মনোহরিণী পর্ব -২৭+২৮

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৭.
১৩-ই অক্টোবর। ছোটো বেলায় এই দিনটাকে আমার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হত। এই দিনটা এলেই যে আমি আস্তে-আস্তে বড়ো হয়ে যাব। বয়সের এক ধাপ বাড়বে। সবাই আমাকে বড়ো বলবে। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর মনে হয়, এই দিনটা আরও দেরী করে আসুক। বয়সটা থেমে থাকুক, সময়গুলো থমকে যাক। বোধ হয় প্রতিটি মানুষই নিজের বয়স ধরে রাখার সুপ্ত বাসনা লুকিয়ে রাখে। জীবন থেকে একেকটা বছর পার হয়ে যাওয়া মানেই আমরা ধীরে-ধীরে জীবনের শেষ প্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছি, যা কেউ চায় না। সব মানুষই চায় এই সুন্দর পৃথিবীতে বহু বছর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ভাঙার সাধ্য তো আর কারোর নেই। বড়ো হওয়ার পর জন্মদিন পালনেও আমার ভীষণ অনিহা সৃষ্টি হয়েছে। আমার পরিবার, বিশেষ করে আব্বু এটা ঠিক পছন্দ করে না। ধীরে-ধীরে আমিও তেমনটাই হয়ে গেছি। কেক কা’টা, হৈ-হুল্লোড়, গান-বাজনা এসব ঠিক ভালো লাগে না। কেউ উইশ না করলেও আমার কিছু যায় আসে না। কারণ উইশ করলেও মানুষগুলো আমার আপন, না করলেও তাই। উইশ করেনি মানে সে আমায় মনে রাখেনি, তেমনটা ভাবা ভুল। সত্যিকারের আপন মানুষগুলো সবসময়ই আমাদের মনে রাখে। তার জন্য কোনো বিশেষ দিনের দরকার পড়ে না। এই দিনটি আসার আগেও সবার কাছে আমি ইলোরা ছিলাম, দিনটি চলে যাওয়ার পরও সেই ইলোরাই থাকব। শুধু বয়সটা এক ধাপ বাড়বে, এই যা। আমি অন্যান্য দিনের মতোই এই দিনটা সাদামাটা কা’টাই। পার্থক্য শুধু কিছু মানুষের সুন্দর উইশ বেশ আনন্দ দেয়। সবচেয়ে বিশেষ হচ্ছে আম্মুর হাতের মজার-মজার রান্না। ব্যস, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি। এর বেশি কিছুর আশাও আমি রাখি না। আজ ১৩-ই অক্টোবর। এই প্রথম জন্মদিনে আমি আম্মুর কাছ থেকে দূরে। আম্মু সকালেই ফোন করেছিল। তার সাথে বোনরাও শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। আমার চোখে ছিল তখন টইটুম্বুর জল। আম্মু নামক মানুষটাকে তো আমি এমনই একটা দিনে পেয়েছিলাম। সে যখন ব্যথিত কন্ঠে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল, তখন আমার খুব করে ইচ্ছে করছিল তাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। ওই স্পর্শটা আমি ভীষণ মিস করি। নূর আঙ্কেল আর আম্মিও সকালেই শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তারপর থেকে সময় কা’টল অন্যান্য দিনের মতোই। শুধু ভার্চুয়াল জগতে ঢুঁ মা’রলেই অনুভব হয় আজ আমার জন্মদিন। কত মানুষের ভালোবাসাপূর্ণ শুভেচ্ছা! এদিক থেকে ভাবলে দিনটা অবশ্য বেশ সুন্দর। টাইমলাইন আর ইনবক্স ভর্তি উইশ। অথচ তখন আমি ভার্সিটিতে। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে আম্মি নামক মানুষটাকে আমার আরও একবার আম্মুর কার্বন কপি বলে মনে হলো। আম্মুর মতোই সে স্পেশাল রান্নার পশরা সাজিয়ে বসেছে। টেবিল ভর্তি খাবার আর আম্মির মুখ ভর্তি হাসিতেই আমার মনটা অনেক হালকা হয়ে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। সারা বিকেল পার করে দিলাম ঘুমিয়ে। সন্ধ্যায় খাটে পা ছড়িয়ে বসে ইনবক্সের চাপ কমাচ্ছিলাম, অর্থাৎ ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ মিনহা আপু এসে বলল,
“ইলো, চল তো একটু বাইরে যাই।”
“কী করতে?”
“দরকার আছে।”
“কী দরকার বলা যায় না?”
“গেলে তো দেখবি।”
“এখন আম্মি যেতে দিবে?”
“কাকিকে আমি বলে এসেছি। তুই রেডি হ।”
মিনহা আপু রেডি হয়েই এসেছে। আমি ঝটপট রেডি হয়ে আম্মিকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। মিনহা আপু আমায় নিয়ে একটা শপিংমলে ঢুকল। বুঝলাম সে কিছু কেনার জন্য এসেছে। মিনহা আপু একবার ড্রেস দেখছে, একবার কসমেটিকস দেখছে। তার এটা-ওটা দেখতে দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না আজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা চলবে। এই মেয়ে নিজেই জানে না কী কিনতে এসেছে। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, “এটা ভালো? ওটা কিনব? কোনটা সুন্দর?”
আমি উত্তর দিলাম,
“তুমি যেটা কিনবে, সেটাই সুন্দর। এবার তাড়াতাড়ি করো প্লিজ।”
“ধুর! কী কিনব বুঝতে পারছি না তো। দেখ তো তোর কী ভালো লাগে?”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। একবার ভাবলাম, মিনহা আপু কি আমার জন্য কিছু কিনতে এসেছে? পরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম,
“তুমি কার জন্য কিনতে এসেছে?”
মিনহা ঠোঁট উলটে বলল,
“কিনতে তো এসেছি তোর জন্য। কিন্তু কী কিনব ঠিক করে আসিনি। শপিংয়ে এলে এজন্যই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কনফিউজড হয়ে পড়ি। এই বল না তোর কী পছন্দ।”
“আমার কিছু লাগবে না আপু। তোমার জন্য কিছু কিনতে হলে কিনো।”
“আমার জন্য কিনলে এতক্ষণে কিনে ফেলতাম। তোকে কি চেহারা দেখাতে নিয়ে এসেছি?”
“তুমি তো আমায় বলোইনি। বললে আসতাম না।”
“তোর সাথে বকবক করাই বৃথা। সর, আমার পছন্দেই কিনব।”
নিজের পছন্দ ঠিক করতে গিয়েও মিনহা আপু নাকানিচুবানি খেল। শেষে দশ-বারোটা দোকান ঘুরে সে একটা ড্রেস কিনল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু আমার স্বস্তির বারোটা বাজিয়ে আপু ফুসকার দোকানে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি অনুরোধ করে বললাম,
“এবার চলো আপু। ফুসকা কাল খেয়ো। রাত সাড়ে দশটা বেজে যাচ্ছে। আম্মি নিশ্চিত রাগ করবে।”
আপু পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ফুসকা খেতে কত সময় লাগবে? আরেকটু অপেক্ষা কর। কিছু হবে না। কাকিকে বলে এসছি না?”
গোবেচারা আমি বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ফুসকা খেতে বসে না আবার এগারোটা বাজিয়ে ফেলে। তারপর বাসায় গেলে এমনিতেই ঘড়ির কাঁ’টার সাথে আমারও বারোটা বেজে যাবে। মনে থাকলে আর এই মিনহা আপুর সাথে আমি জীবনেও রাতে বাইরে আসব না। মাথায় চিন্তা নিয়েই আমি দ্রুত ফুসকা গিললাম। অথচ মিনহা আপুর কোনো হেলদোল নেই। সে নিশ্চিন্তে খাচ্ছে। আমি এবার বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আপু, তোমার কি আজ বাসায় ফেরার ইচ্ছে নেই?”
সে আস্ত এক ফুসকা মুখে পুরে চিবোতে-চিবোতে উত্তর দিলো,
“বাসায় ফিরব না তো রাস্তায় রাত কা’টাব? এই তো আমার খাওয়া শেষ। এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন?”
“ধৈর্য রেখে হলোটা কী? তুমি তো পারলে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নাও?”
অবশেষে মিনহা আপু বাসায় ফিরতে সম্মত হলো সোয়া দশটায়। লিফট থেকে বেরিয়ে আপু নিজেই বলল,
“চল, আমি কাকিকে বলে আসছি কেন দেরী হয়েছে। ভীতুর ডিম।”
কলিংবেল বাজিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। দরজা খুলল শ্রেয়ান ভাইয়া। আমি তাকে দেখে প্রশ্ন করলাম,
“ভাইয়া, আপনি কখন এলেন?”
উনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন,
“কিছুক্ষণ আগে। ভেতরে এসো।”
আমাকে ঠেলেঠুলে মিনহা আপু ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার পেছনে আমিও ঢুকলাম। ভেতরে পা রাখতেই চারপাশের ‘হ্যাপি বার্থডে’ ধ্বনি আর ঘর ভর্তি জরি কাগজের ছড়াছড়ি আমায় পুরোদস্তুর চমকে দিলো। কিছু সময়ের জন্য আমি হতবাক হলাম। ড্রয়িংরুমে সব হাস্যোজ্জ্বল পরিচিত মুখগুলো। ঘরটা বেশ সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। সেন্টার টেবিলে কেকও দেখা যাচ্ছে। আমি হাসলাম। এজন্যই আম্মি আর নূর আঙ্কেল ছাড়া কেউ সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত আমায় উইশ করেনি। এরাই যে পরিকল্পনা করে এসব আয়োজন করেছে, তা-ও স্পষ্ট। নূর আঙ্কেলের পরিবার আর আমিরা আপুদের পরিবারের সবার সাথে শ্রেয়ান ভাইয়াও আছে। জানতে পারলাম পরিকল্পনামাফিক আমাকে মিনহা আপুর সাথে বাইরে পাঠিয়ে এসব আয়োজন করা হয়েছে। সেলিব্রেশন আমার ভালো লাগে না, বিধায় ঘটা করে কেক কা’টার ব্যাপারটা নিয়ে কেউ আমায় জোর করেনি। উইশ করে একে-একে সবাই আমার হাতে গিফট তুলে দিলো। কেবল তাজ ভাই দুহাত পকেটে গুটিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। উইশ, গিফট কোনো কিছুতেই যেন উনি আগ্রহী নন। শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেই কেক কে’টে সবার হাতে দিলো। সেখানেও তাজ ভাই গম্ভীর গলায় বলে দিলেন,
“এখন মিষ্টি খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
জোর করেও লাভ হলো না। তারপর এল রাতের খাবারের সময়। আম্মি বিরিয়ানি রান্না করেছে শুনেই আমার আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল। আজ বাড়িতে থাকলে আম্মুও নিশ্চয়ই এটাই করত। খাওয়ার সময়ও আমি তাজ ভাইয়ের হাবভাব লক্ষ্য করলাম। কেমন যেন অন্যরকম ঠেকল। মুখে হাসি নেই, সবার মতো আনন্দ নেই। খাবারের প্রতিও অনিহা। কোনোরকমে খেয়ে উঠে গেলেন। সদা চঞ্চল মানুষের হঠাৎ এমন উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তশিষ্ট ভাব আমায় বেশ ভাবিয়ে তুলল। এনার ক্ষেত্রে এসব ভালো লক্ষণ নয়। কী হয়েছে তা জিজ্ঞেস করাও সম্ভব না। অপেক্ষা করতে হবে। আমি অপেক্ষা করলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে একে-একে সবাই ঘুমাতে চলে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়াও সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সবাই ঘুমাতে গেলেও আমার মনের ভেতরের খচখচানি থামল না। শোয়া তো দূর ফ্রেশও হলাম না। বেশ কিছু সময় রুমে পায়চারি করে দরজা খুলে বাইরে সতর্ক দৃষ্টি রাখলাম। বিপরীত দিকের কোণের রুমের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললাম। দরজা ঠাঁ করে খোলা। আশ্চর্য! এরপর আর আমি দেরী করলাম না। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের কাছে চলে গেলাম। দরজার বাইরে থেকেই দেখলাম উনি চেয়ারে বসে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের ওপর কী সব কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলাম। সাবধানে পা ফেলে ওনার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঁকি দিয়ে টেবিলের কাগজপত্র দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। ধারণা করলাম ওসব ওনার কাজের কোনো কাগজপত্র। হয়তো কোনো কেস সম্পর্কিত। পেছন থেকে সরে এসে ওনার পাশে দাঁড়ালাম। অথচ উনি টের পেয়েও চোখ তুলে তাকালেন না। যেন মনোযোগে বিঘ্ন ঘটা অ’ন্যায়। আমিও চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইলাম। টেবিলের বইয়ের ওপর চোখ পড়তেই আমি উৎসুক হয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। বইয়ের ওপর কয়েকটা চকোলেট রাখা। মহাশয় তো এসব চকোলেট পছন্দ করেন না। তাহলে? সাতপাঁচ না ভেবে আমি চকোলেটগুলো মুঠোয় পুরে নিলাম। সঙ্গে-সঙ্গেই উনি গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
“হবু জামাই দুটো চকোলেটও কিনে দেয় না? এত পয়সাওয়ালার হবু বউ শেষে অন্যের ঘর থেকে চকোলেট চু’রি করে?”
আমি চকোলেট মুখে পুরতে গিয়েও থেমে গেলাম। কথাটা মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। চিন্তিত মুখে বললাম,
“বুঝলাম না। কিসের হবু জামাই, হবু বউ?”
“শ্রেয়ানের প্রপোজাল যখন অ্যাকসেপ্ট করার ইচ্ছে ছিল, তখন এই এক মাস অযথা ওকে পেছনে ঘুরিয়ে সময় নষ্ট করার কী দরকার ছিল? বেচারা শ্রেয়ান শুধু-শুধু এতদিন ক্লান্ত হলো। শ্রেয়ানের উচিত তার এত সাধনার হবু বউয়ের অ্যাক্টিং স্কিলকে বাহবা জানানো।”
আমার মনে হলো আমি কানে ভুল শুনলাম। কিন্তু ওনার মুখ দেখে মোটেও মনে হলো না উনি মজা করছেন। অবাক হয়ে বললাম,
“প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট কে করেছে? অদ্ভুত কথা! এক মাস পর এসব গুজব কোত্থেকে শুনেছেন আপনি?”
“তোর হবু বরই তো বলল,” স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলেন উনি।
আমি কী রিয়্যাকশন দিবো তা-ও বুঝে উঠতে পারলাম না।
“মানে কি এসবের? আপনি ফাজলামি করছেন?”
উনি কাগজগুলো গোছাতে-গোছাতে বললেন,
“বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমের সফলতা নিয়ে আমি ফাজলামি করতে যাব কোন দুঃখে?”
বুঝলাম উনি সত্যিই সিরিয়াস। আমি নিজেও এবার সিরিয়াস হলাম। ওনার টি-শার্টের কাঁধের কাছে মৃদু টান দিয়ে বললাম,
“শ্রেয়ান ভাইয়া নিজের মুখে এসব বলেছে? আপনি এদিকে তাকান। আমাকে নিয়ে এসব ফা’লতু গুজব উনি কেন ছড়াবেন? ওনার সাথে তো আমার ঠিকমতো কথাও হয় না। আর ওসব প্রপোজের কথা আমি এতদিনে ভুলেও গিয়েছিলাম। এদিক ফিরুন। আমি শ্রেয়ান ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করব উনি এসব কেন বলেছেন। কী হলো? এখন কিছু বলছেন না যে?”
তবু উনি আমার দিকে তাকালেন না। কাগজগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে কাবার্ডে রেখে দিলেন। তারপর কী মনে করে এই রাতদুপুরে পাঞ্চিং বক্সে কিলঘুষি মা’রা শুরু করলেন। মুখের অবস্থা থমথমে। যেকোনো সময় ভ’য়ানক ভূমিকম্প হানা দিতে পারে। আমি গম্ভীর মুখে অদূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কয়েকবার বললাম এসব সত্য নয়। তা-ও থামছে না। শেষে আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“সামনে আস্ত একটা মানুষ থাকতে পাঞ্চিং বক্সের ওপর রাগ ঝাড়ার কী দরকার?”
সঙ্গে-সঙ্গে উনি থেমে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত থম মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে জোরে-জোরে শ্বাস নিলেন। এবার আমি সাহস করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললাম,
“এসব ব্যাপারে আমি সত্যিই কিচ্ছু জানি না। শ্রেয়ান ভাইয়া কেন হঠাৎ এমন মিথ্যে কথা বলল তা-ও জানি না, বিশ্বাস করুন।”
কথাটা বলতেই উনি হুট করে ডান হাতে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার পিলে চমকে উঠল। চুলের ব্যথায় চোখের কোণে চিকচিকে জল জমে উঠল। উনি চোয়াল শক্ত করে কঠিন মুখে বললেন,
“শ্রেয়ানের সাথে আমার বন্ধুত্ব এক-দুই দিনের না। ওর নাড়ি-নক্ষত্র সব আমার জানা, আর এসব ও নিজেই আমায় জানায়। আজ পর্যন্ত ও আমার সাথে সিরিয়াস কোনো বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেনি। আর আজ ও নিজের প্রেম বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে মিথ্যে বলবে? লাভটা কী ওর? নিজেকে খুব সেয়ানা মনে করিস, তাই না? তাজকে বোকা বানানোর খুব ইচ্ছে ছিল তোর? হায় ইলুরানি, তুমি বোয়াল হলে তাজ রাঘব বোয়াল। এতদিনেও বুঝলে না?”
আমি চেষ্টা করেও ওনার মুঠো থেকে চুল ছাড়াতে পারলাম না। ছলছল চোখে বললাম,
“চুল ছাড়ুন তাজ ভাই, ব্যথা লাগছে।”
উনি হাতের মুঠি আরও শক্ত করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“ব্যথা! ব্যথার মানে বুঝিস তুই? ব্যথা আবার কী রে? আমার তো খুব আনন্দ লাগছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তার ভালোবাসা জয় করে নিয়েছে। আহ্! কী যে আনন্দ!”
আমার ডান চোখ বেয়ে অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখ-মুখ কুঁচকে ওনার পেটের কাছের টি-শার্ট দুহাতে চেপে ধরে মৃদু কন্ঠে বললেন,
“আমার সত্যিই খুব লাগছে। প্লিজ ছাড়ুন। মে’রে ফেলবেন?”
ধীরে-ধীরে ওনার শক্ত হাতের মুঠি কিছুটা আলগা হলো। আমি ওনার চোখের দিকে তাকালাম। ওই জলন্ত চোখের ভাষা পড়ার সাধ্য আমার ছোট্ট মস্তিষ্কেরও নেই। তবু কাঁপা গলায় বললাম,
“আমি জানি না শ্রেয়ান ভাইয়া কেন এত বড়ো মিথ্যেটা আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে। আমার এটা বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনার কেন মনে হয় বন্ধু সত্যি বলছে আর আমি মিথ্যে বলছি? বন্ধু আপনার প্রাণপ্রিয়, আর আমি ভেসে এসেছি? এটা যদি সত্যি হয়েই থাকে তাহলে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ? বিশ্বাসের ভীত এটুকুই?”
উনি চুল ছেড়ে দুহাত কিছুটা শক্ত করেই আমার গালে রাখলেন। একইভাবে বললেন,
“বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলো না ইলুপাখি। এরপর থেকে আমি এই বিশ্বাসকে পিষে ফেলতেও দ্বিধা করব না। তুমি জেনে খুশি হবে, আমি তাজ কোনো বিশ্বাসঘাতকের ছায়াও মাড়াই না। আমি খুব করে চাইব আমার ছোট্ট হরিণীকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ ছুঁতে না পারুক। তার বেলায় সাত খু’ন মাফ।”
আমার দুই গাল ইতোমধ্যে ভিজে উঠেছে। বিরক্তি তরতর করে রাগে পরিনত হয়েছে। সব মানতে পারলেও আমি এই মিথ্যে অপবাদটা কখনোই মানতে পারি না। যেটা আমি করিনি, সেটার জন্য কষ্ট কেন ভোগ করব? মুঠোয় ধরা ওনার টি-শার্ট ঝাঁকুনি দিয়ে মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম,
“কিসের বিশ্বাসঘাতক? কে বিশ্বাসঘাতক? আপনি আর আপনার বন্ধু যা ইচ্ছে বলবেন আর আমি মেনে নিব? এত সহজ? আমাকে আপনার রোবট মনে হয়। যখন যা ইচ্ছে বলে ফেলবেন আর আমি চুপচাপ মেনে নিব? ছয় বছর আগেও আপনি ঠিক এই আচরণটাই আমার সাথে করেছিলেন। সেটা না হয় অভিনয় ছিল। এখনকারটা কী? আপনি আমার ছায়া না মাড়ালে আমি ম’রে যাব? না ম’রব, না কোনো অপবাদ সহ্য করব। আমার এখন আফসোস হচ্ছে, আমি কেন আপনার মতো অবিশ্বাসী একটা মানুষকে বিশ্বাস করার মতো ভুল করলাম।”
“চিন্তা কোরো না, তাজ নামক ভুল তোমার জীবন থেকে মুছে যাবে। তাজ কারো পথের কাঁটা হয়ে থাকে না। আফসোস নিয়ে তোমায় বাঁচতে হবে না। তুমি তোমার সঠিক মানুষের সাথে বাঁচো। দোষী তাজ তোমার চোখে আজীবন দোষী হয়েই থাকুক। তবু তুমি ভালো থাকো ইলুপাখি।”
শীতল কন্ঠে কথাগুলো বলেই উনি আমাকে প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়ে টানতে-টানতে এনে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে, ঠাস করে দরজা আটকে দিলেন। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে কেমন পাগল-পাগল লাগল। চিৎকারগুলো গলায় এসে দলা পাকালেও, বাইরে বেরোতে পারল না। নীরব অশ্রুর সাথে সবটা ঝরে গেল। মনে হচ্ছে আমি এখনও কোনো ঘোরের মধ্যে আছি। নইলে তাজ ভাই কীভাবে আমার মুখের ওপর দরজা আটকাতে পারলেন? আর ওসব অপবাদ? উনি এভাবে আমায় অবিশ্বাস করলেন? এতগুলো দিনের সব বিশ্বাস শুধুমাত্র একটা মিথ্যে গুজব এসে এভাবে গুঁড়িয়ে দিলো? শ্রেয়ান ভাইয়া, যাকে সবসময় খুব ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম; উনি হঠাৎ করে কেন আমার সাথে এমনটা করলেন?
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৮.
আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা অনেকটা জাদুকরের মতো। এই মানুষগুলো আমাদের মন পড়তে জানে। তুড়ি মে’রে মন ভালো করে দেওয়ার মতো অসাধারণ ক্ষমতাও এদের আছে। এদের থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টাটুকুও করা যায় না। কিন্তু এই মানুষগুলো যখন হুটহাট অপরিচিত আচরণ করে, তখনকার সময়গুলো হয় ভয়’ঙ্কর। কারণ এই জাদুকররা অনায়াসে অন্যের মন পড়তে জানলেও, এদের মন পড়ার সাধ্য কাউকে দেয় না। এ কারণে তাদের অপরিচিত আচরণ কেবল এবং কেবলই আমাদের পী’ড়া দেয়। সেই পী’ড়া থেকে বেরোনোর সাধ্যটুকুও আমাদের থাকে না। আমার জীবনেও এমনই এক জাদুকর আছে। সে তাজ। সে খুব অনায়াসেই তার স্থান আমার মাথায় করে নিয়েছে। এ তার রাজত্ব। এই রাজত্বের বলে সেও আজ আমায় পী’ড়ায় আক্রা’ন্ত করে নিজে লাপাত্তা হয়েছে। গতকাল গোটা রাত আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কা’টিয়েছি। মাথায় শুধু একটা আর্তনাদই ঘুরেছে, উনি আমায় অবিশ্বাস করলেন! ভোরের দিকে একটুখানি ঘুমিয়েছিলাম। তাতে কি আর রাতের ঘুম পূরণ হয়? ফলস্বরূপ আবার সেই মাথার য’ন্ত্রণার সূচনা। সহ্য করতে না পেরে সকালে রান্নাঘরে উঁকি দিলাম তাড়াতাড়ি চা পাবার আশায়। আম্মি আমাকে সূক্ষ্ম চোখে দেখে বলল,
“চোখ-মুখ অমন দেখাচ্ছে যে? তোমার কি মাথাব্যথা করছে?”
আমি অসহায় মুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালাম। আম্মি কুলসুম আপাকে তাড়া দিলেন আমাকে চা দেওয়ার জন্য। তারপর আমাকে বললেন,
“কী একটা অভ্যাস হয়েছে মেয়েটার! সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা। যাও, চুপচাপ বসো। জানি তো চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ বসে রইলাম। এরমধ্যেই তাজ ভাই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চললেন রান্নাঘরে। আম্মিকে ডেকে বললেন,
“আম্মি, চা/কফি কিছু পাওয়া যাবে? আমি বেরোব।”
“দিচ্ছি, একটু অপেক্ষা কর। এত তাড়া কিসের?”
“দেরী করা যাবে না।”
এত সকালে উনি বেরোনোর জন্য তাড়া দেখাচ্ছেন কেন জানা নেই আমার। আম্মিও কোনো প্রশ্ন করছে না। অফিসে তো এখন যাওয়ার সময় না। তাহলে? কুলসুম আপা আমার জন্য চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে নিতেই তাজ ভাই চায়ের কাপটা নিজে নিয়ে নিলেন। আম্মি বলল,
“ওটা ইলোর। তোরটা দিচ্ছি আমি।”
উনি উত্তর দিলেন,
“চায়ের কাপে তো নাম লেখা নেই। আমার তাড়া আছে।”
কুলসুম আপা বলে উঠলেন,
“ছোডো আফার অনেক মাতায় ব্যতা। ওনারডা ওনারে দিয়া দেন। আহারে! আফার চোখ-মুখ কেমন টান ধরছে, দেহেন না?”
উনি সরু চোখে এক পলক আমাকে দেখলেন। আমি ওনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। চোখাচোখি হলো এক মুহূর্তের জন্য। সঙ্গে-সঙ্গেই উনি চোখ সরিয়ে চলে যেতে-যেতে বললেন,
“কুলসুম আপা, নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে গিয়ে যেচে রাত জাগলে তো যে কারোরই মাথা ব্যথা করবে। এরজন্য চা নয়, পছন্দের বরের ব্যবস্থা করুন।”
আম্মি চেঁচিয়ে উঠল,
“ছেলে পেয়েছি আমি একটা! নিজের ভবিষ্যত নিয়ে হেলদোল নেই, সে আরেকজনের ভবিষ্যত নিয়ে খোঁচা মা’রে। বিদেশ-বিভূঁই চষে এসেও তার কোনো মেয়েকেই চোখে লাগল না। এর পেছনে এত মেয়ে ঘুরল কী করতে? নিরামিষাশী নিরামিষই চায়, আজকাল তারও খোঁজখবর নেই।”
কথাগুলো আমার কানে এলেও তখন আমার দৃষ্টি অদূরের ওই বদ্ধ দরজায়। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে আমি তাজ আর শ্রেয়ান নামক দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বন্ধুত্বের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। কীভাবে কী হয়ে গেল? অদ্ভুত! আম্মি আবার চা নিয়ে এসে আমাকে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“বেশি খারাপ লাগছে?”
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম,
“না আম্মি, ঠিক হয়ে যাবে।”
চা শেষ করেও আমি একই জায়গায় ঠাঁয় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরেই আবার তাজ ভাই বাইরে এলেন। এবার ওনাকে দেখে আমি দৃষ্টি সরালাম না। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি কোনোরকমে রেডি হয়ে বেরিয়েছেন। তার থেকেও বড়ো ব্যাপার হচ্ছে ওনার কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। উনি কোথাও যাওয়ার সময় ওই ব্যাগে জামা-কাপড় নেন। তাহলে সত্যিই উনি কোথাও যাচ্ছেন? কিন্তু ওনার তো অফিস আছে। উনি আম্মিকে ডাকলেন। আম্মি ছুটে এসে হা-হুতাশ করে বলল,
“না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই? বোস, রুটি করা হয়ে গেছে। কুলসুম, তাজের খাবার রেডি করো।”
তাজ ভাই বাঁধা দিয়ে বললেন,
“না আম্মি, এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নিব।”
“তুমি কত যে খাবে তা কি আমার অজানা? কাজের আগে খাবার। ঠিকমতো না খেলে বিছানায় পড়ে থাকবে। তখন দেখা যাবে কীভাবে খেয়ে, না খেয়ে কাজের পেছনে ছোটো।”
উনি আম্মিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তোমার ছেলে এমনিতেই ফিট আম্মি। এত চিন্তার কিছু নেই। আমি সময়মতো খেয়ে নিব। আব্বুর সাথে দেখা করে আসি।”
উনি নূর আঙ্কেলকে খুঁজতে ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। আম্মিও চেঁচাতে-চেঁচাতে ওনার পিছু নিলেন। আমি এক চুলও নড়লাম না। মূর্তির মতো এক জায়গাতেই বসে কাহিনি দেখতে লাগলাম। মিনিট তিনেক পর মা-ছেলের সাথে নূর আঙ্কেলও বেরিয়ে এলেন। বাবা-মা দুজনেই খেয়ে যাওয়ার জন্য ছেলেকে তোষামোদ করছেন। কিন্তু ছেলে এখন খাবেই না। তার রুচি আজ চান্দের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। নূর আঙ্কেল আর আম্মির থেকে বিদায় নিয়ে উনি জেনিফার ভাবির থেকেও বিদায় নিলেন। শেষমেষ কুলসুম আপাকেও বাদ দিলেন না। অথচ আমি ছিলাম চোখের সামনে বসে থাকা এক অদৃশ্য মানবী। আমাকে যেন খালি চোখে দেখা যায় না। দেখতে হলে দূরবীন অতীব জরুরী। ডিটেকটিভ দৃষ্টিতেও এই অদৃশ্য মানবী ধরা পড়ল না। দেখেও না দেখার ভান করে দিব্যি বেরিয়ে পড়লেন নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আমার গত রাতের য’ন্ত্রণাগুলোতে অভিমানের মরিচা ধরল। এ মরিচা ছাড়ানোর উপায়ও আমার জানা নেই। ভেবেছিলাম আম্মিকে জিজ্ঞেস করব উনি কোথায় যাচ্ছেন। কিন্তু এরপর আর সেটা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটুকুও থাকল না। ইগো কারোর একার নয়। রাগ, অভিমান, অভিযোগও কারোর একার নয়। ওনার থাকলে আমারও এসব সমানভাবেই আছে। কিন্তু আফসোস, উনি শুধু নিজেরটাকেই গুরুত্ব দিয়ে অপরজনেরটা পায়ে ঠেলে দিয়েছেন। তবে বেশ, থাকুক যে যার মন নিয়ে। যেখানে আমার দোষ নেই, সেখানে আমি দায়বদ্ধও নই। আজ আর ভার্সিটিতে যাওয়ার ইচ্ছেও হলো না। জুম্মান ভাইয়া আমাকে ডাকতে এলে আমি শরীর খারাপের কথা বললাম। ভাইয়া খুব কৌতুহল নিয়ে বলল,
“এই ইলো, তুই শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে কিছু ভেবেছিস?”
আমি ভাবলেশহীন উত্তর দিলাম,
“হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি তো যা বলার আগেই বলে দিয়েছিলাম।”
“তাহলে শ্রেয়ান ভাইয়া এখনও যে তোর পেছনে পড়ে আছে?”
“জানি না ভাইয়া। আমি একবার ‘না’ বলে দিয়েছি। আমার ‘না’ আর ‘হ্যাঁ’ হবে না।”
“বুঝি না ভাই তোদের কাহিনি। আমি তো ভেবেছিলাম গতকাল শ্রেয়ান ভাইয়া এত আয়োজন করে তোর বার্থডে সেলিব্রেশন করেছে তোকে খুশি করার জন্য। যাতে তুই ওনার প্রতি ইমপ্রেসড হোস।”
আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ এই বিরাট খবরের বিন্দুমাত্র আমার জানা ছিল না। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
“উনি বার্থডে সেলিব্রেশন করেছে মানে?”
“কেন, তুই এখনও জানিস না?”
“না তো।”
“তোর বার্থডে সেলিব্রেশন প্ল্যানিং আমরাই করছিলাম। শ্রেয়ান ভাইয়াকেও বলেছিলাম। তখন উনি আমাদের প্ল্যান বাদ দিয়ে নিজে একাই সব আয়োজন করেছেন। আমাদের শুধু সাথে রেখেছেন, আর কাকিকে দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করিয়েছেন। তখন আমাদের বলেছিলেন তোকে না জানাতে, তাই জানাইনি।”
“তাজ ভাই জানত?”
“নাহ্। তাজ ভাই তো সেলিব্রেশনের আগে জেনেছে। তোর মতো উনিও প্রথমে ভেবেছিলেন সব আমরাই করেছি। পরে তুই আসার আগে শ্রেয়ান ভাইয়া-ই ওনাকে সত্যি কথা বলে দিয়েছে। আমি আরও ভাবলাম তোর মন গলবে।”
“মন গলার মতো কিছুই হয়নি ভাইয়া।”
“তোর মতো নিরামিষদের মন গলবেও না। থাক, আমি আসি।”
“আচ্ছা।”
জুম্মান ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলল। গতকাল শ্রেয়ান ভাইয়া বার্থডে সেলিব্রেশনের আয়োজন করেছিলেন বলেই তাজ সাহেবের কোনোরকম হেলদোল ছিল না। এখন সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নই রয়ে গেছে। শ্রেয়ান ভাইয়া কবে, কখন এবং কেন তাজ ভাইয়ের কাছে মিথ্যে কথা বললেন? নানা চিন্তার মাঝে আমি গতকালের সব গিফট নিয়ে বসলাম দেখার জন্য। গতকাল ওনার ওমন আচরণের পর আর এসব ছুঁয়ে দেখাও হয়নি। সব গিফটের মাঝে আমার দৃষ্টি পড়ল বেশ বড়ো একটা বক্সের ওপর। এটা কে দিয়েছে? এটা তো গতকাল দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সবাই তো আমার হাতেই গিফট তুলে দিয়েছিল। খুব কৌতুহল নিয়ে আমি ওই বক্সটাই আগে খোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। কেন জানি মনের ভেতর খচখচ করছে। দ্রুত হাত চালিয়ে প্যাকেট খুললাম। ভেতরের জিনিসগুলো দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হলাম। দুইটা শাড়ি, চার মুঠো চুড়ি, শাড়ির সাথে মিলিয়ে দুই সেট গহনা আর তিনটা নতুন বই। ফুল প্যাকেজ। জিনিসগুলো দেখামাত্রই যেন আমি প্রেরকের নাম জেনে ফেললাম। কেউ যেন আমার কানে-কানে বলে গেল সেই নাম। জিনিসগুলো ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে সবকিছুর সাথে একটা চিরকুটও পেলাম। মন অস্থির হয়ে উঠল চিরকুটের ভেতরের কথাগুলো পড়ার জন্য। দ্রুত চোখ বুলাতে লাগলাম।

মনোহারিণী,
কে জানত এই বাক্সে মুড়ানো অনুভূতি তোমার হাতে পৌঁছানোর আগেই সেই অনুভূতি স্থানান্তর হয়ে যাবে? হয়েই যখন গেছে, তখন তো আর অনুভূতি ফিরিয়ে আনা যাবে না। অনুভূতি মনের ব্যাপার। ওসবে কারোর জোর চলে না। আমি কখনোই তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। আজ সব কথা থাক, তোমার জীবনের সুখ কামনা করি। যার জন্য বাক্স ভর্তি অনুভূতি রেখেছিলাম, তাকে সেসব না দিয়ে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। সব মূল্যবান উপহারের মাঝে এটাও না হয় রেখে দিয়ো দোষী এক মানুষের শেষ স্মৃতি হিসেবে। ভালোবাসা নিয়ে খুব বেশি ভালো থাকো আমার ছোট্ট হরিণী।
ইতি
থাক, আজ আর কিছু মনে পড়ছে না

এ চিরকুট একবারের বেশি দুবার পড়ার সাহস আমার হলো না। অবাধ্য মন আর চোখ জোড়া বাঁধ সাধল। সব বাদ দিয়ে তখনই শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম্বারে কল করলাম।
উনি রিসিভ করলেন না। পরপর তিনবার কল করার পরও উনি রিসিভ করেননি। তারপর ম্যাসেজ করলাম যে, ওনার সাথে কথা বলতে চাই। সঙ্গে-সঙ্গেই ওনার উত্তর এল।
“যা বলার ম্যাসেজেই বলো। আমি টিমের সঙ্গে আছি। জানোই তো আমরা নরসিংদী যাচ্ছি।”
ওনার এই ম্যাসেজেই জানতে পারলাম ওনারা নরসিংদী যাচ্ছেন। একসঙ্গে যখন যাচ্ছেন নিশ্চয়ই কাজেই যাচ্ছেন। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে পুনরায় ম্যাসেজ করলাম।
“আপনি তাজ ভাইকে কী বলেছেন?”
“কোন ব্যাপারে?”
“আপনার আর আমার ব্যাপারে। আপনি মিথ্যে কথা কেন বলেছেন? আপনার থেকে কখনও এমনটা আশা করিনি ভাইয়া।”
“আমার উত্তর কাজে পাবে, মুখে নয়।”
ওনার কথাটা আমার কাছে সুবিধার মনে হলো না। তবু স্বাভাবিকভাবেই লিখলাম,
“আপনার কথা, কাজ কোনোটাই আমি বুঝতে পারছি না ভাইয়া। দয়া করে বুঝিয়ে বলবেন? হঠাৎ এসবের মানে কী?”
“বুঝতে হবে না ইলোমিলো। বললাম তো সব উত্তর আমার কাজেই পেয়ে যাবে। একটু অপেক্ষা করতে হবে। এসবের জন্য আমায় বিরক্ত কোরো না। আমি ব্যস্ত আছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বলছেন ওনাকে আমি বিরক্ত করছি। বিশ্বাস করতেও যেন আপত্তি হচ্ছে। আমি আর ওনাকে একটা ম্যাসেজও করলাম না। এরপর ফোন করলাম তাজ ভাইকে। উনিও রিসিভ করলেন না। কল তো দূর, উনি ম্যাসেজের উত্তরও দেননি। ইচ্ছে করেই এমন করছেন। জানি না কবে ফিরবেন। তবে এটুকু নিশ্চিত, না ফেরা অবধি এসব উড়ে আসা ঝামেলার নিষ্পত্তি হবে না। অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(।🖤🥱)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here