মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ২৪

#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ চব্বিশ

তুলতুল বিস্মিত হয়ে রাফসানের মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলকও ফেলছে না। রাফসান সেটা বুঝতে পেরেও কিছু বলছে না। সে তার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তুলতুলের মনে হচ্ছে এটা রাফসান না অন্য কেউ। কারন একটু আগে সে যে কাজ গুলো করেছে সেগুলো কখনো রাফসান করবে না তুলতুলের ধারণা মতে। তাহলে এটা কে? রাফসানের ভূত? তুলতুল এবার ভয় পেয়ে এদিক ওদিক তাকালো দেখতে যে কেউ আছে কিনা? কিন্তু কেউ নেই। এখন কি হবে তার এই ভূত যদি তার ঘার মটকে দেয়? এটা ভেবে তুলতুল জোরে চিৎকার দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যাথা পেয়ে আবার বসে যায়। রাফসান এতে বিরক্ত হয়ে একটা ধমকি দেয়।

-“সমস্যা কি? চুপচাপ বসে থাকতে পারছো না? খালি তিড়িং বিড়িং করা। দেব একটা কানের নিচে।” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল মুখ কালো করে চুপচাপ বসে থাকলো। তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে এটাই রাফসান কোনো ভূতটূত না।
তখন সে এলার রুমে যাওয়ার পরে এলা তেড়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আকস্মিক এ ঘটনায় তুলতুল তাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়। আর তার হাতের ধাক্কা লেগে পাশে থাকা ফ্লাওয়ার বাস পরে গিয়ে ভেঙে যায়। ফ্লাওয়ার বাসের সাথে একুরিয়াম ছিল ওটাও ভেঙে পানি আর কাচের টুকরো রুমে সিটকে পড়ে। ভেতরের মাছ গুলো পানি ছাড়া ফ্লোরের উপর ছটফট করতে থাকে। এতে এলার রাগ আরো বেড়ে যায়। সে চিল্লিয়ে তুলতলের চুলের বেণি ধরে দাঁড় করায়। আর তুলতুল এতোক্ষণ হতভম্ব হয়ে সব দেখছিল। মূহুর্তের মধ্যেই কি থেকে কি হয়ে গেলো। এসেছে রাফসানের সাথে দেখা করতে কিন্তু তা না হয়ে এই ডাইনির সাথে দেখা হয়ে গেলো? কিন্তু এলা যখন তুলতুলের চুল ধরে ও রাগে পা দিয়ে এলার পায়ে জোরে করে লাথি। এতে এলা চুল ছেড়ে দিয়ে পা ধরে বিছানায় বসে পড়ে।

-” ভালো ব্যবহারের কোনো দামই নেই তোর কাছে। একদম আমার সাথে লাগতে আসবি না।” বলে তুলতুল রুমের বাইরে যেতে উদ্যত হলে এলা আবার দৌড়ে এসে তুলতুলকে ধাক্কা দেয়। তুলতুল আবার হুমড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। ফ্লোরে কাচ থাকার কারনে কিছু তার হাতে আর পায়ে ঢুকে যায়। তুলতুল ওখানে বসেই আর্তনাদ করে উঠে। হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে তার। কাচগুলো এখনো বিঁধে আছে। এলা এরপরও ক্ষান্ত হয় না। সে টেবিলের ওপর থাকা খালি কাচের জগ হাতে উঠিয়ে নেয়

-” তোর জন্য আমি সেদিন রাফসানের কাছে কথা শুনেছি, তোর জন্য আমার এতো টাকার ব্যাগ নষ্ট হয়ে গেছে। তোর সাথে দেখা হবার পর থেকেই আমার জীবনে যত ঝামেলা এসেছে। রাফসানও আমার কথা শোনে না। সব কিছুর মূলই তুই।” বলে তুলতুলের মাথায় জগটি দিয়ে বাড়ি দিতে যায় কিন্তু পারে না। তার আগেই কেউ তার হাত ধরে ফেলে। এলা তাকিয়ে দেখে রাফসান। তার চোখ দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে। সেই আগুনে এলা ভস্ম হয়ে যাবে এমন অবস্থা। রাফসান চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে মনে হচ্ছে তার পুরো শরীর কাঁপছে। সাহস কি করে হয় এলার তার বাড়িতে থেকে তারই অনুমতি ছাড়া কারো গায়ে হাত দেওয়ার? তাও আবার এই পিচ্চি মেয়েটাকে? সে এসে তুলতুলকে নিচে বসে থাকতে দেখে। এলা যখন জগ হাতে নিয়ে কথাগুলো বলছিল তখন তার কাছে পরিষ্কার হয় যে তুলতুল তার সামনে সত্যিই রয়েছে। আর এলা তার ওই অবস্থা করেছে। সে নিচে বসে কেমন নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফসানের খারাপ লাগলো। কিন্তু মূহুর্তের ভিতরেই তার রাগ দপ করে জ্বলে উঠলো যেনো। এলা যখন বারি দিতে যায় তখন রাফসান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলে। রাফসানের এই অবস্থা দেখে এলা ঢোক গিলে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে কিছু বলার আগেই রাফসান তার হাত থেকে জগটা কেড়ে নিয়ে অন্য দিকে আছাড় মারে। এতে জগটা ভেঙে ঝনঝন শব্দ হয়। রাফসান ঠাস করে পর পর দুটো থাপ্পড় মারে এলার গালে। তারপর মূহুর্তেই এলার গলা চেপে দেয়ালে সাথে ওকে লাগিয়ে গর্জন করে বলে ওঠে

-” ইউ ব্লাডি বি*! তোর সাহস কিভাবে হয় আমার বাড়িতে থেকে এসব করার? কার অনুমতিতে নিজের কর্তৃত্ব ফলাস? এখানে থাকতে দিয়েছি দেখে তুই যা ইচ্ছা তাই করবি? সেই সাহস তোকে রাফসান দেয় নি। তোর বাপ তোকে শাসন না করে যা ইচ্ছা তা করার অনুমতি দেয় দেখে কি ভেবেছিস আমিও দেবো? উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে একটা বানিয়েছে। তাকিয়ে দেখ তুই মেয়েটার কি অবস্থা করেছিস। সাইকো কোথাকার।” এলা রাফসানের হাত গলা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আজকে মনে হয় রাফসান তাকে মেরেই ফেলবে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাফসান এটা দেখে ছেড়ে দিয়ে বলে

-“এখনি বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। আমি তোকে একমুহূর্তও এখানে দেখতে চাই না। গেট লস্ট ফরম মাই হাউজ! ” রাফসানের চিৎকারে এলা ভয় পেয়ে দ্রুত ওখান থেকে চলে যায়। নাহলে এই কাজ করার পর এখানে থাকার জেদ করলে রাফসান তাকে শেষ করে ফেলবে। এদিকে এলা বের হয়ে যাবার পর রাফসান রাগ নিয়েই তুলতুলের কাছে যায়। গাধী একটা পড়ে পড়ে মার খেয়েছে। এটাকেও এখন কয়েকটা কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। স্টুপিড!

তুলতুল নিচে বসে কান্না করছিল আর নিজের হাত পা গুলো দেখছিল। সে এখন উঠে দাড়াবেই কিভাবে আর বাড়িই বা যাবে কিভাবে? শয়তান এলার জন্য তার এই অবস্থা হলো। কিন্তু এলাকে মার খেতে দেখে তার হুঁশ হয়। সে কান্না বন্ধ করে হাবার মতো তাকিয়ে দুজনকে দেখছিল। কখন যে মার বন্ধ করে রাফসান তার দিকে এগিয়ে এসেছে সেটা সে খেয়াল করেনি। রাফসান এগিয়ে এসে বলে

-” হ্যাঁ দেখো! ভালো করে দেখো। সিনেমার রোমান্টিক সিন চলছে তো। ভালো করে দেখতে পারবে না? থ্রিডি চশমা এনে দেবো? স্টুপিড কোথাকার। এখনো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে মার খেয়ে। অসহ্য!” রাফসান বিরক্তির সাথে তুলতুলকে চট করে কোলে তুলে নেয়। এতে তুলতুলের টনক নড়ে। সে রাফসানের কোলে নিজেকে দেখে হতভম্ব হয়ে নড়াচড়া শুরু করে নামার জন্য।

-“আরে কি আশ্চর্য! আপনি আমাকে কোলে নিয়েছেন কেন? নামান বলছি তাড়াতাড়ি। নামান!”

-“এখন তো আশ্চর্য লাগবেই। এতোক্ষণ তো সব নরমাল ছিল তাই না? বেশি করলে ফেলে দিব সিঁড়ি দিয়ে একদম। কোমড় তো ভাঙবেই সাথে একবারে গড়িয়ে নিচে গিয়ে মাথাও ফাটবে। তাই চুপচাপ থাকো।” বলে রাফসান সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। আর তুলতুল রাফসানের কথা শুনে ফেলে দেওয়ার ভয়ে চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু ওর অস্বস্তি হচ্ছে প্রচুর এভাবে রাফসানের কোলে থাকতে। বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। তুলতুল রাফসানের দিকে তাকালো। শাওয়ার নিয়ে হয়তো চুল মোছেনি এজন্য চুল থেকে এখনো পানি পড়ছে হালকা। সিল্কি চুল ভেজা হওয়ায় কপালের ওপর পড়ে রয়েছে। ভালো লাগছে রাফসানকে দেখতে। তুলতুল রাফসানের গায়ের দিকে তাকালো। রাফসান একটা কালো রঙের সেন্ডো গেঞ্জি পড়া। যা গায়ের সাথে ফিট হয়ে রয়েছে। হাতের পেশিগুলো দৃশ্যমান। ফর্সা গায়ে… তুলতুলের মাথায় ভাবনাগুলো বারি খেলো। ও কি করছিল এতোক্ষণ? ছিঃ সে কিভাবে এই গুন্ডার দিকে তাকিয়ে ছিল। তুলতুল নিজের কাজে লজ্জা পেলো আবার রাগও হলো। সে রাফসানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। কিন্তু রাফসানের দৃষ্টি সামনে স্থির। রাফসান তুলতুলকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে আবিরকে ডাক দিয়ে ডাক্তার ডাকতে বলে। আর তুলতুলের গালে হাত দিয়ে বলে

-” পিচ্চি ওয়েট। এখানে বস আমি আসছি। উঠলে তুলে আছাড় মারবো। গট ইট?” বলে রাফসান চলে গেলো আর তুলতুল অবাক হলো রাফসান তার গালে হাত দিয়েছে? তুলতুল নিজের গালে হাত দিল। তারপর আবার রাফসানের কথা মনে করে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। ব্যাটা তাকে ধমকি দিয়ে গেলো ঠান্ডা স্বরে। গুন্ডা, পান্ডা একটা।

রাফসান নিজে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে তুলতুলের পাশে বসে ওর হাত নিজের কাছে নিয়ে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো গুলো হাত থেকে তুলে ক্ষত স্থান অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তারপর পায়ের কাছে বসে একই ভাবে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। আর তুলতুল রাফসানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে তাকে মেরে ফেলতে চাওয়া লোকই এখন তার হাত পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে? তারজন্য আবার এলাকেও মারলো? ভাবা যায়? রাফসানের প্রশ্নে তুলতুলের ভাবনার সুতো কেটে গেলো।

-” তুমি এখানে কি করছিলে? আর কিভাবেই এখানে আসলে?”

রাফসানের প্রশ্নে তুলতুল অবাক হলো নিজেই লোকজন দিয়ে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে এসে আবার বলছে সে এখানে কি করে আসলো? আজব! গুন্ডা ব্যাটার মনে হয় সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। নাহলে তার এভাবে সেবা করছে? আবার বলছে সে এখানে কি করছে? ধুর! তুলতুল রাগ নিয়ে বললো

-” আপনি নিজেই ডেকে পাঠিয়ে এখন আবার বলছেন কিভাবে এসেছি?”

-” ওয়েট ওয়েট! মানে? তুমি কি বললে আমি তোমাকে এখানে ডেকেছি? আমার কি মাথা খারাপ যে আমি এখানে আমার বাড়িতে তোমাকে ডাকবো?” রাফসান ভ্রু কুচকে বললো।

-” তাহলে কি আমি উড়ে এসেছি এখানে? আপনি ডেকেছেন আর আপনার লোকজন জোর করে নিয়ে এসেছে আমাকে। যত্তসব।”

-” মানে আমার লোকজন তোমাকে নিয়ে এসেছে আমার নাম করে?” রাফসান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। ও তো ওর লোকজনকে কিছু বলেনি তাহলে ওর কথা ছাড়া এই মেয়েটিকে কেন নিয়ে এসেছে অকারণে?

-” জি হ্যাঁ! ”

রাফসান উঠে কোথায় যেনো চলে গেলো। আর তুলতুল নিজের বাড়ির কথা ভাবছে। ও বাড়ি গিয়ে কি বলবে? এগুলো ব্যান্ডেজ দেখেই তো প্রশ্ন করবে কি হয়েছে কিভাবে হয়েছে? তখন তুলতুল কি জবাব দেবে? উফফ।
রাফসান তার লোকজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরও আছে রাফসানের পাশে। কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে তুলতুল রাফসানের সাথে এখানে কি করছিল? রাফসান সবাইকে জিজ্ঞেস করে

-” মেয়েটিকে এখানে কে নিয়ে এসেছে আমার নাম করে? আর কেনোই বা নিয়ে এসেছে আমার অনুমতি ছাড়া বল? ড্যাম ইট!”

রাফসানের চিৎকার শুনে ওদের দলের মবিন মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল

-“ভাই আপনি সকালে বলছিলেন মেয়েটাকে মনে পড়ছে, তাই আমরা ভেবেছি ওকে আপনি নিয়ে আসতে বলেছেন। অন্য সময়ে তো কাউকে মনে করা মানে তাকে আপনার সামনে হাজির করা তাই আমরা নিয়ে এসেছি। ” রাফসান গিয়ে মবিনকে একটা থাপ্পড় মেরে দিল।

-” গাধা! এতোদিন যাদের কথা বলেছি ওরা সবাই উল্টো পাল্টা কাজ করেছে আর নয়তো আমার কথার বাইরে গিয়েই কিন্তু মেয়েটা কি করেছে? আর আমি কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে আসতে বলেছি? ইডিয়ট গুলো।” বলে রাফসান তুলতুলের ওখানে যায়। ওর ভুল হয়েছে ওদের সামনে তুলতুলের নাম নেয়া। রাফসান গিয়ে তুলতুলের সামনে দাড়ালে তুলতুল বলে

-” আমি বাসায় যাবো আমাকে দিয়ে আসুন।”

-” ওদের সাথে এসেছো নিজের ইচ্ছায় এখন যাবে আমার ইচ্ছায় বেবি।” বলে রাফসান চোখ টিপ দেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here