মেরির প্রতিজ্ঞা পর্ব -০২

গল্পঃ মেরীর প্রতিজ্ঞা ( ২য় পর্ব )

বিবস্ত্র মেরী পালঙ্কে শুয়ে অপেক্ষায় আছে সুলতানের, বালিশের নিচে ধারালো তরবারী। মেরী অপেক্ষায় আছে সুলতান কখন আসবে তার দেহ ভোগ করতে আর মেরী তার উদ্দেশ্য হাসিল করবে।

সুলতান জানালার পাশে দাড়িয়ে মেরীর মৃত বাবার নামে উল্টোপাল্টা বলেই যাচ্ছে সমান তালে। আর মেরীর অস্থির মনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে বাবার হত্যার শোধ নেবার সেই মুহুর্তের।

মেরীর বাবাকে যেদিন হত্যা করা হয়েছিল সেদিন কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সেদিন মেরীর বাবা রাজা মির্জা আকবরের মন্ত্রীর একমাত্র মেয়ে এলিসা রাজপ্রাসাদে এসে মীরার কক্ষে উপস্থিত, এলিসাকে ক্লান্ত এবং ভীষণ চিন্তিত ও চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখে মেরী জিজ্ঞেস করলো– কী হয়েছে এলিসা?

একগ্লাস পানি খেয়ে মৃদু কম্পিত কণ্ঠে এলিসা বললো– সুলতান মস্তবড় ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে মেরী, প্রতিশোধের আগুনে মাতাল হয়ে আছে সুলতান, যেকোনো মুহূর্তে ভয়ঙ্কর হামলা করে বসতে পারে!

একটু সময় কিছু একটা ভেবে মেরী বললো– হুম, আমাদের আরও আরও সতর্ক হওয়া উচিৎ, রাজ্যের সীমান্তে রক্ষী দ্বিগুণ করতে হবে অতি দ্রুত, আমি বাবার সাথে কথা বলছি এক্ষুণি।

এলিসা হন্তদন্ত হয়ে বললো– তার আর সময় নেই মেরী, গুপ্তচরের মাধ্যমে সংবাদ পেয়েছি আজ রাতেই রাজ্যের দক্ষিণাংশে হামলা করে ভেতরের দিকে প্রবেশ করবে সুলতান ও তার সৈন্যরা সদলবলে, আমাদের রাজ্যের আজ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে, বাবা অসুস্থ তাই আমায় পাঠিয়েছেন, আমার আবার জলদি ফিরতে হবে মেরী।

মেরী মিষ্টি হেসে এলিসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো– তুই একদম চিন্তা করিসনা, কিছুই হবেনা, সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখ।

এলিসা বিদায় নিয়ে চলে গেল।

মেরী বাবার সাথে আলাপ করে রাজ্যের বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত শক্তিশালী সৈন্যদল একত্রিত করে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের দক্ষিণাংশের সীমান্তে পাঠিয়ে দিলো।

আর একদল এসে উপস্থিত যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জঙ্গল থেকে বিষাক্ত ভিমরুল জীবন্ত ধরে আনার জন্য, অসংখ্য ভিমরুল ধরে আনলো তারা।

মেরী রাজপ্রাসাদে ছাদে উঠে দুবার হাততালি দিতেই রাজপ্রাসাদের পেছনের বাগান থেকে মেরীর সাদা ঘোড়াটা দৌড়ে এসে রাজপ্রাসাদের সামনে দাড়ালো। এমন তেজি ঘোড়া আশেপাশের দশ রাজ্যে আছে কিনা সন্দেহ! ঘোড়াটা জার্মান রাজা ফিলিপ দুবছর আগে মেরীর জন্মদিনে উপহার স্বরূপ দিয়েছিল।

মেরী তৈরী হয়ে তীর ধনুক নিয়ে, বাবার পা ছুয়ে সালাম করে নিচে নেমে এসে ঘোড়ায় চেপে বসলো। যারা ভিমরুল ধরে এনেছে তারাও অন্যান্য ঘোড়ায় চেপে বসলো। তাদের নিয়ে মেরী রওয়ানা হলো দক্ষিণাংশের উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত বাড়ছে, দক্ষিণাংশে এসে পৌঁছে ভিমরুল ধরে আনা লোকদের মেরী বললো ছোট ছোট অসংখ্য মাটির হাড়িতে ভিমরুল ভরে দুই রাজ্যের সীমান্তে কিছু দূর দূরে হাড়িগুলো রাখতে, তারপর সমস্ত হাঁড়ি মুখে ঢাকনা একটা দড়িতে এমন ভাবে বাঁধতে যেন দড়ি টান দিলেই একসাথে সমস্ত হাড়ির ঢাকনা খুলে যায়।

মেরীর এমন বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তার কারনেই দেশে দেশে এমন সুনাম অর্জন করেছে এই বয়সেই। মেরীকে সবাই ভীষণ ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে মেরীর এত এত গুণের জন্যই।

মেরীর কথা একটাই, শক্তিতে না পারলেও কৌশলে জয়ী হতে হবে।

রাত্রি দ্বিপ্রহর, হঠাৎ মশাল হাতে হৈ-হল্লা করতে করতে সুলতানের সৈন্যরা এগিয়ে আসতে লাগলো।

সুলতানের লোকদের বর্বরতা শুরু হতে যাচ্ছে বুঝেই যেন ক্ষীণ আলো ছড়ানো চাঁদটাও মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো, সে-ও সাক্ষী হতে চায়না এমন বর্বরতার।

হাড়ির ঢাকনায় বাধা দড়িটার একপ্রান্ত ধরে দাড়িয়ে আছে মেরী। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর চারপাশ।

সুলতানের সৈন্যরা সীমান্ত বরাবর আসতেই মেরী দড়ি ধরে টান দিতেই সমস্ত হাড়ির ঢাকনা খুলে গেল, হাজার হাজার ভীমরুল বেরিয়ে পড়লো মুহূর্তে, হঠাৎ ভীমরুলের আক্রমণে দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করলো সুলতানের সৈন্যরা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেরীর স্পেশাল ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়লো সুলতানের সৈন্যদের ওপর।

দীর্ঘসময় ধরে চলা যুদ্ধে সুলতানের সৈন্যরা যখন ধরাশায়ী, তখন মেরীর মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো অজানা আতঙ্কে।

মেরী জলদি করে ঘোড়ায় চেপে ছুটে চললো রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। সময়ের স্রোতে ভেসে রাতটাও শেষের দিকে।

সামনের বন পেরিয়ে পাহাড়ের পাশ দিয়ে পাহাড় অতিক্রম করে গেলেই প্রাসাদে ফিরতে আর বেশি দেরী হবেনা।

বনের কাছে আসতেই ঘোড়া ডেকে উঠে থমকে দাড়িয়ে পড়লো। আসার সময় তো মেরীর সাথে সৈন্যরা ছিল তাদের হাতে মশাল ছিল, সেই মশালের আলোতে বন অতিক্রম করেছিল। কিন্তু এখন তো মেরী একা, মশালও নেই, তাই বনের ভেতর এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে ঘোড়া থেমে গেছে।

অজানা আতঙ্কে মেরীর মন অস্থির, এই অবস্থা একটি মুহূর্ত মেরীর কাছে এক বছরের সমান।

অস্থির মেরী মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে সাহায্য চাইলো।

দপ করে একটু সামনেই শূন্যে ভাসমান একটি জ্বলন্ত আলোর গোলকের মতো দৃশ্যমান হলো, তার আলোয় আলোকিত চারিপাশ।

এই দৃশ্য দেখে ঘোড়াটা ভীষণ চমকে গেল, মেরী ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।

সেই আলোর গোলকটা শূন্যে ভেসে চললো বনের ভেতর দিয়ে, মেরীকে নিয়ে ঘোড়া তার পেছন পেছন এগিয়ে চললো।

বন পেরিয়ে পাহাড় অতিক্রম করে এসে সেই জ্বলন্ত গোলকটা একজন বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিনত হয়ে সামনে দাড়ালো হাসিমুখে। কি সুন্দর তার চেহারা, কি মিষ্টি হাসি! ভয়ের বদলে তাকে দেখে মেরীর আরও আনন্দ হলো।

মেরীকে নিয়ে ঘোড়াও দাড়িয়ে পড়লো।

এবার বয়স্ক ব্যক্তি মেরীকে বললো– রাজকুমারী মেরী, তোমার সততায় নিষ্ঠায়, জ্ঞানে বুদ্ধিমত্তায়, সৌন্দর্যে সবকিছু মিলিয়ে তোমার তুলনা তুমি নিজে, তুমি যেমন মানুষের অন্তরে অন্তরে ঠাই পেয়েছো তোমার নিজগুণে, তেমনি আমরাও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।

মেরী বললো– কিন্তু আপনি কে?

বয়স্ক ব্যক্তি বললো– আমি তোমাদের রাজ্যে বসবাসকারী জ্বীন সম্প্রদায়ের একজন। তুমি তোমার সততা সাহসীকতা বজায় রেখে চলো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।

মেরী প্রাণভরে কৃতজ্ঞতা জানালো।

বয়স্ক ব্যক্তি আবার বললো– জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই আসবে মেরী, কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না, ভেঙে পড়লে তো হেরে গেলে।

কথা শেষ করে বৃদ্ধ জ্বীন সামনের দিকে হাত প্রসারিত করতেই তার হাতে একটা বেলীফুল দৃশ্যমান হলো। বেলীফুলটা মেরীর হাতে দিয়ে তিনি বললেন– এটা খোঁপায় গুঁজে রেখো সবসময়, যদি কখনও একান্ত প্রয়োজন হয় আমাদের সাহায্য, তখন ফুলটায় হালকা আগুনের তাপ দিলেই আমরা তোমার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবো।

কথা শেষে বৃদ্ধ হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

তারপ্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মেরী এগিয়ে চললো।

রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি আসতেই মেরীর বুকটা ধক করে উঠলো! রাজপ্রাসাদের বাউন্ডারির গেটে পড়ে আছে রক্ষীদের মৃতদেহ।

ঘোড়া ছুটিয়ে গেট পার হয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে বাবার কক্ষে এসে থমকে গেল মেরী। বাবা রক্তাক্ত শরীরে মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। মেরী ছুটে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বাবার মাথা তুলে কোলের ওপর রাখলো।

বাবা কাঁপা কাঁপা হাতে মেরীর হাত ধরে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললো– আমার শেষ ইচ্ছেটা তুই রাখিস মা, তুই সুলতানকে বিয়ে করিস, নয়তো ও তোকে বাঁচতে দেবেনা আর রাজ্যের প্রজাদেরও সুখে থাকতে দেবেনা ও বলে গেছে। অন্তত প্রজাদের সুখের কথা ভেবে হলেও আমার কথা রাখিস মা।

কথা শেষে মেরীর বাবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। মৃত বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে মেরীর বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ পাতাল যেন কেঁপে উঠলো।

এর থেকে কষ্ট আর যন্ত্রণার মুহূর্ত আর কি হতে পারে। মেয়ের কোলে শত্রুদের আঘাতে আহত বাবার মৃত্যু।

মেরী বাবার মৃতদেহ ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করলো বাবার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে সুলতানকে বিয়েও করবে, আবার বাবার হত্যার বদলা নিতে নিজ হাতে সুলতানকে হত্যা করবে।

সুলতানের সাথে বিয়েতে মেরীর রাজি হবার এটাই ছিল কারণ।

যা-ই হোক বিছানায় বিবস্ত্র মেরী অপেক্ষায় সুলতানের। টেবিলের ওপরে রাখা দুধের গ্লাসে অলরেডি সেই ভয়ংকর বিষ মিশিয়ে রেখেছে মেরী, হয়তো বিষপানে নয়তো মেরীর হাতে তরবারীর আঘাতে মৃত্যু হবে আজ সুলতানের।

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। কাপড় পরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই রাজ দাসী জেসিকা হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো, তার পেছন পেছন একটা কালো বেড়াল।

জেসিকা সুলতানকে বললো– মহারাজ, বলবীর আবার পাগলামি করতে শুরু করেছে হঠাৎ, আপনি ছাড়া কেউ তাকে শান্ত করতে পারবে না।

এই বলবীর হচ্ছে সুলতানের পোষা প্রিয় হাতি।

বেড়ালটি ক্রমাগত মিউমিউ করছে দেখে সুলতান এগিয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখা দুধের গ্লাসটা হাত দিয়ে বেড়ালের সামনে ফেলে দিয়ে রুম থেকে দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল বলবীরের উদ্দেশ্যে।

মেঝেতে পড়া দুধ চুকচুক করে একটু খেতেই বেড়ালটা মিয়াঁও শব্দ করে এক লাফ দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

জেসিকা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে মেরীর দিকে! জেসিকা বুঝতে পেরেছে দুধে বিষ মেশানো ছিল, তারমানে সুলতানকে মারার ষড়যন্ত্র!

মেরীর বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠলো, তাহলে কি ধরা পড়ে গেল সে! সুলতান যদি জানতে পারে তাহলে সুলতানের হাতে মেরীর প্রাণ যাবে আজই। তাহলে কি বাবার হত্যার বদলা নেবার আগেই মেরীর মৃত্যু হবে?

চলবে…

লেখকঃ হৃদয় চৌধুরী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here