#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী
তানিশার মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত কাটছে দিনগুলো। একা হাতে মেয়েকে সামলে নিজের দিকে নজর দিতে খুবই কষ্ট হয়। তবুও করার কিছুই নেই। মা হয়েছে আর এইটুকুন কষ্ট সহ্য করতে পারবেনা! রিশার নানিমনি খুবই চেষ্টা করছে সাহায্য করতে। কিন্তু তিনি নিজেই অসুস্থ। এ নিয়ে তার আফসোসের শেষ নেই।
মেয়ের মুখের দিকে তাকালে তানিশার সকল দুঃখ ঘুচে যায়। ওর পিটপিট করে তাকানো, ফোকলা দাঁতের হাসি তানিশার হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। তবে একটা জিনিস সে লক্ষ্য করেছে, মেয়েটার হাসি ওর বাবার মত। এতে তানিশার ভিষণ রা*গ হয়। সে মেয়েকে পেটে রাখল নয়মাস, কষ্ট ভোগ করল জন্ম দিতে, প্রেগন্যান্সি অবস্থায় কতইনা কষ্ট করল, কিন্তু মেয়ে বাপের মত করে হাসে। এটা সে কিছুতেই মানতে পারছেনা।
” এ কোন শ*ত্রু*র বংশধর জন্ম দিলাম রে! দ্বায়িত্ব পালন করছি আমি আর এই মেয়ে বাপের ভঙ্গিতে হাসে। এতদূর পালিয়ে আসলাম তবুও সেই লোকের ছায়া পিছু ছাড়ছেনা। তার কোন জন্মের শ*ত্রু*তা আমার সাথে! ” কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আফসোস করছে তানিশা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে সাইরার বিয়ের দিন।ওর পরিক্ষা শেষ তাই বিয়ের ডেট করা হয়েছে দুই সপ্তাহ পর। জামিল চৌধুরী মেয়ের জন্য যথেষ্ট খরচ করছেন। সাদিফ তো বোনের বিয়ের সব দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে।
শায়লা চৌধুরীর মন ভিষণ খারাপ। একটামাত্র মেয়ে কয়দিন পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।
এদিকে সাইফও পাঁচদিন থেকে ফোন করছেনা। সেই চিন্তাও তাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছেনা। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর সাইফকে ফোন দেন। কিন্তু ফোন সুইচড অফ আসছে।
সাইরা তো ভিষণ খুশি। এত ভালো একটা পরিবারে বিয়ে হচ্ছে। রাতুল মানে সাইরার হবু বর সে একটা বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। রাতুলের বাবাও এক্স ব্যাংকার। রাতুলের বড় ভাই শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত। রাতুলের বোন আর দুলাভাই দুজনেই একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে আছে লেকচারার হিসেবে।
সাইরা ভাবছে একবার বিয়ে হলেই সে রাজরানী হয়ে থাকবে ঐ বাড়িতে। কিন্তু একটা বিষয়ে খটকা লাগছে সাইরার, বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এতদিন যাবৎ অথচ রাতুল একদিনও ফোন দিয়ে কথা বলেনি! সে কি খুব গম্ভীর মানুষ! কথা কম বলে!
পরদিন দশটার দিকে সাইফের ফোন আসে।
শায়লা চৌধুরী ফোন ধরেই অস্থির হয়ে ছেলেকে নানান প্রশ্ন করতে থাকে।
” সাইফ, তুই এই কয়দিন ফোন করিসনি কেন বাবা? তুই ঠিক আছিস তো? কোন সমস্যা হয়নি তো? এদিকে আমি তোর চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। ”
” রিল্যাক্স মম। আমি ঠিক আছি। বন্ধুদের সাথে আউটিং এ গিয়েছিলাম। অনেকেই ফোন করে বিরক্ত করে তাই অফ রেখেছিলাম। ”
” সাইফ! এদিকে আমরা তোর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি আর তুই ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ রেখেছিস! তোকে কে বিরক্ত করে শুনি? খোঁজ নেয়ার মধ্যে তো শুধু আমরাই। তারমানে তুই আমাদের জন্য ফোন বন্ধ রেখেছিস? ”
” উফ মম আজাইরা শুরু করে দিওনা প্লিজ। মাথা ব্যথা করছে, তাই তোমার এই আজাইরা প্যাঁচাল ভালো লাগছেনা। কিছু বলার থাকলে বলো আর না হলে ফোন রাখো। ”
শায়লা তোমার তার অতি আদরের পুত্রের মুখে এধরনের কথা শুনে হতবাক। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কথা বলেন, ” সাইরার বিয়ে সামনের আঠারো তারিখে। তুই কি একবার আসতে পারবি? তুই আসলে মেয়েটার ভালো লাগত। ”
” আমি তো এখানে বসে বসে সময় পার করি। তুমি বললেই আমার যেতে হবে! বিয়ে কি আর কারো হয়না! তোমরা না যত্তসব। ”
” আসতে হবেনা তোর। সাদিফ সব সামলে নিবে। ” ফোন কেটে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরতে থাকে।
একটা কথাই বারবার মনে হয়, ছেলেকে তিনি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি!
এতক্ষন জামিল চৌধুরী দরজায় দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীর ফোনালাপ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তিনি তার স্ত্রীর কিছু কথা শুনতে পাওয়ায় আবার পরে কাঁদতে দেখায় দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেন। তিনি এসেছিলেন কয়েকজন গেষ্টের লিষ্ট দিতে। লিষ্টটা সেন্টার টেবিলে রেখে চলে যেতে যেতে বলেন , ” একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমরা সবাই নিজেদের করা অন্যায় ভুলে গেলেও প্রকৃতি ঠিকই মনে রাখে। আজ এতটুতেই কষ্ট পাচ্ছো মিসেস চৌধুরী! ভবিষ্যতের জন্য কিছু কষ্ট জমিয়েও তো রাখো। ”
শায়লা চৌধুরীর মাথা নিচু করে শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই।
ইশান প্রায় দিনই দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে তানিশার ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। অস্থির চিত্তে এদিকওদিক খোঁজ করে তার না হওয়া প্রেয়সীর। শুধু এক নজর দেখার জন্য তার এত আকুলতা। কিন্তু যার জন্য সে পাগলপ্রায় সেই রমনীর কোন খোঁজ নেই। ইশান লক্ষ্য করে একটা মেয়ে গাড়িতে উঠছে, যাকে সে কয়েকবার তানিশার সাথে দেখেছে। দৌড়ে যায় সেদিকে।
” এক্সকিউজ মি ম্যাম। আপনি তো তানিশার ফ্রেন্ড? অ্যাম আই রাইট? ”
” আপনি কে? আর তানিশাকে আপনি চিনেন কেমন করে! ”
” শুধু আমি নই। সেই ম্যাডামও আমাকে চিনে। কিন্তু আজকাল তার দেখা পাওয়া যায়না। তিনি কি ঠিক আছেন? ”
” হুম ও ঠিক আছে। ” রিশা গাড়িতে উঠতে গেলেই ইশান আবার তাকে থামায়।
” কাইন্ডলি বলবেন উনি ভার্সিটিতে আসছেনা কেন? আমি বেশ কয়েকদিন উনার খোঁজ করেছি।”
বুদ্ধিমতি রিশা যা বোঝার বুঝে গেছে। তানিশার সাথে কথা না বলে ও কাউকে কিছুতেই সব কিছু জানাতে চায়না। তাই ইশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে।
ইশান হতভম্ব হয়ে রিশার যাওয়া দেখে।
” যাহ বাবা! এটা কি হল! অপমান করল মনে হয়! কিন্তু আমিতো অপমান করার মত কিছুই করিনি! ”
সাদিফ দিনরাত বাবার কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে ওর মেয়েকে একনজর দেখতে। কিন্তু জামিল চৌধুরী এ বিষয়ে চুপচাপ থাকে।
” বাবা, তুমি কি ওকে সত্যিই দেখনি! এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে বল! ও দেখতে কেমন হয়েছে বাবা? কার মত হয়েছে? ও কি হাসতে শিখেছে? না কি সারাদিন কান্নাকাটি করে? ওর চুলগুলো কি তানিশার মত হয়েছে? ওর নাম কি রেখেছে বাবা? ”
জামিল চৌধুরী এই ছেলেকে কি করে বুঝাবেন যে তিনি এখনো নাতনিকে দেখেননি। এতবার বলার পরও তার ছেলে বিশ্বাসই করছেনা যে তিনি সেই পরীটাকে এখনো দেখেননি। তিনি নাতনিকে দেখতে চাইলে তানিশা বলেছে কয়েকদিন দেখাবে। ও একটু সুস্থ হলে দেখাবে। তানিশার শরীর খারাপ থাকায় প্রতিদিন ফোনও করেনা।
তিনি অনেকবার সাদিফকে বলেছেন কিন্তু সাদিফ নাছোড়বান্দা। জামিল চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ছেলের পাগলামি দেখছেন।
সাদিফ এক সময় বিশ্বাস করে তার বাবা আসলেই সেই পরীটাকে দেখেনি।
মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে সাদিফ। সে যদি ভালো স্বামী হতো তাহলে আজ অবশ্যই একজন ভালো বাবা হতে পারত। এই ঘরটা আজ শূন্য থাকতনা তাদের ছাড়া। ঘরের প্রতিটি কোন মুখরিত থাকত তানিশা আর ওদের ছোট্ট পরীটার কলকাকলীতে।
” সাদিফ তুমি আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকো। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করনা, অফিসকেই বাড়ি বানিয়েছো। ”
” এগুলো তো আজকাল থেকে চলছেনা। চলছে প্রায় এক বছর ধরে। এতদিনে তোমার নজরে আসল! আমি ধন্য হলাম। হোকনা প্রায় বছর খানেক আগের বিষয়গুলো এখন তোমার চোখে পরছে। তবুও তো তুমি দেখতে পেয়েছো। আর আমি কি না ভেবেছিলাম তুমি কিছুই দেখতে পাওনা। তবে আজ তুমি প্রমান করেছো তুমি সবই দেখতে পাও। ” স্পষ্ট ব্যঙ্গ সাদিফের গলায়।
” আমি ভুল করেছি সাদিফ। সারাটা জীবন আমি ভুলের সাথে বসবাস করেছি। দিনে দিনে আমার ভুলগুলো অন্যায়ে পরিনত হয়েছে। আর এই অন্যায়ই আজ তোমাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি সাদিফ। আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না বাবা।! আজ স্পষ্টতই শায়লা চৌধুরীর গলায় অনুশোচনা। নিজের বিবেকের কাছে হেরে আজ তিনি নিঃস্ব।
” শুধু আমার কাছে ক্ষমা চাইলেই তোমার সব অন্যায় মুছে যাবে? আগেতো বাবার কাছ থেকে ক্ষমা পাও! তুমি না পেরেছ শ্বশুর বাড়ির প্রিয় বউ হতে, না পেরেছ প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী হতে। তবে একটা সময় সন্তানদের প্রিয় মা হয়েছিলে ঠিকই। কিন্তু আদৌ কি তুমি প্রিয় মা ছিলে? যদি প্রিয়ই ছিলে তবে কেন সন্তানের সুখ কিসে তা বুঝলেনা? একটা ছেলে যখন কিশোর বয়স থেকে শুনে আসে তার জন্য বউ নির্ধারন করে রাখা আছে, তখন সেই কিশোরের অনুভূতি কেমন হয় তা কি জানো? কিশোর বয়স থেকেই আমার কানে ঢুকিয়েছ সোহা আমার ভবিষ্যৎ বউ। তখন থেকেই একটা অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছি, যা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু বাবা এটা কখনোই চায়নি। কিন্তু তুমি কি করেছ! দিনের পর দিন এ নিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া করেছো। বাবার কাছে যখন আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, তখন তুমি আমাকে সাপোর্ট না দিয়ে উল্টোটা করলে। আমার ভেতরের জা*নো*য়া*র*কে জাগিয়ে দিলে। একজন কিশোরী যে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছিল, প্রতি পদে পদে তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে। তোমার স্বামী যখন তোমার সঙ্গ ত্যাগ করল, তখন কোথায় ছিল তোমার বিবেক? আজ তুমি ক্ষমা চাইলেই সব আগের মত হয়ে যাবে? ”
শায়লা চৌধুরী নির্বাক হয়ে রয় তার ছেলের কথা শুনে। সত্যিই এতটাই নি*কৃ*ষ্ট সে!
তবে এটা সত্যি কখনোই একজন ভালো স্ত্রী হবার প্রচেষ্টা তার ছিলনা। সে তো সবসময়ই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। শ্বশুর বাড়ি, সেই পক্ষের আত্নীয় স্বজনদের কখনোই আপন মনে করতে পারেননি। তিনি একটা সময় তাদের সাথে যা যা করেছেন এখন কি তার সবটাই ফেরত পাবেন!
” আমি ভুল করেছি সাদিফ। তুমি বলো আমার ভুল শোধরাতে কি কি করতে হবে? তামি তাই করব। ”
” যত সহজে বলছো বিষয়টি ততটা সহজ নয়। আর তোমার প্রায়শ্চিত আমি বলে দিলে হবে! তুমি নিজেই জানো কত অন্যায় তুমি করেছো। ”
শায়লা চৌধুরী বুঝতে পারে এগুলো সাদিফের নিছকই মুখের কথা নয়। তার ছেলেকে তিনি খুব ভালোভাবে জানেন। এমন জেদি, একরোখা ছেলে খুব কমই হয়। আজ জামিল চৌধুরীর বারবার বলা কথাটি মনে হচ্ছে, ” শায়লা তুমি একদিন ঠিকই বুঝবে। কিন্তু তখন শোধরাবার কোন রাস্তা থাকবেনা। ”
চলবে…..