মুহুর্তে পর্ব -০২

#মুহূর্তে
পর্ব-২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

[প্রধান চরিত্রের নাম কাব্য থাকার কারণে অনেকের সমস্যা হচ্ছিল তার নাম পরিবর্তন করে কবিতা রাখা হয়েছে।]

তীর্থ! এই তীর্থ নামক যুবকটি এতগুলো মানুষের মধ্যে তার জন্য এগিয়ে এসেছে। কবিতার হঠাৎ ইচ্ছা জাগলো এই তীর্থ নামক যুবকটাকে দেখার।

তীর্থ ছেলেটার হাত মুচড়ে পেটে একের পর এক ঘুষি মারতে শুরু করল।
কবিতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। তার পাশ থেকে আরেকটা ছেলে বলল, “এই’যে আপু আমার বন্ধু বুঝলেন? একদম হিরোদের মতো মারছে না?”
কবিতা কিছু বলার পূর্বেই তার ভাই পিছনে থেকে ডাক দেয়, “কবিতা তুই ঠিক আছিস?”
কবিতার রাগ উঠে আবিরকে দেখে। সে আবিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “ভাই তোমার ঘুম শেষ? তোমাকে তো আমার সাথেই পাঠিয়েছেই ঘুমানোর জন্য তাই না? এক ছেলে আমার সাথে যত খারাপ ব্যবহার করুক না কেন তুমি কুম্ভকর্ণের মতো পড়ে ঘুমাও।”
কবিতা রাগ করে আবিরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দেখে আবারও তীর্থ নামক ছেলেটার দিকে। তার পাশের ছেলেটা আবারও বলে, “আপু আমার নাম লিমন। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি তীর্থ ভাইকে থামাতে পারি, নাহলে আপনি চাইলে এই পিটানোর সেশন চলতে পারে। যদিও ছেলেটা অলরেডি আধমরা হয়ে গেছে। তারপরও আপনার ইচ্ছা।”
কবিতা গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটার দিকে। তারপর বলে, “থামান।”

লিমন নামক ছেলেটা লাফিয়ে যেয়ে থামায় তীর্থকে। এই প্রথম তীর্থের চেহেরা দেখতে পায় কবিতা। লম্বা, শ্যামলার মাঝে তার রঙ, সুগঠন কাঠামোর অধিকারী তীর্থ ছেলেটা। তীর্থের পরণে একটি সাদা রঙের গেঞ্জি, এর উপর জিন্সের জ্যাকেট। তার চুলগুলো এলোমেলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে বড্ড বেপরোয়া ছেলেটি, তবে বেশ আকর্ষণীয়ও। প্রথম নজরে যেকোনো মেয়ে তাকে বেশ পছন্দ করে নিবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কবিতার তীর্থর থেকে বেশি ধ্যান ওই ছেলেটার উপর থাকা উচিত।

তীর্থ লিমনের কথা শুনে ছেলেটাকে ছেড়ে দিলো। তারপর শীতল দৃষ্টিতে তাকাল কবিতার দিকে। তারপর তার কলার ধরে তাকে উঠিয়ে উঁচু স্বরে বলল, “এই ড্রাইভার, ভাই গাড়ি থামান। আপনার বাসে এতকিছু হচ্ছে কিন্তু আপনার কোনো ধ্যানই নেই।”
ড্রাইভারও তার কথায় উত্তর দিলো, “একদিন পর পরই এইসব কাহিনী হয় ভাই। সব কামে এত ধ্যান দিলে বাস চালামু কখন? দাঁড়ান জায়গা বুঝে সাইডে করতেছি।”

তীর্থ ছেলেটার কলার ধরে টেনে তাকে কবিতার সামনে দিয়ে নিয়ে যেতে নিলো তখনই কবিতা বলল, “একটু দাঁড়ান, এখনো আমার কাজ বাকি আছে।”
কবিতা তার জুতোটা খুলে হাতে নেয়। তারপর তা দিয়ে কয়েকটা মারে ছেলেটাকে। ছেলেটা যে নিজেকে রক্ষা করবে অথবা প্রতিবাদ করবে এই শক্তিটাও তার নেই। শেষমেশ ছেলেটা না পেরে কবিতার পা ধরে নেয়, “আপা…আপা মাফ করে দেন। আর হইব না৷ আজকের পর কোনো মাইয়ার দিকে খারাপ নজরেও তাকাব না। প্রয়োজনে সারাজীবনে বিয়েও করব না। আজকের মতো ছাইড়া দেন।”
যদিও এমন মানুষের প্রতি মায়া লাগা উচিত না তবুও কবিতা দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দেয় ছেলেটাকে। বাস থামতেই ছেলেটা হরবর করে বাস থেকে নিচে নেমে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।

কবিতা কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকায় তীর্থের দিকে, “থ্যাঙ্কিউ আমার সাহায্য করার জন্য।”
কবিতা ভেবেছিলো তীর্থ যেভাবে তার সাহায্য করলো ছেলেটা খুব ভালো। কিন্তু যখন তীর্থ তার ধন্যবাদের উওর না দিয়ে কঠিন গলায় বলল, “এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তা আটকাবেন না। জায়গা দিলে আমার সিটে যেয়ে বসবো এমনিতেই ঘুম হারাম করেছেন।”
তীর্থের কথা শুনে কবিতার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
“আপনি আমাকে সাহায্য করতে এসেছেন বলে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। আর আপনি আমার সাথে এমন বেয়াদবি করছেন?”
“এক্সকিউজ মি, ওই ছেলের জন্য আমার ঘুম নষ্ট হয়েছে তাই ওকে শাস্তি দিলাম। আপনার কারণে না।”
তীর্থ কবিতার হাত ধরে তাকে একপাশে সরিয়ে নিজে যেয়ে তার সিটে বসলো।

কবিতা হকচকিয়ে যায়। কিছু সময় পর আবির তাকে বলল, “আর তামাশা করিস না মা। চল, সিটে যেয়ে বস।”
কবিতা আবিরের কোনো কথা না শুনে তীর্থের সামনে যেয়ে বলে, “আপনি আস্ত এক অসভ্য। কোথায় ভেবেছিলাম হিরোদের মতো লোকটাকে মেরেছে কিন্তু আপনিই তো একদম…. একদম…”
“এই একধুম তাকধুম অন্য কোথাও যেয়ে করেন। আমার কানের সামনে এসে ভনভন করবেন না।”
“আপনি এত বেয়াদব কেন?”
ড্রাইভার বাস চালু করতেই তাল সামলাতে পারে না কবিতা পড়ে যেতে নেয় তখনই সে তীর্থের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সামলায়। তার অন্যহাত ধরে তীর্থ। তীর্থ তাকায় কবিতার দিকে। কবিতা তার মুখোমুখিই ছিলো। কবিতার দিকে তাকাতেই তাদের চোখে চোখ পড়ে। হয় দৃষ্টিমিলন। মেয়েটার চোখে কাজলমাখা। তার চোখ দুটো উপন্যাসের মায়াবতীর মতো টানা নয়, কিন্তু চক্ষু দুটো গভীর ও মায়াবী।
তাদের দৃষ্টি বন্ধনটা বেশি সময়ের জন্য ছিলো না। ছিলো কিছু মুহূর্তের।

কবিতা অস্বস্তি নিয়ে সরে যেয়ে নিজের সিটে যায়। এইবার সে বসে জানালার কাছের সিটে। আবির তার পাশে এসে বসে বলে, “তুই আমাকে ডাকবি না? আমি ছেলেটার খবর নিতাম। এই হুটহাট করে তোর রাগ উঠলে তো হবে না। বিয়ের পর যখন শশুড়বাড়ি যাবি তখন এমন রাগ দেখালে তো বের করে দিবে বাসা থেকে।”
“উফফ ভাইয়া জামাইয়ের খবর নাই আসছো বিয়ের ঢোল বাজাতে। কার এত সাহস হবে আমাকে কোথাও থেকে বের করার? আমি উল্টো বিয়ের পর সবাইকে আঙ্গুলে নাচাব। আর ওই ছেলে আমার শরীরে এত বাজেভাবে হাত দিচ্ছিলো আর আমি চুপচাপ বসে থাকব? আমি তো পারলে এইখানে ওই ছেলেকে গ্রিল করতাম। যে শিক্ষা দিয়েছি আর কোনো মেয়েদের দিকে খারাপ নজরে তাকাবে না।”
“এইটা তোর ভুল ধারণা। কুত্তার লেজ কখনো সোজা হয় না। আজ এইখান থেকে পালানোর জন্য শুধু কথাটা বলা। এই কাজ সে আবারও করবে।”
কথাটা শুনে কবিতার মেজাজ আরও খারাপ হলো। যদিও কথাটা সত্য, সে জানে। কিন্তু সবসময় সত্য কথা বলতে নেই। সত্য কটু হয়।

কবিতা আড়চোখে একনজর তাকাল তার পিছনের সিটে তীর্থের দিকে। দুইসিটের ফাঁক দিয়ে ছেলেটার চেহেরাটা দেখে যাচ্ছে। সে ফোনে কিছু একটা করছিলো। এত সুদর্শন ছেলেটা, অথচ বেয়াদব!
এই কথা চিন্তা করার মাঝেই তীর্থ একপলক তাকায় কবিতার দিকে। চোখে চোখ পড়ে। সাথে সাথে কবিতা হড়বড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। লজ্জায় পড়ে যায় সে।
.
.
তাহিরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব তার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে। ঘুমানোর সময় কতটা শান্ত লাগে তাকে অথচ জাগলে এক স্থানে তাকে বেশিক্ষণের জন্য পাওয়া যায় না। তাহিরা আলতো করে চুমু খায় ধ্রুব কপালে। তারপর যত্ন করে তার মাথা নিজের চোখের থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রাখে। তারপর উঠে যায় রান্নাঘরে। রান্নাঘরে যেয়ে চা বানিয়ে নিয়ে যায় তার দাদীর রুমে। যেয়ে দেখে দাদী বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছে। সে চা রেখে যেতে নিলেই দাদী তাকে হাতের ইশারায় বলল দাঁড়াতে। তারপর নিজের কোরআন পড়া শেষে হাতে চা নিয়ে বসলেন। কঠিন গলায় তাহিরাকে বললেন, “তোরে কিছু কইতে পারি না দেইখা কি তুই এইসব কইরা বেড়াবি?”
“কী করলাম দাদীমা?”
“কী করছোস? তুই কি ভাবছোস ধ্রুব তোর কোলে মাথা রাইখা যে শুইয়া ছিলো তা আমি দেখি নাই? আমার চোখ নাই? ভালা ঘরের মাইয়াগো এইসব মানায়? এই’যে এলাকায় এতকিছু হইলো কেউ যদি বাসায় আইসা তোগোরে দেইখা লাইতো তাইলে ভাবসোস কত কথা হইতো। শুন ওর মা’য়ে তোগো বিয়ার কথা কইসে, তোগো বিয়া হয় নাই। লাজ শরম রাখ।”
“আমি মানা করেছিলাম দাদী’মা। ও আমার কথা শুনে না। তুমি ওকে মানা করে দিও। সাথে বলো রাতে যেন বাসায় না আসে।”
কথাটা এমনিতেই বলা। তাহিরা জানে দাদী’মা কখনো ধ্রুবকে কিছু বলবেন না। তার অনেক আদরের ধ্রুব।
দাদী বিরক্তি নিয়ে বললেন, “এইসবের লাইগা ওরে বাসায় আসতে মানা করা ঠিক হইব না। ভবিষ্যতে তোর লগে বিয়া হইলে তো সমস্যা। এমনিতেও মা-বাপ ছাড়া কোনো ভালা ঘর মাইয়ারে নিতে চায় না। দেখ শিল্পা আইসে না’কি? ফোন দিয়া ধ্রুবর খবর নিসিলো। যদি আহে তাইলে চা দিয়া আয়, যা।”

শিল্পা আন্টি হলেন ধ্রুবর মা। তিনি একজন ডাক্তার। উনার নাইট ডিউটি ছিলো আজ রাতে। যদিও তার ডিউটি আগে শেষ হলেও তাহিরা বলায় মিদুলের মা’কে তিনি নিজে দেখেন।

দরজা খুলেই শিল্পা আন্টি একগাল হাসলেন তাহিরাকে দেখে। তাহিরা তার শিল্পা আন্টিকে কখনো হাসি ছাড়া দেখে নি। ধ্রুবর বাবার মৃত্যুর পর তার উপর দিয়ে অনেক ঝামেলা যায়। জায়গা-সম্পত্তির কারণে সব আত্নীয়-স্বজনের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। সংসারেও ভীষণ সমস্যা হয় অথচ নিজেকে খুব ভালো করে সামলে নিয়েছে তিনি। তাহিরা তাকে খুব শ্রদ্ধা করে। তার মতো হতেও চায়। কিন্তু সে এতটুকু জানে সে চাইলেও কখনো তার মতো হতে পারবে না।

তাহিরাকে চা-নাস্তা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিল্পা বলে, “তুই আমার এঞ্জেল বুঝলি? এত অলসতা লাগছিলো নাস্তা বানাতে আর তুই নিয়ে আসলি।”
তাহিরাকে ভেতরে ঢুকার রাস্তা দিয়ে শিল্পা আক্তার জিজ্ঞেস করে, “ধ্রুব কোথায় জানিস?”
“আমাদের বাসায়।”
“অকারণেই জিজ্ঞেস করলাম। আর কোথায় থাকবে ফুলটুসিকে ছাড়া।”
হাসলেন শিল্পা। তাহিরা বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না শিল্পার কথায়। কারণ সবাই ভাবে ধ্রুব আর তার মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু ধ্রুবর দৃষ্টি অনুসারে তারা ছোটবেলার বন্ধু ছাড়া কিছু না। তাহিরা এই বিষয়ে কথা এগোতে চাইলো না তাই জিজ্ঞেস করে, “মিদুলের মা কেমন আছে আন্টি?”
“আউট অফ ডেঞ্জার বাট এখনো হুশ ফিরে নি।”
“ও”
“তোর বোন না আজ ঢাকায় আসতো?”
“আসতে আরও সময় লাগবে।”
শিল্পা এসে দাঁড়ানের তাহিরার সামনে। তার থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ কেন?”
“আন্টি আপনি কেন বিয়ের কথাটা দাদীকে বললেন? উনি তো এখন আশা লাগিয়ে বসে আছে।”
“আমার ছেলেকে এত ভালোবাসিস তাহলে বলবো না কেন? আল্লাহ না করুক আমি যদি কাল মরে যাই আমি নিশ্চিন্তে থাকব কারণ তুই ওর সাথে….”
“আন্টি এইসব কথা বলবেন না।”
“কী হয়েছে বলতো?”
“ধ্রুবর মনে কি আছে তা না জেনে আপনি এবং দাদী বিয়ে নিয়ে কথা বললে হবে? ও আমাকে বন্ধু থেকে বেশি কিছু মনে করে না।”
পরিষ্কারভাবে বলল তাহিরা। তার কন্ঠ উদাসীন। শেষ বাক্যটা বলার সময় তার গলা কেঁপে উঠে।
শিল্পা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে, “আমাদের তাহিরাকে কেউ না পছন্দ করে থাকতে পারে? আমার ছেলেটা তো ছাগল। নিজের মনের কথা বুঝে না। তোর থেকে মায়াবী মেয়ে কোথায় পাবে ও? আর একটা কথা বলি? ধ্রুব এই পৃথিবীতে আমার পরে শুধু তোকে ভালোবাসে।”
“ভালোবাসে…..” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহিরা, “বন্ধুর মতো ভালোবাসে।”
শিল্পা আবারও হাসলেন। তাহিরাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে সামনের চেয়ারে সে বসে। জিজ্ঞেস করে, “নাস্তা করেছিস?”
তাহিরা মাথা নাড়িয়ে ‘না’ উওর দেয়। শিল্পা নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দেয় ও বলে, “ধ্রুবর বাবা ও আমার লাভ ম্যারেজ ছিলো। তাই আমি ভালো করেই জানি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সীমানাটা। অনেকে ভালোবাসে কিন্তু বুঝতে পারে না আবার অনেকে ভালোবাসলে স্বীকার করতে চায় না। নিজেকে এবং ওকে দুইজনকেই সময় দিয়ে বাকিটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিবি। ভাগ্যতে যা থাকবে তা হবে।”

চলবে…..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here