#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer:মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ এগারো
তুলতুল আর দিয়া আজ কলেজে যাচ্ছে। ওরা আজ একটু আগেই এসেছে। কলেজে হয়তো বেশি কেউ আসেনি এ সময়। তারা কলেজের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসার জায়গাটায় কিছু সময় গল্প করবে। কলেজের কিছুটা সামনে থেকে রুশাও ওদের সাথে যুক্ত হয়। রুশা, দিয়া আর তুলতুলের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। কিন্তু মেয়েটা একটু বেশিই ন্যাকা। তুলতুল আর দিয়া অন্য সবার সাথেই মিশে কিন্তু কম। তিনজনই গল্প করতে করতে কলেজের দিকে আগায়। এমন সময় ওদের পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে অনেক গুলো গাড়ি যায়। সবগুলো গাড়িই হোয়াইট কালারের শুধু মাঝখানের তিনটা গাড়ি ব্লাক কালার। তুলতুলের চোখ যায় মাঝখানের একটা গড়িতে। সেখানে সে আবিরকে দেখতে পায়। তারমানে এগুলো সব রাফসানের দলবল। রাফসানও নিশ্চয়ই কোনো একটা গাড়িতে আছে। কিন্তু এরা কলেজের এদিকে কি করছে? নাকি কলেজেই যাচ্ছে। তাদের কি কলেজে যাওয়া ঠিক হবে এখন? রাফসান তো দেখি পুরো বাহিনী নিয়ে এসেছে। একা হলে তুলতুল কিছুটা সাহস পেত ।কিন্তু এখন তো ওদিকে যেতেই ভয় লাগছে।
তুলতুল দিয়ার দিকে তাকায় ওর চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ। কিন্তু রুশার ঠোঁটের কোণে হাসি। তুলতুল বুঝতে পারলো না রুশা কেনো হাসছে। ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে তুলতুল একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো যে কোনো চিৎকার চেচামেচি বা কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা। কিন্তু না সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এবার সে দিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে তার আগেই রুশা লাফ দিয়ে বলে উঠে
-” এই জানিস ওগুলো কার গাড়ি? রাফসানের গাড়ি।” বলে লাজুক হাসলো।
-” তো এতে আমরা কি করতে পারি? তুই এমন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে নতুন বঊ পালকি থেকে নেমে আসলি। আর এই গাড়িগুলো কলেজের দিকে যাচ্ছে কেন?” তুলতুল বললো
-” তোদের কিছু করা লাগবে না। হেহ! জানিস আমি না রাফসানের ওপর ক্রাশ খেয়েছি। কি হ্যান্ডুস রে দেখতে। হাইটাও ছয় ফিটের মতো। বডিটাও জোশ। গাল গুলো ও কিউট আমার তো দেখেই টেনে দিতে মন চায়।”
-” এই তুই তোর ক্রাশকে নিয়ে দূরে থাক। কি ভয়ংকর লোক এর ওপরে আবার ক্রাশ খায়। আর যাস ওই গুন্ডা লোকের গাল টানতে,গালে হাত দেওয়ার আগেই তোর নিজের গালগুলোই হাওয়া হয়ে যাবে। তখন বুঝবি। হুহ। ক্রাশ নয় বাঁশ।”
-” তুলতুল তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি। আর তুই রাফসানকে গুন্ডা বলছিস কেন? কত হ্যান্ডুস ছেলেটা। আমি আমার ক্রাশের ব্যাপারে খারাপ কথা শুনে পারি না। হুহ।” রুশা কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো।
-” হ্যাঁ বলতে পারলো। বলেছে দেখেই তো তুই শুনতে পেরেছিস। আর হ্যান্ডুস মানে কিরে?” দিয়া বললো।
-” আরে হ্যান্ডুস মানে বুঝিস না? হ্যান্ডুস মানে হলো হ্যান্ডসাম। হোয়াট অা হ্যান্ডসাম গাই।” রুশা গদগদ হয়ে বললো।
-” ওওও! হ্যান্ডুস মানে হ্যান্ডসাম। আমি তো ভাবলাম হ্যান্ডুস মানে হ্যান্ডওয়াশ। হ্যান্ডওয়াশের সর্টফর্ম হ্যান্ডুস” বলেই দিয়া হাসি দিল।
-” তোরা একদম ভালো না”
-” আরে শোন না। রাফসান হ্যান্ডসাম মানছি। সব দিক দিয়ে ঠিক বলা যায়। কিন্তু ঔ গুন্ডামিটা বাদে। আর তুই বললি না “হোয়াট আ হ্যান্ডসাম গাই”। তোর এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো তুই বলছিস “হোয়াট আ হ্যান্ডসাম গরু”। মানে গাই বলতে গিয়ে তোর চেহারা দেখে মনে হলো গরু বলছিস।” এটা বলে দিয়া খিলখিল করে হাসা শুরু করল।
-“মনে থাকবে হুহ্। আমারও এটা মনে থাকবে। তোদেরকে দেখে নেব।সময় আমারো আসবে।” রুশা ভেঙচি কেটে বললো।
-” এখন আপনার ক্রাশের কথা বাদ দেন। আমরা দুজনই দুইদিন কলেজে আসিনি। পড়ালেখা কি দিয়েছে তাও জানিনা। তুই বলতো এই দুই দিন কি হয়েছে। দিয়া বললো।
-” আসলে আমিও না তিনদিন যাইনি তোদের থেকে একদিন বেশি মিস দিয়েছি।” বলেই রুশা ক্যাবলা একটা হাসি দিয়ে মাথা চুলকালো। সে সময়ই রুশার ফোন আসলো। সে ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে ফোন নিয়ে আসে।কলেজে গিয়ে ফোন সাইলেন্স করে দেয়। রুশা ফোনো কথা বলে একটা হাসি দিয়ে বলে
-” বাই গাইস আজকেও আমার কলেজ যাওয়া হচ্ছে না। বন্ধুর সাথে দেখা করবো। বলেই দ্রুত হাঁটা দিল।
-” কি মেয়েরে বাবা। ধুর! ওই তুলু আমরাতো দুইদিন কলেজে যাইনি কলেজ খোলা না বন্ধ সেটাওতো জানিনা ঠিকমতো। ইশশ তুই বা আমি কেউ একজন না গেলে কলেজ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না।” দিয়া বললো
-” হুম। আমার না ভয় লাগছে এতো তাড়াতাড়ি ওই বাহিনী ওদিকে গেলো কেন? প্রিন্সিপালও তো আসেনি। থাক যা হবে দেখা যাবে চল।”
তুলতুল আর দিয়া কলেজে ঢুকতে যাবে এমন সময় একটা শব্দে থেমে যায়। ওরা কলেজের গেট দিয়ে না ঢুকে অন্য একটা চিপা জায়গায় দিয়ে ঢুকে। যেখান দিয়ে পুরো কলেজ দেখতে পারবে ওরা কিন্তু ওদের কেউ দেখতে পারবে না। কারন জায়গাটা সামনেও একটা বড় গাছ আছে। গছের এপাশ দিয়ে একজায়গায় দাঁড়ালে সব দেখা যায় কিন্তু ওপাশ থেকে দেখা যায় না। তুলতুল আর দিয়া গাছের এদিক দিয়ে কলেজের দিকে তাকিয়ে চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়। কলেজে কেউ নেই। এমনকি ক্লাসরুম গুলোর তালাও খোলা হয়নি। তাহলে কি আজ কলেজ বন্ধ ছিল? আর ওরা কিছুই জানে না। দিয়া তুলতুলের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়৷ মানে হলো-” তুই যদি ঔদিন কলেজে আসতি তাহলে এমন হতো না।”
হঠাৎ কারো চিৎকারে দুজনেই চমকে ওঠে। তুলতুলের গা ছমছম করছে। এমনি একটা নির্জন জায়গায়। তারপর আবার কারো চিৎকার। ওরা একটু এগিয়ে গিয়ে কিছু দেখে থমকে যায়। দিয়ার মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেছে ভয়ে। সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটির সাথে বেশ কয়েকজনকে বেধে রাখা হয়েছে। কিছু লোক তাদেরকে বেদম পেটাচ্ছে। লোকগুলো চিৎকার করছে। রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে তারা। তারপরও থামাচ্ছে না পেটানো। পাশে রাফসান একটা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। হাতে সিগারেট, চোখ মুখে হিংস্রতা। হঠাৎ রাফসান উঠে দাড়ায়। পাশের একজনের কাছ থেকে একটা প্লাস হাতে নিয়ে বেঁধে রাখা লোকগুলোর দিকে আগায়। লোকগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলে। তুলতুলরা দূরে হওয়ায় তা শুনতে পায় না।
রাফসান হঠাৎ এক লোকের হাত টেনে ধরে হাতের এক আঙুলে প্লাস দিয়ে জোরে চাপ দেয়। এতে হাত থেঁতলে রক্ত বের হয়ে নখ একটু আলগা হয়ে গেলে প্লাস দিয়ে নখ টান দেয় তাতে লোকটির নখ উঠে যায়। এ দৃশ্য দেখে ওরা দুজনই শিউরে ওঠে। কি ভয়ংকর পদ্ধতি। রাফসান একে একে পাঁচটি আঙুলের নখই তুলে ফেলে প্লাসটা অন্য লোকের হাতে দেয় যে তারা বাকিদের যেন এভাবে শাস্তি দেয়। রাফসান পেছন ফিরে পা বাড়ায় তখন তাদের মধ্যে কেউ কিছু একটা বলে সেটা শুনে রাফসান রিভলবার বের করে লোকটির দিকে ফিরে মাথায় গুলি করে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে, লোকটি বাঁধা অবস্থায়ই নেতিয়ে পড়ে। রাফসান গিয়ে আগের মতোই চেয়ারে বসে। অন্য লোকগুলোর চিৎকার তুলতল আর দিয়ার কানে আসছে। তুলতুল জমে গেছে ভয়ে এগুলো দেখে। দিয়ার হাত- পা কাঁপছে। আর দেখতে পারবে না সে। এখনো হয়তো আরো অনেক বাকি। রাফসান যেভাবে গিয়ে বসেছে। যেন এতটুকুতে কিছুই হয়নি। মনে হচ্ছে সে লোকগুলোর সাথে আরো ভয়ংকর কিছু করবে। লোকটা আস্ত একটা সাইকো। কোনো মায়া দয়া নেই। আর একমুহূর্ত থাকলে নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে।
ও দ্রুত তুলতুলকে টেনে ধরে। ওদের এখান থেকে যেতে হবে। কিন্তু তুলতুল নড়ছে না।
দিয়া তুলতুলকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা খেয়ে তুলতুলের হুঁশ হয়। দিয়া ইশারায় চলে যাওয়ার কথা বুঝায়। ওরা চলে যেতে নেয় তখন তুলতুল ভেঙে পড়া গাছের ডালের সাথে পা বেঁধে পড়ে যায়। তুলতুল আস্তে আর্তনাদ করে ওঠে। দিয়া ভয় পেয়ে যায় যে কেউ শুনলো নাকি। ও তাড়াতাড়ি তুলতুলকে ধরে ওঠাতে যায়। তখন শোনে কেউ বলছে
-” এই কেউ দেখতো ওদিকে কিসের শব্দ হলো। মনে হলো কারো কন্ঠ শুনলাম। দেখ কেউ আছে কিনা।”
দিয়ার বুক ধুকপুক করছে এই বুঝি ধরা পড়ে গেলো। ও গিয়ে তুলতুলকে হ্যাঁচকা টানে উঠিয়ে পেছনের দিকে যেতে থাকে। আর তুলতুল রোবটের মতো হাটছে। বোঝাই যাচ্ছে শক থেকে এখোনো বের হতে পারে নি। চারপাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরই জোরে নামবে।
দিয়া তুলতুলের হাত ধরে জোরে দৌড়াতে শুরু করে। এতক্ষণে জোরে বৃষ্টি নামা শুরু করেছে। দুইজনেই ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টি বড় বড় ফোঁটা গুলো গায়ে পড়ে হালকা ব্যাথা লাগছে। কারণ অনেক জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে দিয়া তুলতুলের দিকে তাকায়। ওর এখন তুলতুলকে ঠিক চারবছর আগের তুলতুল লাগছে। চারবছর আগেই দিয়ার সাথে তুলতুলের পরিচয় হয়। তুলতুল সবসময় চুপ হয়ে থাকতো, নড়াচড়া করতো না,মনে হতো রোবট একটা। কথা বললেও উওর দিত না। শুধু চেয়ে থাকতো, কেমন নির্জীব হয়ে থাকতো। যেমনটা এখন হয়ে রয়েছে।
বৃষ্টির পানিতে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেখানে তুলতুল চোখের পলক ফেলছে কয়েকবার মাত্র। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর সব শূন্য হয়ে গিয়েছে। দিয়া ওর হাত ধরে দৌড়াচ্ছে দেখে ঔ দৌড়াচ্ছে। দিয়া নজর সামনের দিকে দিল। তাদেরকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে। কেউ যদি তখন দেখে থাকে তাহলে গাড়ি নিয়ে ওদের খুঁজতে আসবে। তখন কি করবে তাহলে। দিয়া ভাবছে সবসময় ওদের সাথেই কেন এটা হয়?
চলবে….