মনোহরিণী পর্ব -২১+২২

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২১.
ঢাকায় ফেরার দুদিন হলো। কিন্তু এখনও জানতে পারলাম না তাজ ভাই কোন প্ল্যানিংয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নিয়ে এসেছেন। যে জিজ্ঞেস করেছে তাকেই বলেছে সময়মতো বলবে। এরমধ্যে আজ সবাইকে ধরে-বেঁধে জেনিফার ভাবিদের বাসায় নিয়ে এসেছেন রাজ ভাই। কেউ আসতে রাজি ছিল না। জেনিফার ভাবির আত্মীয়-স্বজন যারা বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল, তারা সবাই চলে যাবে। সেজন্যই আবার এই আয়োজন। জেনিফার ভাবির কাজিনগুলোকে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হয় না। কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে! অসভ্য লোকটাও এসে হতে জেসিকা আপুর সাথে সুপার গ্লুর মতো চিপকে আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে আসতে হয়েছে বলে আমাদের সবার মাঝেই একটা অলস ভাব জেঁকে বসেছে। এসে হতে সবাই এক জায়গায় বসে আছি। রাজ ভাইয়ের শাশুড়ি একের পর এক খাবার সামনে হাজির করছে, সেগুলো সব আদনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়ার পেটেই চালান হচ্ছে। হুট করে জেসিকা আপু আর তাজ ভাই প্রস্তাব রাখলেন, সবাই মিলে কোনো গেম খেলা হবে। কেউ আগ্রহ প্রকাশ করল, কেউ নারাজ। দুজন মিলে পরিকল্পনা করে গেম খেলতে এসেছে, হুহ্। এই লোক সুইডেনে সুন্দরী মেয়েদের ভিড়ে যে কী কী অকাজ করে এসেছে, তা নিয়ে মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়। এই তো জেসিকা আপুর সাথে গলায়-গলায় ভাব। অথচ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলবে, আমরা খুব ভালো ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ড না ছাই। কী গেম খেলা হবে, এই নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। প্রথমে ঠিক হলো লুডু খেলা হবে। কিন্তু লোকসংখ্যা বেশি, তাই বাদ দেওয়া হলো। তারপর এটা-ওটা করতে-করতে শেষে ঠিক হলো ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা হবে। এমনিতেও আমি মনে-মনে ভেবেছিলাম খেলব না। তারমধ্যে এই খেলার নাম শুনেই আমি সঙ্গে-সঙ্গে নাকচ করে দিলাম। জেসিকা আপুর রুমে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসল। আমি আর আমিরা আপু একদমই নারাজ। আমিরা আপু বলল,
“আর কোনো গেম খুঁজে পান না আপনারা? সবসময় ঘুরেফিরে এক গেম বিরক্ত লাগে।”
তাজ ভাই আমাদের দুজনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন। খেলা শুরু হলো জেসিকা আপুকে দিয়ে। সে ডেয়ার নিল। তাজ ভাই বলে বসলেন,
“তোমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি দেখাও।”
জেসিকা আপু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
“তাজ, হোয়াট ইজ দিস? তুমি সুযোগ বুঝে আমাকে বাঁশ খাওয়ানোর চেষ্টা করছ?”
“এখানকার কেউ তোমাকে বাঁশ খাওয়াবে না। তুমি শুধু তোমার কাজিনদের ম্যানেজ করে নিয়ো।”
“নো ওয়ে। এটা বাদ দাও, অন্য যেকোনো কিছু দাও।”
জেসিকা আপুর এক কাজিন বলে উঠল,
“আপু, আমরা কাউকে বলব না। প্রমিস। তুমি দেখাও না প্লিজ।”
“একদমই না, এক্ষেত্রে আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।”
জেসিকা আপুকে অনেক জোরাজুরির পর সে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“ঠিক আছে,‌ দেখাচ্ছি। কিন্তু কেউ এই খবর বাইরে প্রকাশ করতে পারবে না। আমি আপাতত চাই না আব্বু-আম্মু এসব জানুক।”
সবার সম্মতিতে শেষে জেসিকা আপু তার বয়ফ্রেন্ডের ছবি দেখাল। সঙ্গে-সঙ্গে তার কাজিনদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম ছেলেটা তাদের পরিচিত। জেসিকা আপুর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই পড়ে। এতক্ষণে বিশ্বাস হলো সত্যিই জেসিকা আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। তবু তাজ সাহেবের সাথে এত খাতির কেন কে জানে? এদিকে আমিরা আপু চাপা স্বরে আনন্দ প্রকাশ করছে।
“উফ্! ভালো হয়েছে এই জেসিকা আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। নইলে নিশ্চিত আমার কলিজা, ফুসফুস নিয়ে টানাহেঁচড়া করত। বাঁচা গেল।”
একে-একে সবাইকে যত অদ্ভুত ট্রুথ, ডেয়ার দেওয়া হচ্ছে। আমার পালা এলে আমি বললাম,
“আমি বারবার বলেছি না আমি খেলব না? আমার এসব ভালো লাগে না। তোমরা খেল, আমাকে বাদ দাও প্লিজ।”
কিন্তু কাউকে সে কথা শুনাতে পারলাম না। সবাই মিলে জোরাজুরি শুরু করল। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ট্রুথ নিলাম। এদের উলটা-পালটা ডেয়ার নেওয়া মানে যেচে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মা’রা। জেসিকা আপুর এক কাজিন আমায় ট্রুথ দিলো,
“তোমার জীবনের একটা সিক্রেট বলো, যা আজ পর্যন্ত কাউকে বলনি।”
খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম, আমার জীবনের সিক্রেট আমি নিজেই জানি না। প্রয়োজনের সময় কোনোকিছুই মনে পড়ে না আরকি। বহুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর একটা কথা মনে পড়ল, কিন্তু তা বলতে ভীষণ দ্বিধা বোধ করলাম। কাঁচুমাচু করে শেষে বলেই ফেললাম।
“কয়েক বছর আগের কাহিনি এটা। আমার এক কাজিনের বিয়ে ছিল। প্রোগ্রাম ছিল রাতে। আমার হঠাৎ খুব পানি পিপাসা পেয়েছিল, কিন্তু পানির গ্লাস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গ্লাস খুঁজতে-খুঁজতে আরেক কাজিনের রুমে ঢুকে পড়েছিলাম। ওই রুমের দরজা ভেজানো ছিল। তো আমি ভেবেছিলাম ভেতরে কেউ নেই। কারণ সবাই কাজে ব্যস্ত। কিন্তু দরজা খুলে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে নিজেই আহাম্মক বনে গিয়েছিলাম। ঘরটা অন্ধকার ছিল।”
মিনহা আপু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
“অন্ধকার ঘরে কে ছিল রে? কোনো হ্যান্ডসাম ছেলে?”
দেখলাম সবাই খুব উৎসুক দৃষ্টি তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি রয়েসয়ে বললাম,
“শুধু ছেলে না, মেয়েও ছিল। আসলে আপু আর ভাইয়ার রোমান্সের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। তারা অবশ্য সঙ্গে-সঙ্গে দূরে সরে গিয়েছিল। আমিও নিজেকে সামলে দ্রুত বাইরের আবছা আলোয় টেবিলের দিকে গিয়ে গ্লাস নিয়ে চুপচাপ কে’টে পড়েছিলাম। মাঝখান থেকে তারা ভেবে নিয়েছিল আমি কিছুই দেখিনি। আমি তো সেদিন কানে ধরেছি, এভাবে আর বিবাহিত মানুষজনের রুমে ঢুকব না।”
এই নিয়ে সবাই বেশ মজা পেল। আনহা আপু হুঁ-হা করে হাসতে-হাসতে বলল,
“একদম সঠিক সময়ে অ্যান্ট্রি নিয়েছিস তুই, ইলো। না দেখার ভান করে ভুল করেছিলি। তোর উচিত ছিল খুব অবাক হওয়ার ভান করে কিউট করে জিজ্ঞেস করা, অ্যাই, তোমরা কী করছ।”
হাসাহাসির মধ্যে জুম্মান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“এই ইলো, তারা কি চুমু-টুমু খাচ্ছিল?”
আদনান ভাইয়া তাকে থা’প্পর মে’রে বললেন,
“তা-ও শুনতে হবে তোর? অশ্লীল পোলা-মাইয়াগুলা।”
তাজ ভাই বললেন,
“এই জেসি, ভাইয়া আর ভাবিকে সাবধান করে দিয়ো তো। এই মেয়ে আবার কখন তাদের রোমান্সে এলাচি হয়ে ঢুকে পড়ে, তার তো ঠিক নেই। বলা তো যায় না, পুরোনো অভ্যাস পুনরাবৃত্তি হয়েও যেতে পারে।”
আমি উত্তর দিলাম,
“এমন হলে তো আমি আপনার রোমান্সেও ঢুকে পড়তে পারি।”
উনি বেহায়ার মতো উলটো বলে দিলেন,
“নো প্রবলেম। ছোটোদের জন্য আমি এটুকু দয়ালু হতেই পারি। বাচ্চাদেরও তো শিখতে হবে। বড়োরা না শেখালে বাচ্চারা শিখবে কীভাবে? আমার থেকে যদি শেখে, তাহলে সমস্যা কোথায়? তুই চাইলে বাসর রাতেও আমার রুমে ঢুকে যেতে পারিস।”
জুম্মান ভাইয়ারা হৈ-হৈ করে উঠল। যেন এখনই তারা সবাই তাজ সাহেবের বাসর ঘরে ঢুকে পড়েছে। অনেক হৈ-চৈ করে আবার শুরু হলো গেম। সৌরভ ভাইয়াকে জোর করে ডেয়ার দেওয়া হলো, এখন থেকে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা তার জন্য ফোন নিষিদ্ধ। এই চব্বিশ ঘন্টা তার ফোন থাকবে জুম্মান ভাইয়ার কাছে। সময় শেষ হলে আবার ফেরত দেওয়া হবে। সৌরভ ভাইয়া এমন অবিচার হজম করতে পারল না। ফোন দিতে সে কোনোভাবেই রাজি না। ওটা হচ্ছে তার প্রাণভোমরা। কিন্তু এতগুলো মানুষের সাথে পেরেও উঠল না। অবশেষে অসহায় বালকের মতো কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফোনটা জুম্মান ভাইয়ার হাতে তুলে দিলো। জুম্মান ভাইয়া তো ইদের চেয়েও বেশি খুশি হলো। সৌরভ ভাইয়ার মুখটা দেখেই সে মজা নিচ্ছে। তাজ ভাইকে ট্রুথ দিতে চাইলে উনি নাকচ করে দিলেন। কিছুতেই ট্রুথ নিবে না সে। চো’রের মন পুলিশ-পুলিশ। তাকে কোন ধাঁচের প্রশ্ন করা হবে তা সে খুব ভালোভাবেই জানে। সেজন্যই ইচ্ছে করে ব্যাপারটা থেকে নিস্তার পেতে চাইছে। পরে তাকে ডেয়ারই দেওয়া হলো। আদনান ভাইয়া রুমে একটা ব্যাট পেয়ে সেটা তাজ ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি ছাড়া এদের মধ্যে যার মাথা ফাটাতে মন চায়, ফাটিয়ে দে। তোর জন্য দারুণ সুযোগ।”
আদনান ভাইয়া মজা করে ডেয়ারটা দিয়েছে বলে সবাই না, না করে উঠল। তাজ ভাই নিজেও না করলেন। আদনান ভাইয়া বললেন,
“আরে ভাই, এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে? তোকে কেউ পু’লিশে দিবে না, চাকরিও খাবে না। ইটস্ জাস্ট ফর ফান। মাথায় না হলে পিঠে মে’রে দিবি।”
জেসিকা আপুর কাজিন বলল,
“আপনি নিজে কে’টে পড়ে আমাদের ফাঁসালে তো চলবে না। এটা চিটিং।”
আদনান ভাইয়া তাজ ভাইয়ের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে, আমিও আছি। বেয়াইন সাহেবার মর্জি কবুল।”
তাজ ভাই ব্যাটটাকে যেভাবে ঘুরাচ্ছেন, মনে হচ্ছে সে ক্রিকেট খেলতে নেমেছে। এক্ষুনি কারো মাথাটা বল বানিয়ে ছক্কা মে’রে দিবে। সবাই সন্দিহান, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তাজ ভাই হেঁটে-হেঁটে যেদিকেই যাচ্ছে, সেদিকেই একেকজন চোখ বন্ধ করে জড়োসড়ো হয়ে অনুরোধ করছে। জুম্মান ভাইয়ার কাছে গিয়ে ব্যাট উঁচু করতেই সে দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল,
“ব্রো, ব্রো, ব্রো। মাফ চাই, দয়া করো। তোমাকে রোজ দুই টাকার চকলেট খাওয়াব, প্রমিস।”
কিন্তু তাজ ভাই মজা করে ব্যাট উঁচু করেছিলেন। এবার সবার সামনে থেকে সরে পেছনে ঘুরছিলেন উনি। কখন যেন দুম করে তাল ফেলেন কারো পিঠে। আতঙ্কে কেউ পেছন ফিরেও তাকাচ্ছে না। আদনান ভাইয়া তাড়া দিচ্ছেন। প্রায় দুই মিনিট পর হুট করে ব্যাটটা আমার পিঠেই পড়ল। শব্দ শুনেই আমি মুখ চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার চেঁচানো শুনে বাকিরাও চমকে উঠল। কিন্তু যখন আতঙ্ক কে’টে গেল, তখন খেয়াল হলো ব্যাটটা আমার পিঠে পড়লেও, ব্যথাটা আসলে আমি পাইনি। ব্যাট আমার পিঠে লাগার আগেই একটা শক্ত হাত আমার পিঠে ঠেকেছিল। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিক থেকে সবাই চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করছে আমার বেশি ব্যথা লেগেছে কি না। অথচ ওই মানুষটা নির্বিকার ভঙ্গিতে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটটা এখনও হাতে ঘুরাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। বিমর্ষ মুখটা সামলানোর চেষ্টা করে আমি সবাইকে জানালাম, তেমন ব্যথা পাইনি। তাজ ভাই বললেন,
“আরে রিল্যাক্স গাইস। আমি এত নির্দয় না কি? বাচ্চা মানুষ তো, দয়া করে আস্তে মে’রেছি। জোরে মা’রলে তো এতক্ষণে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে নাকের পানি, চোখের পানি এক করত।”
সবাই বিশ্বাস করে নিল তাজ ভাই আস্তে মে’রেছেন। দুপুরের খাবারের পর একটা সময় সুযোগ পেয়ে ওনার হাত পরীক্ষা করলাম। উনি বাঁধা দিলেন না, চুপ করে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলেন। আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“হাসছেন কোন সুখে?”
“ব্যথা তো পাইনি, কাঁদব কোন দুঃখে?”
“এতগুলো মানুষের মাঝে আপনি আমাকেই চোখে দেখলেন? কেন? জেসিকা আপুর মাথায় মা’রতে পারলেন না?”
“তুই হিং’সুটে বলেই তোকে মে’রেছি। মাথায় মা’রলে ঠিক হত। মাথা থেকে সব ভূ’ত নেমে যেত।”
“তো নিজের হাতে মা’রলেন কোন দুঃখে?”
“আমি যে দয়ার সাগর, সেই সুখে। তোর কোনো সমস্যা? না কি মাথায় বাড়ি খেতে চাইছিস? এখন দিবো? শর্ত হচ্ছে, অজ্ঞান হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।”
আমি শক্ত মুখে বললাম,
“আপনি না ডিটেকটিভ হয়ে ভুল করেছেন। আপনার উচিত ছিল গ্যাংস্টার হওয়া। ওই পেশাই আপনার জন্য পারফেক্ট ছিল।”
সারাদিনে যতটা সময় ওই বাসায় ছিলাম, একদমই ভালো সময় কা’টেনি। বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যায়। ফ্রেশ হয়ে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন একটা ম্যাসেজ এল। সঙ্গে-সঙ্গেই সেটা অন করলাম।

মনোহারিণী,
কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যদি পাপ না হত, আজ তোমায় মা’রার এক পার্সেন্ট চান্সও যদি থাকত; তবে আমি সেটা কাজে লাগাতাম। সব ব্যথা চুকিয়ে নিতাম। অতঃপর এই নশ্বর পৃথিবীর এক ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নিতাম। কিন্তু আমি তো এত তাড়াতাড়ি শ্বাসকষ্টে ভুগতে চাই না। নেহাত আমার বেঁচে থাকার তাগিদ আছে, সুস্থ শ্বাসকার্যের প্রয়োজন আছে, তাই তো এক জীবন্ত যন্ত্রণাকে অতি যত্নে অন্তস্তলে জিইয়ে রেখেছি।

ম্যাসেজটা বার কয়েক পড়ে ফোনটা রেখে দিলাম। অনেকটা সময় বিছানায় পড়ে রইলাম, কিন্তু ঘুম এল না। তারপর বিছানা ছেড়ে চলে গেলাম বিপরীত দিকের রুমটার দিকে। দরজার নব ঘুরিয়ে একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলাম। ডাকলাম,
“শুনুন?”
উনি বই ঘাঁটছিলেন। ডাক শুনে মাথা তুলে তাকালেন। আমি পুনরায় বললাম,
“ট্রুথ, ডেয়ার গেমে আর কখনও আমায় টানবেন না। গেমটা আমার ভালো লাগে না।”
উনি ত্যাড়াভাবে উত্তর দিলেন,
“আমি খুব পছন্দ করি। তাই সবসময় সবাইকেই টানব। তোর পছন্দ না হলে তুই দূরে গিয়ে ম’র।”
আমি কিঞ্চিত রাগত স্বরে বললাম,
“হ্যাঁ, পছন্দ তো হবেই। আমাকে যত অপমান তো এই ফালতু গেমটার জন্যই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অযথা কেন ওমন করেছিলেন, সেটা পর্যন্ত বলেননি আজও। আপনি ইচ্ছে করে সুযোগ কেন নিয়েছিলেন, এবার জানতে পারি?”
উনি বই রেখে এগিয়ে এলেন। দরজা ধরে মাথা ঝুঁকে বললেন,
“তোর বয়ফ্রেন্ডের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার জন্য দয়া করেছিলাম।”
তারপর ঠাস করে মুখের ওপর দরজা আটকে ফেললেন। আমার রাগ বেড়ে গেল। দরজায় জোরেশোরে থা’প্পর মে’রে গজগজ করতে-করতে সরে গেলাম। রাতেই তাজ ভাই ঘোষণা দিলেন তার প্ল্যান হচ্ছে সবাইকে নিয়ে একটা ট্যুরে যাওয়া। এই অছিলায় রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবির ছোটোখাটো একটা হানিমুনও হয়ে যাবে। যদিও কদিন পরেই তারা বাহিরের দেশে হানিমুনে যাবে। কিন্তু এই ট্যুরটা তাজ ভাইয়ের তরফ থেকে। ঘোষণা শুনে সবাই আনন্দে নেচে উঠল। কিন্তু তারপরই উনি জানালেন আগামীকাল সকালেই রওয়ানা হবেন। আজ রাতের মধ্যে যেন সবাই যার-যার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। এটা শুনে একেকজনের মাথায় হাত পড়ল। আমিরা আপু দুঃখ প্রকাশ করল, আগে জানলে সে কেনাকাটা করে রাখত। রাতে ঘুম বাদ দিয়ে ব্যাগপত্র গোছাতে হবে ভেবেই আমার কাঁদতে বসে পড়তে ইচ্ছে করল। ট্যুরে যাওয়ার কথা শুনে সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা আর আনন্দের সাথে ব্যাগ গোছানোর অলসতাও দারুণভাবে জেঁকে বসেছে। তার ওপর আবার কাল সবাইকে খুব সকালে উঠতে হবে। সব মিলিয়ে আমাদের মাথা ঘোরার জোগাড় হলো। দ্য গ্রেট তাজ সাহেবের প্ল্যান বলে কথা! এটুকু ধাক্কা তো খেতেই হবে। না হলে এই ট্যুর হজম হবে না কি?
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২২.
আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল সাড়ে সাতটায়। সংখ্যায় দশ জন সদস্য আমরা। রাজ ভাই, তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া, আদনান ভাইয়া, জুম্মান ভাইয়া, সৌরভ ভাইয়া, জেনিফার ভাবি, আমিরা আপু, আনহা আপু আর আমি। মিনহা আপুর পরীক্ষার কারণে সে যেতে পারবে না। আমাদের এই ট্যুরের কথা শুনে বেচারি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। তাজ ভাই তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে সুযোগ বুঝে তাকেও কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে। গতকাল সবাই অনেক রাত পর্যন্ত নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়েছিল। তাই ঘুমানোর জন্য বেশি সময় পায়নি। ঘুমকে উড়িয়ে দিয়ে সকাল-সকাল সবাইকে উঠতে হয়েছে। সকালের নাস্তা সেরে, রেডি হয়ে তবেই বাসস্ট্যান্ডে এসেছি। বাসে ওঠার সময় ঘটল বিপত্তি। তাজ ভাই হুট করে আমার হাত চেপে ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। এহেন কাণ্ডে আমি অবাক হয়ে গেলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। চাপা স্বরে রাগ দেখালাম, তাতেও লাভ হলো না। একে-একে সবাই বাসে ওঠার পর উনি নিজে উঠে তবেই আমাকে উঠতে দিলেন। ততক্ষণে একে-একে সবাই সিটে বসতে শুরু করেছে। লোকজন সিট দখল করতে লেগে পড়েছে। সেই ফাঁকে তাজ ভাই আবার আমার হাত টেনে ধরে মাঝের সারির দিকে নিয়ে গিয়ে জানালার পাশের সিটে ঠেলে বসিয়ে, নিজে পাশে বসে পড়লেন। আমি সঙ্গে-সঙ্গে আপত্তি জানালাম।
“আমি আমিরা আপুর সাথে বসব। আপনি উঠুন।”
“আমিরা আনহার সাথে বসেছে দেখতে পারছিস না? এখন বসতে চাইতে পারিস শুধু ভাবির সাথে। কিন্তু তাহলে তো আমার ভাইয়ের হানিমুনের শুরুতেই ব্যাঘাত ঘটে যাবে। ভাই হয়ে ভাইয়ের এত বড়ো ক্ষ’তি তো আমি করতে পারি না। তাই যেখানে আছিস সেখানেই সন্তুষ্ট থাক।”
“সারা রাস্তা আপনার আজাইরা কথা শুনে আমার পক্ষে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব না। মিনহা আপুকে এখানে আসতে বলে আমি আমিরা আপুর সাথে বসব। সরুন।”
“পারলে বল।”
মিনহা আপুরা সামনের দিকে বসায় এত মানুষের সামনে ডাকতেও পারলাম না। ফোন বের করলাম ম্যাসেজ করার জন্য। কিন্তু ম্যাসেজ টাইপ করা ধরতেই পাশের ব’দ লোক ছোঁ মে’রে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিপরীত দিকের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। আমি ফোন নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু উনি বললেন,
“ফোন নিষিদ্ধ।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না তাজ ভাই। ফোন ফেরত দিন।”
“এখন তো আরও আগে দিবো না। পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ ভদ্র ছেলেকে তুই ফা’জিল বলেছিস। তাই এটা তোর শা’স্তি।”
ইচ্ছে করছে এখান থেকে উঠে চলে যেতে। কিন্তু ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। উঠলে বেরোতেও দিবে না এই লোক। কিছুক্ষণ বৃথা রাগ দেখিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। এই লম্বা জার্নি যে কতটা বিরক্তিকর হতে চলেছে, ভাবতেই জানালা টপকে লাফিয়ে নেমে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এমন হলে আজই এই ধরায় আমার জীবনের শেষ দিন হবে। এত সহজে জীবন উৎসর্গ দিতে আমি মোটেও রাজি নই। সিদ্ধান্ত নিলাম সারা পথ এই আপদের সাথে একটাও বাক্য ব্যয় করব না। আট ঘন্টার মৌনব্রত পালন করব। মাথা উঁচিয়ে দেখলাম বাস ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের টিম ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়তো সবাই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবে। ঘুম যে আমারও আসছে না তা নয়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমি ঘুমাতে চাইছি না। কিছুক্ষণ পর একটু ঘুমিয়ে নিব। তারপর ঘুমটা কা’টিয়ে উঠে প্রকৃতি উপভোগ করব। জানালা দিয়ে বেশ ফুরফুরে বাতাস আসছে। আমি জানালার একদম কাছ ঘেঁষে বসে বাতাসটা গায়ে মাখালাম। তাজ ভাই নিজের ফোন বের করে বসেছেন। অথচ আমার ফোনটা জিম্মায় রেখে দিয়েছেন। পাজি লোক। নিজে শান্তিতে থাকবে, আর সব অশান্তির ভূত খুব যত্ন সহকারে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে। খুব বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারলাম না। বাকিদের মতো আমার চোখেও ঘুম ভর করছে। না চাইতেও বারবার ঘুমে ঝিমাচ্ছি। ঠিকঠাক মতো ঘুমটা আর হচ্ছে না। হুট করে তাজ ভাই আমার মাথাটা ওনার বাহুতে রাখলেন। আমি তড়াক করে সোজা হয়ে বসে সরু চোখে তাকালাম। উনি আবার একই কাজ করলেন। আমিও আবার সরে এলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“মুরগির মতো ঝিমালে জানালা দিয়ে ক্রিকেট বলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিবো।”
আমি প্রত্যুত্তর না করে গাল ফুলিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। তা-ও লাভ হলো না। একটু ঘুম এলেই বারবার সিট থেকে মাথা গড়িয়ে পড়ছে। ঘুমের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে হাত পেতে আরেকবার মিনতি করলাম,
“ফোন দিন না।”
“কানের নিচ বরাবর দিবো,” চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন উনি।
আমি মুখ কালো করে হাত নামিয়ে নিলাম। মিনিট খানেক বিমর্ষ মুখে বসে রইলাম। তারপর বিরক্তি নিয়ে নিজেই ওনার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। উনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঠান্ডা লাগছে? জানালা বন্ধ করব?”
“উঁহু।”
বাহুতে হেলান দেওয়ায় পারফিউমের তীব্র সুগন্ধ হুরহুর করে নাকে ঢুকে পড়ছে। গন্ধটা সুন্দর, কিন্তু এই মুহূর্তে গন্ধটা ভীষণ বিরক্ত লাগল। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
“সবসময় এমন পারফিউমের বোতল ঢেলে দিবেন না তো। খালি মেয়ে পটানোর ধান্দা?”
“মেয়ে পটানোর জন্য আমার পারফিউমের প্রয়োজন পড়ে না, ইলুবতী। মেয়েরা আমাকে দেখলে এমনিতেই পটে যায়। হিং’সুটে মেয়েরাও কিন্তু পটে যায়।”
“যেই না চেহারা, তার আবার কত অহং’কার!”
“বুঝি, বুঝি। হিং’সুটেরা সুদর্শনদের এটুকু হিংসা করেই। আই ডোন্ট কেয়ার।”
আমি কিঞ্চিত রাগত চোখ তুলে তাকালাম। উনি এক ভ্রু উঁচিয়ে মৃদু হাসলেন। ক্রো’ধে ওনার বাহু চেপে ধরে শক্ত মুখে বললাম,
“ঘুমাব আমি।”
উনি আমার মাথা পুনরায় বাহুতে রেখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। চোখে পুরোদস্তুর তন্দ্রা নামতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগল না। বেশ লম্বা একটা ঘুম দিলাম। তবে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটার কারণেই ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে বুঝলাম তাজ ভাই নিজেই ইচ্ছে করে ঘুম ভাঙিয়েছেন। হামি তুলে সোজা হয়ে বসে শুধালাম,
“কী হয়েছে?”
“সারা রাস্তা পড়ে-পড়ে ঘুমালে ট্যুরে যাওয়ার কী দরকার?”
“জার্নিতে আমি অত ঘুমাতে পারি না।”
“এতক্ষণ কে ঘুমাল? আমি?”
“সে তো রাতে ঘুম হয়নি বলে ঘুমিয়েছি। আর সিটে হেলান দিলে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারতাম না।”
“তো যাকে বালিশ বানানো হলো তাকে বিনিময়ে কিছু দিন।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কেউ যেচে বালিশ হতে চাইলে আমার কী করার?”
“তখন তো দয়া করেছিলাম, তা-ও দয়া ভালো লাগেনি। কিন্তু পরেরবার তো কেউ ইচ্ছে করেই ঘুমাল। এখন আমি তো আমার পাওনা ছাড়ব না।”
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
“আপনার মতো দয়ার সাগর হঠাৎ বিনিময়ের হিসাব করছে কেন?”
“আমি কোনো স্বার্থপরদের দয়া করি না।”
“কিসের স্বার্থ?”
“ভালো থাকার।”
“আপনি খারাপ থাকেন কবে? পারলে তো চব্বিশ ঘন্টার পঁচিশ ঘন্টা চিল মুডে থাকেন।”
উনি কেমন আপন মনে হাসলেন। ব্যাগ থেকে জুসের বোতল বের করে এগিয়ে ধরলেন। আমি গলা ভিজিয়ে নিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ক্ষুধা পেয়েছে?”
“না।”
সময়গুলো বেশ ভালোই কা’টল। বাইরের প্রকৃতি উপভোগ করলাম মনভরে। ট্যুরের বিষয়ে নানা প্রশ্ন করলাম। উনি সব শুনলেন, প্রতিটা উত্তর দিলেন। হাত চেপে ধরে শাসা’লেন,
“ওখানে গিয়ে যদি অবাধ্য হয়েছো, তাহলে ডিরেক্ট সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবো।”
“আপনার থেকে দশ হাত দূরে থাকব।”
“শ্রেয়ানের প্রোটেকশনে?” চাপা স্বরে বললেন উনি।
“প্রয়োজনে তাই করব। শ্রেয়ান ভাইয়া আপনার মতো ব’দ না। যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি।”
“আচ্ছা? তাহলে শ্রেয়ানের কপালে এক আস্ত বলদ আছে না কি ?”
“ওমন হলে আপনার বন্ধুর সাত কপাল হবে।”
“আশা আছে মনে হচ্ছে?”
“থাকতে দোষ আছে?”
সঙ্গে-সঙ্গে উনি আমার বাহু চেপে ধরে মিষ্টি হেসে বললেন,
“গোটা পাঁচেক ইট বেঁধে সমুদ্রের মাঝ বরাবর ডু’বিয়ে দিবো।”
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
“কেন? আপনার এত সমস্যা কিসে? আপনি যখন সুইডিশ সুন্দরীদের সাথে ইংরেজিতে প্যাঁক-প্যাঁক করেন, তখন তো আমি বলতে যাই না আপনার ল্যাপটপ পানিতে ডুবিয়ে দিবো।”
“ওরা আমার ফ্রেন্ড, জাস্ট ফ্রেন্ড। কেউ যে মনে-মনে ওদের হিংসা করে জ্ব’লে ম’রে, তা আমার জানা আছে।”
“এই আপনি কথা বলবেন না তো আমার সাথে।”
“তোকে কে বলতে বলেছে? নিজেই একশো বার বলিস কথা বলবেন না, আবার নিজেই বকবক শুরু করিস। আগে নিজের মুখ বন্ধ রাখ।”
“আপনি যে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে কথা বের করেন, সেই বেলায়? এখন সাধু সাজছেন? আপনিও মুখ বন্ধ রাখুন, আর এই হাতটাও,” আমার বাহু ধরা ওনার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম।
কিন্তু এত দীর্ঘ পথ কি আর মুখে কুলুপ এঁটে পার করা যায়? মহাশয় নিজেই মিনিট দশেক পার হতেই মুখের বাঁধ খুলে ফেললেন। আমি আনমনে হাসলাম। একটু পরেই আবার বলবে আমি বকবক করে তার মাথা খাই। দীর্ঘ আট ঘন্টার বাস ভ্রমণ মন্দ কা’টল না। কখনও মনোযোগ দিয়ে গল্প করা, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ, একটু-আধটু ভিডিয়ো করা, খাওয়া-দাওয়া, আবার ক্ষণে-ক্ষণে কথা কা’টাকা’টি, খুনসুটি। এভাবেই পেরিয়ে গেল গোটা পথ। বিকাল সাড়ে তিনটায় আমরা কক্সবাজার পৌঁছালাম। আমাদের লক্ষ্য সোনাদিয়া দ্বীপ। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামীকাল সকালে সোনাদিয়া দ্বীপে যাত্রা শুরু হবে। আজকের রাতটা রাজ ভাইয়ের এক ঘনিষ্ট বন্ধুর বাড়িতে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমাদের আসার খবর শুনে রাজ ভাইয়ের বন্ধু নিজেই এই আবদার করেছেন। আমন্ত্রণটা আমাদের জন্য ভালো মনে হয়েছে, বিধায় সবাই সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। রাজ ভাইয়ের বন্ধুর নাম ফাহিম। রাজ ভাই বউ সাথে নিয়ে এসেছে বলে ফাহিম ভাইয়ার মা নিজেই তাকে দিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ফাহিম ভাইয়া আমাদের রিসিভ করার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন। তার সাথেই আমরা তার বাড়ি গেলাম। বাড়িতে তার মা, বাবা আর ভাবি ছাড়া অন্য কাউকে দেখা গেল না। বাড়ি পৌঁছে তাদের সাথে টুকটাক কথা বলে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফাহিম ভাইয়ার মা-ভাবি আমাদের জমজমাট আপ্যায়ন করলেন। বউ, শাশুড়ি দুজনের আচরণই খুব সুন্দর। যতটুকু বুঝলাম, ফাহিম ভাইয়ার ভাবিকে তার মা নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তা দেখে আমিরা আপু আফসোস করে বলল,
“তাজ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে কাকিও আমাকে এমন মাথায় তুলে রাখবে, তাই না? আমার তো ভাবতেই আনন্দ লাগছে, আহ্!”
আনহা আপু মুখ বাঁকিয়ে কটাক্ষ করে বলল,
“ফুপি তার ছেলের বউদের মাথায় করেই রাখবে, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সে কি একবারও বলেছে তোমাকে ছেলের বউ করবে?”
“কাকি কি আর আমার মনের কথা জানে? জানলে হয়তো বউ করবে।”
“স্বপ্ন দেখা ভালো,” তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল আনহা আপু।
সন্ধ্যায় হালকা নাশতা করে রাজ ভাই আর ফাহিম ভাইয়ার বন্ধুত্বের গল্প শুনছিলাম। ফোনটা রুমে রেখে এসেছিলাম। ভাবলাম ফোনটা নিয়ে এসে আবার তাদের আড্ডায় বসব। কিন্তু রুমে ঢুকে আর বেরোনোর পথ পেলাম না। হুট করে তাজ ভাইও সেখানে উপস্থিত হলেন। কড়া গলায় আদেশ করলেন,
“রুম থেকে যেন আর বেরোতে না দেখি।”
“কেন?”
“না বলেছি তাই।”
“কেন? সমস্যা কী?”
“এত কৌতুহল কেন?”
“আপনি এই সন্ধ্যাবেলা রুম থেকে বেরোতে বারণ করছেন, তা জিজ্ঞেস করব না? ওখানে সবাই কত মজা করে আড্ডা দিচ্ছে, দেখেননি?”
“আড্ডায় মন টানছে, না ফাহিম ভাই?”
আমি খানিক থমকালাম। অবাক হয়ে বললাম,
“এসব কোন ধরনের কথা?”
“ফাহিম ভাই বারবার প্রেমময় চোখে তাকাচ্ছে দেখলাম। শ্রেয়ানকে ঘোলাজল খাইয়ে ফাহিম ভাইকে পটানোর চেষ্টা চলছে?”
আমি মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপনার আজাইরা কথাগুলো এই মুহূর্তে অন্তত বন্ধ রাখুন। আমি তো দেখলাম ফাহিম ভাইয়া মিনহা আপুর দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমার মনে হয় আপনার চোখের ডাক্তার দেখানো দরকার। নিন আপাতত আমার চশমাটা কাজে লাগান।
কথাটা বলেই আমি নিজের চশমাটা ওনার দুই কানের ফাঁকে গুঁজে দিলাম। উনি চশমাটা পুনরায় আমার চোখে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“নিজে কানা বলে আশেপাশের সবাইকে কানা মনে হয় তোর? আগে নিজের চোখের ট্রিটমেন্ট করা। দেখ আবার চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস কি না।”
“সরুন তো আপনি, যেতে দিন।”
ওনার পাশ কা’টিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি হাতের কবজি টেনে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“না বলেছি একবার।”
“আজব! আমি একা ঘরে বসে থাকলে সবাই কী ভাববে?”
“সে কথা আপনাকে না ভাবলেও চলবে। বিশ্রাম নিন, নইলে কালকের ট্যুরে যদি শুনি শরীর খারাপ লাগছে, রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাব। পান থেকে চুন খসলেই তো বিছানায় পড়ে থাকেন।”
ওনার বাড়াবাড়িতে আমি মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম। ওনার সাথে কথা বাড়াতে না পেরে হতাশ হলাম। বিরক্তির সুরে বললাম,
“তো আপনি এখানে এসে বসে আছেন কেন? যান এখান থেকে। বাড়াবাড়ি ভালো লাগছে না। নিজে গিয়ে বিশ্রাম করুন।”
উনি আর কথা না এগিয়ে চলে গেলেন। আমি ফোন নিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। দুই মিনিটের মাথায় ম্যাসেজ এল।
“ভালোবাসার বিনিময়ে আমি কেবল অজস্র যাতনাময় বিনিদ্র রজনী উপহার পেয়েছি। আর কত, মনোহারিণী?”
থমকানো দৃষ্টিতে চুপচাপ সেই ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে এই প্রথম এক গভীর অভিযোগে অভিযুক্ত হলাম। মিনিট তিনেক পর টাইপ করলাম।
“ছয় বছরেও এক অভিশপ্ত চিরকুটের ক্ষ’ত মুছতে তো কেউ আগ্রহ দেখায়নি। আর কত?”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে ফোন রেখে দিলাম। হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলাম। ঘুম প্রয়োজন। ‘বিনিদ্র রজনী’ শব্দটা বুকের ভেতর কেমন নাড়া দিয়ে উঠল। আমার অভিযোগের মূল্য তো কেউ দেয় না। জেনেশুনেও অভিযোগ এড়িয়ে চলে। তবে আজ কেন উলটো অভিযোগ করা হচ্ছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here