#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
.
.
.
রবিনের বাড়ি থেকে ফাহাদ ও পৌষী নিজেদের বাড়িতে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো । কেউ কারো সাথে কথা বলেনি এখনো ।
ফাহাদ ড্রয়িংরুমে বসে চিন্তায় মগ্ন । এমন সময় পৌষী এসে বললো-
চা খাবেন?
-মন্দ হয়না ।
.
রান্নাঘরে এসে পৌষী চা বানাতে শুরু করলো । সাথে গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগলো-
আমারো পরাণ যাহা চাই
তুমি তাই…
তুমি তাই গো,
আমারো পরাণ যাহা চাই…
.
রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ফাহাদ বললো-
তুমি দেখছি গানও গাইতে পারো ।
.
ফাহাদের কথার পিঠে কোনো কথা না বলে মনোযোগ সহকারে পৌষী চা বানাতে থাকলো ।
ফাহাদ প্রশ্ন ছুড়লো-
পৌষ মাসে জন্ম বলে তোমার নাম পৌষী রাখা হয় । তোমার মা খুব শখ করে এই নামটি রাখেন । তাইনা?
.
সে কথার জবাব না দিয়ে পৌষী উল্টো প্রশ্ন করলো-
আপনার কি ফাল্গুন মাসে জন্ম?
-আমার নাম ফাল্গুন নয় ।
-ফ তো আছে!
.
কথাটি বলে হাসলো পৌষী ।
সেই কথাটি আর আগালো না ফাহাদ । গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করেই বললো-
ছোট বেলায় তোমার মা মারা যায় । তোমার দেখাশোনার জন্য তোমার খালাকে বিয়ে করেন তোমার বাবা । কিন্তু বিয়ের পরে তোমার খালার আচরণ পাল্টে যায় । তোমার প্রতি অবিচার শুরু করেন তিনি । তার বাচ্চা হবার পরে আরো অবহেলা শুরু হয় তোমার প্রতি । তোমার পড়াশোনার প্রতি কোনো খেয়ালই নেয়া হতোনা বাসায় । যে কারণে সবসময় রেজাল্ট খারাপ হতো তোমার । জে.এস.সি পরীক্ষা দুবার দিয়েও ফেল করেছো । এর পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তোমার । তবে ঘরের কাজে বেশ পারদর্শী তুমি ।
.
ফাহাদের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৌষী ।
ফাহাদ বললো-
এসব কেনো বলছি ভাবছো? আমি তোমার সম্পর্কে সবই জানি এটা বোঝালাম ।
.
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে পৌষী বললো-
সবই জানেন?
-জানি এটাই জানতাম । কিন্তু এখন মনেহচ্ছে জানিনা । আজ রবিনের বাসায় যে আমি তোমার নতুন রূপ দেখলাম । তুমি আর সাহিত্য! হিসেব টা যেনো কিছুতেই মেলাতে পারছিনা আমি ।
.
পৌষীর চা বানানো হয়ে গিয়েছে । মগে চা ঢালতে ঢালতে সে বললো-
কাজি নজরুল ইসলামের জীবনী জানেন না আপনি? তিনিও কিন্তু উচ্চশিক্ষিত নন ।
-আমি জানি, সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হলে উচ্চশিক্ষিত হতে হয়না । আধ্যাত্মিক কিছু বিষয়ও মানুষের মাঝে বিদ্যমান থাকে । কিন্তু এই পৌষীকে আমি চিনিনা! মনেহচ্ছে…
.
ফাহাদের কাছে এগিয়ে এসে তার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে পৌষী বললো-
এতো বেশি ভাববেন না । মাথায় চাপ পড়বে ।
.
.
মিয়াজ শেখ ড্রয়িংরুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। হঠাৎ তার মনে হলো, নিচের বাগানের গাছগুলোতে আজ পানি দেয়া হয়নি । পানি দেয়া প্রয়োজন । ভাবনা মতো উঠতেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় মধুর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত এর শব্দ কানে ভেসে আসলো তার । এ কণ্ঠ তার চেনা, সুরটাও মুখস্ত । এই সুরের মাঝে দোল আছে । সে দোলে দোল খাওয়ার আকুতিও আছে । এই সুর তারই রুম থেকে ভেসে আসছে । তার স্ত্রী আমেনা বেগম মধুর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করছেন ।
আর উঠলেন না মিয়াজ শেখ । কিছুক্ষণ তিনি তিলাওয়াত শুনতে চান । ভালোই লাগছে তার!
.
.
ড্রয়িংরুমে বসে বেশকিছুক্ষণ ধরেই টিভি দেখছে পৌষী । চ্যালেন আইতে একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্টান চলছে । অতিথি হয়ে এসেছেন উষ্ণ মাহমুদ । যিনি তরুণ জনপ্রিয় কবিদের মাঝে একজন । উষ্ণ মাহমুদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৌষী ।
এমন সময় ফাহাদ এসে বললো-
পৌষী আমার খিদে পেয়েছে ।
.
পৌষী কোনো জবাব দিলোনা ।
ফাহাদ আবারো বললো-
পৌষী? খিদে পেয়েছে । ডিনার করবো ।
.
এবারো পৌষী জবাব দিলোনা কোনো । ফিরেও তাকালো না ফাহাদের দিকে ।
ফাহাদ কিছুটা রেগে গিয়ে একপ্রকার চেঁচিয়েই বললো-
কি ব্যাপারটা কি! কতোক্ষণ ধরে বলছি খিদে পেয়েছে আমার ।
.
ফাহাদের কথায় পৌষীর উত্তেজিত হবার কথা হলেও হলোনা সে । শান্ত গলায় বললো-
আমি টিভি দেখছি । এই অনুষ্টান শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবো না আমি । অপেক্ষা করতে না পারলে খেয়ে নিন নিজে । সব রান্না করা আছে ।
.
কথাগুলো পৌষী টিভির দিকে তাকিয়েই বললো ।
পৌষীর এমন ব্যবহারে ফাহাদের প্রচন্ড রাগ হতে থাকলো ।
কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে । আজ না খেয়েই ঘুমোতে হবে । খাবার ইচ্ছেই যেনো মরে গিয়েছে!
.
ফাহাদকে চলে যেতে দেখেও তাকে ডাকলোনা পৌষী । বিড়বিড়িয়ে বললো সে-
আমি এখন উষ্ণ কে দেখতে চাই!
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই ফাহাদের চোখ কপালে উঠে গেলো । সকাল ৮টা বাজতে চলেছে । আর সে কিনা এখনো বিছানায়! প্রতিদিন এই সময়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয় তাকে । নিজের তো অফিস তো নয়, যখন ইচ্ছে যেতে পারবে!
তবে আজ পৌষী তাকে ডাকলো না কেনো? প্রতিদিন তো সেই ফাহাদকে ঘুম থেকে ডেকে নাস্তা নিয়ে হাজির হয় ।
তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়ে নিলো ফাহাদ। পৌষীর রুমে এসে দেখলো, সে এখনো ঘুমে মগ্ন ।
পৌষীর মাথার কাছেই একটি ডায়েরি ও কলম । ফাহাদ ডায়েরিটি হাতে নিতেই একটি কবিতা দেখতে পেলো-
যখন একটি মেয়ে তার সব প্রিয়জনদের ছেড়ে পরের ঘরে গমন করে,
তখন সে নারীর পুরো কল্পনাকেই ঘিরে তার স্বামী বাস করে।
সে নারীর কপালে যদি স্বামীর এক ফোটাও ভালোবাসা না জোটে,
তার চেয়ে অভাগিনী পৃথিবীতে কেউ নেই বটে!
অভাগিনী, মোর কপালখানা
পাইনি স্বামীর হৃদয়খানা,,
বলোনি কভু হাসি-মুখে
অনেক ভালো-বাসি তোকে,,
আঁচল ভরা আশা এটাই
বাসবে ভালো ভীষণ করে,,
তুমিই আমার লক্ষী কনে
বলবে কানে গুনগুনিয়ে।
.
দেরী হওয়া আর নাস্তা না পাওয়ার কারণে মাথাটি খারাপ লাগলেও পৌষীর লেখা কবিতাটি পড়ে মনটা ঘেমে গেলো ফাহাদের ।
বিয়ের পরে যেকোনো মেয়েই স্বামীর ভালোবাসা কামনা করে । সেই জায়গায় পৌষী বিয়ের পর থেকে ফাহাদের কাছে কিছু পায়নি । হ্যাঁ ফাহাদ তার সাথে খারাপ আচরণ করেনা । কিন্তু ভালো করে দুটো কথাও কখনো বলেনি । কিন্তু সেও কি করবে! পৌষীর জন্য তার মনে তেমন কোনো অনুভূতিই কাজ করেনা । বরং রাগই হয় মাঝেমাঝে । সে না থাকলে নিশ্চয় মনের মতো কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারতো সে । সেক্ষেত্রে পৌষীকে অভাগী বলা যায় । সুখ যেনো ধরাই দিচ্ছেনা তাকে ।
বেশি না ভেবে পৌষীর উদ্দেশ্যে ফাহাদ বললো-
আমি অফিসে যাচ্ছি । দরজাটা লাগিয়ে দিও ।
.
পৌষী শুনেছে কিনা সে জানেনা, বেরিয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে ।
.
.
স্বামীর দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতেই মিয়াজ শেখ বললেন-
বড় আশা ছিলো । ছেলেটাও সাহিত্যিকের দিকে মনোযোগ দিবে । কিন্তু সে ব্যবসার পথেই..
.
তাকে থামিয়ে আমেনা বেগম বললেন-
এই এক বিষয়ে বারবার কথা না বললে হয়না তোমার? সবার মাঝে সব গুণ বিদ্যমান থাকেনা ।
-ঠিক বলেছো । তবে কাল এক মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে রবিনের বাসায় । নাম পৌষী ।
-ভারী মিষ্টি নাম ।
-দেখতেও মিষ্টি । অল্পবয়সী মেয়ে । তার সাথে কথা বলে বুঝলাম, ট্যালেন্ট আছে মেয়েটির মাঝে ।
-রবিনের কি হয়?
-কোনো বান্ধবী হতে পারে । আসলে আমরা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে বলতে পরিচয়ই জানা হলোনা! তবে সুযোগ পেলে মেয়েটি অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে । আমার এতোবছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ।
-তুমি কি তাকে সাহায্য করতে চাইছো?
-সেইরকমই কিছু ভাবছিলাম । কেননা সে জড়িত হয়ে চায় বলেছিলো, লেখালেখির জগতে ।
-তোমার মাধ্যমে যদি সে সবার মাঝে পরিচিতি লাভ করে ক্রেডিট টা তুমিই পাবে ।
.
মৃদু হেসে মিয়াজ শেখ বললেন-
আমি কোনো ক্রেডিটের জন্য কাজ করিনা আমেনা!
-তবে কিসের জন্য?
-তুমি আমাকে এতোদিনেও চেনোনি?
.
স্বামীর প্রশ্নে জবাব না দিয়ে হাসলেন আমেনা বেগম । মিয়াজ শেখের মনটা প্রচন্ড ভালো, কাউকে সাহায্য করতে পারলেই খুশি হন তিনি, নিঃস্বার্থ একজন মানুষ তিনি । এসব বিষয়ে অজানা নয় আমেনা বেগমের । মাঝেমধ্যে গর্ব হয় তার, এমন একজন মানুষের স্ত্রী হতে পেরে ।
.
.
অফিসে বসে আছে ফাহাদ । কাল থেকে পৌষীর ব্যাপার স্যাপার বুঝে উঠতে পারছেনা সে । কাল নাহয় অন্য কারো কবিতাকে নিজের বলে চালিয়েছিলো । তার ধারণা ছিলো এমনটায় । তবে সাহিত্য নিয়ে কথা বলা, ব্যবহার পরিবর্তন হওয়া এসব কি করে সম্ভব?
ভাবতে ভাবতেই আজ সকালের পৌষীর লেখা কবিতাটির কথা মনে পড়লো ফাহাদের । পৌষীর হাতের লেখা স্কুলের বাচ্চাদের মতো । তবে ডায়েরিতে এতো সুন্দরভাবে কিভাবে লিখলো সে! এই বিষয়টি আগে মাথায় আসেনি ফাহাদের । সে কি ভুল দেখেছে? মোটেও না । স্পষ্ট মনে আছে ফাহাদের । সুন্দর হাতের লেখার একটি কবিতা ছিলো ডায়েরিটায় ।
পৌষীর হাতের লেখা এতো ভালো কি করে হলো!
.
বি:দ্র: উল্লেখিত কবিতাটি নিহাল আহম্মেদ ভাইয়ার লেখা।