধ্যায় যেন আমি তাদের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। রাজ ভাইয়ের বিয়েতে নিজের আনন্দ বিসর্জনের জন্য আমার যতটা না খারাপ লাগল, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগল এই মানুষগুলোর জন্য। শুধুমাত্র তাদের জন্য আমি নিজের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করলাম। কিন্তু হায়! কপালের লিখন কি আর পালটানো যায়? বিন্দুমাত্র উন্নতি আমার হলো না। সন্ধ্যায় সবাই শাড়ি, মেকআপ নিয়ে ব্যস্ত হলো, আর আমি নীরব চোখে দেখলাম। তাজ ভাইয়ের শর্ত ত্যাগ করে আফরা আপুকে ভারী মেকআপ করতে দেখলাম। মিনহা আপুরা আমাকে শাড়ি পরানোর জন্য অনেক জোরাজুরি করেছে, কিন্তু শরীর-মন অসুস্থ থাকলে কি আর আনন্দ উৎসবে মন বসে? আমি নাকচ করে দিলাম। তাদের বিষণ্ণ মুখ দেখে এটুকু আশ্বাস দিলাম যে, উৎসব শুরু হলে আমি তাদের সাথে ছাদে যাব। ব্যস, এতেই তাদের মন খারাপ উবে গেল। সন্ধ্যায় আমি সত্যিই তাদের সাথে ছাদে গেলাম। অনেকটা সময় নিয়ে মুগ্ধ হয়ে চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন দেখলাম। অবশ্য এটা আগে থেকেই জানতাম যে, ডেকোরেশন সবটাই তাজ ভাইয়ের পছন্দমতো হয়েছে। উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা করিয়েছেন। স্টেজে রাজ ভাইকে মেহেদি পরানো হচ্ছে। আফরা আপুরাও ইতোমধ্যে মেহেদি পরতে শুরু করেছে। সবার মুখে আনন্দের হাসি। মেহেদি পরার বেলাতেও আমার অনীহা চলে এল। মনে হলো এতটা সময় এক জায়গায় বসে মেহেদি পরা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। কখন আবার শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। জুম্মান ভাইয়ারা একেকজন রীতিমতো জোরাজুরি করল। শেষে আমি বললাম। আমার ভালো লাগলে পরে দেবো। কিন্তু তা হবে কীভাবে? ভাগ্য যে আমার প্রতিকূলে। এক ঘন্টাও বসে থাকতে পারলাম না। কারণ সাউন্ড বক্সটা রীতিমতো মাথায় হাতুড়ি পে’টাচ্ছে। আমার উস-খুস দেখে সায়মা আপু আম্মিকে বলে আমায় বাসায় নিয়ে এল। ছাদ থেকে আসার আগেও আমি চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়েছি। কিন্তু ওই মুখটার দেখা পাইনি। এমনকি আজ সকালের পর সারাটা দিনে একবারের জন্যও মুখ দর্শন হয়নি। দিনের বেলায় না হয় আমি রুমেই পড়ে ছিলাম, কিন্তু এখন? এই সময় তো এখানেই থাকার কথা। নেই কেন? প্রশ্নভরা মন নিয়েই বাসায় ফিরলাম। সায়মা আপু আমায় নিজের হাতে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। সে আর আমাকে একা রেখে ছাদে যেতে চাইছিল না, কিন্তু আমিই তাকে জোর করলাম। শুধু-শুধু আমার কারণে কেন তার আনন্দটা মাটি হবে। তাছাড়া এখন এমনিতেও আমার ঘুম পাচ্ছে। সায়মা আপুকে ঘুমের কথা বলে পাঠিয়ে দিলাম। ক্লান্ত চোখ জোড়াও অবাধ্যের মতো গটগট করে গভীর নিদ্রায় ঝাঁপ দিলো।
পরবর্তী সকালটা হলো আমার জন্য আস্ত এক চমকপ্রদ সকাল। বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো, যা আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথম চমকটা ছিল একান্তই আমার জন্য। তা হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই দুহাত রাঙানো মেহেদি দেখা। ডিজাইনই বলে দিলো কাঁচা হাতের পরিচয়। খুব বেশি ভালো না, আবার খুব খারাপও না। মেহেদি শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে ছিল। হতবুদ্ধি হয়ে আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আকাশ-কুসুম ভাবলাম। বহু ভাবনার পর অদ্ভুত এক জিনিস দৃষ্টিগোচর হলো। ঘন নকশার মাঝেই বেশ কায়দা করে ইংরেজি অক্ষরে ‘ই’ লেখা। আসল চমকটা হলো এই ই-এর মাথাটায় শুধু ডানদিকে নয়, বাঁ দিকেও দাগ কা’টা। অর্থাৎ বিচক্ষণতার প্রমাণ স্বরূপ ‘ই’ এর সাথে কায়দা করে ‘টি’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাহ্! বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এটুকু প্রমাণই যথেষ্ট ছিল মেহেদী পরানো ব্যক্তিটিকে চেনার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কখন আর কীভাবে সম্ভব হলো? এতটা সময় কীভাবে পেল? কী ভেবেই বা কাণ্ডটা ঘটাল।‌ পরবর্তী চমকটাই ছিল আমাকে মূর্তি বানানোর আসল রহস্য। বিরাট বিস্ময়কর এক সংবাদ, যা শুধু আমাকে নয় বাসা ভর্তি সবাইকেই আহাম্মক বনে পাঠিয়ে বসে আছে। সবার মুখে-মুখে না কি গতকাল রাত থেকে এখনও পর্যন্ত ওই এক বিস্ময় খেলছে। সঙ্গে সকলের মুখে শুধু একটাই বুলি, আফরার বিয়ে ফিক্সড। আর তা না কি আফরা আপুর সম্মতিতে। সংবাদটা শুনে আমি মিনিট খানেক হা হয়ে বসে রইলাম। আমার জানামতে আফরা আপুকে আজ পর্যন্ত তার বাবা-মা বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি। গত কয়েক দিন ধরে একটা পাত্রপক্ষ তাকে বউ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। অথচ সেই আফরা আপু কি না এক সন্ধ্যায় নিজের মত পালটে ফেলল? কীভাবে সম্ভব? তাজ ভাইয়ের আশা এত সহজেই ছেড়ে দিবে সে? এ-ও কি বিশ্বাস করা যায়? গতকাল পর্যন্তও তো তাজ ভাইয়ের জন্য আমাকে যত বাজে কথা শোনাল। শেষে আমদের গ্যাং এসে ফিসফিস করে আরও এক ভয়ানক সংবাদ দিলো। আর তা হচ্ছে, আফরা আপুর বিয়ে ফিক্সড হওয়ার আসল মাথা আমাদের মহামান্য ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
মিনহা আপুর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ শুনে আমি পাথুরে মূর্তি বনে গেলাম। তার ভাষ্যমতে গতকাল রাতে আমি ছাদ থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে এসেছিলেন। তারা বাজারে গিয়েছিলেন কী সব কেনাকাটা করতে। এসেই না কি তাজ ভাই মেহেদি উৎসব বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন নাচ-গানের আসর বসিয়ে। অথচ সে নিজেই সেই আসরে ছিলেন না। কী এক কাজের কথা বলে আসর বসিয়ে কিছু সময়ের জন্য কে’টে পড়েছিলেন। ফিরেছিলেন মেহেদি উৎসব শেষ হওয়ার কিছু আগে। সবার মেহেদি দেওয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তাজ ভাই সবাইকে একসাথে ডেকে আড্ডা বসিয়েছিলেন। আড্ডার বিষয় ছিল শুধুমাত্র ডেয়ার খেলা। ট্রুথ সম্পূর্ণ বাতিল। সবাইকে বাধ্য করেছিল খেলায় অংশগ্রহণ করতে। উলটা-পালটা ডেয়ারে আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। যখন আফরা আপুর পালা এসেছিল, তখন তাজ ভাই না কি তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ওটা নিয়ে আফরা আপুর বাবার হাতে দিতে। এরূপ ডেয়ারে সবাই অবাক হয়েছিল। আফরা আপু কিছুতেই রাজি ছিল না। খেলা রেখে উঠে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করা চলবে না বলে সবাই মিলে তাকে বাধ্য করেছিল ডেয়ার পূর্ণ করতে। শেষমেষ আফরা আপু মানতে বাধ্য হয়েছিল। তাজ ভাইয়ের দেওয়া কাগজটাই নিয়ে দিয়েছিল তার বাবার হাতে। ওই কাগজটাই হলো সব ভেজালের মূল। যাতে লেখা ছিল,

বাবা,
তোমাকে একটা কথা বলব-বলব করেও কিছুতেই বলতে পারছি না। কীভাবে বলব তা-ই মাথায় আসে না। লজ্জা লাগে; তবু আজ লিখে দিলাম। প্লিজ তুমি কিছু মনে কোরো না। আসলে আমি তোমাদের মিথ্যে বলেছিলাম। তোমার পছন্দ করা ছেলেকে আমার পছন্দ হয়নি, এ কথা বলেছিলাম মনের আশঙ্কা থেকে। সত্যি বলতে, বিয়ে, সংসার নিয়ে সবসময় আমার মনে একটা আশঙ্কা চলে। সেই কারণেই বিয়েতে রাজি হওয়া নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এবার আমি অনেক ভেবেছি। তারপর ঠিক করেছি সাহস জুগিয়ে আশঙ্কা কা’টিয়ে আমি তোমাদের কথার মান রাখব। তোমার পছন্দের ছেলেকেই আমি বিয়ে করব। আমার আর কোনো আপত্তি নেই। আরেকটা কথা, দয়া করে তুমি এসব নিয়ে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না। তাতে কিন্তু আমি লজ্জায় ম’রে যাব। তুমি বরং আজই ওনাদের জানিয়ে দাও যে, বিয়েটা হবে। আর রাজ ভাইয়ের বিয়ের পরপরই বিয়ের তারিখ ঠিক করো। আবার বলছি, আমায় একদম লজ্জায় ফেলবে না।
ইতি
তোমার আদুরে কন্যা
আফরা

চিঠিটা পাওয়ার সাথে-সাথেই ফুপা পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে কনফার্ম করে ফেলেছিলেন। তারপর সবাইকে জানিয়েছিলেন। খবর শুনে সবাই বিস্মিত হলেও, আফরা আপুর অবস্থা ছিল ম’রি-ম’রি। চিঠির ভেতরের খবর জেনে সে ম’রা কান্না জুড়ে বসেছিল। অথচ ততক্ষণে তার বাবা কয়েক কেজি মিষ্টি এনে বাসাসুদ্ধ সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ফেলেছিলেন। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, আফরা আপু ডেয়ারের কথাটাও মুখে আনতে পারেনি। কারণ পাত্র বাতিল করতে-করতে সে ফুপাকে রীতিমতো ঘোলাপানি খাইয়ে ছেড়েছে। এই পাত্রপক্ষ আজকাল থেকে ঘুরছে না, বহুদিন হলো। তাই তো তার বাবা-মা বিয়ে কনফার্ম করে এত বেশি খুশি হয়েছিল। এরপরও যদি সে একবার মুখ খুলে বলত সে আসলে বিয়ে করতে চায় না, তাহলে নিশ্চিত তাকে ঘরছাড়া করত। বিয়ে নিয়ে কম জ্বালায়নি সে। আর এবার তো বিয়ে কনফার্ম হওয়ার পরও ভেঙে ফেলা মানেই ফুপার সম্মান নষ্ট। সবদিক ভেবে আফরা আপু কেবল যন্ত্রণা চেপে কাঁদা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি।‌ অথচ খেলায় অংশগ্রহণ করা জনগণ ছাড়া বাসার ছোটো থেকে বড়ো সবাই এক কথায় ভেবে নিয়েছিল বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে দুঃখ-কষ্টে আফরা আপু ওভাবে কাঁদছিল। কাগজটা আফরা আপু তার বাবার থেকে নিয়ে পড়েছিল। তারপর বড়োদের চোখের আড়ালে তাজ ভাইয়ের সাথেও ঝামেলা করেছিল। তার থেকে আবার কাগজটা জুম্মান ভাইয়া নিয়ে পুরো গ্যাংকে শুনিয়েছিল। তারপর আর ফেরত দেয়নি। তার বদৌলতে আমিও পড়তে পারলাম। তার পর থেকেই মাথার ভেতর হাজার-হাজার প্রশ্ন মাথার ভেতর গুবরে
পোকার মতো কামড়ে চলেছে। তার ওপর আবার জুম্মান ভাইয়া বলে বসলেন,
“কেন জানি মনে হচ্ছে ছয় বছর আগের চির স্মরণীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ইন্টারেস্টিং রিভেঞ্জ!”
রিভেঞ্জ, হ্যাঁ। এ ছাড়া এই অদ্ভুত কাণ্ডের অন্য কোনো অর্থ তো দাঁড়ায় না। যেদিক থেকেই ভাবনা শুরু হোক, শেষ প্রান্তে গিয়ে সেই রিভেঞ্জেই ঠেকে যায়। সকালে যখন থেকে আফরা আপুর বিয়ে ফিক্সড হওয়ার কাহিনি জানলাম, তখন থেকেই মাথা হ্যাং হয়ে বসে আছে। কেবলমাত্র রিভেঞ্জ শব্দটা ছাড়া কিছুই মাথায় আসছে না। মস্তিষ্কটা চক্রাকারে ঘুরতে-ঘুরতে আবার ঠিক কোন দিকে গিয়ে থামে, ধারণা একদমই নেই। আজ রাজ ভাইয়ের গায়ে হলুদ। বাসায় আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে আমার শরীরের তাপমাত্রা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাড়ছে, তো এই কমছে। সকালে নাস্তার টেবিলে তাজ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। চোখাচোখি হওয়া তো দূর, আমার অস্তিত্ব নাই করে একবার চোখ তুলেও তাকায়নি।‌ এমনকি সারাদিনে যতবারই আমার সামনে পড়েছে, রীতিমতো এড়িয়ে গেছে। তা-ও আবার ইচ্ছে করেই। আমিও বিশেষ তোয়াক্কা করিনি। থাকুক যে যার মতো করে। কারো কোনো বাজে কথা শোনার ইচ্ছে আর আমার নেই। সন্ধ্যায় আব্বু এল। তাকে পেয়ে যেন আমি অসুখ ভুলে গেলাম। আমার জ্বরের অবস্থা দেখে আব্বুর মন খারাপ হলো। বুকে জড়িয়ে বসে রইল। এতেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আজ আমিরা আপুদের সাথে শাড়ি পরতেও রাজি হলাম। শরীর কিছুটা ভালো লাগছে। আম্মি আমায় একটা হলুদ শাড়ি দিয়েছে অনুষ্ঠানে পরার জন্য। দেখে মনে হলো নতুন শাড়ি, এখনও ভাঁজ খোলো হয়নি। সেটা পরার পর আমিরা আপু আর মিনহা আপু আমাকে ধরে-বেঁধে হালকা মেকআপ করে দিলো। কোনো বাঁধাই তারা শুনতে রাজি নয়। অথচ তাদের মেকআপ করা আর শেষ হচ্ছে না। চুলগুলো আঁচড়ে আমি আমিরা আপুদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। করিডোরেই তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া আর আদনান ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিল। না চাইতেও দৃষ্টিটা প্রথমে ওনার ওপরেই পড়ল। উনিও হয়তো বেখেয়ালে তাকালেন। চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ইলোমিলো। শাড়িটায় দারুণ মানিয়েছে। কার পছন্দ?”
আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম,
“আম্মির।”
“ওহ্। আচ্ছা যাও।”
আমি ধীর পায়ে বাসায় ঢোকার সময় দরজায় পা রেখেই আদনান ভাইয়ার বিস্মিত কন্ঠস্বর শুনলাম।
“এই তাজ, এই শাড়িটা না তুই ফুপির জন্য কিনেছিলি? ফুপি তো নিজে না পরে ওকে পরতে দিয়ে দিলো।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার পা থেমে গেলেও, ফিরে তাকালাম না। কথাটার প্রত্যুত্তর না শুনেই দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সায়মা আপু আমাকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“কী সুন্দর লাগছে রে তোকে! কারো নজর না লেগে যায় আজ।”
আমি হেসে বললাম,
“তোমার জামাই বাবুর নজর না পড়লেই হলো।”
“আমার সতীন হওয়ার শখ জেগেছে?”
“হলে মন্দ হয় না। এই অছিলায় তোমার সাথে চুলাচুলি করব।”
সায়মা আপু হুঁ-হা করে হেসে বলল,
“পেটে-পেটে এসব বুদ্ধি নিয়ে ঘোরো?”
পাশ দিয়ে সৌরভ ভাইয়া যাওয়ার সময় পা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আপু, ওই আমিরা আর মিনহা মহিলা দুটো আপনাকে মেকআপ করিয়েছে, না?”
আমি হতাশ ভঙ্গিতে বললাম,
“হ্যাঁ।”
“জানতাম, কারো ন্যচারাল লুক ওই আটা-ময়দাদের সহ্য হয় না।”
সায়মা আপু সৌরভ ভাইয়াকে বলল,
“কেন? ওকে তো ভালো লাগছে। তুই সর এখান থেকে। মেয়েদের মেকআপ নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে।”
“তুমি তো সমর্থন করবাই। বিয়ের আগে আব্বুর টাকায় ময়দা ঘঁষেছ, বিয়ের পর এখন ভাইয়ার টাকায় ঘঁষ। তার চেয়ে বরং ভাইয়াকে বলো বাসার সামনে একটা ময়দার দোকান খুলে বসতে।”
সায়মা আপু ধমকে উঠল,
“সৌরভ, যেতে বলেছি। কানের নিচে একটা মা’রব কিন্তু। পাকামি করতে ডেকেছি তোকে?”
আমাদের কথার মাঝে আমিরা আপুকে দেখা গেল। যেখানে তাকে আজ সবচেয়ে গর্জিয়াস লুকে আশা করেছিলাম, সেখানে সে সাজ তো দূর, শাড়িও পরেনি। দিনের বেলা যেমন দেখেছিলাম, তেমনই আছে। এসেই সরাসরি আমাকে বলল,
“তোর সাথে একটু কথা আছে। আয় তো।”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে একপ্রকার টেনেটুনে আমাকে বেলকনিতে নিয়ে গেল। সে মুখ খোলার আগেই আমি আন্দাজ করে ফেললাম ঠিক কোন ধরণের কথা বলতে চলেছে সে। অতঃপর আমার ধারণার ষোলো কলা পূর্ণ করে সে চাপা স্বরে বক্তব্য শুরু করল,
“খুব খুশি হয়েছিস, না? আমাকে সরাতে পেরে একেবারে জ্বরটর ভুলে শাড়ি-মেকআপ দিয়ে সেলিব্রেট করছিস? আমি কিছু বুঝিনি ভেবেছিস? সব বুঝতে পেরেছি। তাজ ভাইকে দিয়ে পুরোনো প্রতিশোধ নিয়েছিস তুই?”
আমি বিরক্তিতে ঠোঁট ফাঁক করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
বললাম,
“তুমি ওসব নিয়ে পড়ে থাকলেও, আমার এসব নিয়ে পড়ে থাকার অভ্যাস নেই। আজকের দিনেও ঝগড়া কোরো না প্লিজ।”
আফরা আপু তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠল,
“তুই মিথ্যে বললেই আমি বিশ্বাস করব? মিথ্যুক। এত বছর ধরে তাজ ভাই তোকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনি। এখন তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেই পুরোনো কথা বিশ্বাস করিয়ে আমাকে তার চোখে খারাপ বানিয়েছিস। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে দিয়ে আমার বিয়ের ব্যবস্থাও করে ফেলেছিস। ভেবেছিস একদিকে তোর বাঁধাও থাকবে না, আরেকদিকে প্রতিশোধও নেওয়া হলো। ওপরে বোকা-সোকা সেজে পেটে ভালোই কুবুদ্ধি রাখিস। তোকে চেনা হয়ে গেছে আমার।”
“তুমি তা ভাবার ভাবতে পারো আপু। কিন্তু আমি এসব কিছুই করিনি। এমনকি আমি এসব জানতামও না। সকালে ঘুম থেকে উঠে জুম্মান ভাইয়ার থেকে জেনেছি। আর সবার মতো আমি নিজেও অবাক হয়েছি। কারণ তাজ ভাই এমন কিছু করবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।”
“সাধু সাজছিস? সাধু সেজেই তো পটিয়েছিস তাজ ভাইকে। নইলে যে তাজ ভাই সুইডেন চষে বেড়িয়েও একটা প্রেম অবধি করল না, সে কি না তোর কথায় পটে যায়! তোর মতো মেয়েরা থাকেই এসব ধান্দায়। কীভাবে টাকা-পয়সা ওয়ালা ছেলে হাত করবে, আর আজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে আরামসে জীবন-যাপন করবে। এত লোভী কীভাবে হলি রে তুই?”
আফরা আপু ভয়ঙ্কর রেগে গেছে। তার তীরের মতো বাক্য শুনে আমার মাথায়ও রাগ চড়ে বসেছে। আমি চাপা স্বরে শক্ত গলায় বললাম,
“চিৎকার করবে না আপু। তাজ ভাইয়ের পেছনে আমি ঘুরিনি, ঘুরেছ তুমি। ভুলে গেছ?”
“সেটাই তো তোর সহ্য হয়নি। আমি তাজ ভাইয়ের মতো ওমন একজন পারফেক্ট ছেলেকে পছন্দ করি, তা দেখে হিং’সায় জ্ব’লেছিস। সেজন্যই তো বুদ্ধি খাটিয়ে এই বাসায় উঠেছিস, যাতে তাকে তুড়ি মে’রে হাত করে ফেলতে পারিস। এই এসব তোর বাপ-মা শিখিয়ে দিয়েছিল না কি রে? প্ল্যান করে মেয়ের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার জন্য এত নিচে নেমেছে? মামার বন্ধু সেজে নিজের স্বার্থসিদ্ধির ব্যবস্থা করছে? এত টাকার লোভ তোদের? ছিঃ!”
আমি চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। এ আমার বিখ্যাত দোষ। কারো কটুক্তি সহ্য হয় না। আর তা যদি হয় মিথ্যে অপবাদ, তাহলে তো তা সহ্য সীমার বাইরে। তবু ছলছল চোখে আমি প্রতিবাদ করলাম,
“খবরদার আপু, আমার আব্বু-আম্মুকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না। সোজা গিয়ে ফুপাকে জানাব আমি। তোমার এই বিশ্রী মানসিকতা সম্পর্কে সবাইকে জানাব। তুমি নিজেই তো সবার সামনে সাধু সেজে থাকো, আর এই মুহূর্তের রূপটাই হলো তোমার আসল রূপ। আমাকে বাজে কথা শোনানোর আগে নিজের মনটাকে ঠিক করো। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তাজ ভাই তোমার মতো মেয়েকে নিজের থেকে দূরে সরাতেই এই কাজটা করেছে। উনি ভালো করেই জানেন, কে কত সাধু।”
আফরা আপু নিজের খারাপ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে এমনসব কথা বলল যে, আমি কোনোমতে তার সঙ্গ ছেড়ে রুমে চলে এসেছি। কারণ তার সাথে তাল মেলানো আমার কর্ম নয়। কিন্তু অবাধ্য চোখের জল বাঁধা মানল না। ঘৃণায় ঝরঝর করে ঝড়ে চলল। ওয়াশরুমে ঢুকে নিঃশব্দে কাঁদলাম। এত জঘন্য কথা আমি কেবল আফরা আপুর মুখেই শুনেছি। এর আগে কোনোদিন অন্য কোনো ব্যক্তি আমায় নিয়ে জঘন্য মন্তব্য করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। সবাই এসব হজম করতে পারে না, তন্মধ্যে আমিও। ওয়াশরুমের দরজার বাইরে থেকে সায়মা আপুর ডাক শুনে দ্রুত মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। ছাদে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে সে। সবাই না কি চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি কান্না লুকাতে গিয়ে আমার মেকআপের বারোটা বাজিয়ে বসে আছি। বিরক্তি নিয়ে ঘষেমেজে মুখ থেকে মেকআপ নামক প্যারা ধুয়েমুছে সাফ করে ফেললাম। নিজেকে সামলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সায়মা আপুকে পেলাম না। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দুটো জিনিস পেলাম। একটি অতি পরিচিত চিরকুট, আরেকটি বেলী ফুলের বড়ো মালা। মালাটা হাতে তুলতেই নাকে সুঘ্রাণ ধাক্কা খেল। নাকের কাছে নিয়ে কিছু মুহূর্ত প্রাণভরে ঘ্রাণ নিলাম। তাজা ফুলের মালা। তারপর চিরকুট খুললাম।

মনোহারিণী,
আমার শুভ্রতা জড়ানো নিষ্পাপ কামিনি। শুভ্রপ্রেমীর বেলী ফুলের এক টুকরো শুভ্রতা আমার ব্যক্তিগত ফুলের জন্য। এ জীবন, আজীবন আমার বক্ষ জুড়ে ফুলের মতো ফুটে থাকুক সে। এক শুভ্রপ্রেমীর নিজস্ব পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা তার নামে লিখে দেওয়া হলো। তবু সে একটুখানি হাসুক সূর্যমুখীর ন্যায়, শুভ্রতা ছড়াক বেলীর। কেউ একজন সেই আকাঙ্ক্ষিত শুভ্রতামাখা হাসির অপেক্ষায়। ওহ্ হ্যাঁ, ওই বেলীর চাহিদা কেবল মনোহারিণীর ঘনকালো কেশ।
ইতি
কোনো এক শুভ্রপ্রেমী

চিরকুটটা পরপর তিনবার পড়লাম। মালাটা দুহাতে তুলে বারংবার ঘ্রাণ নিলাম। কিন্তু কেশে আর ছোঁয়ানো হলো না। গলায় কান্নারা দলা পাকাতে লাগল। বহুকষ্টে সেই কান্নাটুকু গিলে আমি হাতের মালাটা মুচড়াতে গিয়েও মুচড়ালাম না। দ্রুত নিজের ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর বড়ো করে শ্বাস নিয়ে খোলা চুলগুলো বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। এখন কেবল শাড়ি ব্যতীত বাড়তি সাজ নেই বললেই চলে। কানের দুল দুটোও খুলে ফেলেছিলাম। তবে আগের থেকে এখনই বেশ হালকা লাগছে। আমার অবস্থা দেখে সবার চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড়। সবার একই প্রশ্ন, আমি সাজ উঠালাম কেন। আমিরা আপু রীতিমতো রেগে গেছে। আমি তাদের কোনোমতে বিশ্বাস করালাম, অস্বস্তি হচ্ছিল বলে সাজ উঠিয়ে ফেলেছি। কথাটা তারা বিশ্বাস করল শুধুমাত্র আমি অসুস্থ বলেই। আমিও সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি। ছাদে যাওয়ার পরও ছোটো-বড়ো সবার একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। সবাই দুঃখ প্রকাশ করলেও, সৌরভ ভাইয়া হাসিমুখে বলে উঠল,
“আমি জানতাম আপনি ওসব ছাইপাশ উঠিয়ে ফেলবেন। একদম ভালো করেছেন। ওই ময়দাওয়ালীদের দলে নাম না লেখানোই শ্রেয়।”
আমি উত্তর দিলাম,
“আপনি কি জানেন না বলুন তো? সবই তো দেখছি জানেন।”
হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট হয়ে উঠেছে। রাজ ভাই বেজায় খুশি। তার মুখের মিষ্টি হাসিটাই যেন সবার আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু আমার জন্য সমস্যা হচ্ছে সাউন্ড বক্সের তীব্র শব্দ। প্রত্যেকটা শব্দ যেন ধুপ-ধাপ করে মাথায় আঘা’ত হানে। স্টেজের সামনেই ক্যামেরা হাতে দেখা যাচ্ছে তাজ ভাইকে। স্টেজের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে ভীষণ ব্যস্ত সে। মাঝে-মাঝে আবার চারপাশেও ক্যামেরা তাক করছে। এগিয়ে এসে নূর আঙ্কেল আর আব্বুর ছবিও তুলেছে। আব্বুর পাশে কোনো হাতি, না ঘোড়া বসে আছে, সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপই নেই। পুরোটা অনুষ্ঠান আমি কা’টিয়ে দিলাম আব্বুর পাশে বসে। এদিকে একেকজন হলুদ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। কে কাকে মাখাতে পারে। আব্বু আমার শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে কাউকে হলুদ লাগাতে দিলো না। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এসব একদমই ভালো লাগে না। রাত-বিরেতে আবার হলুদ ঘষেমেজে উঠাতে হত। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বুঝি আমার একার কানে পৌছাল না। যার কর্ণগোচর হলো, তার বুঝি সহ্যও হলো না। সবার হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই আমি টের পেলাম পেছন থেকে কেউ বাঁধা চুলগুলো থেকে কাটার খুলে নিয়েছে। চকিতে পেছন ফিরে তাকালেও, ভীড়ের মাঝে সঠিক মানুষটির সন্ধান পেলাম না। তবে খোলা চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে বাঁধতে গিয়ে স্পষ্ট টের পেলাম ঘাড়ে ভেজা বস্তুর অস্তিত্ব। দ্রুত চোখের সামনে হাত মেলে ধরতেই কাঁচা হলুদ বাটার গন্ধ নাকে লাগল। পুনরায় ঘাড়ে হাত বুলালাম। একটুখানি হলুদ, সম্ভবত দুই আঙুলে ছোঁয়ানো। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আমি মুঠোয় ধরা চুলগুলো আবার পিঠে মেলে দিলাম। অতঃপর স্টেজের দিকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো, দেহ-মনে প্রিয় শুভ্রতা জড়ানো মানুষটির শুভ্র দুই গালে টকটকে হলুদের ছোঁয়া দিলো আমিরা আপুর দুটি উচ্ছল হাত।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here