মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৭
গাড়ি খুব ধীরে চলছে।মোনার চোখে কখনো লজ্জা কখনো বা আশঙ্কা।প্রিয়ম এক পলক তাকালেই লজ্জায় মিইয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়ে এলো।মাঝে মাঝে গভীর আবেগে মোনার হাত চেপে ধরছে প্রিয়ম। পশ্চিম অম্বরে লালচে গোলাকার অরূণ হেলে পড়ছে,শহর জুড়ে গোধূলি নেমেছে। পুরো শহরে যেন আজ বসন্ত নেমেছে।বসন্তের রং,লাবন্য, সজীবতা অনুভূত হচ্ছে মোনার । প্রিয়ম গাড়ি থামায়। মোনা প্রশ্ন বিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো,
– “জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম সূর্যাস্ত, বিশেষ ভাবে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
মোনা ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “বিশেষ ভাবে আবার সূর্যাস্ত কিভাবে দেখে?”
– “তোমার পাশে দাঁড়িয়ে।”
মোনা হাসলো। নিশান মোনার এক হাত ধরে দাঁড়ানো,প্রিয়ম মোনার অন্য হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মোনার চোখ ছলছল করে উঠল।হয়ত অতি সুখে কিংবা গভীর প্রশান্তি’তে। সূর্য’টা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে।এ যেন নতুন রূপে সূর্যাস্ত দেখা। নিত্য দিনের সূর্যের চেয়ে আজকের সূর্য’টা একটু বেশি’ই রঙ্গিন। মনের বসন্তের রং যেন সূর্য’তেও লেগেছে।
চারদিকে আবছা অন্ধকার ব্যাপ্ত হতে লাগল। আলো-অন্ধকারের এক চিরপরিচিত রূপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।আবছা আবছা অন্ধকারে সব কিছু যেন আরো মায়াময় হয়ে উঠে। নীরবতা’কে বিলীন করে প্রিয়ম বলল,
– “বাসায় চলো।”
মোনা হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে হালকা মাথা নাড়ায়।শাড়ি পরে মোনার হাঁসফাঁস অবস্থা। এতক্ষণ ক্লান্ত অনুভূত হয় নি।বাসায় ঢোকার পর পরই ধরণীর সমস্ত ক্লান্ত যেন মোনার শরীরে ভর করেছে। প্রিয়ম হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙ্গে। নিশান এসেই মোবাইলে কার্টুন দেখতে বসছে। প্রিয়ম সোফায় বসে ছিল। সোফা থেকে উঠে মোনার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
– “মোনা এদিকে আসো কথা আছে।”
কি কথা বলবে প্রিয়ম?মোনার বুকের ভিতর পিটপিট করতে লাগল। মুহূর্তেই চিন্তিত হয়ে গেল।প্রিয়মের পিছু পিছু পাশের রুমে গেল। মোনা রুমে ঢুকতেই প্রিয়ম রুমের দরজা বন্ধ করে মোনা’কে জড়িয়ে ধরল। মোনার আবার সেই অনুভূতি, শিহরণ জাগতে লাগলো।প্রিয়ম বলল,
– “বিয়ে তো হুট করে হয়ে গেল। তাই তুমি এত নার্ভাস হয়ে পড়েছো। বি ইজি মোনা পাখি।আজ আমি আমার বন্ধুর বাসায় থাকব, তোমার নার্ভাসনেস বাড়িয়ে লাভ নেই।”
মোনাও সাধলো না।সত্যি’ই অস্থির লাগছিলো খুব। নিচু গলায় বলল,
– “আচ্ছা যান।”
– “যাবো একটু তুমি-টুমি বলো। চুমু-টুমু দেও।”
মোনা নাক মুখ ঘুচিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালো।মনে মনে লজ্জা পাচ্ছে বেশ। বিতৃষ্ণা ভাব নিয়ে বলল,
– “পারবো না যান।”
প্রিয়ম ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
– “পারবা না? চুমু দিবা নাকি রাতে আমি এখানে থাকবো?চয়েজ ইজ ইউর’স।”
– “তুমি।বলছি এবার যান।”
প্রিয়ম উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। মোনা চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,
– “দানবের মত হাসছেন কেন?”
– “দানবের মত হাসি?এই হাসি দেখে কত মেয়ে পাগল হয়েছে জানো?আমায় নিয়ে তোমার প্রাউট ফিল করা উচিত।”
মোনা রাগ রাগ গলায় বলল,
– “আপনার এই বাসি,পঁচা দুর্গন্ধওয়ালা কাহিনী আমি শুনতে চেয়েছি?”
মোনার রাগে প্রিয়মের ভাবান্তর নেই। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
– “জেলাস!তুমি তো—”
মোনা রাগে চাপা চিৎকার করে উঠে।প্রিয়মের কথা’টা অসমাপ্ত’ই থেকে যায়।
– “মোনা তুমি প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছো কেন?যা বলেছি শুনবে না?আমি কিন্তু যাবো না! ফুলসয্যার রাত রেখে কেউ কোথায়ও যায়?”
মোনা চোখ বন্ধ করে কপট বিরক্ত দেখিয়ে বলল,
– “উফ!তুমি কিভাবে বলে?”
প্রিয়ম প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে অন্যদিকে ফিরে নিরূদ্বেগ ভাবে বলল,
– “সে তুমি জানো।ওই যে একদিন বলে ছিলে না মনে আছে?বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলে?”
কি বলেছে তা মনে করতে বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগলো।মনে পড়তেই ঢোক গিলে।আবার সেই কঠিন কথা বলতে হবে। সেদিনের ন্যায় মুখস্থ পড়ার মত এক সেকেন্ডে বলল,
– “প্রিয়ম আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
প্রিয়ম ঘুরে তাকায়। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। মোনার চোখে মুখে লজ্জার চাপা ঝিলিক। প্রিয়ম খুব আদুরে গলায় মোনার মাথায় হাত রেখে বলল,
– “মোনা পাখি’টা আমার!”
মোনার কর্ণকুহরে বার বার মোনা পাখি,মোনা পাখি ডাক’টা প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।এই ডাক’টা আজকাল এত সুমধুর লাগে! কয়েক মুহূর্ত পর প্রিয়ম বলল,
– “আর চুমু কে দিবে?”
মোনার মুখাবয়ব সঙ্কটজনক।প্রিয়ম ফিক করে হেসে বলল,
– “এই থাক থাক লাগবে না এখন।যাও তুমি বিশ্রাম নেও।”
প্রিয়ম আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।মোনা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ অস্বস্তি’তে গা গুলিয়ে যাচ্ছিলো মোনার। এই অস্বস্তিপূর্ণ ভাব’টা কাটিয়ে ওঠার জন্য আসলেই সময়ের দরকার।প্রিয়মের প্রতি হঠাৎ সম্মান জাগলো। প্রিয়ম ওর বন্ধুর বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফোন দিলো। ফোনে কথা বলতে বলতে মোনা ঘুমিয়ে গেল।ফোন’টা তখনো মোনার কানের নিচে বালিশের উপর।প্রিয়ম অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে শেষে হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিলো।
___
ভার্সিটির ক্যাম্পাসের এক কোণে একা একা বসে আছে মোনা। প্রিয়ম ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে একটু আগে।ওয়াটস’কে ও দেখছে না,শ্রুতিরও খবর নেই। শ্রুতির ফোন বন্ধ। মোনা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। মোনার মেজাজ বেশ ফুরফুরে। ঠোঁটে হাস্যেজ্জ্বল ভাব। ওঁদের দুই জনের কাউকে না দেখে হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলো।বিয়ের ব্যাপার’টা মোনার অস্থিমজ্জা সঞ্চালন করছে শুধু। বিয়ে বিয়ে শব্দ’টা মোনার শরীর- মনে শিহরণ সৃষ্টি করছে। আবার অজানা এক আশঙ্কায়ও বিজড়িত হয়ে যাচ্ছে। মোনার মনে হচ্ছে পুরো’টা ই স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে মিছে হয়ে যাবে।মোনা চোখ বুঁজে ভাবে শুধু।এই ভাবনা কখনো সুখের সন্ধান দেয়,কখনো বা প্রচণ্ড চিন্তার। মোনার হঠাৎ মনে হলো বিয়ের ব্যাপার’টা শ্রুতি, ওয়াটস আর জ্যাক’কে জানাতে। কোন এক অজানিত কারণে জ্যাকের কাছে এই ব্যাপার’টা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। জ্যাকের কথা মনে পড়তেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে গেল মোনা, একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। জ্যাকের সামনে উদ্বেগসঞ্চারী হয়ে পড়ে মোনা। জ্যাক কষ্ট পেয়েছে মোনা জানে। কিন্তু এই কষ্ট মোনা কিভাবে উপশম করবে? মোনা জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করল।জ্যাক ফোন রিসিভ করে ব্যস্ত গলায় বলল,
– “একটু পরে ফোন দিচ্ছি মোনালিসা।”
কোন ক্লাইন্ট এসেছে নয়ত মিটিং-এ ব্যস্ত জ্যাক। অনেকক্ষণ পর ক্লাসে যায় মোনা। শ্রুতি আর ওয়াটস,ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হেনরির সাথে কি যেন বলছে। এত ব্রিলিয়ান্ট হওয়ার কারণে হেনরি সব সময় একটা ভাব নিয়ে থাকে। হেনরির এত ভাব মোনার অসহ্য লাগে।মোনা মুখ বাঁকিয়ে চলে আসলো। কিছু সময় পর শ্রুতি আসে।মোনা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল,
– “হেনরির সাথে কি কথা বললে?”
শ্রুতি মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
– “তোমায় কেন বলব? প্রতিদিন ভার্সিটি’তে আসতে কি হয় তোমার? মোনা তুমি না এক অদ্ভুত প্রাণী! বুঝতেই পারি না আমি তোমায়!”
এক শ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো শ্রুতি। মোনা হেসে বলল,
– “কথার মাঝে মাঝে একটু শ্বাস ফেলো।নয়ত দম বন্ধ হয়ে যাবে।”
এর ভিতর ক্লাসে টিচার আছে।শ্রুতির সাথে কথা আর আগালো না। ভার্সিটি শেষে মোনা অফিসে গেল।মোনা’কে দেখে লরি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল,
– “আচ্ছা মোনালিসা তুমি যখন ইচ্ছা অফিসে আসো, যখন ইচ্ছা আসো না। তবুও কেন কৈফিয়ত দিতে হয় না কেন তোমার?”
মোনা কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিলো,
– “জানি না তো।”
মোনার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না লরি।কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করল না। নিজের কাজে মন দিলো।
__
বাসায় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে মোবাইল হাতে নিলো মোনা।জ্যাক কয়েক বার কল দিয়েছে। প্রিয়মের ফোন থেকে না এসেছে কোন কল,না এসেছে ম্যাসেজ। মোনা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে প্রিয়মের নম্বরে ডায়েল করল। কেমন একটা উদ্ভট চিন্তা মোনার মস্তিষ্ক গ্রাস করল। বিশ বার ডায়েল করল একে একে।এমন কখনো হয় নি। মোনা সশঙ্ক চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে। তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রনাময় রাত কেটেছে মোনার। ভেবেছে প্রিয়ম আসবে ।কলিং বেল বাজাবে,নয়ত ফোনের রিং বেজে উঠবে। মোনার চোখ দুটো বার বার অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠছে। মোনা প্রিয়মের অফিস চিনে না। একমাত্র উপায় লিলি বেগমের কাছে ফোন দেওয়া।কি বলবে লিলি বেগম’কে?মোনা উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে গেল। ভার্সিটি,অফিস কোথায়ও যায় নি। সারাদিন ফোন, ম্যাসেজ দিয়ে গেছে। রিং হয় কিন্তু ফোন রিসিভ হয় না। পুরো একটা ক্লেশময় দিন কাটলো। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে মোনার।প্রিয়ম ঠকালো ওকে?প্রিয়মের উদ্দেশ্যে যদি খারাপ হত তাহলে সেই রাতেই সুযোগ নিতে পারত। নানান রকমের শঙ্কায় মোনা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে।
(চলবে)
~গল্প রিভিশন দিই নি। ভুল ত্রুটি বুঝে নিন