মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ২৯

#মরুর_বুক বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২৯

★আজ শুক্রবার ছুটির দিন। নূর আজ বায়না ধরেছে সে বেড়াতে যাবে।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতেই আদিত্যের কাছে এই বাইনা ধরে বসে আছে। আর নূর যখন কিছু চেয়েছে তখন তো আদিত্যের সেটা পূরণ করতেই হবে। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ ওরা ফ্যান্টাসি কিংডম যাবে বেড়াতে। নূর তো খুশিতে সারা বাড়ি নেচে বেড়াচ্ছে। আদিত্যের আর কি লাগে। নূরকে খুশী করতে পারলেই ও সার্থক।

আয়নার সামনে আদিত্য নূরকে রেডি করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নূর একটুও স্থীর ভাবে থাকছে না।বেড়ানোর এক্সাইটিং এ শুধু অস্থির পনা করছে। আদিত্য বলে উঠলো।
–একটু চুপ করে বসোনা এঞ্জেল। এতো নড়াচড়া করছ কেন? দেখ কাজলটাও দিতে পারছিনা।

নূর বিরক্তির সুরে বললো।
–আর দিতে হবে না কাজল ফাজল। তাড়াতাড়ি চলোতো। নাহলে সবাই আমাদের রেখে চলে যাবে।

–কেওই যাবেনা আমাদের রেখে। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। আমাকে কাজ করতে দাও।

নূরকে রেডি করা শেষে আদিত্য নূরকে নিয়ে নিচে নেমে এলো। বাইরে এসে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। আদিত্য নূরকে নিয়ে গাড়ির পেছনের ছিটে বসলো। বিহান ড্রাইভিং সিটে। আর আয়াত তার পাশের সিটে। আবির আর নিলা আরেক গাড়িতে যাবে। তাই তারা তাদের গাড়িতে গিয়ে বসলো। তারপর সবাই রওয়ানা দিল।

নূর আসার সময় ওর বিড়ালকেও নিয়ে এসেছে। গাড়ির ভেতরে তার সাথেই খেলছে। সবাই উৎসাহ আর খুশীর আমেজের মধ্যেই তাদের গন্তব্যে স্থলে এসে পৌঁছাল। গাড়ি থামলে আদিত্য প্রথমে বের হয়ে এসে নূরের হাত ধরে ওকে বের করলো। নূর ওর বিড়ালকে কোলে নিয়ে আদিত্যের হাত ধরে নেমে দাঁড়াল। আয়াত আর বিহানও নামলো। একটু পরে আবিরের গাড়িও এসে থামলো। ওরাও গাড়ি থেকে নেমে এলো। বিহান বলে উঠলো।
–আমি টিকেট কেটে আনছি তোরা এখানেই দাঁড়া।
কথাটা বলে বিহান চলে গেল টিকেট আনতে।

বাকি সবাই গেটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তখনই হঠাৎ আদিত্যের ফোন এলো। আদিত্য একটু থেমে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে লাগলো। এক হাতে নূরকে ধরে আছে, আরেক হাতে ফোনে কথা বলছে। বাকিরা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। ওরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছে, তাই পেছনে আর খেয়াল নেই।

হঠাৎ নূরের হাতে থাকা বিড়াল টা হাত থেকে নেমে রাস্তার দিকে দৌড় দিল। বিড়ালকে যেতে দেখে নূর অনেক ঘাবড়ে গেল। আদিত্য ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত থাকায় সেটা খেয়াল করেনি। নূর ওর বিড়াল কে ধরার জন্য আদিত্যর হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে বিড়ালের পেছনে দৌড়ালো। নূর হাত ছাড়াতেই আদিত্য চমকে নূরের দিকে তাকালো। নূরকে রাস্তার দিকে দৌড়াতে দেখে আদিত্যে ঘাবড়ে গিয়ে নূরের পেছনে ছুটলো। তবে ততক্ষণে অনেক দেড়ি হয়ে গেল।

নূর রাস্তায় আসতেই একটা কার ওকে দ্রুত বেগে টক্কর মেরে চলে গেল। নূর ছিটকে গিয়ে রাস্তার এক পাশে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। আদিত্যর পৃথিবী মুহূর্তেই থমকে গেল। কেমন অনূভুতি শূন্য পাথর হয়ে গেল আদিত্য। ওর সামনেই নূর রাস্তায় পরে আছে। মাথার নিচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে রাস্তা ভিজে যাচ্ছে। নিজের প্রাণভোমরার এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আদিত্যের হৃদপিণ্ডের চলাচল যেন বন্ধ হয়ে গেল। নূরকে এভাবে দেখার চেয়ে মৃত্যুও যে শ্রেয়। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আদিত্য।

নূরের এক্সিডেন্ট দেখে সব লোকজন ওখানে ভীড় করে ফেললো। নিলা আবির আর আয়াতও দৌড়ে এলো ওখানে। নূরকে ওভাবে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো নিলা। সবাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল।আবির তাড়াতাড়ি ফোন বের এম্বুলেন্স ডাকলো। বিহানও দৌড়ে এলো ওখানে। নূরের অবস্থা দেখে বিহানও থমকে গেল। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও কেমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বিহান ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে আদিত্যের কাছে ওর কাধ ঝাঁকিয়ো বললো।
–আদি, আদি কথা ক। নূরেরে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিতে হবে।

বিহানের ডাকে আদিত্য সম্ভূতি ফিরে পেল। দৌড়ে নূরের কাছে এগিয়ে গেল। নূরের কাছে এসে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।ওর সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠে থরথর করে কাঁপছে। নূরের সামনে বসে দুই হাতে নূরের মাথাটা কোলের মাঝে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নূরের গালে রেখে কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–এ এ এঞ্জেল, এ এই এঞ্জেল, এঞ্জেল সোনা চোখ খোলনা? ওঠো সোনা আমরাতো পার্কে বেড়াতে যাবো তাইনা? অনেক মজা করবে আমার এঞ্জেল টা । তাড়াতাড়ি ওঠো না।
নূরের কপালে রক্ত দেখে আদিত্য তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে রুমাল বের নূরের কপালে চেপে কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে বললো।
–এ এএতো রক্ত কি করে এলো? আমার এঞ্জেল টা তো রক্ত দেখলে ভয় পেয়ে যাবে।

আদিত্যের এমন পাগলামি দেখে আয়াত মুখ চেপে কাঁদছে। ভাইয়ের এমন করুন দশা সে সহ্য করতে পারছে না। নিলাও এদিকে হাওমাও করে কাঁদছে। সবারই অবস্থা নিদারুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে এম্বুলেন্স চলে এলো। এম্বুলেন্স থেকে লোকজন নেমে এসে নূরকে নিয়ে যেতে নিলে,আদিত্য বাঁধা দিয়ে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–এই এই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তোরা আমার এঞ্জেল কে? ছাড় ওকে,ছাড় বলছি। আমার এঞ্জেল কে কোথাও নিয়ে যাবিনা।

আদিত্যের পাগলামো দেখে আবির আর বিহান এসে আদিত্যের দুই হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো।
–আদি এমন করিসনা। সামলা একটু নিজেকে। নূরকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে । নাহলে ওর ক্ষতি হয়ে যাবে।

ওদের কথায় আদিত্যের কোন হুঁশ নেই। ও শুধু পাগলের মতো বলেই যাচ্ছে।
–আমার এঞ্জেল কে কোথাও নিবে না। আমার এঞ্জেল আমার কাছেই থাকবে।

আদিত্যকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। আবির আর বিহান অনেক কষ্টে আদিত্যকে আটকে রাখলো। আর নূরকে এম্বুলেন্সে তোলা হলে। ওরাও এম্বুলেন্সে উঠে নূরকে হসপিটালে নিয়ে গেল।

হসপিটালে এসে নূরকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া দেখে আদিত্য আরও পাগলামি শুরু করে দিল। এই হসপিটালই যে একদিন ওর মা বাবাকে কেঁড়ে নিয়ে ওকে এতিম করে গেছে। আজও আবার ওর এঞ্জেল কে কেঁড়ে নিতে চাচ্ছে, সেটা আদিত্য হতে দিবেনা। আদিত্য বারবার নূরকে আটকানোর চেষ্টা করছে। আবির আর বিহান অনেক কষ্টে ওকে ধরে রেখেছে। আদিত্যর শক্তির সাথে পেরে উঠছে না ওরা।

নূরকে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ডক্টর দেখে তাড়াতাড়ি নূরকে ওটিতে নিয়ে যায়। নূরকে ওটিতে নিয়ে যেতে দেখে আদিত্য আরও হাইপার হয়ে গেল। এই রুম থেকেই একদিন ওর মা বাবা লাশ হয়ে বেরিয়ে ছিল। এটা ভেবে ভেবেই আদিত্য আরও পাগল হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য আবির আর বিহানের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ওটির দরজা ধাক্কাতে লাগলো। দরজায় লাথি মেরে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–খোল দরজা আমার এঞ্জেল কে বের করে দাও। খোল খোল,,,

আবির আর বিহান গিয়ে আবারও আদিত্যকে টেনে আনার চেষ্টা করছে তবে আদিত্যের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না ওরা। আদিত্য এবার হাইপার হয়ে হসপিটালের সবকিছু ভাংচুর করতে লাগলো আর চিল্লাতে লাগলো। আদিত্যের এমন অবস্থা দেখে সবাই প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। একদিকে নূরের এই অবস্থা, তারওপর আদিত্যের এমন পাগলামি। সবার অবস্থা করুন হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য যদি এভাবেই হাইপার হতে থাকে তাহলে যেকোনো সময় ও ব্রেইন স্টোক করতে পারে। তাই শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে আদিত্যকে শান্ত করার জন্য ওকে ধরে, ডক্টর কে দিয়ে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। এতে করে আদিত্য ঘুমিয়ে পরে।
_____

দুই ঘন্টা পর আদিত্যর জ্ঞান ফিরে আসে।চোখ খুলে নূরের কথা মনে হতেই আবারও লাফিয়ে উঠলো আদিত্য। বিহান ওর পাশেই বসা ছিল। আদিত্যকে উঠতে দেখে ওর কাছে গিয়ে ওকে ধরে আটকালো। আদিত্য কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–আ আমার নূর বিহান।

বিহান আদিত্যকে আস্বস্ত করে বললো
–রিল্যাক্স আদি, শান্ত হ। এতো হাইপার হোশ না। নূর ঠিক আছে। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। ডাক্তার কইছে নূরের ইন্টারনাল আঘাত তেমন গুরুতর না। তাই তেমন কোন সমস্যা হয় নি। আর ঘন্টা পরই নূরের জ্ঞান ফিরে আসবে।

বিহানের কথায় আদিত্য যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। বিহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
— আমি আমার নূরের কাছে যাবো। আমি ওকে দেখতে চাই।

–ঠিক আছে চল। তয় কোন পাগলামি করবিনা।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। বিহান আদিত্যকে নূরের কেবিনের সামনে নিয়ে এলো। কেবিনের বাইরে সবাই বসে আছে। এতক্ষণে নূরের বাবা মাও চলে এসেছে। নূরের মা কান্নাকাটি করে শরীর অসুস্থ ফেলেছেন। নূরের বাবারও মেয়ের চিন্তায় প্রেশার বেড়ে গেছে। মেয়েটার ওপর থেকে যেন বিপদই সরছে না। একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। মাত্রই মেয়েটা সুখে শান্তিতে থাকতে শুরু করেছিল। এখোনি আবার কি থেকে কি হয়ে গেল? এদিকে আদিত্যের জন্যও নূরের মা বাবার অনেক চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটার কি অবস্থা হয়ে গেছে।

আদিত্য নূরের দরজা আস্তে করে খুলে ভেতরে ঢুকলো। বেডের ওপর নূর শুয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। আদিত্য ধীরে ধীরে এগিয়ে বেডের পাশে থাকা টুলে গিয়ে বসলো। নূরকে এই অবস্থায় দেখে বুকটা পুড়ে যাচ্ছে ওর। ওর চঞ্চল পরিটা কেমন নির্জীব হয়ে পরে আছে। এমনটা ওর সাথে না হয়ে আমার সাথে কেন হলো না? আমার মাছুম পরিটা এতোকষ্ট কিভাবে সহ্য করবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দু চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।

আদিত্য আস্তে করে নূরের একটা হাত ধরে, হাতের উল্টো পিঠে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল। হাতটা নিজের দুই হাতে ধরে নিজের কপালের সাথে ঠেকিয়ে বসে রইলো। এভাবেই অনেকক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ নূরের হাতটা নড়ে উঠলো। আদিত্য একটু চমকে উঠে নূরের দিকে তাকিয়ে দেখলো। নূর ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাচ্ছে। আদিত্যের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারমানে নূরের জ্ঞান ফিরে আসছে।

নূর চোখ খুলে তাকালো। মাথার ভিতরে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। নূর এক হাতে মাথাটা হালকা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে একটু আর্তনাদ করে উঠলো।
–আহহ,,,

আদিত্য ঘাবড়ে গিয়ে বললো।
–কি হয়েছে নূর? ব্যাথা করছে?

আদিত্যের কথায় নূর আবার চোখ খুলে তাকালো। আদিত্যকে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। আদিত্য আবারও অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–কি হয়েছে বলো? বেশি কষ্ট হচ্ছে?

নূর কাতর কন্ঠে বললো।
–হ্যাঁ ব্যাথা তো হচ্ছে, কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম? কি হয়েছে আমার?

–তেমন কিছুনা। ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। ভয় নেই কোন। আমি আছিনা?

নূর ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো।
–কিন্তু আপ,,,,

নূরের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য বলে উঠলো।
–এখন আর বেশি কথা বলোনা। তোমার কষ্ট হবে। তুমি আরাম করো। আমি সবাইকে বলে আসছি তোমার জ্ঞান ফিরেছে।

–সবাই মানে? আমার মা বাবাও কি এসেছে?

–হ্যাঁ এসেছে তো। আমি এখুনি তাদের ডেকে নিয়ে আসছি কেমন?
কথাটা বলে আদিত্য বাইরের দিকে গেল। বাইরে এসে সবাইকে নূরের জ্ঞান ফিরার কথা জানালো। তারপর নূরের মা বাবা আর নিলাকে নিয়ে আবার কেবিনে ঢুকলো আদিত্য।

কেবিনে ঢুকে নূরের মা নূরকে দেখে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠলো। নূর ওর মাকে দেখে বলে উঠলো।
–কি হয়েছে মা? এভাবে টিভি সিরিয়ালের মায়েদের মতো কাঁদছ কেন? আমি একদম ঠিক আছি। এসব ছোট মোট এক্সিডেন্ট আমার কিছু করতে পারবে না। তোমার মেয়ে অনেক স্ট্রং।

নূরকে এভাবে কথা বলতে দেখে। সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ওরা নূরের হাবভাব বুঝতে পারছে না।
নূর এবার ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
–বাবা তুমি একটু মাকে বুঝাও না? এভাবে কাঁদার কি আছে। আজকেতো কতো বড়ো একটা খুশীর দিন।

নূরের বাবা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–খুশীর দিন?

নূর বললো।
–হ্যাঁ খুশীর দিনই তো। আজ আমার রেজাল্ট বের হয়েছে। আমি গোল্ডেন প্লাস পেয়েছি। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে তোমরা?

নূরের মা বাবা এবার একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। তারা যা ভাবছে তাকি সত্যিই? তাহলে কি নূর আবার আগের মতো ঠিক হয়ে গেছে?
নূর আবার নিলার দিকে তাকিয়ে বললো।
–কিরে নিলু তুইও কি ভুলে গেলি?

নিলা অবাক হলো বললো।
–আপু তোমার সব মনে পরে গেছে?

নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মনে পরে গেছে মানে? এটা আবার কেমন কথা? আমি আবার ভুললাম কখন?

এবার নূরের মা বাবা আর নিলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারা বুঝতে পারছে নূরের সব মনে পরে গেছে। নূর আবার ঠিক হয়ে গেছে। তবে আদিত্যে ওদের কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছে না। আর নূরের বিহেভিয়ার কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
নূরের মা এবার নূরের মুখে হাত বুলিয়ে বললো।
–তোর সব মনে পরে গেছে নূরিমা। আমার যে খুশী লাগছে। আমার মেয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। আবার আগের মতো হয়ে গেছে।

নূরের মায়ের কথা শুনে আদিত্য বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই কি ওর এঞ্জেল ঠিক হয়ে গেছে? নরমাল হয়ে গেছে ? আদিত্যর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।
নূরের বাবা আর নিলাও অনেক খুশী। নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ঠিক হয়েছি মানে? কি হয়েছিল আমার?

নূরের মা বলে উঠলো।
–সে অনেক কথা। সেসব কথা পরে হবে। তুই এখন আরাম কর।

নূর মুচকি হেসে বললো।
–ঠিক আছে। কিন্তু আমি বাসায় যাবো কখন? হসপিটালে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার।

নূরের বাবা বললো।
–ঠিক আছে আমি ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখি উনি কি বলেন।

নূর বলে উঠলো।
–ডক্টর তো এখানেই আছে। উনার কাছে শুনলেই তো হয়।

নূরের বাবা বুঝতে না পেরে বললেন।
–এখানে কোথায় ডক্টর আছে?

নূর আদিত্যের দিকে ইশারা করে বললো।
–কেন এইযে, উনিই তো ডক্টর তাইনা?

নূরের কথায় সবাই আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। নূরের কথা বুঝতে পারছে না ওরা। নূরের বাবা বলে উঠলো।
–আরে ও ডক্টর হতে যাবে কেন?

নূর বলে উঠলো।
–তাহলে কে উনি? আমিতো ভেবেছিলাম উনি ডক্টর।

আদিত্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো নূরের কথায়। বাকি সবাইও চরম অবাক হয়ে গেল। ওদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। নূরের মা বলে উঠলো।
–নূরিমা তুমি কি ওকে চিনতে পারছ না?

–না তো। কে উনি? আর এখানে কি করছেন?

আদিত্যের কানে যেন কথাটা বারবার বাজতে লাগলো “কে উনি? নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। আদিত্য দিশেহারা হয়ে গেল। পুরো পৃথিবীটা যেন গোল গোল ঘুরতে লাগলো ওর সামনে। নূর এভাবে কেন বলছে? আমার এঞ্জেল কি আমাকে চিনতে পারছে না? না না এটা হতে পারে না। কখনোই না। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। আদিত্য হঠাৎ দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল। বাইরে আবির আর বিহান আদিত্যকে এভাবে দৌড়াতে দেখে ঘাবড়ে গেল। ওরা বুঝতে পারছে না কি হলো আবার।

আদিত্য হন্তদন্ত হয়ে ডক্টরের কেবিনে ঢুকলো। তারপর ডক্টরের কাছে গিয়ে অস্থির হয়ে বললো।
–ডক্টর প্লিজ চলুন আমার সাথে। নূর কেমন আবোল তাবোল কথা বলছে।ওর কিছু হয়েছে, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন।

ডক্টর বলে উঠলো।
–রিলাক্স মিঃ আদিত্য। কি হয়েছে খুলে বলুন আমাকে।

আদিত্য কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।
–নূ নূর বলছে ও নাকি আ আমাকে চেনে না। জানিনা কি বলছে আবোল তাবোল। আমার মাথা ঘুরছে। আপনি প্লিজ গিয়ে দেখুন ওকে।

–ওকে ওকে আমি দেখছি কি হয়েছে।

ডক্টর আদিত্যর সাথে নূরের কেবিনে এলো। কেবিন থেকে আপাতত সবাইকে বেরিয়ে দিল। তারপর নূরকে চেকআপ করে ওকে জিজ্ঞেস করলো।
–আচ্ছা বলুন তো আপনার নাম কি?

–আমার নাম মেহরুমা নূর।

–আচ্ছা বলুনতো আজকের তারিখ টা কি?

নূর যেদিন এক্সিডেন্ট করেছিল সেদিনের ডেট বললো।

–আচ্ছা আপনার শেষ কি মনে আছে?

–আমি আমার রেজাল্ট পেয়ে খুশি হয়ে আমার বন্ধুদের সাথে সেলিব্রেট করতে যাচ্ছিলাম। একটা সিএনজিতে করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা বাসের সাথে ধাক্কা খায় আমার সিএনজি টা। তারপর আর কিছু মনে নেই।

ডক্টর একটু গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–হুম বুঝতে পেরেছি।

নূর একটু চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে ডক্টর? আমার কি বড়ো কোন সমস্যা হয়েছে?

–না তেমন কোন সমস্যা না। আসলে তুমি যে এক্সিডেন্ট টার কথা বলছো। সেটা আজ না বছরখানেক আগে হয়েছিল। যারজন্য তোমার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলে। দূর্ভাগ্যবশত আজ তোমার আবারও একটা এক্সিডেন্ট হয়। আর তোমার আগের স্মৃতি ফিরে এসেছে। তবে তুমি মাঝখানের গত দশ মাসের সবকিছু ভুলে গেছ।

ডক্টরের কথায় নূর হতভম্ব হয়ে গেল। ওর জীবনের এতটা সময় ও ভুলে গেছে? কি হয়েছিল তখন? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নূরের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। নূর মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো। ডক্টর অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি করে নূরকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল।
____

ডক্টরের কেবিনে বসে আছে আদিত্য আর নূরের মা বাবা। আদিত্যর বুকটা ধড়ফড় করছে। হাত পা কাঁপছে। অস্থির হয়ে বসে আছে ডক্টরের সামনে। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে। নাজানি কি বলে ডক্টর?

ডক্টর একটু পরে বলে উঠলো।
–দেখুন মিস নূর তার আগের স্বাভাবিক স্মৃতি ফিরে পেয়েছে। তবে দূর্ভাগ্যবশত তার গত এক্সিডেন্টের পর থেকে এযাবতকাল পর্যন্ত যা যা হয়েছে সেগুলো কিছুই তার মনে নেয়। সে এখন সেই দশ মাস আগে ফিরে গেছে।

ডক্টরের কথায় আদিত্য স্তব্ধ হয়ে গেল। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল ওর। আদিত্য কাঁপা কাঁপা স্বরে কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো।
–ম মনে নেই মানে? এ এভাবে কিভাবে মন নেই? বললেই হলো নাকি? গত দশমাসের ভেতরে ওর আমার সাথে দেখা হয়েছে। আমার সাথে বিয়ে হয়েছে।গত পাঁচ মাস ধরে আমরা একসাথে থাকছি। এসব কিভাবে ভুলতে পারে ও? ও আমাকে , ওর হিরোকে কিভাবে ভুলতে পারে? না না এটা হতে পারে না। নূর আমাকে ভুলতে পারে না। কিছুতেই না।

ডক্টর বলে উঠলো।
–দেখুন মিঃ আদিত্য শান্ত হোন। আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তবে এই মুহূর্তে নূরকে ওর পুরানো স্মৃতি মনে করাতে গেলে ওর ক্ষতি হতে পারে। এমনিতেই উনার দুই দুইবার মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তাই সামান্য স্ট্রেসও তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এমনকি উনার ব্রেইন ড্যামেজ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। তাই আপনাদের অনেক সাবধানে থাকতে হবে।

আদিত্য আর শুনতে পারছে না। নিজেকে বোধশক্তিহীন লাগছে। ওর সাজানো পৃথিবী টা হঠাৎ করেই বালির মতো ঢসে পড়লো। আদিত্য ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কেমন অনুভূতি শূন্য হয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল। নূরের মা মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগলো। নূরের বাবারও চোখে পানি চলে এলো। আদিত্যের জন্য ওদের অনেক খারাপ লাগছে। ছেলেটা কতো ভালোবাসে তাদের মেয়েকে। অথচ আজ কি থেকে কি হয়ে গেল?

আদিত্য বাইরে এসে এলোমেলো পায়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে একসময় হসপিটালের ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদে এসে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।তারপর হঠাৎ অনেক জোরে চিৎকার করে হৃদয়বিদারক এক আর্তনাদ করে উঠলো। তার অসহনীয় যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ করতে লাগলো। তখনই আবির আর বিহান ওখানে দৌড়ে এলো। আদিত্যকে ওভাবে আসতে দেখে ওরাও পেছনে পেছনে চলে এসেছে। আবির আর বিহান গিয়ে আদিত্যর কাছে বসে ওকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আদিত্য বিহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো।
–আমিযে আবারও একা হয়ে গেলাম রে। আবারও নিস্ব হয়ে গেলাম। আমার নূর,আমার এঞ্জেল আমাকে ভুলে গেছে। সে তার হিরোকে ভুলে গেছে বিহান। আমার যে সব শেষ হয়ে গেল বিহান। আমি কি করবো এখন? বারবার আমার সাথেই কেন এমন হয় বলনা? কি দোষ করেছি আমি?

আদিত্যের এমন নিদারুণ অবস্থা দেখে বিহান আর আবিরের চোখেও পানি চলে এলো। ওরা কি বলে শান্তনা দিবে তার ভাষা জানা নেই ওদের। ছেলেটা এতবছর পর কতো সুখী হয়েছিল। হঠাৎ আবার কি হয়ে গেল? এখন কিভাবে বাঁচবে ছেলেটা? এমনটা কি নাহলেই হতো না?

চলবে…….
(আজকে আদিত্যর কথাগুলো লিখতে গিয়ে আমার নিজেরই কান্না চলে এসেছিল। 😢)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here