মুহুর্তে পর্ব -৪৯+৫০

#মুহূর্তে
পর্ব-৪৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“সব মাইয়াগো এগুলো সহ্য করতে হয়। বাচ্চাকাল থেকে এগুলো শিখা উচিত।”
তীর্থের মায়ের এমন কথায় হাসে কবিতা, “এটাই তো সমস্যা। মেয়েদের শুধু সহ্য করা শেখানো হয়। সাহস করে লড়াই করা নয়। আমাকেও তাই শেখানো হয়েছিল। তাইতো এত বছর আপনার মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছি।”
এই কথায় চড়ে উঠে তীর্থের মা, “ওই মাইয়া তুই এসব কি বলোস? আমি তোর উপর অত্যাচার করছি?”
“কন্ঠ উঠিয়ে কথা বলবেন না। এটা আমার বাসা, আপনার ছেলের না। আর না আমি আপনার ছেলের বউ। আর আপনার তো সম্মান করার মতো কোন কারণ আমার কাছে নেই। আপনার বয়সের মর্যাদা রাখছি কেবল, নাহলে আপনি আমার সাথে এত বছর যা করেছেন তার পরিণাম অনেক খারাপ হতো। আর যদি একটা কথা বলেছেন তাহলে বলে দিচ্ছি, যৌতুক চাওয়ার জন্য তো আইনও শাস্তি দেয়। আপনি সম্ভবত তা জানেন না। তাইতো আমাদের প্রতিবেশী সবার সামনে বলতে থাকেন যে আমার বাসা থেকে আপনাকে কিছু দেয় নি। তারপর কতগুলো খোঁটা শোনান। অকথ্য ভাষায় কথা বলেন। আরে আমার তো মাথায় এ ব্যাপার আগে আসে নি। আপনার ছেলের সাথে আপনাকেও জেলে পাঠালে কেমন হয়? তারপর দুই মা ছেলে জেলে বসে পিকনিক করেন। এখন আর বেইজ্জতি করাতে চান, না এখানেই এই কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটাব?”

তীর্থের মা উঠে দাঁড়ায়। নাক ফুলিয়ে কবিতাকে বলে, “তোমারে… তোমারে তো আমি পরে দেইখা নিব।”
“আমার কথা মতো না চললে ক’দিন পরে এমনিতেই পুলিশথানায় দেখা হবে।”
তীর্থের মা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না রাগে হনহনিয়ে চলে যায়।

তীর্থের মা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বাসায় ঢুকে বলে, “ওই মাইয়ার কথা ভুলে যা। আর ওর কথা ঘরে তুলবি না।”
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই মা’য়ের মুখে এই কথা একটু থতমত খেয়ে যায় তীর্থ। সে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”
“কী হইসে? ওই মাইয়া আমারে হুমকি দেয় ওরে তালাক না দিলে আমগোরে জেলে ভরবো। তুই যে ওরে কাল মারসোস তার কেস কইরা।”
তালাকের কথা শুনে তীর্থের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে।
কবিতা তাকে ছেড়ে যাবার পর তালাকের বিষয়টা স্বাভাবিক হবার কথা ছিলো। তবুও কথাটা বিশ্বাস হলো না তার। সে বলল, “তুমি মিথ্যা বলছো। কবিতা আমাকে তালাক দিতে পারে না। এটা অসম্ভব।”

“তোরে ছাইড়া গেছে এতদিন হইসে। ওই মাইয়া নাকি চাকরিও নিসে। মানে তোর কাছে ফিরা আসার ওর কোনো ইচ্ছা নাই। তাও এই কথা কস?” মা তীর্থের কাছে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই চিন্তা করবি না। ওর চেয়ে সুন্দর মাইয়ারে তোর বউ কইরা আনমু।”
তীর্থ এক ঝাড়ন দিয়ে তার মা’য়ের হাত সরিয়ে দিলো। বলল, “তুমি ওখানে যেয়ে ওকে উল্টাপাল্টা কথা বলে এসেছ তাই না? যেন ও আমার কাছে না ফিরে।”
“আমি এমন কেন করমু?”
“কারণ তুমি সবসময় চাইতে যেন কবিতা আমার জীবন থেকে চলে যাক। এখন খুব খুশি তুমি তাই না? তোমার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে। কবিতা আর আমার জীবনে থাকতে চায় না। আমাকে এভাবে দেখে তো তুমি আরও খুশি।”
তীর্থের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। যে তীর্থ আজ পর্যন্ত তার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলে নি সে আজ তার সাথে এত বেয়াদবি করছে?
যেন এতটুকু তার জন্য অবাক করার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। এর থেকে বেশি অবাক কান্ড দেখলো সে। তীর্থের চোখের পানি দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তীর্থের বাবা যখন তাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন তখন তীর্থ বারো বছরের ছিলো। সেদিন শেষ কান্না করতে দেখেছিলেন তিনি তীর্থকে। এরপর আজ, এতবছর পর আজ তিনি তীর্থকে কান্না করতে দেখছেন। এক মুহূর্তের জন্য তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না।

তিনি আবার তীর্থকে সামলাতে গেলে তীর্থ তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তিনি জিজ্ঞেস করে, “এই রাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
উওর দেয় না তীর্থ। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তীর্থের মা যেয়ে তার রুমে বসেন। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে তার। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। সন্তানের কষ্ট কোনো মা’য়েরই সহ্য হয় না। আজ ঘর পরিষ্কারের সময় অনেক সিগারেট ও মদের বোতল পেয়েছেন তিনি। তার অবাক হওয়ার সীমা থাকে না। তার ছেলে এইসব কবে থেকে শুরু করল?

এর উপর তার নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে। সেও একটি কারণ তার ছেলের এই অবস্থার। হয়তো অতীতে কবিতার সাথে এত বাজে ব্যবহার না করলে আজ তার ঘরে এই অশান্তি হতো না। হয়তো। এই কথায় আরেকটি চিন্তা এলো তার মাথায়। কবিতাকে সে এত অপছন্দ করে কেন? মেয়েটি তো কখনো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। তাকে কখনো কষ্ট দেয় নি। উল্টো তার যত্ন নিতো, তার সব কটু কথা সহ্য করতো, তার সব বাজে স্বভাবও। তাহলে কেন সে কবিতাকে আপন করতে পারলো না?
অনেক চিন্তা করেও উত্তর পেলেন না তিনি।
.
.
অনু আসার পরে সে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে কবিতার সাথে। কবিতা বাচ্চাদের খাইয়ে জলদি ঘুম পড়িয়ে দিয়েছে। তাই আরামে খেতে বসে দুই বান্ধবীর গল্প করছে। কবিতা তীর্থের মা’য়ের সাথে সব কথোপকথন শুনায় অনুকে। অনু তো এসব শুনে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিস্মিত গলায় বলল, “ভাই তুই আসলে এভাবে কথা বলেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“আমার তো এখন তার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করছে। ভাই তুই আমার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলি না কেন?”
“এইসব বাদ দে, তুই আগে আমাকে এটা বল আমার কোন জামাই কোন দেশে আছে?”
অনু খাবার খাচ্ছিলো, কবিতার কথা শুনে তার কাশি শুরু হয়। সে পানি পান করে কবিতার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসে, “তুই জেনে গেছিস?”
“তুই জানিস আমার মেজাজ তখন যে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তুই মিথ্যা বলতে গেলি কেন? আমার কত লজ্জা পড়তে হয়েছে তুই জানিস?”
“সত্যি বললে সবাই তোকে নিয়ে কথা বলতো। গবেষণা করতো। এসব নিয়ে মানুষের কত ইন্টারেস্ট তুই জানিস না? তোর জন্যই বলেছি।”
“যা বলার বলুক। আমার কিছুই আসে যায় না। এতকিছুর পর আমার আজকাল কোনো অনুভূতিই হয় না। তুই এরপর কাওকে মিথ্যা কথা বলবি না। বুঝেছিস?”
মাথা নাড়ায় অনু।

রাতের খাবার শেষে অনু বসে বসে টিভি দেখছিলো। এমন সময় এক আননোওন নাম্বার থেকে কল আসে। বিরক্ত হয় অনু। তবুও কল ধরে।
“হ্যালো, কে?”
“অনু বলছো? অনু, আমি আবির।”
আবিরের নাম শুনতেই অনু চমকে যায়। বিছানায় দাঁড়িয়ে পড়ে। বিস্মিত কন্ঠে বলে, “আবির ভাইয়া আপনি আমায় কল দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, একটা কথা ছিলো। প্লিজ তুমি কবিতাকে জানিও না।”
অনু নিজেকে সামলে আবার ঠিকমত বসলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।”
“কবিতার পরিবারে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
কথাটা থমকে যায় অনু। সে কি বলবে? কবিতা তো তাকে আবিরকে সত্যটা বলার জন্য মানা করেছে। এমন সময় কবিতা থেকে ডাক দিলো। ফোনের মধ্যে কবিতার কন্ঠ শুনে আবির হয়ে ওঠে, “কবিতা তোমার বাসায়? আমি জানতাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। অনু সত্যি করে বল কি চলছে?”
“না না, এটা তো আমার রুমমেটের কন্ঠ। কবিতা আমার পাশে থাকবে কেন? ওর নিজের ঘর সংসার আছে।”
এমন সময় কবিতা আবারো ডাক দেয় তাকে। অনুর তো এই মুহূর্তে কাঁদতে মন চাইছে। কোথায় ফেঁসে গেল সে? সে বিরক্তি নিয়ে কবিতাকে জবাব দেয়, “আরে ভাই আসছি একটু অপেক্ষা কর।”

আবির ফোনের ওপাশ থেকে বলে, “আমি নিশ্চিত এটা কবিতার কণ্ঠ। সত্যি বলো অনু। কী হচ্ছে? আমি কবিতাকে না পেয়ে একদিন আগে ওর বাসার টি এন টিতে কল দিয়েছিলাম। একজন লোক ধরে বলল কবিতা কয়েক সাপ্তাহ ধরে সেখানে থাকে না। আমি একথা কবিতাকে জিজ্ঞেস করতে চায়নি কারণ ও কখনো আমাকে সত্যটা বলবে না। বলার হলে আগেই বলতো। দেখ অনু, এখন কেবল আমিই ওর অভিভাবক। ওর জীবনে কোন সমস্যার হলে আমার জানা দরকার।”

অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আবির কে বলতে শুরু করল সকল ঘটনা। কথাগুলো সে এ-কারণে বলে না যে সে আবিরকে পছন্দ করে। বরং সে আগের থেকেই চাইতো কবিতা তার পরিবারের কারও সাথে দেখা করুক। তার আজকাল কবিতাকে নিয়ে ভারী চিন্তা হয়। মেয়েটা তার হৃদয়ের কষ্ট মেটায় না। কান্নাও করে না। স্বাভাবিক থাকে। এই স্বাভাবিক ভাবটাই তার মধ্যে ভয় জাগায়। সে চায় কারও সাথে নিজের কষ্ট শেয়ার করে তার মন হাল্কা হোক। সে বলেছিলো কবিতাকে, একটিবার তার পরিবারের সাথে যেয়ে যেন দেখা করে। সে যায় নি, উল্টো বলেছে, তীর্থ যেমন তার সাথে অপরাধ করেছে তেমনটা তারাও করেছে। সে যেয়ে তাদের মুখের থেকে এই কথা শুনতে পারবে না যে, তাদের কথা মানলে হয়তো আজ সে সুখে থাকতো।

কথাটা মিথ্যা নয়। অতীতে কবিতার পরিবার তার সাথে এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি। কবিতার রাগ তার কাছে জায়েজই মনে হয়।
.
.
বাহিরে তুফান ছুটেছে। তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে। কবিতা সব কাজ সেরে ঘুমাতে যাবার আগে কয়েকবার ডাকলো অনুকে। মেয়েটা প্রতিদিন দেরিতে ঘুমিয়ে সকালে সময়ে উঠতে পারে না। কিন্তু সে অপেক্ষা করতে বলে আর আসলো না। কবিতা নিজে গেল ঘুমাতে। বিছানার কাছে যেয়ে তার দেখে ফোনের বাতি জ্বলছে। তীর্থ কল করেছো তাকে। ফোনের স্ক্রিনে তার নামটা দেখেই কবিতার দম আটকে আসলো। এত রাতে কী প্রয়োজন তার?

কবিতা কল ধরল না। কল শেষে ফোন হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো মিসকল ও মেসেজ তীর্থের। সে এতটাও অবাক হয় না। সে আজ তীর্থের মা’কে যা বলেছে তার কারণে কল দিচ্ছে ধারণা হলো তার। আরেকবার কল আসায় তা শেষ হবার অপেক্ষা করে মেসেজ ওপেন করে পড়ে সে, “কবিতা বারান্দায় আসো একটু। আমি তোমার বাসার সামনে।”
কবিতা মেসেজটা পড়ে অবাক হয়। দ্রুত যেয়ে বারান্দার দরজা খুলে দেখতে পায় তীর্থ বাহিরে দাঁড়ানো। চারপাশের অন্ধকারে মাঝে একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটি গাড়ি দাঁড় করানো। সে গাড়িতেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে সে। তবুও দাঁড়িয়ে আছে।
কবিতার অবাক হওয়ার কারণ আছে। তীর্থ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ জোর করে বাসার ভিতরে ঢুকতে চায় নি এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর।

তীর্থ তাকে দেখে এগিয়ে আসে কিছুটা। আবারও ফোন করে তাকে। কবিতা এবার ফোন ধরে। জিজ্ঞেস করে, “তুমি আবার কোন নাটক শুরু করেছ? আমার বাসার সামনে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ তুমি?”
“কবিতা মা কি তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? এ-কারণে তুমি আমার কাছ থেকে ডিভোর্স চাচ্ছো?”
“আমি গতকালও তোমার কার কথা বলেছি। ওহ সরি, তুমি তো নেশায় ডুবে ছিলে মনে থাকবে কি করে?”
“আমি তোমায় কষ্ট দিয়েছি তাই না? আই এম সরি কবিতা, আই এম সো সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
“উফফ ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে। কতবার এই এক কথা বলে ক্ষমা চাইবে তুমি? ভুল একবার হয়, দুইবার হয়। হাজারবার না। আর আমি আগে থেকেই তালাকের কথা চিন্তা করছি। আমার এই সম্পর্কে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে।”
“জান প্লিজ আমার কথা শুনো, তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। তালাক কোনো ছোট বিষয় না। তুমি আমাকে ভালোবাসো কবিতা। একথা তুমি অস্বীকার করতে পারবে?”
এই প্রশ্ন অনেক সময় ধরে চুপ থাকে কবিতা। ফোনের দুইপাশে নিরবতা। একসময় সে কাঁপানো গলায় উওর দেয়, “না, আমি অস্বীকার করতে পারবো না।”
“তাহলে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের দুইজনকে কষ্ট দিচ্ছো। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত লাগে, কিন্তু তার অনুতাপ সারা জীবনের থাকে।”

“যেমন তুমি এক মুহূর্তে অন্য মেয়ের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিলে। না তুমি আমাদের সম্পর্কের মর্যাদা রেখেছ, আর না ভালোবাসার। জানো আমি কেন তোমার কাছ থেকে তালাক চাই? কারণ তোমাকে আমি যতবার দেখি ততবারই আমার মাথায় প্রথম ভাবনা আসে তুমি অন্য একটি নারীকে স্পর্শ করছো, তাকে ভালোবাসছো, তাকে….” দম আটকে এলো কবিতার। সে সম্পূর্ণ কথাটুকু শেষ করতে পারলো না। কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলে সে আবার বলে, “তোমাকে ভালোবেসে অথবা ঘৃণা করে, তোমার থেকে দূরে থেকে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু তোমার কাছে থেকে আমি বাঁচতে পারবো না। বারবার ভেঙে পড়বো তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে। আমি তখন আর নিজেকে সামলাতে পারবো না। আমার মনে হয় কি জানো? তোমার কাছে থাকলে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতে পারি।”
শেষের কতটুকু দিতে বুকের ভিতর তুফান আনার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সে উন্মাদের মতো বলল, “এভাবে বলো না কবিতা। প্লিজ এভাবে বলো না। আমি সব ঠিক করে দিব।তোমার ভালোবাসা, বিশ্বাস সব ফিরিয়ে আনব।”
“একটি মানুষ ধোঁকা দিলে তাকে আবার ভালোবাসা যায়, তবে বিশ্বাস করা যায় না। আর বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসার মূল্য নেই। আর গতকালের পর থেকে তো আমি তোমার সাথে থাকলে সারাক্ষণ আতঙ্কিত থাকবো, তুমি কখন আমার সাথে জোর করো অথবা মদ খেয়ে মারধর করো আমায়।”
এখানেই চুপ হয়ে যায় তীর্থ। সে কিছু বলতে পারে না।

বারান্দা থেকে ছিটকে আসা বৃষ্টির পানি কবিতার চোখের অশ্রুজলের সাথে মিশে যাচ্ছিল। সে নিজেকে সামলে চোখ, মুখ মুছে। তারপর কঠিন গলায় বলে, “তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে তুমি তালাক না দিলে আমি কি করতে পারি। দেখ তীর্থ, আমি তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বলবো না যে আমাকে ভালোবাসলে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দেও। না, কারণ আমার মুক্তি আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইবো না। আমি যা বলছি তোমার তা করতে হবে, নাহলে… ”
“নাহলে আমাকে জেলে পাঠাবে তাইতো? আমি রাজি। তোমার জন্য আমি সব করতে রাজি। সব কষ্ট সইতে রাজি।”
“তাই? এক পরিণাম জানো? তোমার স্বপ্ন, তোমার সাফল্য, তোমার ব্যবসা সব মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। তুমি আমার জন্য এইসব বিসর্জন দিতে রাজি?”
কথাটা শুনে থতমত খেয়ে যায় তীর্থ। এভাবে সে চিন্তা করে নি। আসলেই তার জেলে যাবার খবর এলে তো তার সব শেষ হয়ে যাবে।

কবিতা তাচ্ছিল্য হাসে, “উত্তর নেই তোমার কাছে। কারণ আমার থেকেও তোমার কাছে তোমার ব্যবসা বেশি। এক মুহূর্তও তুমি তাই চিন্তা করছো।”
“এ-এমন কিছু না।”
“আমাকে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। তুমি ক’দিনের মাঝে ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে কেবল সাইন করে দিও। আর না করলে আইনগতভাবে আমার তালাকের দাবি জানানোর আরও উপায় আছে।”
ফোন কেটে দিলো কবিতা। তীর্থ উন্মাদের মতো কল দিতে থাকে কবিতাকে। সে এভাবে কবিতাকে হারাতে পারে না। সে পা বাড়ায় তার বাসায় যাবার জন্য। থেমে যায়। গতকালের পর তার সাহস হয় না। যদি আবারও সে যদি নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকতে পেরে কবিতাকে ব্যাথা দেয়?

কবিতা দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। তার চোখ দিয়ে ঝরলো কিছু বিন্দু দুঃখের জল। নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়ে সে। চোখ বন্ধ করে ফোনটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকের কম্পন বাড়ে। হৃদয়ের জ্বলা বাড়ে।

রাতের নীরবতার মাঝে ভিন্নরমকের বিশেষত্ব আছে। রাতের নিরবতা তোমার আবেগ বাড়ায় ও সারাদিনের হাসিখুশি থাকার মিথ্যা নাটকটা বৃথা করে দেয় মুহূর্তেই।
.
.
দুইদিন কেটে যায়। কবিতা রীতিমতো অফিসে কাজ করছিলো। হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। ধ্রুবর কল। সে খানিকটা অবাক হয়। এতদিন সে তাহিরাকে কল করে পায় নি। ভেবেছিলো এই শুক্রবারে তার বাসায় যাবে অনুকে নিয়ে।

কবিতা ধ্রুবর ফোন কেটে আবার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ধ্রুবর সাথে কথা বলে নিজের মেজাজ গরম করতে চায় না। আবারও ফোন আসে। বড় ম্যাডাম কাজ করছিলেন। দ্বিতীয়বার ফোনের শব্দ শোনে সে বলে, ” কলটা ধরো। অনেকসময় ইমাজেন্সি থাকে।”
ধ্রুবর তার সাথে জরুরী কী কথা থাকবে? সে-ই তীর্থকে নিয়েই সে বলবে। তবুও বড় ম্যাডামের কথায় সে কল ধরলো। রুমের এক কোণে যেয়ে বলল, “কী চাই বলেন।”
“কবিতা তুমি একটু হাস্পাতালে আসো, জলদি।”
কবিতা বিরক্তি নিয়ে বলে, “কোন দুঃখে? আপনি আর তীর্থ মিলে আবার কোনো নাটক পরিকল্পনা করেছেন? আপনাদের নাটক প্রদর্শন করার এত ইচ্ছা থাকলে থিয়েটারে যে করুন। আমার সময় নষ্ট করবে না।”
কবিতা কান থেকে ফোন কাটতে নিলেই ধ্রুব অশান্ত সুরে বলে, “তাহিরার জন্য ডাকছি। প্লিজ তুমি আসো। আমার…আমার খুব ভয় করছে।”
“তাহিরা আপু!” চমকে উঠে কবিতা, “তাহিরা আপুর কী হয়েছে?”
“একজনের কল এসেছিল, ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। আমার ওর সামনে যেয়ে ওর খেয়ালও রাখতে পারবো না। প্লিজ কবিতা তুমি আসো।”
ধ্রুবর কান্নাভেজা কন্ঠে কবিতা তার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। সে বলে, “আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি আমাকে হাস্পাতালের নাম ও ঠিকানা মেসেজ করুন।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৫০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা বড় ম্যাডাম থেকে অনুমতি নিয়ে গেল হাস্পাতালে। কবিডরে যেয়েই সে ধ্রুবকে পায়। সে কেবিনের বাহিরেই বসেছিলো। কবিতাকে দেখেই সে এগিয়ে এলো, “কবিতা ভালো হয়েছে তুমি এসে পড়েছ। তুমি তাহিরার কাছে যেয়ে ওর খেয়াল রাখো।”
ধ্রুবর কথা কবিতার কানে গেলেও সে উওর দিতে পারে না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তার চোখের নিচের কালি স্পষ্ট। মুখেও কেমন মলিন ভাব। দাঁড়ি বেড়ে গেছে তার। ধ্রুবকে এত বাজে অবস্থায় কখনো সে দেখে নি। সে সবসময়ই গুছানো মানুষ ছিলো। স্টাইলিশ ছিলো। সবসময়ই নিজের যত্ন করতো। শেষবার তার অগুছালো অবস্থা তার মা’য়ের মৃত্যুর সময় ছিলো। আর কখনোই ধ্রুবকে এত বাজে অবস্থায় সে দেখে নি।

ধ্রুব আবারও বলে, “কবিতা কোথায় হারিয়ে গেলে? প্লিজ তাহিরার কাছে যাও।”
“আপুর কী হয়েছে?”
“দুর্বলতার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। এখনো অজ্ঞান। হোটেলের লবিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। তারপর ম্যানেজার তার ফোন থেকে আমায় কল দেয়। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানলাম ওর অসুখ ঘনিয়ে আসছে। ও নিজের চিকিৎসা না করানোর কারণে অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।”
“আপনি কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপুর কোন অসুখ? আর আপু হোটেলে কি করছিলো?”
ধ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ওর লিউকেমিয়া।”
চমকে উঠে কবিতা, “মানে ব্লাড ক্যান্সার?”
মাথা নাড়ায় ধ্রুব। কবিতা স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। কাঁপানো গলায় বলে, “আপনি মিথ্যা বলছেন তাই না? আপনি মিথ্যা বলছেন।” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে কবিতা।
“আই উইশ আজও আমি মিথ্যা বলতে পারতাম।”
ধ্রুবর নম্র চোখ দেখে কথাটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় কবিতা। সে ধ্রুবর হাত ধরে বলে, “আপনি তাহলে আপুর কাছে না থেকে এখানে বসে কী করছেন? জলদি আসুন।”
কবিতা তার হাত ধরে এগোলেও ধ্রুব নড়ে না। কবিতা অবাক হয়ে ফিরে তাকায় তার দিকে। ধ্রুব বলে, “আমি ওকে দূর থেকে দেখছি। ওর কাছে যাওয়াটা আমার জন্য বারণ।”
“এসব কী বলছেন আপনি?”
“পাপের পরিণাম ভোগ করছি। তাহিরা আমার কাছ থেকে তার শেষ ইচ্ছায় চেয়েছে তাকে যেন এই জনমে নিজের মুখ না দেখাই। আমি ওকে দূর থেকে দেখছি। তুমি ওর কাছে যাও।”
কবিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ ধ্রুবর দিকে। ধ্রবর করণীয়র পর তার প্রতি মোটেও খাবার লাগা উচিত না কবিতার। কিন্তু আজবভাবে তার খারাপ লাগছে।
সে ধ্রুবর হাত ছেড়ে দ্রুত গেল তাহিরার কাছে।

তাহিরার জ্ঞান ফিরতে সময় লাগে। কবিতা সেখানেই বসেছিলো। তার জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুক্ষণ সময় দেয়। কিছু কথা বলে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আপু তুমি আমাকে সত্যটা বলোনি কেন? তোমার এত বড় অসুখ তাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি? তুই চিকিৎসা করাও নি কেন? আর তুমি হোটেলে ছিলে কেন? ধ্রুব ভাইয়াকে তুমি দেখতে মানা করে দিয়েছ অর্থাৎ তুমি ঘর ছেড়ে হোটেলে ছিলে? একারণে তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ? এত কিছু হয়ে গেছে আমাকে বলাটাও উচিত মনে করো নি?”
“আস্তে আস্তে, এত প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর দিব কিভাবে? তোর জীবনে এমনিতেই সমস্যার অভাব নেই , এর উচিত তোর চিন্তা করাতে চাচ্ছিলাম না। মনে আছে তুই সেদিন ধ্রুবর পরকীয়ার কথা আমায় বলেছিলি?”
কবিতা মাথা নাড়ায়। তাহিরা বলে,
“আমি তা কয়েকমাস আগে থেকে জানতাম। সেদিন মিথ্যা কথা বলেছি। অপেক্ষায় ছিলাম ধ্রুবকে মুক্তি দেবার জন্য। আর বেঁচে কি করব বল, আমার সব তো আগেই শেষ।”
“এসব কি বলছে আপু? এসব কথা মুখেও আনবে না।”
“ঠিকই বলছি। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। হয়তো কখনো প্রকাশ করিনি। যারা আমার কাছের ছিলো সবাই ছেড়ে চলে গিয়েছি। যে ধ্রুবকে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবেসেছে কি’না সন্দেহ। ভালোবাসার মানুষটা অন্যকারো বাহুডোরে নিজ চোখে দেখাটা দম আটকে যাবার মতো। বিষয়টা কষ্টকর। আমার মা-বাবার মৃত্যুর সময়ের কষ্ট ঠিক কতটুকু ছিল আমার মনে নেই। কিন্তু সেদিনের মতো আমার কষ্ট আর কখনো হয় নি। জানিস আমি সবসময় মোনাজাতের দোয়া করতাম যেন আমার মনের কষ্টটা কমে যাক। আল্লাহ আমার দোয়া শুনেছে। আমি আমার মৃত্যুর সংবাদেই সে শান্তিটা পেলাম।”
কবিতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে কি বলে বুঝতে পারছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তাহিরা আবার জিজ্ঞেস করে, “ও বাহিরে তাই না?”
“হ্যাঁ ডাকবো?”
“না, চলে যেতে বল। তার জন্য হয়তো অন্য মেয়েরা অপেক্ষা করছে। অকারণে আমার জন্য ওর সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
“আপু উনার এত বাজে অবস্থা আমি কখনো দেখি নি। আমি তো তাকে প্রথমে চিনতেই পারি নি।”
তাহিরা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। এই প্রথম তার গলা কেঁপে উঠে, “ওকে বলিস নিজের খেয়াল রাখতে। এভাবে নিজেকে নিয়ে অবহেলা যেন না করে। ওকে যেতে বল এখান থেকে। আমি ওকে দেখতে চাই না।” কথাটুকু বলার সময় তাহিরার চোখজোড়া নম্র হয়ে এলো। ভিজে গেল।

কবিতা কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে ধ্রুব এখনো বাহিরের করিডরে বসা। সে যেয়ে দাঁড়ায় তার সামনে। বলে, “আপু আপনাকে যেতে বলেছে। আর বলেছে আপনি যেন নিজের খেয়াল রাখেন।”
“তুমি একটু বসো। কিছু কথা বলব।”
কবিতার ধ্রুবর সাথে বসতে রুচিতে বাঝলো। সে তার সাথে যা করেছে এরপর তার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না কবিতার। তবুও সে বসলো। কেননা ধ্রুবর অবস্থা দেখে তার মায়া হচ্ছে। সে জানে, সে তাহিরার সাথে যত অন্যায় করুক না কেন এই পৃথিবীতে যদি ধ্রুব একমাত্র কাওকে ভালোবাসে তাহলে সে হলো তাহিরা। আচ্ছা, ভালোবাসলে কী ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে মন চায়? তার বিশ্বাস ভাঙাতেই এতই সহজ মনে হয়? একথাটুকু ভেবে ভালোবাসা শব্দটা নিয়েই সে দ্বিধায় পড়ে গেল। পরের মুহূর্তে ভাবলো, ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ আছে। তাহিরা এবং ধ্রুবর সম্পর্কটা সবচেয়ে ভিন্ন। তাদের একে অপরের সবচেয়ে বেশি কাছের। বন্ধু হিসেবে, পরিবার হিসেবে। ধ্রুব যদিও তাহিরাকে ভালো না বাসে তবুও তার অসুখের সংবাদে সবচেয়ে বেশি কষ্ট ধ্রুবরই হবে।

কবিতা একসময় ধ্রুবকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছিলো। আসলে ভাইও মেনেছিলো। তাই তার প্রতি আলাদা জায়গা আছে তার মনে। ধ্রুব তার সাথে যত খারাপ করুক না কেন, সে ভাই শব্দটার মর্যাদা টুকু সে রাখবে।

ধ্রুব চোখ মেঝেতে স্থির রেখে বলে, “আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ করেছি কবিতা। নিজের স্বার্থের জন্য তোমাদের সকলের জীবন নষ্ট করেছি। তোমার সংসার ভাঙার দায়ী আমি। তোমার ভাই বলার মর্যাদাটুকুও আমি রাখি নি।”
কবিতা চুপ রইলো। কিছু বলল না।
ধ্রুব আবার বলে, “তীর্থ আমার সাথে থাকতো। আমি যে মেয়েদের সাথে ঘুরাঘুরি করি তা যেন সে তাহিরাকে না জানায় এই কারণে আমিই মৃণার সাথে ওকে জোর করে সম্পর্কে করানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি কখনো ভাবেনি ও কখনো এত গম্ভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে। আমি তোমার অপরাধী কবিতা। তুমি যে শাস্তি দিবে, আমি মেনে নিব।”
কবিতা এবারও কিছু বলে না। ধ্রুব বেঞ্চ থেকে সোজা হাঁটু গেড়ে বসে পা ধরে নেয় কবিতার। কবিতা চমকে উঠে, “কি করছেন আপনি?”
“আমি জানি তোমার কাছে আমি যত ক্ষমা চাইবো ততই কম হবে। আমি অনেক খারাপ করেছি তোমার সাথে। আমি না কখনো ভাবি নি যে তাহিরাকে আমার কখনো হারাতে হবে। তাই ওকে গ্রান্টেড নিয়েছি। বলে না খুব সহজে কিছু পেয়ে গেলে কদর থাকে না। আমার অবস্থাও তাই। এত সুন্দর একটি জীবন পেলাম, ভালোবাসার মানুষ পেলাম, সব পেয়েছি কিন্তু কিছুর কদর করি নি। তোমার মতো বোন পেয়েছিলাম, তার মর্যাদাও রাখি নি। তীর্থের বন্ধুত্বের লাভ উঠিয়েছি। আমি জঘন্য একটি মানুষ। হয়তো আমি সম্পর্কের মর্যাদা রাখতে পারি না বলেই আল্লাহ আমার জীবনে কাওকে রাখে নি। তাহিরা আমার মা’কে মৃত্যুর পূর্বে করা ওয়াদাটা সবসময় পালন করেছে। আমি করতে পারি নি। আমার মা মৃত্যুর কাগারে গিয়ে আমার হাত ধরে বলেছিলো, ‘তোর বাবা যেভাবে সারাজীবন আমাকে আগলে রেখেছে, সম্মান দিয়েছে, বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে, ভালোবেসেছে সেখাবে তুই তাহিরাকে রাখবি।’ আমি এই কথাটা কখনো তাহিরাকে বলিনি। উল্টো তার মা’কে করা ওর ওয়াদাই মনে করিয়ে গিয়েছি। ধিক্কার আমার উপর। আমি কখনো বাবার মতো হতে পারি নি। আফসোস। যদি হতাম, তাহলে হয়তো তাহিরার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার ওর পাশে থাকতাম। আমার এভাবে লুকাতে হতো না।”

ধ্রুব তার চোখ মুখে কবিতার হাত ধরে নেয়। অনুরোধ করে, “কবিতা আমি তো ওর কাছে থাকতে পারবো না। প্লিজ তুমি ওর খেয়াল রেখো। ওকে চিকিৎসা করার জন্য মানাও। ওকে বলো আমি জীবনেও ওর সামনে আসবো না। ওর জীবন থেকে দূরে থাকবো। কেবল ওকে নিজের জীবন আবার নতুনভাবে শুরু করতে বলো। এমন কাওকে খুঁজে নতুন করে সংসার করতে বল যে কখনো ওকে কষ্ট দিবে না। ওর বিশ্বাস ভাঙবে না। আমি ওর জীবন থেকে অনেক দূরে যাব, কিন্তু ওকে খুশি থাকতে বলো।”
কেন যেন কবিতার চোখও নম্র হয়ে এলো। সে চেয়েও চোখের জল আটকাতে পারলো না। সে এবারও কিছু বলল না।

ধ্রুব গেল না। সারারাত সেখানেই বসে থাকলো। তবে কবিতা তাহিরাকে বলে দিয়েছে ধ্রুব চলে গেছে। এই অনুরোধটাও ধ্রুবরই। পরেরদিন ডিসচার্জ করা হয় তাহিরাকে। কবিতা তাহিরাকে জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগও করে তার চিকিৎসার জন্য।

দেখতে দেখতে দুইমাস কেটে যায়। কবিতার জীবনে এই সময়কালেও অনেককিছু হয়। তীর্থের সাথে তার ডিভোর্সের কথা চলছে। তীর্থের উপর আসলেই পুলিশ কেস করেছিলো সে। তাকে ভয় দেখানোর জন্য। বিশেষ কিছু পরিণাম আসে নি। কবিতার ধারণা টাকা খাইয়ে সে ছুটে গেছে। তারপর সে পরকীয়া এবং নারী নির্যাতনের ভিত্তিতে তালাকের জন্য আবেদনও করেছে। তা এখনো হয় নি। তাও কেবল তীর্থের কারণে। এর উপর তার এলাকায় তার নামে বিভিন্ন কথা উঠে। কথাগুলো তার তালাককে নিয়েই। তার চরিত্র নিয়েও গবেষণা করা হয়। এমনকি তার জন্য অনুর চরিত্রেও প্রশ্ন তুলে। এর একটাই কারণ, তার তালাক। এলাকার সবাই জানে সে ডিভোর্সি। এতেই সকলে দুশ্চরিত্রার ট্যাগ দিয়ে দিয়েছে তাকে। কেউ তার স্বামী থেকে আলাদা হবার থাকার কারণ জানে না, জানতেও চায় না। কিন্তু যেহেতু ডিভোর্স হচ্ছে, স্বাভাবিক তারই দোষ। কথা এখানেই থেমে গেলেও ভালো ছিলো। কিন্তু এমনটা হয় না। এলাকার কিছু ছেলেপেলেও তার সাথে খারাপ ব্যবহারে পিছ’পা হয় না। একদিন তো এক লোক ঘরে ঢুকে কবিতার সাথে খারাপ কিছু করারও চেষ্টা করে। কিন্তু কবিতা নিজেকে বাঁচায়, সাথে লোকটাকে মেরে শিক্ষাও দেয়। সেদিন তার মধ্যে এত শক্তি কিভাবে এসেছিলো সে জানে না। তবে এতটুকু জানে জীবনের এত বড় এক পরীক্ষা পেড়িয়ে আসার পর সে আর দুর্বল নয়।

এই ক’মাস কেবল খারাপ গেছে এমনটাও নয়। ভালোও কয়টা জিনিস হয়েছে তার সাথে। তার কাজ ভালো চলছে। যদিও এখনো সে সব ঠিক মতো গুছাতে পারে না। সে তার বোন, বান্ধবী ও ছেলে মেয়ের সাথে ভালোই আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সে তার স্বপ্নের দিকে এগোচ্ছে। নিজের অজান্তেই।
অনুর কলিগ মোহনার জন্য সে যে শাড়ি বানিয়েছিলো তা মোহনা ফেসবুক গ্রুপে আপলোড দেয়। শাড়ির ডিজাইন দেখে অনেকেই কাজ পছন্দ করে। অর্ডার দিতে চায়। এমনকি অফিসের লোকেরাও। অবশ্য কবিতা প্রথমে মানা করে দিলেও পরে খেয়াল করে তার এসব মন্দ লাগছে না। উল্টো শাড়ি নিয়ে কাজ করার সময় তার ভালো লাগে। সকল চিন্তা, অশান্তি ভুলে বসে সে। তার খেয়াল থাকে কেবল শাড়ির ডিজাইনের ভেতর। এমনিতেও বিকেল চারটার অফিস শেষে, ঘরের কাজ এবং বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর পরও তার কাছে সময় থাকে। আজকাল তাদের তাহিরাই পড়াশোনা করায়। তাই টুকিটাকি অর্ডার নেয় সে।

কবিতা আজ অফিস থেকে একটু দেরি করে আসে। যেহেতু আজকাল তাহিরা কাব্যকে স্কুল থেকে আনে তাই তার চিন্তা হয় না। কবিতা বাসায় আসতেই দরজায় তাহিরা তাকে ধমক দেয়, “তোকে ফোন দিচ্ছিলাম। ফোন বন্ধ রাখতে হলে ব্যবহার করিস কেন?”
“ফোনে চার্জ ছিলো না। কী হয়েছে?”
“কাব্য সে স্কুল থেকে বের হয়ে কান্না করেই যাচ্ছে।”
“বলো কি?”
কবিতা তাহিরার কোলে কুহুকে দিয়ে ছুটে গেল কাব্যের কাছে। বেডরুমে যেয়ে দেখে আসলেই কাব্য কাঁদছে। কাব্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে, “কী হয়েছে বাবা তুমি কাঁদছো কেন?”
কান্না বাড়লো কাব্যের। সে ঠোঁট উল্টে বলল, ” আম্মু আজ না টিচার বলেছে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিবে। আম্মু প্রমিজ আমি কিছু করি নি। আম্মু আমাকে বের করে দিলে আমার ফ্রেন্ডসদের কী হবে?”
কবিতা কথাটা বুঝতে পারলো না। হঠাৎ তাকে বের করে দেবার কথা বলা হলো কেন? সে কাব্যের চোখ মুছে বলে, “কাঁদে না সোনা, আম্মু কাল যেয়ে টিচারের সাথে কথা বলবো। ওকে?”
মাথা নাড়ায় কাব্য। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার মা’কে।

সকালে কবিতা স্কুলে যেয়ে প্রথম পিরিয়ডেই দেখা করলো কাব্যের ক্লাসটিচারের সাথে।
“ম্যাম আমি জানতে পারি আপনি কীজন্য কাব্যকে স্কুল থেকে বের করে দেবার কথা বলেছেন? ও কি কোনো দুষ্টুমি করেছে অথবা পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে?”
“না। ওর তো পড়ালেখা ভালোই। আর খুব শান্ত ছেলে।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়? আপনি ওকে বের করার কথা কেন বললেন?”
“দেখুন ম্যাম আপনার এবং আপনার হাসবেন্ডের ডিভোর্স হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আপনি আমাদের এত এক্সপেন্সিভ স্কুলের খরচাপাতি চালাতে পারবেন না। আপনি দুইমাসের বেতনও দিতে পারে নি। বেতন ছাড়াও আরও খরচ আছে। যা আপনার পক্ষে এফোর্ড করা সম্ভব না। আর আমি এখন ওকে এক্সপেল করার কথা বলছি না। সামনের মাসে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা। এরপর নতুন ক্লাসে আপনি ওকে নরমাল কোথাও ভর্তি করতে পারেন। এতে আপনারও সমস্যা হবে না। আমি আপনার কথাও ভাবছি।”
কবিতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল টিচারের দিকে, “আর আপনাকে একথা কে জানাল যে আমি কাব্যের বাবার থেকে আলাদা হয়েছি।”
“মিঃ তীর্থই জানিয়েছে।”
“ওহ, আর আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে আমি আমার ছেলেকে বড় করার যোগ্য নই। কারণ আমি একজন নারী। একজন মহিলা চাকরিজীবি হিসেবে আপনার চিন্তাভাবনা অনেক উন্নত।”
কথাটা শোনার পর মনে হলো কাব্যের টিচার লজ্জা পায়। সে কিছু বলতে নিবে এরপূর্বেই কবিতা বলল, “ম্যাম আমি বুঝতে পারছি না আপনারা কি ছাত্র-ছাত্রীদের এখানে শিক্ষা দিতে বিদ্যালয় খুলেছে না ব্যবসা করতে? এছাড়া আপনি ওদের স্কুলের প্রিন্সিপাল কি জানে যে আপনি এভাবে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে ব্যবহার করেন? আপনার প্রয়োজন হলে আমার সাথে যোগাযোগ করতেন, আমার ছেলেকে এভাবে বলার আগে আপনি এতটুকু বিবেকে আসে নি যে ও বাচ্চামানুষ? ও কতটা কষ্ট পেতে পারে আপনার কথায়? থাক আপনার সাথে আমার কথা বলা লাগবে না, আমি প্রিন্সিপালের সাথেই যেয়ে এই ব্যাপারে কথা বলছি।”
সে উঠে যেতে নিলেই কাব্যের টিচার তাকে থামায়, “ওয়েট। প্লিজ এমন করবেন না।”
“কেন করবো না? আপনার ব্যবহার তার জানা উচিত না? আর কেবল সে কেন আপনাদের এত উন্নত স্কুলের বাচ্চাদের সাথে কেমন ব্যবহার করে তা সকল অভিভাবকদের জানা উচিত।”
“দেখুন প্লিজ এমন করবেন না। আমার চাকরি সমস্যায় পড়ে যাবে।”
“ঠিকাছে। কিন্তু এরপর থেকে এমন কিছু শুনলে আমি চুপ থাকবো না। আর আপনি সঠিক তথ্য রাখুন। আমি এই মাসে বকেয়াসহ বেতন পরিশোধ করে দিয়েছি। আপনি বাচ্চাদের পড়ায় ধ্যান দেন, তাদের ফ্যামিলি মেটারে না।”
এতটুকু বলে সে রাগে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। এত কিছু শোনানোর পরেও তার রাগ কমে না। রাগে কটমট করছিল সে। তীর্থের সাহস কি করে হলো তার ছেলেকে এসবের মাঝে আনার? এতকিছুর পরেও সে তীর্থের বড় কোন ক্ষতি করতে চাই নি। কিন্তু এখন তীর্থ তার ছেলেকে এসবের মাঝে এনে অনেক বড় ভুল করেছে। নিজের জন্য তাকে একবার হলেও ছাড় দিতে পারে, তার সন্তানদের জন্য নয়। তার এই কাজের অনুতাপ তাকে করতেই হবে।

দুইদিন পর,
তীর্থ অফিসে বসে ছিলো। নিজের ব্যবসার হিসাব দেখছে সে। ব্যবসার লাভ অনেকাংশ কমে গেছে। এই নিয়ে সে ভারী চিন্তায় আছে। নতুন কোন ডিজাইন না আসায় তেমনটা কেউ শপেও আসে না। কবিতার উপদেশ দ্বারা তাদের আগের সকল ড্রেসের ডিজাইন নিয়ে কাজ হতো। তার ডিজাইনগুলোর ধরণই ভিন্ন ছিলো। গ্রামীন এবং আধুনিক মিলিয়ে। এই কারণেই তাদের পণ্যের এত চাহিদা ছিলো বাজারে। কিন্তু এখনের করা ডিজাইনগুলো বাজারে অহরহ পাওয়া যায়, তাই তেমন চাহিদা নেই। এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পরেছে সে। তার অনুপস্থিতে যে ক্ষতি হয়েছে তাও এখনো পোষাতে পারে নি। সামনে কি করবে?

অনুমতি না নিয়েই রাহাত জলদি করে ঢুকে পড়ে তার কক্ষে। এমনিতেই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল তার। রাহাতের এই কান্ডে তার সকল চিন্তা রাগ হয়ে বর্ষণ হলো রাহাতের উপর, “হোয়াট দ্যা হেল! এভাবে রুমে ঢুকে পড়ার মানে কী? নিজের চাকরি কি তোমার প্রিয় না যে আদব-কায়দা সব ভুলে গেছ? ”
রাহাত আতঙ্কিত স্বরে বলে, “স্যার এখন এসবের সময় নেই। আপনি জলদি নিউজ দেখুন কি হচ্ছে।”
রাহাত তার ফোনটা দিলো তীর্থের কাছে। আর বলল, “স্যার জলদি কিছু করতে হবে, নাহলে এই একটি খবরে আমাদের ব্যবসা বিরাট বড় ঝুঁকিতে পরতে পারে।”

চলবে…

লেখকের কথাঃ আমি কোনো ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইলাম। আমি আইনগত বিষয় সম্পর্কে বিশেষ একটা জানি না। খোঁজ করে যতটুকু পেয়েছি, তাই দিয়েছি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। এছাড়া আজ হঠাৎ গল্পটা টেনে নিয়ে আসতে হয়েছে নাহয় এতটুকুই অনেক পর্ব হতো, যা পড়তেও ভালো লাগতো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here