মনোহরিণী পর্ব -২৩+২৪

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৩.
মনোহারিণী,
আমার প্রতি তোমার অভিমানের মাত্রা ঠিক কতটুকু বলো তো? আকাশ কিংবা সমুদ্র সমান? না কি সমগ্র ভূপৃষ্ঠের সমান? তুমি কি জানতে, আমার হাহাকার ছিল তোমার আকাশ, সমুদ্র, ভূপৃষ্ঠের চেয়েও দ্বিগুণ? জানতে না। তাই বলেই তো আমার অবহেলায় তুমি আজও দুঃখ পাও। কখনও কি বুঝতে চেয়েছ যা তোমার চোখে অবহেলা, তা আমার কাছে কী? এই অবহেলাটা আমার চোখে ছিল সতর্কতা, শুভ কামনা। সেই সাড়ে ছয় বছর আগে যখন নিজের দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি চলছিল, তখন আমার তরুণ মনে ছিল তরতাজা য’ন্ত্রণা। তারও বহু আগে যে ছোট্ট একটা হরিণীর দুটো গভীর নেত্র আমার মন হরণ করেছিল। দেশে থাকাকালীন না হয় তাকে কয়েক মাস পর হলেও একবার দেখে চোখ জুড়াতাম। সুদূর সুইডেনে আমি তাকে কোথায় খুঁজতাম? তাকে জানানোও হয়নি আমার ভেতরের য’ন্ত্রণার খবর। সে যে তখন পনেরোতে পা রাখা এক ছোট্ট কিশোরী। টগবগে যুবক তার জন্য পু’ড়ছে, এ কথা জানতে পারলে সে আবেগে ভাসত। পড়াশোনা গোল্লায় তুলে মাথায় আবেগ চড়িয়ে দিন কা’টাত। অভিমান, অভিযোগে গাল ফুলিয়ে আমার পড়াশোনাও রসাতলে দিত। তারপর কী হত? দুজনের ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে প্রেমের গান গাইতে হত। আমার মতো সচেতন নাগরিক এতটা কেয়ারলেস কী করে হত? আবেগকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিবেক দিয়ে ভেবেছিলাম। পাঁচ বছরের ব্যবধান। সময়টা হয়তো দীর্ঘ ছিল, কিন্তু স্মৃতিগুলো ছিল স্মরণীয়। সুইডেনের নিরিবিলি ফ্ল্যাটের গভীর অন্ধকারে আমি আমার ছোট্ট হরিণীকে খুঁজে বেড়াতাম। বুকের ভেতর র’ক্তক্ষ’রণ হত কতশত বার! অথচ হরিণীটা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাত। সবার সাথে কথা বলার সময় আমার চোখ দুটো একটা বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুখ খুঁজত। কিন্তু সে একটাবারও দেখা দিত না। কতবার তার নাম নিতে গিয়েও বুকে পাথর চেপে নিজেকে সামলে নিয়েছি! সে আমার অভ্যাসে পরিণত হলে যে দু-দুটো ক্যারিয়ার ধ্বংস হবে। তার চোখ দুটো আমায় দূরত্ব ভুলিয়ে দিবে। পরিবারের চোখে দায়ী হলে সেই আমিই হতাম। আমার ছোট্ট হরিণী ধীরে-ধীরে বড়ো হয়ে গেল, আবেগ ভুলে গেল, অভিযোগ করতে শিখে গেল। ভেবেছিলাম মুখোমুখি দাঁড়ালে সে আবার বোকা-বোকা চোখে তাকিয়ে বলবে, ‘চিঠিটা আমি দিইনি তাজ ভাই। আমি এসব লিখতে পারি না।’ অথচ দেশে ফিরে তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমার ভেতরের ছটফটানি সে টেরও পেল না। চাপা রাগ আর অভিযোগ ঢেলে দিলো। তবু আমি তার শক্ত মুখের আড়ালের সেই বাচ্চা হরিণীকে খুঁজে পেয়েছিলাম। পাঁচটা বছরের য’ন্ত্রণার জার্নিটা খুব সহজ ছিল না। তা যদি বাচ্চাটা বুঝত; তবে অভিমান, অভিযোগের আগে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করত, ‘এতগুলো বছর আপনি কেমন ছিলেন? আপনার বুকের ব্যথা কমেছে?’ তাকে কখনও জানাতে ইচ্ছে হয়নি, ক্যারিয়ার আর জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে আমি তার চোখে অপরাধী হয়েছিলাম। সব ব্যথা সহ্য করে নিয়েছিল এক সান্ত্বনায়, ফিরে এসে আজীবনের জন্য তাকে হরণ করে নিব। আমি ফিরলাম, কিন্তু তাকে হরণ করতে গিয়েও সেই ব্যথাই পেলাম। সে জানতে চাইল না আমার ব্যথা কিসের। আমি যে সবসময় তাকে ওপরের খোলসটুকুই দেখিয়েছি। আমার হরিণী নিজে বলল অভিশপ্ত চিরকুট তার ক্ষ’তর কারণ। এরপর কী করে আড়ালে থাকি? সে জানুক সাড়ে ছয় বছর আগে আমি দোষী ছিলাম, সাড়ে ছয় বছর পরে এসেও আমিই দোষী। এটা তার অভিযোগ নয়, আমার স্বীকারোক্তি। আমার হরিণীটা যে বাচ্চাসুলভ। তাকে যা বুঝিয়েছিলাম, সে তো তার বেশি বোঝেনি। যা দেখিয়েছিলাম, শুধু তার নির্ভরতায় আমায় দোষী সাব্যস্ত করেছিল। দোষটা আমারই ছিল। এই দোষ নামক য’ন্ত্রণা আমি আজীবন বয়ে বেড়াতে পারব। তার বিনিময়ে আমার নিষ্পাপ হরিণী য’ন্ত্রণামুক্ত থাকুক। তার সবটুকু যন্ত্রণা শুষে নিক আমার দোষী মন। আমি না হয় ওই গভীর চোখে, দীঘল কেশে, গালের ওই মিশমিশে তিলে য’ন্ত্রণা ভুলব। দোষী তাজ তার মনোহারিণীর কাছে কেবল একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। মন হরণ করা কি দোষের নয়? তার চোখে কি সে নির্দোষ? উত্তরটা আমার চাই-ই চাই, এমনটা নয়। তার ইচ্ছেই সই। আমার চাওয়া কেবল আমার বাচ্চা হরিণী। এক্ষেত্রেও সে না চাইলেও সই। অনুভূতির য’ন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়া আমার ধাতে নেই। সে আমি একাই দিব্যি বয়ে বেড়াতে পারি। সে কেবল একটু সুখানুভূতি বয়ে বেড়াক, আর কিচ্ছু চাই না।
ইতি
মনোহারিণীর দোষী তাজ

দুই পৃষ্ঠা ভর্তি পরিচিত হাতের লেখার দীর্ঘ চিঠিটা আজ সকালে ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে পেয়েছি। সম্পূর্ণ চিঠি পড়ার পর আমি ঠিক কতটা সময় মূর্তির মতো অটল হয়ে ছিলাম ধারণা নেই। ভেতরটা ডুকরে উঠলেও বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। পাছে সবাই না আবার প্রশ্ন করে বসে। চিঠি পাওয়ার পর থেকে ওনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ফাহিম ভাইয়াদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কক্সবাজার কাস্তুরিঘাটে ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করার সময়ও ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি বোধ হয় ইচ্ছে করেই সুযোগ দিলেন না। আমাকে তব্দা খাইয়ে বসিয়ে রেখে সে দিব্যি হেসে-খেলে উপভোগ করছে। আমিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ট্রলারে উঠেই ওনার পাশে জায়গা দখল করে নিলাম। উনি কপাল কুঁচকে বললেন,
“ট্রলারে উঠেছিস, না কি প্রাইমারি স্কুলে আগেভাগে বেঞ্চ দখল করছিস?”
আমি ওনার কথার প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও করতে পারলাম না। ওই চোখে চোখ আটকাতেই চিঠির প্রত্যেকটা লাইনের লুকায়িত য’ন্ত্রণা হৃদয় গহ্বরে খোঁচা মা’রল। সঙ্গে-সঙ্গে আমার কান্না পেয়ে গেল। কথার আগে কান্না আসার স্বভাবটা বড্ড ঝামেলার। বেপরোয়া চোখ জোড়া স্থান, কালও মানে না। আমি তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি নামিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ ঝাপটে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করলাম। উনি নিচু স্বরে বললেন,
“ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করলে এক ধা’ক্কায় সমুদ্রে ফেলে দিবো।”
ট্রলারে সময়টা মন্দ কা’টল না। আমাদের গ্যাং বেশ আড্ডা জমিয়ে দিলো। আমিও উপভোগ করলাম। কিন্তু হুটহাট ওই লোকটার দিকে তাকালেই ভেতরে কেমন তীব্র অস্বস্তি আর ব্যথায় জ’র্জরিত হয়ে পড়ে। সমুদ্রের পানির ঢেউ আর ভাসমান গাঙচিলের সৌন্দর্য দেখতে-দেখতে মন অনেকটা হালকা হলো। চারদিকে থৈ-থৈ পানি আর নীল আকাশের মাঝেই ডুবে রইলাম কতটা সময়। প্রকৃতির মাঝে সত্যিই দৈব এক জাদু আছে। প্রকৃতির কাছাকাছি এলে প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে দুঃখগুলো শুষে নেয়। সে চায় কেবল আনন্দ দিতে, মানুষকে হাসাতে। জুম্মান ভাইয়া আর শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেদের ক্যামেরায় সকল দৃশ্য ফটাফট বন্দি করে ফেলছেন। এখন সে ব্যস্ত জেলে নৌকাগুলোর ছবি তুলতে। আমিরা আপু আর আনহা আপু প্রবল আগ্রহে সবার ছবি তুলছে। সৌরভ ভাইয়া একবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে, আবার ফাঁকে-ফাঁকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবি একপাশে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর হাসিমুখে গল্প করছে। আদনান ভাইয়ার হাতে ক্যামেরা থাকলেও, সে ছবি তুলছে কম। সমুদ্রের পাড়ে ট্রলারের কারখানা দেখে তাজ ভাই সৌরভ ভাইয়াকে ডেকে বললেন,
“জনাব সৌরভ, চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত মানুষ। তোকে একটা সাজেশন দিই, শোন। তুই বরং এখানেই থেকে যাস। ওই জেলেদের সাথে সারাদিন মাছ ধরবি, না হয় ওই কারখানার ট্রলারে ঠুসঠাস করবি। তবু তো তোর সময়গুলো একটা কাজের কাজে ব্যয় হবে।”
সৌরভ ভাইয়া ভ্রুকুটি করে বললেন,
“এটা সাজেশন, না মা’রার প্ল্যান?”
“অফ কোর্স সাজেশন। এখন তুই যদি নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা করিস, তাতে আমার কী করার আছে? আমি তোর বড়ো ভাই হিসেবে একটা দায়িত্ব পালন করলাম। অনিক কোনোদিন এটুকুও করেছে?”
রাজ ভাই হেসে বললেন,
“অনিকের অনুপস্থিতিতে ওর নামে বদনাম করছিস?”
“তুমি নিজেও এটুকু দায়িত্ব পালন করোনি ভাইয়া। এই গা’ধা ফোনের পেছনে জনম পার করে দিচ্ছে। এখন বড়ো ভাই হিসেবে আমাদের উচিত ওকে সঠিক পথে আনা। তো এসব কাজে লাগিয়ে দিলে ওর ফোনের সাধ এমনিতেই মিটে যাবে,” বিজ্ঞের মতো বললেন উনি।
আমিরা আপু কটাক্ষ করে বলল,
“এখানে রেখে যাওয়ার আগে একটু দয়া করে গা’ধার ফোনটাও দিয়ে যাবেন। ওটা ওর প্রাণভোমরা তো। সব দুঃখে ও হাসতে পারবে, শুধু এই ফোনের দুঃখে ও ম’রেও যেতে পারে। তারপর উপকার করতে গিয়ে উলটো আমাদেরই কেস খেতে হবে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া সহমত পোষণ করলেন,
“এটা ঠিক বলেছ। অক্সিজেন ছাড়াও সৌরভ বাঁচতে রাজি আছে,‌ কিন্তু ফোন ছাড়া নয়।”
আমি বললাম,
“তারপর দেখা যাবে সৌরভ ভাইয়া কাজ ফেলে রেখে মাছের বা ট্রলারের ছবি তুলবে, আর ফেসবুকে পোস্ট করে ক্যাপশন দিবে, গাইস দেখুন আমার নিজ হাতে ধরা মাছ, আমার নিজ হাতে তৈরি ট্রলার। আবার আকাশে উড়ে যাওয়া বিমানের ছবি তুলেও বলতে পারে, গাইস দেখুন আমার নিজ হাতে তৈরি বিমান।”
সবাই হুঁ-হা করে হেসে উঠল। সৌরভ ভাইয়া চুপসানো মুখে বলল,
“কী আশ্চর্য আপু! শেষমেষ আপনিও ওদের দলে নাম লেখালেন? এজন্যই বলে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
“না ভাইয়া, আপনি নিজেই ফোনের প্রেমে পড়ে দল থেকে ফসকে যাচ্ছেন।”
তারপর আদনান ভাইয়ারা গলা ছেড়ে গান ধরলেন। একটার পর একটা গান টেপ রেকর্ডারের মতো চলছে। মাঝে-মাঝে আবার একেকজন আলাদা করেও গান গাইছে। জুম্মান ভাইয়া হেড়ে গলায় হাঁক ছাড়লেন,

নদীর ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে
ভাঙেরে দুই কূল
মনের দুই কূল ভাঙল তবু
ভাঙল না তার ভুল, আমার
মনের দুই কূল ভাঙল তবু
ভাঙল না তার ভুল।

গানের মাঝেই আদনান ভাইয়া জুম্মান ভাইয়ার মাথায় সজোরে এক গাট্টা মে’রে বললেন,
“হুপ ব্যাটা, এটা তোর নদী না, সমুদ্র। বিরহের গান ধরছিস কোন দুঃখে? তোর বউ তার এক্সের সাথে ভাগছে?”
জুম্মান ভাইয়ার সাধের গানে ব্যাঘাত ঘটায় সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল।
“ধুর ভাই, গানের মুডটাই নষ্ট করে দিলে।”
তাজ ভাই বললেন,
“সমুদ্রে বসে নদীর গান না গেয়ে বাতাসের গান গাইতে পারিস। যেমন ধর,

গুরুজনে কইছিল, প্রেমের বাতাস নিয়ো না
প্রেমের বাতাস গায়ে লাগলে
হইবা তুমি দিওয়ানা।

তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে যেভাবে গানটার সুর তুললেন, তাতেই সবার হাসতে-হাসতে গানের বারোটা থেকে চৌদ্দটা বাজিয়ে দিলো। তাজ ভাই ধমকে উঠে বললেন,
“এত্ত সুন্দর একটা গানকে এভাবে অপমান করার অপরাধে তোদের সবকটাকে প্রেমের বাতাস থেকে দূরে থাকার শা’স্তি দেওয়া হবে।”
রাজ ভাই বললেন,
“আমার এই বাতাস খুব প্রয়োজন। নইলে বউ টিকবে না ভাই।”
জুম্মান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“প্লিজ ভাই, এই শা’স্তিটা সম্পূর্ণ আমার ওপর মঞ্জুর করো। তবু যদি প্রেমের বাতাসের কৃপায় কপালে একটা প্রেম জোটে।”
আমিরা আপু মুখ কুঁচকে বলল,
“কয়টা লাগে তোর? এখন কি এক্সকেও ফেরত চাস?”
সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“এসব বাতাস-টাতাস আমি নিব না ভাই। আমার বাপ আমাকে ডিরেক্ট বাতাসের সাথেই উড়িয়ে দিবে।”
আনহা আপু অনুরোধ করল,
“তাজ ভাই, ভালো একটা গান ধরুন তো।”
তাজ ভাই কিছুক্ষণের মধ্যেই গান ধরলেন,

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি
তোমার দ্বিধায় পু’ড়ে যাই,
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি
তোমার স্বপ্নে পু’ড়ে যাই,
এমন সাধের পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।

গানের সাথে দু-এক জন সুর মিলাল। পুরো গান শেষে শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“আহা ভাই, কী ফিলিংস নিয়ে গাইলি! কেউ আছে না কি?”
তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,
“অবশ্যই আছে।”
আমি চমকে উঠলাম। সতর্ক চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবাই খুব উৎসুক হয়ে উঠেছে তাজ ভাইয়ের কেউ একজনের পরিচয় শোনার জন্য। আমিরা আপু আহত মুখ করে বসে আছে। বেচারি বোধ হয় শক খেয়েছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার ভয় তুঙ্গে তুলে দিয়ে বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলেন,
“আরেহ্! ডিটেকটিভ বাবুরও তাহলে কাউকে মনে ধরেছে, অথচ আমিই জানি না! তুই এটা করতে পারলি তাজ? আচ্ছা যা আনন্দর ঠেলায় মাফ করে দিলাম। এবার আমাদের হবু ভাবির পরিচয় শুনি, বল, বল। কী নাম? কোথায় থাকে?”
“তোর শ্বশুরবাড়ি।”
তাজ ভাইয়ের উত্তর শুনে সবাই কপাল কুঁচকে ফেলল। শ্রেয়ান ভাইয়া চোয়াল ঝুলিয়ে বললেন,
“আমার শ্বশুরবাড়ি তো আমিই চিনি না, তুই চিনলি কীভাবে? আর আমার শ্বশুরবাড়িতে তোর বউ এল কোত্থেকে? তোর মতলব খারাপ হলে তো আমি শ্যালিকা দেখে বিয়ে করব না। ওই আশা ছেড়ে দে।”
“তোর শ্যালিকা কে চায়? তোর বউই তো আমার বউ।”
তাজ ভাইয়ের উত্তর শুনে সবাই হাসতে লাগল। শ্রেয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“তাহলে তো তোর বউও আমার বউ। শোধবোধ।”
“আমার বউ তোর ভাবি।”
“অ্যাহ্! নিজের বেলায় ষোলো আনা, পরের বেলায় চার আনা?”
“আজব ব্যাপার! আমি যখন বললাম তোর বউ আমার বউ, তখন তো তুই প্রতিবাদ করলি না। আমার বউ পাওয়ার লোভে মেনে নিলি। আমি তো মেনে নিইনি। তাই তোর বউ আমার বউ, আমার বউ তোর ভাবি। সোজাসাপ্টা ক্যালকুলেশন।”
আমাদের গল্প, আড্ডায় ট্রলার মহেশখালীর বাঁকে পৌঁছাল। মহেশখালী বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। আমরা আড্ডা রেখে দূর থেকে মহেশখালী দ্বীপ দেখতে ব্যস্ত হলাম। জুম্মান ভাইয়া আবার ছবি তুলতে লেগে পড়েছেন। জেনিফার ভাবি তার ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে সবার মাঝে বিলি করলেন। তাজ ভাই তার চকোলেট খুলে এক কামড় খেয়ে আমার‌ বাঁ হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তখন ডান হাতের চকোলেট মুখে পুরেছি। ভ্রু কুঞ্চিত করে ওনার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি বললেন,
“পচা কাঁদার মতো স্বাদ।”
“কই? মজাই তো লাগছে। আপনি পচা কাঁদা খেয়েছেন মনে হয়?”
উনি আমার মাথায় মৃদু টোকা মে’রে বললেন,
“না, ছোটো বেলায় তুই খেয়েছিলি, আমি দেখেছিলাম।”
“আজাইরা কথা।”
ট্রলার বাঁকখালী নদীর একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই হঠাৎ ঢেউ উঠল জোরেশোরে। আমরা শক্ত হয়ে বসলাম। রাজ ভাই বললেন,
“সমুদ্র পার হলাম কত সুষ্ঠুভাবে। এখন নদীতে এসে ঢেউ উঠল। এই ঠিক করে বস সবাই।”
তাজ ভাই হুট করেই আমার দিকে সরে বসে এক হাত চেপে ধরলেন। আমি সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
“সরে বসুন। আমি বাচ্চা নই।”
উনি সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ওহ্, আপনি তো খুব বুড়ি। নদীতে ফেললে উঠে আসতে পারবেন?”
“উঠে আসার কী দরকার? না এলেই তো আপনার সব য’ন্ত্রণা চিরকালের জন্য বিদায় হবে।”
উনি চোখে হাসলেন। কিঞ্চিত তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“আগে জানলে সুইডেন যাওয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় একটা মা’র্ডার করে য’ন্ত্রণা বিদায় করে যেতাম।”
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৪.
আমরা যখন সোনাদিয়ার মাটিতে পা রাখলাম, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে সবার পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেল। কাঁদা পার হয়ে পা ধুয়ে তবেই সোনাদিয়ার সবুজ ঘাসে পা ফেললাম। এরমধ্যে আবার কাঁদা মাটির মধ্য থেকে আমিরা আপুর পায়ে ছোটো শামুক ফুটে গেল। খুব বেশি ব্যথা না পেলেও একটুখানি র’ক্তক্ষ’রণ হলো। আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“দ্বীপে পা রাখতে না রাখতেই বি’পদ। ধুর!”
জুম্মান ভাইয়া আমিরা আপুর পায়ের র’ক্ত মুছে ঔষধ লাগিয়ে দিলেন। এখানটায় কোনো জনবসতি চোখে পড়ছে না। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু ঝাউবনের সমারোহ। এ যেন সবুজের ছড়াছড়ি। আমিরা আপুর জন্য আমাদের কিছু সময় খোলা মাঠে বসতে হলো। তৃণলতার ওপর আমরা আরাম করে বসে পড়লাম। এই দুপুরে ঝাউবনের বাতাসে একরাশ প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। জনশূন্য নির্জন সবুজ মাঠে আমরা দশ জন মানব। মনে হচ্ছে আমরা হারিয়ে গিয়ে কোনো এক অচেনা দ্বীপে ঢুকে পড়েছি। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে। কারণ সামনে কী আছে তা এখনও আমাদের কারো-কারো কাছে অজানা। সবার ব্যাগপত্র তুলে নিয়ে দীর্ঘ ঝাউবন পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। সোনাদিয়া দ্বীপ দুটো পাড়ায় বিভক্ত। একটা পূর্ব পাড়া, আরেকটা পশ্চিম পাড়া। পূর্ব পাড়ায় জনবসতি বেশি। তাই খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য পূর্ব পাড়া ভালো। তবে ঘোরাঘুরি এবং ক্যাম্পিংয়ের জন্য পশ্চিম পাড়া বেশি নিরাপদ। পূর্ব পাড়ার স্থানীয় এক লোককে দিয়ে আগে থেকে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল। সর্বপ্রথম আমরা সেই লোকের বাড়িতেই উঠলাম। এখানকার বাড়িগুলো দেখতে কেমন কুঁড়েঘরের মতো। প্রায় সকল বাড়ির সামনেই শুঁটকি মাছের ছড়াছড়ি। কড়া রোদে বিভিন্ন রকমের শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। এই দ্বীপ শুঁটকির জন্য বেশ বিখ্যাত। বাংলাদেশে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাড়িওয়ালাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল মনে হলো। খুব বিনয়ের সাথে আমাদের ভেতরে নিয়ে বসালেন। ওনারা খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়েই খেতে বসে গেলাম। সবার পেটেই দারুণ ক্ষুধা। ভাতের সাথে মুরগির ঝোল আর শুঁটকি রান্না করা হয়েছে। বেশ তৃপ্তি নিয়েই আমরা খাওয়া সম্পূর্ণ করলাম। বাড়িওয়ালা এবং তার স্ত্রীর আচরণ বেশ। হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কয়েকজন বাদে আমরা অনেকেই এদের ভাষা বুঝতে পারছি না। এরা কথা বলে চাটগাঁইয়া ভাষায়। যা আমি এক লাইনও বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না। ফাহিম ভাইয়ার বাসায়ও আমাকে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ওনার মায়ের কোনো কথাই আমি বুঝতে পারিনি। কোথাও গিয়ে সেখানকার মানুষের ভাষা বুঝতে না পারার মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই। বাড়িওয়ালা যখন তাজ ভাইদের সাথে এই দ্বীপের ব্যাপারে কথা বলছিলেন, তখন আমি তাজ ভাইকে খোঁচা মে’রে ফিসফিসিয়ে শুধালাম,
“লোকটা কী বলছে?”
“লোকটা বলছে ওনার বউয়ের না কি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। ওদের ছেলের জন্য রেখে দিতে চায়।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আজাইরা কথা।”
“বিশ্বাস না হলে তুই জিজ্ঞেস করে দেখ। ওহ্, তুই তো মূর্খ। ভাষা বুঝিস না।”
“আমি এই ভাষা বুঝে কী করব? আমার নিজের ভাষা বুঝলেই হলো।”
“এইজন্যই ভাবছি তোকে রেখে যাব। এদের সাথে থাকলে ভাষা শিখে যাবি।”
“দাঁত ভাঙার শখ নেই আমার।”
একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম সোনাদিয়ার বুকে। পূর্ব পাড়া ডিঙিয়ে এবার পশ্চিম পাড়ায় যেতে হবে। তখন সূর্যের তেজ খানিকটা শিথিল হয়ে এসেছে। নির্জন দ্বীপটা সম্পূর্ণ বালিয়াড়িতে পূর্ণ। চারদিকে ধূ-ধূ বালুচর। কোথাও বালির ছোট্ট টিলাও নজরে পড়ল। বালিয়াড়ির বুকে মাঝে-মাঝেই আবার সবুজ ঘাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়। চারদিকে নাম না জানা বিভিন্ন ধরনের গাছ। এরমধ্যে শুধু গুটিকয়েক নারকেল গাছ আর ক্যাকটাস চিনতে পারলাম। বন্য ফুল গাছও দেখা গেল, কিন্তু আমার এসবের নাম জানা নেই। নারকেল গাছে নানান রঙের বাহারি পাখি বসে আছে। কিছু সংখ্যক আবার সমুদ্রের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করছে। সাগর লতায় মুড়ানো বালিয়াড়িতে হাঁটতে গিয়ে সবার পা বালিতে মাখামাখি হয়ে গেছে। দু-এক জন চাষী ছাড়া এখানেও কাউকে নজরে পড়ল না। সবুজ ঝাউবনের পাশেই বালিয়াড়ির মধ্যে আমাদের তাঁবু খাটানো হলো। কক্সবাজার থেকেই তাঁবুর সকল সরঞ্জাম কিনে আনা হয়েছিল। কক্সবাজার থেকে উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত এই সোনাদিয়া সম্পূর্ণ নিরিবিলি একটি দ্বীপ। একে বিচ্ছিন্ন দ্বীপও বলা চলে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে মাত্র নয় কিলোমিটার আয়তন নিয়ে এ দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। এখানে না আছে পর্যটকদের জন্য বিশেষ কোনো থাকার জায়গা, আর না আছে খাওয়ার ব্যবস্থা। হয় স্থানীয়দের বলে তাদের বাড়িতে খেতে হয়, নয়তো নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে হয়। থাকার ব্যবস্থাও একইভাবে করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়দের কিছু টাকা-পয়সা দিতে হয়। আবার কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে সেখানকার বন বিভাগের অফিসেও রাত্রিযাপন করা যায়। তবে কারো বাড়িতে থাকার চেয়ে তাঁবু খাটিয়ে থাকাটাই বেশি উপভোগ্য। কারণ সোনাদিয়ার আসল সৌন্দর্য রাতেই খুঁজে পাওয়া যায়। তার ওপর যদি হয় জ্যোৎস্না রাত। তাহলে তো কথাই নেই। নিঃসন্দেহে এই নির্জন দ্বীপ যেকোনো পর্যটকদের মন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম। একদিনে সম্পূর্ণ দ্বীপ ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই তাজ ভাই আগে থেকে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করে হাতে দুদিন সময় নিয়ে এই দ্বীপ ঘোরাঘুরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন। তাঁবু খাটানো শেষ হওয়ার আগেই আমরা কয়েকজন নেমে পড়লাম সমুদ্রে। এতটা পথ ভ্রমণের পর এখন গোসলটা খুব জরুরী। সাগরের বুকে নেমে মনে হলো নীলের রাজ্যে হারিয়ে গেছি। মাথার ওপর নীল আকাশ, নিচে নীল সমুদ্র। দুটোই সুবিশাল। যতদূর চোখ যায় শুধু নীল রঙের রাজত্ব। এ যেন আকাশ আর সমুদ্রের পার্থক্য করা দায়। মাঝে আবার কিছু সামুদ্রিক পাখি উড়ে চলে যাচ্ছে। ওদের দেখলে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেরও পাখি হওয়ার ইচ্ছে জাগে ব্যাকুল মনে। তাহলে আর পানিতে ডুবে যাওয়ার কোনো ভয় থাকত না, আর না এই তীরে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে হত। পাখি হলে উড়ে চলে যাওয়া যেত ওই সমুদ্রের মাঝে, নীল আকাশের বুকে। আহ্! ব্যাপারটা কী অদ্ভুত সুন্দর হত! সোনাদিয়ার সাগরের স্বচ্ছ নোনা পানির শীতলতা মনকে তরতাজা করার জন্য যথেষ্ট। একেকটা ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ার দৃশ্যটাও নজরকাড়া। দু-একটা জেলে নৌকা ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের পুরো টিম রীতিমতো ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে দিয়েছে। সবাই যেন নিজেদের হারানো শৈশবে ফিরে গেছে। তীরে বসে আমরা মরা শামুক কুড়িয়ে ভেজা বালিতে উদ্ভট সব আঁকিবুঁকি করলাম। রা’ক্ষসী ঢেউ এসে আবার সব আঁকিবুঁকি ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবি দল থেকে আলাদা হয়ে হাঁটু অবধি পানিতে বসে ছবি তুলছেন। তাদের দেখে জুম্মান ভাইয়া চেঁচানো গলায় সুর তুললেন,

ভাই যখন বউ নিয়া
আমার চোখের সামনে দিয়া,
রঙ্গ কইরা সেলফি নেয়
ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।

জুম্মান ভাইয়ার গান শুনে আমরা হাসতে-হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বাহবা জানালেন,
“তোমার ফাটা বাঁশের মতো গলায় এটা জোস ছিল ভাই। আমাদেরও একই গান গাওয়া দরকার।”
রাজ ভাই হাসলেন। জুম্মান ভাইয়ার দিকে পানি ছুঁড়ে মে’রে বললেন,
“তাজ আর আদনানকে স্কিপ করে তুই কাজ সেরে ফেল। না করেছে কে?”
“তোমার কাকা আমার বাপে মানবে মনে করছ? ঘরে বউ তুলতে গিয়ে পরে দেখা যাবে আমি নিজেই ঘরছাড়া হয়ে গেছি। নিজেই যদি ঘরে থাকতে না পারি, তো বউ ঘরে সাজিয়ে রাখব কার জন্য?”
তাজ ভাই বললেন,
“চিন্তা কিসের? আমি আছি তো। তোর বদলে এন্ট্রি নিয়ে নিব।”
জুম্মান ভাইয়া মুখ কুঁচকে, নাক সিঁটকে বললেন,
“ছেহ্! তুমি ভাসুর হয়ে এই আশা করছ?”
“আশা করছি কখন বললাম? তোর চিন্তা দূর করে উপকার করলাম।”
“ধন্য হলাম ব্রো। এমন উপকার পাওয়ার চেয়ে আজীবন সিঙ্গেল থাকব।”
মাঝখান থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“বউ নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় আছো, তাদের জন্য আমি আছি। সোজা আমার কাছে ট্রান্সফার করে দিবে। আমি আবার দয়ালু মানুষ। ভাবি আপনাকে কিন্তু বাদ দিয়ে বলেছি। কিছু মনে নিয়েন না। রাজ ভাইয়ের বউ হিসেবে আপনিও আমাদের মুরব্বি।”
জেনিফার ভাবি মৃদু শব্দ তুলে হেসে বলল,
“তোমরা পারোও বটে! ফা’জিলের দল।”
দারুণ উচ্ছাসে আমাদের কতটা সময় কে’টে গেল হিসেব নেই। হুট করে খেয়াল করলাম তাজ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখের ইশারায় উঠে যেতে বললেন। আমি মোটেও তোয়াক্কা করলাম না। এত আনন্দ রেখে আমি উঠতে যাব কেন? পরপর দুইবার উনি একইভাবে ইশারা করলেন। তারপর আর আমি ওনার দিকে তাকালামই না। কিছুক্ষণ পর উনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“চলো এবার ওঠা যাক।”
আনহা আপু আপত্তি জানাল,
“এখনই? আরেকটু পর উঠি। রোজ-রোজ তো আর সমুদ্রে গোসল করব না।”
“সবাই কি ঠান্ডা সইতে পারে? পরে কারো সর্দি লেগে গেলে তাকে আরও এক ঘন্টা যাবত সমুদ্রে চু’বাব। ঘুরতে এসে অসুস্থ হওয়ার সাধ মিটিয়ে দিবো।”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। এসব ইঙ্গিতে আমার ওপর ঝাড়া হলো। পরে আদনান ভাইয়াও বললেন,
“বিকেল কিন্তু হয়ে গেছে। আমাদের এদিক-ওদিক ঘুরতেও হবে। চল উঠে পড়ি। নইলে সময় নষ্ট হবে।”
তার কথায় সম্মত হয়ে সবাই উঠে পড়লাম। ভেজা কাপড় পালটে আমরা তাঁবুতে বসে কিছু সময় অবসর নিলাম। তারপর সবাই বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপের পেছনের দিক ঘুরে দেখতে। পায়ে হেঁটে চারদিকের অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যপট দেখতে-দেখতে এগিয়ে চললাম। খুব একটা জনমানব চোখে না পড়ায় নিজেকে কেমন এই দ্বীপের রানি মনে হয়। এ যেন একার রাজত্ব। দ্বীপের পেছন দিকে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেকটা জায়গা ঘের দিয়ে লবন উৎপাদন হচ্ছে। এই জায়গাটাকে বলা হয় লবনের মাঠ। লবন উৎপাদন এই প্রথম দেখা। এই দ্বীপের মানুষের উপার্জনের প্রধান উৎসই হচ্ছে লবন চাষ আর মাছ ধরা। লবনের বিশাল একটি অংশ এই দ্বীপে উৎপাদন হয়। নোনা পানিতে ঘেরা এই দ্বীপে তেমন খাদ্য শস্য উৎপাদন সম্ভব হয় না। উৎপাদনের পরিমাণ খুবই স্বল্প। তার মধ্যে তরমুজ উৎপাদন হয় বছরের বারো মাস, অর্থাৎ সারা বছর। এক চাষির সাথে কথা বলে আমাদের তরমুজ খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। তরমুজ জিনিসটা আমার কোনোকালেই খুব একটা ভালো লাগে না। সবার থেকে কম খেলাম আমি। তাজ ভাইয়েরা একেকজন পেট পুরে তরমুজ খেলেন। আমি বললাম,
“এসব পেট পুরে খাওয়ার জিনিস?”
তাজ ভাই শ্লেষের সুরে বললেন,
“নাহ্, কাঁদা মাটি দিয়ে বানানো চকোলেট পেট পুরে খাওয়ার জিনিস।”
“আপনাকে বলেছে কাঁদা মাটি দিয়ে বানায়?”
“ডিটেকটিভ হয়েছি আর এসব জানব না?”
“ঘোড়ার ডিম জানেন।”
“হুঁ, তা-ও জানি। আমি তো তোর মতো মাথামোটা না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“কী আশ্চর্য! তোরা ঝগড়া করছিস কেন?”
“নারী জাতির তো এটাই স্বভাব। কেউ সঠিক বুঝাতে গেলে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে নিজে ওপরে থাকবে। নইলে ভাব, তরমুজের মতো এত মজার একটা ফল কেন ভালো লাগবে না? তুই বুঝাতে গেলে দেখবি তোরও দোষ হয়ে গেছে,” প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি বললাম,
“এটাকে বুঝানো বলে? উচ্চারণ করবেন ক, আর বলবেন কলকাতা বানান শিখিয়েছি? আপনার মতো ঝগড়াটে লোককে গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি দিলো কে?”
“আমার শ্বশুর দিয়েছে। কেন, তুই জানতি না? আমার শ্বশুরের বাচ্চার ঘট তো ফাঁকা, তাই তার ঘটের বুদ্ধির অনুসন্ধান করতে আমাকে ডিটেকটিভ বানিয়ে দিয়েছে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“আজ একটা শ্বশুরের অভাবে ডিটেকটিভ হতে পারলাম না।”
আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। এই গ্যাংয়ের সামনে মুখ খুললেই বিপদ। সোনাদিয়ার বিকেলের মনোরম দৃশ্য আমাদের প্রত্যেকের মন ফুরফুরে করে ছাড়ল। তবে আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি সন্ধ্যা থেকে রাতের দৃশ্য উপভোগের জন্য। সারা বিকেল ঘুরেফিরে আমরা গোধূলি লগ্নের আগমুহূর্তে সাগরের পাড়ে ফিরলাম। সাগরের বুকে সূর্যের ডুব দেখতে হবে। সবাই বসে পড়লাম সাগর পাড়ে। সূর্যের চিকচিকে আলোক রশ্মি সমুদ্রের বুক থেকে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশ রূপান্তরিত হলো লালচে আভায়। সেই আভা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আকাশসহ সমুদ্রের স্বচ্ছ পানিতে। সারি-সারি সাদা বক উড়ে যেতে লাগল আকাশ আর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে। তারা ফিরছে তাদের আপন নীড়ে। দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে আমরা গোধূলির অপরূপ সাজ দেখলাম। কী অদ্ভুত সুন্দর সব দৃশ্য! এ যেন রূপকথার জগত। লাল টুকটুকে সূর্যটা ঘোমটা টেনে লজ্জাবতী বধূর মতো ধীরে-ধীরে সমুদ্রের বুকে ডুব দিলো। সূর্যাস্তের পর নেমে এল সাঁঝের বেলা। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকারের বদলে আকাশে উঁকি দিলো থালার মতো গোল চাঁদ। সঙ্গে নিয়ে এল এক ঝাঁক তারা। চাঁদের চারপাশে তারারা মেলা বসাল। চাঁদমামা আকাশে বসে চারদিক আলোকিত করে তুলল। আমরা তখন রাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লেগে পড়লাম। সর্বপ্রথম ক্যাম্পিং ফায়ার, তারপর বারবিকিউ পার্টির আয়োজন। দুপুরে যে লোকের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম, উনিই আমাদের চারটা মুরগির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাদবাকি সবকিছু আমরা সংগ্রহ করেই এসেছি। সমুদ্রের তীরে বারবিকিউ। আহ্, কী আনন্দ! বালি খুঁড়ে গর্ত করা হলো। পাশের ঝাউবন থেকে শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে আগুন ধরানো হলো। আগুন জ্বা’লাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। তাজ ভাই, আদনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়ার চোখে ধোঁয়া গিয়ে একাকার। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। রাতেরবেলা বলে তাঁবুতে চশমা রেখে এসেছি। এদিকে ধোঁয়া চোখে লাগতেই আমার চোখে জ্বা’লাপো’ড়া শুঊ হলো। আমি চোখ ঘঁষতেই তাজ ভাই ধমকে উঠলেন,
“এখান থেকে সরবি, না চোখ যেটুকু আছে তারও বারোটা বাজাবি? কানার গোষ্ঠী।”
কোনোরকমে আগুন জ্বে’লে মুরগি বসানো হলো। তারপর শুরু হলো আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার পালা। মুরগি সিদ্ধ হতে বেশ সময় লাগল। এরমধ্যে আমরা বসে-বসে গল্পগুজব করলাম। একেকজনের কৌতুক মাখা কথায় হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড়। নির্জন দ্বীপে দশজনের হাসির আওয়াজ যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। বহুকষ্টের বারবিকিউ দেখতে খুব একটা সুবিধার না হলেও, তেমন খারাপও হয়নি। খোলা মাঠে গোল হয়ে বসেই আমরা পেটপূজা করলাম। মাথার ওপরে খোলা আকাশে চাঁদ, তারার বিচরণ। নিচে ক্যাম্পিং ফায়ার আর চাঁদের আলোয় বসে আমাদের ভোজন বিলাস। খাওয়ার সাথে দারুণ এক আড্ডা হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। তখন হঠাৎ শ্রেয়ান ভাইয়া সবাইকে ডেকে বললেন,
“গাইস, এদিকে এসো। আমি কিছু বলতে চাই।”
তার কথা শুনে উৎসুক হয়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়াল। তাজ ভাই বললেন,
“এত আড্ডার পরও তোর পেটে আবার কোন কথা বাকি পড়ে রইল?”
“বলছি ভাই। দাঁড়া না।”
তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়া পকেট হাতড়ে একটা রিং বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে বসলেন,
“আই লাভ ইউ ইলোমিলো। উইল ইউ ম্যারি মি?”
কয়েকটা ব’জ্র যেন একসঙ্গে আমার মাথায় আছড়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরোদস্তুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্তব্ধ দৃষ্টিতে সকলের হৈ-হৈ দেখলাম। সবাই তাড়া দেখিয়ে বলছে,
“ইলো, হ্যাঁ বলে দে। বললেই কি এখনই বিয়ে করতে হবে? পরে করে নিবি। তুই তো লাকি। চান্স মিস করিস না। আঙ্কেলের ভয়ে না করিস না আবার। শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শুনলে খুশি হবে রে ভীতুর ডিম। হ্যাঁ বল, হ্যাঁ বল।”
আমি চোখ তুলে শ্রেয়ান ভাইয়ার ঠিক পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালাম। মনে হলো সে আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল। শ্রেয়ান ভাইয়া উৎসুক দৃষ্টিতে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছেন। সবার তাড়ায় জল ঢেলে দিয়ে আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“সরি ভাইয়া। আমার পক্ষে এটা সম্ভব না।”
সঙ্গে-সঙ্গে সবাই চুপ মে’রে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া আ’হত মুখে বললেন,
“কেন? তোমার কোনো প্রবলেম আছে? তাহলে বলতে পারো।”
বাকি সবারও একই প্রশ্ন। আমি কোনোমতে বললাম,
“এখন আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।”
ওখানে আর দাঁড়ালাম না। আর না ঝুপ করে শান্ত হওয়া মানুষটার দিকে তাকালাম। সোজা তাঁবুতে ফিরে এলাম। আমি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় সবাই ফিরে এল। আমাদের দশজনের জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে ছয়টি। আমার সাথে ঘুমাতে এল আমিরা আপু। ততক্ষণে আমি শুয়ে পড়েছি। সে এসে বলল,
“এটা কী হলো বল তো?”
আমি বুঝেও উলটো প্রশ্ন করলাম,
“কোনটা?”
“কোনটা আবার? শ্রেয়ান ভাইয়াকে রিজেক্ট করলি কোন দুঃখে? সে যথেষ্ট যোগ্য ছেলে।”
“যোগ্যতা নিয়ে আমি কিছু বলেছি না কি?”
“তাহলে? শ্রেয়ান ভাইয়া দেখতেও হ্যান্ডসাম। তোর সাথে মানাবে। আঙ্কেলের না মানার কোনো চান্সই নেই। তাহলে তোর কী সমস্যা?”
“বলেছি তো আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।”
“ধুর! এতদিন ভাবিসনি তো কী হয়েছে? এখন ভাববি। তোর মাথায় যে বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে মাবুদ জানে। গাধা একটা। তাজ ভাই সাধে তোকে বলদ বলে না।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
“তাহলে আরেকটা বলদ খুঁজে নিয়েই বিয়ে করব। এটা ভালো হবে না?”
“ধুর! আকাইম্মা পোলাপাইন।”
আমিরা আপু প্রচণ্ড বিরক্ত। তাই তার সাথে কথা বাড়ালাম না। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। আমিরা আপু শোয়ামাত্রই ঘুমে বেহুঁশ হয়ে গেল। আমার চোখে সহজে ঘুম ধরা দিলো না। ঘুমেরা আজ লুকোচুরি খেলছে। অনেকক্ষণ অবধি এপাশ-ওপাশ করে সারাদিনের রোমাঞ্চকর সব অনুভূতি স্মরণ করলাম। রাত দেড়টার দিকে চোখ লেগে এল। কিন্তু কাঁচা ঘুমের বারোটা বাজাল ফোনের রিংটোন। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে দেখলাম তাজ ভাইয়ের মিসড কল। ভ্রুকুটি করে কিছু একটা ভেবে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। সতর্ক দৃষ্টিতে আমিরা আপুর দিকে তাকালাম। তার ঘুম বেশ কড়া। সহজে ঘুম ভাঙবে না। তার ওপর আজ সারাদিন হাঁটাহাঁটি করেছে। ফোনটা হাতে তুলে আমি নিঃশব্দে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্যাম্পিং ফায়ার নিভে গেছে বহু আগে। বাইরে বেরোতেই ঝকঝকে চাঁদের আলো এসে সারা গায়ে আছড়ে পড়ল। ভরপুর জোৎস্না রাতেও এই নির্জন পরিবেশে কেমন গা ছমছম করে উঠল। দুরুদুরু বুকে আমি সামনে পা বাড়ালাম। দূর থেকেই দেখতে পেলাম সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব। দ্রুত গতিতে পা ফেলে আমি এগিয়ে গিয়ে অবয়বটির পাশে দাঁড়ালাম। কিন্তু তার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। নীরব চোখে সমুদ্রের বড়ো ঢেউয়ের ভীড়ে তার দৃষ্টি যেন কোনো গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাথার ওপরের চাঁদটার আলোক রশ্মি সমুদ্রের পানিতেও পড়েছে। প্রত্যেকটা ঢেউ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড়ো মনোরম পরিবেশ। মনে হচ্ছে অপরূপ সুন্দর এক রাজ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এ রাজ্যের কানায়-কানায় শুধুই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। বড়ো-বড়ো ঢেউগুলো বিকট শব্দে গর্জন করে ছুটে এসে কূলে আছড়ে পড়ছে। নাম না জানা কোনো এক পাখি কাছে কোথাও ডেকে চলেছে। অদ্ভুত তার সুর। অন্য সময় হলে ভয় লাগত। এই মুহূর্তে ভয় আমাকে স্পর্শ করতে পারল না। পাশে যেন অদ্ভুত এক মনোবল দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে উনি আপন মনে মৃদু শব্দে গেয়ে উঠলেন,

তুমি কখনও আমায় ভালোবাসোনি,
আমি ফিরে এসেছি
তুমি ফিরে আসোনি।
সীমানা ছাড়িয়ে, কেন দূরে দাঁড়িয়ে?
আজ দেখছ আমায়
কেন এমন করে?

প্রবল ঢেউয়ের তান্ডবের সাথে এই সুর কেমন বুকের ভেতর কাঁপন ধরাল। আমি একটুখানি কাছে সরে দাঁড়ালাম। কোনো এক জাদুবলে আমার হাত দুটো পাশের বলিষ্ঠ বাহুটাকে আঁকড়ে ধরল। অতঃপর কাঁধের একটু নিচে মাথা ঠেকিয়ে সমুদ্রের তোলপাড় দেখতে-দেখতে আনমনে বললাম,
“এত-এত অভিযোগ তো আমি মেনে নিব না। কেউ যেচে য’ন্ত্রণা বাড়ালে আমার কী করার? আজীবন আমি দর্শকই থেকে গেলাম। পরিচালক যা ইচ্ছে বুঝিয়ে দিবে, আর আমি তা-ই বিশ্বাস করব।”
প্রত্যুত্তরে উনি মৃদু শব্দে হাসলেন। রয়েসয়ে জবাব দিলেন,
“ভাগ্যিস পরিচালক তার বন্ধুর জীবনের সাথে জড়িয়ে দিতে চায়নি।”
খোঁচা মা’রা হলো বুঝি? চোখ তুলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। চাঁদের এই মায়া বুঝি ওই মুখটাতেও ভর করেছে। আমি ওই মায়ায় জড়াতে গিয়েও চাপা অভিমান নিয়ে সরে দাঁড়ালাম। পরমুহূর্তেই উনি আমার ডান হাতটা মুঠোয় আবদ্ধ করে সামনে পা বাড়ালেন। অগত্যা আমিও এগিয়ে গেলাম। সমুদ্রে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার উনি মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মুঠোবন্দী হাতটা তুলে ধরলেন। হুট করেই ডান হাত দিয়ে আমার অনামিকা আঙুলে কিছু একটা পরিয়ে দিলেন। আমি চকিতে আঙুলের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। ছোট্ট একটা লতানো ঘাসফুলে মোড়ানো রিং। চকচকে দৃষ্টি তুলে তাকাতেই দুটো গভীর চোখে ধরা পড়ে গেলাম। উনি মাথা তুলে একবার আকাশের চাঁদটা দেখলেন। অতঃপর আমার মুখে শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কেমন নমনীয় স্বরে আওড়ালেন,
“আমৃত্যু ব্যক্তিগত মানুষের ব্যক্তিগত চাঁদ হয়ে থাকো ইলুরানি। আকাশের চাঁদেরও যেন হিং’সা হয়।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here