মায়াবিনী_মানবী পর্ব ৬

#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৬

–থ্যাংক ইউ!

জুইঁ নিচুস্বরে আলআবি কে বলে উঠলো। আলআবি জুইঁর দিকে স্তব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো…

–ছেলেগুলোর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছ।তাই না?

জুইঁ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল…

–ওই পরিস্থিতিতে যে কোন মেয়েরই খারাপ লাগার কথা।কিন্তু ওদের একটা শিক্ষা দিতে পেরে এখন খারাপ এর চেয়ে দ্বিগুণ ভালো লাগছে।

জুইঁ কথাগুলো বলে দিলেও মনে মনে এখনও একটু মন খারাপ। তখনি একটা ১০ থেকে ১১ বছরের ছেলে দুই হাতে দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে এসে ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল…

–এই যে লন।

আলআবি ছেলেটার হাত থেকে প্লেট দুইটা নিয়ে নিল। ফুচকার হালকা উষ্ণ ঘ্রাণটা নাকে আসতেই জুইঁ আলআবির হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে নেয়।একটু নাকের কাছে প্লেট টা এনে তৃপ্তির সহিত বড় একটা দম নেয়।আলআবি জুইঁর কান্ডে ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলে উঠলো…

–এটা কি করলে?ফুচকার ও যে কেউ স্মেল নেয় তা এই প্রথম দেখলাম।

জুইঁ কপট রাগ দেখিয়ে বলল…

–দেখেন নি যখন ভালো করে এখন দেখে নেন।

জুইঁ আলআবির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো এখনো আলআবি মিটমিট করে হাসছে।জুইঁ তার বা হাতের তর্জনি আঙুল আলআবির দিকে তাক করে বলল…

–আর একবার যদি আমার পছন্দের কাজের উপর হেসেছেন, তাহলে ওই ছেলেগুলোর মতো আপনাকেও একটা শিক্ষা দিয়ে দিব।

আলআবি খপ করে জুইঁর আঙুল ধরে ফেলল।এতে জুইঁ হকচকিয়ে গেল।আলআবি শান্ত কন্ঠে জুইঁ কে বলতে লাগলো…

–এই কাজ টা দ্বিতীয় বার করার সাহস করবে না।কারো সাথে আঙুল নাচিয়ে কথা বলা ব্যাড মেনার্স এর মধ্যে পরে।নেহাত তোমাকে এমুহূর্তে হাত নাচিয়ে কথা বলায় বিউটিফুল লাগছে বলে কিছু বললাম না।

আলআবির কথায় জুইঁর টনক নড়ে উঠলো। সত্যি ই তো এই কাজ টা ঠিক না।কিন্তু জুইঁর পছন্দের উপর কেউ হাসলে তার একদম ভালো লাগে না। এমন ভিন্ন ধরনের একটা পছন্দ সবারই আছে। কারো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে তো কারো রঙের ঘ্রাণ ভালো লাগে।সাদুর তো নতুন জুতার ঘ্রাণটাও ভালো লাগে।এমন জুইঁরও ফুচকা খাওয়ার আগে ফুচকার ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে।এতে হাসার কি হলো?এসব জিনিসে হাসলে জুইঁর একদম সহ্য হয় না।তাই জন্য ই তো হুট করেই আঙুল টা উঠে গিয়েছে।

জুইঁ আলআবির থেকে আঙুল টা ছাড়িয়ে নিয়ে ফুচকা খাওয়ায় মন প্রাণ দিয়ে মনোযোগ বসিয়ে দিল।ফুচকা খেতে খেতে একের্যায় জুইঁ হুট করে আলআবি কে বলল…

–ফুচকা আপনার ও প্রিয় আমারও প্রিয়।তাই না?

আলআবি মুখে একটা ফুচকা পুড়ে বলল…

–হুম।

জুইঁ এবার উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো…

–আচ্ছা চলুন তাহলে দেখি কে বেশি খেতে পারে। প্রতিযোগিতা হয়ে যাক?

আলআবি জুইঁর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল…

–এটা জানা কথা যে আমি ই জিতব।

জুইঁ ও তাচ্ছিল্যের স্বরে আলআবি কে বলল…

–হুহ! দেখা যাবে।

আলআবি তার অর্ধেক খাওয়া ফুচকার প্লেট টা চেয়ারে রেখে, গিয়ে আরো দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে আসলো।জুইঁ মনে মনে বেজায় খুশি হলো।কারণ আর যাই হোক ফুচকা খাওয়ায় কেউ ওকে হারাতে পারে না। আজ পর্যন্ত যত বারই সাদু আর রোজিনা আপুর সাথে প্রতিযোগিতা করেছে ততবারই জুইঁ জিতেছে।

জুইঁ আলআবি দুজনেই একেরপর এক ফুচকা খেয়ে যাচ্ছে।ফুচকা মোটামুটি ঝালই বলা চলে।জুইঁ বারবার টিস্যু দিয়ে নাক মুচ্ছে।কারণ তার ঝাল খেলে চোখ দিয়ে কোন কালেই পানি পরেনি।পরে শুধু নাক দিয়ে।আলআবি মোট দুই প্লেট খেয়েই রেখে দিয়েছে।

জুইঁ তিন নাম্বার প্লেটের শেষ ফুচকাটা মুখে দিয়ে আলআবির দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি দিল।টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জুইঁ বলল…

–ওভার কনফিডেন্স শরীর ও মনের জন্য হানিকারক।

জুইঁ ভালো করে হাতটা মুছে আলআবিকে ব্যঙ্গ করে বলল…

–এটা জানা কথা যে আমি ই জিতব।

বলেই জুইঁ অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।জুইঁ কে হাসতে দেখে আলআবি বলে উঠলো…

–ফ্রেমে অলরেডি ছবি বাঁধানো হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কুরিয়ার করে পাঠানো বাকি।ভাবছি সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দিব। কেমন হবে?

আলআবির কথায় জুইঁর হাসি উবে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে তেজি কন্ঠে বলে উঠলো…

–এখানে আপনার ওই বেনজি না গেঞ্জি নামের কুকুর টা নেই।তাই আমাকে ভয় দেখিয়েও লাভ নেই।

আলআবি জুইঁ কে কিছু না বলে হাত দিয়ে চুলগুলোকে নেড়েচেড়ে জুইঁর দিকে তাকিয়ে শয়তান রূপি হাসি হেঁসে বলল…

–যত পারো বলে নেও।হাতে আমার আরো ৮ দিন আছে। এখন চলো।

আলআবি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো। সামনে গিয়ে ফুচকার বিল দিয়ে আবার পিছনে বাইকের দিকে হাঁটতে লাগলো। এবার আলআবি জুইঁর হাত ধরায় জুইঁ আর কিছু বলল না।

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই জুইঁ আলআবি কে জিজ্ঞেস করল…

–আচ্ছা কয়টা বাজে এখন।বের হয়েছি তো অনেক সময় হয়েছে।

আলআবি পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখে বলল…

–বেশি না পৌনে দশটা বাজে।

জুইঁ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো। আলআবি কে উদ্দেশ্য করে উৎকন্ঠা হয়ে বলল…

–দশটা বাজে!বাসায় আঙ্কেল আন্টিকে কি বলব?আন্টিতো নিশ্চয়ই বুঝে যাবে আমরা ডাক্তার এর কাছে যাইনি।

আলআবি জুইঁর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো আর জুইঁকে বলল…

–তোমার আন্টি জেনে গিয়েছে আমরা ডাক্তার এর কাছে যাইনি।

জুইঁ উত্তেজিত হয়ে বলল…

–কিহ!কীভাবে জানল?

–আমি ফোন করে বলেছি ডাক্তার আজ জরুরি কাজে আটকে গিয়েছে।তার চেম্বারে আসতে পারেনি। তাই তোমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে এসেছি।

জুইঁ আলআবির কথায় অবাক হয়ে বলে ফেলল…

–আপনি এতো মিথ্যে কথা কেন বলেন?আর আঙ্কেল এর সাথে সবসময় ত্যাড়া ভাবে কথা কেন বলেন?

আলআবি হঠাৎ করেই গম্ভীরতার রেশ টেনে বলে উঠলো…

–আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

জুইঁ আলআবির হুট করে অন্যভাবে কথা বলাটা ঠিক ধরতে পেরেছে।কিন্তু এমন করে কেন বলল তা জুইঁর বোধগম্য হলো না। জুইঁ আলআবি কে আর না ঘাটিয়ে সেও আলআবির সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে রইল।

বাইকের কাছাকাছি আসতেই আলআবি জুইঁ কে নিয়ে রোড ক্রস করে একটা আধভাঙা টঙ্গের চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জুইঁ আলআবি কে বলল…

–আপনার বাইক তো ওপাশে।এখানে আসলেন কেন?

–মালাই চায়ের টঙ্গ এপাশে। তাই এপাশে এসেছি। (আলআবি)

–আপনি এখন চা খাবেন?(জুইঁ)

–আমি না।আমরা এখন চা খাব।তোমার কোন সমস্যা আছে? (আলআবি)

জুইঁ মৃদু হেসে মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে বুঝালো তার কোন সমস্যা নেই।জুইঁ কে মোটামুটি চা প্রেমিকা ই বলা চলে।সকালে উঠে প্রতিদিন তার কড়া লিকার এর দুধ চা না হলে ঘুমের রেশটাই পুরোপুরি কাটে না।

এই টঙ্গে বসার জায়গা মাত্র ৫ জনের।৫ টা সিটেই কাস্টমার বসে আছে। আলআবি খেয়াল করল দোকানের পাশে ই একটা ভ্যান রাখা। দেড়ি না করে জুইঁকে নিয়ে ভ্যানের সামনে এসে পা ঝুলিয়ে ভ্যানের উপর বসে পরলো।আলআবির দেখাদেখি জুইঁ পা ঝুলিয়ে আলআবির পাশে ই বসে পরলো।

ল্যাম্পপোস্টের কালচে হলদে কমলার মিশেল আলোয় জুইঁর গাঁয়ের বাদামি বর্ণের জামাটা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। জুইঁ চা খাচ্ছিল আর তার জামার রঙ দেখছিল।এই জিনিসটা জুইঁর কাছে অনেক ভালো লাগে।একরঙের জামা পড়ে বের হলে রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তা অন্যরঙের হয়ে যায়।

বসে বসে দুজনেই চা খাচ্ছিল।মানুষের কোলাহল আগের মতোই আছে।ঝিলের পানির গন্ধ এসে নাকে বারবার বারি খাচ্ছে।ঝিলের পাড় হওয়ায় পরিবেশে মৃদু বাতাসের আনাগোনা রয়েছে। এই বাতাসের কারণেই ঝিলের পানির গন্ধ টা বারবার জুইঁর নাক ছুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা জুইঁর খারাপ লাগছে না। বরং সে এই পরিবেশে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম চা ফু দিয়ে খেতে বেশ মজা পাচ্ছে। মুহূর্ত টাকে জুইঁ খুব ভালো করে মুগ্ধতার সহিত উপভোগ করছে।

চা খাওয়া শেষে আবার রোড ক্রস করে দুজন বাইকের কাছে আসলো।এতো সময় হেলমেট আলআবির হাতেই ঝুলিয়ে রাখা ছিল।জুইঁ কে হেলমেট পড়িয়ে দিয়ে আলআবি নিজেও হেলমেট পড়ে নিল।তারপর বাইকে চড়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল।এবার আগের তুলনায় একটু দ্রুতগতিতে ই আলআবি বাইক চালাচ্ছে। জুইঁ বাইকের পিছনে শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে।

বাড়িতে আসতেই জুইঁ ড্রইংরুমে দেখতে পেল সিরাজ সাহেব, মিসেস পারভীন, লিপি বসে আছে। আরও দুজন সার্ভেন্ট ও আছে সেখানে।

ওদের দুজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সিরাজ সাহেব আলআবি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন…

–দাঁড়াও। ঘড়িতে কয়টা বাজে?

আলআবি কোন কথা না বলে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে সময় দেখে সিরাজ সাহেব কে জবাব দিল…

–১১ টা ১৭ মিনিট।

সিরাজ সাহেব তেতে উঠে বললেন…

–রাত ১১ টা পর্যন্ত তুমি একটা মেয়েকে নিয়ে বাইরে কিভাবে থাকো।ওকে নিয়ে এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে।ওর কোন ক্ষতি হলে তখন ওর বাবাকে কি বলতাম আমি?

আলআবি গাঁ ছাড়া একটা ভাব নিয়ে বলল…

–ক্ষতি তো হয়নি।এখানে এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছু তো আমি দেখছি না।আর আমি তো ছিলাম ওর সাথে।

–সমস্যা তো সেখানেই। তুমি ছিলে বলেই ভয় হচ্ছিল। কোথাও গেলে তো মারপিট না করে বাড়ি ফিরতে পারো না।আর আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।(সিরাজ সাহেব)

–আমি জানি আজকের কথা তুমি সব জেনে গেছ।আর আজকের কথা যে তোমাকে শাফিন বলেছে এটাও ভালো করে জানি।জেনেছ যখন ভালো হয়েছে। এবার আমি আসি।(আলআবি)

গটগট করে আলআবি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।সিরাজ সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না।জুইঁ এসে সিরাজ সাহেব কে বলল…

চলবে………….

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here