মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -৩০+৩১

মেঘদিঘির পাড়ে – ৩০
মালিহা খান

৬৭.
মেঘদিঘির ঝোঁপের আড়ালে একটা বড় বাঁশঝাড় আছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বাঁশঘুঘুর ডাক আসে। এখনো আসছে। ঊষাকালে যখন শীতের নরম রোদ পৃথিবীর গা ছোঁয়, বাঁশঘুঘু গুলো নিশ্চুপ হয়ে সেই রোদে গা পোঁড়ায়।
ইভা দাড়িয়ে আছে ঠাওর করতে পেরেও সায়ন তাকাতে পারলোনা। তার সামনে নেওয়াজ সাহেব বসে আছেন। আর সবার সামনে হলেও বাপের সামনে অন্তত মেয়ের দিকে বেহায়ায় মতোন তাকিয়ে থাকা যায়না। অতটুকু শোভনীয় ভদ্রতা তার মধ্য আছে। সায়ন মনে মনে খুব করে কপাল চাপড়ালো।
কপাল চাপড়ানোর ঠাস ঠাস আওয়াজগুলো সে কান অবধি শুনতেও পেলো।

কারো পায়ের পদচারণে ইভা দ্রুত পেছন ফিরলো। চোখ ডলার ভঙ্গি করে ভারী নির্বিকার গোছে একটা মিথ্যে হাই তুললো। ইউসুফ তন্দ্রার ঘর থেকে ফিরছিলো। ইভাকে সিঁড়ির কাছে দাড়িয়ে থাকতে
দেখে থেমে গেলো। কাছে যেয়ে মাথায় হাত রাখলো। ভারী আদর করে জিজ্ঞাসা করলো,

-“ঘুম হলো?”

মিথ্যে হাইটায় একটা মিথ্যে শব্দ হলো। ইভা মুখ থেকো হাত সরিয়ে দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,

-“হলো ইউসুফ ভাই।”

-“এখনো হাই তুলছিস যে? কেও তোকে জাগিয়ে দিয়েছে নাকি? আমি মানা করেছিলাম তো..”ইউসুফের কন্ঠে রোষ প্রকাশ পায়। ইভা দ্রুত ধাতস্থ করলো তাকে।

-“না না কেউ জাগায়নি। ওই এমনি একটু…”তার কথা সম্পূর্ণ হলোনা। ভয়ার্ত নারীকণ্ঠের চিৎকারে কথা আটকে গেলো। তন্দ্রা ভাবীর কন্ঠ। ইউসুফের রুহ কেঁপে উঠলো। তন্দ্রার হাবভাব সে স্বাভাবিক দেখে আসেনি। ভাবি অনবরত ঘামছিলো। সরফরাজ বলেছিলো শরীর খারাপ একটু তাই সে তেমন ঘাটায়নি।

বিভা মাত্র ইভার ঘর থেকে বেরোচ্ছিলো।
তন্দ্রার চিৎকারে সে প্রায় দৌড়ে ঘরের দুয়ারে হাজির হলো। তন্দ্রা দাড়ানো, বসার মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। দাঁড়াতে গিয়ে সে পুরোপুরি দাড়াতে পারছেনা। বিভা দ্রুত যেয়ে ধরলো। পায়ের নিচে অকস্মাৎ কিছু দেখতে পেয়ে ভীত হয়ে উঠলো মন। ইভাকে দরজার কাছে আসতে দেখে ত্রস্ত গলায় বললো,

-“ইভা! আম্মা, চাচীকে আসতে বল গিয়ে, ভাবীর পানি ভাঙছে।”

বিয়ে বাড়ির হাসিঠাট্টাপূর্ণ কোলাহল মূহুর্তেই থমকে গেলো। তন্দ্রা অল্পতেই ভয় পায়। সরফরাজ সাথে না থাকায় সে আরো ঘাবড়ে গেলো। হু হু করে কেঁদে ফেললো। বিভা শত বুঝিয়েও শান্ত করতে পারলোনা তাকে। জাহানারারা এলেন। তন্দ্রার প্রসব বেদনা উঠছে। ব্যাথার চেয়ে দূর্নিবার ভয়েই তার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ইউসুফ আরো বারকয়েক ফোন করার চেষ্টা করলো সরফরাজকে। মরার উপর খরার ঘা হিসেবে সরফরাজের ফোন এবার বন্ধ পাওয়া গেলো।
ইউসুফ বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। নিচে নেমে গাড়ি বের করতেই আবার মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। ফুয়েল মিটারের কাঁটা মাঝামাঝি অবস্থানে। অভিজ্ঞতা বলছে এতোটুকুতে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। মাঝে অবশ্য ফুয়েল পাম্প আছে। কিন্তু ভাবির অবস্থার অবনতি হলে মাঝপথে গাড়ি থামানো যাবে নাকি তাও সমস্যা। সায়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো। ইউসুফ এসে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“সায়ন? তুমি গাড়ি নিয়ে এসেছো?”

-“জি ভাইয়া।”

-“কোথায়? উঠোন তো খালি।”

-“গেটের বাইরে পার্ক করা। উঠোনের ওখানে তখন ফুলের ঝাঁকি টাকি রাখা ছিলো।”

সায়নকে গাড়ি বের করতে বলে একদৌড়ে উপরে গেলো ইউসুফ। তন্দ্রা ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে। ব্যাথায় চাদর খামছে ধরেছে। জাহানারা ইউসুফকে দেখেই বললেন,”কই ছিলি তুই? গাড়ি বের করেছিস? বৌমাকে হাসপাতালে নিতে হবে তো।”

ইউসুফ মাথা দোলালো।

সায়ন ড্রাইভিং সিটে। পেছনে তন্দ্রা, বিভা আর জাহানারা। ইভা নেওয়াজ সাহেবের সাথে ওই গাড়িতে আসছে। তারা মাঝপথে তেল নিয়ে বাকিটা যেতে পারবে। ইকবাল বাড়িতেই থাকবেন৷ বিয়ের বাড়ি। একেবারে খালি করে যাওয়া যাবেনা। কারো তো থাকতে ই হবে। ইভার মা ভীষণ অসুস্থ মানুষ। তিনিও চলাফেরা বেশি একটা করতে পারেন না৷ তিনি সামলাতে পারবেননা সব। বাহাদুর ছোট। সেও বাসায়ই রইলো।

ইউসুফ ফ্রন্ট সিটে যেয়ে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। তন্দ্রা তখনো দূর্বল স্বরে সরফরাজের নাম আওড়াচ্ছে। ইউসুফ ফোন বের করলো। তুখর গরম মেজাজ নিয়ে অনবরত সরফরাজের ফোনে ডায়াল করতে লাগলো।

গাড়ি তখন মাঝামাঝি পথে। লাউডস্পিকারে রাখা ফোনটা রিং করলো। প্রথম রিংয়েই ফোন তুললো সরফরাজ। খানিক কেটে কেটে ভেসে এলো তার ভারি কন্ঠ,”হ্যালো? ইউসুফ? এদিকে নেটওয়ার্কের এতো সমস্যা। হ্যালো?”

আরাধ্য কন্ঠটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র ডুঁকরে উঠলো তন্দ্রা। ফোন অবধি পৌঁছালো আওয়াজটা। ওপাশে সঙ্গে সঙ্গে উৎকন্ঠা ছেঁয়ে গেলো,

-“হ্যালো? ইউসুফ? তোর ভাবী কাঁদছে? কি হয়েছে? হ্যালো?”

ফোনটা ধরে রেখে ইউসুফ থমথমে গলায় বললো,”ভাবির পেইন উঠেছে। হাসপাতালে যাচ্ছি।”

-“কিহ্?”সরফরাজ স্তম্ভিত।

ইউসুফ অবিচল গলায় বললো,
-“ভাবির সাথে কথা বল। ধর।”

তন্দ্রার কাছে ধরা হলো ফোন। সে কিচ্ছুটি বলতে পারলোনা। কেঁদে গেলো কেবল। সরফরাজ মৃদুক্ষণ তার কান্নাই শুনলো। তারপর নরম গলায় ডাকলো,”ইউসুফ? লাউডস্পিকার টা বন্ধ করে দে।”

ইউসুফ লাউডস্পিকার বন্ধ করে আবার তন্দ্রার কাছে দিলো ফোন। তন্দ্রা এপাশ থেকে বললোনা কিছু৷ ওপাশ থেকে পুরুষকন্ঠটি অনর্গল বিরতিহীন কি যেনো বলে গেলো। যার উদ্দেশ্য বলা হলো সে এপাশ থেকে চুপটি করে শুনলো। কিছুক্ষন পর লাইনটা কেটে গেলো। তন্দ্রা ফোন এগিয়ে দিয়ে মিনমিন করে বললো,

-“রেখে দিয়েছে, নাও।”

এরপর আর ভেঙে পড়তে দেখা গেলোনা প্রসববেদনা সহ্য করে যাওয়া ভয়ে জর্জরিত রমনীটিকে। সে চুপচাপ শান্ত হয়ে গেলো। ভয় যেনো কোথায় উবে গেছে।
সেই নিঝঝুম রাতে সায়ন আশ্চর্য হয়ে দেখলো নিরব অনূভুতির জোয়ার। ঠিক কতটা শক্তি থাকলে মাত্র কিছু সময়ের আলাপে নিজের সঙ্গীনীকে এত দূর থেকেও এতটা সাহস দেয়া যায়।
তার আর ইভারও কি এমন শক্তি হবে? এতোটা?

৬৮.
তন্দ্রার সিজার শেষ হলো রাত আড়াইটার দিকে। বেশ ভুগেছে মেয়েটা। জ্ঞান আসেনি এখনো। হাতে স্যালাইন চলছে। রক্ত দেয়া লেগেছে। অবশ্য রক্ত খুঁজতে অসুবিধা হয়নি। সায়নের সাথে মিলে যাওয়ায় সায়ন দিয়েছে।

নেওয়াজ সাহেব হাসপাতালে টাকা জমা করে ফিরে এলেন। সাদা টাওয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটা জাহানারার কোলে আছে। তিনি তন্দ্রার বেডের পাশে বসে আছেন। বাড়ির সবাই ক্লান্ত।

ইভা ঘুমিয়ে পড়েছে সায়নের উপর। নার্স একজন কয়েকবার এসে বলে গিয়েছে সায়নকে একটু বিশ্রাম নিতে। সে রক্ত দিয়েছে। সায়ন শোনেনি। আলতো করে ঘুমন্ত ইভাকে ধরে কড়িডোরের চেয়ারে বসে বসেই চোখ বুজে রেখেছে। নেওয়াজ সাহেব দেখে চাপা হাসলেন। সে এসেছে ছেলেটা বুঝেনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।

নেওয়াজ সাহেব খানিক দুরত্ব রেখে পাশে বসলেন। সে পাশে বসতেই সায়ন আস্তে করে চোখ মেললো। পাশে উনাকে দেখে হঠাৎই কিছুটা বিচলিত বোধ করলো। ইভার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে পেটের দিকের শার্ট মুচরে ধরে আলুথালু হয়ে ঘুমাচ্ছে। সায়ন নড়লোনা। নিজ থেকেই বললো,

-“আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা, নড়লে উঠে যাবে।”
নেওয়াজ সাহেব হাসলেন। সম্মতির ইঙ্গিত দিয়ে ছোট্ট করে বললেন,

-“নড়োনা তবে।” মেঘদিঘির পাড়ে – ৩১
মালিহা খান

৬৯.
হাসপাতালটা দোতলা। দোতলার শেষপ্রান্তের দিকে প্রসূতি মায়েদের ইউনিট। সেখানের লম্বা করিডোর শেষে গোলাকার খোলা জায়গা। হাসপাতালের পেছনদিকটা দেখা যায় ওদিকে দাঁড়ালে। বিভা ধীরলয়ে হেঁটে সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে দাড়ালো। এদিকটা নিরিবিলি। অবশ্য সারা হাসপাতালই প্রায়নিরব। রাত তিনটা বাজে কিসের কোলাহল-ই বা হবে। ইউসুফকে দেখেনি অনেকক্ষণ। ভেবেছিলো কোনো কাজে হয়তে নিচতলায় গেছে। কিন্তু না, নিষ্ঠুরটা এককোঁণায় দাঁড়িয়ে ফোন চালাচ্ছে। বিভা পাতলা জর্জেটের ওড়না টেনেটুনে ঠিক করলো। এদিকটায় ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। সামনের জঙ্গলের মতো গাছগাছালি একটু পরপর দুলে উঠছে। নির্মমটার ঠান্ডা লাগেনা? জ্যাকেটের বুক খুলে দাঁড়িয়ে আছে? হাহ্।
বিভা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা সময় চুপচাপ দাড়িয়ে থেকেও যখন কোনরূপ সাড়া-ই পেলোনা তখন নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

-“ভাইজানকে জানিয়েছেন?”

-“জানিয়েছি।”ইউসুফের কাটকাট সংক্ষিপ্ত উওর। সে যেনো খুব দেখেও এক্কেবারেই দেখতে চাইলোনা মেয়েটাকে।

বিভা দাড়িয়েই রইলো। ইউসুফ দীর্ঘক্ষণ পর লক্ষ্য করে বললো,

-“কি দরকার?”

-“আপনি রেগে আছেন কেনো?”

-“রেগে নেই।”

-“আছেনতো। তখনও আমাকে বকলেন। কিসব বললেন যেনো!”

ইউসুফ খপ করে বিভার হাত চেপে ধরলো। কবজি মুঁড়ে বললো,”জানোনা কেনো রাগ করেছি? অবুঝ সাজছো?”

বিভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ইউসুফ নিচু স্বরেই ধমকালো,

-“তুমি সব বলেছো কেনো?”

-“বেশ করেছি বলেছি।”

ইউসুফ হাতে আরো চাপ দিলো। বিভা কুঁকিয়ে উঠলো,

-“আঃ ব্যাথা পাচ্ছি।”

ইউসুফ সজোরে ঝামটা মেরে হাত ছেড়ে দিলো। বিভা হাতের কবজি ধরে ইউসুফের দিকে তাকালো। লোকটার চেহারা মায়া মায়া হলে কি হবে? মনে একটু মায়া নেই। এতটুকুও না। অথচ এ মানুষটার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মায়া যেন তার ভেতর ঢেলে দিয়েছে কেউ। একদম কেঁচেকুচে। অল্পএকটুও বাকি রাখেনি অন্যকারো জন্য।

ইউসুফ ফোনের দিকে চেয়ে বললো,

-“তুমি বলেছো, আমিও রেগে আছি। ব্যস! কথা শেষ। যাও এখান থেকে।”

-“যাবোনা।”

-“যেওনা।”

বিভা আচমকা রেগে ধাক্কা দিলো ইউসুফকে। ইউসুফ কোনোমতে সামলে নিলো নিজেকে। বিভার দিকে চেয়ে কিড়মিড় করে বললো,

-“ঠাঁটিয়ে চড় লাগাবো একটা।”

বিভা গাল বাড়িয়ে দিলো।

-“দিন।”

ইউসুফ একনজর চেয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো। ঠান্ডা গলায় বললো,

-“বিরক্ত করবেনা, যাও।”

শত রাগ হোক। কপালের রগ ফুলে ফেঁটে যাক। তবু কি সে পারবে চড় লাগাতে? জানেতো। জানে বলেই তো সুবিধা নেয়। যতদিন না জানতো কেঁদেকুটে একাকার করতো। সেই ভালো ছিলো।

দৈবাৎ একটা প্রভন্জন হানা দিলো। বিভা দু’বাহু আড়াআড়িকরে জড়িয়ে ধরলো। মনে হলো এই সামনেই হিমালয় পর্বত। হিমালয় পর্বতের সবচেয়ে ঠান্ডা বাতাসটাই এটা।

-“মার সাথে কথা বলবো, আপনার ফোনটা দিন।”

-“এখানে আরো মানুষ আছে, অন্যকারোটা থেকে করো। চাচার ফোন দিয়ে করো গিয়ে। আমি কাজ করছি। দেয়া যাবেনা..

বিভা ঝুপ করে ফোনটা টেনে নিলো। মাঝখানের বাটন চেপে ইউসুফের সমস্ত কাজকর্ম সরিয়ে দিলো। মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিসিভ হলো। ইউসুফ হাতমুঠো করে ফেললো। রাগে তার মাথার রগগুলো দপদপ করে জ্বলতে শুরু করলো।

মায়ের সাথে কথা বলে যেইনা ফোনটা কেটেছে বিভা তক্ষুনি একজোড়া হাত তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। মিনিটের ব্যবধানে তুমুল ধস্তাধস্তি করে মোটা জ্যাকেট পরিয়ে সশব্দে সামনের চেইনটা গলা পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। ধস্তাধস্তির অবশ্য প্রয়োজন ছিলোনা। সে অহেতুক বুকে থাপড়াথাপড়ি করেছে বলেই জোর করতে হয়েছে।
ইউসুফ বাহুতে কপালের ঘাম মুছে বললো,

-“শরীরটাতো মরা মানুষের মতো ঠান্ডা বানিয়ে রেখেছো। ভালো জিনিস ভালোলাগেনা না? আর একবার এটা খোলার চেষ্টা করলে এখানেই মেরে মর্গে লাশ রেখে যাবো।”

বিভা থমথমে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। গটগট করে হেঁটে বাবার পাশে যেয়ে বসে পড়লো। জ্যাকেটটা তার ঢোলা হয়। নেওয়াজ সাহেব আদুরে গলায় বললেন,

-“ভাইয়ের জ্যাকেট নিয়ে এসেছো কেনো মা? বেশি ঠান্ডা করছে?”

-“জোর করে পরিয়ে দিয়েছেন।”

ইউসুফ ততক্ষণে এসে দাড়িয়েছে সেখানে। নেওয়াজ সাহেব তার দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে চাইলেন। ইউসুফ বিভার ঠিক বরাবর দেয়ালটায় হেলান দিয়ে একগাল হেসে বললো,”শীতে কাঁপছিলো চাচা। তাই পরিয়ে দিলাম। বড় হচ্ছে আর ঘাড়ত্যাড়া হচ্ছে তো। জোর করতে হয়েছে একটু।”

বিভা কিছু বললোনা। পাশে তাকিয়ে সায়নের দিকে তাকালো। কি সুন্দর অবসন্ন শ্রান্ত চোখেও কেমন করে ইভার তাকিয়ে আছে। একটু আগেই তো একফাঁকে তাকে ডেকে ভীষণ চিন্তিত হয়ে বললো,”বিভা? তোমার বোনের কি জ্বর এলো দেখোতো? শরীরটা এতো গরম লাগছে কেনো? হলুদের পর ওকে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়েছিলো নাকি? ইশ!”

সে ইভার কপাল ছুঁয়ে পরখ করে হেসে উওর দিলো,”জ্বর আসেনি। সামান্য গরম। ঘুমিয়ে আছে তো।”

বিভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইভা কেমন লতাপাতার মতো পেঁচিয়ে ধরে শুয়েছে। কই? সায়ন তো বিন্দুমাত্র বিরক্ত হচ্ছেনা।
আর সে একটু কথা বলতেই ইউসুফের বিরক্তি লেগে গেলো?

৭০.
সরফরাজের সাথে তন্দ্রার সাক্ষাৎ হলো ভোরের প্রথমপ্রহরে। তন্দ্রার তখন মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। সে আধো আধো মস্তিষ্কে কপালের উপর সেই শক্ত হাতটার বিচরণ পেলো। পেলো গায়ের সেই চেনা গন্ধটা। আরে! ডানহাতটাও তো ধরে রাখা শক্ত করে। তন্দ্রা খুবকষ্টে তাকালো। সরফরাজ ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকলো। ক্ষীণ গলা ডাকলো,

-“তনু? তন্দ্রাবতী? এইতো আমি।”

তন্দ্রা নিচু মুমূর্ষ কন্ঠে কি যেনো বললো। সরফরাজ পরিষ্কার শুনতে পেলোনা। কানটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বললো,

-“কি বলছো তনু?”

তন্দ্রার কন্ঠ ভেঙে গেলো আবার, সে কোনরকমে বললো,

-“কেনো এসেছেন আপনি? কেন আসলেন?”

সরফরাজ দমবন্ধ করে কথাটা শুনলো। তাকালো তন্দ্রার যন্ত্রনায় বিধস্ত বিবর্ণ মুখটার দিকে। জাহানারা চাচি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আশেপাশে আরো প্রসূতিরা আছেন। নয়তো সে এক্ষুনি মেয়েটাকে খুবকরে আদর করে দিতো। সব অভিমান নিজের ভেতর শুঁষে নিতো। একটুকুও অবশিষ্ট রাখতোনা।
সরফরাজকে অমন করে চেয়ে থাকতে দেখে তন্দ্রা শান্ত হলো। দুঃখী গলায় প্রশ্ন করলো,

-“মেয়েকে দেখেছেন? কার মতোন হয়েছে? আমি দেখিনি। আবছাভাবে শুনেছি মেয়ে হয়েছে।”

সরফরাজ তার মাথার উষ্কখুষ্ক চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-“দেখেছি তন্দ্রাবতী, তোমার মতো হয়েছে। অবিকল তোমার মতো। দেখি উঠিয়ে বসাই, কোলে নিয়ে দেখো কার মতো হয়েছে।”

সরফরাজ তন্দ্রাকে সাবধানে উঠিয়ে বসালো। সেলাই কাঁচা। তন্দ্রাকে ধরতেও অজান্তে তার পা কাঁপলো।মেয়েকে কোলে দিতেই তন্দ্রা হা করে বললো,

-“আল্লাহ! আপনার মতো হয়েছে তো। মিথ্যে বললেন কেনো?”

সরফরাজ হাসলো। মেয়ের মুখে তাকালো। একটু আগেই তো তন্দ্রার মতো লাগছিলো এখন আবার তার মতো দেখাচ্ছে কেনো? অদ্ভুত!

মেয়েকে তন্দ্রার কোলে রেখেই সরফরাজ বেরিয়ে গেলো। সায়ন ইভা দুজনেই গভীর ঘুম। সায়নের গালটা ইভার মাথার তালুর উপর হেলে রয়েছে। সরফরাজ নেওয়াজ সাহেবকে খুঁজলো। মাগরিবের পর ইভার বিয়ে। মানুষজন দাওয়াত দেয়া বিশাল অনুষ্ঠান। পেছানো অসম্ভব। অন্তত মেয়েগুলোকে নিয়ে কারো একজনের বাসায় যাওয়া দরকার।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here