মায়াবিনী_মানবী পর্ব ৭

#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৭

রুমের দরজা খুলতেই জুইঁর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।দরজার সামনেই কতগুলো বাঁধাই করা ছবি রাখা। যেখানে অস্পষ্ট আলআবি কে দেখা যাচ্ছে আর স্পষ্ট জুইঁ কে দেখা যাচ্ছে। আলআবি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার বিশ্বজয় করার ন্যায় হাসির ছড়াছড়ি।

কালকে রাতে সিরাজ সাহেব কে জুইঁ সব ঘটনা খুলে বলার পর সিরাজ সাহেব বলেছিলেন…

–আইন থাকতে ও কেন রাস্তা ঘাটে মারামারি করবে।

সিরাজ সাহেব কে জুইঁ আর মিসেস পারভীন অনেক বুঝিয়ে রাতের খাবার খাওয়ান।জুইঁ রাতে আর কিছু না খেয়েই উপরে ওর রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে যায়। সকালে দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে জুইঁর ঘুম ভাঙ্গে।ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ছয়টা বাজে। জুইঁ দরজা খুলে দেখে ছবি সমেত আলআবি দাঁড়ান।

এমুহূর্তে জুইঁর বিশ্বাস ই হচ্ছে না যে আলআবি সত্যি সত্যি ই ছবি ফ্রেমবন্দি করবে।জুইঁর ভাবনার মাঝেই আলআবি বলল…

–গুড মর্নিং বিউটিফুল! সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো?

বলেই ভ্রুযুগল দু-তিন বার উপর নিচ করলো।জুইঁ অবিশ্বাসের রেশ টেনে বলল…

–আপনি সত্যি সত্যি ই এমন করলেন?

আলআবি কিছুটা ভাব নিয়ে বলল…

–আলআবি মাশরুখ কথা দিয়ে কথা রাখে।

জুইঁ অসহায় মুখ করে আলআবি কে বলল…

–প্লিজ ভাইয়া আব্বুকে এগুলো পাঠাবেন না।আমি না আপনার বোনের মতো?আমি আপনার সব কথা মানতে রাজি।

আলআবি হয়তো ভাই বোন কথাটা মেনে নিতে পারেনি।জুইঁর পানে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল…

–তোমার সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক?রক্তের ভাই হই?

জুইঁ ভীত চোখে আলআবির দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে না বুঝালো।আলআবি পুনরায় বলল…

–তাহলে ভাই ভাই করছো কেন?এমন ভুল আর দ্বিতীয় বার যেন না হয়।

জুইঁ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো।আলআবি ছবি গুলো তুলে জুইঁ কে বলল…

–নাও এগুলো তোমার গিফ্ট।গিয়ে সুন্দর মতো রুমে সাজিয়ে রাখ।

জুইঁ তাড়াহুড়ো করে আলআবির কাছ থেকে ছবি গুলো নিয়ে আলমারি তে তুলে রাখলো।পিছনে ফিরতে ই দেখতে পায় আলআবি এখনো দরজা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুইঁ আলআবির কাছে গিয়ে বলল…

–আর কিছু বলবেন?

–আসল কথাই তো বলি নি।(আলআবি)

–আবার কি?(জুইঁ)

আলআবি হুট করে জুইঁর হাত ধরে বলল…

–আসো আমার সাথে।

জুইঁ আলআবির থেকে হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলে…

— এই ভোরবেলা আমি আপনার সাথে কোথায় যাবো?আমি এখন কোথাও যাব না।

আলআবি জুইঁ কে টেনে রুমের দরজার বাইরে কয়েক কদম নিয়ে এসেছে। আলআবি তখন বলল…

–তুমি আমার কথা মানতে বাধ্য।

জুইঁ একগাল হেঁসে জবাব দিল…

–ছবি আমার কাছে।মানে লাটাই এখন আমার হাতে।এখন আর আপনার কথা কে শুনবে?

আলআবি জুইঁ দিকে ঘুরে জুইঁ কে এক গাল হাসি ফেরত দিয়ে বলে উঠলো…

–আমার টাকা বেশি হয়ে গিয়েছিল তো।তাই দুই কপি করে বাঁধাই করেছিলাম।সেখান থেকেই সব গুলোর এক কপি তোমাকে দিয়েছি।

বলেই জুইঁকে আবার টানতে লাগলো। তখন জুইঁ বলে উঠলো…

–আরে আরে! আমি ফ্রেশ হইনি তো।দাঁত ব্রাশও করি নি।

–কতোদিন আমি তো দাঁত ব্রাশ না করেই নাস্তা করেছি। একটু আগেও ঘুম থেকে উঠে কফি খেয়ে ফ্রেশ হতে গিয়েছি।(আলআবি)

জুইঁ নাক ছিটকে বলল…

–ছিঃ!খচ্চর লোক কোথাকার।আমি আপনার মতো খবিশ নই।ছাড়ুন তাড়াতাড়ি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

আলআবি জুইঁর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল…

–মাত্র পাঁচ মিনিট সময়।তাড়াতাড়ি যাবে তাড়াতাড়ি আসবে।

–পাঁচ মিনিটে তো আমার ব্রাশ করাই হয় না।(জুইঁ)

–দেশের মাটি কি তুমি সব একা চিবিয়ে খাও,যে ব্রাশ করতে এতো সময় লাগে।(আলআবি)

আলআবির কথায় জুইঁ চটে গেল। গলায় তেজি ভাব নিয়ে বলল…

–কি বললেন?আমি মাটি খাই?

জুইঁ আর কিছু বলার আগেই আলআবি বলে উঠলো…

–তোমার ত্রিশ সেকেন্ড অলরেডি চলে গিয়েছে। পাঁচ মিনিট শেষ হয়ে গেলে এভাবে ই তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব।

জুইঁ কথা না বাড়িয়ে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেল।ফ্রেশ হয়ে বের হতে ই দেখতে পায় বেনজি ওর রুমে বসে আছে। বেনজিকে দেখা মাত্র ই জুইঁর মনে আতঙ্ক ঢুকে গেল।জুইঁ ভীত কন্ঠে বলল…

–এই কুত্তা এই জায়গায় কি?

জুইঁ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল…

–যাহ!হুঁশ! হুঁশ!

ঠিক তখনই বারান্দা থেকে আলআবি বের হয়।আলআবিকে দেখে জুইঁর মনে আরও আতঙ্ক ঢুকে যায়।আলআবি বলে ওঠে…

–তুমি ওকে কি বলছিলে?

জুইঁ একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে…

–বব…বলছিলাম ও খুব ভালো।কি সুইট।

আলআবি আবার বলে…

–আমি বারান্দায় ছিলাম। স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি তুমি ওকে কুত্তা বলেছ।এরপর আরেকবার কুত্তা বলে দেখ।তোমার খবর করে ছাড়ব।

আলআবি এসে একহাতে জুইঁর হাত ধরে আরেক হাতে বেনজির গলার কালো মোটা বেল্টটা ধরে বলল…

–চলো।

জুইঁ তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো…

–এই কুত মানে বেনজিও যাবে আমাদের সাথে?

আলআবি জুইঁর কোন জবাব না দিয়েই জুইঁকে নিয়ে বাড়ির গেটের বাইরে এসে পরলো।জুইঁ জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে বেনজিকে নিয়ে। হঠাৎ করে আলআবি বেনজির বেল্ট টা জুইঁর হাতে গুঁজে জুইঁর হাত চেপে ধরল। বেনজির বেল্ট জুইঁ নিজ হাতে দেখে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতেই আলআবি বলে উঠলো…

–আজ বেনজিকে নিয়ে আমরা হাটবো।প্রতিদিন এসময় হলো ওর জগিং টাইম।

জুইঁ বিস্ময় নিয়ে আলআবি কে বলল…

–ওর সাথে জগিং করার জন্য আমাকে এখানে এনেছেন?

–হ্যাঁ গো তোতাপাখি। (আলআবি)

আলআবির কথা শেষ হতে না হতেই বেনজি এসে জুইঁর পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো।এটা দেখে জুইঁ আলআবির পিছনে লুকিয়ে পরলো।বেনজি সেখানে গিয়েও উপস্থিত হতেই জুইঁ আবার আলআবির সামনে চলে গেল।এমন করে বেনজি আর জুইঁর চোরপুলিশ খেলা আলআবি খুব মজার সহিত উপভোগ করছে।

এদিকে জুইঁর অবস্থা একেবারে নাজেহাল। আলআবি তা দেখে বেনজিকে থামিয়ে দিল।আর কোলে তুলে নিল।বেনজিকে আদর করতে করতে আলআবি জুইঁ কে উদ্দেশ্য করে বলল…

–আরে ও তোমার আদর পেতে চায়।ওর গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দাও।

এ কথা শুনে জুইঁ ছিটকে আলআবির কাছ থেকে দুই হাত দূরে চলে গেল।এরূপ কান্ড দেখে আলআবি বলল…

–কি? কি সমস্যা? ওকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে?

জুইঁ ভয়ে ভয়ে জবাব দিল…

–ছোটবেলা থেকেই কুকুর অনেক ভয় পাই কোন কারণ ছাড়াই।

–আশ্চর্য! কোন কারণ ছাড়াই মানুষ ভয় পায় কিভাবে? (আলআবি)

–আসলে ছোটবেলা থেকে সাদু কুকুর কে ভয় পায়। কারণ ওকে একবার কুকুর আচড় কেটে দিয়েছিল।ওর দেখা দেখি এখন আমিও ভয় পাই।

শেষের কথা টুকু জুইঁ মিনমিন করে নিচু স্বরে বলল।

–এই সাদুটা কে?(আলআবি)

–সাদিয়া।আমার বেস্টফ্রেন্ড।(জুইঁ)

–তোমার ফ্রেন্ড ভয় পায় বলে এখন তুমিও ভয় পাও।হোয়াট অ্যান এক্সকিউজ! (আলআবি)

আলআবি বেনজিকে জুইঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল…

–নাও আমি ধরে রেখেছি। তুমি শুধু ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিবে।

জুইঁ আবার ও পিছিয়ে যেতে নিলেই আলআবি বলে ওঠে…

–এক পা পিছিয়েছ তো বেনজিকে কোল থেকে নামিয়ে দিব।

জুইঁ আলআবির কথায় আর পিছু পা হতে পারল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।আলআবি একহাতে বেনজিকে আঁকড়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে জুইঁর হাত ধরে এনে বেনজির লোমশ গায়ে রাখল।জুইঁর হাত ধরে ই আস্তে আস্তে বেনজির গায়ে হাত বুলাতে লাগল।কিছুসময় পর আলআবি ধীরে ধীরে বেনজির উপর জুইঁর হাত রেখে নিজের হাত গুটিয়ে নিল।জুইঁ তা লক্ষ্য ই করল না।বরং এমুহূর্তে বেনজিকে আদর করতে জুইঁর বেশ লাগছে।

হঠাৎ করে জুইঁ খেয়াল করল সে একাই বেনজিকে আদর করছে আর ভয় টাও কেটে গেছে।তখন জুইঁ মনে মনে অনেক খুশি হলো।জুইঁ নিজে থেকে বলে উঠলো…

–ওকে নিয়ে হাটি?

আলআবি প্রাণ খোলা হাসি হেঁসে জবাব দিল…

–চলো হাটি।

আলআবির এ হাসিতে যে মুগ্ধতা মিশ্রণ ছিল তা জুইঁর মনকেও ছুঁয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছে। জুইঁ এই প্রথম আলআবির হাসিকে এতো নিখুঁত ভাবে পরখ করল।হাসলে লোকটার গালে ঈষৎ টোল সৃষ্টি হয়।চোখ গুলোও কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে যায়।আসলেই লোকটা সুদর্শনের তালিকাভুক্ত।

জুইঁ আর আলআবি বি ব্লকে হাঁটছে। সাথে লম্বা পশম দুলিয়ে হাঁটছে বেনজি ও।তার বেল্ট জুইঁ ধরে আছে।প্রতিটা দমে দমে ভোরের শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া ফুসফুসে আসা যাওয়া করছে।পিচঢালা রাস্তার সরু ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ওরা।খচখচ আওয়াজ তুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা পিচঢালা রাস্তার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঝাড়ু দিচ্ছে।

বি ব্লকের যে রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছে তার এপাশ ওপাশে রয়েছে এপার্টমেন্ট।মাঝে মধ্যে এপার্টমেন্ট থেকে দু একটা প্রাইভেট কার বের হচ্ছে। এছাড়া এদিকে আর কোন যানবাহন জুইঁর চোখে পরছে না।এ রাস্তায় মানুষ ও অনেক সময় পর পর দু একজন দেখা যাচ্ছে।

গ্রামে থাকলেও জুইঁর বেড়ে ওঠা মফস্বল শহরে।তাই সকালের এমন পরিবেশে কখনো হাঁটা হয়ে ওঠে নি জুইঁর।সকালে উঠেই তাকে ছুটতে হতো স্কুল-কলেজের জন্য।

এভাবে হাঁটতে জুইঁর খুব ভালো লাগছে। বলা যায় প্রচুর শান্তি শান্তি লাগছে তার কাছে।হঠাৎ করে জুইঁর মনে একটা প্রশ্ন উদয় হলো।তাও সেটা আলআবি কে নিয়ে।

মেরুন বর্ণের গেঞ্জি আর কালো এডিডাস এর টাউজার পরিহিত আলআবির পানে চেয়ে জুইঁ জিজ্ঞেস করল…

চলবে………….

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here