#মৃত_কাঠগোলাপ – ২৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আয়েশী ফ্রেশ না হয়েই ধপাধপ পা ফেলে কক্ষ ছেড়ে বেরোয়। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝ’ড়ছে। সামনে যা পাবে তাই যেন ভ’স্ম করে দেবে। আয়েশীর এমন ভয়ংকর রাগ দেখে ধ্রুবর বাড়ির সার্ভেন্ট সব ত’টস্থ হয়ে সরে যাচ্ছে। আয়েশী ম্যাম রে’গে গেলে ধ্রুব স্যার নিশ্চয়ই তাদের উপর রাগ ঝাড়বে। তারপর এত ভালো একটা চাকরি হাত থেকে ফসকে যাবে। আয়েশী একজন সার্ভেন্ট এর সামনে দাঁড়াল। কাঠকাঠ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ ধ্রুব কোথায়? ‘
মেয়ে সার্ভেন্ট মাথা নত করে কাপতে কাপতে উত্তর দিল,
‘ স্যার উনার ঘরে আছেন। ঘুমাচ্ছেন। ‘
আয়েশী আর কথা বাড়াল না। হন্য হয়ে ধ্রুবর ঘরের দিকে চলল। এত বড় একটা কান্ড করে এখন ঘুমানো হচ্ছে! কতবড় বে’য়াদব!
আয়েশী ধ্রুবর ঘরের সামনে এল। দরজা বন্ধ করা। আয়েশী দরজায় করাঘাত করল। একবার, দুবার, তিনবারের সময় ভেতর থেকে ধ্রুবর ঘুমঘুম কণ্ঠ ভেসে এল,
‘ উম, ভেতরে আসো। ‘
আয়েশী কিছুটা অবাক হল। ধ্রুব তুমি বলে সম্বোধন করছে। অর্থাৎ ধ্রুব জানে আয়েশী এসেছে। কিভাবে জানল? সে যাক গে। এখন তো আয়েশী ধ্রুবর মাথা ফা’টানোর সময়। এখন এসব ভাবল চলবে না। আয়েশী দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। ধ্রুব উদোম গায়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ধবধবে ফর্সা শরীরে স্থানে স্থানে গভীর ক্ষ’তের দাগ। পিঠের কিছু জায়গা কা’লশিটে হয়ে গেছে। কার থেকে মা’র খেয়ে এসেছে কে জানে। আয়েশী ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়াল। দাতে দাত চেপে প্রশ্ন করল,
‘ আপনি আমার কাপড় বদলেছেন? ‘
ধ্রুব তখনো ঘুমাচ্ছে। গরম গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে বুঝাচ্ছে, আয়েশীর কথার মূল্য তার কাছে এক পয়সাও না। আয়েশী রা’গে ফেটে পড়ল। উত্তর দিচ্ছে না। কতবড় বে’হায়া লোক। আয়েশী ধ্রুবর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘ উত্তর দিন। আপনি আমার কাপড় বদলেছেন কি না? ‘
ধ্রুব এবার চোখ খুলল। চোখ খুললো বলতে চোখের পাতা টেনেটুনে জোর করে খুলে দিল। অত্যাধিক ঘুমে চোখের শুভ্র অংশ লাল হয়ে আছে। যেন এখুনি চোখ থেকে র’ক্ত পড়বে। আয়েশী সেসব পাত্তা দিল না। চোখে আগুনসম রা’গ নিয়ে চেয়ে রইল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কোন পরিষ্কার করল। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,
‘ আস্তে কথা বল। আমি বয়রা নই। শুনতে পাই। ‘
আয়েশী রা’গে এবার যেন কেঁদে ফেলবে। এত অপমান সে জন্মেও বোধ করেনি। চোখের কোণ ছলছল করছে। আয়েশী রা’গ সংবরণ করতে না পেরে আবার চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমার জামা কাপড়ে হাত দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি, শয়তান! উত্তর দে। ‘
আয়েশীর কণ্ঠে ‘তুই-তোকারি’ শুনে ধ্রুবর মাথার র’ক্ত ছলকে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে আয়েশী হাত খপ করে ধরল। অতএব একটানে আয়েশী ধ্রুবর বুকের উপর। কি হল, আয়েশী বুঝতে পারল না। ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষণ সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইল। ধ্রুব যখন আয়েশীর বাহু খা’মচে ধরল, তখন আয়েশীর হতবম্ব ভাব কাটল। অতঃপর ধ্রুবর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য রাগ, ছোটাছুটি, ধস্তাধস্তি যা পারে করল। তবে খুব একটা লাভ হল না। বরং ধ্রুবর হাতের বাঁধন আরো শক্ত হল। আয়েশীর ফর্সা নরম বাহু ধ্রুবর শক্ত হাতের চাপে লাল হয়ে গেল। আয়েশী মেয়েটা তবুও দমে গেল না। র’ক্তলাল চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘ আমায় ছাড় নয়ত আমি তোকে খু’ন করে ফেলব। ‘
ধ্রুব চটাশ করে আয়েশীর গালে গভীর চুমু খেয়ে বসল। আয়েশী হতবম্ব হয়ে পড়ল। মুখ থেকে কথা ফুটা বন্ধ হয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব আয়েশীর ঠোঁটের পাশে আঙ্গুল বুলিয়ে হুস্কি কণ্ঠে বলল,
‘ ঘৃ’না, ভালোবাসা যা ইচ্ছা করো। তবে কখনো তুই তোকারি করে কথা বলবে না। আমার সবচেয়ে অপছন্দ এই সম্বোধন। ‘
আয়েশী কিছুক্ষণ ধ্রুবর উপরে ছোটাছুটি করল। ধ্রুব ছেড়ে দিল না। বরং বলল, ‘ এত নড়ছ কেন? একটু সময় চুপ করে বসে থাকা যায়না? ‘
‘ না। ‘
আয়েশীর স্পষ্ট উত্তর। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না জানি এই মেয়েটা ধ্রুবর আর কত দীর্ঘশ্বাসের কারণ হবে। ধ্রুব কিছুটা নিভে এল। মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ সমস্যা কি? এত রাগছ কেন? ‘
আয়েশী বলল, ‘ আমাকে আগে ছাড়ুন। তারপর বলছি। ‘
‘ না। ছাড়া যাবে না। আগে প্রবলেম সলভড হবে, তারপর ছাড়ব। বলো এখন। ‘
আয়েশী আরো কিছুক্ষণ ছটফট করল। অতঃপর হাল ছেড়ে দিয়ে কঠিন কণ্ঠে আগের করা প্রশ্ন বলল,
‘ আমার কাপড় বদলেছেন কেন? এত সাহস কোথায় পেলেন? আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়েছেন! ছিঃ। ‘
ধ্রুব কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল। তারপর হাত বাড়িয়ে একটা সুইচে চাপ দিল। সম্পূর্ন বাড়িতে একটা রিং বাজল। সেকেন্ড পরেই একজন সার্ভেন্ট হন্তদন্ত হয়ে ধ্রুবর কক্ষে এল। মাথানত করে তটস্থ হয়ে বলল,
‘ স্যার, আদেশ করুন। ‘
ধ্রুব আয়েশীর সামনের এক গোছা চুল হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে প্রশ্ন করল, ‘ গতকাল ম্যাডামের কাপড় কে চেঞ্জ করেছে? উত্তর ম্যাডামের দিকে চেয়ে দে। ‘
সার্ভেন্ট আয়েশীর দিকে তাকাল। গলা উচুঁ অংশ থরথর করে কাপছে। আয়েশী ভ্রুরু কুচকে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। সার্ভেন্ট এক ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
‘ কাল রাতে আমি ম্যাডামের কাপড় বদলে শাড়ি পড়িয়েছি।’
আয়েশী প্রচন্ড অবাক হলো। ঘাড় কাত করে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব তখন ব্যস্ত আয়েশীর চুল আঙুলে প্যাঁচাতে। আয়েশীর সন্দেহ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। সার্ভেন্ট মিথ্যাও বলতে পারে। হয়তো ধ্রুব মিথ্যা বলার জন্য আদেশ দিয়েছে। হতেও পারে। আবার সার্ভেন্ট সত্যিও বলতে পারে। ধ্রুব এতটা নিচে নিশ্চয়ই নামবে না। এটাও হতে পারে। সবই হতে পারে। অনুমানের উপর ভিত্তি করে কাউকেই সন্দেহ করা যাচ্ছে না। ধ্রুব হাত উঁচু করে সার্ভেন্টকে চলে যেতে বলল। সার্ভেন্ট একবার আয়েশীর দিকে করুন চোখে চেয়ে চলে গেল। ধ্রুব আয়েশীর চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ সন্দেহ গেছে? ‘
আয়েশী উত্তর দিল না। চুপ করে কিছু একটা চিন্তা করে যাচ্ছে। ধ্রুব এবার কৌতুক করে বলল,
‘ একটু আগে তো যুদ্ধ করছিলে আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। এখন আমার বাঘিনী এত শান্ত কেন? নাকি আমার সাথে মিশে থাকতে ভালো লাগছে? হুঁ? ‘
ধ্রুবর এমন গা জ্বা’লানো কথা শুনে আয়েশীর ধ্যান এমনিই ভেঙে গেল। চট করে ধ্রুবর থেকে সরে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ আমার এত শখ জাগে নি। ‘
অতএব আয়েশী চলে গেল ধ্রুবর কক্ষ থেকে। ধ্রুব বিছানায় শুয়ে আছে। এক হাত মাথার নিচে রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে দরজার দিকে চেয়ে আছে। কাঠের দরজা এখনো হেলছে। বাঘিনী যেখানে যায়, সেখানের সবকিছু ভ’য়ে তা’ণ্ডব করে। হা হা হা, আমার বাঘিনী।
ধ্রুব আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কাল রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। এখন একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে। শরীর চাঙ্গা না হলে দুনিয়া চালাবে কি করে?
#মৃত_কাঠগোলাপ – ২৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
তখন বেলা প্রায় ১২টা। ধ্রুব লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বেশ রয়েসয়ে জাগল। ঘন্টা ধরে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে নিচে এল। আয়েশী সোফার উপর বসে রয়েছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। সকালে ৮ টায় ঘুম থেকে উঠেছে। এখন অব্দি পেটে একবিন্দুও দানাপানি পড়েনি। সার্ভেন্টকে বলবে, লজ্জায় পারছে না। নতুন বউ প্রথম দিন এসেই খাবার চাইছে। ইশ, ছিঃ ছিঃ! খাবার না পেয়ে আয়েশী শুধু পানি খাচ্ছে। ইতিমধ্যে দু বোতল পানি শেষ করা হয়েছে। এখন ফ্রিজ থেকে আরো একটা পানির বোতল নিয়ে বসেছে। ধ্রুব ঘুম থেকে উঠছে না কেন? ক্ষুধার জ্বালা আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
‘ চলো, নাস্তা খাবে। ‘
ধ্রুব আয়েশীর কাছে এসে বলল। আয়েশী চোখ তুলে তাকাল। কালো প্যান্ট, সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার পড়েছে। একদম তৈরি হয়ে এসেছে। কোথাও যাচ্ছে নাকি? খাবারের কথা শুনে আয়েশী চট করে সোফা ছেড়ে উঠে গেল। ধ্রুবর আগেই ধপাধপ খাবার টেবিলে দিকে হেঁটে গেল। পেছন পেছন ধ্রুব বুক টানটান করে হেঁটে এল। আয়েশী চেয়ারে বসে ধ্রুবর দিকে তাকাল। এই লোক হাঁটেও কি সুন্দর করে। মনে হয় যেন লাল বাগিচায় হাঁটছে। হাঁটার সময় দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখবে, তারপর সোজা চেয়ে হাঁটবে। বুক দুটো সবসময় ফুলিয়ে রেখে কি বোঝাতে চায়? অহংকার? অহংকারে মাটিতে যেন পা’ই ফেলতে চায়না। সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে। শুধু আয়েশীর কাছে এলে তার যত বে’হায়া কাজ কারবার। বে’হায়া লোক! এই লোককে আয়েশীর একদম স’হ্য হয়না। তবে এখন আর সহ্য হওয়া না হওয়া দিয়ে কি কাজ? বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু না, আয়েশী এই লোককে কখনোই মেনে নিবে না। বন্ধুর ভালোবাসাকে যে এত ছল চাতুরী করে বিয়ে করে, সে কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। সে ঘৃণার’ই যোগ্য।
সার্ভেন্ট খাবার বাড়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওসমান। ওসমানকে আয়েশী চেনে। ধ্রুবর পাশে সবসময় ছায়ার মত লেগে থাকে। সবাই নাস্তা করছে, পাশে ওসমান মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে। তাই আয়েশী বলল,
‘ চাচা, আপনিও আমাদের সাথে খেয়ে নিন। ‘
ওসমান কিছু বলার আগে ধ্রুব গম্ভীর কণ্ঠে জানাল,
‘ না, ওসমানকে মাস শেষে টাকা দেওয়া হয়। সে নিজে কিনে খেতে পারবে। তুমি তোমারটা শেষ করো। ‘
আয়েশী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ওসমানের মুখটা অপমানে এটুকু হয়ে গেছে। আয়েশীর খুব মায়া হল। বাবার বয়সী লোকের সাথে এমন করে কেউ কথা বলে? কিন্তু ধ্রুব বলে। কারণ সে খা’রাপ। আয়েশী রাগ দেখাল,
‘ আপনি উনার সাথে এমন করে কথা বলছেন কেন? উনি আপনার বাবার বয়সী। ‘
সার্ভেন্ট আরো এক চামচ সবজি ধ্রুবর প্লেটে দিল। ধ্রুব খেতে খেতে বলল,
‘ বাবার বয়সী, বাবা তো না। আর বাবা হলেও ধ্রুবর সাথে খাবার খাবার জন্যে বিশেষ কেউ হতে হয়। ওসমান কোনো বিশেষ লোক না। অযথা তর্ক না করে খাও। নাহলে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ো। ‘
আয়েশী অবাক হল। ধ্রুব কি নির্দয়। ধ্রুবর এ কথায় আয়েশী আজ নিশ্চয়ই খাবার ছেড়ে উঠে পড়ত। কিন্তু পেটে এখনো অনকে ক্ষুধা। এখনি কিছু খেতে না পেলে আজ সে ম’রেই যাবে। তাই আয়েশী চুপচাপ খেতে লাগল।
খাবার পর্ব শেষ হলে সার্ভেন্ট ধ্রুবর দিকে টিস্যু এগিয়ে দেয়। ধ্রুব টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে আয়েশীকে বলল,
‘ আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে বিকেল হবে। একা একা খারাপ লাগলে, বাড়ি ঘুরে দেখবে। ভালো লাগবে। আসছি আমি। ‘
আয়েশী হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। ধ্রুব এগিয়ে এসে আয়েশীর কপালে চুমু খেল। আয়েশী রাগ হল। ধ্রুবর বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিল। ধ্রুব সরল না। চুমু খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ হলে তারপরই সরে এল। ঠোঁট কামড়ে কৌতুক করে বলল,
‘ শরীরে চার আমার মাংস নেই, আর আমাকে শক্তি দেখাও।’
আয়েশী ক্ষেপে গেল। চেঁচিয়ে কিছু বলার আগে দেখা গেল ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছনে আয়েশী ওড়না দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে চেঁচাল,
‘ বে’হায়া লোক। সারাক্ষণ শুধু গা ঘেঁষার ধান্দা। ‘
_________________________________
অলস বিকেলে একা একা বসে থাকতে আয়েশীর একটুও ভালো লাগছে না। আয়েশী যখন একা থাকে তখন খুব করে মৃদুলের কথা মনে পড়ে। মৃদুলের কথা মনে হলে আয়েশীর কান্না আসে। ম’রে যেতে ইচ্ছে হয়। আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হত, তবে আয়েশী নির্ঘাত এতদিনে মৃদুলের বা পাশের কবরে শুয়ে থাকত। মৃদুলের সাথে গল্প করত। অনেক ভালোবাসা-বাসি করত। ইশ! কত ভালো দিন কাটত তাদের। কিন্তু এখন যেন আয়েশীর দিন কাটতেই চায়না। সারাক্ষণ মন খারাপ করে। কিছু খেতে ভালো লাগে না, ঘুমাতে ভালো লাগে না, হাসতে ভালো লাগে না, কিচ্ছুটি ভালো লাগে না। তবুও খেতে হয়, ঘুমাতে হয়, হাসতে হয়। কারণ আমাদের মনুষ্য জীবন এমন করেই প্রক্রিয়া করা। উপরওয়ালা আমাদের ভেতরের ইঞ্জিন এমন করেই তৈরি করেছেন। তারপর একটা চাবি লাগিয়ে ব্যাটারি চালু করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই আমরা আমাদের মনমত আমাদের জীবনকে চালাতে পারি না। উপরওয়ালার উর্ধ্বে কারো যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তেমনি আয়েশীরও নেই।
ধ্রুবর কথামত, আয়েশী বাড়ি ঘুরতে বের হল। দু তলা রাজকীয় বাড়ি। বাড়ি দেখে যে কারো চোখ জুড়াতে বাধ্য। হয়তো ধ্রুব টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছে না। তাই বাড়ির পেছনেই টাকার শ্রাদ্ধ করেছে। অথচ আয়েশী জানলো না, ধ্রুবর এই টাকার সমুদ্র সব কালো ধান্দা থেকে আগত। সৎ পথে নয়, বরং অসৎ পথে তৈরি ধ্রুবর এই রাজকীয় সাম্রাজ্য। কত গরীবের পেটে লাথি দিয়েছে, কত অনাথের হক মেরেছে, কত মানুষকে হ’ত্যা করেছে, তা ধ্রুব স্বয়ং বলতে পারবে না। হিসেব নেই এসবের। তাই তো তার এত-এত টাকা।
আয়েশী ভাবছে, ধ্রুব কি টাকার উপর ঘুমায় নাকি? হতেও পারে। ধ্রুবর দ্বারা সব সম্ভব।
আয়েশী বাড়ি ঘুরে বাগানে এল। একজন সার্ভেন্ট আয়েশীকে বাগান ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। এটা গোলাপের চারা, এটা হচ্ছে সূর্যমুখি, এটা আম গাছ, এটাতে লেবু হয়, এটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, সার্ভেন্ট সব হাতে ধরে আয়েশীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাগানের এত সুন্দর সাজসজ্জা দেখে আয়েশীর চোখ কপালে। মনেমনে ভাবছে, ইশ, কি সুন্দর বাগান। মন চায়, সারাক্ষণ এই বাগানেই পড়ে থাকতে। দিনদুপুরে বাগানের মধ্যিখানে চুলা বসিয়ে রান্না করতে, তারপর মাদুর পেতে আকাশের নিচে খাবার খেতে, গোলাপের চারার সাথে গল্প করে ধোঁয়া উড়া চায়ের কাপে চুমুক দিতে, আর রাতে ঘাসের উপর মাথা রেখে তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়তে। এসব ইচ্ছে ধ্রুবকে সাথে নিয়ে পূরণ করতে চায়না আয়েশী। মৃদুল হলে আয়েশী সব ইচ্ছে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে পূরণ করত। মৃদুল নেই, তাই আয়েশীর ইচ্ছেগুলো বুকের ভেতর ডানা ঝাপটে বুকেই ম’রে গেছে।
আয়েশী বাগান ঘুরছে, হঠাৎ করে বাগানের পূর্ব দিক হতে একটা বিকট চিৎকার ভেসে এল। আয়েশী যেন কেঁপে উঠল। সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে ওখানে? আমি যাব। ‘
সার্ভেন্ট ভয় নিয়ে বলল,
‘ ম্যাম ঘরে চলুন। ওদিকে যাওয়ার আদেশ নেই। ‘
‘ কেন নেই? কি আছে ওদিকে? ‘
আয়েশীর অস্থির প্রশ্ন। সার্ভেন্ট তটস্থ কণ্ঠে জানাল,
‘ আমি জানি না ম্যাম। এখানের কেউই বাগানের পূর্ব দিকে যায়না। ওই জায়গা ধ্রুব স্যার রেড সিগন্যাল এঁকে দিয়েছেন। ওখানে যাওয়া নিষেধ। ‘
‘ আমি যেতে চাই। ‘
আয়েশী স্পষ্ট উত্তর। ধ্রুবর নিষেধ শুনতে ইচ্ছে হলো না আয়েশীর। আয়েশী সার্ভেন্টকে এড়িয়ে হেঁটে চলল পূর্ব দিকে। সার্ভেন্ট অনেকবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল। তবে বিফল হল। আয়েশী ততক্ষণে রেড সিগন্যাল মার্ক করা জায়গা পেরিয়ে গেছে। চোখের সামনে একটি কালো কক্ষ ভেসে উঠেছে। কক্ষের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখা। এখন চাবি কোথায় পাবে? কে আছে ওখানে? আয়েশী স্পষ্ট শুনেছে কেউ এই কক্ষের ভেতরে করুন সুরে কাদঁছে। কে কাঁদছে? কে আছে এই কক্ষের ভেতর? আয়েশী জানতে চায়। কিন্তু কক্ষের চাবি কোথায় পাবে? ধ্রুবর কাছে আছে? হতে পারে। ভাবনার মধ্যে আবারও ভেতর থেকে কান্নার শব্দ এল। আয়েশী অস্থির হয়ে গেল। এত করুন সুরে কাদঁছে কেন? কিসের দুঃখ তার? কে সে?
#চলবে ( ১১০০+ )