মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ২৫

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ পঁচিশ

তিয়াস প্রান্তর সাথে সব কথা বলে বাড়ি ফেরে। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে গেটের সামনে গাড়ির চাকার দাগ দেখে মাটিতে। এখানে কে গাড়ি নিয়ে আসবে? আর কেনোই বা একদম গেটের গা ঘেঁষে রাখবে? এখানে তো গাড়ি পার্ক করার জায়গা না। আশ্চর্য! তিয়াস চিন্তিত ভাবে বাড়ির ভেতর ঢোকে। তার ব্যাপার টা ভালো লাগলো না। কোনো গ্যাংস্টার আসলে তো অনেক গাড়ি নিয়ে আসতো কিন্তু ওখানে শুধু একটা গাড়ির চাকার ছাপ রয়েছে। তাহলে কে আসবে? তিয়াস ভেতরে গিয়ে দেখে তাওহী সোফায় শুয়ে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখছে কিছুক্ষণ পরপর খিলখিল করে হাসছে। তিয়াস তাওহীকে হাসতে দেখে মুচকি হাসলো। সে তাওহীর পাশে বসে আর তাওহী তাকে দেখে বলে

-” ভাইয়া দেখো জেরি টা কি দুষ্ট, সবসময় টমকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। আমিও জেরির মতো হবো।”

-” উহুম। এতো দুষ্টুমি করা ভালো না। আর অন্যদের সাথে বেশি দুষ্টুমি করলে তারা রাগ আর বিরক্ত হয় যেমন, এইযে টম জেরির ওপর হয়।”

-” কিন্তু জেরি তো অকারণে দুষ্টুমি করে না। টম ওকে বিপদে ফেলতে চায়, খেতে চায় এজন্যই তো জেরি টমকে দুষ্টুমি করে শাস্তি দেয়। আমার সাথে কেউ এমন করলে আমিও দুষ্টুমি করে শাস্তি দেব। ভালো হবে না?” বলে তাওহী আবার খিলখিল করে হেসে উঠে। তিয়াস সে হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে৷ কতটা নিষ্পাপ সে হাসি। এই হাসিকে ধরে রাখতে তার পরিবারকে রক্ষা করতে সে যা করার তাই করবে। পুরনো জগতে ফিরতে হলেও ফিরবে। তাওহী পুনরায় টম এন্ড জেরি দেখায় মন দিল। তিয়াস তাওহীর চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। আবার হাত দিয়ে ঠিক করে দিলো।

তিয়াস উঠে নিজের রুমের দিকে যায়। ফ্রেশ হয়ে তুলতুলের রুমের দিকে আগায়। রুমে গিয়ে দেখে দিয়া ঘুমিয়ে আছে। গায়ে কাঁথা দেওয়া কিন্তু পা বের হয়ে আছে। তিয়াস পা ঢেকে দিয়ে দিয়ার মাথার কাছে বসে ওর দিকে তাকায়। ঘুমালে মেয়েটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। দিয়া প্রচুর ফর্সা, চোখ গুলো টানা টানা নাকটা একটু বোঁচা। তিয়াসের দিয়ার নাক দেখলে হাসি পায়। মনে হয় কিছুতে গুঁতা খেয়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, এটা শুধু তার কাছেই মনে হয়। যদিও দিয়ার নাক অতটাও বোঁচা না। তিয়াস দিয়ার মুখের ওপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল। এ কয়দিনে সে তিয়াসকে প্রচুর জ্বালাতন করেছে। পায়ে ব্যাথার জন্য তিয়াসকেই কোলে নিতে হয়েছে। সে রুমে খাবার খাবে না। তাকে ডাইনিং এ নিয়ে যেতে হবে। তিয়াসকে নিয়ে যেতে হয়েছে আবার রুমে দিয়ে যেতে হয়েছে। আরো অন্য সময় তো আছেই। তিয়াসের মনে হয় দিয়া ইচ্ছা করেই তাকে জ্বালিয়েছে। সাথে তুলতুলও সাথ দিয়েছে। সে জানে দিয়া তাকে ভালবাসে। তাকে ভয় পায় তারপরও তার জন্য পাগল। কিন্তু তিয়াস দিয়াকে ভালবাসে না ঠিক কিন্তু স্নেহ করে। কেনো জানি সে দিয়াকে ভালবাসতে পারে না। ভালোবাসতে চায়ও না। সে চায় না দিয়া তার জীবনের সাথে জড়াক। যেখানে তার জন্য তার পরিবারের নিরাপত্তাই অনিশ্চিত সেখানে সে আরেকটা জীবনকে কিভাবে অনিশ্চয়তায় জড়াবে? তিয়াস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দিয়া কালকে বাড়ি চলে যাবে। তিয়াস ওঠে বাইরে চলে যায়।

তুলতুলকে খোঁজে, অনেকক্ষন হয়ে গেলো তাকে দেখছে না। বাসায় থাকলে তো তাওহী, দিয়া এদের সাথে মেতে থাকে। পুরো বাড়ি ভরা ভরা লাগে তুলতুল আর তাওহীর জন্য কিন্তু ওরা যখন বাড়িতে থাকে না তখন বাড়িটা একদম নিরব নিস্তব্ধ হয়ে থাকে ভালো লাগে না সেটা তিয়াসের। তিয়াস আফসা বেগমকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখলো। সে গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করে

-“মা তুলতুল কোথায় এতক্ষণ হয়ে গেলো ওকে তো দেখলাম না। কোথাও কি আবার গিয়েছে?”

-” তোর সাথে যে বের হয়েছে এরপর সে কি আর বাড়ি ফিরেছে? ফেরেনি। দেখ গিয়ে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নাহয় দোকানে চলে গেছে। মহারানী একবার বাইরে যেতে পারলে আর ঘরের খোজ থাকে না।”

-” আমি তো ওকে অনেকক্ষণ আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি তাওহীর সাথে তাও প্রায় তিনঘণ্টা হতে চললো। আর ও এতক্ষণ বাড়িতে আসেনি তাহলে কোথায়? তাওহী তুলতুল কোথায় তুই তো ওর সাথে ছিলি। ”

-” আমি তো ভুলেই গেছি। বাড়ির সামনে থেকে আমি দৌড়ে চলে আসি। আপুও আমার সাথে আসছিল। এরপর আর দেখিনি তো।” তাওহী বললো।

-“দেখ দোকানে গেছে হয়তো। চলে আসবে।” বলে আফসা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। জানে এটা তুলতুলের নিত্য দিনের কাজ।
কিন্তু তিয়াসের চিন্তা গেলো না। তার তুলতুলকে ওভাবে ছাড়া মোটেও উচিত হয়নি। চারপাশে এতো সমস্যা যে না চাইলেও তিয়াসের মাথায় খারাপ ভাবনা চলে আসছে। সে দ্রুত তার বাবাকে ফোন করে। কিন্তু তফিজ আহমেদ বলেন তুলতুল দোকানে যায় নি। এতে তিয়াস ঘাবড়ে যায়। তখনকের বাড়ির সামনে গাড়ির চাকার দাগের কথা মনে পড়ে। ঐ গাড়িতে করে তুলতুলকে কোথাও নিয়ে যায় নি তো কেউ? তিয়াস দ্রুত বাড়ির বাইরে যায়। বোনকে হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরেছে। সে বাইরে এসে দ্রুত সেই জায়গাটা আর আশেপাশে চোখ বুলায় কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। হঠাৎ করেই তার বারান্দার কোণে লাগানো সিসি টিভি ক্যামেরার দিকে চোখ পড়ে। সে দ্রুত পায়ে তার রুমের দিকে যায়। তুলতুল যখন বলে তার রুমে কেউ এসেছিল এরপরেই সে তুলতুলের বারান্দায় সিসি টিভি ক্যামেরা সেট করে। যাতে দেখতে পারে কে রুমে ঢুকে। বারান্দা থেকে গেটের দিক একটু দেখা যায় তাই ফুটেজে দেখা যেতে পারে। তিয়াস ভাবতে লাগলো কে এমন করেছে রুশান? নাকি যে তুলতুলের রুমে ঢুকেছিল? নাকি অজানা কেউ?

তিয়াস তার রুমে ঢুকে মনিটরের সামনে বসে সেটা অন করে ফুটেজ গুলো দেখতে লাগে। তিন ঘন্টা আগের ফুটেজ দেখে কারন তুলতুলকে সে বাড়ি পাঠিয়েছে প্রায় তিনঘণ্টা আগে। সে দেখে তাওহী বাড়ি দৌড়ে চলে আসে তার একটু পরেই একটা সাদা রঙের গাড়ি এসে তাদের গেটের সামনে পথ আড়াল করে দাঁড়ায়। মানে তুলতুলকে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছে গাড়ি। কিন্তু তিয়াস গাড়ির এপাশটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে ওপাশে কি হচ্ছে তা ফুটেজে দেখা যায় না। বারান্দায় লাগানো ক্যামেরা এজন্যই বেশি দেখতে পারছে না। তিয়াস দেখে গাড়িটা দশমিনিট পযন্ত সেখানে ছিল এরপর চলে যায়। তাহলে এই গাড়িতে করেই কি তুলতুলকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে? তিয়াসের হাত পা কাঁপতে থাকে। গরম নেই কিন্তু তারপরও সে ঘামছে। বোনকে কি আর ফিরে পাবে সে? নাকি আগের মত.. নাহ সে আর ভাবতে পারছে না। তাড়াতাড়ি প্রান্তকে ফোন করে এটা জানায়। তারপর সে কাউকে ফোন করে

-” তিয়াস বলছি!”

-” তফি তোমার হেল্প লাগবে।

-” কিছু লোকজন লাগবে। আর একটা গাড়ির নাম্বার দিচ্ছি ওটা সম্পর্কে সব ইনফরমেশন লাগবে, গাড়ির মালিক সম্পর্কেও সব ডিটেইলস জানতে চাই। সময় কম, দ্রুত লাগবে।

-” ধন্যবাদ। আর কখনো ফিরবো কিনা তা বলতে পারছি না। আর আমি নাম্বার মেসেজ করে দিচ্ছি।”

ফোন রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিয়াসের ফোনে ফোন আসে। কিন্তু সেটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। সে ফোন রিসিভ করে। এরপর জানায় যে সে আসছে।

.

রাফসানের গাড়িতে বসে আছে তুলতুল। গাড়িটা তাদের বাড়ির সামনে থামিয়েছে। তুলতুল রাগী দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রাফসানের মুখের কোনো ভাব বোঝা যাচ্ছে না। আজকে তুলতুলকে রাফসান প্রচুর জ্বালিয়েছে। আর উদ্ভট সব কাজ করেছে। তুলতুল তা মনে করতে চাইলো না। তার সে কথা ভাবলেই রাগ হচ্ছে এখন এর সামনে থাকলে নিশ্চিত উল্টা পাল্টা কথা বলে বসবে আর এই ব্যাটাও তাকে মেরে দিবে। সে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমি নামবো।”

-” তো নামো। আটকে রেখেছে কে?” রাফসান ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল। এতে তুলতুলের মেজাজ আরো খাারাপ হয়। তার পা ব্যান্ডেজ করা সে কিভাবে হাঁটবে? একটু আগেও তো কোলে নিয়েই গাড়িতে বসিয়েছ তখন সে মানা করেছে শুনেনি আর এখন ঢং করছে। সে বাড়ি যাবে কিভাবে? এখান থেকে ডাকলে তার আওয়াজ বাড়ির ভেতর যাবে না। আর এই লোকও সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। উফফ! তুলতুল রাগ করেই গাড়ি থেকে নামতে গেলো কিন্তু গাড়ির ডোর লক করা। এবার সে রাফসানের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো

-” গাড়ি লক করে রেখেছেন কেন? খোলেন এটা, আমি বাড়ি যাবো।”

তুলতুলের কথা শুনে রাফসান শান্ত ভাবে তুলতুলের দিকে তাকায়। তারপর একটা মুচকি হাসি দেয়। তুলতুল অসস্থিতে পড়ে যায়। রাফসান হাসলে তাকে সুন্দর লাগে। আর সে শুধু তুলতুল একা থাকলেই তার সামনে হাসে অন্য সময় নয়। তুলতুল রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান মুখে হাসি নিয়েই তুলতুলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। হঠাৎ করে হওয়ায় তুলতুল বুঝতে পারে নি যখন বুঝতে পারে তখন তার মুখের সামনে রাফসানকে দেখে। সে চোখ বড় বড় করে তাকায়, কিছু বলতে যাবে কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। যদিও রাফসান তার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে। তুলতুল হাঁসফাঁশ করে। তা দেখে রাফসান বলে

-” আমার সাথে কখনো আর এভাবে কথা বলবে না, তাহলে ভালো হবে না।” রাফসান সরে যায় আর তুলতুল বিরবির করে বলে ডেভিল একটা। কি রকম ঠান্ডা স্বরে তাকে থ্রেট দিল। তুলতুল ভেংচি কাটে, কিন্তু রাফসান তা দেখে না। সে গাড়ির লক খুলে বের হয়ে তুলতুলের পাশের ডোর খোলে তারপর নিচু হয়ে তাকে কোলে তুলে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়া করায়। এরপর বলে

-” এখন থেকে তোমার বাড়ির লোক কাউকে ডাক দাও তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”

-” আজব! এতদূর থেকে ডাকলে তারা কিভাবে শুনবে? আমার জন্য কি দরজার সামনে বসে থাকবে?” তুলতুল বিরক্তি নিয়ে বললো। তারচেয়েও বিরক্তি নিয়ে রাফসান ফোন বের করে তুলতুলের হাতে দিয়ে বলে

-” বাড়ির কাউকে ফোন দাও। ফোন দিয়ে বলো তুলোর বস্তাকে যেনো নিয়ে যায়। ”

-” আপনি কি বললেন?”

-” কি বলবো? বললাম ফোন দিয়ে কাউকে বলো যাতে তোমাকে নিয়ে যায়। বেশি বোঝো একদম।” রাফসানের কথায় তুলতুল রাগ হলেও কিছু বলে না। সে ফোনে কথা বলে ফোন ফেরত দেয়।

-“আপনিও চলুন, এতো কষ্ট করে এতদূর যখন আসলেন তখন ভেতরে চলুন। ” ব্যাটা তুই শুধু বাড়িতে চল তোকে আমি বেঁধে ঝাড়ু দিয়ে পেটাবো। আমি না পারলে তাওহীকে দিবো। এতোদিনের সব শোধ আজকে আমি তুলে নেব শুধু বাড়ি গেলেই হয়। রাফসান বুঝি তুলতুলের মনের কিছু বুঝতে পারলো। কারন তুলতুলের মুখ স্বাভাবিক থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সে ভেতরে ক্রোধান্বিত। রাফসান মুচকি হেসে বললো

-” তোমাকে দেখে বুঝা যায় তুমি আমাকে দেখতেই চাও না আবার বাড়ি যেতে বলছো? কেনো জামাই আদর করবে বুঝি? কিন্তু আমি না আদরে অভ্যস্ত নই। তো আমি আসি ঠিকাছে বেবি?” রাফসান গাড়িতে গিয়ে বসে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসি দেয়

-” আবার দেখা হবে। এখন তো আমাকে যেতে হবে কষ্ট পায় না ঠিকাছে? আমি আসি। যাও বাবু বাড়ি যাও। হুঁশশশশশশশশ।” বলে গাড়ি টান দিয়ে চলে যায়। আর তুলতুল রাগে গজগজ করতে থাকে। সে দেখে নেবে এই গুন্ডু, পান্ডুকে। হুহ্

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here