মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ২৮

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২৮

★রাত ১২ টা
শায়না বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। টেনশনে ওর ঘুম আসছে না। এতকিছুর পরেও নূরকে আদিত্যের কাছ থেকে সরাতেই পারছেনা। ওই পাগল মেয়েটা যে কি যাদু করেছে আদিত্যের ওপর? আদিত্য ওকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। শায়নার ভাবনার মাঝে হঠাৎ ওর দরজায় কেউ নক করলো ।শায়না ভ্রু কুঁচকে ভাবলো এত রাতে আবার কে এলো ওর রুমে? শায়না উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে শায়না অবাক হয়ে গেল। এতরাতে আদিত্যকে ওর দরজায় দেখে শায়না অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আদিত্য নিজে থেকে ওর কাছে এসেছে।

আদিত্য শায়নার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রহস্যময়ী ভঙ্গিতে বললো।
–কি ব্যাপার আমাকে দেখে খুশি হওনি? আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে দেখে খুশি হবে।

শায়না নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে হাসি মুখে বললো।
–আরে কি বলছো আদিত্য? তুমি আমার কাছে এসেছ আর আমি খুশী হবোনা? আমিতো কবে থেকে এই দিনটারই অপেক্ষা করছিলাম। এসোনা? ভেতরে এসো?

আদিত্য রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো।
–না ভেতরে যাবোনা। আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?

শায়না ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কোথায়?

–চলো।গেলেই দেখতে পাবে।

শায়না তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশী হয়ে গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো।
–ঠিক আছে চলো।

আদিত্য আগে আগে আর শায়না আদিত্যের পিছে পিছে যাওয়া শুরু করলো।

আদিত্য শায়নাকে নিয়ে বাসার পেছন দিকে গেল। শায়না এদিকে কখনো আসেনি। এদিকে কেমন গাছগাছালি আর অন্ধকারে ঘেরা। কেমন জানি ভূতুড়ে। শায়নার একটু ভয় ভয় লাগছে। শায়না ঢোক গিলে বললো।
–আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি? আদিত্য চলনা আমরা অন্য কোথাও যাই?

–আরে ভয় পাচ্ছ কেন? আজকে তোমাকে আমার এক স্পেশাল জায়গায় নিয়ে যাবো। যেখানে শুধু আমি আমার স্পেশাল গেস্ট দের নিয়ে যাই। আর আজ তুমি সেই লাকি পারসন।

কথাটা শুনে শায়না সাত আসমানে উড়তে লাগলো। ও আদিত্যের কাছে স্পেশাল? হায় শেষমেশ এই দিন এসেই গেছে। যারজন্য ও এতদিন অপেক্ষায় ছিল। আদিত্য ফাইনালি ওর কাছে ধরা দিয়েছে। শায়না খুশিতে ডগমগ হয়ে আদিত্যর সাথে যেতে লাগলো।

কিছুদূর আসার পর সামনে একটা একতলা বিশিষ্ট আউট হাউজ দেখতে পেল। শায়না অবাক হয়ে গেল। ও এতদিন ধরে এখানে থাকছে অথচ এখানে এমন একটা জায়গা আছে তা ও টেরই পায়নি। শায়না আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এখানে একটা আউট হাউজ আছে সেটাতো জানতামই না আমি।

আদিত্য সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এটা আমার গোপন জায়গা। আমার স্পেশাল গেস্ট দের এখানে নিয়ে আসি আমি। এখানে এনে তাদের স্পেশাল ট্রিট দেই। আজ তুমি হলে আমার স্পেশাল গেস্ট। সত্যি বলছি আজকের মেহমান নওয়াজী তুমি সারাজীবন মনে রাখবে।

শায়না খুশিতে বেলুনের ফুলে হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। আদিত্য ওকে স্পেশাল ট্রিট দিবে,ভাবতেই শায়নার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।
আদিত্য বলে উঠলো।
–তাহলে চলো।

–হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
শায়না আহ্লাদে আটখানা হয়ে আদিত্য সাথে ভেতরে দিকে পা বাড়ালো।

গেটের কাছে দুজন পালোয়ানের মতো সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের দেখে সিকিউরিটি দুটো মাথা হালকা ঝুকিয়ে সম্মান জানালো।শায়না দেখে বুঝলো,এরা দেশি না বিদেশ থেকে আনা হয়েছে।
আদিত্য শায়নাকে নিয়ে ভেতরে একটা রুমে ঢুকলো। রুমটা কেমন যেন অদ্ভুত। অন্য সব সাধারণ রুমের মতো না। এখানে কোন বেড বা রুমে ব্যবহৃত তেমন কোন জিনিস দেখতে পেল না শায়না। রুমের ভেতর নীল আলো জ্বলছে। আর কিছু মেশিনের মতো এলোমেলো কিছু জিনিস রাখা আছে।

শায়নার কাছে ব্যাপার টা কেমন যেন আজীব লাগছে। তাই আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এটা কেমন রুম আদিত্য? এখানে রুমের মতো কিছুই দেখছিনা?

আদিত্য আবারও রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো।
–তোমাকে বললাম না এটা স্পেশাল জায়গা? আর স্পেশাল জায়গা স্পেশালই হয়। সাধারণ সবকিছুর মতো হয় না।
আদিত্য একটা চেয়ার দেখিয়ে বললো।
–এসব ছাড়ো। এখন তুমি এখানে এসে বসো।তারপর দেখবে আমার স্পেশাল খাতের দারী।

আদিত্যর কথামতো শায়না চেয়ার টার দিকে তাকিয়ে দেখলো চেয়ারটাও কেমন অন্যরকম। চেয়ারের সাথে কেমন সব তারের মতো লাগানো। শায়নার একটু অদ্ভুত লাগলেও আদিত্যের কথামত চেয়ারে গিয়ে বসলো। চেয়ারে বসে চেয়ারের হাতলের ওপর দুই হাত রাখতেই হঠাৎ অটোমেটিক হ্যান্ডকাফ দ্বারা শায়নার দুই হাত চেয়ারের হাতলের সাথে টাস করে আটকে গেল। শায়না চমকে গিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–আদিত্য এসব কি হচ্ছে? আমার হাত আটকে গেল কেন? প্লিজ খোল আমাকে, আমার এসব ভালো লাগছে না।

–তা বললে কি হয়? তোমাকে তো আমার স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে তাইনা? আর তার জন্য তোমাকে এভাবেই থাকতে হবে।

–লাগবেনা আমার কোন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। তুমি আমাকে খুলে দাও প্লিজ। আমি বাসায় যাবো।

আদিত্য হঠাৎ সাইকো দের মতো হাসতে লাগলো। যা দেখে শায়না আরও ভয় পেয়ে গেল। আদিত্য হাসি থামিয়ে চোখ মুখ কঠিন করে বললো।
–এতো সহজে না শায়না বেবি। এখানে যে একবার আসে সে আর বাইরের পৃথিবী দেখার সুযোগ পায় না।

শায়না ভীতু স্বরে বললো।
–মা মানে?

–হ্যাভ সাম পেশেন্স শায়না বেবি। সব কি একবারেই জানতে চাও? ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে।
কথাটা বলে আদিত্য ওর এক লোককে ডাকলো। লোকটা একটা সাধারণ চেয়ার এনে আদিত্য দিল। আদিত্য চেয়ার টা নিয়ে শায়নার মুখোমুখি হয়ে চেয়ারে বসলো। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে কঠিন চোখে শায়নার দিকে তাকালো। পুরোই গ্যাংস্টার লুক। আদিত্য ওর ডান হাত বাড়াতেই ওর পাশে থাকা লোকটা আদিত্যের হাতে একটা রিমোট ধরিয়ে দিল। তারপর লোকটা গিয়ে দেয়ালে থাকা ছকেটে একটা প্লাগ লাগিয়ে দিল।

শায়নার এসব দেখে ভয়ে আত্মা বেড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্য কি করতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না ও। শায়না আবারও আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ভীতু সুরে বললো।
–কি করছ আদিত্য? প্লিজ ছাড়ো আমাকে? কি হচ্ছে এসব?

আদিত্য আগের মতোই বলে উঠলো ।
–ছাড়া পেয়ে যাবে। তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও। যদি সঠিক উত্তর দাও তাহলে বেঁচে যাবে। আর যদি ভুল উত্তর দাও তাহলে কি হবে সেটা নিজেই বুঝতে পারবে। তো আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, তুমি কি নূরকে সেদিন বলেছিলে যে আমি ওর ওপর বিরক্ত হয়ে গেছি?ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো?

আদিত্যের কথায় শায়না আৎকে উঠলো। আদিত্য কিভাবে জানলো এসব? নূর কি তাহলে ওকে সব বলে দিয়েছে? ভয়ে শায়নার গলা শুঁকিয়ে আসছে। শায়না আমতা আমতা করে বললো।
–কি বলছ এসব আদিত্য? আমি কেন নূরকে এসব বলতে যাবো? তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।

শায়নার কথা শুনে আদিত্য শোয়াল শক্ত করে ওর হাতে থাকা রিমোটের বাটনে চাপ দিল। সাথে সাথে শায়নার সারা শরীরে কারেন্টের শক লাগা শুরু হয়ে গেল। শায়না যন্ত্রণায় চিল্লাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আদিত্য আবার রিমোট চেপে শক বন্ধ করে দিল। শায়নার সারা শরীর ঝিনঝিন করছে। শরীরে কোন শক্তি পাচ্ছে না ও। আদিত্য আবার বলে উঠলো।
–আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, তুমি কি নূরকে আমার নাম করে অন্য কারোর সাথে কথা বলিয়েছ?

শায়না ক্লান্ত শরীরে বলে উঠলো।
–দে দেখ আদিত্য তু তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি আসলে,,,

শায়নার কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য আবারও রিমোটে চাপ দিল। সাথে সাথে আবারও শক ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেল। শায়না শুধু ফোনের ভাইব্রেশনের মতো কাঁপছে আর জোরে জোরে আর্তনাদ করছে। কিছুক্ষণ পর আদিত্য আবারও শক বন্ধ করে দিল। শায়নার অবস্থা করুন। মাথার চুলগুলো দাড়িয়ে গেছে। চোখে অন্ধকার দেখছে ও,শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি নেই। ক্লান্ত শরীরে মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পরে আছে।

আদিত্য আবার বললো।

–এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছ মিথ্যে বলার কি পরিনাম হতে পারে? তো আমার তৃতীয় প্রশ্ন হলো, তুমি কি নূরকে ছাঁদে গিয়ে ফুল পাড়তে বলেছিলে?

শায়না এতক্ষণে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে আদিত্য ওকে এখানে কেন এনেছে। আর ওর কথার জবাব ঠিকমতো না দিলে কি হবে। তাই এবার আর কোন ভনিতা না করে বললো।

—হ্যাঁ হ্যাঁ আমি করেছি সব। আমিই নূরকে সব বলেছি।

আদিত্যের মুখমণ্ডল আরও কঠিন হয়ে উঠলো। আদিত্য দাঁত চিবিয়ে বললো।

–কেন করেছ?

শায়না এবার একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো

—কারণ ওই পাগলকে আমি তোমার জীবন থেকে সরাতে চাই। কারণ তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে আমি চাই। কি আছে ওই পাগল মেয়ের মাঝে? কি দিতে পারবে ও তোমাকে? ওই পাগল তো তোমাকে শারীরিক সুখও দিতে পারবে না। তুমি ওকে ছেড়ে দাও আদিত্য। আমাকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে সর্ব সুখ দিয়ে ভরিয়ে দেব। একবার আমাকে মেনে নাও।

ব্যাস আদিত্য আর শুনতে পারলোনা। ওর পাশে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো।

–থোমাস, গো এন্ড স্লাপ হার টাইটলি।

আদিত্যের কথামতো লোকটা গিয়ে শায়নার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। শায়নার মাথাটা কাত হয়ে একদিকে পড়ে গেল। আদিত্য এবার লোকটাকে আরও কিছু ইশারা করতেই লোকটা শায়নার চুলের মুঠি টেনে ধরে শায়নার মুখটা উপরে তুলে ধরলো। আদিত্য তখন শায়নার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।

–তোর মতো নোংরা মেয়েকে ছুতেও আমার রুচিতে বাঁধে। আর তুই কিনা বলছিস আমার এঞ্জেল কে ছেড়ে দিয়ে তোকে বিয়ে করবো? তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুই এটা ভাবারও সাহস কি করে পেলি? আমার এঞ্জেল আমাকে কি সুখ দেয় সেটা তোর চিপ মাইন্ডেড মেয়ের মাথায় ঢুকবে না। তুই এই জনমে কেন,হাজার জনম নিলেও আমার নূরের পায়ের নখেরও যোগ্য হবিনা। তোরা সবাই আমার ভদ্রতাকে আমার বোকামি ভাবার ভুল করিস কেম বলতো? তোদের মতো মানুষদের জন্যই আজ মানুষ ভদ্রতা দেখাতে ভুলে যাচ্ছে। তুই কি ভেবেছিলি তোর হাবভাব আমি বুঝিনা? আরে তোর মতো চিপ মাইন্ডের মেয়েকে আমার প্রথম থেকেই পছন্দ না। তবুও ফুপির মেয়ে বলে ভদ্রতা দেখিয়ে তোকে থাকতে দিয়েছিলাম। আর তুই কিনা আমার নূরকে কেড়ে নেওয়ার প্ল্যান করছিলি? ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছিলি? তুই কি ভেবেছিলি আমি এসব জানতে পারবোনা? এখন দেখ আমি কি করি? সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যর কলিজায় হাত দেওয়া মানে, পৃথিবীতে তার দিন ফুরিয়ে আসা। আর আজ তোর ও দিন শেষ।

শায়না ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো।

–দিন শেষ মানে? এসব কি বলছ?

আদিত্য শায়নার কথার জবাব না দিয়ে ওর লোকের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। লোকটা মাথা ঝাকিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। একটু পার লোকটা আবার ফিরে এলো। দুই হাতে দুটো কুকুরের বেল্ট ধরে ভেতরে এলো। কুকুর দুটো খুবই বড়সড় এবং ভয়ংকর দেখতে। রুমে ঢুকতেই কুকুর দুটো জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। শায়নার এবার আত্মার পানি শুঁকিয়ে গেল। বেচারি মরার আগে ভয়েই ওর জান বেরিয়ে যাবে। আদিত্য কুকুর দুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে শায়নার দিকে তাকিয়ে বললো।

–ওরা হলো জ্যাক এন্ড জিল। ওরা আমার খুব ভালো বন্ধু। একটা কথা জানো শায়না? ওরা না কিছুতেই আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। যে আমাকে কষ্ট দেয় তাকে তো আরও সহ্য করতে পারে না। তাকে ওরা ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলে। দেখা যাক তোমার সাথে কি করে তাইনা? এমনিতেও বেচারারা কয়েকদিন হলো ভালো ডিনার খেতে পারছে না। আজকে নিশ্চয় ওদের জলসা হবে।

শায়না ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো।

–কি বলছ এসব? প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে। ছেড়ে দাও প্লিজ? সত্যিই বলছি আমি আর কিছু করবোনা। কালই এখান থেকে চলে যাবো। প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে। 😭

–তার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে শায়না।আমার নূরের ক্ষতি করার চেষ্টা করার আগে এটা ভাবা উচিত ছিল। এখন আর কোন নিস্তার নেই। আমি সবকিছু মাফ করতে পারি। তবে আমার জানের দিকে কেও কু নজর দিলেও তাকে আমি কখনো মাফ করিনা। পারলে নিজেকে বাচিয়ে নাও। আর না পারলে,,,, বাকিটা নিজেই বুঝবে।

কথাটা বলে আদিত্য জ্যাক আর জিলের গলার বেল্ট খুলে দিল। সাথে সাথে দুজন ভয়ংকর ভাবে ঘেউ ঘেউ করতে করতে শায়নার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। শায়না ভয়ে ছটফট করতে করতে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো আর আদিত্যর কাছে জান ভিক্ষার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। কুকুর দুটো শায়নার একদম কাছাকাছি যেয়ে শায়নাকে কামড় দেওয়ার জন্য আগ্রাসী হলো। শায়না ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।তখনই আদিত্য হঠাৎ বলে উঠলো।

–স্টপ জ্যাক এন্ড জিল।

সাথে সাথে কুকুর দুটো থেমে গেল। শায়না চোখ খুলে তাকালে আদিত্য বলে উঠলো।

–দেখলিতো নিজের চোখের সামনে নিজের মৃত্যু চলে এলে তখন কেমন লাগে? এর চেয়েও হাজার গুণ বেশি ভয় পেয়েছিলাম কাল নূরকে ওই অবস্থায় দেখে। ভাবিস না তোকে আমি মাফ করে দিয়েছি। কখনোই না। আজ শুধু মাত্র ফুপির কথা ভেবে তোকে ছেড়ে দিলাম। কারণ তোর পাপের শাস্তি আমি তাকে দিতে চাইনা। তবে মনে রাখবি এরপর জীবনে আর কখনো যদি তোর এই কুৎসিত চেহারা আমাকে আর দ্বিতীয় বার দেখিয়েছিস। তাহলে সেদিনই তোর জীবনের শেষ দিন হবে।

শায়না ক্লান্ত শরীরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।

—হ্যাঁ হ্যাঁ মনে রাখবো। কাল সকালেই আমি চলে যাবো। আর কখনোই আসবোনা।

–তোকে আর আমি এক সেকেন্ডর জন্যেও সহ্য করতে পারবোনা। তুই এখন একমুহূর্তেই বিদায় হবি। আমি সব ব্যাবস্থা করে রেখেছি। তুই তোর জিনিস পত্র গুছিয়ে এখনই বেড়িয়ে যাবি।

–ঠিক আছে।তাই যাবো।

বেচারি শায়না যে জান নিয়ে ফিরতে পারছে এই হাজার হাজার শুকুর। আর কিছুর দরকার নেই ওর।

______

দেখতে দেখতে আরও দুটো মাস কেটে গেছে। আদিত্য আর নূরের বিবাহিত জীবনের পাঁচ মাস হতে চললো প্রায়। এই কয়মাসে আদিত্য নিয়মিত নূরকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করিয়েছে। নিয়মিত মেডিসিনও খাওয়ায়। ইদানীং নূরের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখন আর আগের মতো অল্পতেই হাইপার হয়ে যায় না। আদিত্য যেভাবে বলে সেটাই করে। আদিত্যও নূরের ইম্প্রুভমেন্ট দেখে অনেক খুশী।এখন শুধু নূরের পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।

আবির আর নিলার প্রেম ভালোই চলছে। তবে শরিফা বেগম আবিরের সাথে এই নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। শরিফা বেগমের সাথে আবিরের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। শেষে আবির রাগ করে ও বাড়ি থেকে চলে এসেছে। আসার সময় ওর মাকে বলে এসেছে সে আর কখনো এবাড়িতে ফিরবে না। তারপর থেকে আবির আদিত্যর বাসায়ই থাকে। আর আবির না থাকায় আয়াতও আর ও বাড়িতে বেশি থাকেনা। বেশির ভাগ সময় আদিত্যর বাড়িতেই থাকে।

বিহানের কিছু পরিবর্তন না হয়েও আবার যেন হয়েছে। আসলে ওর ব্যাপার টা ও নিজেই কেমন যেন বুঝতে পারছে না। আজকাল চিন্তাভাবনা গুলো কেমন যেন ওর আয়ত্তে থাকে না। যেটা নিয়ে ভাবতে চায়না সেই ভাবনাগুলোই বিনা বেতনে ওর মাথায় ঢুকে পরে। আর আজকাল ওর ভাবনার মাঝে শুধু একটা নামই আসে তা হলো আয়াত। আয়াত এই দুই মাসে অনেক বদলে গেছে। আগের আয়াত আর এখনকার আয়াতের মাঝে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। মেয়েটা হঠাৎ করেই কেমন গম্ভীর আর ম্যাচিওর হয়ে গেছে। আজকাল আয়াত ওর কিছু বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা এনজিও খুলেছে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো,রাস্তার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাদের সাহায্য করা। প্রথম দিন আয়াতের এই উদ্যোগের কথা শুনে বিহান অনেক অবাক হয়েছিল। বিহানের কথার প্রভাব যে আয়াতের উপর এভাবে পড়বে। তা কখনোই ভাবেনি বিহান। ব্যাপার টা নিয়ে বিহানের খুশী হওয়া উচিত নাকি মন খারাপ করা উচিত। সেই বিষয় টা নিয়েও অনেক কনফিউশনে আছে বিহান।আগে যখন আয়াত ওর পিছনে পিছনে ঘুরতো তখন কতো অনায়াসে ওকে ইগনোর করে দিত।অথচ আজকাল মেয়েটা আশেপাশে থাকলে কেন যেন ইগনোর করা যায় না। কেমন নার্ভাস নার্ভাস লাগে।

আয়াত কখনো বিহান কে ইগনোর বা এভয়েড করেনা। সবসময় স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক কথা বলে। আর এই ব্যাপার টাই বেশি পেরেশান করে বিহানকে। আর এজন্য নিজের ওপরই রাগ লাগে বিহানের। কেন যেন মনে হয় মেয়েটা এমন স্বাভাবিক থাকে কেন? একটু অভিমান দেখালেও তো পারে। নিজের এমন অবাঞ্ছিত ভাবনার ওপর নিজেই বিরক্ত হয় বিহান। নিজের মনকে নিজেই রাগ দেখিয়ে বলে, ছাভাবিক থাকবো নাতো কি করবো? তুই কি ওর নাগর লাগোছ নি? যে তোর লাইগা অভিমান কইরা বইয়া থাকবো? মাথাডা পুরাই গ্যাছেগা তোর। ছারাদিন খালি আবাল মার্কা চিন্তা ভাবনা লইয়া ঘোরছ।তোর মাথাটা সার্ভিসিং করান লাগবো।

আদিত্যের বাসার সুইমিং পুলের পাশে ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে আর নিজের ভাবনার ওপর বিরক্ত হয়ে এভাবেই নিজেকে বকছে বিহান। তখনই আদিত্য ওর পাশে এসে বসলো। আদিত্যর হাতে দুটো কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান। একটা ক্যান বিহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।

–এসব নিকোটিন না টেনে এটা খা। তাও কিছুদিন বেশি বাঁচবি।

বিহান আদিত্যের হাত থেকে ক্যান টা হাতে নিল। তারপর বলে উঠলো ।

–আইচ্ছা কতো,বাইচ্চা থাকাটা বেশী জরুরি নাকি ভালো থাকাটা?

আদিত্য জানে বিহান এই কথা কেন বলছে। সেদিন ছাঁদে বিহান আর আয়াতের সবকথা শুনেছিল ও। তবে ওই ব্যাপারে বিহান বা আয়াতকে কিছু বলেনি। কারণ এটা ওদের একান্তই পার্সোনাল ব্যাপার। তাই এই নিয়ে কথা না বলাটাই ওর কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল। তবে আজ বিহানের প্রশ্নে আদিত্য স্মিত হেসে বলে উঠলো।

–এটা বলাটা হয়তো একটু কঠিন। তবে একটা কথা কি জানিস। বেঁচে থাকতে হলেও ভালো থাকার দরকার হয়। শুধু নিঃশ্বাস নেওয়া টাকে কি বেঁচে থাকা বলে? “আমরা কতদিন বাচলাম এটা জরুরি না,জরুরি হলো আমাদের আয়ুকালে আমরা কতগুলো জীবন উপলব্ধি করলাম।” এই আমাকেই দেখ। আমিতো এতদিন শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। বাঁচতে তো শুরু করলাম নূরকে পেয়ে। নূর আমার জীবনে আসার পরে আমি জীবনের আসল মাইনে বুঝলাম। এখন মনে হচ্ছে আমি সত্যিকার ভাবে বেঁচে আছি।

বিহান সামনের দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাকিয়ে বলে উঠলো।

–চাইলেই কি ভালো থাকোন যায়?

–হ্যাঁ তা হয়তো যায় না। সবারই কোন না কোন বাধ্যবাধকতা থাকে। তবে ভালো থাকতে চাইলে কখনো কখনো একটু স্বার্থপরও হতে হয়। আমিও তো নূরকে বিয়ে করতে গিয়ে কিছুটা স্বার্থপরতা দেখিয়েছি।

–তুই কই স্বার্থপর হইলি? তুই তো নূরেরে ভালোবাইসা ওর সব কিছু যাইনা ওরে বিয়া করছস।তাইলে এইহানে স্বার্থপরের কি হইলি?

–তুই আমার বন্ধু বলে আমার দোষ টা তোর হয়তো চোখো পরছে না। তবে আমি বলছি।নূরকে আমি আমার সজ্ঞানে বিয়ে করলেও, নূর কিন্তু আমাকে তার সজ্ঞানে বিয়ে করেনি। আরে সেতো বিয়ের মানেই বোঝেনা। ওতো মনে করে আমরা বর বউ খেলছি। তাহলে এখানে দেখতে গেলে আমি ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে আমি ওকে বিয়ে করেছি। কারণ নূরের পুরো হুঁশ থাকলে হয়তো তার আমাকে পছন্দ নাও তো হতে পারতো। তখন তো সে এই বিয়েতে মানা করে দিত তাইনা? সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে আমিও নূরকে পাওয়ার জন্য একটু স্বার্থপর হয়েছি।

–তা বুঝলাম, তয় তোর স্বার্থপর হওয়ায় সামনের ব্যাক্তির কোন ক্ষতি হইতাছে না। তোর মতো নূরেরে কেউই ভালো রাখতে পারবোনা। মাগার যদি ভালো হওয়ার জন্য স্বার্থপর হইতে গিয়া ছামনের মানুষটার ক্ষতি হইয়া যায় তহন?

— হ্যাঁ তখন হয়তো ব্যাপার টা ঠিক হবে না। স্বার্থপর হতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করা যাবেনা। কিন্তু সামনের ব্যাক্তি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না,সেটাও তো আমাদের ভালো করে আগে জানতে হবে তাইনা। হতে পারে আমি আমার মতো করে ভাবছি যে সামনের ব্যাক্তির ক্ষতি হবে।কিন্তু সামনের ব্যাক্তি তো এমনটা নাও ভাবতে পারে। তারমতে হয়তো সেটা ক্ষতিকর না বরং সুখকর মনে হচ্ছে। তাই কখনো কখনো শুধু নিজের মতো করে বরং সামনের ব্যাক্তির পক্ষ থেকেও ব্যাপার টা ভাবতে হয়। আর যদি সামনের ব্যাক্তি তোর স্বার্থপরতায় খুশী হয় তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই। একটা কথা কি জানিস? জন্ম মৃত্যু আমাদের হাতে থাকে না। তবে ভালো থাকা আর অন্যকে ভালো রাখাটা অবশ্যই আমাদের হাতে আছে। আমরা কেউই পারফেক্ট না। সবার মাঝেই কমতি আছে। হয়তো কারোর একটু বেশি কারোর একটু কম। তবে সেই কমতি ধরে বসে না থেকে, বরং সেই কমতি টাকে জয় করে ভালো থাকার চেষ্টা করাটা সবারই অধিকার। অতীত ধরে বসে থাকলে কখনো ভবিষ্যৎ আশাজনক হয় না। তাই অতিতটাকে কাটিয়ে উঠে ভবিষ্যতের হাত ধরাটায় বুদ্ধিমানের কাজ। যাইহোক আজকের জন্য অনেক ফিলোসোফি হয়ে গেল। আশা করি কিছুটা তোর মোটা মাথায় ঢুকেছে।

বিহান হেসে দিল। আদিত্য উঠে চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে বললো।

–যাওয়ার আগে আরেক টা কথা বলতে চাই। যাই করিস সময় থাকতে করিস। কারণ ভালো থাকতে চাইলে সময়মত ঠিক কাজটা করতে হয়। নাহলে পরে বেশি দেরি হয়ে গেলে আর চাইলেও ভালো থাকা যায়না।

কথাটা বলে আদিত্য চলে গেল। আর বিহান বসে বসে ভাবতে লাগলো। সত্যিই কি একটু স্বার্থপর হবে ও?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here