মুহুর্তে পর্ব -৪৭+৪৮

#মুহূর্তে
পর্ব-৪৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তীর্থ আবারও তার কানের কাছে মুখ এনে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তাহলে কার স্পর্শ ভালো লাগে? সে কথনের? যার সাথে আমাকে ছেড়ে যাবার পরদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলে?”

“আমায় ছাড়ও তীর্থ, ব্যথা লাগছে।” কবিতা গোঙ্গানি দিয়ে উঠে।
তীর্থ কবিতার চুলে নাক ডুবিয়ে বলে, “তুমি আমাকে যত কষ্ট দিয়েছ তার কিছুটা নিজেও অনুভব করো। তোমার জন্য আমি পাগল হয়ে গেছি। আমার সব ছেড়ে তোমাকে মানানোর পিছনে পড়ে আছি। কিন্তু তুমি… তুমি আমার নাকের নিচে অন্য পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে? আর আমায় বলছ আমার স্পর্শে ঘৃণা লাগে তোমার? চিন্তা করো, যখন আমি যখন জানলাম যার জন্য আমি আমার সব ছেড়ে পাওয়ার চেষ্টা করছি সে অন্য পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ায় তখন কেমন লাগে আমার?”
“আমাকে নিজের মতো করে ভেবেছ? আমি তো…তোমার মতো চরিত্রহীন নয়।”

তীর্থ কিছুটা ছাড় দিতেই কবিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সে ফিরে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। পেটের পুড়ে যাওয়া অংশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় মেঝেতে বসে পড়ে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে সে।

তীর্থ কবিতার সামনে বসে তার মুখে হাত রেখে বলে, “জান তোমার বেশি লেগেছে? তুমি আমার রাগ উঠালে কেন বলোতো? তুমি জানো তোমাকে আমি অন্যকোনো পুরুষের সাথে সহ্য করতে পারি না। বিশেষ করে ওই কথনের সাথে তো একদমই না। আই লাভ ইউ জান।”

তীর্থ চোখে এসে কবিতাকে চুমু খেতে নিলেও কবিতা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে, “খবরদার আমার কাছে আসবে না। তোমার লজ্জা লাগে না নিজের করণীয়র পরেও আমার সামনে ভালোবাসার কথা বলতে? আমি ভেবেছিলাম তুমি অনুতাপ করবে আমায় হারিয়ে। শুধরে যাবে। আমি তোমাকে ক্ষমা না করতে পারলেও তোমার জন্য হৃদয়ের এককোণে ভালোবাসা রেখে জীবন কাটিয়ে দিব। কিন্তু তুমি তো দিন দিন হিংস্র প্রাণী হয়ে যাচ্ছ। তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম ভেবে আমার নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে।”

তীর্থ কবিতার গাল চেপে ধরে। তাকে টেনে উঠায়। ক্রুদ্ধ গলায় বলে, “কেন তুই না চেয়েছিলি আমি ধ্বংস হয়ে যাই? আমি ধ্বংস হচ্ছি তোর ভালোবাসায়। শেষ হয়ে যাচ্ছি। এখন তো খুশি হওয়া উচিত তোর।”
“এখন তুমি নেশায় আছো। কি বলছো নিজেও জানো না। নেশা কাটলে কথা হবে। এমনিতেও আমি এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।”

কবিতা সেখান থেকে যেতে নিলেই তীর্থ আবার তাকে ধরে নেয়। নেশাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “তুমি কখনো আমার থেকে মুক্তি পাবে না। তুমি আমার সাথে কেন এমন করছ কবিতা? আমি ভুল করেছি। ঠিকাছে করেছি। কিন্তু সে ভুলের কারণ তো তুমিও ছিলে। তুমি আমাকে খুশি রাখতে পারলে কেন বাইরে যে খুশি খুঁজতাম?”

কবিতা তীর্থের সাথে কথা বলায় রুচিতে বাঁধলো না। এই মুহূর্তে সে নেশায়। তাকে কিছু বলা, না বলা এক কথা। যেতে না কিন্তু পারে না। তীর্থ তার সাথে জোর করতে শুরু করে দেয়। কবিতা বলে, “তীর্থ ছাড়ও আমায়, করছটা কি তুমি?”
“আদর করছি। ভালোবাসছি। এমনতো নয় আগে করিনি।”
“আমার এসব সহ্য হচ্ছে না তীর্থ, ছাড়ও। আমরা আগের মতো নেই। আমাদের সম্পর্ক আগের মতো নেই। তুই আমার সাথে জোর জবরদস্তি করতে পারো না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন করে আমার রেপ করবে তুমি।”

তীর্থ কথাটা শুনে তাকায় কবিতার দিকে। শব্দ করে হাসে, “জান আমি তোমার স্বামী। আর তোমার সাথে কিছু করলে তা আমার ভালোবাসা হবে, রেপ না।”
“তুমি আমার সাথে জানোয়ারের মতন ব্যবহার করছ আমার সাথে।”
তীর্থ তাকে ছাড়ে না। আরও শক্ত করে ধরে। কবিতার অনিচ্ছায় তার দেহের নানান স্থানে ছুঁতে থাকে তাকে। তাকে আঘাতও করে। জ্বলন্ত সিগারেট তার হাতে ও ঘাড়ে লাগায়। এই তীর্থকে তো কবিতা জানে না। কখনো তীর্থের এই রুপের সাথে তার পরিচয় হয় নি। তীর্থ তার সাথে হাজারো দুর্ব্যবহার করুক, কখনো এমন অমানুষের মতো ব্যবহার করে নি।

কবিতা তাকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করে। শক্তির সাথে পেরে উঠে না। কথা দিয়েও বুঝে না তীর্থ। তারপর দিশেহারা হয়ে কবিতা তার পাশের টেবিল থেকে একটি কাঠের বাক্স উঠিয়ে তার মাথায় মারে। সাথে সাথে তীর্থ তাকে ছেড়ে পিছিয়ে যায়। তার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সে মাথায় হাত দিয়ে পিছিয়ে যায়।

রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায় কবিতা। আবার একটু আগের তীর্থের ব্যবহারের কথা মনে করে তার কাছে যেতেই ভয় করছে কবিতার। কিন্তু সে তীর্থকে এই অবস্থাতেও ফেলে যেতে পারে না।

কবিতা আলমারি থেকে একটি কাপড় বের করে তীর্থের মাথায় চেপে ধরে, “তুমি কাপড় মাথায় চেপে ধরো, আমি কারও সাহায্য নিয়ে আসছি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
তীর্থ কবিতার হাতের উপর হাত রাখে। আধবোজা চোখে তাকিয়ে অদ্ভুত হেসে বলে, “দেখলে তুমি আমাকে ঘৃণা করতে পারো না। এই’যে… এই’যে দেখ আমার ব্যাথা দেখে সহ্য হলো না তোমার। তুমি ছুটে এলে আমার কাছে।”
কবিতা বিরক্ত নিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। সে উঠে মেঝের থেকে নিজের ওড়না উঠিয়ে বাহিরের দিকে যায়। দরজা খুলে নিচে নামার পূর্বেই লিফট থেকে বের হয় রহমত এবং কাব্য।

কবিতা তাদের দেখে দৌড়ে যায়। রহমতকে বলে, “ভাই…ভাই ওই তীর্থ…”
কথা শেষ হবার পূর্বেই রহমত তার এই অবস্থা দেখ ঘাবড়ে যায়, “আপা আপনার কি হইসে? এই অবস্থা কেন আপনের?”
“আমার কথা বাদ দিন। ওই ভেতরে তীর্থের মাথা দিয়ে রক্ত পরছে। ওকে হাস্পাতালে নেওয়া লাগবে।”

রহমত দৌড়ে যায় সেদিকে। কবিতা যেতে নিলেই কাব্য তার হাত ধরে নেয়। হাতের পোড়া স্থানে আলতো করে ছুঁয়ে ভেজা চোখে তাকায় কবিতার দিকে। ঠোঁট উলটে জিজ্ঞেস করে, “আম্মু তোমায় কে ব্যাথা দিয়েছে?”
কবিতা তার চোখ মুছে জোর করে হাসার চেষ্টা করে, “কেউ না সোনা। আম্মু হাঁটতে যেয়ে পড়ে গিয়েছিল, ব্যাথা পায় নি। কাঁদে না ঠিকাছে।”
কবিতা কাব্যকে সামলানোর পর ওড়না জড়িয়ে নিয়ে নিজের শরীর ঢেকে নিলো। এরপর রহমতের সাথে তীর্থকে হাস্পাতালে নিয়ে গেছে। তিনটা সেলাই পড়েছে তীর্থের ক্ষত স্থানে। তীর্থকে রুম বের করার পূর্বেই কবিতা কাব্যকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
.
.
মৃণার শরীর আজকাল খুব খারাপ লাগছে। দুপুরে তো তার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই আইদের মা তাকে অফিস থেকে কল করে ডাকে, ডাক্তারের কাছে নেওয়ার জন্য। আইদের মন এমনিতেই ভালো ছিলো না। তাহিরা আপু না’কি অফিস ছেড়ে চলে গেছে। তাকে বলেও নি। তাহিরা খুব কাছের ছিলো আইদের। তার বড় বোনের মতো। সবসময় তাকে আদর করতো, তাকে সাহায্য করতো, সঠিক উপদেশ দিতো। যেদিন থেকে আইদ অফিস জয়েন করেছিল সেদিন থেকেই তাহিরাকে অনুসরণ করতো সে। আজ হঠাৎ করে তার কাজ ছেড়ে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছিলো না।

ডাক্তারের কাছে যেয়ে জানা যায় প্রেগ্ন্যাসির কারণেই তার একটু খারাপ লাগছে। এছাড়া কোনো সমস্যা তার নেই। আইদ হাস্পাতাল থেকে বের হয়ে কিছুই বলে না মৃণাকে। যেহেতু সে গর্ভবতী সেহেতু একটু খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু মৃণা এই চুপিকে তার প্রতি চিন্তা ভেবে নেয়। সে বলে, “তুমি রাগ করো নি তো যে আমার জন্য অকারণে তোমার টাকা নষ্ট হয়েছে?”
“না।”
“আচ্ছা শুনো, আই এম সরি বাবার মৃত্যুর পর আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তাই তোমাকে অকারণে দোষ দিয়েছি।”
কোনো উওর দেয় না আইদ। একথা সে আগেও বলেছে। মৃণা আবারও বলে, “আচ্ছা চলো না কোথাও যেয়ে আস্ক্রিম খাই, আমার খুব ক্রেভিং হচ্ছে।”
আইদ কিছু বলে না। পাশের দোকান থেকে দুইটা আইস্ক্রিম কিনে এনে মৃণার হাতে দেয়। সাথে কিছু টাকাও দেয়। বলে, “তুমি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাও।”
মুখ মলিন হয়ে যায় মৃণার, “আমি বলছিলাম আমরা কোথাও যেয়ে বসে একসাথে আইস্ক্রিম খাব। আর আমি চলে যাব মানে? তুমি আসবে না?”
“আমার অফিস আছে। আমি তোমাকে রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি।”
আইদ এগিয়ে যেতে নিলে মৃণা তাকে থামিয়ে বলে, “ছুটি তো নিয়েই নিয়েছ। ফুল ডে এর ছুটি নিয়ে নিতে পারো। আমরা একটু ঘুরে আসি।”
আইদ ঝাড়ন দিয়ে মৃণার হাত সরিয়ে দিয়ে রুক্ষ গলায় বলে, “তোমার সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করছি না বলে এমনও না যে আমি তোমাকে আমার জীবনে ফিরে চাই। তুমি কি করেছ মাথায় রাখো। আর নিলজ্জের মতো আমার সাথে এমন ব্যবহার করবে না যেন ভাজা মাছ উল্টিয়ে খেতে পারো না। তোমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার ধারণা আছে।”
মৃণার মেজাজ বিগড়ে যেতে সময় লাগে না। সে আশেপাশে মানুষের কথা চিন্তা না করেই উচ্চস্বরে বলে উঠে, “আমি যখন আগে তোমার সাথে রুক্ষভাবে কথা বলতাম তখন ঠিকই আমার আগেপিছে ঘুরে মধু মিশিয়ে কথা বলতে। আর এখন আমি যখন তোমার সাথে সুন্দরভাবে কথা বলছি, সব ঠিক করতে চাইছি তখন তুমি আমার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করছ?”

আশেপাশের লোকেরা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। লজ্জায় পড়ে আইদ। সে চোখ রাঙিয়ে মৃণাকে বলে, “মৃণা সবাই শুনছে।”
“শুনুক তাহলে। তুমি আমার সাথে এভাবে ওই মেয়ের জন্য কথা বলছ তাই না? ফোনে যে মেয়েটা ছিলো তাই না? ওই মেয়ে কী তোমার অফিসে কাজ করে? এক মিনিট, এটা কী কবিতার ফ্রেন্ড? যে তোমার সাথে ছাদে ছিলো? ওই মেয়ে তোমাকে দিয়ে এমন করাচ্ছে তাই না?”
“চুপ, একদম চুপ।” আইদ মৃণার মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “খবরদার এরপর একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করবে না। তুমি যা করেছ তারপরও এমন প্রশ্ন করার সাহস কোথাও পাও তুমি? তুমি আমার কেউ না। তোমাকে বাসায় থাকতে দিয়েছি বলে আমার উপর নিজের অধিকার দেখানোর চেষ্টা করবে না। ইউ নো হোয়াট, অনেক হয়েছে। আমি আন্টির কথা ভেবে তোমাকে ঘরে রেখেছিলাম। আর না। আমি আজই বাসায় যেয়ে তোমার কথা সবাইকে বলে দিব। এরপর তুমি কোথায় যাবে তা চিন্তা করে নিও।”
আইদ এই বলেই সেখান থেকে চলে গেল। মৃণা পিছন থেকে তাকে ডাকল, চেঁচামেচি করল, সেদিকে ধ্যান দিলো না সে।

আইদ কাজ শেষে সোজা বাসায় যায়। আজ সব নাটক শেষ করবে সে। সে আর পারছে না। আর সহ্য হচ্ছে না তার। তার এখন অনুভূতি হচ্ছে, সে ভালোবাসতো মৃণাকে। অনেক আগের থেকেই হয়তো ভালোবাসতো। এতবছর সে এই অনুভূতি বুঝে নি। আজ যখন বুঝছে তখন এই অনুভূতির প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। সে চাইলেই তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে রাখতে পারে। কিন্তু এতে তার কষ্ট মিটবে না, উলটো বাড়বে। যখনই সে মৃণাকে নিজের চোখের সামনে দেখবে তখনই তার বিশ্বাসঘাতকতা মনে পড়বে তার। এতে সে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। সবার জন্য ভালোবাসা সুখের হয়না, কিছুজনের জন্য ভালোবাসার অপর নাম দুঃখ।

আইদ রাতে বাসায় যেয়ে দেখে ড্রইংরুমে সবাই সমাবেশ বেঁধেছে। টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট। তাকে দেখেই তার মা এসে জড়িয়ে ধরলেন। ছেড়ে গালে হাত রেখে বললেন, “মৃণা তোকে খবরটা দিয়েছে?”
রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো মৃণা। আইদ কপাল কুঁচকে তাকাল মৃণার দিকে। তারপর মা’কে জিজ্ঞেস করল, “কী খবর?”
মা উড়ু উড়ু গলায় বলল, “মৃণা প্রেগন্যান্ট। তুই বাবা হতে চলেছিস এবং আমি দাদী।”
আইদ এক ঢোক গিলে। সে চিন্তিত গলায় বলে, “মা সম্ভবত তোমার ভুল হচ্ছে। গতবারও তুমি…”
“আরে গতবার ভুল ছিলো, এইবার না। বউ’মা নিজে আমায় বলেছে।”
আইদ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় মৃণায় দিকে। মৃণা নিজ থেকে এমন কেন বলবে?

সে প্রস্তুতি নিলো সত্যটা বলার। কিন্তু পারল না। এর পূর্বেই মৃণার মা তার কাছে এসে হাত ধরে কান্নাভেজা গলায় বলল, “আজ এতদিনের শোকের পর এই ঘরে খুশির মুহূর্ত। অনেক অভিনন্দন বাবা। অনেক অভিনন্দন। আজ মৃণার বাবা জীবিত হলে কত খুশি হতো সংবাদ শুনে। কেন তার এই সুখের সংবাদ যেতে হলো?”
শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কান্না শুরু করে দিলেন মৃণার মা। আজ তার স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছে তার। আইদের মা সামলালো তাকে।

আইদের বাবা তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি’রে তুই বাপ হবি। তোকে খুশি দেখাচ্ছেনা কেন?”
আইদ চিন্তায় পড়ে যায়। কি করবে সে? কি বলবে? এই মুহূর্তে সত্য বলে তার এতদিন পর ঘরে আসা সুখ হারাতে চায় না। আবার সবার কাছ থেকে সত্য লুকিয়ে এর পরে সবার কষ্ট বাড়াতেও চায়না।

এই মুহূর্তে মৃণার মায়ের কান্না দেখে তা সত্য বলার সাহসটা হলো না।সে বাবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল, “না বাবা আমি খুশি। একটু ক্লান্ত তাই এমন দেখাচ্ছে।”
.
.
“তোর এই অবস্থা কেন?”
অনু বাসায় এসেই কবিতার এই রূপ দেখে হতবাক হয়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত।
কাব্য তার হোমওয়ার্ক করছিলো। অনুর প্রশ্ন শুনে সে উওর দেয়, “অনুমণি… অনুমণি আজ না আমরা আব্বুর বাসায় গিয়েছিলাম সেখানে পড়ে যেয়ে আব্বু ও আম্মু ব্যথা পেয়েছে।”
কথাটা শুনে অনেক জলদি করে কবিতা কোন রুমে নিয়ে গেল, “কি হয়েছে সত্যি করে বল।”
কবি অনুকে সব কথা খুলে বলল। সবটা শুনে অনুর রাগে গা জ্বলে উঠে, “কার এত বড় সাহস? মানুষটার বুকে কি মন নেই? কি অবস্থা করেছে তোর। তুই এখনই আমার সাথে আসবি।”
“কোথায়?”
“পুলিশ থানায় যেয়ে ওকে লকাপে ভরাবো আমি।”
“প্রয়োজন নেই।”
“প্রয়োজন নেই মানে? একশোবার প্রয়োজন আছে। তুই মহান হয়ে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করবি না। অথবা বলবি না যে তুই তাকে ভালোবাসিস দেখে ক্ষমা করে দিয়েছিস। সে তোর সাথে যা করেছে তা নারী নির্যাতন। আর সে এমন করতে পারেনা। শাস্তি তাকে পেতেই হবে।”
“না, এখন নয়। আমি একটা পরিকল্পনা করে রেখেছি।”
“কীসের পরিকল্পনা?”
“ডিভোর্সের। তীর্থ আমাকে সহজে তালাক দিবে না।তা আমি জানি। তাই আপাতত এই বিষয়েই একটা পরিকল্পনা করে রেখেছি।”
“তুই কি বলছিস আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।”
“সময় হলেই বুঝতে পারবি। আর তা খুবই জলদি।”
“ঠিকাছে। তুই যা ভালো বুঝিস।।”

কবিতার ফোনে মেসেজ আসে এমন সময়,
‘কবিতা আমি কি নেশায় তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করেছি? বিশ্বাস করো আমার মাথা ঠিক ছিলো না। কাব্যকে রহমতের সাথে পাঠানোর পরে তোমার অপেক্ষায় আমি কখন যে ড্রিংক করা শুরু করেছি নিজেও বুঝে নি। রহমত বলল তোমার হাতে কতগুলো ক্ষত ছিলো। তার দায়ী কী আমি?’
কবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উত্তর দিলো না তীর্থের মেসেজের।
#মুহূর্তে#মুহূর্তে
পর্ব-৪৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সকাল সকালই তীর্থ দেখে তার মা এসেছে। মা’কে দেখে অবাক হয় সে। সে তার মামাকে বলেছিল মা’কে যেন কোনোমতেই না আসতে দেয়। সে মোটেও চায়নি তার মা তার এবং কবিতার সম্পর্কের মাঝে যে ফাঁটল এসেছে সে সম্পর্কে জানুক। তার মায়ের দুই রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। প্রথমত, হয়তো সে খুব রাগ করবে। সম্ভাবনা খুবই কম। দ্বিতীয়ত, হয়তো এই সুযোগে কবিতার থেকে তাকে আরও দূর করে দিবে।

মাথার ব্যান্ডেজ দেখেই তার দিকে ছুটে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তুই ব্যথা কিভাবে পাইছিস? কত্ত বড় ব্যান্ডেজ লাগাইছে ডাক্তারে। অনেক বড় ব্যাথা না’কি রে?” তারপর আশেপাশে তাকিয়ে আবার বলল, “ওই মাইয়া কই? ওই মাইয়া এতদিন আমার খোঁজও নেয় নাই। যা মানলাম। তুই ব্যথা পেয়েছিস তাও আমাকে জানায় নাই। রহমতকে কাল কল দিয়ে জানছি, নাহলে তো আমার ছেলের খেয়াল রাখার মতো কেউ-ই ছিলো না। দেখ তুই এত ব্যথা পেয়েছিস আর ওই ঘুইরা বেড়াইতাছে? এইজন্যই কইছিলাম এই মাইয়ার সাথে বিয়া কইরা জীবন নষ্ট করছিস তুই।”
“মা প্লিজ।” বিরক্ত হয়ে বলল তীর্থ, “আসার সাথে সাথে কবিতার ভুল ধরাটা এতই প্রয়োজনীয়?”
মা অবাক হয়। তীর্থ এর পূর্বে কখনো তার সাথে এমন রুক্ষভাবে কথা বলে নি।
“ওই মাইয়া এতদিন তোরে আমার ব্যাপারে খারাপ কথা কইছে তাইনা? এতদিন কান ভরসে দেইখাই তো এতদিন আমার পোলা আমারে নিতে আসে নাই।”
“সত্যি বলতো তুমি আমার চিন্তা করে এসেছ না’কি কবিতাকে নিয়ে দুর্নাম করতে? ও ঠিকই বলেছিলো তোমার সাথে থাকাটা যন্ত্রণাদায়ক। তোমার মনে ওকে নিয়ে এত বিষ কীভাবে ভরা?”
“তুই…তুই আমাকে এভাবে কইতে পারলি?”
“আমার আফসোস হচ্ছে এতদিন পর বলতে পারলাম। তুমি জানো তুমি কি করেছ? তুমি আমার সংসার ভাঙ্গার আরেকটা কারণ।”
কথাটা শুনে মা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তীর্থ আবার বলল, “এমন ব্যবহার করবেন এজন্য তুমি কিছুই জানো না। রহমত যদি তোমাকে ফোন দিয়ে আমার অবস্থার কথা বলে তাহলে নিশ্চয়ই এটাও বলেছে যে আমি কবিতার উপর গতকাল অত্যাচার করেছি। নেশায় অমানুষের মতো ব্যবহার করেছি ওর সাথে। আঘাত করেছি ওকে। আমি কীভাবে আমার কবিতাকে আঘাত করতে পারি?”
তীর্থ তার মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। এই কথা চিন্তা করেই তার মাথা ধরে যায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
এক সময় ছিলো তীর্থের নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ হতো না। রাগে সে কখন কি করতো নিজেও বুঝতে পারতো না। এরপর তার জীবন নিয়ে কবিতা এলো। তার অগুছালো জীবনটাকে গুছিয়ে দিলো। তার সকল বদভ্যাস ছাড়িয়ে দিলো। আজ সে তার জীবনে আর নেই। কবিতা এই শূন্যতা তাকে আগের থেকে শতগুণ বেশি এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। আজকাল তার কোনো কিছুর ঠিকানা নেই। নিজেরও না।

মা কিছুই বুঝলেন না। কি হয়েছে সে আসলেই জানে না। সে তীর্থের রাগ দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তীর্থ বাবা, সব ঠিক আছে?”
তীর্থ আর্তনাদ করে উঠে, “ঠিক নেই। কিছু ঠিক নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কবিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সব ওই মৃণার দোষ। আপনারও দোষ। আপনি ঘরে অশান্তি না করলে না আমার কবিতার সাথে ঝগড়া হতো, না আমি মৃণার কাছে যেতাম, আর না কবিতা আমায় ছেড়ে যেত।”
মা ভ্রু কুঁচকে নিলেন, “এই মৃণা আবার কোন মাইয়া?”

প্রশ্নটা শুনে তীর্থ একটু থমকে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সে রাগের মাথায় কি বলে ফেলল মাত্র বুঝল।
মা তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “কি জিজ্ঞাস করি? মৃণা কোন মাইয়া? তুই ওর কাছে গেছোস বলে ওই মাইয়া তোরে ছেড়ে গেছে মানে? তুই মৃণা নামক মাইয়ার লগে কি করছোস? এমন কি করছোস যে ওই মাইয়ায় তোরে ছাইড়া গেছে? তুই কি ওর লগে প্রেম পিরিত করছোস?”
উওর দেয় না তীর্থ। কিন্তু এই চুপিতে উওর পেয়ে যায় তীর্থের মা। সে জোরে এক চড় বসায় তীর্থের গালে, “তোরে আমি এল্লাইগা বড় করসি যেন বাপের মতো হইতে পারোস? তোর বাপে আমগো সাথে কি করছে ভুইলা গেলি তুই? আমি সবার কাছ থেকে হাত পাইতা তোকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছি এইদিনের জন্য? তোর এসব করার আগে একবারও খেয়াল আসে নাই যে তোর মা কত কষ্টে দিন কাটাইছে?”
তীর্থের মা মেঝেতে বসে পড়ে। নিজের কপালে হাত রেখে হায় হুতাশ করতে থাকে, “হায় খোদা, এত বছর ধইরা ওই মাইয়ারে কথা শুনাইলাম যে ওই আমায় পোলার জন্য ভালা না। আর এদিকে আমার পোলায় আমার মুখে কালি মাখার কাম করল! খোদা এই দিন দেখার লাইগা বাঁচায় রাখছিলা আমারে?”
সে তীর্থের দিকে তাকায়, “তুই এই কথা শুনানোর আগে আমারে মাইরা ফেলোস নাই কেন? ওই মৃণা মাইয়া জানতো না তোর বউ বাচ্চা আছে?”

তীর্থ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। উওর শুনে তো আরও ক্ষেপে যায় সে, “কী নিলজ্জ মাইয়া! ওই ত্যানার ঠিকানা দে। যাইয়া ওর সব তেল বাইর করুম। তোর কি কইসি ঠিকানা দে।”
“মা এমনিতেই এতদিন ধরে অশান্তিতে আছি। আর অশান্তি বাড়িও না।”
“তুই নিজের সংসার নষ্ট করে কি অশান্তিতে আছোস হ্যাঁ? তুই জানতি না তোর সত্য সামনে আইলে এমন হইবো? তোর বাপ আমারে আর তোরে কেমনে ফালায় রাইখা গেল তা মনে করেও বুক কাঁপে নাই তোর?”
সে আবার উঠে তীর্থকে একেরপর এক মারতে থাকে। তবে এতে তীর্থের উপর কোনো প্রভাব পড়ে না। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সে বলে, “আমি কী কবিতাকে ছেড়ে দিয়েছি নাকি? ব্যাস মৃণার কিছু সময়ের জন্য ওর সাথে কাটাইতাম যেন এই ঘরের অশান্তি থেকে মুক্তি পাই।”
“কিছু সময়ের লাইগা? তোর কিছু সময়ের শান্তির লাইগা অন্যমাইয়ার কাছে যাইতে হইতো? তো আমি তো এতবছর ধইরা কষ্টে ছিলাম, কত বিয়ার ঘর আইসে। সব জায়গায় কইসে আমারে তারা ঘরে উঠানোর লাইগা রাজি কিন্তু তোরে আমার ফালায় যাইতে হইবো। কই আমি তো শান্তির লাইগা তোরে ছাইড়া যাই নাই।”
মা হয়রান হয়ে বিছানায় বসে পড়ে। তীর্থ তার মা’য়ের পায়ের কাছে বসে। তার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলে, “মা তুমি দয়া করে কবিতাকে আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসো। আমি মৃণাকে ছেড়ে দিয়েছি। আর সব খারাপ স্বভাবও ছেড়ে দিব। আই প্রমিজ। কবিতাকে কেবল আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। ওকে ছাড়া আমি মরে যাব।”

তীর্থের কাঁপানো কন্ঠ শুনে মা’য়ের মন গলে। সে তার ছেলেকে এমন করুণ অবস্থায় কিছুতেই দেখতে পারে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওই মাইয়া এখন কই? আমি আজ ওর লগে যেয়ে কথা কমু।”
কথাটা শুনে তীর্থ যেন আত্নহারা। সে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, “থ্যাঙ্কিউ মা। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
“এত ভালোবাসা দেখানোর প্রয়োজন নাই। এসব খালি তোর লাইগা করতাসি না। আমার নিতি নাতনি ওই মাইয়ার কাছে। আমগো বংশের অংশ ওর কাছে, ওগোরে তো দূরে রাখা যায় না।”

তীর্থের মা মানুষ এনিয়ে ঘর পরিষ্কার করায়। এই কয়দিনে খুব ময়লা হয়ে গেছে ঘর। তারপর রান্না করে খাওয়ায় তীর্থকে। আজ অনেকদিন পর তীর্থ ঘরের খাবার খাচ্ছে। কবিতা যাবার পর সে কখন কি খেত তা নিজেই খেয়াল করে নি। দুপুরের রহমত এসে তাকে জানায় রাহাত আজ আবারও এসেছে।
তীর্থ কবিতার যাবার পর থেকে আর অফিসে যায় নি। সে সুবাদে একদিন পরপরই রাহাত আসে তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তীর্থ দেখা করে না। রহমতকে বলে দরজা থেকেই বিদায় জানিয়ে দেয় তাকে। অনেকসময় দরজাও খুলে না। কিন্তু আজ সে রাহাতের সাথে দেখা করার জন্য রাজি হয়। গতকালের ঘটনার পর সে বুঝতে পারছে সে তার জীবন নিজের হাতে এলোমেলো করছে। তাই তার নিজেই এবার তার জীবন গুছাতে হবে।

তীর্থ ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে রাহান সেখানে বসা। সে রুমে প্রবেশ করতেই রাহান উঠে দাঁড়ায়, “হ্যালো স্যার, আপনি ঠিক আছেন?”
তীর্থ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। সে যেয়ে সামনের সোফায় বসে। টেবিলে অনেকগুলো ফাইল রাখা। তা দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “এত ফাইল এনেছ কেন?”
“স্যার আপনি বলতে গেলে একমাস অফিসে আসেন নি। ফ্যাক্টরির সব কাজ থেমে গেছে। আমাদের প্রডাক্ট শেষ হবার কাতারে অথচ বাজারে নতুন পণ্য আনার ব্যবস্থা নেই। আমি আপনার সাথে এত যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনি আমার সাথে দেখাই করেন নি। ব্যবসায় ক্ষতির উপর ক্ষতি হচ্ছে। সব ইনভেস্টাররাও নিজেদের টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। এর উপর…. ” তীর্থ রাহাতের কথা থামায়, “আস্তে ধীরে বলো। একবার কথা শুরু করলে থামার নামই নেও না। আর আমি ছিলাম না বলে কাজ হবে না এটা কেমন কথা? তোমাদের কী চেহেরা দেখানোর জন্য রেখেছি।” তীর্থের কথার ধরণ রুক্ষ। বিরক্তি মেশানো।

রাহাত তার এমন কথার ধরণে অস্বস্তি বোধ করে। এতদিন সে সবকিছু কিভাবে সামলেছে নিজেই জানে। তীর্থের অনুপস্থিতিতে অনেক ঝামেলা গেছে তার উপর। সে সব সহ্য করল। তবুও তাকে এমন অপমানিত কথা হয়েছে?
সে মৃদুস্বরে বলে, “স্যার আপনার স্বাক্ষর ছাড়া কোনো কাজ এগোনো সম্ভব না এবং ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠানোটাও অসম্ভব।”
“এইসব ফালতু বাহানা আমাকে দিবে না। আমি না থাকলেও ধ্রুব তো ছিলো।”
“স্যার সব কাজ সবসময় আপনিই সামলান তাই সব জায়গায় আপনার স্বাক্ষর প্রয়োজন। এছাড়া ধ্রুব স্যারও অনেকদিন অফিসে আসে নি। গত পুরশু এসে বলেছিল সে কোম্পানির অংশীদার আর থাকতে চায় না। আইনগত দলিলও বানাতে দিয়েছে সে।”
“কী!” চমকে উঠে তীর্থ, “কিন্তু কেন?”
“তা তো জানি না। তবে বলেছে মূলধন উঠাবে না। কেবল এসব থেকে দূরে যেতে চায়।”
চিন্তায় পড়ে যায় তীর্থ, “আচ্ছা তুমি এসব রেখে যাও। আমি সাইন করে দিব। আগামীকাল এসে নিয়ে যেও।”
“স্যার আপনার অফিসে আসা প্রয়োজনীয়। কারখানার কর্মীরা মজুরি না পেয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রডাক্টের কাঁচামাল নেই, আরও ঝামেলা হচ্ছে। অনেক ক্ষতি হয়েছে ব্যবসার। ইনফ্যাক্ট শো রুমে পাঠানো পণ্যেরও কমতি পরছে।”
“তোমার আমাকে শিখাতে হবে না আমার কি করা উচিত। আমি চেক সাইন করে দিচ্ছি আর এই ফাইলগুলো সাইন করে রাখবো। আমার সময় হলে আমি নিজেই অফিসে আসবো।”
বলে তীর্থ চেকবুক আনতে উঠে যায়। সে রাহাতকে যাই বলুক না কেন তার ব্যবসার এই অবস্থার কথা জেনে ভেতর থেকে অনেকটা ভেঙে পড়েছে সে। প্রথমে কবিতা, এরপর তার ব্যবসা, হচ্ছেটা কি তার জীবনের সাথে?
.
.
আজ কবিতার প্রথম দিন ছিলো অফিসের। দিনটা খুব ভালো কেটেছে। ভালোই লেগেছে বড় ম্যাডামের সাথে কাজ করতে কিন্তু তার ফাইল সামলানোটা ভীষণ কষ্টকর মনে হলো। সে কিছুই ঠিক মতো করতে পারছিলো না। সম্ভবত আর এসব কাজের অভ্যাস নেই এই কারণে। সময়ের সাথে সাথে সে কাজগুলো শিখে নিবে।

বিকেলে সে বাসায় আসার সময় কাব্যকে তার বন্ধুর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। আজকের জন্য সে স্কুল শেষে নিজের বন্ধুর বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য ছিল। সে তার কোচিং এর জন্য টিচারের সাথে কথা বলেছে। এই সাপ্তাহেই কাব্যের কোচিং শুরু হবে। কবিতা একটু শান্তি পাচ্ছে। তার জীবনের সবকিছু ঠিক হয়ে আসছে। তার এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে নিচ্ছে সে।

তার বাসায় এসে দরজা খোলার সময় একটি মধ্যবয়সী মহিলার সাথে তার দেখা হয়। মহিলাটি বলে, “আরে তোমরা এই বাসায় নতুন উঠেছ তাই না? আমি এই বাড়িওয়ালার বউ। তোমার সাথে মেয়ে থাকে তার সাথে আগে কথা হয়েছে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয় নি আগে।”
কবিতা থেকে সালাম দেয়। মহিলাটি সালামের উত্তর নিয়ে গল্প করতে শুরু করে তার সাথে। কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ বলে, “তোমার বাচ্চারা তো মাশাল্লাহ অনেক মিষ্টি। যেহেতু তোমার স্বামী বিদেশে সেহেতু একা সামলাতে কষ্ট হয় তাই না? তোমার কোনো সাহায্য লাগল্র লাগলে আমাকে জানাবে। দ্বিধাবোধ করবে না।”
কবিতা মহিলার কথায় অবাক হয়। সে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে কে বলেছে আমার স্বামী বিদেশে?”
“তোমার সাথে যে মেয়েটি থাকে সে বলল। আচ্ছা কোন দেশে থাকে তোমার স্বামী।”
কবিতার অনুর উপর মেজাজ খানিকটা খারাপ হয়। মিথ্যা কেন বলতে গেল সে?
কবিতা সরাসরি বলে, “আমার স্বামীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল মহিলাটার। মহিলাটি কবিতার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে বড় কোন অপরাধ করেছে। মহিলাটি চোখমুখ কুঁচকে বলল, “আচ্ছা আমি যাই। বাসায় কাজ আছে।” সেখানে একমুহূর্ত দাঁড়ালো না সে। চলে গেল।

কবিতা বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেয় না। বাসার ভিতরে যেয়ে নিজের বাচ্চাদের খাইয়ে প্রথমে ঘর গোছায়। রান্না শেষ করে। এসব করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। কবিতা সব শেষে কাব্যকে পড়াতে বসে। কাব্য যখন পড়ছিলো তখন কুহু ঘুমন্ত অবস্থায়। এর মধ্যে কবিতা একটি শাড়ি বের করে। অনুর এক কলিগ তাকে এই শাড়ি দিয়ে অনুরোধ করে গেছে এই শাড়িটা যেন সে ডিজাইন করে দেয়। মুখের উপর মানা করতে পারে না কবিতা। সে নিয়ে আসে। সে সুতোর বক্স খুলে কাজ করতে শুরু করে। বাকি জিনিস পরে এনে বসাবে। যখন কাজ করছিল তখনই কলিংবেল বাজে। কবিতা উঠে যায়। সে দরজা খুলে দেখে তীর্থের মা তার বাসার সামনে দাঁড়ানো। মোটেও অবাক হয়ে না সে। যেন সে জানতো উনি আসবেই। উনার আসারই অপেক্ষায় ছিলো সে। তীর্থের মা এসে সর্বপ্রথম কাব্য এবং কুহুকে দেখে নিলো। তাদের আদর করে যেয়ে বসলো অন্যরুমে। কবিতা তার জন্য পানি নিয়ে আসে। এতক্ষণেও কবিতা তার সাথে কোনো কথা বলেনি। তাই তীর্থের মা নিজ থেকেই কথোপকথন শুরু করলন, “তুমি জানো আমি কি কারণে আইসি। ঠিকাছে আমার ছেলে ভুল করছে আমি জানি। কিন্তু ও নিজের ভুল বুঝতে পারছে। তোমার এখন আমার সাঙ্গে আসা উচিত।”
কবিতা হাসে, “আমার মনে হয়েছিল আপনি অনেক আগের থেকে চান যেন আমি তীর্থের জীবন থেকে চলে যাই। তাহলেই তো আপনি আপনার মনমতো একটা বউ আনতে পারবেন।”

তীর্থে মা’য়ের কথা বলার কন্ঠ দৃঢ় ছিলো। সে ভেবেই এসেছিলো কবিতার সামনে এসে নরম গলায় কথা বলবে না, নাহয় মেয়েটা আরও সাহস পেয়ে যাবে। সে ভেবেছিলো সে এলে কবিতার তার কাছে কান্নাকাটি করবে। এমন কোনো লক্ষ্মণ সে দেখছে না।
“দেখো, তোমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমি মরে যাইতেছি না। কেবল আমার ছেলে এবং নাতি নাতনির জন্য তোমারে নিতে আইস।”
“বাহ আপনি নিজের নাতি নাতনিকে এত ভালোবাসেন?”
“নিঃসন্দেহে।”
“তাহলে আপনার যে আরেকটা নাতি অথবা নাতনিকে যে আপনার ছেলের মেরে ফেলতে চেয়েছিলো তাও নিশ্চিত আপনি জানেন।”
তীর্থের মা যেন কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ে।
কবিতা আবার বলে, “ওহ আপনি বোধহয় জানেন না, আপনার ছেলের যে মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো সে মেয়ে প্রেগন্যান্ট।”
তীর্থের মা বড়সড় ধাক্কা খায়। সে ভেবেছিলো তীর্থ কেবল মেয়েটার সাথে কথা বলতো। অথচ এত বড় কান্ড সে ঘটিয়েছে বলেই নি। তার তীর্থের উপর রাগ উঠলেও তা কবিতার সামনে প্রকাশ করে না সে, “পোলা মানুষ, ভুল হইতেই পারে। আর করবো না। মাইয়াগো এতটুক সমঝোতা না করলে সংসার টিকে না’কি?”
“আপনি আপনার সংসারে কমপ্রোমাইজ করেছিলেন?”
“তাইলে? আমি সবসময়ই করতাম।”
“তাও আপনার সংসার টিকে নি।”
কবিতার এতোটুকু কথায় লজ্জায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করল তার। কবিতা কখনো তার মুখের উপর কথা বলে নি। আজ কী হলো এই মেয়ের?

কবিতা আরও বলে, “এইখানে আপনার এবং আমার মধ্যে পার্থক্য কি জানেন? আমি নিজের সম্মান রক্ষার্থে বেরিয়ে এসেছি। আপনি তা করেন নি। এই কারণেই আজও আপনাকে তীর্থের মামার বাড়ির কেউ সম্মান দেয় না। আর আপনি যে সমঝোতার কথা বলছেন না তা আমি এতবছর ধরে করেই সংসার টিকিয়ে রেখেছি, নাহয় একবছরও টিকতো না।” এক নিশ্বাসে এত কিছু বলে হয়রান হয়ে যায় কবিতা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে, “আমার আপনার সাথে শুধু শুধু তর্কাতর্কির কোন ইচ্ছা নেই। আমি সরাসরি বলতে চাই আমার তালাক লাগবে। আমি এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।”

কবিতার এমন কথার ধরণ দেখে ঘাবড়ে যায় তীর্থের মা। তবুও সে নিজেকে শক্ত রেখে বলে, “এহ তালাক নেওয়া এত সহজ? আর তালাক নিলেও তোর মনে হয় আমি তোরে নিজের নাতি নাতনি রাখতে দিমু? তোর মতো মাইয়া ওদের কি খাওয়াইবো আর কি পরাইবো। সুন্দর কইরা কথা বলায় চঙ্গে উঠে গেছেন উনি। শোনো মাইয়া, সুন্দরমতো আমার কথা শুনো। তালাক নিতে গেলে নিজের বাচ্চাদের চেহারাও আর দেখতে পারবা না। আমার পোলার ঢের টাকা। দুইমিনিট লাগবো না টাকা দিয়া বাচ্চাগোরে আমগো কাছে রাখতে।” বলেই সে বিজয়ীর হাসি দিলেন।

কবিতা হাসলো। সে তার হাত দেখিয়ে বলল, “আমার হাতে, গলায়, মুখে আঘাত দেখছেন? এগুলো আপনার ছেলে গতকাল আমায় দিয়েছে। আপনি কি চান আপনার ছেলের উপর আমি নারী নির্যাতনের কেস করি? আপনি কোনোমতেই এরপর আমার বাচ্চাদের আমার থেকে দূর করতে পারবেন না। ইনফ্যাক্ট আপনারা হয়তো এরপর কখনো ওদের দেখতেও পারবে না। ওদের ফুল কাস্টাডি আমি পাব। যেহেতু আমি এখন চাকরি করি আমার বিপরীতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর নিলেও আজকাল মিডিয়া জগতের পাওয়ার অনেক। আর আপনার ছেলে এতও বড়লোক না যে মিডিয়াও নিজ ইচ্ছামতো কিনে নিতে পারবে। তাই আপনি নিজের ছেলেকে বুঝান সবদিক থেকে ওর আমার কথা মেনে যায় এতেই ওর জন্য ভালো হবে। ওর বদনাম উঠলে আপনার এই অহংকারের টাকা পয়সা যেতেও বেশিদিন লাগব না।”
“তুমি… তুমি আমারে হুমকি দেও? আমার পোলা ভুলে প্রথমবার তোমারে মারসে দেইখা তুমি এই নিয়া আমারে হুমকি দেও?”
“ভুলে মেরেছ? একটা নারী হয়ে এতকিছুর পরও আপনার নিজের ছেলের পক্ষ হয়ে কথা বলতে লজ্জা লাগছে না? যাই হোক, আপনার থেকে অন্যকিছু আমি আশাও করি নি। তবে আপনার ছেলেকে আমি যতটুকু জানি এছাড়া আর উপায় পায় নি।” সামনের কথাটুকু বলতে যেয়ে গলা কেঁপে উঠে কবিতার। সে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে, “এখন কি করবো এই সমাজে মন ভাঙার শাস্তি নেই, বিশ্বাস ভাঙার কোনো দণ্ড নেই, একটি মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে দেওয়াটাকে অপরাধ মনে করা হয় না। এই সমাজে পরকীয়া অপরাধ না। এইটা হাজার জীবন নষ্ট করে দেয়, তবুও এর শাস্তি নেই। এর উপর এই পরকীয়াটা যদি পুরুষ করে থাকে তাহলে এতে কারও কিছু আসে যায় না। কিন্তু যদি একটি নারী এই অন্যায় সহ্য না করে জীবনে এগোতে চায় তাহলে তাকে দোষারোপ করা হয়। কারণ তার জন্ম হয় মানিয়ে নেবার জন্য, স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য নয়।”

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here