মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ৩৩

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৩

★ বিকালে আয়াতের বলা টাইম মেতাবেক বিহান গাড়ি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াতকে সাথে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু আয়াতের আসার কোন নাম নেই। বিহান বোর হয়ে একটা সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ পরেই আয়াত বেরিয়ে এলো।বিহান আনমনে পাশে তাকাতেই ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল মস্তিষ্কের সকল কার্যক্রম। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনে থেকে আসা অপরুপ রমনীর দিকে।

আয়াত আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটা নৃত্য পরিবেশন করবে। তাই সেই অনুযায়ী সে তৈরি হয়েছে।পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, দুই হাত ভর্তি লাল কাচের চুড়ি, মাথায় উঁচু করে ফুলিয়ে খোঁপা করা,খোপার ওপর দিয়ে বেলি ফুলের গাজরা লাগানো,কপালের ওপর টায়রা,দু কানে বড়ো ঝুমকা, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া। সবমিলিয়ে যেন আয়াতকে এক অপ্সরী লাগছে। বিহান যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। আশেপাশের সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা, শুধু আয়াতকেই দেখতে পাচ্ছে বিহান। এমন ভাবে কখনো আয়াতকে ভালো করে খেয়াল করে দেখেনি বিহান।তবে আজ কেন চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে ওর কাছে? আজকাল বিহানের সবকিছুই যেন ওর অবাধ্য হয়ে গেছে। বিহানের কথা ওরা শুনতেই চায় না। নিজের মনমর্জি মতোই চলে।

বিহান এখানো ওভাবেই তাকিয়ে আছে। আর ওর আঙুলে ধরে রাখা সিগারেট টা পুড়তে পুড়তে একদম শেষ মাথায় চলে এসেছে। শেষ মাথায় আসতেই বিহানের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগলো। সিগারেটের ছ্যাঁকায় বিহানের ঘোর কাটলো। বিহান সিগারেট টা ফেলে দিয়ে হাত ঝাঁকাতে লাগলো। তখনই আয়াত ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–কি হয়েছে?

বিহান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তেমন কিছুনা। ওই সিগারেটের ছ্যাঁকা লেগেছে একটু।

আয়াত স্মিত হেসে বললো।
–দুশমনকে কাছে রাখলে দুশমন তো ছোবল মারবেই। এসব ছাইপাঁশ না খেলে কি হয়? আমাকে তো সেদিন এতো বুঝালেন যে, জীবন এতো সহজ না।বেঁচে থাকতে অনেক কষ্ট করতে হয়। তো এতো স্ট্রাগল করে বেঁচে আছেন কি এসব খেয়ে অকালে মরার জন্য? জানেন একজন সুইসাইড করা ব্যাক্তি আর একজন সিগারেট খাওয়া ব্যাক্তির মাঝে কোন তফাৎ নেই। একজন সাথে সাথে মরে আরেকজন ধুঁকে ধুঁকে মরে। ব্যাস এতটুকুই পার্থক্য। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

একদমে কথাগুলো বলে আয়াত এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতর বসলো। আর বিহান ওভাবেই কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আয়াতের কথাগুলো ভাবতে লাগলো। আজকাল মেয়েটার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতেই পারে না বিহান।কেমন যেন ভাষাহীন হয়ে যায়। বিহানের ভাবনার মাঝে আয়াত গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে বিহানকে অবগত করলো। বিহান ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এসে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িতে দুজনের ভেতর আর তেমন কোন কথা হলোনা।

অনুষ্ঠানের ভেন্যুতে এসে বিহান গাড়ি থামালো। আয়াত দরজা খুলে নামতে নিলেই বিহান পাশ থেকে বলে উঠলো।
–শোন,,

সাথে সাথে আয়াত থেমে গেল। বুকটা কেঁপে উঠল ওর। এই প্রথম বিহান আয়াতকে তুমি সম্বোধন করে ডাকলো। আয়াত একটা ঢোক গিলে বিহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–জ্বি? কিছু বলবেন?

বিহান একটু গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। তারপর একটু আমতা আমতা করে বললো।
–ব বলছিলাম যে, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

আয়াতের যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকি ঠিক শুনলো? বিহান ওর প্রশংসা করছে? আয়াতের শরীর কেমন কেঁপে উঠল। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে ওর চোখ ভরে উঠবে। তাই কোনরকমে ঠোক গিলে বললো।
–ধন্যবাদ,,
কথাটা বলেই আয়াত ঝট করে নেমে গেল। নাহলে যে অবাধ্য নোনাজল গুলো চোখের বাধ ভেঙে গড়িয়ে পরবে। সে বিহানের সামনে আর দূর্বল পরতে চায়না।

বিহান আয়াতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আয়াতকে যে সে তুমি করে সম্বোধন করেছে সে ব্যাপারে এখনো হুঁশ নেই বিহানের। কেন যেন আজ হঠাৎ করেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আজকাল সত্যিই কোনকিছু বিহানের আয়ত্তে থাকে না।
বিহান একটু গাড়ি পার্ক করে নিজেও ভেতরে গেল।

একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। আয়াত আর তার বন্ধুরা মিলে অনুষ্ঠানের সঞ্চালন করছে। ছোট ছোট বাচ্চারা এসে নানান রকম পরিবেশনা দেখাচ্ছে। কেউ গান, কেউ কবিতা, কেউ নাচ করে দেখাচ্ছে। বিহান দর্শক সারিতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। বিহান না বললেও আয়াতের এই উদ্যোগে অনেক খুশী। বিশেষ করে এই সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের জন্য অনেক ভালো লাগছে ওর। এসব বাচ্চাদের আর বিহানের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঠোকর খেতে হবে না। এদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে।

কিছুক্ষণ পরে আয়াত মঞ্চে এলো। মঞ্চে এসে ওর পারফরম্যান্স শুরু করলো। #ফাগুনের মোহনায় গানটিতে সুন্দর একটা নৃত্য পরিবেশন করলো আয়াত। বিহান মনোমুগ্ধকর হয়ে আয়াতের নৃত্য দেখছে। ওর বুকের ভেতর জং ধরে যাওয়া যন্ত্রটা যেন আজ নতুন উদ্যমে চলতে শুরু করেছে। যেন কোন নতুন প্রাণের খোঁজ পেয়েছে সে। তাহলে কি শেষমেশ বিহানও সেই ভালোবাসা নামক মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে গেল? কথাটা ভাবতেই বিহানের ঠোঁটের কোনায় কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ভেসে উঠলো।

পারফরম্যান্স শেষে আয়াত সবার উদ্দেশ্যে নিজের এনজিও সম্পর্কে সুন্দর একটা স্পিস দিল। বিহান আজ যত দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে আয়াতকে দেখে। এই একটা মেয়ের মাঝে কতো প্রতিভা লুকিয়ে আছে বিহান আগে কখনো বুঝতেই পারেনি।
আয়াতের স্পিচ শেষে সবাই করতালি দিয়ে উঠলো। তারপর একে একে সব অতিথিরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ডোনেশন দিতে লাগলো।আয়াত খুশী মনে সবার ডোনেশন কালেক্ট করতে লাগলো।

বিহানও ওর পক্ষ থেকে একটা চেকে কিছু এমাউন্ট লিখে আয়াতের দিকে এগিয়ে গেল। আয়াতের সামনে এসে যেই ওর চেকটা দিতে যাবে তখনই হঠাৎ আরেকটা ভদ্রলোক আয়াতের দিকে একটা পঞ্চাশ লাখ টাকার চেক এগিয়ে দিল। আয়াত একবার চেকটার দিকে তাকালো তারপর মুখ তুলে লোকটার তাকালো। লোকটাকে দেখে আয়াত মুচকি হেসে অমায়িক ভাবে বললো।
–আরে রাফিন সাহেব আপনি? আপনিতো বলেছিলেন আপনি আসবেন না?

রাফিন মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ কাজের জন্য আসা অনেক টা অসম্ভবই ছিল বটে। তবে যেখানে তুমি ডেকেছ সেখানে কি আমি না এসে পারি? তাও আবার এতো ভালো কজের জন্য। তাইতো চলে এলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। আই হোপ এই অধমের সারপ্রাইজে তুমি খুশী হয়েছ।

আয়াত হাসি মুখে বললো।
–অবশ্যই অবশ্যই। আপনি আসায় আমরা সবাই খুশী। তারওপর আপনি এতো বড় মাপের ডোনেশন দিয়েছেন। এটাতো আমাদের জন্য অনেক খুশীর বিষয়। থ্যাংক ইউ সো মাচ রাফিন সাহেব। আমরা সবাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্লিজ হ্যাভ অ্যা সিট।

–বসতে পারি তবে এক শর্তে।

–কি শর্ত?

–আমাকে রাফিন সাহেব না বরং শুধু রাফিন বলে ডাকবেন প্লিজ। আসলে আপনার মুখে রাফিন সাহেব শুনে নিজেকে কেমন ওল্ড ওল্ড লাগে। সো ক্যান ইউ স্কিপ সাহেব?

আয়াত মুচকি হেসে বললো।
–ওকে রাফিন সাহে,, সরি আই মিন রাফিন। প্লিজ হ্যাভ অ্যা সিট।

রাফিন হাসি মুখে আয়াতের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।

এতক্ষণ ধরে বিহান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের কার্যক্রম দেখছিল। এই লোকটার সাথে আয়াতের এতো আদিখ্যেতা দেখে বিহানের ভ্রু কুঁচকে এলো। বিহান লোকটাকে ভালো করে স্ক্যান করে দেখলো।লোকটা বয়সে ওর সমানই হবে। সুট বুট পরা একদম জেন্টেল ম্যান যাকে বলে। কিন্তু কে এই লোকটা? আর আয়াত একে কিভাবে চিনে?

আয়াত এতক্ষণে বিহানকে খেয়াল করলো। বিহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–বিহান জি, কিছু বলবেন?

বিহান ওর চেকটা পেছনে লুকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো।
–না না তেমন কিছুনা। আমিতো খালি জিগাইবার আইচিলাম, আপনে কহন বাইর হইবেন?

–উমম আমার তো মনে হয় একটু দেরি হবে। আপনার সমস্যা হলে আপনি নাহয় চলে যান। আমি একাই চলে যাবো।

–না না ছমস্যার কি আচে? আপনের কাজ যহন ছ্যাচ হয় তহনই লইয়া যামুনে। রাইতো হইয়া গেছে,এতো রাইতে আপনের একলা যাওন ঠিক না। আমি বাইরে অপেক্ষা করতাছি। আপনের কাম ছ্যাছ হইলে চইলা আইহেন।

আয়াত মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে।

বিহান এবার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ইতস্তত ভাবে বললো।
–আইচ্ছা ওই লোকটা কে,? আর আপনে হ্যারে ক্যামতে চিনেন? না মানে আগে কহনো দেহিনাই তো তাই কইলাম।

আয়াত বলে উঠলো।
–আরে উনি? উনিতো অনেক বড় বিজনেস ম্যান আর সোস্যাল ওয়ার্কার। আমার এই এনজিওতে উনি অনেক হেল্প করেছেন। বলতে গেলে উনি না হলে হয়তো এনজিও টা চালাতেই পারতাম না। সত্যিই উনি অনেক বড়ো মনের মানুষ।

বিহান আর কিছু না বলে ওখান চলে এলো। কিছুটা দূরে এসে আয়াতের এক বান্ধবীর কাছে ওর চেকটা ধরিয়ে দিল। বিহান দূর থেকেই আয়াত আর ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। দুজন কি সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। রাফিন কেমন যেন শুধু আয়াতের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর তার চোখের ভাষায় আয়াতের প্রতি তার ভালোলাগা টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বিহানের বুকের ভেতর টা কেমন যেন জ্বলতে শুরু করলো। তখনই বিহানের মনে পড়লো আদিত্যের বলা সেদিনের কথাটা,”ভালো থাকতে চাইলে জীবনে সবসময় সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করতে হয়। নাহলে বেশি দেরি হয়ে গেলে তখন আর চাইলেও ভালো থাকা যায় না”
আমি কি সত্যিই দেরি করে ফেলেছি? আয়াত কি ভালো থাকার নতুন পথ বেছে নিয়েছে?
_____

রাত ৯টা
আদিত্য ডিনারের জন্য ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। নূর আর নিলা আগেই এসে বসেছে। নিলার বাবা একটু অসুস্থ তাই সে আগেই নিজের রুমে খেয়ে নিয়েছে। নূরের মা সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে। নূর আর নিলা খাওয়া শুরু করলো। তবে আদিত্য এখনো খাচ্ছে না। সেটা দেখে নূরের মা বলে উঠলো।
–কি হলো আদিত্য খাচ্ছোনা কেন? খাওয়া শুরু করো?

আদিত্য করুন সুরে বললো।
–কিভাবে খাবো মা। আসলে আজকে রাস্তায় একটা গাড়ির সাথে আমার গাড়ির হালকা টক্কর লেগেছিল। তাই ডান হাতে কাচের টুকরো বিঁধে যাওয়ায় হাতে অনেক ব্যাথা হচ্ছে। এখন এই হাত দিয়ে কিভাবে খাবো বলুন?

নূরের মা চিন্তিত সুরে বললো।
–সেকি, কি বলো?কখন হলো এটা? দেখিতো একটু?
নূরের মা আদিত্যের হাত ধরে চেক করতে লাগলো। আদিত্য তখন চোখের ইশারায় কিছু বুঝালো। নূরের মা তখন বুঝতে পারলো যে, আদিত্য এসব ড্রামা করছে। তাই তিনিও ড্রামা করে বললো।
–ইশশ কতখানি ব্যাথা পেয়েছে আহারে। এখন ছেলেটা খাবে কি করে?

নূর একটু কৌতুহলী চোখে আদিত্যের দিকে তাকালো। আদিত্যের এক্সিডেন্টের কথা শুনে ওরও কেমন জানি খারাপ লাগছে। তবে কিছু বললো না ও।
নিলাও ওর মায়ের সাথে মিলে ড্রামা করে বললো।
–হ্যাঁ সত্যিতো। বেচারা ভাইয়া এখন কিভাবে খাবে?

নূরের মা হঠাৎ বলে উঠলো।
–নূরিমা তুই খাইয়ে দেনা ছেলেটাকে?

নূর বেচারি পুরো টাস্কি খেয়ে গেল। ওর মায়ের কথা শুনে আজ ওর পুরো বিশ্বাস হয়ে গেল যে এটা ওর মা না। নিশ্চয় ওর মা বদলে গেছে। টিভি সিরিয়ালের মতো ডুপ্লিকেট কেউ এসে ওর মায়ের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। আর নয়তো ওর মায়ের ভেতর কোন ভূত প্রেতের আত্মা ঢুকে গেছে। নাহলে ওর মা কখনো এমন উদ্ভট কথা বলতেই পারে না। এসব ভেবে নূর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো।
–মা তুমি কি ঠিক আছো? কি বলছ এসব?

নূরের মা বলে উঠলো।
–বারে কি এমন বললাম? বেচারা ছেলেটা হাতের ব্যাথায় খেতে পারছেনা তাইতো খাইয়ে দিতে বললাম। এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আরে একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের সাহায্য করাতো আমাদের ধর্ম তাইনা?

নূর দাঁত চেপে বললো।
–তো তুমি পালন করোনা এই ধর্ম। তুমিও তো তোমার সো কল্ড আদরের ছেলেকে খাইয়ে দিতে পারো।আমাকে কেন বলছ?

নূরের মা আমতা আমতা করে বললো।
–হ্যাঁ দিতাম না তো কি করতাম? চুলোয় রান্না বসানো আছে, আমাকে ওখানে থাকতে হবে। নাহলে আমিই খাইয়ে দিতাম। তুই খাইয়ে দে আমি গেলাম রান্না দেখতে।
কথাটা বলে নূরের মা তাড়াতাড়ি করে ওখান থেকে কেটে পড়লো।

নূর এবার পাশে তাকিয়ে যেই নীলাকে বলতে যাবে তখনই দেখলো নীলা ওখান থেকে গায়েব। যেন মুহূর্তেই নিলা গায়েব হয়ে গেছে।

আদিত্যের এসব দেখে ভীষণ মজা লাগছে। কপাল গুনে এমন একটা শাশুড়ী আর শশুড় বাড়ি পেয়েছে। এমন শশুর বাড়ি থাকলে আর কি লাগে। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে অসহায় ফেস বানিয়ে বললো।
–থাক তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি নাহয় আজ না খেয়েই থাকবো। একদিন না খেলে তো আর মরে যাবোনা তাইনা?

আদিত্যের কথায় নূরের কেমন মায়া লাগলো। নূর একটু অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বললো।
–ইটস ওকে। আসুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি। মা কি বললো শোনেন নি? আমরা মানুষই তো একজন আরেকজনের উপকারে আসবো।
কথাটা বলে নূর আদিত্যের খাবারের প্লেট টা নিজের হাতে নিল। তারপর ভাত মাখিয়ে আদিত্যর মুখের সামনে ধরলো।

আদিত্যকে আর পায় কে। সেতো এতক্ষণ এইটারই অপেক্ষা করছিল। নূরের হাতে খাওয়ার জন্যেই তো এতো ড্রামা করলো। আদিত্য দেরি না ফটাফট হা করে খাবার মুখে নিল। খাবার মুখে নেওয়ার সময় আদিত্য নূরের আঙুল গুলো সহ মুখে পুরে নিলো। নূরের আঙুল চুষে খাবারটা মুখের ভেতর নিল। আদিত্যের এহেন কাজে নূর কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতর আবারও ধুকপুক করে উঠলো। নূর বুঝতে পারছে না এই লোকটার ছোঁয়ায় ওর এমন কেন হয়। বাইরে চলা ফেরার সময় অসাবধানতায় কখনো কোন ছেলের ছোঁয়া লেগে গেলেও কেমন অস্তিত্বতে গা গুলিয়ে ওঠে। কিন্তু এই লোকটার ছোঁয়ায় কোন অস্বস্তি বা ঘৃণা কেন বোধ হয়না আমার? কেন মনে হয় এই ছোয়াটা খুবই পরিচিত, খুবই আপন। যেন একান্ত আপন কেউ। কেন এমন হয়? কে উনি? উনাকে ঘিরে এতো রহস্য কেন জাগে মনে?

এসব ভাবতে ভাবতে নূরের মাথার ভিতরে কেমন ব্যাথা হতে লাগলো। নূরের চোখের সামনে আবছা আবছা কিছু প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। যেখানে নূর এমন করেই কাওকে খাইয়ে দিচ্ছে। তবে ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে না। নূরের মাথার যন্ত্রণা আরও বাড়তে লাগলো। মাথার যন্ত্রণায় নূর বাম হাত দিয়ে ওর মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে হালকা আর্তনাদ করে উঠলো।
–আহহ

আদিত্যর চেহারায় অন্ধকার নেমে এলো। আদিত্য প্রচুর ঘাবড়ে গিয়ে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো।
–এ এই নূর কি হয়েছে তোমার? কথা বলো? কষ্ট হচ্ছে তোমার? বলো আমাকে?

নূর চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই বলে উঠলো।
–মা মাথা ব্যাথা করছে অনেক।

আদিত্য কোনকিছু না ভেবে নূরকে পাঁজা কোলে তুলে নিল। নূরকে ওর রুমে নিয়ে যেতে যেতে ওর মাকে ডাকলো আদিত্য। নূরকে রুমে এনে বেডে শুইয়ে দিল। নূরের মা ও দৌড়ে এলো রুমে। আদিত্য নূরের মাকে জিজ্ঞেস করলো নূরকে কোন মেডিসিন দেওয়া হয়। নূরের মা ঔষধ দেখিয়ে দিলে আদিত্য তাড়াতাড়ি করে নূরকে ওর মেডিসিন খাইয়ে দিল। মেডিসিন খাওয়ার কিছুক্ষণ পর নূরের মাথা ব্যাথা একটু কমে আসলো। আদিত্য নূরের পাশে বেডের ওপর বসে নূরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বললো।
–এখন কেমন লাগছে?

নূর এবার চোখ মেলে আদিত্যের দিকে তাকালো। এই কিছু সময়ের ব্যবধানেই আদিত্যকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। চোখ দুটো কেমন লাল বর্ন ধারণ করেছে। আচ্ছা উনি কি আমার জন্য এতো ব্যাকুল হচ্ছেন? কিন্তু কেন? আমি কি হই তার? আমার জন্য এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন?

নূরকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে আদিত্য আবারও বলে উঠলো।
–কি হলো কথা বলো? এখনো খারাপ লাগছে? তাহলে হসপিটালে নিয়ে যাই চলো।

নূর ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে বললো।
–না না তার দরকার নেই। এখন ঠিক লাগছে আমার।

নূরর কথায় আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নূরকে ওভাবে দেখে আদিত্য খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যে জন্য সে নূরকে কিছু বলে না। সেখানে সামান্য কারনে নূরের কিছু হয়ে গেলে সহ্য করতে পারবে না ও। নূরের সুস্থতার চেয়ে কিছুই জরুরি না ওর কাছে।
____

রাত ১০টা
আয়াতের দেরি দেখে বিহান আবারও আয়াতকে ডাকতে এলো। আয়াতের অফিস রুমের কাছে আসতেই থমকে গেল বিহান। খোলা জানালার ভেতর দিয়ে বিহান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আয়াতের সামনে তখনকার ওই রাফিন লোকটা এক হাঁটু গেড়ে বসে আছে। হাতে তার একগুচ্ছ ফুলের তোড়া। যেটা সে আয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলছে।
–আয়াত আই রিয়েলি লাভ ইউ। উইল ইউ বি মাইন?

হঠাৎ বিহানের মাথায় আগুন ধরে গেল।রাগে হাত মুষ্টি করে ফেললো ও। ছেলেটাকে এখন ওর খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। রাগে চোয়াল শক্ত করে বিহান ওদের কাছে যেতে নিল। দু কদম যেতেই বিহান আবার থেমে গেল। বিহানের ভেতরের আওয়াজ টা হঠাৎ বলে উঠলো।
–কি করছিস বিহান? কোথায় যাচ্ছিস? ওখানে তোর কোন কাজ নেই। যা হচ্ছে ঠিকই তো হচ্ছে। আয়াতের জন্য ওই ছেলেই যোগ্য। একবার ওই ছেলেটাকে দেখ, আর তোকে দেখ। ওর ধারে কাছেও যেতে পারবি না তুই। আয়াত যদি ভালো থাকার নতুন পথ বেছে নিয়ে থাকে। তাহলে তুই কেন বাঁধা দিতে যাবি? হোকনা ও ওর জীবনে সুখী। বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার কারণে। এখন শুধু ওর সুখী হওয়ার দিন। থাক ও ভালো। আমার কি, আমিতো আগেও লাওয়ারিশ ছিলাম, এখনো তাই আছি। সামনেও তাই থাকবো। আমার জীবনে আর কোন পরিবর্তন আসবে না।

এসব ভেবে বিহান আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ওখান থেকে চলে আসে। বুকটা কেমন জ্বলছে ওর। ইচ্ছে করছে চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে, কেন আমার ভাগ্যটা এমন? কি দোষ করেছি আমি? এতো যন্ত্রণদায়ক কেন আমার জীবন টা? জন্ম নিতেই মৃত্যু কেন হলোনা আমার? এমন অভিশপ্ত জীবনের থেকে মরে যাওয়া ভালো।

বিহান গাড়ির কাছে এসে গাড়িতে কয়েকটা লাত্থি মারলো।তারপর দু হাতে নিজের চুল টেনে ধরে নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আহত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো।
–আমি সত্যিই দেরি করে ফেললাম রে আদি। এ জীবনে বোধহয় আমার আর ভালো থাকা হলোনা।

আরও দশ মিনিট পর আয়াত গাড়ির কাছে এলো। বিহান ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে বিহান। আয়াত গাড়িতে বসে বলে উঠলো।
–সরি সরি দেরি হয়ে গেছে তাইনা?

বিহান সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো।
–হ দেরিতো হইয়াই গেছে অহন আর কিছু করনের নাইক্কা।

–আসলে অনেক কাজ ছিলো তাই,,,

আয়াতের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিহান বলে উঠলো।
–বাদ দ্যান ওইছব। আমি হুইন্যা কি করুম?
কথাটা বলে বিহান গাড়ি স্টার্ট দিল। একবারের জন্যও আয়াতের দিকে তাকালো না। রোবটের মতো সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো।

আয়াতের কাছে বিহানের বিহেভিয়ার একটু অন্যরকম লাগলেও, তেমন একটা ঘাটলো না আয়াত। সেও চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে রইলো।

চলবে……
(প্রায় দুই হাজারের মতো ওয়ার্ডের পর্ব দেই তারপরও পাবলিক কয় ছোট হইছে। এই দুক্কু কই রাখুম? দেখি আশেপাশে কোন ডোবা নালায় রাখা যায় নাকি🤧🤧🤧🤧

আর হ্যাঁ যারা বোনাস পর্ব দিতে বলে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। আপনারা অনেকে জানেন, আবার অনেকে হয়তো জানেন না। আমি একজন বিবাহিত নারী। আমার সংসারের আরও অন্যান্য ঝামেলা থাকে। আমার জন্য একদিনে এক পর্ব দেওয়াই অনেক কঠিন। তাই বাড়তি পর্ব চেয়ে লজ্জিত করবেন না। জানি আপনারা গল্পটা ভালোবাসেন তাই বেশি করে চান। তবে আমার ব্যাপার টাও একটু বোঝার চেষ্টা করবেন আশা করি 😟)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here