#মুহূর্তে
পর্ব-১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কৃষ্ণাঙ্গ আকাশ। আকাশের কালো মেঘের রাজ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। কবিতার মনে হলো আকাশও আজ দুঃখ ঝরাতে চাইছে এই পৃথিবীর বুকেতে। সে সবে গিয়েছিল ধ্রুবর রুমে খাবারের প্লেট দিয়ে আসতে। সেখানে যেয়ে খুবই বাজে অবস্থায় দেখল সে ধ্রুবকে। নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছিলো তাকে। তার নিজের বুকের ভেতরই কেঁপে উঠে। সে মাঝেমধ্যে চিন্তা করে তাহিরা আপু এতবছর একা নিজেকে কীভাবে সামলেছে? সে-তো আপন কাউকে হারানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।
কারও আসার আভাস পেয়ে একটু চমকাল। সে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় তীর্থকে। তড়িঘড়ি করে বলে, “ওহ আপনি… আপনি সম্ভবত সিগারেট খাবেন। আমি যাই তাহলে।”
কবিতা যেতে নিলেই তার হাত ধরে নেয় তীর্থ, “তুমি কী আমার থেকে ভয় পাচ্ছ কবিতা?”
“না…না তো। ভয় পাব কেন?”
তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতার হাত ছেড়ে দিলো। তার দুইহাত পকেটে ভরে বলল, “তুমি আমার কাছ থেকে ভয় পাচ্ছ। স্বাভাবিক। ওদিন তুমি যা দেখলে তারপর তোমার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমি কখনো তোমাকে আমার এই জীবন দেখাতে চাই নি কবিতা। আমি কখনো তোমাকে আমার জীবনে স্থানই দিতে চাই নি। আমার আঁধারের রাজ্যে তুমি সেই উজ্জ্বল গোলাপ যাকে আমি ছুঁলে তাও ধ্বংস হয়ে যাবে। যা আমি চাই না।”
কথাগুলো শুনে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে কবিতার। সে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। কিন্তু তীর্থের দৃষ্টি তার দিকে নেই। সে তার সাথে দৃষ্টি মিলাচ্ছে না। আচমকায় তীর্থ তার কাঁধে মাথা রাখে কিন্তু হাত দিয়ে তাকে ছোঁয় না। সে কাঁপানো গলায় বলে, “কিন্তু তবুও আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি কবিতা। আমি ভুলে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।”
কবিতার বুকের বা পাশটায় তীব্র যন্ত্রণা হলো এক মুহূর্তের জন্য। পরের মুহূর্তেই শান্তি ছেয়ে গেল তার প্রতিটি অঙ্গে অঙ্গে।
তীর্থ তার কথা বলতে থাকে, “ছোটবেলায় আমার বাবা বিদেশে চলে গিয়েছিলো। ক’বছর পর শুনলাম সেখানে অন্য বিয়ে করেছে সে। আর খোঁজ পাই নি তার। মা তার আত্নীয়দের কাছে হাত পেতে আমাকে খাইয়েছে, পড়িয়েছে, মানুষ করেছে। ছোট থেকেই আমার মা’কে অন্যের সামনে হাত পাততে দেখেছি আমি। অপমান হতে দেখেছিলাম। বড় হবার পর একটি সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। একদিন এত টাকা আয় করব যেন কখনোই টাকার অভাব না হয়। এই নিষ্ঠুর জগৎ দেখেছি ছোট থেকেই। পড়াশোনার জন্য মা’য়ের কাছ থেকে আলাদা থাকতে হতো। এমনও দিন কাটিয়েছি যে টানা দুইদিন না খেয়ে পড়াশোনা করেছি। চাকরির চেষ্টাও করেছি। কিছু হয় নি। পড়ার খরচও চালাতে পারতাম না। তারপর চোখের সামনে যে সহজ রাস্তা পেয়েছি তাই গ্রহণ করেছি। এই পৃথিবীতে কেউ-ই ইচ্ছা করে নিজের জীবনটাকে অন্ধকার বানায় না কবিতা।” কিছুক্ষণের বিরতি নেয় তীর্থ। আবার বলে, “জানো, এই কথাগুলো আজ পর্যন্ত কাউকে আমি বলি নি। তুমিই প্রথম। কেন যেন এই পৃথিবীর কাউকে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করে না, তোমাকে ছাড়া। ভালো লাগে না তোমাকে ছাড়া। তোমাকে ছাড়া এই পৃথিবীটাই ভালো লাগে না। আমি কেবল তোমার মাঝে নিজের সুখটা খুঁজে পাই। তোমাকে দেখা ছাড়া এই চারটাদিন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আজব লাগে। এতগুলো বছর যাদের সাথে কাটিয়েছি তাদের জন্যও এমন অনুভূতি হয় নি। তুমিবিহীন আমার জীবনটা শূন্য হয়ে পড়েছে। কী করব আমি? কীভাবে থাকব আমি?”
কথাগুলো শুনে কবিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তীর্থ কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি জানি তোমাকে ভালোবাসার অনুমতিটা আমার নেই, কিন্তু তুমি আমার জীবনের কবিতা সূচনা ও অন্ত তুমি হয়ে পড়েছ। আমার জীবন এখন তোমার থেকে শুরু এবং তোমাতেই শেষ।
কীভাবে এই অনুভূতির বিসর্জন দিতে হয় তা আমার জানা নেই।”
কবিতা আলতো করে তীর্থের শার্টের হাতাটি ধরে। চোখ নামিয়ে কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি ভালোবাসেন?”
“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য।”
“আমার জন্য কী করতে পারবেন?”
“সব।”
এইবার কবিতা তাকাল তীর্থের দৃষ্টিতে, “শুনেছিলাম কাউকে পরিবর্তন করে ভালোবাসা যায় না। কিন্তু আমার মতে ভালোবাসলে, ভালোবাসার মানুষটার খারাপ অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করা আপনার দায়িত্ব হয়। আমাকে আপনার জীবনে পেতে হলে মারামারি বন্ধ করতে হবে, আস্তে-ধীরে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে, অন্যকোনো খারাপ অভ্যাস থাকলে তাও ছাড়তে হবে, কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙতে পারবেন না, আমাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারবেন না, যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতি ছাড়তে হবে। আপনি এর পরিবর্তে টিউশনি করতে পারেন অথবা কোনো ব্যবসা। আমি একটা কথা বলে রাখি, আমার ভাই পুলিশ। আমি আমার পরিবারের আদরের। কোনো গুন্ডামি করে এমন ছেলের হাতে আমাকে তুলে দিবে না। আর আমি আপনার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াব না, একবারে বিয়ে করব। আপনি কী এখনো রাজি?”
তীর্থ হতদম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো কবিতার দিকে, “তুমি আমাকে ভালোবাসো?”
“ভালো কীভাবে বাসে তা আমি জানি না। কিন্তু আপনাকে ভালো লাগে। অতিরিক্ত ভালো লাগে। আপনার জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকে। আপনার হাসি দেখতে ভালো লাগে, আপনার সাথে সময় কাটাতেও ভালো লাগে, কথা বলতে ভালো লাগে। সবটা ভালো লাগে।”
তীর্থ শক্ত করে ধরে কবিতার হাতটা। একগাল হাসে সে। তার ঠোঁটের কোণে এত গাঢ় হাসি আর কখনো দেখে নি। তার মনে হলো কোনো পুরুষের এত সুন্দর হাসির দর্শনও সে আর কখনো করে নি। সে জিজ্ঞেস করে, “সবটা পারবেন তো? আমি অহেতুক আপনার ও আমার অনুভূতি নিয়ে খেলতে চাই না।”
“পারব। তোমার জন্য আমি সব পারব।”
“আপনার প্রেমিকাকে ছাড়তে পারবেন?”
তীর্থ হতদম্ব, “আমার প্রেমিকা?”
কবিতা হাসে, “তো কি? আপনার সিগারেট। যখনই আপনাকে দেখি আপনার ঠোঁটে সিগারেট থাকবেই। এই নেশা ছাড়তে পারবেন?”
তীর্থ এক কদম এগিয়ে এলো কবিতার দিকে। তার গালে হাত রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল তার চোখে এবং বলল, “তোমার নেশার কাছে এই পৃথিবীর সকল নেশা তুচ্ছ।”
শিউরে ওঠে কবিতা। তার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে। সে মাথা নামিয়ে নেয়। লজ্জায় মেখে যায় সে। তার ঠোঁটের কোণে এঁকে উঠে লজ্জামাখা এক হাসি। তীর্থ অনুমতি চায়, “আমি কী একটিবার তোমায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি?”
“জ্বি না, একেবারে বিয়ের পর।”
.
.
চার মাস পর,
“ভাইয়া হঠাৎ করে বললেই হলো? আমার ভার্সিটি নেই না’কি? আমাকে কি পেয়েছ তোমরা? তোমরা বলবে আর আমি সব ছেড়ে বিয়ে করে নিব?” বিরক্ত নিয়ে বলে কবিতা। ফোনের ওপাশ থেকে তার বড় ভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো, “তুমি কি করবে না করবে তার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি। আগামী মাসে কথনের আমেরিকা যাওয়ার ডেট। তাই এই শুক্রবারই তোমাদের বিয়ে দিতে হবে। একমাস ঘুরাঘুরি করে নিবে। ও চলে যাওয়ার কয়েকমাসের মধ্যে তোমাকেও নিয়ে যাবে। সেখানে তোমার যা মন চায় করো। আপাতত তুমি আমার দায়িত্ব এবং আমি তোমার অভিভাবক। আমি যা বলব তোমার তাই করতে হবে।”
রাগে কটমট করে কবিতা জিজ্ঞেস করে, “বিয়ের কথা কী কথন জানে?”
“তো ওর বিয়ে ও জানবে না? পুরুষ মানুষ, ওর অনুমতি ছাড়া তো বিয়ে দিতে পারবে না ওকে। আগামীকাল আবির তোমাকে নিতে আসছে। বেশ কয়েকদিনের ছুটির আবেদন করে এসো ক্লাসে।”
“জ্বি।”
ফোনটা রাখার পরই রাগে কবিতা কল দেয় কথনকে। পেয়েছে কি লোকটা তাকে? যখন যা মন চায় তার সাথে তাই করবে? ক’দিন আগে তার এক্স-গার্লফ্রেন্ড এসে তাক কথা শুনিয়ে গিয়েছিল। তাও অহেতুক। আর এখন আবার এই নাটক। তাকে কি ভেবে রেখেছে যখন যা মন চাইবে তাই করবে তার জীবনের সাথে? এত সোজা?
কথন একটাও কল ধরলো না। কতক্ষণ পর মেসেজ এলো কথনের, “আমি হাস্পাতালে আছি, কাল সকালেই তোমাকে কল দিচ্ছি।”
কবিতাও মেসেজের রিপ্লাই দেয়, “কল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আগামীকাল কাল বিকেল চারটায় আমার সাথে দেখা করবেন। আপনার যা কাজই থাকুক এডজাস্ট করে নিবেন। তাও দেখা করবেন আমার সাথে। জরুরি কথা আছে। দুপুরের মাঝে এড্রেস পাঠিয়ে দিব।”
কবিতার বেশ অশান্তি লাগছিলো। ভয়ে তার বুকটা কাঁপছিল। সে রুমে পায়চারি করতে শুরু করে কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। বুকের ভেতরের সে অশান্ত ঝড় কোনোমতে শান্ত হয় না। অবশেষে সে কল দেয় তীর্থকে। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে তীর্থ বলে, “তুমি না ঘুমাবে বলে কলটা রাখলে একটু আগে। ঘুমাও নি এখনো?”
“তী…তীর্থ!” গলাটা কেঁপে উঠে কবিতার। সে নিজেও কাঁপছিলো। ফোনের ওপাশ থেকে অশান্ত গলা শোনা যায়, “কী হলো কবিতা? তোমার কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো?”
“আমার খুব অশান্ত লাগছে। বড় ভাইয়া কল করেছিলো। উনি বলেছে…. ” এইটুকু বলে থেমে যায় কবিতা। তীর্থ অশান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী বলছে?”
“বলেছে যে….বলেছে যে এই শুক্রবার আমার বিয়ে দিবে কথনের সাথে। আর পাঁচদিন পর।”
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। কবিতাও কিছু বলল না। নিরবচ্ছিন্ন কাটলো কিছু মুহূর্ত। কিছুসময় পর তীর্থ বলে, “কথন তো তোমাকে বিয়ে করবে না বলল।”
“ওইটাই তো। আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।”
“তোমাকে আমি অন্যকারো হতে দিব না। তুমি বলায় আমি মারামারি সব ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু যদি প্রশ্ন তোমার উপর আসে আমি নিজেকে সামলাতে পারব না।”
“খবরদার তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। আর উনাকে তো একটুও না। আমি আগামীকাল উনার সাথে যেয়ে কথা বলব।” কবিতা কঠিন গলায় বলে।
তীর্থের কন্ঠ বেশ রাগী শোনা যায়, “তাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা কেন আমি বুঝি না।”
“কারণ সে সবকিছুতে সবসময় সাপোর্ট করেছে। আর তার পরিবার আমাকে অনেক আদরও করে।”
“তোমাকে এত সাপোর্ট করলে তাহলে আমাদের কথা তাকে জানালেই পারতে। অন্তত তখন আর তোমাকে বারবার দেখা করতে বলতো না।’ ঝাঁজালো গলায় বলে তীর্থ।
কবিতা খিলখিলিয়ে হেসে দিলো, “বুঝলাম। কেউ জেলাস ফিল করছে।”
“আমি? একদমই না।”
“জ্বি, একদম। তোমার হিংসা হচ্ছে। আর উনাকে না জানানোর কারণ আগেই বলেছি। আমি চাই নি ভাইয়া কোনোভাবে আমাদের ব্যাপারে জানুক। ক’মাস হলো তোমরা সবাই এই রাজনীতির ঝামেলা থেকে বের হয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করলে। আমি তো ভেবেছিলাম যে আরও কয়বছর গেলে ভাইয়াকে ব্যাপারটা জানাব। কিন্তু এত বড় ঝামেলায় পড়ব কে জানতো।”
আরও কিছু সময় কাটে। তীর্থ কিছুসময় কোনো কথা বলে না। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আমি কী তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলব?”
“পাগল তুমি? তোমার হিস্ট্রি জানলে আমাকে খুন করে ফেলবে। আমি আগে কথনের সাথে কথা বলে দেখি। কাল আবির ভাইয়া এসে সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে যাবে। এর আগে উনার সাথে কথা বলে যাব।”
“কালই চলে যাবে?” কেমন উদাস শুনাল তীর্থর কন্ঠ।
“চিন্তা করো না। ফিরে তোমার কাছেই আসব।”
“আমি ফোন কাটছি। তুমি এখনই ঘুমিয়ে পড়বে না।”
“কিন্তু…. ” কবিতা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তীর্থ ফোন কেটে দেয়। সে বুঝতে পারে না হঠাৎ করে এমন ভাবে ফোন কাটার মানেটা কি? এর উপর থেকে ঘুমাতেও মানা করে দিলো। সে করবেটা কি?
ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক বাইশ মিনিট পর কল আসে তীর্থের। সে কল করে বলে কবিতাকে বারান্দায় আসতে। বারান্দায় এসে দেখে লিমন, পলাশ ও তীর্থ তাদের বাড়িরের রাস্তার অপর পাড়ে দাঁড়ানো। সেখানে একটি বড় হলুদ রঙের দেয়ালে লাল রঙ দিয়ে লেখা, “একটু হাসো দেখি।”
কবিতা লেখাটি দেখে সাথে সাথে হেসে দিলো। তার মনে হলো।এই মানুষটাকে নিজের জন্য বাছাই করে জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে সে। মাঝেমধ্যে তীর্থের এমন পাগলামি দেখে নিজেকে কোনো রাজ্যের রাণী মনে হয় তার। অবশ্য তীর্থের রাজ্যের রাণীই। যাকে বিশেষ অনুভব করানোর জন্য সব করতে পারে তীর্থ।
গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো সে তীর্থের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে এখনও সে রাজ্য জয়ের হাসি। ফোনটা বেজে উঠে তার। তীর্থের কল। কবিতা ফোনটি রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে তাকায় তীর্থের দিকে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে সে কবিতার দিকে। কী গভীর দৃষ্টি! সে অপলক কবিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ভালোবাসি।”
কবিতা কেবল হেসে বলে, “পাগল!”
.
.
পরেরদিন কবিতা আর ভার্সিটিতে যায় না। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে দুপুর হয়ে যায় তার। বিকেল চারটায় কথনের সাথে দেখা করার কথা। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে রওনা দেয় দেখা করার জন্য। আবির ভাইয়ার বাসায় আসার আগে তার দেখা করে ফিরে আসতে হবে। সময়মতোই পৌঁছাল সে। যেয়ে দেখে কথন আগে থেকে বসে কফি খাচ্ছে। তার হাতে একটি কালো মলাটের ডায়েরি। কবিতা টেবিলের সামনে যেতেই টেবিলে শব্দ করে হাত মেরে বলল, “আপনার সমস্যা কী হ্যাঁ? বিয়েকে ফাজলামো পেয়েছেন? একবার বললেন করবেন না, আর এখন এক সাপ্তাহে বিয়ে! এইসবের মানেটা কী?”
কথন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি কবিতার দিকে। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে ছিল। কবিতার কথা শুনে সোজা হয়ে বসে বলল, “আরে এত হাইপার হচ্ছো কেন তুমি?”
“হাইপার হচ্ছি কেন মানে? আপনি ঝট করে বিয়ে করতে চাইবেন, আর আমি এইখানে এসে আপনার সামনে খুশিতে নাচবো। এই ভেবেছিলেন?”
“মাথা ঠান্ডা করো আগে। মনে হচ্ছে এখনই বোম্বের মতো ঠাসঠুস ফুটে যাবে।”
“রসিকতা করবেন না বলে দিলাম।”
কথন উঠে কবিতাকে চেয়ারে বসিয়ে। ওয়েটারকে ডেকে কবিতার জন্য একটি কোল্ড কফির অর্ডার দেয়।
তারপর নিজের চেয়ারে বসে বলে, “আর শুনো বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি না, আমাদের পরিবার নিয়েছে।”
“আপনি বিয়ের জন্য না করলে আপনার পরিবার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে?”
“আমি বিয়ের জন্য না করি নি। আরও কয়েকবছর পর করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু মা জেদ করলো তাই আর না করি নি। তোমার ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার জন্য আমেরিকায় কয়টা ভালো জায়গাও বাছাই করেছি। কিন্তু যাবার আগে জেবা আপু শর্ত দিয়েছে তুমি তাকে কয়টা জামার ডিজাইন বানিয়ে দিয়ে যাবে। তোমার ডিজাইনগুলো তার অতিরিক্ত পছন্দ। ওহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এইটা তোমার জন্য। ” কথন তার হাতের কালো ডায়েরিটা এগিয়ে দেয় কবিতার দিকে। কবিতার দৃষ্টি শীতল। সে হাত বাড়িয়ে কথনের দেওয়া উপহারটা গ্রহণও করর না। কেবল জিজ্ঞেস করে, “আপনি নিজে আমাকে বলেছিলেন এই ছয়মাস আমরা স্বাভাবিকভাবে কাটাব এবং আপনি বিদেশে যাবার আগে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিবেন। আপনার কথার কী হলো? আর আপনার ক্যারিয়ারের কি হলো?”
কথনের মুখের রঙ উড়ে যায়। সে তার হাতের ডায়েরিটা টেবিলে রেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে, “আমি তোমাকে যতটা চিনি তুমি আমার ক্যারিয়ারে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না এটা আমার বিশ্বাস। আর আমার পরিবারের সবাইও তোমায় অনেক পছন্দ করে। আমি ভেবেছি যেহেতু আমরা একে অপরের সাথে কমফোর্টেবল তাই…..”
“আপনি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন?”
“আমি ভেবেছি তুমিও আমার সাথে বেশ স্বস্তি অনুভব করো। আমি তোমার কাছে একটা ভালো বন্ধু। আর তুমি আমার পরিবারকেও অনেক পছন্দ করো। ”
“হ্যাঁ এইটা সত্য যে আমি আপনার সাথে অনেক কমফোর্টেবল ফিল করি, আপনার পরিবারও আমার অনেক পছন্দের, এমনকি আপনি নিজেও অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমি আপনার সাথে বিয়ে করতে পারব না।”
“তোমার কি এখন বিয়ে বিয়ে করতে সমস্যা?”
“আমার আপনার সাথে বিয়ে করতে সমস্যা। আপনি কেন আমার অন্য যেকোনো ছেলের সাথে বিয়ে করতে সমস্যা। আমি তীর্থকে ভালোবাসি এবং ওকেই বিয়ে করব।”
#মুহূর্তে
পর্ব-১৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আমার আপনার সাথে বিয়ে করতে সমস্যা। আপনি কেন আমার অন্য যেকোনো ছেলের সাথে বিয়ে করতে সমস্যা। আমি তীর্থকে ভালোবাসি এবং ওকেই বিয়ে করব।”
কথাটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো কথনের। তাকে কিছুটা অপ্রসন্ন দেখায়। তবুও সে একগাল হেসে বলে, “ওহ গ্রেট! আমি জানতাম না যে তুমি অন্যকাওকে ভালোবাসো, নাহয় বিয়ের কথা বলতাম না। আমার দুইটা লাভবার্ডের মধ্যে থার্ড পারসোন হবার ইচ্ছা নেই। তো শিল্পা আন্টির মৃত্যুর সময় ধ্রুবর যে ফ্রেন্ড তীর্থের সাথে দেখা হলো তার কথা বলছ?”
কবিতা শান্তির নিশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে সে শান্তি পেল। আবার খারাপও লাগলো। কথনকে ভুল বুঝে এমন ব্যবহার করা উচিত হয় নি তার। কবিতা একগাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেই তীর্থই। আর সরি আমি ভুল ভেবে কি না বলে গেলাম আপনাকে।”
“ডোন্ট ওয়ারি। আমি বিনা মগজের মেয়ের থেকে এইটাই আশা করতেই পারি। কিন্তু আমায় আগে এটা বলো তীর্থ কী জানে যে তোমার মাথায় সমস্যা আছে? আই মিন একটাও স্ক্রু নাই তোমার মাথায়।”
“হা হা অনেক ফানি জোক ছিলো তাই না? জোক অফ দ্যা ইয়ার এওয়ার্ড লাগবে আপনার?” কবিতা একপ্রকার ভেঙিয়ে বলে কথনকে। কথন হাসার চেষ্টা করে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, “তুমি বসো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
কথন যেতেই কবিতা কল দেয় তীর্থকে। কল ধরতেই উৎসুক গলায় বলে, “জানো কথন তো এককথাতেই রাজি। সে বলল ভুলেও আমাদের মাঝে আসবে না।”
“বলো কি!” অবিশ্বাস্য শোনাল তীর্থকে, “আমি তো ভেবেছি ও তোমাকে পছন্দ করে। এত সহজে ব্যাপারটা যেতে দিবে আমি জানতাম না।”
“যতসব আজেবাজে ভাবনা তোমার। তোমাকে বলেছিলাম না উনি অনেক ভালো। তুমিই অকারণে বেশি চিন্তা করতে।”
“তাই তো দেখছি। আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ে খারিজে রাজি না হলে আমি এসে তাকে আমার মতো করে রাজি করাব।”
“তোমাকে বলেছি না এইসব ভাবতেও আসবে না। আচ্ছা আপাতত ফোন রাখি, বাসায় যেয়ে কল দিচ্ছি তোমায়।”
কবিতা ফোন রেখে দেয়। তীর্থকে সে দোষ দেয় না। একসময় তারও মনে হয়েছিল কথন তাকে ভালোবাসে। কিন্তু এর মাঝে তাদের মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যা তাকে মানতে বাধ্য করে কথনের মনে তার প্রতি ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি নেই। আর এই ব্যাপারটা তার জন্য স্বস্তির।
কবিতার চোখ যায় টেবিলে রাখা কালো ডায়েরির দিকে।
“এক শুভ্র সকালে রূপকথার গল্প শুনাই তোমায়
মায়াভবনের মায়াবিনী তার নাম,
তার নয়নজোড়া এক ছন্দ
তার হাসি মানেই চারপাশে মেতে উঠে আনন্দ
পবিত্র তার অন্তর
তাকে ছোঁয়ার আমার নেই কোনো সাধ্য।
রূপকথার রাজ্যের প্রিয়তমা সে
তার চক্ষু….. ”
কবিতা মনোযোগ সহকারে ছন্দটা পড়ছিলো। হঠাৎ করেই তার হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে নেওয়া হলো। সে চোখ তুলে কথনের দিকে তাকায়। কথন চেয়ারে বসতে বসতে বলে, “অন্যের ডায়েরি অনুমতি ছাড়া পড়তে নেই।”
“এই ডায়েরিটা না একটু আগে আমাকে দিলেন? তাহলে এইটা আমার না?”
“জ্বি না, আমার হবু বউয়ের জন্য। ডায়েরি পড়লে কিন্তু বিয়ে করতে হবে।”
“না না থাক, আপনার ডায়েরি আপনার কাছেই থাকে।”
কথন হেসে দেয়।
“আপনি ঠিক বিয়ের জন্য মানা করে দিবেন তো?”
“দিব। কিন্তু একটা শর্ত আছে?”
একটু ঘাবড়ে যায় কবিতা। কথন আবার কী শর্ত দিতে চায়? এই না সে বলল কবিতা এবং তীর্থের মাঝে ভুলেও আসবে না। কবিতা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার বিয়েতে মানা করার জন্য কী শর্ত থাকতে পারে?”
“যে তুমি বিয়ের পর তোমার স্বপ্ন পূরণ করবে। তোমার স্বপ্নের পথে চলবে। আমেরিকা থেকে আসার পর কখনো দেখা হলে আমি তোমাকে সাফল্য দেখতে চাই।”
কবিতা হাফ ছেড়ে বাঁচে। সাথে খুশিও হয়। এতকিছুর পরেও কথন তার চিন্তা করছে? মানুষটা আসলে এতটা ভালো?
কবিতা একগাল হাসে, “আপনার শর্তে আমি রাজি জাহাপণা।”
কথন উঠে দাঁড়ায়, “আজ তাহলে আসি। কাজ আছে।”
“হঠাৎ করে? এতক্ষণ তো বললেন না।”
“মাত্র মনে পড়ল।”
“আমিও উঠি তাহলে।”
“তুমি আস্তে-ধীরে তোমার কফি শেষ করে উঠো। সম্ভবত আমাদের আর দেখা হবে না। শেষ বিদায় নিচ্ছি।”
কথন কথাটি বলার সময় কেমন করে চাইলো কবিতার দিকে। কবিতা সে মুহূর্তে অনেক খুশি ছিলো। কিন্তু কথাটা শোনার পর তার মন উদাসীন হয়ে যায়। কথনের প্রতি তার বিশেষ কোনো অনুভূতি না থাকলেও সে কবিতার ভালো বন্ধুর মতো।সে মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে কেন বলছেন? আপনার যাওয়ার তো সময় বাকি এখনো।”
” ভাবছি বিদেশে যাবার পূর্বে বাংলাদেশের একটা ট্যুর নেওয়া যাক। বাই দ্যা ওয়ে, পাগলের ডাক্তারের কার্ডটা কিন্তু এখনো আমার কাছে আছে। চাইলে নিতে পারো, নাহয় তীর্থকে দিয়ে যাব। তোমার সাথে থাকলে ওর ভবিষ্যতে লাগতে পারে।”
কথাটা শুনতেই মুখ ফুলিয়ে নেয় কবিতা। কথন হেসে কবিতার গাল টেনে বলল, “আজ রাতেই আমার পরিবারের সাথে বিয়ে নিয়ে কথা বলছি। তুমি সুখী থেকো কেমন? আর খবরদার কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে সুন্দর দেখায় না। মুখটা আলুর মতো লাগে।”
“আমার সাথে নরমালি কথা বলতে আপনার এলার্জি আছে তাই না? পৃথিবীর সবার সাথে কত সুন্দরভাবে কথা বলেন, আমার বেলা আসতেই আপনার আজগুবি কথা শুরু হয়ে যায়।”
কথন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “গেলাম কবিতা। ভালো থেকো।”
কথন ড্রাইভ করছিলো। ক্যাফে থেকে বের হয়েই সে ড্রাইভিং শুরু করেছিলো। আর থামে নি। প্রায় একঘন্টা হতে এলো। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সে জানে না। কেবল অশান্তি লাগছে তার। ভীষণ অশান্তি। বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। এমনটা আগে হয় নি। তার মনে হলো তার চোখ ভিজে গেছে। আবারও। কিছু সময় আগে কবিতার সামনেও তার চোখ নম্র হয়ে এসেছিলো। কবিতাকে তা সে বুঝতে দেয় নি। ওয়াশরুমে যেয়ে চোখেমুখে পানি দিলো। তবুও আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে যখন তার মনে পড়ে কবিতার কথা অবাধ্য চোখদুটো আপনা-আপনি পানি ঝরায়।
কথন রাস্তার একপাশে গাড়ি থামায়। তার পাশের সিট থেকে কালো ডায়েরিটা হাতে নেয়। প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কবিতা লেখা। কিছু পৃষ্ঠা উল্টায় সে। নজর বুলায়। এক নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় এসে থামে সে। একটি নির্দিষ্ট বাক্যই বারবার পড়ে। বহুবার পড়ে।
“ভালোবাসি কবিতা। খুব ভালোবাসি তোমায়। তুমিও কী আমাকে একটুখানি ভালোবাসবে?”
হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে কথনের। এ কয়েকমাসে কীভাবে কবিতার প্রতিটি স্বভাব তাকে মোহে ডুবিয়ে দিলো সে বুঝতেই পারে নি। নিজ অজান্তেই ভালোবেসে ফেলল তাকে। বহুবার নিজেকে আটকানোর সত্ত্বেও। কবিতা বলেছিল তাকে নিয়ে একটি কাব্য অথবা ছন্দ লিখতে, অথচ কথন তাকে নিয়ে সম্পূর্ণ অনুভূতি লিখে দিয়েছে ডায়েরির পাতায়। কিন্তু আফসোস!
এই অনুভূতি কখনো পড়তে পারবে না কবিতা। কখনোই না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথন। সে শেষ পৃষ্ঠা খুলে সেখানে লেখে,
“তুমি সে চাঁদ যাকে দূর থেকে ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে ছোঁয়ার সাধ্য আমার নাই। তুমি আমাকে ভালোবাসো নি কবিতা। কেন ভালোবাসো নি?”
.
.
কবিতা বেশ রাতে পৌঁছায় তার বাড়িতে। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে সারাটা বাড়ি। বিয়ের কাজও শুরু হয়ে গেছে। মা তো যেয়ে তার জন্য কয়টা শাড়িও নিয়ে এসেছেন। তার বাবা এবং বড় ভাই বিয়েতে খরচের হিসাবে ব্যস্ত। একদিন বাদেই তাদের কিছু আত্নীয়রও আসার কথা। কবিতার মনের ভেতর কু ডাকতে শুরু করল। তার জীবনে বড় এক তুফানের আভাস পাচ্ছে সে।
পরেরদিনটা শান্তিতেই কাটে কবিতার। সবাই একদম রাজকুমারীর মতো খেয়াল রাখে তার। ঝামেলা হয় সন্ধ্যায়। কবির ভাইয়া খুব রাগে বাসায় আসে। তার মেজাজ থাকে চরম পর্যায়ে। এসেই বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।সেখান থেকে জানা যায় বিয়ের জন্য মানা করে দিয়েছে কথনের পরিবার। সবার মুখ থমথমে। সবাই পড়লো চিন্তায়। একসাপ্তাহ পর বিয়ে তা প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয় সবার জানা। একদিকে কবিতার শান্তি এলো, অন্যদিকে অশান্তি তাকে ঘিরে বসলো। কবির ভাইয়া কথনকে নিয়ে যা তা বলছেন। তাকে শাস্তি দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। কিন্তু কেন? কথন তো কিছুই করে নি। যা করেছে সে করেছে। তীর্থ কথাটা বলার পর সে বলল আপাতত কিছু বলতে না। সমস্যা হবে। হ্যাঁ, কবিতা জানে সমস্যা হবে। অনেক বড় সমস্যা হবে। কিন্তু কবিতা এতটা স্বার্থপর নয় যে নিজের সমস্যা হবে বলে নিজের দোষে অন্য কাওকে ফাঁসাবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজে কথা বলবে তার ভাইয়ের সাথে।
রাত বাজে ৯.৩০। বাড়ির পরিস্থিতি এখনো থমথমে। কেউ রাতের খাবারও খায় নি। কবিতা অবশেষে সাহস যোগাড় করে তার বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে যায়। তার পরিবারের সবাই বসে ছিলো ড্রইংরুমে। সবাইকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল খুব। কবিতাকে দেখে সবাই একটু স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। আবির কবিতার কাছে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “দেখ পিচ্চি ওই ছেলের কথা ভেবে মন খারাপ করিস না। এর থেকে হাজারোগুণ ভালো ছেলে তোর ভাইয়েরা খুঁজে আনবে। তুই এমন মুখ না লটকিয়ে রেখে একটু হাসার চেষ্টা কর।”
কবিতার বাবাও একমত হলেন আবিরের সাথে।
কবিরও গম্ভীরমুখে বলে, “হ্যাঁ, ওই ছেলের থেকে হাজারোগুণ ভালো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিব আমি। নিজেকে ভাবে কী ওই বেয়াদবটা? এতমাস ঘুরাঘুরি করে এখন বিয়ে ক্যান্সেল করে দিলো! তাও আবার বিয়ের ডেট ফালানোর পর। আরে বিয়ে ক্যান্সেল করতে হলে হ্যাঁ কেন বললি তুই?”
কবিতা সমানে ঘামছিলো। তার হাত মোড়াচ্ছিল কেবল। ভয়ে তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। তবুও তার বলতে হবে। সে এভাবে মিথ্যা বলে নিজের কাজ বের করতে পারবে না। কবিতা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বলে, “ভাইয়া কথন না আমি বিয়ের জন্য মানা করেছি।”
মুহূর্ত না গড়াতেই কবিতার মা তার হাত শক্ত করে ধরে বলে, “কী? কী করছিস তুই?”
কবিতার ভয়ে যেন জানই বের হয়ে যাচ্ছিল। সে জানতো এখন সবার রাগ তার উপর বর্ষণ হবে। এটাই স্বাভাবিক। সে প্রস্তুত ছিলো। কবিতা উওর না দেওয়ায় মা শক্ত করে তার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরায়, “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইখানে বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে আর তুই যেয়ে ছেলেকে মানা করে এসেছিস? আমাদের সম্মানের কথা একবারও মাথায় আসে নি?”
আবির মা’কে করে বলে, “আরে মা ছিল হয়তো কোনো কারণ ছিলো। হয়তো কথনকে পছন্দ হয়নি।” তারপর আবির কবিতাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করে, “এই পিচ্চি ভয় পাওয়ার কি আছে? আমরা কী তোকে খেয়ে ফেলব না’কি? দোষ আমাদেরও তোকে না জিজ্ঞেস করে বিয়ের জন্য লাফাচ্ছিলাম সবাই।” আবির একনজর বিরক্তিতে ঘরের সবাইকে দেখে নিল। তারপর কবিতাকে জিজ্ঞেস করল, “বল তোর কথন কি পছন্দ হয়নি? ও কি কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি তোর সাথে? মানে এত মাস কথা বলে হঠাৎ করে যে মানা করে দিলি এজন্য।”
কবিতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল আবিরের দিকে, “ভাইয়া আসলে শুরু থেকে আমাদের দুজনের বিয়ের প্ল্যান ছিল না। আমি এইখানে ফিরে আসতে চাইতাম না এবং আমেরিকা যাওয়ার আগে কথনের জন্য যেন অন্য কোন মেয়ে না দেখতে পারে তাই আমার একটু নাটক করেছিলাম ও হঠাৎ করে হ্যাঁ বলে দিবি আমি জানতাম না।”
কবির আর্তনাদ দিয়ে উঠে, “তুই নাটক করেছিলি? বিয়ে নাটক করা জিনিস? এখন তোর নাটকে চক্করে যে আমাদের মান সম্মান সব ডুবে যাচ্ছে তার কি? আমি এখনই কথনের পরিবারকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছি তোর নাটকের কথা। তোর সাথে কথনের বরাবরই দোষ আছে। এবার সারাজীবন বিয়ে করে নাটক করিস। তোর কারনে আমার পরিবারের মান-সম্মান ভেস্তে যেতে দিবোনা।”
কবির তার ফোন পকেট থেকে বের করতেই কবিতা বলে উঠে, “ভাইয়া আমি অন্য কাওকে ভালোবাসি।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে পড়ে। মা উঁচু স্বরে বলে, “লাজ শরম আছে তোর? একদিকে তোর বিয়ের কথা বলছিলো অন্যদিকে তুই প্রেম করছিলি? এইজন্য গিয়েছিলি তুই ঢাকায়?”
কবিতা চোখ উঠিয়ে কারও দিকে তাকানোর সাহস পায় না। সে মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলে, “মা কথন বলেছিলো বিয়ের জন্য মানা করে দিবে।”
“তোকে আমি…” মা হাত উঠালেন কবিতার উপর। কিন্তু কবিরের কথায় থেমে যায়। কবির বলে, “মা থামো। আমি কথা বলছি।”
মা আর কিছু বলতে পাড়লেন না। এই ঘরে কবিরের উপরে কথা বলার সাহস কারও নেই। কবির বসে সোফায়। শান্ত দৃষ্টিতে কিছু সময় মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “ছেলে কী করে?”
“আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। আগামী বছর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। কিন্তু পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসাও শুরু করেছে।”
“কীসের ব্যবসা?”
“গ্রাম সাইডে দরিদ্র যারা থাকে তাদের হাতে বুনা জিনিসপত্র সাপ্লাই করে। এখন বিদেশের থেকেও জিনিসপত্র ইমপোর্ট করে বাংলাদেশে তা বিক্রি করার চিন্তায় আছে।”
“ওহ।” গম্ভীরমুখে বলে কবির। তারপর জিজ্ঞেস করে, “এই সাপ্তাহে তোমাকে বিয়ে করতে বললে করবে?”
“এ-সব কী বলছিস তুই? ছেলের খোঁজ-খবর না নিয়ে….” কবিতা তার বাবাকে থামিয়ে বলল, “ছেলে আসলে খোঁজখবর নেওয়া যাবে। সবাইকে বিয়ের কথা জানানো হয়েছে। এখন বিয়ে হওয়াটা প্রয়োজন। কবিতা তুমি বলো, ছেলেটা বিয়ে করবে?”
কবিতার চোখে মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠে, “একদম করবে ভাইয়া।”
“ঠিকাছে আসতে বলো কালকে।”
কবিতার দৌড়ে এসে তার বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরল। আর বলল, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
কবিতা হাওয়ার বেগে ছুটে যায় তার রুমে। যেয়েই প্রথমে তীর্থকে কল দেয়। তীর্থ তো এক পায়ে রাজি। তার খুশির ঠিকানা রইলো না আর। সে জানায় আগামীকাল সন্ধ্যার মাঝেই এসে পড়বে। এরপর কবিতা কথনকে কল দেয়। সে ফোন ধরে না। তাই মেসেজে বলে, “থ্যাঙ্কিউ। আপনি জানেন না আপনি আমাকে কত বড় খুশি দিয়েছেন। ভাইয়া তীর্থের সাথে দেখা করতে চায় বিয়ের জন্য। আপনি না থাকলে এমনটা সম্ভব হতো না। আর আমার পক্ষ থেকে আপনার পরিবারের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবেন প্লিজ। বিশেষ করে আন্টির কাছ থেকে।”
.
.
তীর্থ সকাল থেকে ব্যস্ত। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই কবিতা কল দিয়ে বলল, “তীর্থ শুনো কি হয়েছে? ভাইয়াকে আমি তোমার কথা বলে দিয়েছি। উনি চায় এই শুক্রবার আমাদের বিয়ে করাতে। আমাকে জিজ্ঞেস করছে তুমি কী বিয়ে করতে রাজি? আগামীকাল আসতে পারবে?” ভীষণ উৎসুক মনে হলো কবিতাকে। ফোনের ওপাড় থেকে মিষ্টি খিলখিল হাসির শব্দ। এত সুন্দরভাবে কেউ হাসে? শব্দ শুনেই মানুষের মন হেরে যাবার অবস্থা। তবে তীর্থ বুঝতে পারলো না কবিতার তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কারণটা। তীর্থ তাদের বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন সাজিয়েছে এই কয়েকমাস ধরে। তীব্র পরিশ্রম করছে তার ব্যবসার পিছনে যেন কবিতাকে বিয়ে করতে পারে।
নিজের সবচেয়ে ভালো পোশাক নিয়ে নেয় তীর্থ। তার সাথে যাবে লিমন ও রতন। ধ্রুবকে সে বলেছিলো কিন্তু তাহিরার দাদী অসুস্থ হওয়ায় তার যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু সে গেলে ভালো হতো। যেহেতু ধ্রুবর সাথে তাহিরার মাধ্যমে আগে থেকে তাদের আত্নীয়তা সেহেতু ধ্রুব তার পক্ষ থেকে কথা বললে বিষয়টা ভালো দেখাতো। আজ কথা বলে সব ঠিক হলে তার মা এবং মামাদেরও খবর দিতে হবে।
কুমিল্লায় যেয়ে তীর্থ তার এক বন্ধুর বাসায় উঠে। সেখান থেকেই তৈরি হয়ে নেয়। সন্ধ্যার দিকে রওনা দেয় কবিতার বাসায়। কবিতার বাসায় যাওয়ার সময় অনেক ফল ও মিষ্টি নিয়ে নেয়। বাসার ভেতরে ঢোকার পূর্বেও ভীষণ চিন্তিত ছিলো তীর্থ। তারা কী প্রশ্ন করবে? আর সে কীভাবে উওর দিবে? এতটা নার্ভাস সে জীবনে আর কখনো হয়েছে বলে সন্দেহ। নিজেকে সামলে নিয়ে সে কলিংবেল দেয়। দরজা খুলে কবিতার ভাই আবির। আবির প্রথমদিনের মতোই তার সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে। হাসিখুশি তাকে ও তার বন্ধুদের ভেতরে নিয়ে যায়। পরিচয় করিয়ে দেয় কবিতার মা বাবার সাথে। কবিতার মা’কে এতটা খুশি না দেখালেও তার বাবা ভীষণ খুশি ছিলেন। তার স্বভাব একদম আবিরের মতো। বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু তীর্থের চোখ তো কেবল তার কবিতাকে খুঁজছিলো। আজ কেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে তার চক্ষু জোড়া কবিতা দেখার জন্য। গতকাল থেকে বিয়ের খবরটা পাওয়ার পর থেকেই তার মাঝে এই তৃষ্ণাটা কাজ করছে। সে যখন আবির ও তার বাবার সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত তখন একনজর দেখা গেল কবিতাকে। একটি কক্ষ হতে উঁকি মেরে তাকাচ্ছিল সে। চোখে চোখ পড়ে। মুহূর্তখানিকের হয় দৃষ্টিমিলন। সে মুহূর্তখানিকই যথেষ্ট ছিলো তীর্থের ঠোঁটে হাসি আঁকার জন্য।
ডাইনিং রুম থেকে কবিতা উঁকি মেরে দেখছিলো তীর্থকে। তার মা বাহু ধরে তাকে টেনে আনে রান্নাঘরে, “লজ্জা শরম তো কিছু রাখ। একতো প্রেম করে বসে আছিস এরপর আবার উঁকি মেরে দেখছিস ছেলেটাকে।”
“উফফ মা গতকাল থেকে এই খোঁটা আর কয়বার মারবে? আর আমি প্রেম করে বসে আছি তুমি যে বাবাকে প্রেম করে বিয়ে করলে তার কী?”
“থাপ্পড় দিব একটা। বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো তোর বাবা। পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছে।”
“মিথ্যা বলবে না মা। তাহিরা আপুর দাদী আমাকে সব বলেছে। বাবা না’কি এক বিয়ে বাড়িতে তোমাকে দেখে পছন্দ করেছিলেন। তারপর তোমার সাথে দেখা করতে আসতেন। চিঠিও পাঠাতেন। তাও ছোট খালামণি অর্থাৎ তাহিরা আপুর আম্মুকে দিয়ে।”
কবিতার মা লজ্জা পেলেন মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে। তার গালদুটো লালচে হয়ে গেল। সে আমতা-আমতা করে বলল, “যতসব আজেবাজে কথা।”
সে যেয়ে তা চা নাস্তা দেবার জন্য আবারও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। কবিতা এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে আমার মা’কে লজ্জা পেলে কত সুন্দর লাগে। বাবা যে তোমার উপর ফিদা হয়ে গেছে এতে বাবারও তো দোষ নেই। আচ্ছা মা সত্যি করো বলো তো তীর্থকে কেমন লেগেছে? দেখতে একদম নায়কের মতো না?”
“হ্যাঁ দেখতে সুন্দর আছে। সাথে কথা-বার্তাও অনেক ভালো। কিন্তু কথন তো ডাক্তার ছিলো। সাথে কী সুদর্শন! ওকেও তো নায়কের মতো লাগতো। ওকে তোর মনে ধরে নি?”
“উফফ মা তুমিও না। আমি যখন তীর্থকে ভালোবেসেছি তখন ও দেখতে হিরোদের মতো ছিলো না। আমি বানিয়েছি। কথন ভালো। ভালো বলতে অনেক ভালো। কিন্তু চেহেরা আর টাকা দেখে যদি আমি তাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করি তাহলে তা তো ভালোবাসা না, জোর হবে। আর রইলো তীর্থের কথা, ওর জন্য আমি সবকিছু। আর কারও সবকিছু হওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার তাই না? আর আমি চাই ওর জীবনের সকল সাফল্যতা আমি নিজের চোখে দেখি। ও আমায় সুখে রাখবে মা, বিশ্বাস করো। নিজের সাধ্যের থেকে বেশি চেষ্টা করবে আমার যেন কোনো অভাব না হয়।”
কথাগুলো শুনে মায়ের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল, “তাই যেন হয়। তুই খুশি এই অনেক।”
“মা কবির ভাইয়া কখন আসবে?”
“এত অস্থির হচ্ছিস কেন? বলল তো কাজ দ্রুত শেষ করেই এসে পড়বে।”
এমন সময় কলিংবেল বাজে এবং কবিতা লাফিয়ে উঠে বলে, “ভাইয়া এসে পড়েছে।”
আবির যেয়ে দরজাটা খুলে। কবির গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, “এসেছে মেহমানরা?”
“হ্যাঁ ভাইয়া এসেছে। ড্রইংরুমে বসা।”
কবির আবিরের হাতে তার বন্দুক ও টুপিটা দিলেন একপাশে রাখার জন্য। তারপর একগ্লাস পানি পান করে রওনা দেয় মেহমানদের দেখা করার জন্য।
ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে তিনটি যুবক তার বাবার সাথে কথা বলছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। যে হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করলেন। যেহেতু তার বোনের ভবিষ্যতের স্বামী হতে পারে। তাকে দেখেই বাবা বললেন, “এই’যে কবিতার বড় ভাই এসে পড়েছে।”
ছেলে তিনজন তাকাল। কবিরের দিকে দেখতেই কবিরের মুখের রং উড়ে গেল। সে এর মধ্যে ছেলে দুইজনকে চিনে। ক’মাস আগে এই ছেলেদের মধ্যে দুইজনকে সে গ্রেফতার করেছিলো মারপিটের চক্করে। এমনকি তার সাথে অনেক বাজে বিহেভ করেছিল। এরা এখানে কি করছে? এদের মধ্যে কি কাউকে কবিতা পছন্দ করে? না এটা হতে পারে না। তার বোন কোনো গুন্ডার সাথে প্রেম করতে পারে না। আর গতকাল অবিরও বলেছিল ছেলেটা ভালো।
তীর্থ কবিতার বড় ভাইকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার জান আসে যায় অবস্থা। প্রায় পাঁচমাস পূর্বে তীর্থ কুমিল্লা এসেছিলো। তার এক বন্ধু ঝামেলায় ফেঁসে যাওয়ায় তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তাকে জেলে যেতে হলো। তাকে গ্রেফতার করা পুলিশটি ছিলো তার সামনে দাঁড়ানো লোকটি। এরপর লোকটা তার পরিবারের শিক্ষা নিয়ে খারাপ কিছু বলায় তার উপরও হাত উঠায় তীর্থ। কবিতার বড় ভাই পুলিশ। তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা পুলিশের ইউনিফর্ম পরা। অর্থাৎ লোকটা কবিতার বড় ভাই। ভাবতে তার জান গলায় এসে আটকায়। তার চোখের সামনে কবিতার সাথে সাজানো সকল স্বপ্ন সে ভাঙতে দেখতে পায়।
আবির কবিরকে পরিচয় করিয়ে দেয় তীর্থের সাথে, “ভাইয়া এইটা তীর্থ। কবিতা যার কথা বলেছিলো। আর এই দুইজন ওর বন্ধু।”
কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তীর্থের দিকে। হাওয়ার বেগে ছুটে এসে তার কলার চেপে ধরে বলে, “কুত্তার বাচ্চা তুই আমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার বোনকে নিজের প্রেমে ফাঁসিয়েছিস? তোর সাহস কী করে হয় আমার বোনের সাথে প্রেমের নাটক করার? তোর মতো ছেলে আমার বোনের স্বপ্ন দেখে কীভাবে? তোর সাহস কী করে হলো?”
তীর্থ পরিবর্তে তাকে স্পর্শও করে না।
আবির ও তীর্থের বন্ধুরা তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কবিতা এবং তার মা ড্রইং রুমে আসে। কবিতা এসে দেখে তার ভাই তীর্থের কলার ধরে তাকে যা তা বকছে। কবিতা দৌড়ে গেল সেখানে। কবিরকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ভাইয়া তুমি কি করছো? ওকে ছাড়ো।”
“তুই জানিস এই ছেলে একটা গুন্ডা। মারপিট করে। ওকে আমি নিজে একবার জেলে ভরেছি।”
“ভাইয়া ও আগের মতো নেই।”
কবির বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন তার বোনের দিকে, “মানে তুই জানতি যে ও গুন্ডা?”
কবিতা ভয়ে এক ঢোক গিলে। কবির অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি তোকে বল।”
ভয়ে কেঁপে উঠে কবিতা। তীর্থ সামনে এসে দাঁড়ায় কবিতার। তার চোখ মেঝেতে। সে আকুতি করে বলে, “কবিতা যে আপনার বোন আমি জানতাম না। আমি জানি আমি মারপিট করেছিলাম এইটা আমার ভুল কিন্তু সে ছেলেটা আমার বন্ধুর বোনের সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছে। এমন ব্যবহার আপনার বোনের সাথে করলে আপনি নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিতেন না। আর রইলো আপনার উপর হাত তোলার কথা, আপনি আমার মা’কে নিয়ে বাজে কথা বলেছেন, আমার পরিবারকে নিজে বাজে কথা বলেছেন তাই আমার মাথা ঠিক ছিলো না। আমি আপনার বোনকে আসলেই অনেক ভালোবাসি।”
“তোর মতো বস্তির ছেলের হাতে আমি আমার বোনকে তুলে দিব এইটা চিন্তা করার সাহস হয় কীভাবে তোর?” এতটুকু বললেই কবির আবার তীর্থের কলার ধরে নিল। এবার তাকে মারতেও শুরু করলো। কিন্তু তীর্থ ফিরে কিছুই বলল না। এমনকি তোর বন্ধুরা এগোতে নিলেও তাদেরকে থামায় সে। আবির মারপিট থামানোর অপ্রাণ চেষ্টা করে। কবিরের বাবা-মাও তাকে থামতে বলে তবু সে থামে না। অবশেষে দুজনের মাঝে আসতে হয়, “ভাইয়া প্লিজ ওকে ছাড়। তুমি তো কখনো এমন ছিলে না। এমন করছ কেন তুমি?”
কাঁদতে শুরু করে কবিতা। আজ সে কত খুশি ছিলো কিন্তু দিনশেষে এমন এক দৃশ্য দেখতে হবে সে চিন্তা করেনি।
কবিতা মাঝে আসায় কবির তাকেও জোরে একটা চড় মারে। থাপ্পড়টা সামলে উঠতে পারে না কবিতা। মেঝেতে পড়ে যায়। তীর্থ একপলক তাকায় কবিতার দিকে। তার চোখে জল, গালে আঙুল দাগ বসে গেছে, গালটা এতটাই লাল হয়ে গেছে যেন মনে হচ্ছে এখনই রক্ত বের হয়ে আসছে। কবিতার ভাই বলে এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিলো তীর্থ কিন্তু এই দৃশ্য দেখেই তার মাথা বিগড়ে গেল। সে উল্টো এক ঘুষি মারে কবিরকে। এরপর মারতেই থাকে। কবির তার সাথে কোনোভাবেই পেড়ে উঠে না। কবিতারই এসে তাকে থামায় থামায়। কবিতার নম্র দৃষ্টিই তাকে আটকানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো। কবিতা অসহায় গলায় বলল, “তীর্থ তুমি এখনের জন্য যাও এইখান থেকে।”
“কিন্তু তুমি… ”
“প্লিজ তীর্থ এখনের জন্য যাও।”
তীর্থ আহত দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। তার আঘাতের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো তীর্থের। কিন্তু তার কিছু করার নেই। সে তার বন্ধুদের নিয়ে চলে গেল।
তাদের যাওয়ার পর-ই রুমের ভেতর নিরবতা ছেয়ে রইলো কিছু মুহূর্তের জন্য। নিরবতা ভেঙে মা এসে বলে, “তোর লজ্জা লাগে নাই এমন একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে?” বলেই সে কবিতাকে একের পর এক কতগুলো চড় মারতে থাকেন। আবির এসে থামায় তাকে। মা আবিরকেও ধমক মেরে বলে, “তুই একদম ওকে বাঁচাবি না। এই মেয়ের জন্য আজ আমার ছেলেটার উপর একটা গুন্ডা হাত তুলেছে। এই মেয়েকে এইজন্য পেলে বড় করেছি যেন পরিবারের আর আমার ছেলের সম্মান মাটিতে মিশায়?”
আবিরও একই সুরে উওর দেয়, “আম্মু ভাইয়া নিজেই অকারণে প্রথমে ছেলেটাকে মারল। কী দরকার ছিলো? বসে আরামে কথা বলা যেত না?”
“তুই চুপ কর। তোর লাই পেয়েই এই মেয়ে খারাপ হয়েছে।”
“চুপ!” কবিরের কন্ঠ শুনে আবির ও মা দুইজনই আর কিছু বলার সাহস করেন না। রাগে, অপমানে কবিরের মুখের রঙ উড়ে গেছে। তার পরিবারের সামনে তাকে এমন অপমানিত হতে হবে তা সে কখনো ভাবে নি। সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে, “আমি এসে তোর সাথে কথা বলছি।” এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যায় কবির।
রাত ঘনিয়ে আসে এই ঘটনার পর থেকে কবিতা একেবারে চুপ। নিজের রুমে বসে কেঁদেই যাচ্ছে সে। খাবারও খাচ্ছে না। আবির এসে তাকে কত বুঝালো, কোনো লাভ নেই। এর উপর মা সে সন্ধ্যা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বকা দেওয়া বন্ধ করে নি। কবিতা তীর্থকে কয়েকবার কল দিলো কিন্তু তীর্থ ধরলো না।
রাত বারোটার দিকে কবির বাসায় এলেন। সে এসে সোজা কবিতার রুমে যায়। কবিরের পিছনে মা এবং আবিরও এসে দাঁড়ায় কবিতার রুমের দরজায়। তার দৃষ্টি শীতল। সে বসেন কবিতার সামনে। সে শান্ত কন্ঠে বলে, “দেখ কবিতা। ছোট থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমি নিয়েছি। সব আবদার পূরণ করেছি। আমি তোমার ভাই। তোমার খারাপ চাইব না। তীর্থ ভালো ছেলে না। তার ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো না। আমি চাই না ওর সাথে তোমার বিয়ে হোক। কথনের পরিবারে কল দিয়েছি আবার তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে ভাবার জন্য, কথনের বোন আমাকে যা তা বলে অপমান করল। আমার এলাকায় কত সম্মান তুমি ভালো করে জানো। কিন্তু শুধু তোমার কারণে আমার একইদিনে দুইবার অপমানিত হতে হলো।”
কবিতা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সে কাঁপছিল সমানে। সে ভয়ে একবারও চোখ তুলে কবিতার দিকে তাকাতে পারে না।
কবির আবারও বলে, “এলাকার এমপির ছেলে জয়। ও তোমাকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চাইত আগে থেকে।আমি মানা করে দিয়েছিলাম। আজ কথা বললাম। ছেলেটা এই শুক্রবারে তোমার সাথে বিয়ে করতে রাজি। ওর সাথেই তোমার বিয়ে হচ্ছে।”
চমকে উঠে কবিতা। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় কবিরের দিকে। কাঁপানো গলায় বলে, “ভাইয়া তুমি জানো তো ওই ছেলে মেয়েদের সাথে কত বাজে ব্যবহার করে? নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সাথে বিছানায় পাওয়া গিয়েছিলো তাকে। তার দুর্নামের ছড়াছড়ি সম্পূর্ণ কুমিল্লায়। তুমি তার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাও?”
“তো তুমি আর কোনো অপশন রেখেছ? তুমি তো প্রেম পিরিতি কম করো নি। তোমার জন্য অনেক অপমান হয়েছে আমার। এবার আমার পরিবারের সম্মান ডুবতে দেব না।”
আর্তনাদ করে উঠে কবিতা, “ভাইয়া তুমি তীর্থকে মানতে চাইছ না কারণ তোমার মতে ও খারাপ। যা সত্যি না। সে আমার জন্য সব মারধোর সব ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু জয়ের চরিত্রের ব্যাপারে সবাই জানে। সবাই। তাহলে তুমি আমার সাথে এমন কেন করছ?”
কবিতা দৌড়ে গেল নিজের মা’য়ের কাছে, “মা ভাইয়াকে বুঝাও না। কিছু তো বলো।”
মা কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে গেলেন। এইবার সে যায় আবিরের কাছে, “ভাইয়া তুমি তো….”
কবির কবিতার কথা শেষ হতে দেয় না। এর আগেই বলে, “তুমি যদি না চাও যে তোমার প্রেমিকের জীবন আমি নষ্ট করে দেই তাহলে চুপচাপ এই বিয়ে করে নেও। ওই ছেলে এবং তার বন্ধুরা এমনিতেই একজন পুলিশের গায়ে হাত তোমার জন্য লকাপে বন্দী। এর শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। তাদের অবস্থাও বিশেষ ভালো নেই। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। চিন্তা করে আগামীকাল জানিও।”
কবির চলে যায় কথাগুলো বলে। যেন কথাগুলো বেশ স্বাভাবিক। এইদিকে কবিতা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তার মাথায় এই মুহূর্তে কিছু ঢুকছে না। এই এক সন্ধ্যা তার জীবন এমন পালটে দিলো? এক সন্ধ্যার মাঝেই তার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সে সবসময় তার ভাইকে ভয় পেত, কিন্তু সম্মান করতো। আজ তার মনে তার ভাইয়ের জন্য এক বিন্দু সম্মানেরও আভাস পাচ্ছে না সে। শুধু ঘৃণা হচ্ছে তার করণীয় জন্য। এইজন্য নয় যে সে তীর্থের সাথে তার বিয়ে দেয় নি, বরং এইজন্য যে তার বড় ভাইয়ের শ্রদ্ধার যে প্রতিমা তার অন্তরে ছিলো তা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে সে ব্যক্তিটি।
চলবে….
[