#মুহূর্তে
পর্ব-৫১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
বাংলাদেশের বিখ্যাত হস্ত ও কারুশিল্প ‘কর্থী’ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অধিপতি আবদুর রহমান তীর্থের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু তথ্য সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তার স্ত্রী। তিনি তার স্ত্রীকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে আঘাত করেছেন। এছাড়া তার অন্য নারীর সাথে বাজে সম্পর্কও ছিলো। আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও তাকে ন্যায়বিচার দেওয়া হয় নি। তাই বাধ্য হয়ে তিনি সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টা তুলে ধরেছেন। নিম্নে তার প্রকাশ করা ক’টি ছবি দেওয়া হলো।
তীর্থ দেখলো তার ও মৃণার একটি ছবি এবং কবিতা হাতে সিগারেট দিয়ে পুড়ানোর একটি ছবি দেওয়া। রাহাত বলল, “স্যার এটা গতকাল মেডাম সোশ্যাল মিডিয়ার একটি নারী গ্রুপে পোস্ট করেছিলো। সেখান থেকে ভাইরাল হয়ে গেছে। আমাদের ব্যবসার পঁচানব্বই শতাংশ ক্রেতাই মহিলা। সবাই আমাদের ব্রান্ডকে বয়কট করছে। এমনকি ব্যাপারটা নিউজেও আসছে। এমন চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।”
সংবাদটা পড়ে তীর্থের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে মেঝেতে ছুঁড়ে মারে ফোনটা। সেখান থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।
রাহাত তো স্বাভাবিক থাকে কিছু মুহূর্ত। কিন্তু যখন তার মনে পড়ে ফোনটা তার তখন দৌড়ে যেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। সে কাঁদোকাঁদো গলায় নিজেই বলে, “ভাই যা দোষ স্যারের, স্যোশাল মিডিয়াতে দিসে তার বউয়ে, এখানে আমার মাসুম ফোন কী দোষ করল?”
.
.
স্বর্ণালি খেলছিলো কুহুর সাথে। কুহু তাকে ভালোই পছন্দ করে। কবিতা কাজের মাঝে তাদের দেখছিল। স্বর্ণালিকে আগের থেকে খুশি দেখায়। মেয়েটার জন্য মায়া হয় তার, খারাপও লাগলো। এই বয়সে মেয়েরা কলেজের জীবন উপভোগ করে, বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করে, এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখে। অথচ স্বর্ণালি চুপচাপ বসে থাকে এক রুমে। অফিস থেকে বাসায় যেয়ে কয়টা লেডি টিচারের কাছে পড়ে। তার জীবনে কথা বলার লোক খুব কম। এই বিশাল পৃথিবীর মাঝে খুব ছোট তার জগৎ। অবাক লাগে, একটি ঘটনা কিভাবে মানুষের জীবন মুহূর্তেই ওলট-পালট করতে পারে। যেমনটা তার করেছে। তার জীবন পাল্টেছে।
ফোন বেজে উঠে তার। তীর্থের কল। কল দেখে অবাক হয় না সে। সে জানতো তীর্থ কল দিবে। সে এটাও জানে এখন তীর্থ দিশেহারা, রাগান্বিত, আতঙ্কিত। কবিতা আরও কিছু মুহূর্ত এই অনুভূতিগুলো সে অনুভব করুক। টানা পনেরো মিনিট রিং বাজার পর কল।ধরে কবিতা।
“কী সমস্যা?”
“আমার সমস্যা? তোমার কী সমস্যা? তুমি কি আবল-তাবল পোস্ট করেছ সোশ্যাল মিডিয়ায়?”
“আবল তাবল? আমি তো যা সত্য তাই লিখেছ। ইনফ্যাক্ট আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমি এমন কিছু করতে পারি। তাও তুমি নিজের এসব নিচু কাজ বন্ধ করো নি। তোমার কি মনে হয়েছে আমি এতমাসে কিছু করি নি বলে কি সামনে করবো না? না’কি কিছু করতে পারবো না। এ কয়মাস তোমার উপর দয়া মায়া দেখিয়েছি বলে এই ভাববে না আমি দুর্বল। আমার ছেলেকে এইসবের মাঝে এনে তুমি প্রমাণ করে দিলে আমার দয়ারও যোগ্য না তুমি।”
“কাব্য এর মাঝে কোথা থেকে এলো?”
“তুমি এনেছ। কাব্যের ক্লাস টিচারকে কি বলেছ তুমি? তিনি কাব্যকে স্কুল থেকে বের করে দিত।”
“তও আরেক স্কুলে ভর্তি করানো যেত। কোনো বিগ ডিল ছিলো না। তুমি জানো তুমি কি করেছ? এতটুকু বিষয়ের জন্য তুমি আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছ ড্যাম ইট।” চিৎকার করে উঠে তীর্থ।
“খবরদার আমার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলবে না। আমার ছেলের চোখের পানি ছোট বিষয় না। তুমি আমাকে যেভাবে কান্না করিয়েছে সেভাবে আমার বাচ্চাদের সাথে করতে দিব না। আমার বাচ্চাদের সাথে একটা ভুল কিছু করলে তোমার কত বড় ক্ষতি আমি করতে পারি তা তো তুমি দেখেই নিয়েছ। আর গেস হোয়াট এখন আমার এই করণীয় এর পর তোমাকে জেলে পাঠালে তুমি আর টাকা দিয়ে বের হতে পারবে না। তাই তোমার সুবিধার জন্য বলছি ডিভোর্স দিয়ে দেও। তাও আমার শর্তে। তুমি তোমার জীবনে সুখে থাকো আর আমি আমার।”
এতক্ষণ পর তীর্থের কন্ঠ একটু নরম হয়, “ডিভোর্স? তুমি কেন বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। আমি যা করেছি বা করছি সব তোমাকে আর আমার বাচ্চাদের ফেরত পাবার জন্য।”
“সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল পথে কাজ করলে উদ্দেশ্যটাও ভুল হয়ে যায়। আমি যা বলছি তা করো।”
পিছন থেকে তীর্থের মা’য়ের কন্ঠ শোনা যায়, “এই মাইয়া ডিভোর্সের লাইগাই এত কাহিনী করসে। তার দেনমোহরের টাকা লাগবো। এই লাইগা যতসব কাহিনী করে।”
“মা একটু চুপ করবে? আমি কথা বলছি তো।”
কবিতার মেজাজ বিগড়ে যায় তীর্থের মায়ের কথা শুনে। সে বলে, “তোমার মা’কে বলো যে আমার টাকার এত লোভ থাকলে প্রথমত তোমার সাথে বিয়ে করতাম না। বিয়ের পর যখন তুমি ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলো তখন বিলাসিতার সাথে রাজত্ব করতাম। আর তোমার পরকীয়ার পর তোমাকে ছেড়ে এসে এত সমস্যার মুখোমুখি হতাম না। তাকে এটাও বলো, যদি আমি টাকার দাবি করি তাহলে তা আমার অধিকার হবে। কারণ আজ তুমি যে পর্যায়ে আছো আমার কারণে আছো। তুমি নিজের পরিশ্রম দিয়ে এত বড় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছ এটা যেমন সত্যি তেমনি আমার উপদেশে তোমার সকল কাজ চলেছে এটাও সত্যি। কর্থী শুরুটা আমার কথায় করেছিলে, ডিজাইন সব আমার ছিলো, সব পণ্য আমি বাছাই করেছিলাম। তোমার মা’কে মনে করিয়ে দিবে কথাগুলো। এতবছর আমি এসব বিষয়ে কোনো কথা বলিনি। উনি বেশি করলে এই বিষয়েও ছাড়বো না। আজ আমি না থাকলে তুমি আগের জায়গাতেই থাকতে। একচুয়ালি ওটাই ভালো হতো। অন্তত তোমার মাঝে টাকার এত অহংকার আসতো না। আগের তীর্থের মতোই থাকতে যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।”
“তুমি আজও আমাকে ভালোবাসো কবিতা।”
কথাটা শুনে নিজের উপরই বিরক্ত লাগে কবিতা। কথাটা সত্য এবং এই সত্য কথাটা তার সহ্য হয় না। সে কেবল বলে, “ডিভোর্স পেপারে জলদি সাইন করে দিও।”
“একটা পেপারে সাইন করলেই তোমার মনে আমার জন্য যে ভালোবাসা আছে তা শেষ হয়ে হয়ে যাবে না। আর না আমার হৃদয় থেকে তোমাকে মুছতে পারবে।”
“আমি চাই না তুমি আমাকে হৃদয় থেকে মুছে দেও। তোমারও তো নিজের ভুলে আমাকে হারানোর আফসোস করা প্রয়োজন। তাও সারাজীবনের জন্য।”
বলেই কবিতা ফোন কেটে দেয়।
তীর্থ বিছানায় বসেছিলো। মা কবিতাকে বকতে বকতে সেখান থেকে চলে গেলেন। কবিতার ফোন কাটার পর সে চোখ বন্ধ করে হেলান দেয় দেয়ালে। মাথা ঘুরছে। সবকিছু আবছা দেখছে সে। কি হয়ে গেল তার সাথে? তার এত সুন্দর জীবনটা এমন বিশ্রী হয়ে গেল কীভাবে? তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার জীবনের এক ঘটনা।
তখন নতুন ব্যবসা শুরু করেছিলো সে। কবিতা প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঘরে অভাব অনাটনও ছিলো কিছুটা। তবে ব্যবসার শুরুর পর প্রথম লাভ হয় তাদের। সে লাভের তীর্থ তার মা এবং কবিতার জন্য শাড়ি আনে। খুবই সাধারণ শাড়ি। কিন্তু তা দেখে কবিতার খুশির ঠিকানা থাকে না। সে জলদি করে শাড়িটা পড়ে এসে দাঁড়ায় তীর্থের সামনে। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিলো তাকে। তীর্থ তাকে কোলে তুলে ছাদে নিয়ে গেল। নিশি রাত ছিলো। চন্দ্রিমা এঁকে ছিলো আকাশের বুকেতে। চারদিকে হাল্কা শীতল হাওয়া। একটি চাদর বিছিয়ে কবিতাকে বুকে ভরে সে বলেছিলো, “জানো আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিলো তুমি শাড়ি পরে থাকবে। আর আমি তোমার হাত ধরে পাশে হাঁটবো। অথচ দেখ, আজ তুমি আমার বুকে। কত সুন্দর মুহূর্ত তাই না?”
“খুব।”
“আমি ভেবেছিলাম আল্লাহ সবার স্বপ্ন পূরণ করে, আমার করে না কেন? আজ বুঝলাম, আল্লাহ যখন সময় আসে তখন চাওয়া থেকেও বেশি দেয়।”
কবিতা তার বুকের থেকে উঠে বলে, “কখনও এইসবেত অনাদর করবে না বুঝলে? আল্লাহ প্রথমে দিয়ে পরীক্ষা করে মানুষ সামলাতে পারে না। যদি তার বান্দা এসব সামলাতে না পারে তাহলে তার থেকে সব ছিনিয়ে নিতেও মুহূর্ত লাগে না।”
তীর্থ কবিতার দুইগালে হাত রেখে হাসে, “আমি সবার পূর্বে তোমাকে সামলে রাখবো। তুমি আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।” বলে চুমু খায় সে কবিতার কপালে। আর পরিবর্তে কবিতা মনোহর এক হাসি দেয়। সে হাসিতে আবারও মুগ্ধ হয় তীর্থ। আবারও প্রেমে পড়ে।
মা’য়ের কন্ঠে চোখ খুলে তীর্থ, “এই তীর্থ তোর লগে কেউ দেখা করতে আইসে।”
তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুকের ভেতর ব্যাথা করছে তার। এত পরিবর্তন হয়ে গেছে সে এই ক’টি বছরে? এতটা? তার করা সকল ওয়াদা ভুলে গেছে, হারিয়ে গেছে ভুলের জগতে। এমন তীর্থ হয়ে গেছে যে সে কখনো ছিলো না। না সে কবিতাকে খুশি দিতে পারলো, আর না সে তার যত্ন নিতে পেরেছে। আর না তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিয়েছে। দিয়েছে তো শুধু কষ্ট ও বিশ্বাসঘাতকতা।
আবারও ডাক পড়ে তার মা’য়ের। সে উঠে যায় দরজার কাছে। দরজার বাহিরে কথনকে দেখে একটু ধাক্কা খায় সে। কিন্তু রাগও উঠে। আজ এতবছর পরও তার কথনকে সহ্য হয় না। এর সঠিক কারণ সে নিজেও জানে না। কথন কখনো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু তা শুরু থেকেই মনে হতো সে কবিতাকে ভালোবাসে। অন্যকেউ কবিতাকে ভালোবাসবে এটা তার কখনোই সহ্য হয় না। সে আজও বিরক্ত হয়ে কথনকে জিজ্ঞেস করে, “কী প্রয়োজনে এসেছেন?”
.
.
কবিতা আজ বেশি কাজ থাকায় একটু দেরি করেই আসতে হলো তার। যেহেতু তাহিরা ঘরে আছে তাই চিন্তাও হয় না তার। অনু এবং কবিতা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তাদের কথা বলতে থাকে, “ওয়াও, বড় মেডাম তোকে স্বর্ণালির জন্য বার্থডে ড্রেস ডিজাইন করতে দিয়েছে? আমি শুনেছি ম্যডাম তার মেয়েকে বড় ডিজাইনারদের ড্রেসই পরায়।”
“ভাবছি আমিও স্বর্ণালিকে একটা ড্রেস উপহার দিব। মেয়েটা এ কয়দিনে আমার খুব কাছের হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ওর জন্য খারাপও লাগে। এছাড়া বড় ম্যাডাম আমার জন্য এতকিছু করেছে আমি তো এতটুকু করতেই পারি।”
বেডরুমে যেয়ে কবিতা খানিকটা দ্বিধাবোধ করে অনুকে বলে, “আচ্ছা শুন।”
“বল।”
“আমার তো ড্রেসের এখান থেকে ভালো টাকা আসছে। যেখানে আমি ভালো করে সেখানে সময় দেই না, উপযুক্ত সময় দেই না সেখানেই ভালো আয় আসে। যদি সম্পূর্ণ সময়টা….”
“এসব চিন্তা মাথায়ও আনিস না। যে চাকরি করছিস সেখানে মাসশেষে অর্থের নিশ্চয়তা থাকে। ব্যবসায় আজ রাজা কাল ফকির এমন অবস্থায়। আর সেখানে কাজও অনেক। পরে তুই এত কাজ সামলাতে সামলাতে অসুস্থ হয়ে পরবি।”
“তাও ভালো। অফিসের ফাইল দেখলে মাথা ঘুরায় আমার। এর উপর কাজের কচুও বুঝি না। যে কাজের জন্য মেডাম বেতন দেয় তা যখন ঠিক মতো করি না তাহলে বেতন কিসের জন্য নেই? বেতন নেওয়ার সময় মনে হয় এই টাকা আমাকে দয়া করে দেওয়া হচ্ছে। যার আমি যোগ্য না।”
“তোকে আমি কয়টা বই এনে দিব। তা পড়লে কাজ বুঝতে সহজ হবে।”
“বই? জীবনে স্কুল কলেজে বই ধরে পড়তে বসি নি। এখন বসবো? তুই তো জানিস বই দেখলে আমার মাথা ঘুরায়।”
সাথে সাথে পিছন থেকে একজন বলে, “আর প্রেগন্যান্ট প্রেগন্যান্ট লাগে তাই না?”
কবিতা পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় কথনকে। তার মুখে কথাটা শুনে লজ্জা লাগে কবিতা। অতীতের বাচ্চামো কথাবার্তা মনে করে। অনু উঠে দাঁড়ায় কথনকে দেখে, “আরে ভাইয়া আপনি কখন এলেন?”
“এলাম তো অনেকক্ষণ হলো। কাব্যের সাথে খেলছিলাম। তোমাদের কন্ঠ শুনে আসলাম।”
অনু সুযোগ বুঝে দু’জনকে একা ছেড়ে দেবার জন্য কুহুকে কোলে নিয়ে বলে, “ভালো করেছেন। আপনি কবিতার সাথে বলুন আমি চা বানিয়ে আনছি।”
অনু যাবার পর কবিতা হেসে বলে, “এক জীবন কেটে গেল এই মেয়েকে রান্নাঘরের কাজ করতে দেখলাম না। আপনি আসলেই ওর রান্নাঘরের ঠিকানা মনে পড়ে।”
সে কথন এর দিকে তাকাতেই তার চোখ পড়ে কথনের মুখের আঘাতে। তার মাথায়, গালে ও ঠোঁটের নিচে লালচে হয়ে আছে। সে কথনের কাছে যেয়ে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “আপনার এ অবস্থা কেন?”
কবিতা হাত উঁচু করে কথনের কপাল ছুঁতে নিলেই সে হাত ধরে নেয়। কবিতা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। কথনের দৃষ্টি শীতল। সে খানিকটা ঝুঁকে আছে কবিতার দিকে। আলতো করে তার ঘাড়ের চুল সরায়।
কবিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। চমকে উঠে। কথন আগে কখনো এমন কিছু করে নি। কিছু বুঝে উঠতে পারে না কবিতা। সে এতটা চমকে উঠেছে যে কথনকে সরাবে তাও পারছে না।
কথন কবিতার ঘাড়ে দাগ দেখে সে অংশ ছুঁতেই কবিতা লাফিয়ে উঠে। সাথে সাথে সরে যায়। কিন্তু কথন হাত ধরে রাখায় বেশি দূরে যেতে পারে না, কথন আবার তাকে কাছে টেনে নেয়। কথন কবিতার জামার হাতা কনুই পর্যন্ত নিতে তার হাতও দেখে। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “কবে এমন করেছে?”
“হঁ?”
“জিজ্ঞেস করছি কবে এমন করেছে?”
“দু..দুইমাস আগে।” কবিতা আমতা-আমতা করে বলে।
“তুমি আমাকে বলো নি কেন?”
কবিতা চোখ নামিয়ে নেয়। কথন তার এত কাছে থাকায় কেমন যেন সংকোচন অনুভব হচ্ছে।
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।” কথন অনেকটা ধমক দিয়ে বলে। কবিতা খানিকটা কেঁপে উঠে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন?”
কবিতার এমন ভাবে বলাতেই কথনের রাগ গলে যায়। সে নিজেকে খানিকটা শান্ত করে। কবিতার হাত ছেড়ে বলে, “বলো তাহলে আমাকে এ ব্যাপারে জানাও নি কেন?”
“ভালো হয়েছে জানাই নি, নাহলে তো আপনি তো পরে আরও ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। আর যেয়ে যদি তীর্থকে…”
“তীর্থকে?” কথন চোখজোড়া ছোট করে নেয়। সে কবিতার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “তীর্থের জন্য তোমার এখনো এত চিন্তা। ও তোমাকে এত আঘাত করেছে তাও?”
কবিতা ভয়ে খানিকটা পিছনে যায়। কিন্তু কথন ঠিকই সামনে এগোয়। পিছনে জায়গা বেশি না থাকায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। কথন তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সে কবিতার পাশের দেয়ালে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে বলে, “তোমার মনে হয় না তোমার ওর চিন্তা করা ছাড়া উচিত? ও তোমাকে অনুভূতির দিক থেকে আঘাত করেছে। সাথে মানসিক এবং শারীরিকভাবেও। এরপরও তুমি তার কথা কীভাবে চিন্তা করতে পারো?”
কবিতা তাকায় তার দিকে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, “অনুভূতি কি এত সহজেই খাঁচাতে বন্দী করা যায়? আপনিও তো একটি মেয়েকে পাবেন না জেনেও এত বছর থেকে ভালোবেসে এসেছেন। আপনার তো কথাটা বুঝা উচিত। তাই না?”
কথন কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। কিছুটা রাগ উঠে। খানিকটা অভিমানও হয় তার। কেবল তীর্থের কথাই কী তার মাথায় এলো?
এক ঢোক গিলে সে। বলে, “ডোন্ট ওয়ারি। বেশি হার্ট করি নি। ও ঠিক আছে। ও তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে জেনে নিজেকে সামলাতে পারি নি।”
বলে কথন ফিরে যেতে নেয়। তখনই কবিতা তার হাত ধরে নেয়। চিন্তিত গলায় বলে সে, “আপনার হাত দেখে মনে হচ্ছে রক্ত পরেছে। আপনি ব্যান্ডেজ করেন নি কেন?”
“তোমার কী?” বলেই কবিতার হাত থেকে সে হাত সরিয়ে নেয়।
“আপনার আজ হলো কি? আপনি তো কখনো এমন ব্যবহার করেন নি।”
“আমি তো কখনো ভাবিও নি যে তুমি আমার থেকে এত নিঁখুতভাবে নিজের ক্ষত লুকাবে। ঠিকই তো আমি তোমার কে হই?”
“আপনি এমন বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করছেন কেন? আমি আপনাকে চিন্তায় ফেলতে চাই নি কেবল।”
হঠাৎ করে কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা যায়। সাথে অনুর চিৎকারও। চমকে যায় কবিতা। চিন্তিত সুরে বলে, “অনুর কন্ঠ? কি হলো ওর?”
“এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখতে পারবে না’কি? চলো।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৫২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
হঠাৎ করে কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা যায়। সাথে অনুর চিৎকারও। চমকে যায় কবিতা। চিন্তিত সুরে বলে, “অনুর কন্ঠ? কি হলো ওর?”
“এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখতে পারবে না’কি? চলো।”
অনুর খোঁজে কবিতা পৌঁছায় ড্রইংরুমে। অনু স্থির হয়ে দাঁড়ানো। তার পায়ের কাছে কাঁচের টুকরো পরা। কবিতা তার কাছে এসে বলল, “তুই ঠিক আছিস?”
কবিতার কথা শোনার পর অনু লাফিয়ে পিছিয়ে যায়। তারপর নিজেই বলে, “ওহ আমার হাতে তো পানির গ্লাস ছিলো। আমি ভেবেছিলাম গরম চা আছে। ভেবেছি তা লেগে পা পুড়ে গেছে। সরি।”
“তুই পাগল?”
কবিতা বিরক্ত নিয়ে চোখ ফিরাতেই তার নজর যায় রুমের অন্যপ্রান্তে দাঁড়ানো আবিরের উপর। আবিরকে দেখে তার চক্ষু কপালে উঠে যায়। সে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। আজ এতবছর পর তার ভাইকে সামনা-সামনি দেখে আবেগ সামলাতে পারে না সে। কান্নায় ভেঙে পড়ে। আজ এতবছর পর সে তার পরিবারের কাওকে এত কাছে পেয়েছে। অনেকক্ষণ কবিতা আবিরকে ধরে ছিলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে আবির তার এবং তীর্থের সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর আবির হঠাৎ বাংলাদেশে কীভাবে? সে আবিরকে ছেড়ে মুখ তুলে তাকায়। আবিরও আবেগী হয়ে পড়েছিলো এতবছর পর য়ার আদরের বোনকে দেখে। সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, “তুই এত কষ্ট সহ্য করছিস অথচ আমাকে জানানোটাও উচিত মনে করিস নি?”
অর্থাৎ আবির সব জানে? কবিতা সর্বপ্রথম তাকায় অনুর দিকে, “তোকে মানা করেছিলাম অনু।”
“তোর কেন মনে হলো আমি বলেছি?”
“বলিস নি?” রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে কবিতা। ভয়ে অনুর কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে আমতা-আমতা করে বলে, “মানে বলেছি কিন্তু তুই প্রথমেই আমার নাম নিবি কেন? অন্যকাওকেও তো সন্দেহ করতে পারতি।”
“তোর পেট যে কত পরিষ্কার আমার জানা আছে। একটা কথাও জমা থাকে না পেটে।”
অনু মুখ ফুলিয়ে নেয়। কথন বলে, “ও একবারে ঠিক করেছে। তোমার নিজে আবিরকে সব জানানো উচিত ছিলো। একটি মানুষের সবচেয়ে বড় সাপোর্ট তার পরিবার। আজ আবিরকে দেখে তোমার মন হাল্কা লাগছে না?”
কবিতা উওর দেয় না। কথন ঠিক বলছে। তার ভালো লাগছে। মন হাল্কা লাগছে আবিরকে দেখে। আবিরকে কাব্য এবং কুহু আগে ভিডিও কলে দেখলেও এই প্রথম তাদের সামনা-সামনি দেখা। এই নিয়ে খুব উৎসুক কবিতা। আগ্রহ নিয়ে পরিচয় করালো কাব্য এবং কুহুকে তাদের মামার সাথে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া কখন এসছ তুমি?”
“আমি বিকেল থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি। আজ সকালে বাংলাদেশে এসেছি। কথনের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। ওই নিয়ে এসেছে। অনু ওর নাম্বার দিয়েছিলো।”
“অনুও জানতো না তুমি আসবে তাই না? ওর প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
কথন অনুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। কবিতার কথা শুনে সে তার দিকে তাকাল। তাকে কেমন যেন অস্বস্তিতে ভুগতে দেখলো কথন। বারবার চুল ঠিক করা, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা, হাতের আঙুল দিয়ে খেলা করা ইত্যাদি । কথন হেসে মৃদু গলায় অনুকে জিজ্ঞেস করে, “শালী সাহেবা আপনার আর আবিরের কিছু চলছে না’কি?”
চমকে উঠে অনু, “আ..আমার আর আবির ভাই-ভাইয়ার? না না কি যে বলেন দুলাভাই! উনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“ওহ আমি আরও ভাবলাম তোমাদের মধ্যে কুচুরমুচুর কিছু চলছে। মানে প্রেমটেম আরকি। বাই দ্যা ওয়ে, আবির রাস্তায় বলল তার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। কয়েকবছর ধরেই।”
“কী?” বিস্ময়ে উঁচু স্বরে বলে ফেলে অনু। তার কন্ঠ শুনে সবাই তাকায় তার দিকে। সবার এমন তাকানো দেখে সে জোরপূর্বক হেসে বলে, “আমার একটা কাজ মনে পড়ে গেছে হঠাৎ। আমি আসি।” বলেই সে দৌড়ে গেল।
আবিরের সবার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর কবিতা উঠে গেল। কথন দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো। যাবার সময় কথনকে বলল, “আপনি আমার সাথে আসুন।”
“কেন?”
“এত প্রশ্ন করছেন কেন? আসুন।”
কথন কবিতার পিছু যায়। তাদের দেখতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় অনু। কবিতা আলমারি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করে কথনের পাশে বসে। তার হাতে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলে, “নিজে ডাক্তার অথচ এতটুকু জানেন না যে এভাবে ক্ষত খোলা রাখা উচিত না। আপনার হাতে রক্ত জমে আছে। করেছেনটা কী আপনি?”
“তুমি কি আমার জন্য চিন্তা করছ?”
কবিতা তাকায় কথনের দিকে। কথন ভ্রু নাচিয়ে আবার একই কথা জিজ্ঞেস করে। কবিতা বিরক্ত হয়ে ইচ্ছা করেই স্যাভলন লাগানো তুলাটা জোরে চাপ দেয় তার হাতে। এতেই কথন লাফিয়ে উঠে, “করছোটা কি তুমি?”
“বেশি কথা বললে এমনই করবো।”
“জালিম মহিলা।”
“কি বললেন আপনি?” বলে আবারও চাপ দেয় হাতে।
“আরে বাবা কিছু বলি নি।”
“আপনি এমন কেন করলেন বলেন তো। কোনো প্রয়োজন ছিলো না।”
“সে তোমাকে আঘাত দিবে কেন? এত সাহস কোথা থেকে পেল? আমার সহ্য হয় নি। মাথা গরম ছিলো তাই চলে গেছি। তবে তোমার চিন্তার বিষয় নেই, তাকে বেশি মারতে পারি নি। লোক এসে ধরে নিয়েছিলো।”
কবিতা একবার আড়চোখে তাকায় কথনের দিকে। আবার হাতে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করে, “আপনিও তো ব্যাথা পেয়েছেন। আপনার হাতে কী কাঁচ লেগেছিলো?”
“আরে হয়েছে কি ওকে ঘুষি মারতে গিয়েছি আর সে সরে গেল। পিছনে কাঁচ ছিলো। একদম হাতে লেগেছে।”
কবিতা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায়, “আর আপনি তা ব্যান্ডেজও করান নি। ইনফেকশন হয়ে যাবে না?”
“তোমাকে যে পুড়িয়েছিল তার চিকিৎসা করেছিলে? দাগ দেখে তো মনে হয় না।”
“আপনি বারবার আমার কথা মাঝখানে আনছেন কেন? আমার সহ্য করার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“কেন তোমার সহ্য করার অভ্যাস হবে? ওয়েট সে কি আগেও তোমাকে….”
“না, এই প্রথম। আর আপনার এই বিষয়ে আর চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তার সাথে যা করা উচিত ছিলো আমি করেছি।”
কবিতা কথনের হাত ব্যান্ডেজ করে উঠে দাঁড়ায়। তার কপালের ক্ষত স্থানটি পরিষ্কার করতে থাকে। কথন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অনেক বছর ধরেই কবিতাকে এত কাছের থেকে দেখছে সে। আগের সৌন্দর্য কিছুটা হারিয়ে গেছে তার। অথচ আগের থেকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে তাকে। এমন সময় কথন বলে, “তোমার এখন থেকে অন্যের কথা শোনা বন্ধ করে নিজের মনের কথা শোনা উচিত।”
“আর কি বিষয়ে তা বলছেন?”
“তোমার এবং অনুর কথা শুনলাম। তোমার যা ভালো মনে হয় তা করো। যে কাজে তোমার ভালো লাগে তা করলে সে কাজে তোমার মন লাগবে। আর সে কাজে তুমি নিজের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করবে। তুমি অনেক উন্নতিও করতে পারবে।”
“আপনার এমনটা মনে হয়?”
কথন মাথা নাড়ায়, “মনে হয় না। আমি জানি।”
কবিতা একগাল হাসে। সে তাকায় কথনের দিকে। কথন তাকিয়ে ছিলো তার দিকেই। চোখে চোখ মিলতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। পিছিয়ে যায় একটু। কেমন অদ্ভুত লাগে তার কথনের দৃষ্টি দেখে। এমনই গভীর দৃষ্টির দর্শনে সর্বনাশ হয়েছে তার একবার। দৃষ্টি অনুভূতিময়। পবিত্র। কিন্তু নিশ্চয়ই কথন সে উদ্দেশ্যে তার দিকে তাকায় নি। তারা তো কেবল ভালো বন্ধু। তাহলে তার আজ কেন মনে হচ্ছে কথনের তার প্রতি আলাদা কোনো অনুভূতি আছে?
.
.
গভীর রাত। ধ্রুব কল দিয়েছিল কবিতাকে, সে ধরে নি। হয়তো ব্যস্ত। ধ্রুব প্রতিদিনই কল দিয়ে তাহিরার স্বাস্থ্যের খবর নেয় কবিতার থেকে। ব্যাপারটা তাহিরা জানে না। সে জানতে দিতেও চায় না। তার চারপাশে নির্জন অন্ধকার। এই অন্ধকারে ডুবে আছে একা সে। চারদিকের এই নিরবচ্ছিন্নতা তার ভেতরটাকে কেমন শূন্য করে দিচ্ছে। সে শুনেছিলো নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার না’কি ভয়ংকর। আজকাল এই ভয়ানক পরিবেশেই তার দিন রাত কাটে। সে বিছানায় শোয়া। তার বুকের মাঝারে তাহিরার এক ফটোফ্রেম। একসময় তাহিরা তাকে আবদার করেছিলো তাকে যেন সবসময় বুকে নিয়ে ঘুমায়। অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। আজকাল এমনিতেই ঘুম হয় না তার৷ এর উপর তার কাছে নেই তাহিরা। অবশ্য তাহিরাই তাই নির্ঘুম রাত কাটানোর কারণ।
তাহিরা তো তার কাছে নেই। তার ছবি দিয়েই হৃদয়ের শূন্যতা খানিকটা কমে আসুক।
.
.
তিনদিন পর,
আইদ ঘুমাচ্ছিলো। মধ্যরাতে তাকে ডাকতে শুরু করে মৃণা। মৃণার অবস্থা দেখে আইদ উঠেও যায়। এটা নতুন কিছু নয়, প্রায়ই মৃণার মধ্যরাতে ক্রেভিং হয় কিছু খাওয়ার। আজও তাই। আইদ উঠে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করে, “কিছু লাগবে তোমার?”
“আইস্ক্রিম খাব।”
“এত রাতে? ঠান্ডা লেগে যাবে। ঠান্ডা লাগলে বাচ্চার সমস্যা হবে।”
“না আমি খাব, খাব, মানে খাবই।”
“আচ্ছা ফ্রিজে আছে। আমি এনে দিচ্ছি।”
আইদ আনতে যাবার পর মৃণা তার পেটে হাত রেখে বলে, “ইশশ সোনা লাথি মারে না। বাবা এক্ষুনি আইস্ক্রিম নিয়ে আসবে। মা’কে বিরক্ত করে না।”
গর্ভে বাচ্চা আবার নড়াচড়া করতেই মৃণার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। সে বসে সোফায়। আজকাল তার সব ভালোই লাগে। বিশেষ করে মা হবার অনুভূতি। এত সুন্দর অনুভূতি সে আর কখনো অনুভব করে নি। হাজারো মূল্যবান জিনিস পেয়েও হয়তো এই অনুভূতির সাথে তুলনা হবে না। যেদিন সে তার গর্ভে একটি প্রাণ অনুভব করতে পারলো সেদিন তার যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলো সে। অথচ এই সুখের জন্য সে কতশত ভুল করে বসলো।
আইদ মৃণাকে আইস্ক্রিম এনে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে তার আইস্ক্রিম শেষ হবার। মৃণা আড়চোখে তাকাতে থাকে আইদের দিকে। মানুষটা অদ্ভুত। একরুমে থাকা সত্ত্বেও একদিনও তার কাছে আসার চেষ্টা করে নি। তার জন্য না হোক, তার বাচ্চার জন্য যা পেরেছে করেছে। তা টাকা দিয়ে হোক অথবা চাওয়া পূরণের দিক থেকে। যেখানে বাচ্চার আসল বাবা একটিবার কল করে তার খবর নেয় নি। তার মা’য়ের খেয়াল এমনভাবে রাখে যেন তার আপন মা। এমন মানুষ আজকাল এ পৃথিবীতে পাওয়া যায়? আচ্ছা মানুষটা কি আজও তাকে ভালোবাসে? সে কি তাকে এবং তার বাচ্চাকে মেনে নিবে?
মৃণা আইস্ক্রিম একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ায়। আইদকে জিজ্ঞেস করে, “মা বলেছে আপনি কালকে আমাকে নিয়ে অফিসে পার্টিতে যাবেন। আমি কোন শাড়ি পরবো কাল?”
আইদ কপাল কুঁচকে নিলো, “আমি তো তোমাকে বলিনি আমার সাথে যাচ্ছো। দেখো মৃণা, আমি কেবল বাচ্চার এবং আমার পরিবারের জন্য চুপ আছি, নাহলে আমি তোমাকে দুই চোখেও সহ্য করতে পারি না। আমার সাথে অধিকার জমিয়ে কথা বলতে আসবে না। ওকে?”
আইদ সামনে এগোতেই মৃণা তার হাত ধরে নিলো, “আমি জানি আপনি আমায় আজও ভালোবাসেন। কেন অতীত ভুলে আমরা ভবিষ্যতে এগোতে পারি না? আমি জানি আপনি এই বাচ্চাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে। ও আপনার রক্ত না তাও। প্রতিদিন ওর সাথে এসে কথা বলেন। আমার এত যত্ন নেন। তাহলে কি সমস্যা?”
“সমস্যা তুমি। ভুল ধারণা রাখবে না যে আমি তোমার যত্ন নেই। আমি যা করি বাচ্চার জন্য করি। আমি এই বাচ্চাকে আপন করে রাখতে পারবো, তোমাকে না। আর আমি তোমাকে ভালোবাসি? সে ভালোবাসা কবে হারিয়ে গেছে। যে মুহূর্ত আমি তোমার সামনে থাকি সে মুহূর্তেই তোমার প্রতি আমার মনে ভালোবাসা কমতে থাকে এবং ঘৃণা বাড়তে থাকে।”
আইদ নিজের হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তখনই মৃণা বলে, “আপনার জীবনে অন্যকোনো মেয়ে আছে?”
আইদ প্রশ্নটা শুনে থেমে যায়। কিন্তু ফিরে না মৃণার দিকে, “থাকতেই পারে। এতে তোমার কী?”
বারান্দায় চলে যায় আইদ। সেখানেই দাঁড়িয়ে রয় অনেকক্ষণ ধরে। আকাশের বুকে রাতের অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসে সূর্যের আলো। সে দেখে মৃণা বিছানায় শুয়ে পড়েছে। কিছু না বলে সে-ও সোফায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরেরদিন স্বর্ণালির জন্মদিন। প্রতিবছর এইদিনে উৎসব হয় অফিসে। যদিও স্বর্ণালিকে আনা হয় না। তবুও বড় করেই পার্টি হয় তার জন্মদিনের উপলক্ষে। অফিসের মানুষদের সাথে সাথে তাদের পরিবারের লোকেদের দাওয়াত করা হয়। আজও সেখানে সবাই আছে। কেবল কবিতা ছাড়া। সে স্বর্ণালির বাসায় গেছে। অফিসে কবিতাই একমাত্র ব্যক্তি যে বড় ম্যাডামের বাসায় গেছে। অবশ্য তার বাসায় যাবার কারণ হলো স্বর্ণালি এবার তার জন্মদিনে কবিতা এবং কুহুর সাথে কেক কাটতে চায়।
.
.
মৃণা সকাল থেকে তার রুম থেকে পা বের করে নি। আর আইদের যাবার পর থেকে সে একটানা কেঁদেই যাচ্ছে। আইদের মা এবং তার মা তার কান্না থামাতে ব্যস্ত। প্রথমে তারা ভাবে প্রেগন্যান্ট হবার কারণে এমন ব্যবহার করছে সে। কিন্তু পড়ে বুঝতে পারে কোনো গম্ভীর ব্যাপার আছে। আইদের মা জিজ্ঞেস করে, “মা তুমি বলো কি হয়েছে আমি বাকিটুকু দিকে দেখবো। আইদ তোমাকে কিছু বলেছে? বকা দিয়েছে?”
“মা…মা উনার অন্যকোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। একারণে উনি ক’মাস ধরে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছেন না।”
কথাটা শুনে একটু নড়ে উঠে আইদের মা, “অসম্ভব। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আইদ এমন ছেলে না।”
“ওটাই তো। সে এমন না। তবুও কয়েকমাস ধরে আমাকে অবহেলা করছে। আপনারা…আপনারা দুইজন নিশ্চয়ই তা খেয়াল করেছেন। আমি নিশ্চিত ওই মেয়েটা আইদকে আমার বিপক্ষে ভুলভাল বলছে। তাই সে আমার সাথে এত বাজে ব্যবহার করছে, নাহলে আমার হাজার ভুল হলেও সে কখনো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি।”
এইবার চিন্তায় পরে গেল দুইজন। কথাটা সত্য। তারাও খেয়াল করেছে আইদ গত ক’মাস ধরে মৃণা থেকে দূরে দূরে থাকছে। বেশিরভাগ সময় বাহিরে কাটাচ্ছে। মৃণার মা এইবার ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন নিজের মেয়েকে নিয়ে। তার স্বামীও এই পৃথিবীতে নেই। তার মেয়ের সাথে বাজে কিছু হলে কি করবে সে?
আইদের মা জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা কে?”
“চিনি না। তবে মনে হচ্ছে অফিসের। মা বিশ্বাস করেন মাঝেমধ্যেই মেয়েটার কল আসে। আর সে আমাকে ছেড়েই কথা বলতে চলে যান। একবার ফিরে তাকায়ও না।”
মা কিছু বললেন না। সোজা উঠে গেলেন বাহিরে। ফিরে এলেন একটি কার্ড নিয়ে। বলে, “পার্টির ঠিকানা লেখা আছে কার্ডে। আজ যেয়ে দেখেই নেই সে কোন মেয়ে যে আমার ছেলে আর বৌয়ের সংসারে অশান্তি করছে।”
মৃণা চমকে উঠে, “আজ যাবেন? উনার অফিসে সমস্যা হবে না?”
“হোক। আনরা এখুনি বের হবো। আইদের সাহস কত বড় সে বৌ ঘরে থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সাথে….ছিঃ! ভাবতেই ঘৃণা করছে। ওকে আজ উচিত শিক্ষা দিব। আসো।”
আইদের মা মৃণাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন।
.
.
পার্টিতে গান চলছে। অনুর মন আজ খারাপ। সে এত সুন্দর করে তৈরি হয়েছিলো আবিরকে দেখাবে বলে। অথচ বের হবার সময় কবিতা তাকে জানায় আবির তাদের সাথে আসবে না। সে গেছে তার এক্সের সাথে দেখা করতে। সে থেকেই অনুর মন খারাপ। আইদ তার পাশে এসে বলে, “আজ কোন দিক দিয়ে সূর্য উঠলো? রেডিও মতো চলা মুখটা আজ বন্ধ যে?”
“জ্বালাস না তো। ভাল্লাগছে না। যা এইখান থেকে।”
“হলোটা কী? তোমার রোমিও তোমার থেকে বিরক্ত হয়ে পালিয়ে গেছে না’কি?”
“মাইর দিব। যা এইখান থেকে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, মুড খারাপ করে লাভ নেই। সবাই নাচছে। আমরাও নাচি।”
“ভাই দেখ বিরক্ত করিস না যা এইখান থেকে।”
আইদ একপ্রকার জোর করেই অনুকে ডান্স ফ্লোরে নিয়ে আসে। তার সামনে আজবভাবে নাচতে থাকে সে। একসময় অনু আর পারে না। নিজেও হেসে দেয়।
এমন সময় দরজা দিয়ে প্রবেশ করে মৃণার সাথে তার মা এবং আইদের মা। ঢুকতেই সবার পূর্বে মৃণার চোখ আইদের দিকে যায়। মৃণার চোখ কপালে উঠে যায়। আইদকে একটি মেয়ের সাথে এভাবে হাসতে দেখে গা জ্বলে উঠে তার। কোথায় তার সাথে তো কখনো এভাবে হেসে কথা বলে নি আইদ। এর উপর মেয়েটার হাতও ধরে রেখেছে। মৃণা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত সেখানে যেয়ে মেয়েটাকে নিজের দিকে ফেরায়। না ভেবেচিন্তে এক চড় বসিয়ে দেয় তার গালে, “তোর সাহস কীভাবে হলো আমার স্বামীর এত কাছে আসার?”
মুহূর্তে গান বন্ধ হয়ে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় মহল। অনু কিছু মুহূর্তের স্তব্ধ হয়ে যায়। কি হলো তার বোঝার জন্য সময় লাগছে তার।
মৃণা আবারও বলে, “তুই সে মেয়ে যার সাথে আইদ ফোনে আলাপে এত ব্যস্ত থাকে সে আমার জন্য তার সময়ই হয় না। তুই আইদের মাথায় আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা ভরিস তাই না? লজ্জা লাগে না অন্যের স্বামীর দিকে কুনজর দিতে?”
আইদের মা’ও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সে আইদকে জিজ্ঞেস করে, “আইদ আমি এসব কি শুনছি? মৃণা আমাকে বলল ও থাকতে তুমি অন্য মেয়ের সাথে কথা বলো। এসব কী?” সে আবার অনুর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমাকে তো দেখে ভালো পরিবারের মনে হচ্ছে। তোমার নিজের সীমানায় থাকা উচিত এটাও বুঝো না?”
আইদ কিছুই বুঝতে পারে না। হঠাৎ তার পরিবার এখানে কি করে এলো? এমন সময় সে তার পিছন থেকে কাউকে বলতে শুনল, “আমারও মনে হয়েছিল দুইজনের মাঝে কিছু চলছে। আমি তো ভাবছিলাম অনু মেয়েটা ভালো। এখন দেখি মেয়েটার ক্যারেক্টরে সমস্যা।”
আরেকজনও বলল, “আসলে। অন্যের জামাইয়ের দিকে নজর দেয়। ছিঃ!”
আইদ এসব শুনে ঘাবড়ে যায়। সে তার মা’কে বলে, “মা দেখ আমাদের মাঝে এমন কিছু নেই। আমরা কেবল বন্ধু।”
“তো বন্ধুদের মাঝে এত কীসের হেসে কথা বলা? কই আমার সাথে তো এত হেসে কখনো কথা বলো নি।” মৃণা বলে। আইদ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”মৃণা চুপ করো। কোনো সিন ক্রিয়েট করবে না।”
“একশোবার করবো। এত কিসের ঘুরাঘুরি তোমাদের? এত হেসে কথা বলা কেন? রাতে এই মেয়ে তোমাকে কল দেয় কোন দুঃখে?”
“যেন তোমাকে ওর সহ্য করতে না হয় এই দুঃখে।” অনু সোজাসাপটা উওর দেয়। মৃণা রাগে ফেটে পড়ে এইবার, “লজ্জাও লাগে না এই কথা বলতে?”
“তোমার সাথে আমার লজ্জা করবে?” তাচ্ছিল্য হাসে অনু। আবার বলে, “যে মেয়ের পর পুরুষের সাথে থাকতে লজ্জা করে না, একজন বিবাহিতা পুরুষের দিকে কুনজর দিতে লজ্জা করে না, অন্যকারও সংসার ভাঙতে লজ্জা করে না। তার সাথে কথা বলতে আমার লজ্জাবোধ হবে কেন?”
কথাটা শুনে মৃণা বড়সড় এক ঝটকা খায়। স্তব্ধ হয়ে যায় যায়। হঠাৎ ভয় তাকে এমনভাবে কাবু করেছে যেন তার প্রাণ গলায় আটকে এসেছে।
চলবে…