#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_৫
ইশিতা বসার রুমে চলে এল। মিথিলার ছবি আঁকার ধরন দেখে বোঝা যায় আল্লাহ বিশেষভাবে ওকে ছবি আঁকার প্রতিভা দিয়েছেন। ছবির আনাচে কানাচে ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে দক্ষতার সাথে। ইহানের পড়ার ছবিটা হয়ত সে নিজের কল্পনা থেকে এঁকেছে। আর যদি তা না হয় তবে বলতে হবে নিজের মেমরি ঘেটে বের করে এঁকেছে।
– মেয়েটা এত ভালো ছবি আঁকে অথচ কত অবহেলিত।
– কি করবি ইশুবু। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী মানেই অবহেলিত দলের আরেক দল সদস্য।
ইশিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমরাই এত অবহেলিত আর ওদের কথা তো বাদই দিলাম। ইহান টপিক ঘুরিয়ে বলল, খাবে চলো। আজ একসাথে খেতে মন চাইছে। ইশিতা হেসে বলল, চল।
ইহানের নতুন অভ্যাসযুক্ত হয়েছে। মিথিলাকে খাইয়ে দেওয়া। এখন যখনই খিদে লাগে ইহানকে খাবারের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। তারপর এমন জুলুজুলু করে তাকায় যে হাজার বিরক্তির পরও ওকে এড়াতে পারে না। এখনও মিথিলা ইহানের পাশে বসে ওর কাজ দেখছে। ইশিতা হেসে বলল, বাহ! ভালোই যত্ন করা শিখেছিস। খাইয়ে দিচ্ছিস। ইহান সবজিটা প্লেটে নিচ্ছিলো। রসিকতা শুনে থেমে বলল, না খাইয়ে দিলে তোমার মিথু কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেলবে। ইশিতা হাসল। পরক্ষণে হাসি থামিয়ে বলল, অভ্যাস করে নিস না। পরে কষ্ট হবে। বলেই খাওয়ায় মন দিল। ইহান একবার মিথিলার দিকে তাকালো।
খাওয়া শেষে ইহান আবার পড়তে বসল। মিথিলা এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চলে গেছে বিছানায়। হাতে খাতা পেন্সিল। আঁকার শব্দ কানে আসছে। পেন্সিল দিয়ে যত্ন করে ঘষে ঘষে ছবি আঁকছে। ইহান চুপ করে একবার কান খাড়া করে শুনে আবার মন দিল পড়ায়। প্রায় এক ঘন্টা মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর হঠাৎ খেয়াল হলো শব্দ আর আসছে না। তাকিয়ে দেখল মিথিলা ঘুমে বিভোর। মেয়েটা আঁকতে আঁকতেও ঘুমাতে পারে। কাছে যেতে চোখ পড়ল খাতার স্কেচে। ছবিতে ইহান ঘুমিয়ে আছে বায়োলজি বইতে। বইয়ে ডিএনএ আরএনএ এর ছবি দেখা যাচ্ছে। নিজের ছবি দেখে মনে মনে বলল, ছবিতে এত সুন্দর লাগছে কি করে আমাকে!? ভেবে ফিক করে হেসে দিল। মিথিলা নড়ে উঠতে হাসি বন্ধ করে দিল। সাবধানে ওকে নিয়ে গিয়ে ইশিতার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসল।
পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসছে। আর পনেরো দিন বাকি। সব একবার করে পড়া হয়ে গেছে। যে জায়গাগুলোয় আটকে যাচ্ছে সে জায়গাগুলো পড়ে বার বার ঝালাই করে নিচ্ছে। আজকে সন্ধ্যায়ও পড়তে বসেছে। হায়ার ম্যাথগুলোর নতুন সমস্যা সমাধান করতে বসেছে। সাথে কানে মিথিলার পেন্সিল ঘষার শব্দ। ওর ছবি দেখে ইহান আর ইশিতা যে খুশি হয়েছে তা ভালো মতোই টের পেয়েছে। তাই প্রায়ই খাতা নিয়ে বসে। কোচিং বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সারাক্ষণই ইহান মিথিলার সাথে বাসায় থাকে। ওর পেন্সিলের শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
সম্প্রতি ওকে আয়নার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইহান। যেন নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আর ওকে খুঁটিয়ে দেখা তো রোজকার ব্যাপার। এত ধৈর্য্য মেয়েটার কই থেকে আসে! তবে তারও তো ধৈর্য্য কম না। সারাদিন বই নিয়ে টেবিলে বসে থাকতে থাকতে পিঠ শক্ত হয়ে যায়। এখন শুধু লক্ষ্য পূরণের পালা।
অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে মিথিলা খাতার পেইজ ছিঁড়ছে একটু পর পর। প্রথম দিকে তেমন পাত্তা দেয়নি। এখন বার বার শব্দ আসায় কৌতুহল হচ্ছে। আগে কখনো এমন করতে দেখেনি। ইহান পিছন ফিরে দেখলো কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাতা অর্ধেক হয়ে গেছে। বিছানা ফ্লোরে কাগজের ছেঁড়া অংশে ভর্তি। ওর সামনেই আরেকটা ছিঁড়ল। তারপর কুঁচি কুঁচি করে ফেলল ছিঁড়ে। ইহান উঠে এসে বলল, কি হচ্ছে মিথু? এমন কাগজ ছিঁড়ছো কেন? ইহানের কথায় চমকে উঠে খাতা লুকাতে লাগল। কি এমন আঁকল যে খাতা লুকাচ্ছে? একবার ভাবল জোর করে দেখবে। পরে নিজেকে সংযত করে টেবিলে এসে বসলো। এমনিতেও ওকে পরে দেখাবে। এখন জোর করার কিছু হয়নি। কিন্তু এসব নিজেকে বোঝালেও পড়ায় মন দিতে অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে দুটো অঙ্ক ভুল করেছে। একটু পর পর কাগজ ছেঁড়ার শব্দ ওর কৌতুহলকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু বলতেও পারছে না।
আধা ঘন্টা পর শব্দ বন্ধ হয়ে যেতেই আবার পিছন ফিরে তাকালো। মেয়েটা আঁকতে আঁকতে প্রায়ই ঘুমিয়ে যায়। পরে ইশিতা আসলে ডেকে নিতে হয় খাওয়ার জন্য। আবার সামনে ফিরতেই কলিংবেল বাজল। ইশিতা এসেছে। দশটা বাজে। দরজা খুলতেই ইশিতা ঢুকে সোফায় বসল। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। বসে জিজ্ঞেস করল, আজ কি এঁকেছে? ইহান পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, এসে ছবির খোঁজ করছো? পানিটা শেষ করে বলল, এই নিয়ে ছয়টা ছবি এঁকেছে। কি সুন্দর না?
– হুম, সুন্দর।
ইশিতা বাচ্চাদের মতো আগ্রহ নিয়ে বলল, আজ কি এঁকেছে। দেখা দেখা। ইহান হতাশ ভঙ্গিতে বলল, রুমে গিয়ে দেখো। ও সোফা থেকে উঠে বলল, ঠিক বলেছিস। তা আর্টিস্ট কি আজও ঘুমে? ইহান হুম বলে সায় দিল। ইশিতা মহা আনন্দে রুমে ঢুকে থমকে গিয়ে বলল, এসব কি? মিথিলা একগাদা কাগজের টুকরোর উপর ঘুমিয়ে আছে। ইহান ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, তোমার মিথু আজ আঁকার থেকে ছিঁড়েছে বেশি। ইশিতা টুকরো কাগজগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। মানুষের মুখের অবয়ব, কিন্তু কার বোঝা যাচ্ছে না। আর এত টুকরো, কোনটা কোনটার সাথে জোড়া লাগাবে তাও বোঝার উপায় নেই। ও হতাশ হয়ে কাগজের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ইহান এসে বলল, ইশুবু যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। ইশিতা তখনো চিন্তা করছে কার হতে পারে। ওর ডাক কানে যায়নি। ফিসফিস করছে, কার হতে পারে!? ইনুর? হুম ওরই হবে। আমাকে তো আঁকেনি কখনো। ও কাঁদো কাঁদো মুখ করে ভাবতে লাগল।
– ইশুবু……
– হুম? হুম? কি বল।
– ফ্রেশ হও গিয়ে।
– এটা কার হতে পারে বলতো।
– আমি কি করে বলব।
– তাও ঠিক। তোরই হবে। আগেরগুলো তো……
ইহান ইশিতাকে রুম থেকে ঠেলে বরে করে দিয়ে বলল, আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর গবেষণা করো কার হবে। না হলে মিথুকে জিজ্ঞেস করো। আমার খিদে পেয়েছে। ইশিতা মুচকি হেসে বলল, আচ্ছা বাবা, যাচ্ছি।
.
.
.
.
আজকে শুক্রবার। ইশিতার অফিস ছুটে। তাই চিন্তা করলো খিচুড়ি রান্না করবে। বাইরে ফুরফুরে রোদ। পেঁয়াজটা কুচি করে কেটে মরিচটা হাতে নিতেই মিথিলা রান্নাঘরে উঁকি দিল। সেও একটা ছুরি নিয়ে এসে দাঁড়ালো ইশিতার পাশে। ও হেসে বলল, থাক পাকনামো করতে হবে না। পরে দেখবো হাত কেটে বসে আছিস। ছুরিটা নিয়ে রেখে দিলো রেকে। মিথিলাকে একটা টুল এনে দিয়ে বলল, এখানে বসে দেখ কি করি। ঠিক আছে? মিথিলা মাথা নাড়ল। সব কাটাকুটি শেষে পাতিলে তেল দিয়ে ভাজতে বসলো। চাল ডাল আগেই ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রেখেছে। পেঁয়াজটা হয়ে এলে সেগুলো পাতিলে দিয়ে দিল। কতক্ষণ তেলে নাড়া চাড়া করে পানি দিয়ে ঢাকনা দিতে দিতে বলল, যা গোসল করে নে। আমি জামা দিচ্ছি।
ইহান নামাযে গেছে। এসে দেখল মিথিলা বারান্দায় ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে। রোদ পোহাচ্ছে। ইহান এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। এসে বসল সোফায়। মিথিলা একটুপর এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। বসার ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে ওকে। ইহান দেখলো ও আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। ইশিতার গলা শোনা গেল। সে গোসল করে বের হয়ে বলছে, এমন করে কি দেখছিস আয়নায়? মিথিলা কিছু না বলে মাথা নাড়ল।
খেতে বসে ইশিতা বলল, আজ মিথু নিজের হাতে খাবে৷ তাই না মিথু? ইহান সাথে সাথে বলে উঠল, কেন? আমি কি খাওয়াতে পারি না নাকি? ওর রিয়েকশানে মিথিলা ইশিতা দুজনে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ইহান অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হঠাৎ করে বললে তো তাই। ভালোই তো। এত বড় মেয়ে অন্যের হাতে খেলে মানুষ কি বলবে? ঠিকমতো খাও। গুছিয়ে খাবে। ছড়াবে না এদিক ওদিক। ইহান নিজের খাওয়ায় মন দিল। ইশিতা হেসে মিথিলাকে খিচুড়ি বেড়ে দিয়ে বলল, ইহান আমি ভাবছি ওকে পড়াশোনা করানো দরকার। মানুষের সাথে ওর খুবই কম মেশা হয়। আর আমাদের সাথেও কথা কম হয়।
– হুম, ভালো তো পড়াও।
– তুই পড়াবি।
– আমি কেন? ইশুবু, আমার কদিন পর পরীক্ষা। এর মধ্যে… আমি পারব না। তুমি পারলে পড়াও। আমার সময় নেই।
– বুঝলাম। আচ্ছা দেখি।
খাওয়া শেষ করে মিথিলাকে নিয়ে সেই যে রুমে গেল এই দেড় ঘন্টায় বের হওয়ার নাম নেই। কি যে করছে সেটাই বুঝতে পারছে না। ফিজিক্স বইটা নিয়ে তখন থেকে বসার রুমে বসে আছে। চোখ কেবল ঘুরে ফিরে ইশিতার দরজার দিকে যাচ্ছে। বইয়ে মনোযোগ নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে ফেলল। ইশিতাকে ডাকার জন্য মুখ খোলার আগেই দরজা খুলল। মিথিলা বের হলো। লং ফ্রক পরা। পিঠ পর্যন্ত খোলা চুল দুই পাশে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। মুখে হালকা সাজ। সব মিলিয়ে ভীষণ সাধাসিধে লাগছে ওকে। ইশিতা বেরিয়ে বলল, কেমন লাগছে বলতো ইনু। ইহান কয়েক পলক ফেলে বইটা আবার খুলে বসল। আগে কখন সে মেয়েদের দিকে খুব ভালো করে তাকায়নি। মিথিলার দিকেও না। আজ কেবল ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইছে। কি হল বুঝতে পারল না। ইশিতা অভিমানের সুরে বলল, মেয়েটাকে সাজালাম আর একটু দেখছিসও না। মিথিলা ওর কাছে এসে বসে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। একে তো ওর প্রতি কেমন টান তৈরী হয়েছে তার উপর বাচ্চাদের মতো সরল চাহনিতে অস্বস্তি আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ভালো লাগছে। এটা শুনেই মিথিলা খুশি হয়ে গেল। ইশিতা মিথুকে বলল, ভাই থেকে সার্টিফিকেট পেয়ে গেলি। এবার চল। ইহান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় যাবে?
– ওকে নিয়ে মার্কেটে যাবো। ওর তো কিছুই নেই।
– তোমরা একলা যাবে?
– ফারাবীকে বলেছি। তুই তো যাবি না।
– ফারাবী গেলে আমি যাবো না কেন? আমি এখুনি আসছি।
ইহান তৈরী হতে চলে গেল। ইশিতা হেসে বলল, বুঝলি মিথু, শিখে রাখ। আমার ভাইটাকে কিভাবে ভুজুংভাজুং দিয়ে রাজি করানো যায়।
চলবে…