মুহুর্তে পর্ব -০৯+১০

#মুহূর্তে
পর্ব-৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা বিরক্তি নিয়ে বসে নিজের চেয়ারে, “তাহলে এখানে আসলেন কোন দুঃখে?”
“মা’য়ের ইমোশনাল ব্লাকমেইলে। দেখো আমি ত্যাঁড়া ব্যাঁকা ঘুরিয়ে কথা বলতে পারি না। তাই সোজাসাপ্টা বলি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি জানি আমাকে দেখে তুমি নিশ্চয়ই বিয়ের হাজারো স্বপ্ন সাজিয়েছ কিন্তু আমি প্রেম, ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। তাই বিয়ে করারও আমার কোনো ইচ্ছা নেই।” তারপর একটু বিরতি নিয়ে আবার বলে, “এছাড়া প্রেম ভালোবাসায় বিরক্তি এসে পড়েছে আমার। আমার মনে হয় না আমি অন্যকাওকে নিজের মন দিতে পারব।”

কবিতা বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার মন দিয়ে কী একটা বড়সড় চকোলেট কেক অথবা দামী কোনো জামা কেনা যাবে?”
কথনকে চমকে উঠে কবিতার কথায়, “তোমার মাথা কি আসলে খারাপ না’কি? মন দিয়ে এইসব কীভাবে কেনা যায়?”
“তাহলে আপনার মন দিয়ে আমার কি লাভ?”
কথন বিরক্তি নিশ্বাস ফেলে বলে, “আচ্ছা আমি যা বলছি তা শুনো। আমি কলেজের সময় একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম। আমাদের তিন বছরের সম্পর্কও…” কবিতা তার কথা কেটে বলে, “মেয়েটা আপনাকে ছ্যাঁকা দিয়েছে?”
“তুমি আমার সম্পূর্ণ কথা তো শুনবে।”
“আর্টসের স্টুডেন্ট হয়ে কখনো টিচারের ইতিহাস পড়ানোটা শুনলাম না আমি আবার আপনার প্রেমের ইতিহাস শুনব। শর্টকাটে বলেন তো ছ্যাঁকা খাইসেন তো না’কি?”
কথন বিরক্ত হলো কবিতার কথায়।
“হ্যাঁ কয়মাস আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে।”
ফিক করে হেসে দেয় কবিতা, “মানে আমি ঠিক ছিলাম। আপনি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছেন।”
“এট লিস্ট তোমার মতো তো না যে ভাইয়ের থেকে ভয় পেয়ে কখনো ছেলেদের সাথে কথাও বলো নি।”
“এক্সকিউজ মি, আমি ভয় পাই নি। ওই ছেলেগুলো ভয় পাইতো তাই দশ হাত দূরে থাকতো। আমার ভাইকে চিনেন না। আমার তো মনে হতো আমি জেলখানায় বন্দী হয়ে আছি। টিপিকাল চিন্তাভাবনা। আমাদের সমাজের মতে মেয়ে হলে ঘরে বন্দী হয়ে থাকা লাগবে।”

কথন কবিতার কথা শোনার পর পরই কিছু বলল না। প্রথমে সে ওয়েটারকে একটা কফির অর্ডার দেয়। তারপর কবিতাকে বলে, “ছেলে মেয়ে কথা না। সন্তানদের একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কিছু নিয়মে বেঁধে রাখে মা-বাবা, নাহয় অনেক খারাপ কাজে জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। টিনএজের বয়সে আবেগ বেশি থাকে, নিষিদ্ধ কাজে ঝোঁকও বেশি থাকে, নিজেকে অনেক বড় প্রমাণ করতে যেয়ে অনেকে খারাপ কাজে জড়িত হয়ে পড়ে তাই এইসব নিয়ম করা। তোমার বয়সে আমারও এমনটা মনে হতো কিন্তু আজ তার জন্যই আমি আমার মা-বাবাকে শুকরিয়া আদায় করি। আর রইলো তোমার মেয়েদের নিয়ে কথা বলাটা তুমি জানো আমার থেকে আমার বোনদের হাজারোগুণ বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর আমার মনে হয় না তোমার ভাই এতটা কড়া।
এত কড়া হলে তোমাকে ঢাকায় একা থাকার পারমিশন কেন দিতো?”
“কারণ আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। দেখলেন না ঢাকা আসার পরেরদিনই আপনার সাথে বিয়ের জন্য দেখা করাতে পাঠিয়ে দিলো।”
“ওহ গুড পয়েন্ট। এইটা নিয়ে তো ভাবি নি।”
“দেখেন আপনি বিয়ের জন্য মানা করতে চাইলে একমাস পর করবেন। যদি বিয়ে ক্যান্সেল হয়ে যায় তাহলে ভাইয়া আমাকে ফেরত ডাকতে পারে। একমাসের মধ্যে সবজায়গায় ভর্তি বন্ধ হয়ে যাবে তখন সম্ভবত আর ফেরত ডাকবে না। প্লিজ প্লিজ।”

কথনের কফি এসে পড়েছে। সে কফিতে এক চুমুক দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমারও এতে ভালো হয়। মা আর একমাস কোনো মেয়ে দেখাবে না। তুমি পড়াশোনা নিয়ে এত সিরিয়াস দেখে ভালো লাগলো।”
“কে পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস? আমার তো বই দেখলেও প্রেগন্যান্ট প্রেগন্যান্ট ফিল আসে।”
কথন কফিতে চুমুক দিয়েছিলো। কবিতার কথা শুনতেই হকচকিয়ে যায় সে। হঠাৎ কাশতে শুরু করে।
“তোমার কি ফিল হয়?”
“মানে মাথা ঘুরায় আরকি। ওই যে লাউ সেই কদু।”
“তোমার আসলে মাথায় সমস্যা আছে। তো পড়াশোনা না করলে ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছা তোমার?”
“ইচ্ছা ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনার হবার। এই নিয়েই সামনে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হলো না।”
“কেন?”
“ভাইয়ার মতে ভালো ঘরের মেয়েরা ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ে না।”
“কী আজব কথা-বার্তা!”
“আসলে। এমনকি ভাইয়ার মতে মেয়েদের পড়াশোনা যাস্ট ফর্মালিটি। বিয়ের পর সংসারই করতে হবে। অনার্সে উঠে বিয়ে হলে শশুড়বাড়ি লোকেরা সামনে পড়াবে না’কি তারা সিদ্ধান্ত নিবে।”
কথাগুলো শুনে কথনের চোখে মুখে বিরক্তির ছায়া পড়ে, “আমরা ২০১৩ তে বসবাস করি। আর উনি এই যুগের ছেলে। উনার চিন্তা ভাবনা এখনো এমন কেন? প্রতিটি মানুষের নিজের জীবন নিজের শর্ততে বাঁচা উচিত। আই থিংক তোমার এই বিষয়ে তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। অথবা আমি কথা বলতে পারি।”
“ভাইয়া আমাকে জীবিত কবর দিবে। আমাদের পরিবার এতটা ফ্রী মাইন্ডের না।”

কথন একটি বাঁকা হাসি দিলো। টেবিলে হাত রেখে কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোমার স্বাধীন মনোভাব দেখে ভালো লাগলো। আজকের কথা বলছি না। গতকাল যে ওই পেসেন্টকে বলেছ সে কথা বলছি। আমি আশা রাখি তুমি সবসময়ই এমন মনোভাব বজায় রাখবে এবং নিজের স্বপ্নটাও পূরণ করবে।”
“আর কবে? ভার্সিটিতে তো ভর্তি হয়েই গেছি।”
“দেখ নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য সময় বা বয়সের গননা করা উচিত নয়। যদিও তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তোমার নেওয়া উচিত কিন্তু তোমার ফ্যামিলি যেহেতু রাজি হচ্ছে না তাহলে এমন কোনো জীবনসাথী বাছাই করবে যে তোমার স্বপ্নকে প্রাধান্য দেয়। এক দুই ইয়ার মিস হলেও তোমার ভবিষ্যতে তা নিয়ে তোমার কোনো আফসোস থাকবে না। আর সে জিনিসটা তুমি মন থেকে করবে। আমার কথা বলি, বাবা চাইতো আমি তার বিজনেস সামলাই তাই আমি কমার্স নিয়েছিলাম কিন্তু সে পড়ায় কোনো মতেই আমার মন বসে নি। তারপর মা বাবা আমাকে সাইন্স দেয়। আমার ছোটা থেকে স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবার। যখন আমি নিজের স্বপ্নের পথে চলছিলাম তখন নিজের বেস্ট দিচ্ছিলাম।”

কবিতা কথনের এই কথায় মুগ্ধ হলো। সে মৃদু হাসে। তার মনে হয় সে যতটা ভেবেছিলো এতটাও খারাপ না। উল্টো ভালো। নিজের স্বপ্ন পূরণ এর জন্য আগে কেউ তাকে উৎসাহ দেয় নি। আজ প্রথম কথন থেকে উৎসাহ পেয়ে তার ভালো লাগছে।
.
.
রাত ৯.৩০ বাজে। তাহিরা পড়ছিলো। ঘরের সব কাজ সেরে পড়তে বসে সে। কবিতা ছাদে গিয়েছে। তাই শান্তি মতোই পড়ছিলো সে। কলিংবেল বাজলো। তাহিরা দরজা খুলে ধ্রুবকে দেখতেই তার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে। গতরাতের পর থেকে যথাসম্ভব তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে তাহিরা। তাহিরা যত দ্রুত দরজা বন্ধ করে চাইলো কিন্তু দরজা বন্ধ হবার আগেই ধ্রুব দরজা ধরে ফেলে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই তাহিরার দুই বাহু শক্ত করে ধরে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে নেয় এবং কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুই কল ধরছিস না কেন আমার?”
“আমার ইচ্ছা।”
“তোর ইচ্ছা? তোকে কে বলেছে আমার ব্যাপারে তোর ইচ্ছা প্রয়োগ হবে?”
“দাদী পাশের রুমে আছে, করছিসটা কি তুই?”
ধ্রুব তাহিরার বাহু ছেড়ে তার দুই কোমরে হাত রেখে একটানে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।

চমকে উঠে তাহিরা। ধ্রুবর হঠাৎ কি হলো তার মাথায় ঢুকছে না। এমন সময় রুম থেকে দাদীর কন্ঠ পায় তাহিরা, “দরজা খুলছোস?”
“হ্যাঁ দাদী’মা খুলেছি। ধ্রুব এসেছিলো নোট নিতে।”

তাহিরা ধ্রুবকে নিজের কক্ষে নিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “মাথা খারাপ হয়েছে তোর?”
ধ্রুব আবারও তাহিরার কাছে আসতে চাইলে তাহিরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“তুই জানিস ধ্রুব আমার এইসব পছন্দ নয়। গতকাল… গতকাল।যা হয়েছে ভুলে হয়েছে। এর মানে তো এই নয় যে আমরা বারবার ভুল করব। নিজের সীমানায় থাক।”
তাহিরার কথা যেন তার কানেই যায় নি। সে তাহিরার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আর নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলে, “গতকাল থেকে আমার কি হয়েছে আমি জানি না। আমি গতকাল সারারাত ঘুমাতে পারি নি শুধু কি করেছিলাম তা ভেবে। অশান্ত লাগছিলো খুব কিন্তু কোনো এক কারণে আমার মোটেও অনুতাপও হচ্ছিল না। আমার শুধু তোকে লাগতো। কিন্তু তুই আমাকে ইগনোর করছিলি। কেন? তুই জানিস না তুই আমার সাথে একদিন কথা না বললে আমি থাকতে পারি না।”
“তোর ওই একশোটা গার্লফ্রেন্ড আছে না তাদের সাথে কথা বল। আমাকে কেন লাগবে তোর?”
“তুই এমন করছিস কেন? তুই না আমার ফুলটুসি। প্লিজ এমন করিস না। তুই আমার সাথে কথা না বললে আমার কষ্ট হয়।”
“আর তুই যে আমাকে গত দেড়বছর ধরে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছিস তার কি?”
ধ্রুব মুখ তুলে চমকে তাকায় তাহিরার দিকে। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়, “আমি তোকে কিভাবে কষ্ট দিতে পারি? অসম্ভব!”

তাহিরা বিরক্তি নিয়ে ধ্রুবকে সরাতে চাইল। কিন্তু ধ্রুবর শক্তির সাথে তো আর সে পারে না। ধ্রুব শক্ত করে বাহুডোরে আটকে রেখেছিল তাকে। তাহিরাকে এমন ছটফট করতে দেখে সে বলল, “তোর কি হয়েছে বলবি তো। না বললে আমি কীভাবে বুঝব?”
“জানি না।” তাহিরা মুখ ফিরিয়ে নিল।
“তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?” প্রশ্নটা শুনে একটা ঝটকা খায় তাহিরা। কিন্তু সে চায় না ধ্রুব কেবল তাকে এই কারণে আপন করুক কারণ সে ধ্রুবকে ভালোবাসে। সে জানে ধ্রুব তাকে কষ্ট না দেবার জন্য নিজেকেও কষ্ট দিতে পারে। তাই তাহিরা মিথ্যে উত্তর দিলো, “না।”
“তোর মনে আমার জন্য বন্ধুত্ব ছাড়া কোনো অনুভূতি নেই?”
এই প্রশ্নের উওর দেয় না তাহিরা।

কিছু সময়ের নিরবতা কাটলো। ধ্রুব জিজ্ঞেস করে, “আমি একটা কথা বলি?”
“হঁ”
“যদি বলি আমার মনে তোর জন্য বন্ধুত্ব থেকে বেশি কিছু আছে তাহলে কি তুই রাগ করবি?” তাহিরা আশ্চর্য নিয়ে তাকায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব মোটেও চায় না তার ও তাহিরার বন্ধুত্বের মাঝে কোন সমস্যা হোক। তাই সে সংকোচ নিয়ে বলে, “বিশ্বাস কর আমি চেয়েছি নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে। কিন্তু যখন থেকে আবির তোর বিয়ের কথা বলেছে আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ভাবতেই ভয় লাগে তুই অন্যকারো হয়ে যাবি অথবা তোর উপর অন্যকারো অধিকার হবে। আর গতকাল আমি যা করলাম তা হঠাৎ-ই ছিলো। আমি কখনো তোকে নিয়ে এমন কিছু চিন্তাও করি নি বিশ্বাস কর। আবার যখন প্রথমবার চুমু খেয়ে তোকে ছেড়ে দিলাম তোর মুখ দেখে নেশা লেগে গিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো তোকে আমি সারাজীবন আমার বাহুডোরে ভরে রাখি। তুই আমার জীবনের সবকিছু জানিস। তুই এটাও জানিস আমি আগে অনেকগুলো মেয়েকে চুমু খেয়েছি কিন্তু আমার এমন কখনো মনে হয় নি। গতরাতে আমার হঠাৎ মনে হলো আমি তো…তোকে ভালোবাসি। তোকে অন্যকোনো পুরুষ ছুঁলে, তোর স্বামী হলে, তোকে ভালোবাসলে আমার সহ্য হবে না। মরে যাব আমি। আয় আমরা বিয়ে করে ফেলি। মজা না, সিরিয়াসলি বলছি। এই…তুই কাঁদছিস কেন? তুই কি রাগ করেছিস আমার কথায়?”

তাহিরা চোখের জলে ভরে গেল কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে গাঢ় হাসি এঁকে আসে। তার এতবছরের সাধনার পরিণাম যে তার সামনে।
“তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস?”
ধ্রুব দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
“তাহলে কিন্তু তোর সব গার্লফ্রেন্ডকে ছাড়তে হবে। কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবি না।”
“প্রমিজ করছি একজনের সাথেও কথা বলব না। আজই সবাইকে সব জায়গা থেকে ব্লক মারব। কিন্তু তুইও ওয়াদা কর, আমাকে ছাড়া অন্যকাওকে বিয়ে করতে পারবি না।”
কেমন বাচ্চাদের মতন করে আবদার করে ধ্রুব। ধ্রুবর আবদারের ধরণ দেখে হাসে তাহিরা। পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে উঁচু করে দাঁড়ায়। ধ্রুবর দুই গালে হাত রেখে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় ধ্রুবর কপালে। তারপর জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। তার বুকে মুখ গুঁজে বলে, “ওয়াদা রইলো।”
অন্যরকম এক শান্তি লাগছে তাহিরার। আগে কখনো এমনভাবে সে ধ্রুবর বুকে মাথা রাখে নি। এখন তার আফসোস হচ্ছে এমনটা না করায়। মনে হচ্ছে তার বুকে জমে থাকা ব্যাথাটা আর নেই। যে ব্যাথাটা রাত জাগা কান্না কমাতে পারে নি আজ সে ব্যাথাটা ধ্রুব বুকে মাথা রেখে নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। প্রচুর শান্তি লাগছে তার। কিন্তু এই বাস্তবটাও তার কল্পনা লাগছে।
ধ্রুবর জিজ্ঞেস করে, “আমি কি তোকে ভালোবাসি বলতে পারব?”
পাগল ছেলেটা। সে বুঝে না এই শব্দটা তার মুখ থেকে শোনার জন্য কতটা ব্যাকুল তাহিরা। সে আলতো সুরে জিজ্ঞেস করে, “আগে কখনো অন্য মেয়েকে বলেছিস?”
“না।”
“তাহলে বলতে পারিস।”
.
.
কবিতার মন ভালো নেই। এই মুহূর্তে তার সাথে গল্প করার মতোও কেউ নেই। তাহিরা পড়ছিলো, আবির বাসায় ছিলো না এবং তাহিরার দাদীর কাছে যাবার সাহস তার নেই। এত কটু কথা বলে সে এর পরিবর্তে কবিতা কিছু বলে দিলে তার আর এইখানে থাকা লাগবে না। এই কারণে কবিতা যথাসম্ভব তাহিরার দাদীর থেকে দূরে থাকে। কাওকে না পেয়ে সে ছাদে যায় কিছু সময় কাটানোর জন্য। ভেবেছিলো ছাদে যেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে সে গান শুনবে এবং শীতল হাওয়ার ছোঁয়া অনুভব করবে।

কবিতা ছাদে উঠে দেখতে পায় ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে তীর্থ। কবিতা গুটিগুটি পায়ে তার পিছনে যেয়ে দাঁড়ায়। উঁচু স্বরে ‘ভাউ’ বলে তাকে ভয় পাওয়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। তীর্থের শান্ত দৃষ্টি দেখে সে মুখ ফুলিয়ে বলে, “একটু ভয় পাবার নাটক করলেও পারতেন।”
তীর্থ কবিতার কথার প্রতিউওরে কিছু না বলায় কবিতা আবারও জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী সারাক্ষণ সিগারেটই খেতে থাকেন?”
তীর্থ হড়বড়ে তার হাতের সিগারেট ফালিয়ে দেয়। তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তীর্থকে দেখে হাসে কবিতা, “আপনি যে সারাক্ষণ গোমড়া মুখ করে থাকেন তাতে আপনাকে একটুও ভালো লাগে না। আপনাকে হাসলে সুন্দর দেখায়।”
“তুমি আমাকে আবার কবে হাসতে দেখলে?”
“যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো। সেদিন খাবারের টেবিলে আপনি ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।”
কথাটা শুনে লজ্জায় পড়ে তীর্থ, “আমি মোটেও তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না।”
“ছিলেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনাকে দোষ দিচ্ছি না আমি দেখতে এতই সুন্দর মানুষ তাকিয়ে না থেকে পারে?”
তীর্থ ফিক করে হেসে দিলো এইবার। কবিতা সাথে সাথে লাফিয়ে বলে উঠে, “এই’যে দেখলেন আমি বলেছিলাম আপনাকে হাসলে অনেক ভালো লাগে। কেউ প্রশংসা করলে পরিবর্তে প্রশংসা করতে হয় আমার প্রশংসা করুন।”
“চেয়ে চেয়ে প্রশংসা নিচ্ছ?”
“হ্যাঁ মেজাজ খারাপ। প্রশংসা শুনে ভালো করার ইচ্ছা আছে।”
“আর মেজাজ কেন খারাপ?”
কবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওই লামিয়া আপু আছে না সে সন্ধ্যায় হাস্পাতাল থেকে ডিসচার্জ হয়। আমি ভেবেছিলাম সে এতকিছুর পর হয়তো তালাক নিবে নিজের স্বামীর কাছ থেকে উল্টো সে সংসার করবে শুনলাম।”
“এতে খারাপ কি হলো?”
“খারাপ কি হলো মানে? এমন পুরুষকে লাত্থি মেরে নিজের জীবন থেকে বের করে দেওয়া উচিত।”
“তাহলে তাদের বাচ্চার কি হবে? তার পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়ার জন্য দুইদিন পর পর আত্নীয় কাছে যেয়ে হাত পাতবে? ওই বাচ্চাটা বাবার ভালোবাসা কখনো পাবে না। তার জীবনের কমতির কথা ভেবেছ একবারও?” তীর্থের কন্ঠ মুহূর্তে রাগান্বিত হয়ে আসছিলো। কবিতা তা ভালো করেই লক্ষ্য করে। তবুও সে শান্ত গলায় উওর দেয়,
“আর বাসায় দুইদিন পর পর যখন ঝগড়া হবে তখন বাচ্চাটার মানসিক চাপ পরবে না? মিদুল যখন বড় হয়ে জানবে যে ওর বাবা কি করে আপনার মনে হয় তখনও তার মনে কোনো প্রকার সম্মান থাকবে নিজের বাবার প্রতি? অথবা ও এটাও ভাবতে পারে কাওকে ধোঁকা দেওয়ার প্রতিদানে ক্ষমা পাওয়া যায়।”
এই কথার প্রতিউওরে তীর্থ কিছুই বলে না। কবিতা আবারও বলে, “আর লামিয়া আপুর নিজের কি সম্মান নেই? অনুভূতি নেই? তার কি? যাই হোক, আপনার আর আমার চিন্তাভাবনা অনেকটা ভিন্ন। আপনি আপনার সিগারেট খেতে থাকেন আমি গেলাম।”

কবিতা যেতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়, “তুমি কী রাগ করেছ?”
“রাগ করব কেন?”
“না, হঠাৎ চলে যাচ্ছ যে?”
কবিতা ফিরে এসে তার আগের স্থানে দাঁড়ায়। গালে হাত রেখে তীর্থের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ও তাহলে আপনি চান না আমি যাই?”
“তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর।”
কবিতা হাসে তীর্থের মুখ থেকে তার প্রশংসা শুনে।
“মেজাজ ভালো করার জন্য প্রশংসা করছেন?”
তীর্থ উওর দিলো না কবিতার কথার। তীর্থ তার দিকে এক পা এগিয়ে এলো তার দৃষ্টি গম্ভীর। সে কবিতার কাছে এসে তার চোখে চোখ রেখে বলে, “আর তোমার চোখ দুটো মায়াবী। সমুদ্রের মতো গভীর ও সুন্দর। তোমার চোখে একবার তাকালে যে কারো এই সমুদ্রে ডুবতে মন চাইবে।”
কবিতার বুকের ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে উঠে। তীর্থের শব্দ থেকে বেশি তার দৃষ্টি তার উপর প্রভাব ফেলেছে। সে আরও অনুভব করছে তীর্থ তার হাত ছাড়ে নি। সে শক্ত করে ধরে রেখেছে তার হাতটা।
গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কবিতার দিকে। সে দৃষ্টিতে কিছু না বলা অনুভূতি লুকানো। কবিতা চেয়েও তার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না।
#মুহূর্তে
পর্ব-১০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

একমাস পর,
ক্লাস শেষে কবিতা ও অনু ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিলো।
কবিতা দেখে তীর্থসহ তার কয়েকটা বন্ধুও ক্যান্টিনে এসেছে। তাদের দেখেই একটি টেবিল খালি করা হয়। আশেপাশের থেকেও অনেকে উঠে যায়। কবিতা বুঝতে পারে না তীর্থদের থেকে সবাই এত ভয় পায় কেন? সে ভার্সিটিতে আসার পর থেকে তীর্থের কোনো খারাপ দিক দেখে নি। টেবিলে বসা তীর্থ কবিতার দিকে তাকায়। কবিতার দিকে তাকাতেই তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এঁকে উঠে। সাথে সাথে কবিতা চোখ সরিয়ে নেয়। এই ছেলেকে হাসলে এত আকর্ষণীয় দেখায় কেন?

কবিতাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে অনু পিছনে তাকিয়ে একপলক তীর্থকে দেখে। তারপর বিরক্তি নিয়ে কবিতাকে বলে, “তোকে না বলেছি ওর থেকে দূরে থাকতে। একদম তাকাবি না ওর দিকে। ভার্সিটিতে সবাই ওকে নিয়ে কত খারাপ কথা বলাবলি করে তুই জানিস না?”
“তো সাথে ভালোও তো বলে। ওইটা তো কানে শুনিস না। অনেকের হেল্প করে। একটু রাজনীতি করে মানছি কিন্তু অন্যদের সাহায্যও তো করে। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের ভর্তির ফি কমিয়ে দিলো আবার মেয়েদেরও কত সম্মান করে। আজ পর্যন্ত অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাতেও দেখি নি।”
অনু কবিতার কথা শুনে আরেকবার পিছনে ফিরে তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনো তোর দিকে তাকিয়ে আছে।”
“কেবল আমার দিকেই তাকায় জান। এখন আমার রূপের জাদু এত বেশি হলে ছেলেটার কী দোষ বল?” কথাটা বলেই হেসে দেয় কবিতা।
“ফাজলামো না। তুই ভুলেও ওর প্রতি দুর্বল হবি না বলে দিলাম। তোর বোন একতো ওই ছ্যাঁচড়ার প্রেমে পড়ে বসে আছে তুই ভুলেও এমন করবি না। আমি মানছি তীর্থ অন্যের সাহায্য করে, ভালো কাজও করে আবার তার নজরও খারাপ না। সব মানছি, কিন্তু সাথে গুন্ডামীও করে। ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও শুনেছি বিশেষ ভালো নয়। তোর বড় ভাই ওর কথা জানলে তোকে আস্ত কবর দিবে। আমার কথা শুন, কথনকে নিয়ে আরেকবার ভাব। তুই ওর মতো সেটেল্ড ছেলে আর পাবি না। সবদিক দিকে ও তোর জন্য বেস্ট। ওর পরিবার ভালো, দেখতেও সুদর্শন, ভবিষ্যত উজ্জ্বল, চিন্তাধারাও তোর মতো, তোর স্বপ্নকেও সাপোর্ট করে। আমি বুঝতে পারছি না তুই ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন?”
“প্রথমত আমি বিয়ের জন্য মানা করি নি, কথন করেছে। আমার মনে হয় উনি নিজের আগের গার্লফ্রেন্ডকেই ভালোবাসে এখনো। আর যেখানে কেউ আমাকে ভালোবাসে না আমি তাকে এই কারণে বিয়ে করতে পারব না যে সে সেটেল্ড। দ্বিতীয়ত আমার মনে তীর্থের জন্য তেমন কোনো অনুভূতি নেই। উনি ধ্রুব ভাইয়ার বন্ধু। প্রায় বাসায় আসে দেখে কথা হয়।”
“প্রায় না প্রতিদিন। তোর কথা এবং কাজে আমি অন্তত মিল খুঁজে পাচ্ছি না।”
“জ্বালানো বন্ধ কর তো।” বিরক্তি নিয়ে বলে কবিতা।
“তুই কথনের সাথে কথা বলে দেখেছিস? একদিন দেখা করার পর তার খবরও নিলি না।”
“উনি খোঁজ নেয় নি। আমি কেন নিব?”
” আমি বুঝি না ছেলেটা সবদিক থেকে ভালো তাহলে তুই তোর ইগো একপাশে রেখে নিজের থেকে তার সাথে কথা বলতে পারিস। ও সব দিক থেকে পার্ফেক্ট।”
“এত ভালো হলে নিজে বিয়ে করে নেয়।”
“দেখ আমার নিজের ক্যারিয়ার অনেক প্রিয়। কিন্তু তোর তো পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই। এইজন্যই বলছি কথনের সাথে বিয়ে করে নিলেই তোর জন্য ভালো হবে।কেন যেন আমার মনে হয় সে তোর স্বপ্নের পথেও তোর পাশে থাকবে।”

এমন সময় টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় পলাশ ও লিমন। তারা এসেই জিজ্ঞেস করে, “ভাবি কেমন আছেন?”
কবিতা থতমত খেয়ে যায় দুইজনের মুখ থেকে ভাবি ডাক শুনে। অনু ধমকের সুরে তাদের জিজ্ঞেস করে, “কে আপনার ভাবি?”
“কবিতা ভাবি ছাড়া আর কে হবে?”
“আপনার কোন ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে শুনি?”
কবিতা টেবিলের উপর কনুই রেখে নিজের গালে হাত দিয়ে বলল, “আরে বাদ দে তো, ভাবি ডাকতে কি ট্যাক্স লাগে না’কি? তাই না ভাইয়া?”
“একদম ঠিক।”
“কিন্তু আমাকে ভাবি ডাকলে গিফট দেওয়া লাগবে। জলদি হাজার টাকা বের করেন। প্রতিবার ভাবি ডাকলে পাঁচশো টাকা। আপনারা দুইবার ডেকেছেন তাই একহাজার টাকা।”
টাকার কথা শুনতেই দুইজনের মুখের রঙ উড়ে যায়। লিমন জোরপূর্বক হেসে বলে, “তীর্থ ভাই মনে হয় ডাকতেছে। আমি যাই।”
লিমন প্রায় দৌড়ে যায়। তার পিছনে দৌড় পলাশও দৌড়ে যেয়ে বলে, “আমাকেও ডাকে।”
“আরে ভাই টাকা তো দিয়ে যান।” কবিতা ও অনু দুইজনে হেসে দেয় তাদের দৌঁড়ে যাওয়া দেখে। তারপর দুইজন বিল দিয়ে উঠে যায়। দরজা থেকে বের হবার পূর্বে কবিতা আরেকবার তাকায় তীর্থের দিকে। তীর্থের দৃষ্টি তার দিকে। কবিতা ক্যান্টিনের দরজা দিয়ে বের হবার পরও শেষবারের মতো পিছিয়ে তাকায় তীর্থের দিকে। এখনো তীর্থের দৃষ্টি তার দিকে আটকানো। কবিতা সেখান থেকেই তীর্থকে ভেঙিয়ে অনুর সাথে চলে যায়।

তীর্থের হাসি আরও গাঢ় হয় কবিতার এমন কান্ড দেখে। এমনভাবে সে শেষ কবে হেসেছিলো তার এইটাও মনে নেই। তার এমন হাসি দেখে লিমন বলে, “ভাই আপনাকে এর আগে এমনভাবে কখনো হাসতে দেখি নাই। ভাবিই তো আপনার এমন হাসির কারণ তারে যাইতে দিবেন না।আজ ভাবির বান্ধবী কইলো ভাবির না’কি বিয়ার কথা চলে।”
কথাটা শুনেই তীর্থ চমকে তাকায় লিমনের দিকে। কিন্তু কিছু বলল না। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কবিতাকে দৃষ্টি দর্শনে দিনটি। বাস হঠাৎ চালু হওয়ায় কবিতা পড়ে যেতে নিয়েছিলো। কবিতা তার কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সামলায়। সেও তাকায় কবিতার দিকে। চোখে চোখ পড়ে। দৃষ্টি মিলন হয়। তার নয়নে আঁকা ছিলো কৃষ্ণবর্ণ কাজল। সোনালী রোদ্দুর তার মুখে এসে পড়ায় তাকে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো সে ওই দুটো নয়নের মতো এমন সুন্দর দৃশ্য আর দেখে নি।

লিমনের কথাটা শুনে তীর্থ নিজের বুকে ব্যাথা অনুভব করে। এমনটা হবার কথা না। কবিতার সাথে তার বেশি সময় কাটে নি। তাদের মাঝে বিশেষ কথাও হয় নি। তবে কেন তার এমন হচ্ছে?

কবিতার মাঝে এমন কিছু আছে যাতে সে নিজেকেও কবিতার জন্য ভুলিয়ে দেয়। যতক্ষণ সে কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকে ততক্ষণ তার মনে কোনো চিন্তা আসে না। তার অতীতের স্মৃতিতে তার বুক ব্যাথা করে না। সে পাড়লে তো কবিতাকে মনের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে যেখান থেকে কেউ তাকে না দেখতে পারবে, না ছুঁতে পারবে। কবিতা শুধু তার হয়ে থাকবে। শুধুই তার।
.
.
কবিতা নিজের ক্লাসরুমে যাওয়ার সময় দেখতে পায় তাহিরাকে। তার সাথে আরেকটা মেয়ে রয়েছে। কবিতা দূর থেকে বুঝতে পারলো না তাদের মাঝে কি কথা হচ্ছে কিন্তু ভালোভাবে কথা হচ্ছে তা মোটেও মনে হলো না। মনে হচ্ছে মেয়েটা তাহিরাকে ধমকাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটা তাহিরার হাত শক্ত করে ধরে নিলো। এই পরিস্থিতি দেখে কবিতা দ্রুত যায় তাহিরার কাছে।
“কী হচ্ছে এইখানে?” কবিতার কন্ঠ শুনতেই মেয়েটা তাহিরার হাত ছেড়ে দেয়। থতমত খেয়ে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। তারপর নিজেকে সামলে তাহিরাকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি ধ্রুবর কাছ থেকে দূরে থাকবে, নাহলে ভালো হবে না।”

কবিতার রাগ উঠে যায়। সে মেয়েটাকে কিছু বলতে নিলেই তাহিরা তার হাত ধরে নেয়। কিছু বলতে দেয় না। তাই কবিতার রাগ ঝরে তাহিরার উপরই, “আপু তোমাকে ধমক দিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তুমি কিছু বলো নি কেন মেয়েটাকে?”
“বাদ দে, অকারণে ঝগড়া করে কি লাভ? মেয়েটা এমনিতেই কষ্টে আছে। আমি উল্টাপাল্টা বললে আরও কষ্ট পাবে।”
“ওই মেয়ের ভাব দেখে তো মনে হয় নি যে ও কষ্টে আছে। তোমার এই গুণই তো আমার সহ্য হয় না। ভালো হওয়া ভালো কিন্তু অতিরিক্ত ভালো হওয়াটা নিজের জন্যই একসময় বিষ হয়ে যায়। দয়া করে তোমার মহান ভাবটা কমাও। আর ধ্রুব ভাইয়াকে নিয়ে কি বলল?”
অনু বলে, “এই মেয়ে না ধ্রুবর গার্লফ্রেন্ড ছিলো কয়দিন আগে?”
“গার্লফ্রেন্ড!” বিস্মিত গলায় বলে কবিতা, “তাহিরা আপু তুমি এই ব্যাপারে জানতে?”
তাহিরা মাথা নামিয়ে নেয়, “আসলে ঠিক গার্লফ্রেন্ড না, ওর সাথে কথা বলতো। ও মনে করেছে ধ্রুব ওকে পছন্দ করে। গত একমাস ধরে কথা বন্ধ করার কারণে ও ভাবছে আমার কারণে এমনটা হয়েছে।”
“আর এইটা কি সত্যি?”
তাহিরার গালদুটো হঠাৎ-ই গোলাপি আভায় ঢেকে যায়, “জানি না।”
অনু ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আপনারা দুই বোন একরকম। কথা আর ভাবে কোনো মিল নেই। বিশ্বাস করেন আপনাদের একজনের পছন্দও ভালো না।”

কবিতা অনুকে কিছু বলতে নিবে এর পূর্বেই ফোন বেজে উঠে তার। ব্যাগ থেকে কবিতা ফোন বের করে দেখে আননোওন নাম্বার। কবিতা কল ধরে জিজ্ঞেস করে, “হ্যালো, কে?”
“বিনা মগজের মেয়ে বলছেন?”
কবিতা চোখ বন্ধ করে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে, “আর আপনি কি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হওয়া পার্টি বলছেন?”
“মিস আমার শার্টে পানি ফেলার কন্টেক্টওয়ালি আপনি দয়া করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে আসুন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“আর মিস্টার পাগলের ডাক্তার, আপনি আমার জন্য অপেক্ষা কেন করছেন?”
“মিস ক্ষুধা লাগছে, কারণ আপনি আমার বাসায় যাচ্ছেন। আপনার ভাই বলে নি?”
কবিতা অবাক হয়ে বলে, “ভাইয়া? কোথায় না-তো।”
“নিচে আসুন। আমি দাঁড়িয়ে আছি।”
“আমার ক্লাস আছে।”
“আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি জীবনে বইয়ের দিকে ভালো নজরে তাকাইসেন। ক্লাস মিস দেওয়ার বাহানা দিচ্ছি। চাইলে জলদি আসো, নাহলে আমি গেলাম। তারপর তোমার কবির ভাইকে বলো তুমি ক্লাস করছিলে।”

কবিতার উওর না শুনেই কথন কল কেটে দেয়। কবিতা বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহিরা ও অনুর দিকে তাকায়। দেখে দুইজনেরই ভূত দেখার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনু জিজ্ঞেস করে, “কোন এলিয়েনের সাথে কথা বলছিলি তুই?”
“কথন নামক এলিয়েনের সাথে কথা বলছিলাম সে না’কি নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমার যেতে হবে। তুই ধ্রুব ভাইয়াকে নিয়ে তোর সম্পূর্ণ ভাষণ তাহিরা আপুকে শোনা। আমি গেলাম।”
“আরে কিন্তু ক্লাস আছে তো।”
কবিতা কোনো কথা শুনল না। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।

কবিতার যাবার পর তীর্থ এবং তার সাথীরাও ক্যান্টিনে থাকে না। তারা এসে পড়ে তাদের আড্ডার জায়গায়। ভার্সিটির বাহিরেই একটি চা’য়ের দোকান আছে। সেখানেই প্রতিদিন তাদের আড্ডা বসে। তীর্থ আবারও একটি সিগারেট মুখে দিতে নিয়েও থেমে যায়। সামনে থেকে কবিতাকে আসতে দেখে হাতের সিগারেট হাত থেকে ফেলে দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়। সে ভাবে কবিতা তার সাথেই কথা বলতে এসেছে। তার এমনটা ভাবার বিশেষ কারণ নেই। হঠাৎ তার এমনটা মনে হলো। কিন্তু তার ভাবনাটা সত্যি হলো না। কবিতা তার দিকে একটিবার তাকালও না। তার ঠিক পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

তীর্থ পিছনে ফিরে দেখে কবিতা একটি গাড়ি সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির সাথে কিছু কথা বলে। লোকটা দেখতে সুদর্শন। পরিপাটি মনে হচ্ছে তাকে। এই লোকটার সাথেই কি কবিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভাবতেই কেমন যেন বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে তার। সাথে সাথে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার মনে হয় ওই পরিপাটি লোকটার সাথেই কবিতাকে মানায়, তার মতো এলোমেলো মানুষের সাথে নয়।

কবিতা কথনের সামনে দাঁড়িয়েই বকা দেয়, “কেউ এভাবে ফোন কাটে? আমার কথা তো সম্পূর্ণ শুনবেন না’কি? মাথায় কি আক্কেল নামক কিছু আছে?”
কথন কবিতার কথাগুলো না শোনার ভাব করে যেয়ে গাড়িতে উঠে বসে এবং কবিতাকেও বলে উঠে বসতে। কবিতা না চাওয়া সত্ত্বেও গাড়িতে উঠে। কথন কবিতার হাতে একটি প্যাকেট দিয়ে বলে, “খেয়ে নেও।”
“কী এটা?”
“পেস্ট্রি ও ডোনাট।”
“ওয়াও আমার ফেভারিট। আমি ভাবিনি আপনি আমার জন্য এগুলো আনবেন। যত ভেবেছি এত খারাপও আপনি না।”
“তুমি দুই মিনিট পর পর ক্ষুধা লাগছে ক্ষুধা লাগছে করবে, তাই আমার কান যেন ঝালাপালা না হয়ে যায় এইজন্য আনলাম।”
কবিতা মুখ বানায় কথাটা শুনে, “যাই হোক আজ হঠাৎ নিতে আসলেন যে?”
“মা তোমাকে দেখতে চাইলো। সাথে ঘরও দেখাতে চাইলো। বিয়ের আগে তোমার শশুড়বাড়ি দেখা প্রয়োজন তাই না?”
কবিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় কথনের কথা শুনে, “বিয়ে? কার বিয়ে? আপনি না বিয়ের জন্য মানা করে দিবেন?”
কথন গাড়ি চালাতে শুরু করতে নিলেই তার চোখ যায় কবিতার উপর। সে সিটবেল্ট পড়ে নি। কথন জিজ্ঞেস করে, “সিটবেল্ট পড়তে পারো না?”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উওর দেয়। কথন উঠে কবিতার সিটবেল্ট লাগাতে যায়।

“করছেনটা কী?” কবিতার প্রশ্ন শুনে কথন তাকাল তার দিকে। মেয়েটার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। সাথে মিশ্রিত লাজুকতা। সে খেয়াল করে নি কিন্তু কবিতার কাছে এসে পড়েছে সে। কবিতার কথায় যখন সে তার দিকে তাকায় তখন সে কবিতার মুখোমুখি। প্রথম শুভ দৃষ্টিমিলনের মুহূর্ত এলো। দৃষ্টিমিলনের পরের মুহূর্তেই কবিতা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তার চোখের পলকগুলো কী ঘন! তার ফর্সা মুখটায় লুকানো আছে লালচে আভা। কবিতার চোখ, নাক গড়িয়ে কথনের দৃষ্টি আটকায় কবিতার ঠোঁটে। কবিতার ঠোঁটজোড়া দেখে তার মনে হলো কোনো শিল্পী এঁকেছে এই ঠোঁটজোড়া। তাও এতটা নিখুঁতভাবে!

চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here