মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৬
প্রিয়মের কথায় মোনা বিমূঢ় হয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। মোনার চোখে মুখে নিদারুণ অত্যাশ্চার্যের ঝিলিক। প্রিয়মের একটু আগে বলা কথা’টা যেন ভুল শুনেছে।ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “কি বললেন?”
প্রিয়মের মুখের অভিব্যক্তি নিতান্তই স্বাভাবিক।যেন প্রতিদিনের অভ্যস্ত রীতি’তে কিছু একটা হতে চলেছে। সহজ গলায় বলল,
– “বিয়ে করব আমরা। আজ,এখন। আচ্ছা তোমার মুসলিম ফ্রেন্ড নেই?”
প্রিয়মের গলা শুনে মনে হচ্ছে মোটেও মজা করছে না। প্রিয়মের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে বিষয়’টা আম্ভরিক। মোনা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ।প্রিয়ম মোনার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
– “এই মোনা পাখি কি হয়েছে?”
মোনা প্রিয়মের দিকে তাকালো এক নজর। প্রিয়মের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। চিন্তানিমগ্ন হয়ে নিচু স্বরে বলল,
– “যদি কোন সমস্যা হয়?”
প্রিয়ম মোনার দুই হাত ধরে, আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আশ্বস্ত গলায় বলে,
– “যাতে কোন সমস্যা না হয় সে জন্যই তো বিয়ে করতে চাচ্ছি। এভাবে হঠাৎ বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে তোমার দারূণ ভাবে বিস্মিত হওয়া মুখ’টা দেখতে চেয়েছি।মোনা পাখি,আমি তোমার জীবনের সমস্ত বিষণ্ণতা গুলো দূর করতে চাই।আমি তোমার বিবর্ণ কল্পনায় রং ছিটাতে চাই। আমি চাই তুমি সমস্ত দুঃখ,কষ্ট থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাও।প্রতি মুহূর্তে তোমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি হয়ে থাকতে চাই।”
প্রিয়মের আবেগ মিশ্রিত গলার কথা গুলো শুনে মোনা প্রিয়মের চোখের দিকে তাকায়।প্রিয়মের কোটরগত নীল চোখ জোড়া’তে প্রবল ভালোবাসা ঢেউ খেলছে। এক সরোবর ভালোবাসা নেত্র জুড়ে।প্রিয়ম চোখের পলক ফেললে মনে হয় হিমেল মারুতে নেত্রের ভিতর থাকা এক সরোবর ভালোবাসা মৃদু দুলছে।
এত সব সুমধুর অনুভূতির মাঝেও মোনার অন্তরতর অঁচল থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। মোনার মুখ’টা ফ্যাকাশে, চাহনিতে শঙ্কা। কুণ্ঠিত হয়ে বলল,
– “ভালোবাসা তো বদলে যায়। বিয়ের পরও বদলায়। বিশ্রী ভাবে বদলায়।আমি ভালোবাসার এত বাজে রূপ দেখিছি যে আমার শঙ্কা হয়। জীবনের মোড়ে মোড়ে বদলে চায় মানুষ গুলো।”
প্রিয়ম কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
– “এমন কাউকে দেখো নি ?যারা ভালোবেসে,একসাথে সারা জীবন থেকেছে কিংবা থাকছে?”
মোনা উন্মনা হয়ে কেবল আস্তে করে বলল,
– “দেখেছি।”
কয়েক দন্ড নিঃশব্দে কেটে যায়।বাসার ভিতরে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। মোনা ফের তাকায় প্রিয়মের দিকে।প্রিয়ম অধীর আগ্রহে উন্মত্ত চিত্তে তাকিয়ে আছে মোনার দিকে। মোনার দুই হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মোনা হঠাৎ প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরে, আচমকা আক্রমন যেন।প্রিয়ম প্রশান্তি আর বিস্মিত মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছে। মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– “মোনা পাখি,ছোট বেলায় একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম বুঝলে?পালকি করে বউ নিতে দেখেছি। আমরা বাংলাদেশে যাবো, তোমায় ওভাবে পালকি করে নিবো।”
মোনা প্রত্যুত্তর করলো না। অদ্ভুত এক সুখানুভূতি’তে ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয়।সুখ কি তাহলে ধরা দিলো?এই সুখ,এই প্রশান্তি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত উপলব্ধি করতে চায়।প্রিয়মের শার্ট আকড়ে ধরে রেখেছে।প্রিয়মের ওষ্ঠ কোণে হাসির সূক্ষ্ম রেখা।
___
মোনা ওয়াড্রব থেকে কালো রঙের শাড়ি’টা বের করলো।কেন জানি খুব নার্ভাস লাগছে।অজানা পথে পাড়ি দিতে আতঙ্কিত হচ্ছে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে । মোনার হাত-পা যেন ঈষৎ কাঁপছে। অজানা আশঙ্কায় বিজড়িত হয়ে যাচ্ছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে। চোখ জলে ছাপিয়ে উঠছে। পুরানো স্মৃতি গুলো নাড়া দিয়েছে। পুরানো স্মৃতি বন্দনায় সব ভুলে উদাস হয়ে শাড়ি হাতে বসে আছে। জীবনের কি এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে! সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে ইচ্ছে করে এই নব অধ্যায়ের ভবিষ্যৎ কি হবে?এই সূচিত অধ্যায় কি এক মুঠো সুখ হয়ে ধরা দিবে?যে সুখ যুগ যুগান্তর কিংবা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকবে! যে সুখ দিয়ে জীবনের প্রতিটি সন্ধিক্ষণের মোকাবেলা করবে! মোনার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল, দু ফোঁটা পানি আপন ইচ্ছেয় গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর কপোলে নেত্র বিসর্জিত পানির শুষ্ক রেখা পড়ে থাকল।
শাড়ির পরার অভ্যাস নেই মোনার।যখন কলেজ হোস্টেলে থাকত তখন কয়েক বার পরেছিল বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে,পহেলা বৈশাখে। তাও রুমের এক বড় আপু পরিয়ে দিয়েছিলো।
কোন প্রসাধনী ব্যবহার করল না, শুধু শাড়ি পরে চুল খোঁপা করেছে।প্রিয়মের সামনে যেতে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে হঠাৎ। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুখ সামান্য বাড়িয়ে উঁকি দিলো, নিশান বসে আছে প্রিয়মের পাশে। প্রিয়মের চোখে পড়ল এক জোড়া পা, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়ম এগিয়ে গেল সেদিকে। আস্তে করে ডাকল,
– “মোনা।”
মোনা দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।এক নজর প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফ্লোরে আবদ্ধ করল। প্রিয়ম অনিমিখি নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ চোখে দেখছে মোনা’কে। মোনার চিবুক ধরে মুখ উঁচিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
– “বাঙালি অঙ্কলক্ষ্মী।”
মোনা আবার লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুয়ে পড়ল। প্রিয়ম ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– “এত সুন্দর কেন তুমি মোনা পাখি?”
নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা একটু বেড়ে গেল যেন। চেহেরায় কপট বিরক্তি ফুটিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকালো। প্রিয়ম পুনশ্চ বলল,
– “ম্যানিকুইন মোনা। পুতুল বউ’টা।”
বউ শব্দ’টা মোনার কর্ণকুহরে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে লাগল।মনে হচ্ছে কেউ এক সাগর মধুরাস্বাদ যুক্ত অনুভূতি মোনায় পান করিয়েছে।মোনা লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
– “তাকিয়ে থাকবেন না এভাবে। আমার অস্বস্তি হয়।”
প্রিয়ম আর কোন কথা না বলে মোনা’কে কোলে তুলে নিলো।মোনা অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
– “আরে ছাড়ুন।”
মোনার সমস্ত কথা উপেক্ষা করে প্রিয়ম হাঁটতে শুরু করল।প্রিয়মের ঠোঁটে হাসি।মোনা হাত-পা দাবড়াচ্ছে। প্রিয়ম নিশানের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,
– “শালা বাবু একটু কষ্ট করে হেঁটে আসেন। নাকি আপনায়ও কোলে নিতে হবে? আপনার বোনে পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”
গাড়ির কাছে এসে মোনা’কে কোল থেকে নামালো। মোনা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। মোনা গাড়ি’তে জড়সড় হয়ে বসে রইলো। প্রিয়ম বার বার তাকাচ্ছে মোনার দিকে। মোনা লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে যেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে মোনা আতঙ্কিত হচ্ছে। মনে মনে চিন্তায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে,গলা বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে।
– “পানি আছে?”
প্রিয়ম মোনার দিকে একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয়। কয়েক মুহূর্ত মোনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলে,
– “এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন মোনা?কোন প্রবলেম হলে আমার বলো।”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে।প্রায় আধা ঘন্টা পর গাড়ি থামলো। প্রিয়ম প্রথমে নেমে মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “নামবে না?”
মোনা উন্মনা হয়ে বসে ছিলো।গাড়ি থেমেছে টের পায়নি।প্রিয়মের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
– “হ্যাঁ।”
মোনা প্রিয়মের পিছু পিছু যায়।নিশান মোনার হাত ধরে হাঁটছে। মোনার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল,
– “শাড়ি’তে সুন্দর লাগছে।”
প্রত্যুত্তরে মোনা একটু হাসলো নিশানের দিকে তাকিয়ে।
বিয়েতে প্রিয়মের দুই জন ফ্রেন্ড উপস্থিত ছিলো শুধু। মোনা ঘামছে প্রচুর। প্রিয়মের দিকে তাকাচ্ছে বার বার। কয়েক মিনিটের ভিতর’ই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। মোনা কেমন মূর্তির মত বসে রইলো। প্রিয়ম সবার সামনে বসে মোনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মোনার হাত’টা ধরে পকেট থেকে একটা ডায়মন্ড রিংয়ের বক্স বের করল। মোনার হাতে রিং টা পড়িয়ে দিলো। মোনার হাত ঈষৎ কাঁপছে। প্রিয়মের এক বন্ধু হাসতে হাসতে বলল,
– “বিয়ের পর এ্যাংগেজমেন্ট!”
মোনাও হাসার চেষ্টা করল।প্রিয়ম মোনার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– “এত নার্ভাস হলে চলে মোনা পাখি?”
মোনা কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।প্রিয়ম মোনার হাত শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত গলায় বলল,
– “এই যে এই হাত’টা সারাজীবন এভাবে ধরে রাখবো। হাসো তো এখন। পৃথিবীর সব সুখ মোনা পাখির পদতলে এনে দিবো।”
মোনা একটু হাসলো প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে।প্রিয়ম বলল,
– “ভালো হাসি দেও! হাসছ নাকি কাঁদছ বুঝা যাচ্ছে না তো!”
কিছুক্ষণ ওখানে থেকে ওঁরা বের হলো। মোনার মনে হচ্ছে ও ঘোরের মধ্যে আছে কিংবা স্বপ্ন দেখছে।প্রিয়মের দুই বন্ধু গাড়ির কাছে এসে বিদায় নিলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষ’টা মোনার হাজবেন্ড, ভাবতেই মোনার কি যে কি হয়ে যাচ্ছে।প্রিয়ম গাড়ির দরজা খুলে বলল,
– “আজ সারাদিন আমরা তিনজন ঘুরবো, খাবো,আড্ডা দিবো।আর যদি কেউ মন খারাপ করে থাকে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিবো।”
(চলবে)
আজকের পার্ট’টা ছোট হয়েছে। ব্যস্ত ছিলাম একটু।