মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ২৭

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা- Mehruma Nurr
#পর্ব-২৭

★ আদিত্য নূরকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে নূর। ঘন্টাখানিক আগেই ওরা বাসায় এসেছে। বাসায় এসে আদিত্য নিলাকে দিয়ে নূরকে ফ্রেশ করিয়ে নিয়েছে। তারপর নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসে নূরকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে।

নূর খাবার খাচ্ছে আর বকবক করেই যাচ্ছে। ওই পঁচা লোকেরা কি কি করেছে সেগুলোই বলছে। তবে আদিত্য কিছুই বলছে না। চুপচাপ শুধু নূরকে খাইয়েই যাচ্ছে। মুখমন্ডলে কেমন গাম্ভীর্য ভাব ধারণ করে আছে। অবুঝ নূরের মাথায় ব্যাপার টা প্রথমে বোধগম্য না হলেও সময়ের সাথে ধীরে ধীরে কিছুটা টের পাচ্ছে ও। গাড়িতে আসার সময়ও আদিত্য নূরের সাথে কোন কথা বলেনি। বাসায় আসার পরও কোন কথা বলেনি। ধীরে ধীরে নূর খেয়াল করছে আদিত্য ওর সাথে কথা বলছে না। ব্যাপার টা কেমন যেন লাগছে নূরের কাছে। একটুও ভালো লাগছে না। নূর এতক্ষণে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এই হিরো তুমি কথা বলছ না কেন?

আদিত্য কোন কথা বললো না। চুপচাপ নূরকে খাইয়ে দিচ্ছে। নূর আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো কিন্তু একইভাবে চুপ করে রইলো। আদিত্য নূরের খাওয়া শেষে প্লেট গুছিয়ে রেখে আসলো। তারপর নূরের মেডিসিন আর পানি নিয়ে নূরের সামনে বসলো। সেদিন নূরকে ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার এই মেডিসিন গুলো প্রেসক্রাইব করেছিল। সেগুলো আদিত্য রোজ নিয়মিত নূরকে খাইয়ে দেয়। এখনো তাই করছে। আদিত্য একহাতে মেডিসিন আর একহাতে পানির গ্লাস নিয়ে চুপচাপ নূরের দিকে এগিয়ে দিল।

নূরের এবার আর ভালো লাগছে না। আদিত্যেকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে নূরের খুব খারাপ হয়ে। বুকের ভেতর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। নূর আদিত্যের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো।
–না আমি ঔষধ খাবো না। তুমি কথা বলছ না কেন? আগে কথা বলো তাহলে খাবো।

আদিত্য তবুও কিছু বললো না। আবারও মেডিসিন নূরের দিকে এগিয়ে দিল। নূর আবারও সরিয়ে দিল। এভাবে একই কাজ বারবার হতে লাগলো। কেউ কারো জিদ ছাড়ছে না। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর নূরের আর সহ্য হলোনা। এবার ওর প্রচুর খারাপ লাগছে। নূর আদিত্যের হাত থেকে মেডিসিন আর পানির গ্লাস টা নিয়ে, বেডের পাশে ছোট্ট টেবিলে ঠাস করে রেখে দিল। তারপর আদিত্যের কাছাকাছি এসে দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে উদ্বেগি হয়ে বলে উঠলো।
–এই হিরো কথা বলছ না কেন? দেখ আমার কিন্তু অনেক পঁচা লাগছে। একটুও ভালো লাগছে না। প্লিজ কথা বলোনা? এই হিরো…

আদিত্য তবুও কথা বলছে না। শুধু চুপচাপ নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে করে নূর আরও অস্থির হয়ে গেল। নূর এবার কাধ ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো।
–এই এই হিরো, কথা বলোনা? কথা বলো, কথা বলো…
নূরের এবার কান্না আসছে। নূর কাঁদো কাঁদো গলায় আদিত্যের বুকে দুই হাত দিয়ে হালকা করে চাপড় মারতে মারতে বলতে লাগলো।
–এই হিরো কথা বলোনা,এই হিরো? কথা বলো, কথা বলো,কথা বলো…..

নূরকে কান্না করতে দেখে আদিত্য আর চুপ থাকতে পারলোনা। আদিত্য নূরের হাত ধরে সরিয়ে দিয়ে কিছুতেই রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–কি বলবো আমি তোমাকে? বলো কি বলবো? তুমি কি আমার কোন কথা শোন? আমার কথা কি তুমি মানো? তাহলে কেন বলবো তোমাকে কিছু?

নূর আদিত্যের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বললো।
–এভাবে বলছ কেন হিরো?

আদিত্য নূরের দুই কাঁধ ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো।
–তো কিভাবে বলবো? বলো কিভাবে বললে তুমি আমার কথা বুঝতে পারবে? তোমাকে আমি বলেছিলাম না একা একা কোথাও যাবে না? আমাকে না বলে, আমাকে ছাড়া তুমি কোথাও যাবেনা? বলো বলেছিলাম না? তাহলে তুমি কি করেছ? মেনেছ আমার কথা? আজ তুমি একা একা কাওকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলে? জানো কতবড় ভুল করেছ তুমি?
আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে, নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে রাগ আর আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো।
–আজ তোমার কিছু হয়ে গেলে কি করতাম আমি বলো? আমিতো শেষ হয়ে যেতাম না? জানো তোমার কিডন্যাপ হওয়ার কথা জেনে আমার কি অবস্থা হয়েছিল? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায় আমার। ওই কয়েক মিনিটে আমি কয়েক হাজার মওত মরেছি। তুমি তোমার হিরোর কথা একবারও ভাবলে না? তুমি আজ তোমার হিরোকে অনেক হার্ট করেছ এঞ্জেল। আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার অনেক ভালো লাগে তাইনা? তাহলে তুমি ভালোই থাকো।
কথাগুলো বলে আদিত্য নূরকে ছেড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

আর নূর নাক টেনে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে লাগলো। ওর কি দোষ।ও কি ইচ্ছে করে এমন করেছে নাকি? ওতো হিরোর ফোনের কথাগুলো শুনেই না চলে গিয়েছিল। কিন্তু হিরো তো সেটা শুনলই না। তার আগেই চলে গেল। পঁচা একটা, শুধু আমাকে বকা দেয়।

আদিত্য বাইরে এসে রাগে সব গার্ড আর সিকিউরিটি গুলোকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো। মারতে মারতে বলতে লাগলো।
–তোদের কি আমি এখানে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এনেছি? নূর তোদের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল আর তোরা কি সবগুলো বসে বসে ললিপপ চুষছিলি। সব আবালের দল পালছি আমি।

বিহান আর আবির আদিত্যকে এভাবে মারতে দেখে দৌড়ে এসে ওকে ধরে আটকালো। আদিত্যকে ধরে এনে পুলের পাশে বড়ো চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো।
–রিল্যাক্স ইয়ার, আর কতো মারবি। হইচে অহন একটু শান্ত হ।

গার্ডস আর সিকিউরিটি গুলো আদিত্যের সামনে এসে মাথা নিচু করে অপরাধী সুরে বললো।
–আমরা জানি আমাদের অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। উই আর রিয়েলি সরি স্যার। ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ভুল হবে না।

আদিত্য এবার একটু শান্ত হয়ে বললো।
–ঠিক আছে যাও তোমরা। বিহান ওদের কে টাকা দিয়ে দে। ওরা ট্রিটমেন্ট করিয়ে নিবে।

বিহান মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।

এদিকে শায়না উপর থেকে সবকিছুই দেখছে। মনে মনে একটু ভয় লাগছে ওর। যদি নূর আদিত্যকে আসল কথাটা বলে দেয় তখন কি হবে? আদিত্য নাজানি ওর সাথে আবার কি করে। শায়না ভয়ে ঢোক গিলতে লাগলো।
____

বিহান আবিরের রুমে আয়নার সামনে শার্ট খুলে নিজের ক্ষততে মলম লাগাচ্ছে। তখন নূরকে বাঁচাতে গিয়ে মারামারি করার সময় ওর নিজেরও একটু লেগেছে। আদিত্য অবশ্য ওকে হসপিটালে যেতে বলেছিল। কিন্তু এই সামান্য কারণে হসপিটালে যাওয়া ওর কাছে নেহায়েতই হাস্যকর মনে হয়। এর থেকে কতো বড়বড় আঘাত বিহান সয়ে গেছে। এর আর এমনকি।

বিহানের পিঠেও একটু লেগেছে। কিন্তু বিহানের হাত সেই পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। বিহান অনেক চেষ্টা করেও হাত সেই পর্যন্ত নিতে পারছে। এই আবিরটাও রুমে নেই যে ওর কাছে হেল্প চাইবে। হালায় নির্ঘাত কুনোহানে গিয়া রঙ্গলিলা করছে।বিহান আবারও চেষ্টা করতে লাগলো। নাহ কিছুতেই হাত পৌঁছাচ্ছে না।
হঠাৎ ওর পিঠে কারোর স্পর্শ অনুভব করলো বিহান। বিহান আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা আয়াত। বিহান একটু অবাক হয়ে পেছনে ফিরে বললো।
–আপনি?

আয়াত অতি স্বাভাবিক সুরে বললো।
–হ্যাঁ আমি। ভাইয়াকে ডাকতে এসেছিলাম। আপনাকে এভাবে স্ট্রাগল করতে দেখে এগিয়ে এলাম। ঘুরে দাঁড়ান আমি মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।

বিহান অপ্রস্তুত ভাবে বলে উঠলো।
–না না আপনের পেরেছান হওয়ার দরকার নাইক্কা। আমি কইরা লমুনে।

–হ্যাঁ হ্যাঁ কতো করতে পারবেন তাতো দেখতেই পাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। আমি আপনার গায়ে পড়তে আসিনি। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের হেল্প করা সাবারই নৈতিক দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব বোধ হিসেবেই আমি আপনার হেল্প করছি। তাছাড়া অন্য কোন মতলব নেই আমার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আর তাছাড়া আমাদের দুজনেরই এবাড়িতে প্রায় সময়ই থাকতে হয়। তাই কতক্ষণই বা একজন আরেকজন কে ইগনোর করে থাকা যাবে। তাই সাধারণ সৌজন্যতার খাতিরে আমাদের স্বাভাবিক কথা বার্তা বলাই উচিত। এতে করে আমরা একজন আরেকজনের সামনে আনকম্ফর্টেবল ফিল করবো না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। এতো লম্বা চওড়া জাস্টিফিকেশানের পর, এবার নিশ্চয় মলম টা লাগিয়ে দিতে পারি?

বিহান এতক্ষণ অবাক হয়ে আয়াতের কথা গুলোই শুনছিল। আয়াতের মলম লাগানোর প্রশ্নে বিহান একটু অপ্রস্তুত ভাবে মাথা ঝাকালো।মানে ঠিক আছে। বিহান ঘুরে দাঁড়ালে আয়াত মলম লাগিয়ে দিতে লাগলো। বিহান অবাক চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে আয়াতকে দেখছে। এই মেয়েটাকে হঠাৎ করে কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে ওর কাছে। আগের আয়াতের সাথে কোন মিল নেই এর। আগের মতো আর বাচ্চামো চঞ্চলতা নেই এর মাঝে। কেমন যেন স্ট্রং আর ম্যাচিওর লাগছে ওকে। এই নতুন আয়াতের মাঝে কিছু একটা আছে যা বিহানকে ভাবাতে বাধ্য করে। আগে কখনো তো এমন হয়নি। আচ্ছা মেয়েটা কি আমার জন্য এমন হয়ে গেছে? কতো সাবলীলায় বলে দিল আমাদের স্বাভাবিক থাকতে হবে। সত্যিই কি আমরা স্বাভাবিক থাকতে পারবো? যেন কিছুই হয়নি?

বিহানের ভাবনার মাঝেই আয়াত মলম লাগাতে লাগাতে শান্ত সুরে বলে উঠলো।
–ক্ষত হওয়ার সাথে সাথেই তার নিবারণ করতে হয়। নাহলে ক্ষতটা নাছোড় হয়ে যায়। তার বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। তারপর সারাজীবন আর এর যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।
কথাগুলো বলে আয়াত মলম লাগিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। আর বিহান আয়াতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ওর কথার সারমর্ম খুঁজতে লাগলো।
________

বিশ মিনিট পর আদিত্য আবার নাম নিজের রুমের দিকে এগুলো। রাগের মাথায় এঞ্জেল টাকে তখন একটু বেশিই কথা শুনিয়ে দিয়েছি। নিশ্চয় এখন রুমে অভিমান করে বসে আছে। এখন আবার পরিটার রাগ ভাঙ্গাতে হবে। কথাটা ভেবে মুচকি হেসে নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো আদিত্য।

কিন্তু ভেতরে ঢুকে নূরকে কোথাও দেখতে পেল না আদিত্য। ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওয়াশরুমের দরজা খোলা। তারমানে ওখানেও নেই নূর। আদিত্য বেলকনিতে গিয়ে চেক করলো, সেখানেও নেই নূর। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, কই গেল মেয়েটা? এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারলাম না। তখন এতোকিছু বলে গেলাম। তবুও আবার গায়েব? নাজানি আবার কই গিয়ে বসে আছে? আদিত্য ভাবছে, ওতো এতক্ষণ নিচেই ছিল। নূর নিচে গেলে নিশ্চয় ও দেখতে পেত। তারমানে ও নিচে যায়নি।তাহলে কোথায় গেল?

আদিত্য সেদিনের কথা মনে করে কাবর্ড খুলে চেক করলো। না আজ ওখানেও নেই। আদিত্য এবার রুম থেকে বেড়িয়ে সবার রুমে গিয়ে চেক করলো। কিন্তু কোথাও নূরকে পেল না। এবার ওর ভয় হতে শুরু হলো। জলজ্যান্ত একটা মানুষ এভাবে উপর থেকে কোথায় যেতে পারে? আদিত্যর হঠাৎ ছাঁদের কথা মনে পড়লো।নূর ছাঁদে যায়নি তো? কথাটা মনে আসতেই আদিত্য দ্রুত ছাঁদের দিকে দৌড়ালো।

ছাঁদে এসে যা দেখলো তাতে আদিত্যর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠলো আদিত্যের। ওর সামনেই নূর ছাঁদের রেলিঙের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একটুখানি পা স্লিপ করলেই যেকোনো সময় নিচে পরে যাবে নূর। এমন দৃশ্য দেখে আদিত্য রক্তশূণ্য হয়ে পড়লো। হাত পা কাঁপতে লাগলো। আদিত্য আতঙ্কিত কন্ঠে চিল্লিয়ে নূরের নাম ধরে ডাকলো।
–নূরররররর….

আদিত্যের ডাকে নূর পেছনে ফিরে তাকালো। আদিত্য দৌড়ে নূরের কাছে যেতে নিলে নূর বলে উঠলো।
–এই এই খবরদার আমার কাছে আসবে না কিন্তু। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।

সাথে সাথে আদিত্য থেমে গেল। নূর একটু নড়াচড়া করলেও পরে যাবে। সেই ভয়ে আদিত্য আর এগুলো না। নূরকে কোনরকমে নারাজ করা যাবেনা। ওখানে যে নূরের পা নয় আদিত্যের জান আটকে। আদিত্য কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ওর বোধশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। অন্তর আত্মা ধড়ফড় করছে। নিজেকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর।তখন যদি নূরকে ওভাবে বকা দিয়ে চলে না যেতাম। তাহলে হয়তো এসব হতোনা।আমার বকা দেওয়ার কারণেই নূর নিশ্চয় অভিমান করে এখানে চলে এসেছে। এখন কি করবো আমি?

আদিত্য ঢোক গিলে কান্না জড়িত করুন কন্ঠে বললো।
–নূর সোনা তুমি ওখানে কি করছ? নেমে আসো প্লিজ?

নূর বলে উঠলো।
–না আমি নামবো না।

আদিত্য আর পারছে না। লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। আদিত্য এবার হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে দুই কান ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় মিনতির সুরে বললো।
–প্লিজ সোনা, নেমে আয় প্লিজ? এতো বড়ো শাস্তি দিসনা আমাকে। আমার ভুল হয়ে গেছে। আই প্রমিজ আমি আর কখনো তোকে বকা দিবনা।কখনো না। একবার নেমে আয়? প্লিজ নেমে আয় না কলিজাটা? প্লিজ প্লিজ প্লিজ….

আদিত্যকে কাঁদতে দেখে নূরের সহ্য হলোনা। নূর এবার আস্তে করে রেলিং থেকে নেমে এলো। রেলিং থেকে নেমে দাঁড়াতেই আদিত্য এক ছুটে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে নূরকে বুকের মাঝে আটকে ফেললো। নূরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ঝড়াতে লাগলো। আজ একমুহূর্তের জন্য যেন আদিত্যের পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আদিত্য নূরকে নিয়েই ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তারপর দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে সারামুখে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলো। আদিত্য এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে যে,নূরের মুখে চুমু খেতে খেতে হঠাৎ নূরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। আদিত্যের এহেন কাজে নূর একটা ঝটকা খেল।ওর সারা শরীরে কিছু একটা হয়ে গেল। তবে অবুঝ নূর সেটা বুঝতে পারলোনা। বিস্ময় নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো।তবে আদিত্যের কোন হুঁশ নেই ও কি করছে। এভাবে কিছু সময় থাকার পর আদিত্য নূরের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আবেগি কন্ঠে বললো।
–কি করছিলে তুমি এসব? তুমি বারবার এমন কেন করো? নাহয় একটু বকা দিয়েছি। তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দিবে?

নূর কি বলবে?ও বেচারি তো এখনো শকের ভেতর আছে। শুধু চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আদিত্যের দিকে। নূরকে চুপ থাকতে দেখে আদিত্য নূরকে হালকা ঝাঁকিয়ে বললো।
–কি হলো? বলো?

নূর এবার একটু নড়েচড়ে উঠে বললো।
–আরে তোমাকে শাস্তি দেব কেন?

–তাহলে ওখানে কি করছিলে তুমি?

–আরে আমিতো তোমার জন্য ফুল পারতে গিয়েছিলাম। এইযে দেখ।
কথাটা বলে নূর ওর পেছন থেকে হাত বের সামনে আনলো। ওর হাতে ছিল একটা কাঠগোলাপ। নূর সেটা দেখিয়ে বললো।
–এই ফুল পারতেই তো আমি ওখানে উঠেছি। আসলে আমার হাত পৌঁছাচ্ছিল নাতো, তাই ওটার উপরে উঠেছিলাম। শুধু একটাই পারতে পেরেছি। আরও পারবো তার আগেই তো তুমি নেমে আসতে বললে।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এই সামান্য ফুল পাড়তে তোমাকে ওখানে উঠতে হবে? তোমার এতই যখন ফুল পারার ইচ্ছে ছিল। আমাকে বলতে আমি পেরে দিতাম?আর এই ফুল দিয়ে করবেটা কি তুমি?

–কেন তোমাকে দিব। আসলে তুমি তখন অনেক রাগ করেছিলে তো,তাই তোমার জন্য এই ফুল পারছিলাম। যাতে তোমার রাগ ভেঙ্গে যায়।

আদিত্য অবাক চোখে তাকালো নূরের দিকে। ওর এঞ্জেল টা ওর জন্য এসব করেছে? নূর হাতের ফুলটা আদিত্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
–এই নাও এটা তোমার জন্য। আর রাগ করে না হ্যাঁ? আমি এখন থেকে সবসময় তোমার কথা শুনবো।আই প্রমিজ।

আদিত্য কাঠফুলটা হাতে নিয়ে বললো।
–এই ফুল নিতে তুমি এখানে এসেছ? তুমি কি ভেবেছ এটা দেখে আমি খুশী হয়ে যাবো? ওখান থেকে পড়ে গেলে কি হতো তুমি জানো? আমার জান গলায় আটকে গিয়েছিল। আর উনি আমাকে ফুল দিচ্ছে। এমন স্টুপিড আইডিয়া আসলো কোথাথেকে তোমার মাথায়?

নূর ফট করে বললো।
–আমার মাথায় আসেনি তো। শায়না বলেছে আমাকে।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট?? শায়না তোমাকে এসব করতে বলেছে তোমাকে?

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ ওইতো বললো।

–কি বলেছে?

নূর আদিত্যকে বলতে লাগলো।
“যখন আদিত্য রুম থেকে রাগ করে বেড়িয়ে গেল তার কিছু সময় পর শায়না রুমে ঢোকে। নূরের মন খারাপ দেখে ওর কাছে বসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। নূর সরল মনে তখন শায়নাকে সবটা বলে দেয়।শায়না সবটা শুনে নূরকে বলে,ও যদি ছাঁদ থেকে ওই ফুল এনে আদিত্যকে দেয় তাহলে আদিত্যর রাগ চলে যাবে। নূর তাই শায়নার কথা শুনে ছাঁদে আসে ফুল নিতে। ”

সবটা শুনে আদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ওরতো শায়নার ওপর প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। যখন ও সিসি ক্যামেরায় শায়নাকে নূরের সাথে কথা বলতে দেখেছে। আর তার পরপরই নূর ওভাবে বেড়িয়ে গেল। আদিত্য নূরকে বললো।
–আচ্ছা বলোতো শায়না আরও কি কি বলেছে তোমাকে?

নূর আদিত্যকে ধীরে ধীরে শায়নার বলা সবকথা বলতে লাগলো। নূরের কাছ থেকে সব শুনে আদিত্যের ক্রোধ এবার সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেল। ওর নাকের নিচ দিয়ে কেউ ওর এঞ্জেলের ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর সেকিনা টেরই পেলনা? রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আদিত্যর। তখনই নূর বলে উঠলো।
–এই হিরো তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছ? সরি না? রাগ করে না হ্যাঁ,?

নূরের কথায় আদিত্য চোখ বন্ধ করে নিজের রাগটাকে আপাতত দমিয়ে নিল। ওকে তো পরে দেখা যাবে। তারপর চোখ খুলে মুচকি হেসে নূরকে আবার জড়িয়ে ধরলো। আজকের দিনটা আদিত্যের কাছে সবচেয়ে ভয়াবহ খারাপ দিন ছিল। এই দিনটির কথা ও কখনো মনে করতে চায় না। আদিত্যের এখন শুধু একটাই চাওয়া আল্লাহর কাছে। ওর নূর যেন তাড়াতাড়ি ঠিক হচ্ছে যায়। যাতে আর কেও নূরের সরলতার সুযোগ নিয়ে ওর ক্ষতি করতে না পারে। যদিও ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন দেওয়া হচ্ছে নূরকে। নিয়মিত চেকাবও করাচ্ছে। তবুও তেমন কোন ইম্প্রুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ যেন জলদিই আমার নূরকে সুস্থ করে দেন।
একটু পরে আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের সোফায় গেল।
_____

রাত ১১ টা
আদিত্য নূরকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সারাদিনের টেনশন আর ক্লান্তির কারণে সকাল সকালই ঘুমিয়ে পড়েছে আদিত্য। তবে নূরের চোখে ঘুম নেই। ও এখনো চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। ওর মাথার ভিতরে শুধু আদিত্যের করা তখনকার সেই কাজটাই ঘুরছে। অবুঝ নূর মনে মনে ভাবছে, আমি সেদিন ঠোঁট খেতে চাইলাম আর কেমন ধমক দিয়ে দিল। আর নিজে যে আজ আমার ঠোঁট খেল তার বেলায় কিছুনা। আর আমি চাইলেই দোষ।

নূর মাথাটা একটু উঁচু করে আদিত্যের অধর পানে তাকালো। হিরোর ঠোঁট জোড়া একদম ইয়াম্মি দেখতে। দেখলেই কেমন যেন খেতে ইচ্ছে করে। সেদিন আদিত্য তার ঠোঁট খেতে দিয়েছিল না বলে, নূর অন্য কারোর ঠোঁট খাওয়ার আশায় সবার ঠোঁটের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করেছিল।কিন্তু কারোর ঠোঁটই ওর কাছে ভালো লাগেনি। বরং কেমন যেন ঘৃণা ঘৃণা লাগতো। কতজনের টা দেখে তো নূরের বমি চলে এসেছিল। কিন্তু হিরো, হিরোর ঠোঁট জোড়া সবচেয়ে ভালো লাগে দেখতে। একদম ইয়াম্মি ইয়াম্মি। নিশ্চয় খেতেও অনেক মজা হবে। আজতো আমি হিরোর ঠোঁট খেয়েই ছাড়বো। সে আমার টা খেয়েছে আমিও তারটা খাবো হিসাব বরাবর।

নূর নিজের মতো হিসাব নিকাশ করে নিয়ে ধীরে ধীরে আদিত্যর ঠোঁটের দিকে এগুলো। একসময় একদম কাছে চলে এলো। অতঃপর আদিত্যর অধরের সাথে নিজের অধর মিলিয়ে নিল। অধরযুগল মেলাতেই নূরের সারা শরীরে কিছু একটা হয়ে গেল। কেমন শিহরন ছড়িয়ে পড়লো। যার মর্মার্থ আপাতত নূরের বোধগম্য না। তবে যায় হচ্ছে নূরের কাছে সেটা ভালোই লাগছে। সেদিন টিভিতে দেখা ছেলে মেয়েরা যেমন করেছিল সেটা মনে করে নূরও তেমনই করলো। একপর্যায়ে আদিত্য নড়েচড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। তবে নূর থামে না ও ওর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গভীর ঘুমে থাকায় আদিত্যর ঘুম এখনো পুরোপুরি ভাঙ্গেনি। তাই ও নিজেও কেমন ঘোরের ভেতর আছে।

নূরের এমন চুম্বনে আদিত্যর লোমকূপ কাটা দিয়ে উঠলো।আদিত্যরও নেশা লেগে গেল। আদিত্য ঘোরের মাঝেই এক হাতে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেক হাত নূরের চুলের মাঝে দিয়ে নিজেও নূরের অধরসুধাপান করতে লাগলো। এতে করে নূরের শিহরণ আরও বেড়ে গেল। নূরের শরীর কাঁপতে শুরু করলো। যদিও নূর কিছু বুঝতে পারছে না, তবুও যাই হচ্ছে ওর কাছে ভালোই লাগছে। আদিত্যরও নেশা আরও বাড়তে শুরু করলো। একপর্যায়ে আদিত্য নূরের অধর ছেড়ে ধীরে ধীরে ওর গলায় নেমে এলো। নূরের গলায় চুমু খেতে লাগলো। আদিত্যর এই কাজটা নূর বুঝতে পারলো না।তাই ফট করে বলে উঠলো।
–আচ্ছা, গলাও খাওয়া যায় বুঝি?

এমন একটা মুহূর্তে নূরের এমন বাচ্চামো কথায় আদিত্যের সব ঘোর কেটে গেল। সাথে সাথে নূরকে ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো আদিত্য।শিট, আমি কি করছিলাম এসব? আদিত্য তড়িঘড়ি করে উঠে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি মারতে লাগলো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো।
–এসব কি করছিলি তুই আদিত্য? পাগল হয়ে গেছিস তুই? নিজের ওপর কি এই তোর নিয়ন্ত্রণ? হ্যাঁ মানলাম নূর আমার স্ত্রী। তাই বলে ওর মতো অবুঝ মেয়ের সাথে আমি এসব কিভাবে করতে পারলাম?
এসব হাবিজাবি বলে কতক্ষণ নিজেকে বকতে লাগলো আদিত্য।

আদিত্যের এখন রুমে যেতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে। যদি নূর ওকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে কি বলবে তখন ও? তাই আদিত্য কিছু সময় ওয়াশরুমেই দাঁড়িয়ে রইলো। প্রায় বিশ মিনিট পর আদিত্য আস্তে করে দরজাটা হালকা খুলে দেখলো নূর জেগে আছে কিনা। নূর ঘুমিয়ে পরেছে দেখে আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর আস্তে করে দরজা খুলে পা টিপে টিপে বেডের ওপর এসে বসলো। নূর আরামে ঘুমিয়ে আছে। আদিত্য এবার নূরের দিকে তাকালো। বালিশের ওপর এক হাতে ভর দিয়ে, হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। নূরের ঠোঁটের দিকে তাকাতেই তখনকার মধুর মূহুর্তেটা মনে পড়লো আদিত্যের। আদিত্য নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো। মনে মনে বললো,বউটা সত্যি সত্যিই ঠোঁট খেয়েই ছাড়লো। আমিতো ভেবেছিলাম আজকের দিনটা আমার সবচেয়ে খারাপ দিন। এই দিনটাকে আর কখনো মন করবোনা। তবে দিন শেষ হতে হতে যে আমার বউটা দিনটাকে এমন স্পেশাল বানিয়ে দিবে তা ভাবতেই পারিনি। সত্যিই আজকের দিনটা আমি কখনো ভুলতে পারবোনা। আমার এঞ্জেলের দেওয়া প্রথম ভালোবাসার মুহূর্ত। কথাগুলো ভেবে আদিত্য মুচকি হেসে নূরের কপালে একটা চুমু খেয়ে গায়ে ভালো করে চাদর টেনে দিল।

তারপর একটু পরে উঠে দাঁড়াল আদিত্য। চোখ মুখের ভাবভঙ্গি হঠাৎ পরিবর্তন করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল আদিত্য।

চলবে……

(আমার পাঠকেরা যে শায়নাকে এতো ভালোবাসে তা আমার জানাই ছিলনা। গত পর্বের কমেন্ট শুধু শায়না ময় ছিল। তাই আদিত্যও এখন শায়নাকে ভালোবাসবে 😜)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here