#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#চব্বিশ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
প্রয়াসের কাছ থেকে আসার পর রোদের মন অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে নিজেকে। আমাদের সবার জীবনে এমন কেউ না কেউ থাকে। যে কিনা ম্যাজিকের মত করে আমাদের সকল চিন্তা দুঃখ মুহুর্তে ভ্যানিস করে দেয়।
প্রয়াস রোদের জীবনে তেমনই একজন। জীবনে ভালবাসার মানুষ খুব প্রয়োজন। প্রয়োজনে যার সাথে কথা বলা যাবে। যার উপর রাগ দুঃখ ঝেড়ে ফেলা যাবে। যার কাছে আসলে মনে শান্তি অনুভব করতে পারবে। যার এমন একজন মানুষ নেই তার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই।
প্রয়াস রোদকে কাজের ফাঁকে চোখে চোখে রাখছে।আজ কেন যেন প্রয়াস নিজেরও ভয় করছে। রোদকে বুঝালেও নিজের মনের ভয় কে সে বুঝাতে পারছে না। যতটা সহজে রোদকে বুঝাতে পেরেছে ততটা সহজ কখনোই হবে দুই পরিবারকে এক করা।
এসব চিন্তা মাথায় আসতেই প্রয়াস নিজেকে সামলে নিল। ভাবল থাক প্রয়াস এসব এখন না ভাবলেও চলবে। আজ তোর এক বোনের বিয়ে, সেদিকে মন দেয়। প্রয়াস করলো তাই।
প্রয়াস হচ্ছে তাদের পরিবারের মেজো। মানে তার বাবার তিন ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের মাঝে সে দ্বিতীয়। সবার বড় রোদের ভাই রিফাত।
তারপর প্রয়াস। রিফাত ও কাজে ব্যাস্ত প্রয়াসও। হঠাৎ করে প্রয়াস তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে কারো সাথে যেন ধাক্কা খেলো। মাথায় হাত দিয়ে সরি বলতে লাগল সামনে তাকাতেই দেখল রিফাত কপাল চেপে ধরে আছে,মুখ অন্ধকার। আজ তাদের প্রথম দেখা যদিও রিফাত এর আগে প্রয়াসের ছবি দেখেছে রাহার ফোনে। তাই তার চিনতে ভুল হলো না।
“আরে, প্রয়াস কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া,আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও খুব ভালো আছি।”
“কবে এলেন দেশে?”
“এসেছি আজ সকালে,রাহার জন্যই আসা কিছুতেই মানতে চাইল না। তাই এসে পড়লাম। আর আমারও একটু দরকার আছে।”
“আমাদের বাসায় আসেন একদিন ভাইয়া। এভাবে রক্তের সম্পর্ক দূরে থাকবে ভালো দেখায় না।”
একটু চিন্তিতভাবে রিফাত বলে,
“তা ঠিক বলেছো। আচ্ছা আমার নাম্বার রাখো এই নিয়ে এখনতো এতো কথা বলতে পারবো না, পরে না হয় বলবো।”
ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে প্রয়াস হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
★★★
রোদ রাত্রির সাথে বসে আছে একটুপর কনে বিদায় হবে। মন খুব খারাপ তার, রোদের পাশে রাত্রির এক বান্ধবী তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই রাত্রি ওই ছেলেটা কেরে? কী হ্যান্ডসাম! আমিতো ক্রাশ খেয়ে গেলাম।”
রোদ সেদিকে খেয়াল করতেই দেখলো ছেলেটা প্রয়াস,এতোক্ষণ চিন্তায় সে খেয়াল করেনি। এখন মেয়েটার কথায় প্রয়াসকে ভালোভাবে দেখে নিল।
গাড় নীল রঙের শেরোয়ানির মাঝে গোল্ডেন কালারের জরি সুতার কাজ তার সাথে এডি স্টোন বসানো। আর গোল্ডেন কালারের একটা চুড়িদার। সব মিলিয়ে প্রয়াসকে কোনো রাজপুত্রের চেয়ে কম লাগছে না। রোদ ভাবছে আচ্ছা সব রাজপুত্র কী আমার প্রয়াসের মত সুন্দর!
প্রয়াসের মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। অদ্ভুত এক মায়া আছে এই হাসিতে যা রোদের সব ক্লান্তি চিন্তা দূর করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটার মুখে প্রয়াসের এতো প্রশংসা শুনে রাগ হলো রোদের।
নিজেকে যথা সম্ভব সামলে বলে,
“তোমরা এই বয়সে এতো ক্রাশ খেয়েও না। আর এই ছেলে এতোটা ও সুন্দর না যে তুমি যেভাবে বলছো!”
মুখটা একটু বাঁকা করে বলে রোদ।
রোদের এমন কথা শুনে রাত্রি বলে,
“আরে আপু তুমি জানো ভাইয়া কত সুন্দর দেখতে।আমার সব ফ্রেন্ডরা ভাইয়ার উপর ক্রাশড। তারা সারাক্ষণ ভাইয়ার নাম্বার চেয়ে আমাকে অস্থির করে ফেলে।”
রোদের রাগ যেন এবার আরও বাড়ে সবাই বুঝে যাবে তাই চট করে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।
★★★
রোদের পরীক্ষা শেষ হলো কাল। পরীক্ষা শুরু হওয়ায় পড়ার জন্য খুব একটা দেখা বা কথা বলে না প্রয়াস। তাছাড়া প্রয়াস এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে তার ও সময় হয়না খুব একটা।
প্রয়াসের এক কথা পরীক্ষা ভালো করতে হবে।রোদেরও পড়ালেখার প্রতি ভীষণ আগ্রহী। তাই প্রয়াসের আদেশ মাথা পেতে নিলো। আজ পরীক্ষা শেষ হওয়ায় রোদের অনেকটা নিজেকে হালকা লাগছে। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমে চলে যাবে। আজ সারারাত জেগে প্রয়াসের সাথে কথা বলবে সে।তাছাড়া যেদিন থেকে জেনেছে প্রয়াস তার বড় জেঠুর ছেলে সেদিন থেকে অনেক সতর্ক হয়ে গেছে রোদ।
কারণ রিফাত চাইছে দুই পরিবারকে মেলাতে তাই কাল সব ভাইবোনদের এক হতে বলেছে রাহাদের বাসায়।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিবে কি করে দুইভাইকে এক করা যায়। তাদের সাথে থাকবে রাহার বাবা আল মাহমুদ রহমান। কিন্তু দুইভাইকে মেলানো কি এতো টাই সহজ হবে কে জানে?
রোদ খেয়ে প্রয়াসকে কল দিয়েছে। কিন্তু প্রয়াসের ফোন ব্যস্ত এতোদিন পর কল দিচ্ছে তাও যদি এমন ব্যস্ত থাকে কেমন লাগে।
রোদের মেজাজ ক্রমশ বিগড়ে যাচ্ছে। এতোগুলো দিন সে অপেক্ষা করেছে প্রয়াসের সাথে কথা বলার।কিন্তু তিনি জানেন আজ রোদের পরীক্ষা শেষ কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন।
সে ভাবে ঠিক আছে প্রয়াস রহমান আপনার ফোন ও আর আজ আমি ধরবো না।
রোদের রাগ অনেকটা বেড়ে গেছে। মেঘলা কথা বলতে চাইলেও রোদ ভালো লাগছে না বলে এড়িয়ে যায়। এই মুহুর্তে তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এখন সে ছাদে যাবে। রোদের যখন মন খারাপ করে তখনই ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার অনেক ভালো লাগে ছাদের আবহাওয়া রোদের মন ভালো করে দেয়।
যেই ভাবা সেই কাজ। রোদ ছাদে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। শীতের শেষে সারাদিন গরম পড়লে ও সন্ধ্যার পর একটু শীতল থাকে পরিবেশ। ছাদে বাতাস বইছে, সেই বাতাসে রোদের কোমর অবদি খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। কিছু চুল সামনের দিকে এসে পড়ছে। আজ রোদ অন্যদিনের মত অবাধ্য চুলকে বাধ্য করতে চাইছে না। কার্নিশ ঘেষে দাড়িয়ে আছে সে, এর মধ্যে প্রয়াস প্রায় ২০বার কল দিয়েছে রোদ ফোন ছাদে নিয়ে আসেনি।
রোদের মন সত্যি ভীষণ রকমের খারাপ। আকাশে হালকা মেঘ উড়ছে। হলুদ বাতির আলোয় সেজেছে পুরো শহর। জনশূন্য রাতের শহর যখন নিয়ন আলোয় সাজে দেখতে বেশ লাগে তার।
তার মন হালকা করে ভালো হচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেলো রোদ। ভয়ে পুরো শরীর বরফের মত হয়ে গেছে। এই ছাদে সে সবসময় আসে কিন্তু ভুত প্রেতের উপদ্রব কখনো দেখেনি। আজ তবে কি হলো।
চোখ বন্ধ করে দাঁত মুখ খিচে রোদ দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করেছে,এর মধ্যে সে অনুভব করলো। তার কানের পাশে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে, “ভালবাসি রোদেলা, অনেক অনেক অনেক ভালবাসি।”
সাথে সাথে রোদের মন প্রাণ জুড়ে এক অন্যরকম ছন্দ খেলে গেলো। তার সাথে অনুভব করলো কার এই সুরালো কন্ঠ। বুঝতে পারলেও চোখ খুলছে না রোদ।
কিছু অনুভূতি চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে হয়।
চোখ খুলেলে সব ধোঁয়াশা আর ঝাপসা হয়ে যায়।
রোদ ও তাই করলো। প্রয়াস রোদের সাথে কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। রোদের হাত প্রয়াসের হাতের মুঠোয়। দুটি শরীর হালকা দুরত্বে। তবে একজনের শ্বাস প্রশ্বাস অন্যজন শুনতে পাচ্ছে।
প্রয়াস চোখ বোঝা রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। হলুদ বাতির শহরে রোদকে কেমন স্নিগ্ধ লাগছে।প্রশান্ত লাগছে। রোদের পুরো মুখে মায়া উপছে পড়ছে। এই স্নিগ্ধ মুখটা দেখলে তার কি যেন হয়।মনের ভেতর সুখ খেলে যায়। প্রশান্তি লাগে মনে।
কিছু অনুভুতি কখনো প্রকাশ করার মত যথাযথ শব্দ পাওয়া যায় না। রোদের কাছে আসায় পাশে থাকায় ঠিক সেরকমই শব্দহীন বৃষ্টির অনুভুতি অনুভব করে প্রয়াস। তবে আজকাল ভয় হয় প্রয়াসের রোদকে হারানোর ভয়।
রোদ চোখ খুলে তাকায় অনেকক্ষণ পর প্রয়াসের দিকে। প্রয়াস এই সময়টুকুতে রোদকে কিছুই বলেনি।বরং তার ভালো লাগছে রোদের মায়াভরা মুখটা দেখতে।
রোদের মনের একটু আগের যে রাগ ক্ষোভ ছিলো সব যেন মুহুর্তে উবে গেলো।
কিছু অনুভুতি আসলেই অদ্ভুত।
রোদ কিছু বলছেনা। প্রয়াস রোদের হাত তার মুঠোয় আরও শক্ত করে ধরে রোদের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
শান্ত স্বরে বলে,
“রাগ করেছো?”
“করেছিলাম, কিন্তু সেটা এখন আর মনে নেই”।
প্রয়াসের দৃষ্টি স্থির। এই চোখের ভাষা বুঝতে পারে রোদ। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও আজকাল খুব বুঝে রোদ প্রয়াসকে।
প্রয়াস ও বুঝতে পারে রোদ আগের থেকে কিছুটা পরিণত হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া সেই রোদের সাথে কিছুটা পার্থক্য আছে এই রোদের। আগে সব বলে বুঝাতে হতো। কিন্তু আজকাল রোদ কেমন যেন সব বুঝে যায়। হয়তো পুরোটা না,তবে যা বুঝতে পারে তা অনেক।
দুজন অনেক কথা বলে। তবে আজকের কথায় তাদের দুজন নেই, আছে দুটি পরিবারের কথা। যাদের যেকোনো উপায়ে এক করতে হবে সে যত কঠিনই হোক। কাল রাহাদের বাড়িতে সবাই বসবে তাই তখন রিফাতের সাথে কথা বলছিলো প্রয়াস।
এতোদিন দেখা না হওয়ায় যে খারাপ লাগা কাজ করছিলো দুজনের মাঝে। কে কাকে কতটা মিস করেছে। এসব কিছুই কেউ কাউকে বললো না। তবে এই বলার চেয়ে দিগুণভাবে বুঝে নিলো দুটি মন।
কথা শেষ করে রোদ ছাদ থেকে নেমে যেতে চাইলে প্রয়াস রোদকে পেছন থেকে হাত টেনে নিজের কাছে টেনে নেয়। টাল সামলাতে না ফেরে রোদ হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্রয়াসের বুকে।
তখন বুঝতে পারে প্রয়াসের বুকের ভেতরকার শব্দ।সেই শব্দে রোদের মন প্রাণ জুড়ে প্রশান্তি বয়ে আনে।
প্রয়াস হালকা আদুরে গলায় বলে,
“রোদ আমি জানি তুমি পরিক্ষা দিলে,
স্কলারশিপ পেয়ে যাবে। আর তুমি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।”
প্রয়াসের গলার স্বর ধরে এসেছে। আর কি একটা বলতে গিয়ে বলতে পারলো না।
রোদ প্রয়াসের বুকে থেকেই বলল, “আমি পরিক্ষা দিব না প্রয়াস।”
রোদ খুব একটা প্রয়াসের নাম ধরে ডাকে না। যখন খুব আবেগী হয়ে যায় তখন বলে। তাই রোদের এই নাম ধরে ডাকাটা প্রয়াসের কাছে দারুণ লাগে। মনের ভেতর ছন্দ তুলে।
প্রয়াস বলে,
“প্রয়াসের স্ত্রী কখনো কম পড়ালেখা করলে হবে না।তাকে প্রয়াসের মত পড়ালেখা করতে হবে।”
রোদ বলে,
“উঁহু মানি না।”
প্রয়াস রোদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” দেখা যাবে! অনেক রাত হয়েছে রোদ। এবার বাসায় যেতে হবে।” রোদ প্রয়াসের বুক থেকে মাথা তুলে তাকায়।
চলবে