#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী
পরদিন সকালে সাদিফ অফিসের জন্য তৈরী হতে গেলে পূর্বের ন্যায় হাতের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তোলে।
এদিকে তানিশা কোমড় বেঁধে নেমে পরেছে রান্নার কাজে। একে একে সব রান্না সেরে, শ্বশুরকে খাইয়ে দেয়। এরপর সাদিফের জন্য খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সাদিফ নিচে নামে মেয়েকে কোলে নিয়ে।
নিজের চেয়ারে বসে মেয়েকেও কোলে বসায়। তানিশা প্লেটে খাবার দিলে নিজের সাথে মেয়েকেও খাওয়াতে থাকে। তানিশা অবাক হয়ে দেখে মেয়েটা কি সুন্দর টুকটুক করে খাচ্ছে! অথচ গতকাল পর্যন্ত এই মেয়েকে খাওয়াতে গেলে কতইনা কসরত করতে হত!
” ফাজিল বাপের ফাজিল মেয়ে। ” বলেই দুইহাতে মুখ চেপে ধরে।
” বাপ নাহয় ফাজিল মানলাম, কিন্তু আমার মেয়ে কি দোষ করেছে যে তাকে ফাজিল বলছ? মহা ফাজিল তো তুমি। বাবা-মেয়ের খাবারের দিকে নজর দিচ্ছ। ”
তানিশা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
শায়লা চৌধুরী আসলে তানিশা তাকে খেতে বলে। শায়লা চৌধুরীও সায় দেয়।
” বউমা, তুমিও বসো। আমরা একসাথে খাব। রহিমা এদিকে আয়। ”
তানিশা শ্বাশুড়ির এরুপ পরিবর্তনে খুব খুশি হয়। একটা সময় যে মানুষটার চোখের বিষ ছিল সে আজ সে মানুষটাই একসাথে খেতে চাইছে! সাদিফের নিজের খাওয়া এবং মেয়েকে খাওয়ানো হলে অফিসে রওনা দেয়। মেয়ে অবশ্য বায়না ধরেছিল বাবার সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু সাদিফ নিরুপায়। মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে রেখে যায়।
সাদিফ বেরিয়ে গেলে ওরা খেতে বসে।
দুপুর হতে না হতেই তূর্ণা খুব বিরক্ত করছে পাপাইয়ের কাছে যাবে। কোনভাবেই ওকে কেউ মানাতে পারছেনা। তানিশা ওকে ওর দাদুর কাছে নিয়ে যায় তবুও কাজ হয়না। ওর একটাই কথা পাপাই যাবো। বাধ্য হয়ে শায়লা চৌধুরী তার ছেলেকে ফোন করে তূর্ণার কথা জানায়। সাদিফ সাথে সাথেই তূর্ণাকে নিয়ে অফিস যেতে বলে। শায়লা চৌধুরী তানিশাকে বললে ও না করে দেয়। অগত্যা শায়লা চৌধুরীরই নিয়ে যেতে হয়। সাদিফ অফিসের কাজের ফাঁকে মেয়েকে নিয়ে বাইরে যায়। ওকে অনেক খেলনা, চকলেট কিনে দেয়। তূর্ণা তো ভিষণ খুশি বাবার সাথে ঘুরতে বের হয়ে।
ওরা বেরিয়ে গেলে তানিশা কিছুক্ষণ শ্বশুরের সাথে একতরফা বকবক করে যা তিনি আগ্রহভরে শুনতে থাকেন। অবশ্য মাঝেমাঝে নিজেও চেষ্টা করেন কিছু বলার। বিকেলে তানিশা ওর শ্বশুরকে নাস্তা খাইয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাগানে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরিয়ে তারপর নিয়ে যায় বাসার সামনের পার্কে। এভাবে শ্বশুর-বউমার বিকেল কাটে।
ওদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তূর্ণার দু-হাত ভর্তি নানানরকম খেলনা, চকলেটের বক্স। শায়লা চৌধুরীও অনেকগুলো বক্স নিজের কাছে রেখেছেন। তূর্ণা আনন্দে লাফালাফি করছে। তানিশা মেয়ের খুশি দেখে মুচকি হেসে রুমে নিয়ে যায় ফ্রেশ করাতে।
সাদিফ বেশ রাত করে বাসায় ফিরে। ততক্ষণ পর্যন্ত তূর্ণা জেগে আছে। তার একটাই কথা পাপাই আসলে আমি ঘুমাবো। সাদিফ মেয়েকে জেগে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” মাম্মা, তুমি এখনো জেগে আছো? ঘুম পায়নি তোমার? ”
” আমি তোমাল সাতে গুমাবো। তাই জেগে আচি
( আমি তোমার সাথে ঘুমাবো তাই জেগে আছি) ”
সাদিফ মেয়েকে আদর করে ফ্রেশ হতে যায়।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল তানিশা খাবার রুমেই এনেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে খেতে বসে। নিজের সাথে মেয়েকেও খাওয়ায়।
সাইরা মাত্র দশদিন আগে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে গেছে। এর মধ্যেই ওর ছেলে-মেয়েরা নানু বাড়িতে আসার বায়না ধরেছে। কিন্তু ওর শ্বাশুড়ি কিছুতেই এখন ঐ বাড়িতে যেতে দিবেনা। সাইরা কিছুতেই বাচ্চাদের বুঝাতে পারছেনা। রাতুলকে কিছু বলে লাভ নেই। মায়ের কথার বাহিরে সে কিছুতেই যাবেনা। বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের বায়না কানে না নিয়ে নিজের মত কাজ করতে থাকে। এদিকে সাইরারও বাবার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। কতদিন পর ভাবি পরীটাকে নিয়ে এসেছে। একটু মন ভরে পরীটাকে আদরও করতে পারলনা। এদিকে ভাইয়াও এই কদিনে একবারও আসেনি। সব মিলিয়ে সাইরার মনও উচাটন করছে।
রাতুল অফিস থেকে ফিরতেই ছেলে-মেয়েরা তার কাছে এসে আধোআধো গলায় জানায় নানু বাড়ি যাবে। কিন্তু মা ভক্ত রাতুল মায়ের হুকুম বিনা কোন কিছু বলার সাহস করেনা। ওদের মন ভালো করতে বাইরে নিয়ে যায়। সাইরা মলিন হাসে রাতুলের কাজ দেখে। মনে মনে ভাবে, হায়রে পুরুষ, এখনো মায়ের আঁচলেই বাঁধা পরে রইল।
রাতুল সবেমাত্র বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় এসেছে। ওদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছে, সাথে ওর বাবা-মা’ও আছে। সাইরা রাতের খাবারের আয়োজন করছে। তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। সাইরার শ্বাশুড়ি ড্রয়িংরুমে থেকেও দরজা খুলতে যায়না। বাধ্য হয়েই সাইরা রান্না করতে করতে এসে দরজা খুলে সাদিফকে দেখে হেসে উঠে। সাদিফ বোনের কাছে ফল,মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। বাকি প্যাকেটগুলো নিয়ে ভেতরে আসে। সাদিফকে দেখে বাচ্চারা দৌড়ে আসে। সাদিফ প্যাকেটগুলো একপাশে রেখে ওদের কোলে তুলে নেয়। দুই ভাই-বোন মামাকে দেখে ভিষণ খুশি। সাদিফ সাইরার শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে সালাম করে তাদের পাশে বসে। এরপর বাচ্চাদের হাতে তাদের জন্য আনা প্যাকেটগুলো দেয়। ওরা প্যাকেটগুলো খুলে চকলেট, খেলনা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে থাকা সবাই হেসে উঠে বাচ্চাদের লাফালাফি দেখে।
” কেমন আছো সাদিফ? ” রাতুলের বাবা প্রশ্ন করে। ভদ্রলোক সব সময়ই সাদিফের পরিবারের প্রতি আন্তরিক।
” জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন আংকেল? ”
” বয়স হয়ে গেছে ইয়াংম্যান আর ভালো থাকার আশা করাটাই অরন্যে রোদন হয়ে যায়। বেয়াই এখন কেমন আছে? তোমার মেয়ে নাকি নিজ বাড়িতে ফিরেছে? ” একসাথে প্রশ্ন করেন।
সাদিফ হেসে জবাব দেয়, ” বাবা এখন আগের থেকে ভালো আছে। নাতনিকে পেয়ে তার মনের জোর বেড়েছে। ”
” এতদিন পর তোমার বউ বাড়ি ফিরল তাহলে! আমিতো ভেবেছিলাম সে বোধহয় আরেকটা সংসার পেতেছে। মেয়েদের এত জেদ ভালো নয়। বাড়ির বউদের একটু শাসনে রাখতে হয় বুঝলে? তবেই সংসারে সুখ থাকে। ” সাইরার শ্বাশুড়ি ওদের কথার মাঝেই ফোঁড়ন কাটে।
” ভুল বললেন আন্টি। মেয়ে-বউদের শাসনে নয় আদরে রাখতে হয়। আপনি তাদের সাথে যেমন আচরণ করবেন ওরা তেমনই আপনাকে ফিরিয়ে দিবে। সুখ-শান্তির বিষয়টা সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরিবারের গুরুজনদের ওপর। তাদের উপরই নির্ভর করে বউ-মেয়েদের আচরণ কেমন হবে। ”
” তোমার বউও তো বোধহয় তোমাদের আচরণেই বিগড়েছিল? ” স্ত্রীর এরুপ ব্যাঙ্গাত্বক কথায় অপ্রস্তুত হন রাতুলের বাবা।
কিন্তু সাদিফ বিন্দুমাত্র লজ্জা না করে উত্তর দেয়, ” সেজন্যই বললাম বউ-মেয়ের আচরণ নির্ভর করে গুরুজনের উপর। আর আমার স্ত্রী কখনোই বিগড়ে যায়নি শুধ অভিমান করেছিল। ”
” তা তোমার স্ত্রী লজ্জা পাচ্ছেনা এতদিন পর বাসায় ফিরে? ”
” নিজের বাসায় ফিরতে লজ্জা কিসের। ” হাসিমুখে উত্তর দেয় সাদিফ।
রাতুলেও বেশ অস্বস্তি লাগছে এরুপ আলোচনায়। সে সাইরাকে ডাক দিয়ে নাস্তা দিতে বলে। কিন্তু সাদিফ না করে দেয়। এদিকে বাচ্চারা সাদিফকে ধরেছে নানুর বাসায় যাবে বলে। সাদিফও রাজি হয়ে রাতুলের বাবাকে বলে ওদের নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাঁধ সাধে রাতুলের মা।
” এত ঘনঘন বাবার বাড়ি যাওয়া ঠিকনা। নিজের সংসার বুঝে নিতে হবে তো। মাসের পনের দিন যদি বাবার বাড়িতে যেয়ে পরে থাকে তবে নিজের সংসারে মন বসে নাকি। তোমার বোন সংসারের বিষয়ে একেবারে উদাসীন। ”
” সংসার জায়গাটা খুব কঠিন আন্টি। এর মায়ায় পরতে যেমন সময় লাগেনা তেমনি মায়া কাটানোও সময়ের ব্যাপার। আর পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুকনা কেন মায়া, দ্বায়িত্ববোধ ঠিকই জন্মায়। ”
” সত্যি কথা বলতে গেলে তোমার বোন সাংসারিক কাজকর্মে একেবারেই আনাড়ি। তার কোন দ্বায়িত্ববোদ নেই আর না আছে আদবকায়দা। সে কারো সাথেই মিশতে পারেনা। একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীর যা কিছু পাওয়ার কথা তা সে দিতে ব্যর্থ। তোমার মা সঠিক শিক্ষা মেয়েকে দিতে পারেনি। শুধু শিখিয়েছে বিলাসিতা আর অবাধ্যতা। অবশ্য তোমার মা নিজেও তেমন। তিনি আর মেয়েকে কি শিক্ষা দিবেন। ”
সাইরা ওর শ্বাশুড়ির কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। রান্না করতে করতে নিরবে চোখ ঝরাচ্ছে সে। সাদিফ মাথা নিচু করে রা*গ সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। যেদিনই সাদিফ আসুক না কেন এই ভদ্রমহিলা আকারইঙ্গিতে অনেক কিছুই বলে কিন্তু সাদিফ পাত্তা দেয়না। কিন্তু আজ ইনি সীমা পার করে ফেলেছেন।
রাতুলের বাবা লজ্জায় চুপচাপ বসে আছেন। স্ত্রীর জন্য বরাবরই তাকে লজ্জায় পরতে হয়। আর রাতুল একমাত্র ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। যতই যা কিছু হোকনা কেন মায়ের কথা ওর কাছে বেদবাক্য।
” শিক্ষা জিনিসটা কেমন সেটা সময়ই বলে দেয়। এইযে যেমন ধরেন আপনি সারাদিন আমার বোনের সাথে খিটখিটে আচরণ করবেন ও বড়জোর দু-চার দিন সহ্য করবে। এরপর শুরু হবে প্রতিরোধ এবঙ প্রতিহত করা। এবং তখন সেটা আপনার কাছে কুশিক্ষা মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। ” রা*গে বেশি কিছু বলতে পারেনা সাদিফ।
” তবে তোমার বোন বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। আমার ছেলেরা, মেয়ে-জামাইরা যথেষ্ট যোগ্য। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মত যোগ্যতা কারো নেই। ” সাইরার শ্বাশুড়ি ইন্ডাইরেক্টলি সাদিফকে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা শুনিয়ে দেন। সাদিফও তার কথা বুঝতে না পারার মত বোকা নয়। কিন্তু সাদিফ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে রাতুলের সাথে কথা বলতে শুরু করে।
” রাতুল, আমি যতটুকু জানি তুমি তোমার সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট সেনসেটিভ। এবং তোমার জীবনে সাইরা ছাড়া কোন মেয়ের অস্তিত্ব নেই। যে ভুলটা আমার ছিল তুমি সেটা থেকে মুক্ত। কিন্তু এই আমি, এই ভুলে ভরা মানুষটাকে ছেড়ে যখন তানিশা চলে যায় তখন আমার কাছে দুনিয়া বিস্বাদ লাগে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারি আমার অংশকে নিজের সাথে নিয়ে সে ঘর ছেড়েছে তখনকার অনুভূতি কাউকে বলে বোঝানোর মত নয়। এগুলো হয়েছে আমার ভুলের জন্য। তুমিও কি চাও তোমার সাথেও এমন কিছু ঘটুক? সহ্য করতে পারবে তো? সাইরা কিন্তু এখন পর্যন্ত তোমার বাড়িতে এসে অনেক কিছুই সহ্য করেছে, তোমরা তাকে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করোনা। আর যদি মনে করো আমার বোন তোমাদের জন্য বোঝা তবে আমাকে আজই বলে দাও। আমি ওকে নিয়ে যাবো। এবং তোমার সন্তানদের সাথে নিয়েই যাবো। তোমরা চাইলেও আমাকে আটকাতে পারবেনা। সে তোমারা যতই যোগ্য হওনা কেন।
তোমার বাবা, ভাই-বোন, দুলাভাই মিলে যেখানে যাবে নিজের সন্তানদের পেতে, সেখানে আমার একটা ফোনে নোয়েল-নিরোকে আমি সাইরার কাছে থাকার চিরব্যবস্থা করবো। সাদিফকে এতটাই অযোগ্য ভেবে ভুল করোনা। আর আমার বোনও এতটাই অযোগ্য নয় যে তোমরা ওকে পদে পদে অপমান করবে। তোমার বোন, ভাবিদের থেকেও আমার বোন যথেষ্ট যোগ্য। রুপে, গুনে এমনকি শিক্ষায়ও। আজ এই মুহূর্তে আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। তুমি যখন নিজেকে শোধরাতে পারবে, যখন তোমার মেরুদণ্ড সোজা হবে সেদিন ওদের কাছে যাবে। আর সেদিন তোমাকে কেউ ফিরিয়ে দিবেনা। ” সাদিফ সেই অবস্থায়ই সাইরাকে, নিরো-নোয়েলকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।
চলবে…..