#মায়ার_বাঁধন🍂
৩১.
————————
উত্তরের জানালায় ঠেস দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে নীরা। মনে জাগছে সহস্র প্রশ্ন। তুরান কীভাবে জানতে পারল এই জায়গার সন্ধান? কেন এলো সে? এতক্ষণ নিশ্চয়ই চলে গেছে? সে ক্ষণে ভেসে আসে প্রগাঢ় কন্ঠস্বর,
“নীড়পাখি।”
নীরার সর্বাঙ্গ দুলে ওঠে। জানালার উন্মুক্ত কপাটি গলে ধেয়ে আসে হিম শীতল সমীর। শৈথিল্য আনে নীরার অন্তঃপুরে। নীরার স্তব্ধ, বিমূঢ় রূপে সেই আকুলতা প্রবল হয়। ভেসে আস পুনরায়।
“নীড়পাখি।”
নীরা আনমনেই ওড়নার খোট খামচে ধরে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ক্ষীণ পরেই অনুভব করে তার কোমল হস্তের ভাঁজে খসখসে, শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ। নীরার দেহে মৃদু কম্পন সুস্পষ্ট। তুরান মুগ্ধতা মিশ্রিত দৃষ্টে চেয়ে। ধরে যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তুরান আর একটু নিকটস্থ হয়৷ দুজনের মধ্যে দূরত্ব কিঞ্চিৎ। পিনপতন নীরবতা বিস্তৃত কক্ষে শুধু দুটো মানুষের নিঃশ্বাসের ওঠানামার ভারি সংকেত। পুরোপুরি দূরত্ব ঘুচিয়ে তুরান পেছন থেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় নীরাকে। নীরা এবার থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। ঝটকা মে’রে সরে যেতে চাইলে অসম্ভব হয় তুরানের জন্য। তুরানের হস্ত বন্ধন দ্বিগুণ তীব্র হয়। সে বন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়া নীরার পক্ষে কঠিনসাধ্য। নীরা এখন অব্দি বিন্দুমাত্র সাড়াশব্দ করে নি। শুধু তুরানের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে। তখনই এক নেশাক্ত কন্ঠের আকুতিধ্বনি তার কর্ণে এসে আঘাত হানে।
উলটপালট করে তোলে তার অন্তঃপুর।
“আ’ম সরি বউ। এ যাবত আমার সকল অন্যায়ের জন্য তোমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। যাচাই বাছাই না করেই যে দুর্ব্যবহার আমি তোমার সঙ্গে করেছি জানি তার ক্ষমা হয় না। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি। তোমার অনুমতি বিহীন তোমাকে স্পর্শ করার জন্য ক্ষমা চাইছি। খুব করে তোমার মুখের মিষ্টি হাসি দেখতে চাই। দেখতে চাই সেই লাজুকতা মিশ্রিত কোমল মুখশ্রী। প্লিজ একটি বার! শুধু একটিবার সুযোগ দেবে কী আমায়? কথা দিচ্ছি শেষ নিশ্বাস অব্দি আমার ভালবাসায় বন্দিনী করে রাখব তোমায়। অনন্ত সুখে ভরিয়ে দেব তোমার অন্তঃপুর। কখনো কোনো অভিযোগ আনতে দিব না। একবার বিশ্বাস করেই দেখো।”
তুরান একটু থামে। নীরার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় কন্ঠে স্মিত আওয়াজ তোলে,
“ববববউউ”
নীরা বলতে চায় অনেক কিছু কিন্তু পেরে ওঠে না। আমরা আমাদের দূর্বল সময়ে কারো সান্নিধ্য পেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আর যদি হয় সে প্রিয়জন তাহলে তো কথাই নেই। যে আঘাত দেয় তার বুকেই আবার শান্তির আশ্রয় খুঁজে নেই। নীরার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। তুরানের এই সহজ স্বীকারোক্তিগুলো যেন তার কর্ণে মধুর মতো গলে পড়েছে। সে আর স্থির থাকতে পারে না। পেছনে দিকে ঘুরেই হামলে পড়ে তুরানের বক্ষে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তুরান পরম সুখে জড়িয়ে নেয় তার প্রাণেশ্বরীকে। অধর কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলে,
“ভালবাসি বউ। তোমার শূন্যতা আমাকে পুড়িয়েছে প্রতিনিয়ত। বুঝিয়ে দিয়েছে তুমি আমার ঠিক কতটা জুড়ে আছো। সারাজীবন এভাবেই তোমায় আমার বক্ষপিঞ্জরায় আবদ্ধ করে রাখতে চাই।”
নীরার হাতের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। কান্নার মাত্রা কমে এসেছে। থেকে থেকে শুধু ফোপাঁনোর আওয়াজ আসছে। তুরানের অধরে নিরবে তৃপ্তিপূর্ণ হাসি ফুটে।
———
জাহানারা চৌধুরীর কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজে আছে নীরা। হৃদয় জুড়ে তার আজ অনন্ত প্রশান্তি বিরাজমান। নীরাকে ফিরে পেয়ে জাহানারা চৌধুরী ভীষণ বকাঝকা করেছেন এভাবে চলে যাওয়ার জন্য। আলহাম চৌধুরী তো গাল ফুলিয়ে বসে ছিলেন। নীরা অনেক আকুতি মিনতি করে তার মান ভাঙিয়েছে। জাহানারা চৌধুরীর কাছে তুরানের সকল পাগলামির কথা শুনে নীরা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। সেই সঙ্গে মনে মনে ভীষণ খুশিও হয়েছে। এটাই তো সে এতদিন ধরে চেয়ে আসছে। তুরান একটু বাহিরে গেছে। কী যেন কী দরকারে। নীরা এসে থেকেই শ্বাশুড়ির কোলে ঘাপটি মে’রে পড়ে আছে। তখনই দরজায় টোকা পড়ে। শ্বাশুড়ি মা অনুমতি দিলে নত মস্তকে ভেতরে প্রবেশ করে রিনা। তাকেই দেখতেই জাহানারা চৌধুরী তেঁতে উঠেন। ধমকে বলেন,
“তুমি এ ঘরে কেন? এতকিছু করেও কী শান্তি হয়নি? এতদিন তোমার কার্যকলাপ মুখ বুজে সহ্য করে গেছি কিন্তু আর নয়। এবার তরিকের কাছে তোমার বিষয়টি তুলে ধরতেই হচ্ছে। ভেবেছিলাম শুধরে যাবে কিন্তু না যে হয় সে নয়তেই হয় নিরানব্বই এর প্রয়োজন পড়ে না।”
রিনা অসহায় নেত্রে তাকিয়ে রইল জাহানারা চৌধুরীর মুখপানে। তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট অনুশোচনার রেশ। জাহানারা চৌধুরীর কথায় সে কোনোরকম দিরুক্তি পোশন ছাড়াই নীরার নিকট এগিয়ে এলো। নীরার হাত দুটো চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অপরাধী কন্ঠে বলল,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও বোন। তোমাকে শুরু থেকেই আমি নানাভাবে কষ্ট দিয়ে এসেছি। হিংসে হতো খুব। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তুমি ঠিক কতটা খাঁটি। হালিমা খালা আমাকে বলেছে অগোচরে তুমি আমার ঠিক কতটা খেয়াল রাখতে। আমার সবকিছুর দেখভাল করতে। আর সেই আমিই কী না! ছিহ।
যাই হোক পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে।”
রিনা অশ্রুসিক্ত আঁখি মুছে উঠে দাড়ায়। জাহানারা চৌধুরীর পানে তাকিয়ে পুনরায় বলে,
“আম্মা পারলে আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপনার সুখের সংসারে আমার জন্য অশান্তির আগুন জ্বলেছে। আমার জন্যই আপনার শরীরের এই হাল। পারলে ক্ষমা করবেন আমায়।”
রিনা আর এক মুহূর্ত দাড়ায় না। জোর কদমে হেঁটে প্রস্থান নেয়। জাহানারা চৌধুরী ও নীরা একে অপরের দিক চেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
———–
রাতের খাবার শেষ করে ঘরে চলে এসেছে নীরা। তুরান এখন অব্দি ফেরেনি। নীরার মনটা উশখুশ করছে। শুয়ে, বসে কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। বার কয়েক ফোন হাতে নিয়েছে তুরানের নম্বরে ডায়াল করবে কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে ফোন বিছানায় ফেলে রেখেছে। নীরা ধীর গতিতে এগিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ বেজায় মোহনীয়। ক্ষণে ক্ষণে হিম শীতল পবন শরীরে মৃদু কম্পন তুলছে। অকস্মাৎ উদরে শীতল স্পর্শে কেঁপে ওঠে নীরা। চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তুরান দাড়িয়ে। অধর কোণে ক্রুর হাসি। নীরা আমতা আমতা করছে। দৃষ্টি চঞ্চল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। নীরার হাবভাব বুঝে তুরানই আগে মুখ খোলে। কন্ঠে কৌতুক মিশিয়ে বলে,
“আমিই তো এতো ঘাবড়ানোর কী আছে? অন্য কেউ ভেবেছিলে বুঝি?”
“আশ্চর্য! অন্য কেউ কেন ভাবতে যাব?”
“তাহলে এমন করলে কেন?”
“আ আসলে হঠাৎ করে তো একটু চমকে গেলাম তাই।”
তুরান আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো নীরার সঙ্গে। নীরার কর্ণধারে অধর স্পর্শ মিলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“শুধু চমকে গেলে কেউ এভাবে কাঁপে?”
নীরা পুনরায় কেঁপে ওঠে। তুরানের প্রতিটি কথা, স্পর্শে তার ভেতরকার শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ছে। উত্তেজনায় কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসছে। নীরা প্রতুত্তরে চুপ থাকে। তুরান নিঃশব্দে হাসে। হুট করেই কোলে তুলে নেয় নীরাকে। হতভম্ব নীরা আঁকড়ে ধরে তুরানের শার্টের কলার। আরেক হাতে গলা জড়িয়ে নেয়। দৃষ্টি তার বদ্ধ। তুরান ঘরের ভেতরে এগিয়ে যেতে থাকে। আর মৃদু আওয়াজে বলতে থাকে,
“সেদিন না হয় অচেতন ছিলাম। আজ সচেতন হয়েই কিছু করি। নয়তো বউ আবার ভাবতে পারে তার বর তাকে আদর দিতে কিপ্টেমি করে। মান সম্মান থাকতে তখন আমার?”
নীরার কান গরম হয়ে উঠেছে। শার্টের কলার ছেড়ে তুরানের বুকে আলতো এক কিল বসিয়ে পুনরায় শার্ট আঁকড়ে ধরে নিয়েছে। সামনে কী হতে যাচ্ছে ভেবেই অস্থিরতা প্রকট থেকে প্রকট হচ্ছে তার।
#মায়ার_বাঁধন
৩২.(অন্তিম পর্ব)
সকালে তুরান, নীরা একসঙ্গেই ভার্সিটিতে যায়। আজ সকালটা ছিল অন্য রকম। সকলের সঙ্গে আজ ডাইনিংয়ে রিনাও উপস্থিত ছিল। শ্বাশুড়ির হাতে হাতে সব এগিয়ে দিয়েছে। সবাই বেজায় খুশি। একটা স্নিগ্ধ, সুন্দর দিনের শুরু।
ভার্সিটিতে প্রবেশ করে নীরা তুরানের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে চলে যায়। কিন্তু যত গন্তব্যে এগোচ্ছে তার পায়ের চলন ততই ধীরুজ গতিসম্পন্ন হচ্ছে। অতশীর মুখখানা অক্ষিপটে ভেসে উঠছে বারংবার। একটা সময় স্থবির পায়ে এসে পৌঁছায় সে ক্লাসের দ্বার কক্ষে। চারিদিকে এক পলক নিশ্চল দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। সীমা, রুহিকে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অতশীও রয়েছে। নীরা ভেতরে প্রবেশ করে। কিছুটা এগিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। তার কী ওদের নিকট যাওয়া উচিত? নাকি অন্যত্র স্থান নেওয়া উচিত? নীরার ভাবনা ছেদ ঘটায় রুহি। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে নীরার কাঁধে হাত রাখে। চমকে ওঠে নীরা। নিজ ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে কখন রুহি এলো টেরই পাই না। রুহি তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“এসেছিস। চল তাড়াতাড়ি। কথা আছে অনেক।”
নীরা রুহির সঙ্গে সীমা ও অতশীর নিকট উপস্থিত হয়৷ অতশী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নীরার কেমন জানি খটকা লাগে। সীমা কিছু বলে না। সে নির্বাক শ্রোতা৷ নীরা কিছুটা সাহস জুগিয়ে অতশীর কাঁধে হাত রাখে। অতশী ততক্ষণাৎ হাতটা ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দেয়। নীরা হতভম্ব। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,
“কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
অতশী সীমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“সীমা তাকে বলে দে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সে থাকুক তার মতো। আমাদের তো তার দরকার নেই। এমন ফ্রেন্ডশিপ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”
সীমাও সায় দেয় অতশীর কথায়। বিরক্ত হয় রুহি। চোখ মুখ কুঁচকে তার বানী,
“আহ তোরা কী শুরু করলি? মেয়েটার সঙ্গে কথা তো বলতে দে আগে।”
রুহিবইটি নীরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“আচ্ছা তুই যে তুরান ভাইয়ের বউ এটা আমাদের আগে বলিস নি কেন?”
নীরা ছোটখাটো একটা ধাক্কা খায় যেন। শুরুতেই তার দৃষ্টি যায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা অতশীর পানে। ওরা এসব কীভাবে জানল কিছুতেই নীরার মাথায় ঢুকছে না৷ নীরার স্তব্ধতা দেখে রুহি ফের বলে,
“কী এটাই ভাবছিস তো আমরা কীভাবে জানলাম?”
নীরা দৃষ্টি ঘুরিয়ে রুহির দিকে আনে। রুহি তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে বলে,
“তাহলে শোন।”
অতঃপর রুহি গতদিনের সমস্ত ঘটনা বিবৃতি করে শোনায়। সব শুনে নীরা যেন পাথর বনে যায়৷ তুরানের তার প্রতি সিরিয়াসনেস দেখে যতটা না ভালো লাগছে ঠিক ততটাই খারাপ লাগছে অতশীর মুখ পানে তাকিয়ে। নীরা কী বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ক্ষীণ বাদে সে তার কম্পিত, স্থিতিশীল হস্ত জোড়া এগিয়ে দেয় অতশীর কাঁধে। অতশী ফেরে না ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু নীরার জোড়ালো বন্ধন থেকে মুক্ত হতে অক্ষম হয়। নীরা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অতশী আর শক্ত থাকতে পারে না। সে ও নীরাকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে। ভাঙা কন্ঠে আওড়াল,
“এমন টা কেন করলি বল? আমি অজান্তেই একটা ভুল রাস্তায় পা বাড়িয়েছিলাম। তোদের হালাল সম্পর্কের মধ্যে নিজের অজান্তেই আমি ঢুকে পড়েছিলাম। তুই সেদিন ওভাবে চলে না গিয়ে আমাকে সবটা বলতে পারতি। আমাকে কী তোর অতটাই খারাপ মনে হয় যে আমি সবটা জানার পরেও তোর সংসারে নজর দিতাম? বলেই দেখতি। অযথা কষ্ট পেলি নিজে।”
নীরার কথা আটকে আসছে। তবুও কোনোরকমে বলে,
“আমি কীভাবে তোর সামনে দাড়াব বুঝতে পারছিলাম না। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছিল। কী করেছি না করেছি নিজেও জানি না।”
“হয়েছে, হয়েছে এবার তোরা থাম। পুরো ক্লাস তোদের মনোযোগে।”
নীরা, অতশী চোখ মুছে নেয়৷ সীমা, রুহি মুচকি হেসে ওদের দুটোকে জড়িয়ে নেয়। চার বান্ধবী একে অপরের জড়িয়ে প্রশান্তি অনুভব করে।
——–
নেহাল কেবলই তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ক্যাম্পাস ক্রস করছিল। পথিমধ্যে দেখা হয়ে যায় তুরানের সঙ্গে। তুরানের দিকে তাকিয়ে আগাগোড়া এক পলক মেপে নেয়। পরপরই এক দুর্বোধ্য হাসি টেনে চলে যেতে নেয়। দু কদম এগোতেই ডেকে ওঠে তুরান। নেহাল থামে পেছন ফেরে না। তুরান কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলে,
“পারলে ফিরে আয়। নতুন করে দু’জনে সবকিছু শুরু করব। একসঙ্গে লড়ব।”
নেহাল তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,
“তুই ওদের চিনিস না। ওরা কখনোই ছাড়বে না আমাকে। সেই সঙ্গে তোরও ক্ষতি হবে।”
তুরান এবার ঘুরে দাড়ায়। নেহালের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আমার কিচ্ছু হবে না। জানি লোকটা খারাপ। তুই ওই পথ থেকে সরে আয়৷ আমরা দু’জনে মোকাবিলা করব।”
নেহাল কিছু বলে না চুপ করে রয়। তুরান নেহালের কাঁধে হালকা চাপ প্রয়োগ করে। বলে,
“ভেবে দেখিস।”
অতঃপর দুজন চলে যায় দু’দিকে।
ক্লাস শেষে তুরান নীরাকে কল করে বলে দেয় গেটের কাছে ওয়েট করতে। আজ তারা একসঙ্গে ফিরবে। কথামতো নীরা তাই করে। একটু বাদেই তুরানের উপস্থিতি। সে তার বাইক ছুটিয়ে একেবারে নীরার সম্মুখে এসে দাড়িয়েছে। নীরা চমকে দু কদম পিছিয়ে যায়। তুরান অধর কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
“ভ’য় নেই বিবিসাহেবা আমিই তো। আপনার একান্ত অনুগত বর।”
নীরা মুখ ভেংচি কাটে। ব্যঙ্গ করে বলে,
“ইশ এলেন রে আমার একান্ত অনুগত বর। দুদিন হলো না দরদ দেখাতে এসেছে।”
তুরান শব্দ করে হেসে ওঠে। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। পরপরই তুরান নিজের একহাত বাড়িয়ে দেয় নীরার পানে। উচ্ছসিত কন্ঠে বলে,
“উঠে এসো।”
নীরা লাজুক বদনে এগিয়ে যায়। তুরানের হাতের ওপর হাত রেখে উঠে বসে বাইকে। চলতে শুরু করে দু’জনে আপন গন্তব্যে।
———
পরিশিষ্টঃ🍂
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেটে গেছে পাঁচটি বছর। জীবন এগিয়ে চলেছে জীবনের দাঁড়িপাল্লায়। সুখ, দুঃখ পরিমেয়তায় ভরপুর সবকিছু। জাহানারা চৌধুরীর সংসারে এখন কেবল সুখ আর সুখ। বড় ছেলে তরিক ব্যবসায়িক কাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসার বছর পরেই রিনার কোল আলো করে এসেছে এক পুত্র সন্তান। তার বছর খানেক পরেই একত্রে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছে হিয়া,টিয়ার। বলাবাহুল্য হিয়া,টিয়ার বিয়ে শেষমেশ সুমন ও নয়নের সঙ্গেই হয়েছে। হিয়ার জুড়ি মিলেছে সুমনের সঙ্গে আর টিয়ার জুড়ি মিলেছে নয়নের সঙ্গে। সুমন- হিয়া ঠিক যতটা শান্তশিষ্ট দম্পতি নয়ন-টিয়া ঠিক তার উল্টো। সেই লেভেলের ঝগড়াটে কাপল। এখনো সেই শুরুর দিনের মতোই ঝগড়া করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। নেহাৎই পরিবার থেকে বিয়েটা জোর করে দিয়েছে নয়তো কোনোদিনও দুটিতে এক হতো না। এই প্ল্যানটা অবশ্য নীরার ছিল ওদের ঝগড়া বন্ধ করার কৌশল হিসেবে। কিন্তু হলোটা কী?ঝগড়া কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কিয়া মাঝেমধ্যেই সুযোগ পেলে স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়িতে। তার মেয়ে তিয়া এখন সাড়ে ছয় বছরের পাকনি বুড়ি একটা। অতশীর বিয়ে হয়েছে নেহালের সঙ্গে। এই বিয়ের সমস্ত ক্রেডিট কিন্তু তুরানের। নেহাল যখন তার বন্ধুক্তে সাড়া দিয়ে পুনরায় সৎ পথে ফিরে আসে। পরপরই তুরান লক্ষ্য করে নেহালের হাবভাব। তার অতশীকে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া নজর এড়ায়নি তুরানের। একসময় তুরান অতশীর কাছে নিজে প্রস্তাব রাখে। অতশী আর না করতে পারেনি। এক সময়ের প্রিয় মানুষের কথায় সায় দিয়ে গ্রহণ করে নেয় নেহালকে। সীমা,রুহিও নিজেদের মতো বিয়ে করে সেটেল। সবার জীবন বেশ সুখে পরিপূর্ণ। এখন কেবল অপেক্ষা নীরা-তুরানের ঘর আলো করে একটা রাজকুমারী আসার। যে #মায়ার_বাঁধনে তারা আটকা পড়েছে বেশিদিন হয়তো লাগবে না সেই শুভক্ষণ আসতে। ভালো থাক সকলে। #মায়ার_বাঁধনে জড়িয়ে কাটিয়ে দিক ইহকাল।
————-
সমাপ্ত
®
Khub sundor hoise apii