মনোহরিণী পর্ব -২৫+২৬

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৫.
ভোরবেলায় আমরা সবাই ঘুম থেকে উঠে তাঁবু ছেড়ে সমুদ্র সৈকতে ছুটলাম। তখনও সূর্য ওঠেনি, তবে পূর্ব আকাশে সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি চলছে। আকাশটা এখনও ধূসর রঙে সেজে আছে। চারদিকে আধো আলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সূর্যোদয়ের সাথে গোটা পৃথিবী আলোকিত হবে। পাশের ঝাউবন আপন ছন্দে দুলে সকালের পরিবেশে শীতলতা ছড়াচ্ছে। শীতল হাওয়া এসে আমাদের শরীরে লাগছে। উচ্ছল সমুদ্রটা একদম শান্ত, যেন চঞ্চলা ঝুপ করে শান্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মাঝে-মাঝে মৃদুমন্দ ঢেউ উঠছে। জুতা খুলে রেখে আমরা খালি পায়ে বালুকাময় সৈকতে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। তীরে অসংখ্য মরা শামুক পড়ে আছে। তার সাথে আছে ঝিনুক আর নুড়ি পাথর। আমরা সেখান থেকে কিছু কুড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই পূর্ব আকাশে লালচে আভা দেখা গেল। আমরা দারুণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধীরে-ধীরে লালচে আভা গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হতে লাগল। গোটা ধূসর আকাশ নানান রঙে সেজে উঠল। পূর্ব আকাশে সূর্যটা ঘোমটা তুলে উঁকি দিলো। যেন সমুদ্রের অপর প্রান্ত থেকে মস্ত বড়ো এক গোলাকার লাল বৃত্ত আকাশে উড়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ডান দিক থেকে এক ঝাঁক পাখি উড়তে-উড়তে বাঁ দিকে চলে গেল। বোধ হয় তারাও আমাদের মতো সূর্যোদয় উপভোগ করতে নেমেছে। আমি চোখ বন্ধ করে এই স্নিগ্ধ সকালের মনোরম পরিবেশটা অনুভব করলাম। জুম্মান ভাইয়া ক্যামেরায় ছবি টুকে নিচ্ছে আর বকছে,
“এমন অসাধারণ পরিবেশে যদি পাশে বউই না থাকে, তাহলে কী লাভ এসব উপভোগ করে? সিঙ্গেলদের জন্য এসব পানসে।”
সৌরভ ভাইয়া উত্তর দিলেন,
“সিঙ্গেলদের জন্য না, বলো যাদের মাথায় বউয়ের ভূত থাকে তাদের জন্য পানসে। আমরা তো ভীষণ এনজয় করছি। সমস্যা তোমার একার।”
“তুই চুপ কর জলহস্তী। তোকে জিজ্ঞেস করেছি? তোর আবার বউ লাগে? ফোনটার সাথেই তুই সারাজীবন কা’টিয়ে দিবি।”
“হুঁ, উচিত কথা বললেই আমার ফোনের পেছনে লাগো।”
“ত্যাড়ামি না করে রাজ ভাইকে জিজ্ঞেস কর। তার কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে খেয়ে না খেয়ে আজীবন এই দ্বীপে পড়ে থাকতে। কারণ তার পাশে একটা সুন্দরী বউ আছে। জিজ্ঞেস কর, জিজ্ঞেস কর।”
বালুকাময় সৈকতে আরও এক চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম। তা হচ্ছে লাল কাঁকড়া। সূর্য উঠতেই সারা সৈকত জুড়ে লাল কাঁকড়ার বিচরণ শুরু হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র সৈকত জুড়ে কেউ নিজ হাতে লাল টুকটুকে ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই লাল কাঁকড়ার বিচরণ সকালের সৈকতটা আরও বেশি মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। আনহা আপু একটা কাঁকড়া তুলে জুম্মান ভাইয়ার গায়ে ছেড়ে দিলো। জুম্মান ভাইয়া লাফিয়ে উঠল। আনহা আপু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বাচাল লোকদের এভাবেই থামাতে হয়।”
জুম্মান ভাইয়া তেড়ে এসে দুটো কাঁকড়া তুলে ছেড়ে দিলেন আনহা আপুর মাথায়। আনহা আপুও তার মতো লাফিয়ে উঠল। জুম্মান ভাইয়া হেসে বলল,
“নে, এবার সুন্দর করে নাচ। এই আমি গান ধরলাম।
ভালো কইরা জ্বালাও গো কাঁকড়া, সুন্দরী কমলা নাচে।”
পূর্ব পাড়া থেকে এক পাল মহিষ সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পশ্চিম পাড়ার দিকে যেতে দেখা গেল। এই দ্বীপে বা’ঘ, হরিণের বদলে মহিষের বিচরণ দেখা যায়। সারারাত সমুদ্রের মাঝে বিচরণ করা জেলে নৌকাগুলো তীর ঘেঁষে ফিরে যাচ্ছে। তাদের থেকে বড়ো কয়েকটা মাছ রাখল রাজ ভাই। ফ্রেশ হয়ে সবাই লেগে পড়ল মাছগুলো দিয়ে বারবিকিউ করতে। মাছের আঁশ ছাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে তাতে মসলা মাখানো হলো। শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে গতকালের করা গর্তেই আবার আগুন জ্বা’লিয়ে মাছ বসানো হলো। কেমন অ্যাডভেঞ্চার ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই অচেনা দ্বীপে নিজেদের খাবার নিজেদেরকেই জোগাড় করে নিতে হয়। সমুদ্রের পানি তখন সূর্যের রশ্মি‌ পড়ে চিকচিক করছে। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। আমি কিছুটা দূরের ফুলে ভর্তি গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। কত সুন্দর রঙিন ফুল! এই গোটা দ্বীপটাই এক আস্ত সৌন্দর্যের চাদরে ঢাকা। সবকিছুতেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া। আমি ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। ফোনে কয়েকটা ছবি তুলে রাখতে লেগে পড়লাম। পেছনে শ্রেয়ান ভাইয়া কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। হুট করে সে বলে উঠল,
“ফুলগুলো খুব সুন্দর, তাই না?”
আমি ফিরে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হেসে মাথা ঝাঁকালাম। উনি এগিয়ে এসে হাতের ক্যামেরায় একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“ফুলগুলো তোমার মতো সুন্দর ইলোমিলো। ছবিটা দেখো, এক ফুল অন্য ফুলের ছবি তুলছে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।”
আমি যখন মনোযোগ দিয়ে ফুলগুলোর ছবি তুলেছিলাম, তখন হয়তো উনি এসে ছবিটা তুলে ফেলেছেন। ছবিটা আমার ভীষণ পছন্দ হলেও, ওনার সব কথাতেই কেমন ইতস্তত বোধ করলাম। বারবার গতকালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এতদিন ধরে ওনাকে সিনিয়র হিসেবে বেশ লাগত। বন্ধুসুলভ মানসিকতা ওনার। ওনার সাথে কথা বলতে বেশ লাগত। কিন্তু ওনার মনে যে অন্যকিছু ছিল, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করা যায়নি। কেন জানি আমার মনে হলো তাজ ভাই আঁচ করেছিলেন। এ কারণেই হয়তো উনি শ্রেয়ান ভাইয়ার ধারেকাছে গেলে খেপে যেতেন। শ্রেয়ান ভাইয়া ফুলগুলোর দিকে ক্যামেরা তাক করে বললেন,
“আমাকে যে তুমি এতটা অপছন্দ করো, তা তো জানতাম না ইলোমিলো।”
“এসব কী বলছেন ভাইয়া? অপছন্দ কেন করব?”
“তাহলে আমি মানুষ হিসেবে খারাপ, না দেখতে খারাপ?”
“কোনোটাই না।”
“তবে রিজেক্ট করার কারণ?”
আমি চুপ মে’রে গেলাম। ওনার সামনে থেকে সরে যেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এতে হয়তো উনি মনে-মনে অসন্তুষ্ট হবেন। একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমি মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইছি না। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমি নিজের জন্য তোমাকে পছন্দ করেছিলাম। আর তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছে, তাই ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ফিরিয়ে দিবে না। সেজন্য জানতে ইচ্ছে করছে কেন ফিরিয়ে দিলে। আচ্ছা তুমি সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখবে? আমাকে যতদিন বলবে ততদিন অপেক্ষা করব।”
“না ভাইয়া।”
“কেন? কোনো সমস্যা হলে বলো আমাকে। তোমার ফ্যামিলি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। না কি তোমার নিজের কোনো পছন্দ আছে?”
এ কোন বিপদে পড়লাম রে বাবা! না পারছি ভালোভাবে কথার উত্তর দিতে, না পারছি চলে যেতে। মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করতেই আবির্ভাব ঘটল তাজ ভাইয়ের। এদিকে আসতে-আসতে অদূর থেকেই শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললেন,
“চিপায় কী কাজ ভায়া?”
শ্রেয়ান ভাইয়া এগিয়ে যেতে-যেতে বললেন,
“আর চিপা! খোলা মাঠেই কাজ হয় না।”
তাজ ভাই মৃদু হেসে বললেন,
“এসব ব’লদের বংশধর দিয়ে তোর কাজ নেই। আই থিংক ন্যান্সি ইজ বেটার ফর ইউ।”
“তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? কোথায় যাকে পছন্দ করেছি তাকে পটিয়ে দিবি, তা না করে বিদেশিনী সাজেস্ট করছিস। পারলে একজনকে পটিয়ে দে।”
বকতে-বকতে শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেল। তাজ ভাই আমার কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন,
“বলদ, গাধাও দেখছি আজকাল সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে প্রেমিকের আনাগোনা।”
আমি উত্তর দিলাম,
“উঠতে-বসতে যে সুন্দরী মেয়েদের পটিয়ে পা’গল করে ফেলে, সে বাদে অন্য কারো আবার সেলিব্রিটি হওয়ার উপায় আছে?”
“তোদের মেয়ে জাতিটাই পা’গল। আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছে তো সেখানেই কুপোকাত।”
বলতে-বলতে উনি সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি পিছু নিয়ে প্রতিবাদ করলাম,
“আপনাদের পুরুষ জাতি খুব সাধু বুঝি? যত সুন্দরী মেয়েদের দেখে, তাদের সবই লাগে। আর আপনার মতো পুরুষদের জন্য সবাই কুপোকাত হয় না। আপনাদের তো ব্যক্তিত্বের চেয়ে ওভার কনফিডেন্স বেশি।”
“আমার মতো পুরুষের ওভার কনফিডেন্সেরও ক্ষমতা আছে। কারণ আমি তোর মতো মাথামোটা নই।”
“ঘোড়ার ডিম আছে। নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবে,” মুখ বাঁকিয়ে বললাম আমি।
“প্রমাণ চাই?”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,
“এই ফাঁকা দ্বীপে আপনার সুন্দরী রমণীরা নেই। তাই প্রমাণ দেখাতে চেয়েও লাভ নেই।”
“দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের মুখের কথা প্রমাণ করার জন্য এই ফাঁকা দ্বীপও যথেষ্ট।”
“দিন-দিন আপনার চাপাবাজির মাত্রা আকাশ ছুঁয়ে চলেছে। এত চাপাবাজি টিকিয়ে রাখা মুশকিল দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ সাহেব।”
কথাটা বলার সাথে-সাথেই উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে আমিও থামলাম। কিন্তু হুট করেই এমন এক কান্ড ঘটে গেল যে, আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য পুরোদস্তুর আহাম্মক বনে গেলাম। উনি ঘুরে দাঁড়িয়েই চোখের পলকে আমার দুই বাহু ধরে কাছে টেনে দাঁড় করালেন। কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে আমি রুদ্ধশ্বাসে বিস্মিত দৃষ্টিতে ওনার চোখের দিকে তাকালাম। উনি পলকহীন গভীর চোখে তাকিয়ে কেমন মোলায়েম গলায় বললেন,
“শ্রেয়ানকে রিজেক্ট করলে কার জন্য ইলুপাখি? দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ সাহেবের জন্য, যে তোমার চোখে আজন্মের দোষী?”
আমি কোনোমতে ঠোঁট নেড়ে বললাম,
“কে বলল?”
উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। আরও কিছুটা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“ভালোবাসারা।”
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বাঁ হাতটা আমার ডান গালে রাখলেন। কনিষ্ঠ আঙুলে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন ডান গালের তিল। অন্যরকম এক অনুভূতিতে আমি শিউরে উঠলাম। শুষ্ক কন্ঠনালি দিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম,
“সরুন।”
উনি এবার দুহাতে আমার মুখ তুলে ধরলেন। চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বললেন,
“ইলুপাখি, আমি তোমায়-”
উনি থেমে যেতেই আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। শেষ শব্দটা শোনার জন্য ভেতরটা বড্ড অস্থির হয়ে উঠল। অস্থিরতায় আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। উনি আগেরবারের চেয়েও অধিক চমকে দিয়ে হঠাৎ আমার মাথায় সজোরে এক গাট্টা মে’রে বলে উঠলেন,
“আমি তোমায় এভাবেই কুপোকাত করলাম। দেখলি তো আমার ওভার কনফিডেন্সের কেমন ক্ষমতা?”
আমি যেন এর চেয়ে বড়ো ছ্যাঁ’কা আগে খাইনি। অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি হুঁ-হা করে হাসতে শুরু করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন,
“তোর এই এক্সপ্রেশনটা দারুণ। এভাবেই দাঁড়া, একটা ছবি তুলে রাখি। পরে যখনই তাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবি, তখনই এই মুহূর্তের কথা মনে পড়বে।”
উনি ফোন বের করতেই আমার রাগ আকাশ ছুঁল। ঘুরে দাঁড়িয়ে উলটো পথে হাঁটা দিলাম। কিন্তু তাঁবুতে ফিরে যেতে পারলাম না। উনি ছুটে এসে আমার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চললেন। প্রথমে আমি জেদ দেখালেও, তা ধোপে টিকল না। গাল ফুলিয়ে সারা পথ বিনা বাক্যে হেঁটেছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা-ও জানতে চাইনি। হাঁটতে-হাঁটতে পা ধরে যাওয়ার জোগাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অদূরে জনবসতির চিহ্ন দেখতে পেলাম। তারপর যখন ছোটো একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন ভাবলাম হয়তো কিছু কেনার জন্য এসেছে। কিন্তু এবারেও আমাকে ভুল প্রমাণ করে উনি দুটো চায়ের অর্ডার দিলেন। টংয়ের দোকানে চা খেতে-খেতে আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। এই দ্বীপে এখনও বাজার গড়ে ওঠেনি। ছোটো-ছোটো মুদি দোকানের ওপরই এখানকার মানুষ নির্ভরশীল। এখানকার চায়ের স্বাদ যে ভোলার মতো না, তা খেতে গিয়েই টের পেলাম। দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও, খাওয়ার দিকে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এই চা-টা টেস্ট করা ছাড়াও, আমার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়া হয়নি। এরপর দেখা যেত সারাদিন মাথার য’ন্ত্রণায় অতিষ্ট হতে হত, আর গোটা দিনটাই মাটি হয়ে যেত। সকালের শুরুতে চায়ে অভ্যস্ত মানুষের এই দিক থেকে য’ন্ত্রণার অন্ত নেই। অন্য সময় হলে মহাশয়কে বড়োসড়ো এক ধন্যবাদ জানাতাম। কিন্তু এখন জানাব না। এসব পা’জি লোকের ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার নেই। চুপচাপ চা শেষ করে চারদিকে একটু ঘুরেফিরে আমরা আবার ফিরতি পথে হাঁটা দিলাম। এবার উনি নিজেই আগে কথা বললেন।
“মাথার ব্যারামের রোগীকে চা খাইয়ে তরতাজা করতে এতদূর নিয়ে এলাম, যাতে আমাদের এত সুন্দর ভ্রমণটার বারোটা না বাজে। ভালোয়-ভালোয় চায়ের বিলটা যেন ফেরত পাই। সুবিধাবাদী নারী জাতির পেছনে আমি কষ্টের উপার্জনের টাকা খরচ করি না।”
আমি রুক্ষ কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলাম,
“আমি কাউকে বলিনি এত দয়া দেখিয়ে চা খাওয়াতে। আর কেউ আমায় বলেওনি এতদূর কেন এসেছে। কারো কষ্টের উপার্জনের টাকা খরচ করার শখও আমার নেই।”
“দুদিন পর তো ঠিকই কোনো এক গোবেচারার ঘাড়ে বসে খাবি আর টাকা উড়াবি। এজন্যই আমি কোনো ফেরিওয়ালার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছি। এবার দেখছি তা-ই করতে হবে।”
“আমাকে নিয়ে কারো মাথা না ঘামালেও চলবে।”
“আমার মাথাটা আবার ডিটেকটিভিটির উপাদানে তৈরি তো। তাই সব জায়গায় নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ে। কোনো বাঁধা নেই।”
তাঁবুর কাছাকাছি আসতেই উনি হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে একটা হলুদ ফুল তুলে আমার কানের পাশে গুঁজে দিলেন। আমি তাকাতেই বলে উঠলেন,
“আকাঙ্ক্ষিত ওই শব্দটা বড়ো ভয়া’নক ইলুরানি। তোমার ব্যাকুলতা বাড়াবে বই কমাবে না। অনুভবে সন্তুষ্ট থাকো।”
তারপর আমাকে রেখেই বড়ো-বড়ো পা ফেলে তাঁবুর কাছে চলে গেল। আমি আস্তে-ধীরে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে পৌঁছে দেখলাম আদনান ভাইয়ার আনা বল দিয়ে বালির মধ্যে ফুলবল খেলা চলছে। দু-এক জন আবার পাশের গাছের সাথে দোলনা টাঙিয়ে দোল খাচ্ছে। আমিরা আপু তাজ ভাইকে বলছে,
“একজনকে একা চা খেতে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হলো তাজ ভাই? আমরা বুঝি ভেসে এসেছি? তা-ও শুধু রাজ ভাইকে বলে আমাদের ফাঁকি দিয়ে গেলেন।”
তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“ট্যুরটা সুস্থ রাখতে আমি শুধু রোগীকে তার ঔষধ সেবন করাতে নিয়ে গিয়েছি। এখানে আরও রোগী আছে বলে আমার জানা ছিল না।”
বারবিকিউ নামিয়ে রেখেই সবাই খেলছিল। আমরা ফেরার পর হাত-পা ধুয়ে খেতে বসা হলো। তাজ ভাই দোকান থেকে কিছু-কিছু হালকা খাবার কিনে এনেছেন। বারবিকিউর সাথে সেগুলো আর আমাদের আনা শশা, টমেটো দিয়ে সালাদ বানিয়ে নাস্তা প্রস্তুত করা হলো। জম্পেশ আড্ডার সাথে সকালে নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য দুপুরের আগ পর্যন্ত সোনাদিয়া দ্বীপ চষে বেড়ানো। মাথায় টুপি চাপিয়ে রোদকে পরাস্ত করে আমরা সবুজ তৃণমূল মাড়িয়ে হেঁটে চললাম সোনাদিয়ার বুকে। প্রতিবারই যেন নতুন করে মুগ্ধ করে এই অপরূপ সোনাদিয়া। এই দ্বীপে পর্যটকদের জন্য একটি কচ্ছপের হ্যাচারি তৈরি করা আছে। আমরা হ্যাচারি পরিদর্শন করলাম। ডাব কিনে ডাবের পানি খেলাম। চারদিক চষে বেড়িয়ে শেষে ক্লান্ত হয়ে সবাই বালিতেই বসে পড়লাম। সেখানেও আমাদের মাঝে যেন শৈশব ভর করল। বালি দিয়ে এটা-ওটা বানালাম, আঁকিবুঁকি করলাম। মোটকথা সবাই বালিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম। এতে আমাদের দারুণ আনন্দ ছিল। তারপর আমরা আজ আবার দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো সোনাদিয়ার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টলটলে নীল পানির শীতলতায় শরীর, মন পরিছন্ন করলাম। তারপর চলল আমাদের সমস্ত কিছু গুটিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। নিজেরা তৈরি হয়ে তাঁবু তুলে আমরা পশ্চিম পাড়া ছাড়লাম। পথে আরও একদল পর্যটকের সাথেও আমাদের সাক্ষাৎ হলো। তারা আজই সোনাদিয়ায় পা রেখেছে। এবারেও আমরা সিদ্ধান্ত মতো গতদিনের সেই বাড়িতেই উঠলাম। আজকে দুপুরের ভোজের ব্যবস্থাও এখানেই হয়েছে। আজকের খাবারে ছিল ভাতের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছের আইটেম। খাবার দেখেই যেন অর্ধেক ভোজন হয়ে গেল। একেক আইটেমের একেক রকম স্বাদ। রান্নারও প্রশংসা করতে হয় বটে! পেটের সাথে মনও তৃপ্ত হলো। তারপর এল আমাদের ফেরার পালা। পিপাসু মন এই অপরূপ সৌন্দর্যকে যেন ছাড়তেও চাইছিল না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। এবার আর কক্সবাজারে থেমে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কক্সবাজার থেকে বাস ধরে সোজাসুজি ঢাকায় ফেরা হবে। স্পীড বোটে চড়ে সোনাদিয়া ছাড়তে হবে। দুরুদুরু বুকে আমি ভরসাযোগ্য মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে নীল সমুদ্রে ভেসে চলে সোনাদিয়াকে বিদায় জানালাম। স্পীড বোট এগোনোর সাথে-সাথে চিরহরিৎ, নয়নাভিরাম সোনাদিয়া আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৬.
সময়গুলো চোখের পলকে পার হয়ে যায়। সোনাদিয়া থেকে ফিরে আবার সেই নিয়মমাফিক জীবনে ফিরতে হয়েছে। কোথাও আট’কে থাকার যে উপায় নেই। তবু মাঝে-মাঝে সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমণটা ভীষণভাবে অনুভব করি। ইচ্ছে করে আবার ছুটে যেতে সেই নীল, সবুজের রাজ্যে। কিন্তু চাইলেই তো আর আমাদের জীবনের নিয়ম থেকে নিস্তার মেলে না। সোনাদিয়া থেকে ফেরার প্রায় মাস খানেক পেরিয়ে গেছে। তারপর শুধু বাসা থেকে ভার্সিটি, ভার্সিটি থেকে বাসা। এছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। আজ ছুটির দিন। আম্মির স্পেশাল রান্নার দিন। আমি আগেভাগেই নিজের ইচ্ছেমতো কোনো আইটেমের কথা বলার জন্য ছুটলাম। রান্নাঘরে গিয়ে আম্মিকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আম্মি, আজ কী ডিশ হবে?”
“আজ না কি জেনিফার রান্না করবে। মেয়েটা নিজেই জোরাজুরি করছে। তাই তাজ বলল আজ রোস্ট, কাবাব করতে।”
আপদ আগেই বলে ফেলেছে। ধুর! আমি হতাশ হলেও জেনিফার ভাবি আজ প্রথম রান্না করবে শুনে খুশি হলাম। বললাম,
“যাক, আজ ভাবির হাতের রান্না খাওয়া যাবে।”
জেনিফার ভাবি বলে উঠলেন,
“ভাবি কিন্তু আগেও খাওয়াতে চেয়েছে। আম্মিই দেয়নি।”
আম্মি বলল,
“আমি থাকতে তুমি কেন রান্না করবে? যখন আমি পারব না, তখন করবে।”
আমি বললাম,
“ভাবি, তুমি কি লাকি দেখেছ? এমন শ্বাশুড়ি কজন পায়?”
ভাবি প্রশস্ত হেসে বলল,
“তোমার কপালেও যেন এমন শ্বাশুড়ি জোটে।”
আমি মেকি হাসলাম। আম্মি বলে বসল,
“ইলোর শ্বাশুড়ি আমিই খুঁজে দিবো, চিন্তা নেই।”
আমি প্লাস্টিক মার্কা হাসি মুখে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মন বলছে, শুধু-শুধু হারিকেন ভেঙে কী লাভ আম্মি? কিন্তু প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম,
“আমি কোনো হেল্প করব?”
জেনিফার ভাবি উত্তর দিলেন,
“লাগবে না। আমি পারব। আর আম্মি তো আছেই।”
আমি ভাবলাম আজ ছুটির দিনে গতকালের বইটা শেষ করে ফেলব। কিন্তু তার আগে বুক শেলফটা পরিষ্কার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কোনোমতে অলসতা কা’টিয়ে শুকনো কাপড় নিয়ে এলাম। বুক শেলফ পরিষ্কার করার জন্য প্রাপ্ত সেই হ্যান্ড রাইটিং করা কাপড়টা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। সুন্দর কাপড়টা ময়লা লাগিয়ে নষ্ট করতে ইচ্ছে হয়নি। একে-একে বই নামানো ধরতেই আম্মি রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বলল,
“কী করছ তুমি? রাখো ওসব। কুলসুম করে দিবে।”
সঙ্গে-সঙ্গেই কুলসুম আপা ছুটে এলেন। বললেন,
“আফা, দেন আমি কইরা দিতাছি। আমারে ডাকলেই তো হইত।”
“না, আমিই করব। আপনি নিজের কাজে যান।”
কুলসুম আপা নিচু স্বরে বললেন,
“আফা, একখান কথা কই?”
“আপনি আবার কবে একখান কথা বলতে পারেন? একখানের জায়গায় তো দশখান বলে বসে থাকেন। বলুন।”
“আপনে সবসময় এই বইয়ের তাক নিজে পরিস্কার করেন ক্যান? আমারে করতে দিলে তো আমি আরও তাড়াতাড়ি করতে পারি।”
আমি হাসলাম। দিবো কীভাবে? এই গোটা শেলফের দায়িত্ব তো আমার একার।
“বইয়ের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে নেই, বুঝলেন কুলসুম আপা?”
“ক্যান? আমি কি খাইয়া ফালামু, না চু’রি করমু? আমি তো জীবনে ইস্কুলের বারান্দায়ও যাইনাই।”
“উঁহু, ওসব কিছু না। বইপ্রেমীদের কাছে তাদের একেকটা বই খুব দামী হয়। তাই বই নষ্ট হলে তাদের কষ্ট লাগে। অন্য কারো হাতে নষ্ট হলে আরও বেশি খারাপ লাগে। তাছাড়া নিজের বইয়ের যত্ন নিজে করার মাঝে অন্যরকম আনন্দ থাকে। এতে পুরোনো বইগুলোও ছুঁয়ে দেখা হয়।”
কুলসুম আপা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“এইবার বুঝছি। আপনে কী সুন্দর কইরা কইলেন! আমি যদি পড়তে পারতাম, তাইলে ঠিকই বই পড়তাম।”
শেলফের একপাশ পরিষ্কার করে অন্যপাশ করার সময় তাজ ভাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লেন,
“আম্মি, কফি পাওয়া যাবে?”
আম্মি উত্তর দিলেন,
“দিচ্ছি বাবা। একটু অপেক্ষা করো।”
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম হাতে কফি মগ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বদ লোকের মাথায় তো বাঁদর ঘাপটি মে’রে বসে থাকে চব্বিশ ঘন্টা। শেলফের পাশ ঘেঁষে গিয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন। তারপর আমার খেয়াল হলো ওপাশটায় দুই তাকে কফির গুঁড়া ছিটিয়ে পড়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। হাতের মুঠোয় কফি নিয়ে এসেছিল? আশ্চর্য! এ কেমন বাচ্চামি? হাতের কাপড়টা দিয়ে তাক থেকে গুঁড়া কফি পরিষ্কার করলাম। কিন্তু কফির গুঁড়া কাপড় থেকে ঝেড়ে ফেললাম না। কাপড়টা মুঠোয় নিয়ে হনহনিয়ে ওনার রুমে ঢুকলাম। মহারাজ খাটে হেলান দিয়ে দিব্যি কফি পান করছেন। আমাকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। যেন এখানে মানুষ না, অদৃশ্য পে’ত্মী এসে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে গিয়ে আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এটা কোন ধরনের অকাজ? আমি কষ্ট করে শেলফটা পরিষ্কার করছি না? আপনি আমার পরিষ্কার করা জায়গায় ইচ্ছে করে কফি ফেললেন কেন?”
ওনার যেন গায়েই লাগল না। ভাবলেশহীন মুখে আমাকেই উলটো প্রশ্ন করলেন,
“প্রমাণ আছে?”
আমি হাতের কাপড়টা দেখিয়ে বললাম,
“এসব কী?”
“আমি ফেলেছি তার কী প্রমাণ আছে?”
“আমাকে আপনার অন্ধ মনে হয়?”
“তুই তো এমনিতেও হাফ অন্ধ। তা তুই নিজের হাফ অন্ধ চোখ দিয়ে দেখেছিস আমি কফি ফেলেছি?”
“না দেখলে কি বুঝা যায় না? আপনি রুমে আসার সময় শেলফের পাশ দিয়ে আসেননি? না কি আপনার প্রেতা’ত্মা এসেছিল?”
“আমি আন্দাজে বিশ্বাসী না, প্রমাণে বিশ্বাসী। আপনি আসতে পারেন।”
আমি চরম বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আপনাকে এখানে ডিটেকটিভিটি করতে বলেছি? নিজের দোষ ঢাকার তো খুব ভালো পদ্ধতি জানেন। মাথার ভেতর কয়টা শয়তান নিয়ে ঘোরেন?”
“ওসব তোর ফাঁকা মাথায় জায়গা পেলে পেতে পারে। আমার মাথায় ওসব রাখার জায়গা নেই। আমার মাথা যে একদম পিওর জ্ঞানবুদ্ধি আর সততায় ঠাসা, তা জাতি জানে।”
“ঘোড়ার ডিম জানে। আপনার মতো নিজের ঢোল নিজে বাজানো মানুষ আমি দুটো দেখিনি।”
“দেখবি কী করে? এই সিম্পল ব্যাপারটাও ধরতে পারছিস না? মাথামোটা। পৃথিবী জুড়ে বহু তাজ পাবি, কিন্তু ইউনিক তাজ এই একটাই। তার কোনো বিকল্প হয় না। বুঝেছিস? না বুঝলে গিয়ে আমিরাকে জিজ্ঞেস করতে পারিস। গড়গড় করে বলে দিবে। আফটার অল, তাজ দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ।”
ওনার আজাইরা চাপাবাজি আর ভাব দেখে গা জ্বলে উঠল। আমার কাজের মধ্যে অকাজ করে আবার নিজেই নিজেকে ভূখণ্ডের মহারাজা ভাবছে। রাগে আমি হাতের ময়লা কাপড়টা ওনার মাথায় ছুঁড়ে মে’রে বলে উঠলাম,
“ফালতু অ’হংকার। বলুন তাজ দ্য গ্রেট বদের হাড্ডি। ”
আমায় আর পায় কে? সা’পের গর্তে ঢুকে সা’পের লেজেই পা দিয়েছি, কখন না ফোঁস করে ওঠে। তাই আগেভাগেই কে’টে পড়লাম। ভাগ্যিস আমার পিছু নেয়নি। নয়তো বুক শেলফ পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতেও পারতাম না। কিন্তু দুপুরে খেতে গিয়ে পড়লাম ফ্যাসাদে। তাজ ভাই এলেন সবার শেষে। এসে আমার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে তাড়া দেখালেন, ক্ষুধায় তার পেট জ্বলে যাচ্ছে। আমি সবেমাত্রই খাবারে হাত দিয়েছি। আম্মি খাবার দেওয়া পর্যন্ত যেন ওনার ধৈর্য সইলো না। সামনে থেকে আমার প্লেট টেনে নিয়ে গেল। আমি কিছু বলার আগে খেতেও আরম্ভ করে দিলো। আম্মি বলল,
“একি! ওরটা নিলি কেন? ও তো খাওয়া শুরু করছিল।”
উনি ত্যাড়াভাবে উত্তর দিলেন,
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে, নিয়েছি। আমারটা ওকে দিয়ে দাও, তাহলেই তো হয়।”
সবার সামনে কিছু বলতে না পেরে আমি গাল ফুলিয়ে আড়চোখে তাকালাম। আম্মি ওনার জন্য তোলা খাবারটা আমাকে দিয়ে দিলো।
নূর আঙ্কেল তাজ ভাইকে বললেন,
“তাই বলে সামনে থেকে খাবার নিয়ে নিবি? তোর এই পাজি স্বভাব কবে যাবে বল তো?”
উনি জবাব দিলেন,
“শ্বশুর হলে।”
টেবিলের সবাই হেসে উঠল। জেনিফার ভাবি বললেন,
“তোমার নিজেরই এখনও শ্বশুর হলো না, আর তুমি এখনই শ্বশুর হওয়ার কথা বলছ?”
“এখনকার কথা কে বলেছি? যখন হব তখন।”
আম্মি প্রশ্ন করল,
“তো এখন কি তোমার শ্বশুর চাই না কি?”
তাজ ভাই পালটা প্রশ্ন করল,
“বাজিয়ে দেখছ?”
“বাজিয়ে দেখার কী আছে? রাজ বিয়ে করে ফেলেছে। তোরও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বাবা আছেই আর দুই মাস। এরমধ্যে যদি তোর বিয়েও দেখে যেতে পারে, তাহলে তো খারাপ হয় না।”
“এমনভাবে বলছ, যেন বাবা এবার সৌদি গিয়ে আরেক বিয়ে করে স্থায়ীভাবে সংসার পেতে বসবে। আর দেশে ফিরে ছেলের বিয়ে দেখতে পারবে না।”
আম্মি চোখ রাঙিয়ে বলল,
“বাবার সামনে এসব কেমন কথা তাজ?”
উনি নূর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাবা, ভুল বলেছি?”
আঙ্কেল হেসে বললেন,
“আমার ছেলে ভুল বলবে? কিন্তু বাপ, বিয়ে নিয়ে তোর কী চিন্তা-ভাবনা?”
“কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তোমার ছেলে বুদ্ধিমান পুরুষ, বুঝলে বাবা? বুদ্ধিমান পুরুষ এত তাড়াতাড়ি নারী জাতিকে ঘাড়ে ঝুলায় না। তারপর দেখা যাবে কদিন পর ঘাড়টাই উধাও।”
আম্মি প্রতিবাদ করে উঠল,
“ইঙ্গিতে আমাদের অপমান করা হচ্ছে?”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
“একদম না আম্মি। আমি এ যুগের ইয়াং জেনারেশনের কথা বলেছি। তোমাদের যুগে তো এ যুগের মতো ধান্দাবাজ নারী জাতি ছিল না। এ যুগের নারী হচ্ছে একেকটা ঘষেটি বেগমের কার্বন কপি।”
আমি এতক্ষণ চুপ থাকলেও, এবারের কথাটা গায়ে লাগল। নূর আঙ্কেলের সামনে গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে না পেরে কৌশলে জেনিফার ভাবিকে উস্কে দিলাম।
“ভাবিও কিন্তু এ যুগের নারী।”
সঙ্গে-সঙ্গে ভাবি বলে উঠল,
“এটা কিন্তু আমি মানব না। আমি মোটেও ঘষেটি বেগমের কার্বন কপি নই, তা সবাই জানে। তোমার এ দোষারোপ ভুল। আম্মি, তোমার ছেলে কিন্তু আমাকেও অপমান করল।”
আম্মি বলল,
“ঠিকই তো। আমার বৌমা আর মেয়ে একদমই ওমন না। তোর এই দোষারোপ বাইরে ফলাবি।”
উনি সকৌতুকে বললেন,
“বুঝি আম্মি। তুমি নারী বলে অন্যদের সাপোর্ট করছ। কিন্তু এদের ভেতরের রহস্য তোমার অজানা।”
সুযোগ বুঝে আমি বলে বসলাম,
“আপনি জাতীয় সিঙ্গেল পুরুষ হয়ে নারী জাতির রহস্য জানেন কীভাবে?”
“কারণ আমি ডিটেকটিভ, মাথামোটা নই।”
কথায়-কথায় এক সুর পেয়েছে। ডিটেকটিভ। ঘোড়ার ডিম। যেন এই আজাইরা অ’হংকা’র দেখানোর জন্যই ডিটেকটিভ হয়েছে।
বিকেলে ভাবলাম অবসর সময়টা গতকালের বইটা পড়ে শেষ করব। কিন্তু শেলফ ঘেঁটে বইটা পেলাম না। বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না বই কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছে। শুনেছি তাজ ভাই বেরোবেন। দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে। আমি চুপচাপ গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। উনি যাননি এখনও, রেডি হচ্ছেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন। একবার ভাবলাম উনি যাওয়ার পর এসে বই নিয়ে যাব। আবার কী ভেবে ওনাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে খুব সাবধানে ভেতরে পা বাড়ালাম। নিচু হয়ে পা টিপে হেঁটে নিঃশব্দে খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। সতর্ক দৃষ্টিতে ওনার গতিবিধি খেয়াল করে বালিশ সরাতেই বই পেয়ে গেলাম। বইটা নিয়ে যেভাবে এসেছি, সেভাবেই চলে যাওয়া ধরলাম। কিন্তু হুট করে চোখের পলকে উনি যেন রকেটের গতিতে এসে পেছন থেকে আমার চুল টেনে ধরলেন। চুলে টান পড়তেই আমি দাঁড়িয়ে পড়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম। উনি বললেন,
“আবারও আমার ঘরে চু’রি?”
আমি চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
“আমি বই নিতে এসেছি। ব্যথা পাচ্ছি, ছাড়ুন।”
উনি চুলগুলো হাতের সাথে আরও পেঁচিয়ে নিয়ে বললেন,
“চোরের মতো করে বই নিতে এসেছিস? ধান্দা কী ছিল?”
যেচে চুলে এত বেশি ব্যথা দেওয়ায় মেজাজ গরম হয়ে গেল। রাগত স্বরে বললাম,
“তাজ ভাই, চুল ছাড়ুন। এসব কোন ধরনের আচরণ? ইচ্ছে করে ব্যথা দিচ্ছেন কোন সুখে? আমি বই নিতে এসেছি, আপনার অমূল্য সম্পদ না।”
“আমার অমূল্য সম্পদ নেওয়ার সাধ্য তো তোর নেই। তোর যা সাধ্য আছে তা হচ্ছে, আমার অমূল্য সম্পদের খেয়াল রাখা।”
কথাটা বলেই উনি চুল ছেড়ে দিলেন ঠিকই, কিন্তু সাথে আমার হাতের বইটাও কেড়ে নিলেন। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে গোমড়া মুখে বললাম,
“বই দিন। আমার পড়া শেষ হয়নি।”
উনি বইটা নাড়াচাড়া করতে-করতে বললেন,
“দিতে পারি, যদি তুই তোর ফালতু চা করে খাওয়াস। ভাবিস না সাধ করে খেতে চাইছি। মাথা ধরছে বোধ হয়।”
আমাকে এত জ্বালিয়ে, আবার আমার হাতেরই চা খাওয়ার ইচ্ছে। তা-ও আবার আমার চাকে ফালতু চা বলা হচ্ছে। ব্যাটা হাঁড়ে ব’জ্জাত। তোমায় চা না, গালে জোরেশোরে চাপ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি ভালো মানুষ। বেয়াদবি করব না। প্রত্যুত্তরে শক্ত মুখে বললাম,
“নিজে করে খান। আমার চাকে অপমান করে আবার তা-ই খেতে লজ্জা করে না? পেটে শুধু শয়তানি। বই লাগবে না আমার।”
বই রেখেই ফিরে এলাম। অত চাপ কিসের? এমনিতেও উনি এখন চলে যাবেন। তারপর গিয়ে বই নিয়ে ওনার খাটের উপর বসে পড়লেই উনি দেখবেন কীভাবে? এই ভেবে অন্য একটা বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ার আগেই দরজায় ডিটেকটিভ সাহেব এসে দাঁড়ালেন। হাতে ওই বইটা। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। উনি এগিয়ে এসে হাতের বইটা আমার পাশে ছুঁড়ে ফেলে বললেন,
“এসব নিয়ে অতিরিক্ত সময় পড়ে থাকবে না। এসে যেন পড়ার টেবিলে দেখি।”
হুকুম ঝেড়ে সাহেব বিদায়। পড়ার টেবিল পরে বুঝা যাবে, আমি আমার বই তো পেয়েছি। হাতের বই রেখে দিয়ে ওই বইটা নিলাম। বই খুলে বুকমার্কের নিচে একটা কাগজ পেলাম। হুট করেই যেন খুশি-খুশি লাগল। বই রেখে দ্রুত কাগজটার ভাঁজ খুললাম।

মনোহারিণী,
আমার ব্যক্তিগত রাগিণী। এই যে সে গোটা বিশ্বের কাছে বড্ড চাপা স্বভাবের শান্ত একটা হরিণী, অথচ গোটা বিশ্বের কাছে চেপে রাখা রাগটা কেবল আমার ওপর ঢেলে দেয় নির্দ্বিধায়; একে কি বলে? ভরসা, না কি সাহস? সে যা-ই হোক, তার বিশ্ব সমান রাগ ধারণের ক্ষমতা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা আমায় দিয়েছেন। তবু সে সবার কাছে চাপা রাগটা আমার কাছে উজাড় করে দিক। আমার ব্যক্তিগত রাগিণীর জন্য সমস্ত দ্বিধা মানা। ফিরে এসে কি তার ফোলানো গাল দেখব? আচ্ছা, শেলফে কয়েকটা নতুন বই উঠলে কেমন হয়?
ইতি
রাগিণীর রাগ জমা রাখার সিন্দুক

আমি মুখ বাঁকিয়ে স্বগতোক্তি করলাম, ‘গলছি না, হুহ্।” কিন্তু তাজ সাহেব বলেছেন, আর সেটা করবেন না, তা কি হতে পারে? রাতে তার ফেরার সাথে-সাথে সত্যিই শেলফে কয়েকটা নতুন বই উঠল। তা দেখেই আম্মি হাঁক ছাড়ল,
“এসব কী তাজ? বস্তা ভর্তি বই এনে যে শেলফ সাজিয়েছিলি, ওগুলো এখনও এক ভাগও পড়ে শেষ করেছিস কেউ? আবার এগুলো এনেছিস কী করতে? আনতে পারলেই হয়?”
তাজ ভাই একগাল হেসে উত্তর দিলেন,
“রাগ কোরো না আম্মি। বইয়ের সুবাদে বউ মেলে, বুঝলে?”
আম্মি ওনাকে মৃদু থা’প্পড় মে’রে বলল,
“দুপুরে বলো এক কথা, আবার রাতেই সুর বদল? তোমাকে এ বছরেই বিয়ে করাব, দেখে নিয়ো।”
আমি তখন মনে-মনে আকাশে উড়ছি। যে যা ইচ্ছে বলুক, কয়েকটা নতুন বই তো জুটেছে। আপাতত এই আনন্দে বাকি সব দুধভাত।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here