যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ১৭+১৯

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

১৭.
“কার কথা বলছেন?” সচকিত হল রাইয়্যান, দেখেনি সিদ্রাকে, ও তখন মনযোগ দিয়ে সই করছিল।

“থ্রিপিস পরা একটা মেয়ে মনে হল, চেহারা দেখতে পাইনি” সিদ্রার মনে হল ও শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছে, আজই মনে হয় মুনিরার জীবনের শেষ দিন। হায় আল্লাহ্‌! এটা কি করলাম আমি!!

“ও উনি আপনাদের ম্যাডাম, আমার ওয়াইফ” এক মুহূর্তও দেরী না করে উত্তর দিল রাইয়্যান।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলনা সিদ্রা, অসাড় হয়ে গেল গোটা শরীর, চায়ের কাপটা পড়ে গেল হাত থেকে। কাপ পিরিচ ভাঙার শব্দে বুঝতে পারল রাইয়্যান, সিদ্রা শুনে ফেলেছে ওর কথা। ম্যানেজার আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রাইয়্যান বলল, “সবকথা পরে বলবো, এখনকার মত আপনি যান” প্রায় মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে রাইয়্যান ছুটে এল রান্নাঘরে। দেখল, সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে চায়ের সাগরে, রাগে কাঁপছে থরথর করে, চোখে পানি। ভাঙা কাপ পিরিচে পা কেটে রক্ত পড়ছে, কোন খেয়াল নেই ওর। গরম চা পড়েছে সেজন্য আগে ঠাণ্ডা পানি দিবে, নাকি তাতে আবার কাটার ক্ষতি হবে, বুঝতে পারছেনা রাইয়্যান।

রাইয়্যান কাছে আসতেই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় মারল সিদ্রা। এবার আর আগেরবারের মত মনে হলনা, এ আমি কি করলাম! মনে হল, যা করেছি ঠিক করেছি, আরো আগে করা উচিত ছিল।

“ওই!” রাগে হিসিয়ে উঠলো রাইয়্যান। উলটো চড় কষানোর জন্য হাতটা তুলেও অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত করল ও, “শুধু এই এক্সিডেন্টটা করেছিস বলে বেঁচে গেলি”

“কেন? বাঁচাবেন কেন? মারুন, মেরে ফেলুন আমাকে। তিলেতিলে মরার থেকে একবারে মরে যাওয়া ভাল। মারুন আমাকে, মারুন” পাগলের মত চিৎকার করে কথাগুলো বলল সিদ্রা।

“একদম চুপ! কোন কথা না। আর একটা কথা বললে সত্যি সত্যি খুন করে দিব” এই বলে সাবধানে সিদ্রাকে কোলে তুলে নিল রাইয়্যান। হাত পা ছুড়ে যুদ্ধ শুরু করে দিল সিদ্রা, আমল দিলনা রাইয়্যান, ওকে নিয়ে গিয়ে সোফায় শুইয়ে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে সিদ্রাকে চোখ পাকিয়ে চুপ থাকতে বলল।

“হ্যালো বুবু” কথা শুরু করল রাইয়্যান।

“আচ্ছা, আচ্ছা, ওইসব বিচার তুমি পরে কইরো, এখন আমি একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে আছি। গরম চা ভর্তি কাপ পড়ে গেছে পায়ের ওপর, আর ভাঙা কাঁচে পাও কেটে গেছে, কি করব এখন?”

“না না, আমার না, তুমি আগে বলোতো, তারপর জলদি তোমার জিনিশপত্র নিয়ে এখানে আসো” ওপাশের কথা শুনে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর।

“আরে তাইতো, এখনি করছি, তুমি জলদি আসো”

“আরে বাবা, খালারও না, তুমি এখানে আসো তো আগে, তারপর শুনো” ফোন রেখে রাইয়্যান আবার রান্নাঘরে দৌড়াল।
একটা বাটিতে করে বরফ নিয়ে আসল রাইয়্যান। টি টেবিলটা এগিয়ে তাতে বসে প্রথমে টিস্যু দিয়ে সাবধানে রক্ত মুছতে গেল। সিদ্রা পা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু এমন একটা অগ্নিদৃষ্টি দিল লোকটা, থেমে গেল ও। রক্ত মুছার পর পায়ের ওপর বরফের টুকরা ধরল। পাটা এতক্ষণ জ্বলে যাচ্ছিল, রাগের চোটে পাত্তা দিচ্ছিলনা সিদ্রা, এখন বরফের ছোঁয়ায় আরাম লাগল। কিন্তু ও বুঝতে পারছেনা, খালাকে না বলে উনি নিজে কেন এসব করছেন।

খালাও রাইয়্যানের দেখাদেখি আরেক পায়ে বরফের টুকরা ঘষতে শুরু করল। রাইয়্যান উদ্বিগ্ন চোখে সিদ্রার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “একটু আরাম লাগছে?”

“আমার আরাম নিয়ে তো কোনদিন ভাবেননি, আজকেও ভাবতে হবেনা। আমার পা পুড়ে গেল কি পচে গেল তাতে আপনার কি? আপনি আমাকে বলেন, আপনি ওই লোকটাকে মিথ্যা কথা কেন বললেন?”

“আমার ইচ্ছা হয়েছে বলেছি। তোকে কোন কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য না”

সিদ্রার মনে হল রাগের চোটে ওর ভেতরটা বাস্ট হয়ে যাবে, শক্ত করে হাত মুঠো করল ও, আরেকদফা পানি বেরিয়ে এল চোখ দিয়ে।

“বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা হ্যাঁ, কান খুলে শুন কি বলছি, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুবু আসছে। আমি যা যা বলব, তাতে সায় দিয়ে যাবি। বুবু অনেক প্রশ্ন করবে, আমার সাথে তাল মিলিয়ে উত্তর দিবি। যদি কোন কথার উত্তর কি দিবি বুঝতে না পারিস, ব্যথায় কাতরে উঠার ভান করবি। যদি বেফাঁস কিছু করেছিস বা বলেছিস, বিকালের খবরে তোর বোনের মৃত্যুসংবাদ দেখবি, এন্ড আই মিন ইট! কথাটা মনে রাখিস!” সিদ্রার মাথা ফাঁকা হয়ে গেল লোকটার হুমকি শুনে, আর কিছু ভাবতে পারলোনা ও।

কথাটা বলাও শেষ হল, আর কলিংবেল বাজল। খালা গেল দরজা খুলতে। খালার সাথে যে মহিলাটা ঢুকল, তাকে যে কেউ এক নজরেই পছন্দ করে ফেলবে। মধ্যবয়সী একজন মহিলা, সুন্দরী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। হাসিমাখা মুখে এখন চিন্তার ছাপ লেগে থাকলেও কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুলে উনাকে মহিলা কম মেয়ে বেশি লাগছে। চোখে চশমা, গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে এপ্রোন। ইনি যে একজন ডাক্তার, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রাইয়্যান উঠে দাঁড়াল, মহিলা এসে রাইয়্যানের জায়গায় বসল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিভাবে কি হয়েছে। সব উত্তর দিল রাইয়্যান, সিদ্রা মুখে কুলুপ এটে বসে রইল।

“চা মনে হয় একদম ফুটন্ত ছিলনা, পোড়া নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। এই ক্রিমটা সবসময় লাগিয়ে রাখতে হবে, ধুয়ে বা মুছে গেলেই আবার লাগিয়ে নিতে হবে, ঠিক আছে? কাটাগুলোই শুধু সারতে যা একটু সময় নিবে” দুই পায়ের কাটার উপর ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করার পর একথা বলে মহিলা বেসিনে গেল হাত ধুতে।

আর ঠিক তারপরেই এ যাবৎকালের সবথেকে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল সিদ্রা, মহিলা রান্নাঘর থেকে একটা খুন্তি নিয়ে তাড়া ধরেছে লোকটাকে।

“তুই আমাকে না জানায়ে এতবড় কাজটা করতে পারলি?”

“আরে বুবু, আগে আমার কথাটা শুনো”

“কিসের কথা হ্যাঁ, কিসের কথা? আসার সময় ম্যানেজারের সাথে দেখা না হলে তো জানতেও পারতামনা”

লোকটা দৌড়াচ্ছে আগে আগে, মহিলা পিছে পিছে, এত হাস্যকর একটা দৃশ্য, হাসবেনা হাসবেনা করেও হেসে ফেলল সিদ্রা।

“আরে আমাকে বলার সুযোগটা তো দিবা”

“কবে বলতি তুই? বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পরে বলতি আমাকে?”

“না না, কিযে বলনা, বাচ্চা হওয়ার আগেই বলতাম, নাইলে ডেলিভারি কে করবে?”

এ অবস্থায় এসব নিয়েও মজা করছে, লোকটা কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ্‌ মালুম। তবে ইনিও যে কাউকে ভয় করেন, এটা দেখেই শান্তি লাগল সিদ্রার।

সারা ঘরময় দৌড়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি বসিয়ে ক্লান্ত হয়ে মহিলা ক্ষান্ত দিল। দুইজন দুই সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল। খালা পানি এনে দিল দুজনকে।

পানি খেয়ে দম নিয়ে মহিলা বলল, “এবার বল, ডিটেইলসে বলবি, কিছু যদি বাদ দিয়েছিস! খুন্তি কিন্তু এখনো হাতে আছে। এই মেয়ে, তুই কিন্তু ধরিয়ে দিবি, ও যদি কিছু বাদ দেয়” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল মহিলা। হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা, যদিও জানেনা লোকটা কি বলবে।

শুরু করল রাইয়্যান, “ওর নাম সিদ্রা, সিদ্রাতুল মুনতাহা। ফেসবুকে আলাপ আমাদের। তারপর যা হয়, বন্ধুত্ব ভালবাসা এই আর কি। কিন্তু হঠাৎ করে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তখন ও বাসায় বলে আমাদের কথা। কিন্তু ওর ফ্যামিলির আমাকে পছন্দ হয়নি। তাড়াহুড়ো করে কালকে রাতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলে ওর। কিন্তু আমরা তো একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবোনা। তাই ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি”

বুবুর সাথে সিদ্রাও হা করে তাকিয়ে রইল রাইয়্যানের দিকে, লোকটা এমন অবলীলায় এতগুলো কথা বানিয়ে বানিয়ে কিভাবে বলছে! আমি উনাকে ছাড়া বাঁচবোনা বলে উনার সাথে পালিয়ে এসেছি। ইশ! মনে হচ্ছে উনাকে খুন করতে পারলে গায়ের জ্বালা জুড়াবে আমার!!

“বিয়ে করেছিস?”

“হ্যাঁ, কালকেই করেছি, কাজী অফিসে”

“আমার না কেমন ঘাপলা লাগছে, ঢপ দিচ্ছিস না তো? তোকে জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেখলামনা, আর সেই তুই এতদিন ধরে প্রেম করে সোজা বিয়ে করে চলে এসেছিস, কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা”

“কি বল বুবু? আমি কি তোমাকে মিথ্যা বলব? তুমিই বল, কালকের এত ঝামেলার মধ্যে কখন বলতাম তোমাকে? প্লিজ এবারের মত মাফ করে দাও, এরপরে আর এমন হবেনা”

“এরপরে মানেটা কি? তোর কি আরো কয়েকটা বিয়ে করার প্ল্যান আছে নাকি?” ভ্রু কুঁচকে বলল মহিলা।

“আরে না না, কি যে বল। সেকথা বলিনি, বলেছি আর কোনদিন তোমার কাছে কিছু গোপন করবোনা”

কত্তবড় বাটপার, সমানে বানিয়ে বানিয়ে কিচ্ছা শোনাচ্ছে, আবার কথাও দিচ্ছে, ছি ছি ছি ছিঃ মনে মনে বলল সিদ্রা।
“কতদিন ধরে সম্পর্ক তোদের?” সন্দেহ এখনো যায়নি বুবুর।

“পরিচয় হয়েছে, এই ধরো এক বছর” সিদ্রার মনে হল ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।

“অসম্ভব! তুই কয়মাস আগেও বিয়ে করতে রাজি হসনি, আর এখন এক বছরের সম্পর্ক হয়ে গেল!?” ভ্রু কুঁচকাল বুবু।

“বিয়ে করতে রাজি হইনি কারণ ও এত ছোট, ওর ফ্যামিলি হয়তো বিয়ে দিতে রাজি হবেনা, তাই”

“কিন্তু ওর কথা বলিসনি কেন আমাদের?”

“কারণ ওর ফিলিংস সম্পর্কে আমি শিওর ছিলামনা, তাই। কি করছো বুবু? এমনভাবে জেরা করছো যেন তোমার কাছে আমি সবসময় মিথ্যে বলি। সত্যি বলছি আমি, বিশ্বাস কর, মাফ করে দাও প্লিজ ”

“হুম, ঠিক আছে, মাফ করলাম। কিন্তু তোর জন্য না, এর জন্য” সিদ্রার কাছে এসে ওর মুখটা দুহাতে ধরল মহিলা। “কি মিষ্টি দেখতে, আমার কিন্তু তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। যাক, এতদিনে যে তোর উসিলায় আমার ভাইটুর মাথায় শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাতেই আমি খুশি। আমরা তো বিয়ের কথা বলতে বলতে হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়” সিদ্রা মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখল, কারণ লোকটা ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

“তুই করে বলছি বলে রাগ করলিনাতো? ওদের এভাবেই ডাকি আমি, পছন্দ না হলে চেঞ্জ করে নিচ্ছি”

“না না, ঠিক আছে” মহিলার তুই বলার মধ্যে কোন তাচ্ছিল্য নেই লোকটার মতো, বরং বড় বোনের প্রচ্ছন্ন স্নেহ অনুভব করছে সিদ্রা, ভালই লাগছে শুনতে।

“কিন্তু, আমার ভাইটুর মত হীরের টুকরো ছেলেকে কেন কেউ পছন্দ করবেনা, সেটাই তো বুঝলাম না”

“আরে, কি বল তুমি? সিদ্রা কেমন মেয়ে তুমি তো জানোইনা। ও হাফেজা, মাদ্রাসায় পড়ে, হাত মোজা পা মোজা পর্যন্ত পরে। এরকম মেয়ের জন্য কি আমার মত ক্লিনশেভড ছেলেকে পছন্দ করবে ওর ফ্যামিলি? ওরা তো হুজুর টাইপ কাউকে পছন্দ করবে, তাইনা?” শুধু মহিলা না, সিদ্রাও অবাক হয়ে গেছে রাইয়্যানের কথা শুনে। এত কিছু বুঝেন আপনি, শুধু আমাকেই বুঝলেননা, অবশ্য আপনারই বা কি দোষ, দোষ তো আমারই বোনের, হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সিদ্রার ভেতর থেকে।

“তুমি হাফেজা? মা শা আল্লাহ! তোমার মত মেয়ে ওর পাল্লায় কি কিরে পড়লা?”

সিদ্রা কি বলবে বুঝতে পারছেনা, ওকে উদ্ধার করল লোকটা, “বুবু, ওকে এখন একটু রেস্ট নিতে দিলে ভাল হতোনা?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। নে, ওকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দে”

“কি! তুমি ওর ওজন জানো? রান্নাঘর থেকে এখানে আনতেই দম বের হয়ে গেছে আমার। সিঁড়ি বাইতে পারবোনা ওকে নিয়ে”

যে কিনা আমাকে নিয়ে পাহাড়ে উঠানামা করেছে, সে এখন সিঁড়ি বাইতে ভয় করছে, হুহ! আসলে বুবুর সামনে তো এখন আমাকে নিজের ঘরে নিতে হবে, এজন্যই এত টালবাহানা। বেচারা! নিজের ফাঁদে নিজেই ফেঁসে গেছে, মনে মনে হাসল সিদ্রা।

“আমি ঠিক আছি বুবু, সোফায় আরাম লাগছে, সমস্যা নাই, বিছানায় পরে গেলেও হবে, এমনিতেও একা একা ঘরে শুয়ে থাকতে ভাল লাগবেনা” মনে মনে বলল, আপনার কোলে উঠার আমারও কোন শখ লাগেনাই!

“আচ্ছা ঠিক আছে, তাই থাক। তোর সাথে তো ভালো করে আলাপই হলনা, কিন্তু আমাকে উঠতে হবে, সব রোগীরা লাইন ধরে অপেক্ষা করছে। আমি পরে আবার আসব, কেমন?”

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা।

একটু এগিয়ে আবার ফিরে তাকাল, “আচ্ছা ভাল কথা, কাল কখন ফিরেছিস? বাসর হয়েছে তোদের? নাকি আজ আমি এসে ঘর সাজিয়ে দিব?” দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল মহিলা।

সিদ্রার গালদুটো লাল হয়ে গেল। ধুর! আমি কেন লজ্জা পাচ্ছি, আমি কি আর সত্যি সত্যি উনার বউ নাকি!!

রাইয়্যানও যেন লজ্জা পেল, কিন্তু সামলে নিল মূহুর্তেই, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা, কালকে আসার সময়ই ফুল টুল নিয়ে এসেছিলাম আমি” দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিল লোকটা, দেখে প্রশমিত রাগটা আবার ফিরে এল সিদ্রার।

রাইয়্যান বুবুর ব্যাগ নিয়ে উনাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল, ফিরে আসতেই সম্মুখীন হতে হল সিদ্রার প্রশ্নের, “এসব কি করছেন আপনি? আমাকে আপনি মিথ্যাবাদী প্রতারক বলেন না, আপনি নিজে কি? বানিয়ে বানিয়ে কথা বলারও একটা লিমিট থাকে। আপনার কি মনে হচ্ছেনা, আপনি সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন?”

“কই নাতো? সব তো ঠিকই আছে। থিংক ইট এজ ইয়োর গ্রেটেস্ট পানিশমেন্ট! বিয়ে না করেও আমার ওয়াইফের পরিচয়ে বাকি জীবন কাটাবি তুই”

রাগে ক্ষোভে মাথা খারাপ হয়ে উঠলো সিদ্রার, হাতের কাছে থাকলে নিশ্চিত একটা না বেশ কয়েকটা চড় খেত লোকটা ওর হাতে। মনে হয় বুঝেশুনেই সেফ ডিসট্যান্স রাখছে। রাগের চোটে সোফার কুশনটকে কচলাতে লাগলো ও। লোকটা এসে তার পছন্দের সিংগেল সোফাটায় বসল।

“অবশ্য, তোর কাছে আরেকটা অপশন আছে। তুই চাইলে আমি কাজী ডেকে আনতে পারি, সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিতে পারিস আমাকে। তবে তাতে যে তোর লাইফস্টাইলে কোন পরিবর্তন আসবে, তার গ্যারান্টি দিতে পারবোনা”

কুশনটা ছুড়ে মারল সিদ্রা, একদম লোকটার মুখ বরাবর। কিন্তু প্রস্তুত ছিল লোকটা, ধরে ফেলল।

“আপনার মত লোককে বিয়ে করার থেকে সারাজীবন কুমারী থাকব আমি!”

“সে তোর যা ইচ্ছা। শুধু একটা জিনিস মনে রাখিস। আমার ওয়াইফ সেজে থাকবি, সবাই সেলাম ঠুকবে তোকে, তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু…….এই পরিচয়ের সদ থুড়ি বদ্ব্যবহার করে যদি পালানোর ফিকির করিস, তাহলে যে কিহবে, তাতো তুই ভাল করেই জানিস। আমাকে জাস্ট একটা ফোন করতে হবে। যে কষ্ট রাতদিন আমি ভোগ করছি, তার থেকে হাজারগুণ কষ্ট তুই ভোগ করবি। কারণ আমার ভাইকে হারানোর জন্য আমি দায়ী নই, কিন্তু তোর বোনের মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী থাকবি! পালাতে হয়তো পারবি এখান থেকে, কিন্তু নিজের বোনের হত্যার দায় নিয়ে জীবন কাটাতে পারবি তো?”

শিউরে উঠলো সিদ্রা বিষয়টা কল্পনা করে। নাহ! এখান থেকে পালানোর কথা কল্পনা করাও সম্ভব না!!
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

১৯.
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে রাইয়্যানকে দেখতে পেলনা সিদ্রা। ওকে এদিকওদিক তাকাতে দেখে খালাই উত্তর দিয়ে দিল, রাইয়্যান বাইরে গেছে। ধরা পড়ে গিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিদ্রা, চুপচাপ নাস্তা খেতে থাকল।

খালা ওকে এই পা নিয়ে কিছুই করতে দিলনা, সারাদিন শুয়ে বসে বই পড়েই কাটিয়ে দিল সিদ্রা। বিকেলে নিচে নেমে অবাক হয়ে গেল, বড় সোফাটা শপিং ব্যাগ দিয়ে ভরা।

“এগুলো কি খালা?” জিজ্ঞেস না করে পারলনা ও।

“তোর থুড়ি, আমার বউয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র” ওর পেছন থেকে উত্তর দিল রাইয়্যান।

“প্লিজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেননা, ফারদার আমার সামনে বউ কথাটা উচ্চারণ করবেননা আপনি” ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল সিদ্রা, চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন।

“উপস! তাই নাকি!! কিন্তু কি করি বল, সবাই তো এখন জেনে গেছে তুই আমার বউ, না ডেকে কিভাবে থাকি!!!”

উফ! এই লোকের কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, আমি বরং উনার সামনে থেকে যাই, সিঁড়ির দিকে এগোল সিদ্রা। ওর হাত ধরে ফেলল লোকটা, “ওয়েট, আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আমার সামনে থেকে যাওয়ার সাহস পায়না, আই ডোন্ট লাইক দ্যাট”

হাতটা ছাড়িয়ে নিল সিদ্রা, “ফালতু কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছেনা, এখন এজন্য কি আমাকে গুলি করবেন না ফাঁসি দিবেন?”

“যাচ্চলে! আমি কোথায় তোর জন্য এতকিছু কিনে আনলাম, তুই উল্টে আমাকেই ভাব দেখাচ্ছিস!!”

“আমার কিছু দরকার নেই, যেভাবে আছি, সেভাবেই থাকব, ধন্যবাদ”

“তোর দরকার নাই, কিন্তু আমার আছে। আমার একটা রেপুটেশন আছে। তুই এখন এই টি এস্টেটের মালকিনের রোল প্লে করছিস। তোর সাজপোশাক সেই অনুসারে হতে হবে তো! নাইলে কি আমার মান-সম্মান থাকবে?”

সিদ্রার ওড়নার কোনাটা তুলে ধরল রাইয়্যান, “আজ থেকে এই দুইটা ড্রেস রিজেক্টেড। নতুন আনা ড্রেসগুলো বাদ দিয়ে যদি এগুলো পরতে দেখেছি, তোর কপালে অশেষ দুঃখ আছে”

আগুন চোখে রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা, কিন্তু কিছু বললনা।

“আর হ্যাঁ, বুবু জিজ্ঞেস করেছিল তোর কথা, আমি বলেছি তুই দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছিস। আজকে রাতে বুবুর বাসায় আমাদের দাওয়াত। সেজন্যই এত সাত তাড়াতাড়ি করে এগুলো কিনতে হল। যা, রেডি হয়ে নে, আমরা সন্ধ্যার পর বের হব”

“আমি কোথাও যাবোনা। এখানে এসে আমার বোরকাটা খুঁজে পাইনি। আপনারা মনে হয় সেটা জঙ্গলেই ফেলে এসেছেন। বোরকা ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারবোনা”

রাইয়্যান কিছু বলতে যাচ্ছিলো, সিদ্রা থামিয়ে দিল ওকে, “আর হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমাকে মুনিরা কেন, আমার চৌদ্দ গুষ্টির মৃত্যুর ভয় দেখালেও কাজ হবেনা। আমি পর্দার সাথে কোন কম্প্রোমাইজ করতে পারবোনা”

“তুই না দিনে দিনে বড্ড বাজে বকছিস। না জেনে এত কথা বলিস কেন? নতুন বোরকাও আছে ব্যাগের মধ্যে, যা এবার রেডি হ জলদি জলদি”

শপিং ব্যাগ এতগুলো যে দুই হাতে নিয়েও শেষ করতে পারলোনা সিদ্রা, বাকিগুলো খালা নিয়ে চলল ওর পেছন পেছন। হায়রে, লোকটা মনে হচ্ছে পুরো বাজার তুলে এনেছে! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবল সিদ্রা।

***
বিছানার উপর সবগুলো জিনিস বের করে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা। ড্রেসই আছে মনে হয় কমপক্ষে দশটা। তারপর আছে হালকা, ভারী কয়েক ধরণের সোনার গয়না, স্টোনের জুয়েলারি, তেল শ্যাম্পু সহ সব ধরণের কসমেটিকস, মেকআপ কিট, কয়েক সাইজের হ্যান্ডব্যাগ, বেশ কয়েক জোড়া জুতা-স্যান্ডেল, আর দুই সেট বোরকা। সবগুলোই যে অনেক দামী আর ব্র‍্যান্ডেড, বুঝতে অসুবিধা হলনা ওর। উনি কি পাগল! একটা মানুষের কি এতগুলো জিনিস লাগে! বাকিগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, এতগুলা জুতা আর ব্যাগ দিয়ে মানুষ কি করে!! এমন না যে, সিদ্রাদের ফ্যামিলি গরীব, আর্থিক সামর্থ্য আল্লাহ্‌ যথেষ্টই দিয়েছেন। কিন্তু অপচয় পছন্দ করেনা ওরা, সবসময় পরিমিত জিনিস ব্যবহারে অভ্যস্ত।

সিদ্রা সবথেকে অবাক হল ড্রেসগুলো দেখে। থ্রিপিস আর হাল ফ্যাশনের লং ড্রেস, কোনটা গর্জিয়াস আবার কোনটা বাসায় পরার মত সাধারণ। কিন্তু সবগুলোই বড় ওড়না আর বড় হাতা ওয়ালা। একটা ওড়না বা হাতাও শিফন কিংবা পাতলা ফিনফিনে নয়। মোটকথা একটা ড্রেসও এমন নয় যে ও পরতে আপত্তি করবে। উনি কিভাবে বুঝলেন, আমি এমন ড্রেস ছাড়া পরিনা। এমন ড্রেস খুঁজে পাওয়া যে কত কষ্টকর, ভালই জানা আছে সিদ্রার। বাজারে এমন ঢিলেঢালা আর পর্দা সম্মত পোষাক খুঁজে পেতে সবসময়ই ঝামেলা পোহাতে হয় ওদের, পুরো মার্কেট চষতে হয় অনেকসময়। সেখানে উনি এতগুলো পোষাক কিভাবে পেলেন, আল্লাহ্‌ জানে। বোরকা দুটোর দিকে নজর দিল এবার। দুইটাই একদম ও যেমন পরে। সাথে আবার দুই জোড়া করে হাত-পায়ের মোজাও আছে। এরপর আর কিছুতেই লোকটার ওপর রাগ করে থাকতে পারলোনা ও।

খালা ওকে তৈরি হতে সাহায্য করল। খালার জোরাজুরিতে গোল্ডেন কালারের অসম্ভব সুন্দর একটা গর্জিয়াস ড্রেস পরতে হল ওকে, সিদ্রাও খুব বেশি আপত্তি করলনা কারণ বোরকা তো উপরে পরবেই। তারপর সবথেকে ভারী সোনার গয়নাগুলো পরিয়ে আয়নার সামনে ওকে যখন খালা দাঁড় করাল, নিজেকে চিনতে পারছিলোনা সিদ্রা। কোন সাজগোজ ছাড়াই ওকে একদম নতুন বউ এর মত লাগছে।

খালা এবার মেকআপ কিটটা নিয়ে আসল ওর সামনে, সরে গেল সিদ্রা। “না খালা, পোশাক পরেছি, গয়না পরেছি, কিন্তু কোন সাজগোজ না, প্লিজ!”

খালা অন্তত কাজলটা দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই রাজি হলনা সিদ্রা। বোরকা পরে রেডি হয়ে নিল।

***
বুবুর বাসায় যেতে পায়ে হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগলো। ঠিকই ধরেছিল সিদ্রা, বাংলোটা একটা বড়সড় টিলার ওপর। চওড়া একটা রাস্তা সেই টিলা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমেছে। আবার বুবুর বাসাটাও আকারে ছোট আরেকটা বাংলো, পাশেই আরেকটা ছোট টিলার ওপর।

কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলে বুবু এসে সিদ্রাকে জড়িয়ে ধরে ওয়েলকাম করলো। বুবু আজকে একটা শাড়ি পরে আছে। কথায় আছে না, বড় বোন মায়ের সমান, বুবুকে দেখে কথাটার সত্যতা অনুভব করল সিদ্রা।

সোফায় বসতেই বুবু তেড়ে উঠলো, বোরকা না খুলে কিছুতেই বসা যাবেনা। অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিদ্রা, এমনটা হতে পারে ভাবেইনি। আপত্তি করতে যাচ্ছিল ও, চোখ গরম করল শয়তান লোকটা। তবু মিনিমিন করে বলার চেষ্টা করল ওড়না আনেনি, ওমনি খালা বিশ্বাসঘাতকের মত হাসিমুখে ওড়নাটা বের করে দিল। কখন আমার চোখ এড়িয়ে ওড়নাটা ঢুকিয়েছিল আল্লাহ্‌ই জানে। বিরূপ মনে পাশের ঘরে ঢুকল সিদ্রা বোরকা খুলতে। খালা, আপনি এভাবে আমাকে ফাঁসাবেন জানলে আমি আপনার কথা কিছুতেই শুনতামনা, এখন এই পোশাকে ওই লোকটার সামনে যেতে হবে আমাকে!

ওড়নাটা ভালভাবে পরল সিদ্রা, সবসময়ের মত শুধু মুখটা খোলা। কিন্তু জানে, ওড়নাটা এত সুন্দর যে, এটুকুতে ওর চেহারার সৌন্দর্য ঢাকার পরিবর্তে আরো প্রকট হচ্ছে। আল্লাহ্‌, নিজের না, বোনের জীবন রক্ষার্থে আজ এভাবে পর্দার খেলাফ করতে হচ্ছে আমাকে। আমি কি ঠিক করছি, না ভুল? আমাকে ক্ষমা কর প্রভু, দয়া করে আমাকে পথ দেখাও, আমি যে ঠিক ভুল সব দিশা হারিয়ে ফেলছি! বুবু বাইরে থেকে ডাক দিতেই চোখে চলে আসা পানিটা মুছে বের হল সিদ্রা।
রাইয়্যান সিদ্রাকে দেখে পুরো হা হয়ে গেল, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটা আসলেই এত সুন্দর নাকি ও স্বপ্ন দেখছে! বুবু তো খুশিতে প্রায় লাফালাফি শুরু করে দিল, “ভাইটু, তুই ড্রেসটা ওকে দিয়েছিস! পরিয়েও এনেছিস!! থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু, আমি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি”

সিদ্রা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বুবুর কথা শুনে। বুঝিয়ে বলল বুবু, “তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, ওই মুখচোরাটা কিছু বলেনি তোকে“ ওকে ধরে রাইয়্যানের পাশে বসিয়ে দিল, জড়সড় হয়ে একটু সরে গেল সিদ্রা, বুবু খুশির চোটে বিষয়টা খেয়াল করলনা।

“আমি বলছি শুন, গত ঈদের শপিং এর সময় এ ড্রেসটা রাইয়্যানের অনেক পছন্দ হয়। আমাকে ছাড়া তো আর কোন মেয়েকে চিনেনা এই ছাগলটা, বলে কিনা আমাকে কিনে দিবে। তুই বল, এসব পরার বয়স আছে আমার? তখন আমি ওকে জোর করে এটা কিনে দিয়েছিলাম, যাতে ও এটা বিয়ের পর ওর বউকে দেয়। আর আজ ও আমার কথা রেখেছে, আই এম জাস্ট টু….. হ্যাপি! তোকে ভীষণ মানিয়েছে ড্রেসটাতে, জাস্ট অপূর্ব লাগছে! কিরে, দেখেছিস আমি যা করি, ঠিকই করি” শেষের কথাটা রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে বলল বুবু।

“হুম, তুমি কি আর ভুল হতে পারো! কাভি নেহি!!” দুইহাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে রাইয়্যান এপ্রিসিয়েট করল বুবুকে। সিদ্রা ওড়নার নিচে দুহাত মুঠো করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে লাগল। দিস ইজ জাস্ট টু মাচ, উনার বউয়ের জন্য কেনা ড্রেস উনি আমাকে দিবেন কেন? খালা এজন্যই এত জোর করে পরিয়েছে ড্রেসটা। নাহ! খালা আজ যা করল, এরপর খালাকেও আর বিশ্বাস করতে পারবোনা। বুবুর হাতের ছোঁয়ায় ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এল সিদ্রা।

“কানে গলায় কি পরেছিস দেখি?” সিদ্রার হাত দুটো নিয়ে চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখার পর হাত বাড়িয়ে নিজেই ওড়নাটা খুলতে গেল বুবু। কোনমতে আটকাল সিদ্রা, নিজেই ওড়নাটা আলগা করে দুহাত দিয়ে এমন করে ধরল, যাতে বুবু দেখতে পায় কিন্তু পাশে থাকা লোকটা দেখতে না পায়।

“মা শা আল্লাহ্‌! আমার ভাইয়ের চয়েস আছে। একদম রাণীর মত লাগছে তোকে। উঁহু, ভুল বললাম, তুই তো রাণীই” থুতনিটা ধরে আঙুলে চুমু খেল বুবু। হুহ! রাণী!! বন্দি দাসী আমি বুবু, আপনি আর কি জানেন, মনে মনে বলল সিদ্রা।
আবার আগের মত করে ওড়নাটা পরে নিতেই বুবু আপত্তি করে উঠলো, “ওইভাবেই রাখনা, গয়নাগুলো দেখা গেলে বেশি সুন্দর লাগছে” আরেকটু হলেই জোরে প্রতিবাদ করে ফেলছিল, সামলে নিল সিদ্রা, আস্তে করে বলল, “প্লিজ বুবু, আমি সতর ঢাকা অবস্থায় থাকতেই বেশি পছন্দ করি”

ওর কথা শুনে বুবু একটু অবাক হয়ে গেল, স্বামীর সাথে আবার কিসের সতর? কয়েক মুহূর্ত কি বলবে যেন বুঝতে পারলোনা। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “তোদের নিশ্চয় ক্ষুধা লেগে গেছে, আয় খেতে খেতে কথা বলি”

খেতে বসে তেমন কিছুই বললনা সিদ্রা, শুধু হু হা করে গেল, আর বুবুর মুখে যেন কথার ফুলঝুরি। একটা জিনিস ভালভাবে উপলব্ধি করল সিদ্রা, বুবু অনেক একলা একজন মানুষ, কারো সাথে প্রাণখুলে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন, আজ ওকে পেয়ে উনার বাঁধ ভেঙে গেছে।

খাওয়ার মাঝখানে যখন রাইয়্যান সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে একটু পানি ঢেলে দাওতো”, সিদ্রার তো বিষম খাওয়ার যোগাড়। লোকটা তো ভালই পারে, বুবুর সামনে কি সুন্দর ভাল হাজবেন্ডের মত তুমি তুমি করছে! আমাকে সবসময় নাটুকে বলা, এদিকে নিজে যে অভিনয়ে সিদ্ধহস্ত তার দিকে কোন খেয়াল নাই, হুহ!

কিন্তু বিপদ বাঁধল তখন, যখন সিদ্রা রাইয়্যানকে আপনি করে বলল।
“এই তোরা নাকি ভালবেসে বিয়ে করেছিস, তাহলে এসব আপনি আজ্ঞে আসছে কোথা থেকে?” বুবু যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

রাইয়্যানের রাগ আঁচ করতে পারলো সিদ্রা, বুঝতে পারলো, ওকেই ব্যাপারটা সামলাতে হবে। বলল,
“আসলে বুবু, আমার আম্মুকে সবসময় দেখেছি আব্বুকে আপনি আপনি করে বলে, তো আমিও সেজন্য উনাকে আপনি করে বলি” চট করে ব্যাপারটা মাথায় আসায় মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো।

“এ্যাঁ, এই আধুনিক যুগে এমন সেকেলে চিন্তা তোর মাথায় কিভাবে আসলো, আমি তো সেটাই বুঝতে পারছিনা। না না, এসব চলবেনা, তুমি বলতে হবে”

রাইয়্যান সিদ্রার উপর রেগে ফায়ার হয়ে গেছিলো, কিন্তু এত বুদ্ধি করে উত্তর দিবে সিদ্রা সেটা আশা করেনি, হতবাক হয়ে গেছিল তাই, এখন সায় দিল বুবুর কথায়।

“প্লিজ তুমিই কিছু কর বুবু, আমি তো বলতে বলতে হাল ছেড়ে দিয়েছি”

“এরপরে আপনি আজ্ঞে শুনলে না, ওকে পিট্টি দিব আমি”

“না বুবু প্লিজ প্লিজ, এমন করবেননা, আপনি অনেক ভাল, আমার এভাবে ডাকতেই ভাল লাগে, প্লি…..জ!” মুখটাকে যতটা সম্ভব করুণ করার চেষ্টা করলো সিদ্রা।

“ওরে পটানি রে, আচ্ছা মানতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত আছে”

“কি শর্ত?”

“এখন এই মুহূর্ত থেকে আমাকে তুমি করে বলতে হবে”

বুবু কি না কি শর্ত দেয়, ভীষণ টেনশনে পড়ে গিয়েছিল সিদ্রা, কিন্তু বুবুর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বুবুকে, “বুবু, তুমি না অনেক সুইট”

সিদ্রার কষ্ট দেখে আনন্দ পাওয়ার কথা, আর আনন্দ দেখে কষ্ট, অথচ সিদ্রার হাসিমাখা মিষ্টি মুখটা দেখে এত ভাল কেন লাগছে, কিছুতেই বুঝতে পারলোনা রাইয়্যান।

“কিন্তু জাস্ট কিছুদিনের জন্য, তার পরেও চেঞ্জ করতে না দেখলে তোর খবর আছে”

বাপরে! এরা ভাইবোন তো কথায় কথায় সবার খবর করে ছাড়ে!! ভাবল সিদ্রা।

এরপর বুবু ওর হাতে মোটা মোটা একজোড়া বালা পরিয়ে দিল, এগুলো নাকি ওর শাশুড়িমায়ের স্মৃতি! বুবুকে দিয়েছিল, এখন উনি সিদ্রাকে দিচ্ছে। এত খারাপ লাগলো সিদ্রার, কার না কার হক, ওকে দিচ্ছে। লোকটার উপর আরো রাগ উঠলো ওর, এমন একজন ভালমানুষকে কিভাবে ঠকাচ্ছে লোকটা।

চলে আসার সময় সিদ্রাকে প্রমিস করতে হল বুবুর কাছে, উনার ভাইটু এখানে না থাকলে ও বুবুর কাছে এসে গল্প করবে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here