যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ২০+২১

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

২০.
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই রাইয়্যান সিদ্রাকে বলল, “আরেকটু হলেই তো দিয়েছিলি ভেজাল পাকিয়ে! কাজটা মোটেও ভাল করিসনি। এখন এর শাস্তিস্বরূপ কফি বানিয়ে খাওয়া আমাকে, তবে তার আগে বোরকাটা খুলে নিতে পারিস!”

কোন উত্তর দিলোনা সিদ্রা, বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলো নিজের ঘরে। ড্রেসটা খুলে ওর মনে হল, বিশাল একটা বোঝা নামল শরীর থেকে। আজকেই প্রথম আর আজকেই শেষ, এটা কেন আর কোন ভারী ড্রেসই পরবো না আমি, সিদ্ধান্ত নিল সিদ্রা। ফ্রেশ হয়ে বেছে বেছে তুলনামূলক সবথেকে নরমাল থ্রিপিসটা পরে নিচে এলো আবার।

“কোনটা? আপনারটা না আমারটা?” রাইয়্যানের কাছে এসে জানতে চাইল সিদ্রা।

“মানে কি?” টিভিতে কি একটা দেখে হাসছিল রাইয়্যান, সিদ্রার প্রশ্ন শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে।

“কফি, কোন ভাবে বানাবো সেটা জানতে চাইছি”

“ও! ইউজ করতে জানিসনা টানিসনা, শেষে আমার অত দামী কফি মেকারটা নষ্ট করবি।তার থেকে বরং তোর মত করেই বানিয়ে আন” উত্তর দিল রাইয়্যান।

মনে মনে হাসলো সিদ্রা। বুঝতে পারছে ওর কফি ভালোই পছন্দ হয়েছে লোকটার, তবু একটু বাজিয়ে দেখল,
“না না, আমি অত খারাপ স্টুডেন্ট না, আমি পারব কফি মেকারে বানাতে, এক্ষুনি বানিয়ে আনছি”

“যেটা বলেছি সেটা কর, এত অতিরিক্ত প্যাঁচাল পাড়িস কেন?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল রাইয়্যান। মুচকি হেসে কফি বানাতে গেল সিদ্রা।

কফির মগটা এনে টেবিলে রেখে ভেবে রাখা কথাটা বলার সিদ্ধান্ত নিলো সিদ্রা, কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। ও যে দাঁড়িয়ে আছে, খেয়াল করলো রাইয়্যান।

“কিছু বলবি?”

“হুম! ভেবেছিলাম নিজের জন্য আপনাকে কোন খরচ করাবোনা, কিন্তু আজ যখন আপনি এতসব ফালতু জিনিস কিনে এত টাকা খরচ করে ফেলেছেন, তখন আমি কি কিছু চাইতে পারি?”

“হুম পারিস, কিন্তু আশা করি এমন কিছু চাইবিনা যেটা আমি তোকে দিবনা” কফিতে চুমুক দিল রাইয়্যান।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে আমার মুক্তি চাইতে আসিনি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন” বলল সিদ্রা, “আপনাদের লাইব্রেরিতে আমি না কোন কুরআন শরীফ দেখেছি আর না কোন ইসলামিক বই। যদিও আমি মুখস্থই তেলাওয়াত করতে পারি, তবুও অর্থসহ একটা কুরআন শরীফ পেলে ভাল হতো, আর সাথে কিছু ইসলামিক বই”

রাইয়্যান এত অবাক হল, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলোনা। এই ওর চাওয়া! অথচ আমি ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না যে কি না কি চাইবে।

“আয় আমার সাথে” বলে কফির মগ রেখে লাইব্রেরির দিকে এগোল রাইয়্যান।

কোণার একটা বুক সেল্ফ এর সব উপরের তাকটা অন্যগুলোর মত কাঁচের না, পাল্লা দেয়া, ওইটাই খুলল রাইয়্যান।

“এটা নিশ্চয় খুলে দেখিসনি”

আরে তাইতো, মায়ারেফুল কুরআন সহ অনেকগুলো তাফসীর গ্রন্থ আছে। হাফেজী কুরআন শরীফ ও চোখে পড়ল একটা, খুশি হল সিদ্রা।

“জাজাকাল্লাহ! আমি আসলেই দেখিনি এটা, কিন্তু……..”

“ইসলামিক বই তো, ঠিক আছে, নাম লিখে দিস, এনে দিব”

এত সহজে লোকটা ওর কথা মেনে নিবে কল্পনাও করেনি, কিছুটা অবাক হয়েই লাইব্রেরি থেকে রাইয়্যানের পেছন পেছন বের হয়ে এলো সিদ্রা। বসার ঘরে ফিরে এসে রাইয়্যান পা বাড়াল সোফার দিকে আর সিদ্রা সিঁড়ির দিকে। আমাকে কুরআন শরীফ দেখাতে গিয়ে তো উনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, গরম করে দিবো নাকি, মনে মনে ভাবলো সিদ্রা। ধুর! এতো দরদ দেখিয়ে কি হবে, খাক উনি ঠাণ্ডা কফি, আমার কি!!

রাইয়্যান পেছন থেকে বলে উঠলো, “গুড জব!” ঘুরে দাঁড়ালো সিদ্রা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রাইয়্যানের দিকে, “বুবুর সামনে ব্যাপারটা সুন্দর করে ম্যানেজ করেছিস” বলল রাইয়্যান, “তবে, বুবুর সামনে আমাকে তুমি করে বলতে পারিস, আমি কিছু মনে করবো না”

“আপনার মনে করা না করায় কিছু এসে যায়না। আমি আপনার মত ক্ষণে ক্ষণে ডাক বদল করতে পারবোনা। আর আমি আমার কাছের মানুষদের ছাড়া অন্যদের তুমি বলিনা” কাটাকাটা স্বরে জবাব দিল সিদ্রা।

“তো, বুবু তোর কাছের মানুষ?”

“অবশ্যই, বুবু আমাকে মাত্র দুবার দেখেছে আর তাতেই কত ভালবেসে ফেলেছে দেখেছেন? আমার কাছের মানুষ হওয়ার জন্য সেটুকুই এনাফ”

“সেতো আমি তোকে বউ বলে পরিচয় দিয়েছি বলে, তোর কি মনে হয় আসল কথা জানলে বুবু তোকে এমন ভালবাসতো?”

বড়সড় একটা ধাক্কা খেল সিদ্রা, কিন্তু রাইয়্যানের সামনে প্রকাশ করলোনা সেটা, উলটে বলল, “আসল কথা তো খালাও জানে, তাইনা?” শক্ত কন্ঠে জবাবটা দিয়েই সিঁড়ির দিকে এগোল সিদ্রা, কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ওর। সত্যিই তো, লোকটা ভুল কিছু বলেনি, বুবু আমাকে ভালবাসছে শুধু ওই কারণেই, আমার নিজের তো এতে কোন ক্রেডিট নেই!

বরাবরের মত হতভম্ব হয়ে গেল রাইয়্যান। আসলেই তো, খালা সবকিছু জেনেও এই মেয়েকে এত ভালবাসছে, বুবুও কি তেমনটাই করবে! শুধু আমিই কি…….. আনমনে কফির মগটা নিয়ে চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেললো, এহহে! পুরো পানি হয়ে গেছে!!

মধ্যরাত, খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে অন্ধকার ঘরে। সেজদায় পড়ে আছে সিদ্রা, কেঁপে কেঁপে উঠছে গোটা শরীর, কাঁদছে ও। আর মেনে নিতে পারছেনা ও এসব। এতদিন যাও সব কষ্ট সহ্য করে নিচ্ছিল, কিন্তু এই বউ সেজে থাকার বাড়াবাড়িটা যেন সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আজ বুবুর বাড়িতে ও যেমন অপ্রস্তুত হয়েছে, সত্যিই কি এভাবে কাটাতে হবে ওকে বাকি জীবন, কিভাবে সহ্য করবে ও?

***
বারান্দায় থাকা ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্রা। রেশমের মত চুলগুলো চেয়ারের গা বেয়ে মেঝেতে লুটোচ্ছে। এত নিশ্চিন্তে ভেজা চুল খুলে শুয়ে আছে কারণ লোকটা নেই, ঢাকায় গেছে, কালকে আসবে। এতদিন কখন যেতো, কোথায় যেতো, কখন আসবে কিছুই জানতোনা সিদ্রা। পরশু হঠাৎ যাওয়ার আগে বলে গেলো, কারণ নাকি বুবু জিজ্ঞেস করলে যদি উত্তর না দিতে পারে, তাহলে বুবু সন্দেহ করবে।

কোলের ওপর রিয়াদুস সালেহীনের প্রথম খন্ড রাখা। ইসলামিক বই বলতে আপাতত শুধু রিয়াদুস সালেহীন এর চারটা খন্ডই আনিয়েছে সিদ্রা। বিষয়ভিত্তিক হাদীসের এই গ্রন্থটিতে কোন দুর্বল হাদীস নেই, সব সিহাহ সিত্তাহ থেকে নির্বাচিত সহী হাদীস। অপরিসীম ঈমানী শক্তি পাওয়া যায় এর প্রতিটা হাদীস থেকে, সবর করার শক্তি এখন ও এই গ্রন্থ থেকেই পায়।

কেটে গেছে আরো কিছু দিন, কিন্তু নতুন কিছুই ঘটেনি। এক জায়গাতেই থমকে আছে সিদ্রার জীবন। আজ ও বই না পড়ে চা বাগানের শোভা দেখছিল। কিন্তু আসলেই কি তাই? এই বারান্দার মনোরম চা বাগানের দৃশ্য প্রথমদিনের মতই কি মনে দোলা দিচ্ছে ওর? প্রথমদিন বারান্দায় বেরিয়েই মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো সিদ্রা। মনে পড়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগের দার্জিলিং ভ্রমণের স্মৃতি। দাখিল পরীক্ষার পর সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। অফিসের বাৎসরিক লটারিটা জিতেছিল ওর আব্বু, সেখানে কাপল দার্জিলিং ট্রিপের সুযোগ ছিল। তার সাথে নিজেদের খরচে ওদের দুই বোনকেও নিয়ে গিয়েছিল। চা বাগান আর পাহাড়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সিদ্রা। মনে হয়েছিল, সারাজীবন এমন একটা বাড়িতে কাটালে কেমন হয়? যেখানে জানালা খুললেই মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যাবে, দু চোখ ভরে উপভোগ করা যাবে পাহাড় আর চা বাগানের সৌন্দর্য! আল্লাহ্‌ কি তবে ওর মনের ওই চাওয়াটাই কবুল করে নিয়েছিলেন!!

কিন্তু আব্বু বলেছিল, “সুন্দর জিনিস মাঝেমাঝে দেখলেই তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, প্রতিদিন দেখতে থাকলে সেটার আর আলাদা করে কোন গুরুত্ব থাকেনা” সেদিন আব্বুর কথা মানতে মন চায়নি কিন্তু আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। এই যে এত সুন্দর দৃশ্য, আজ কি ওর মন ভোলাতে পারছে? সিলেটের চা বাগান দেখার জন্য কতইনা বায়নাক্কা করেছে, ভাগ্যের ফেরে আজ সেখানেই বাস করতে হচ্ছে ওকে। অথচ আজ এ অপার সৌন্দর্যের সিদ্রার কাছে কোন মূল্যই নেই।

আর বই! বই পড়ার কত আগ্রহ!! নতুন বইয়ের তালাশে থাকতো সবসময় সিদ্রা। যেদিন খালা প্রথম লাইব্রেরির দরজাটা খুলে দিয়েছিল, চোখ কপালে উঠেছিল ওর। বন্দিজীবনে অন্তত নিজের পছন্দের কিছু করতে পারবে ভেবেই আনন্দ পেয়েছিল। কিন্তু এখন আর বই পড়তে ভাল লাগেনা ওর। ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে যায়, এক বর্ণ মাথায় ঢুকেনা। আবার কখনো দৃষ্টি থাকে বইয়ের দিকে, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্যখানে। জীবন যেখানে থমকে গেছে, নেই কোন স্বপ্ন, আশা কিংবা ভবিষ্যৎ, সেখানে কোন কিছুই কি আর ভাল লাগতে পারে?

অনেক ভেবেছে সিদ্রা, কোন কূলকিনারা পায়নি। পালিয়ে গেলে লোকটা মুনিরাকে মেরে ফেলবে, আর সত্যি কথা খুলে বললে লোকটা যদি ওকে ছেড়ে দিয়ে মুনিরাকে ধরে আনে, তখন? আমি তো সেটাও সহ্য করতে পারবোনা। তার থেকে এই ভালো, জীবন আর কয়দিনের! নাহয় কাটিয়ে দিব এভাবেই, যা কিছু পাওয়া হলনা এ জীবনে, আল্লাহ্‌র কাছে নাহয় আখিরাতে চেয়ে নিব!! আমার বোন বরং এসব থেকে দূরে থাক, আমি প্রতিনিয়ত দুয়া করছি, আল্লাহ্‌ ওকে যেন সহি বুঝ দান করেনন, ও যেন ওর ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। নিজের ভাগ্য নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছে তাই, ছেড়ে দিয়েছে সব এখন আল্লাহ্‌র হাতে।

এখন ভাবছে ও বুবুর কথা। বুবুর কথামতো এখন মাঝেমাঝেই দুপুরের পর খালার সাথে বুবুর বাসায় যায় সিদ্রা। যদিও কি বলতে কি বলে ফেলবে, এই ভয় থাকে, কিন্তু এতদিনে একজন গল্প করার মত মানুষ পাওয়া গেছে, না গিয়ে পারেনা ও। আর লোকটাও কোন আপত্তি করেনি, শুধু মনে করিয়ে দিয়েছে, ভুলভাল কিছু বললে তার পরিণতি কি হবে। তবে বুবু যথেষ্ট বিবেচক একজন মানুষ। জানে যে, বাবা মার কথা তুললে মন খারাপ হবে সিদ্রার, তাই সে বিষয় কখনো তুলেনা। তবে ওদের রিলেশন কখন হল, কিভাবে হল, সে বিষয়ে অনেক কৌতূহল বুবুর, প্রথমদিকে সেসব নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন করতো। সবসময় শুধু একটা কথা বলেই এড়িয়ে গেছে সিদ্রা, “শয়তানে ধরেছিল বুবু, পাপের সাগরে ডুবে যাচ্ছি বুঝতে পারিনি। তখন শয়তানের পাল্লায় যা করেছি করেছি, এখন ওইসব পাপের কথা আমি মুখে আনতে পারবোনা। আমাকে তুমি প্লিজ জিজ্ঞেস করোনা, পারলে তোমার ভাইয়ের থেকে জেনে নিও” অনেকবার চেষ্টা করে বুবু অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছে।

অনেকটা এই কারণেই দুপুরবেলায় যায় ও, বুবু ওইসময় রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকে। সিদ্রা চুপচাপ বসে বসে বুবুর ডাক্তারি দেখে। রোগীরা সবাই এই চা বাগানের শ্রমিক। উপজাতি তো, ওদের কথা একটুও বুঝতে পারেনা সিদ্রা, অথচ বুবু কি সুন্দর করে ওই ভাষাতেই ওদের সাথে কথা বলে, হা করে তাকিয়ে থাকে ও। নতুন কেউ এলেই বুবু ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মালকিন বলে, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মানুষগুলোর, এত লজ্জা লাগে সিদ্রার ব্যাপারটা। ওই লোক আর বুবুর প্রতি মানুষগুলোর ভালবাসা খুব ভালভাবে টের পায় ও। প্রতিদিন কেউ না কেউ এটাসেটা নিয়ে আসে বুবুর জন্য, যার বেশিরভাগই রান্না করা খাবার। গরীব মানুষ, এর বেশি দেবার ক্ষমতা নেই, কিন্তু তার ভেতরের ভালবাসার গভীরতাটা অনুভব করতে পারে সিদ্রা। রোগী দেখা শেষ হবার পর ওগুলো খেতে খেতে গল্প করে ওরা।

বুবু বলেছে ওকে, এই সব শ্রমিকদের চিকিৎসা ফ্রি। বুবুকে কোম্পানি থেকে বিশাল এমাউন্টের স্যালারি দেয়া হয়, বলতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল বুবু, “আমার কিছুই লাগেনা জানিস, সবকিছু তো ভাইটুই ব্যবস্থা করে দেয়। বছর বছর শুধু আমার ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ছে”

গতকাল বুবুকে এমনিই জিজ্ঞেস করেছিল ও, বিয়ে করেনি কেন বুবু? বলেই বুঝেছিল, প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি, কারণ মুখটা ভারী হয়ে গিয়েছিল বুবুর। কিন্তু বুবু এড়িয়ে না গিয়ে বলেছিল, “অনেক লম্বা কাহিনী, সময় করে একদিন বলবো তোকে” এখন সেটাই ভাবছে সিদ্রা, কি এমন কাহিনী থাকতে পারে বুবুর জীবনে?
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

২১.
সিদ্রার ঘুম ভাঙলো এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে। বিছানা হাতড়ে খালি বোতল আবিষ্কার করে নিচে নামল পানি খাওয়ার জন্য। উপরে উঠতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল ও। কোণার ঘর, যেটা ও ফারহানের বলে আন্দাজ করে, সেটার দরজাটা ভেজানো। ফাঁক দিয়ে নরম একটা আলোর রেখা চোখে পড়ছে। ভুতে বিশ্বাস না করলেও ভয় পেল সিদ্রা, কিন্তু কিসের আলো জানতেও ইচ্ছে করছে। শেষমেশ ভয় হার মানল কৌতূহলের কাছে। কিন্তু ঘরে উঁকি মেরে যা দেখলো, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা ও।

পুরো ঘর মোমবাতি, বেলুনসহ আরো নানা জিনিস দিয়ে সাজানো। সামনের দেয়ালে বড় করে লেখা “HAPPY BIRTHDAY FARHAN”। সাথে সাথে মনে পড়ল সিদ্রার, আজ দুপুরে বুবুর মন অনেক খারাপ ছিল। কি হয়েছে জানতে চাইলে কেঁদে ফেলেছিল বুবু। বলেছিল, “কাল ফারহানের জন্মদিন। আমরা দুই ভাইবোন ওকে প্রতি বছর নানারকম সারপ্রাইজ দিই এই দিনে। কিন্তু ও নিজেই এক বিশাল সারপ্রাইজ দিয়ে আমাদের সব সারপ্রাইজের ঋণ শোধ করে গিয়েছে! ছেলেটা যে কেন এমন করলো!!”

চুপ করে গিয়েছিলো সিদ্রা, অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছিল ওকে। এসব কিছুর জন্য দায়ী ওর বোন,জেনে হোক আর না জেনেই হোক। ভাবলেই প্রচণ্ড কষ্ট হয় ওর।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লোকটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল সিদ্রা। ওর আর লোকটার ঘরের থেকে একটু আলাদা এ ঘরটা। বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা একটা ঘর, আসবাবপত্র অনেক কম, একদম শুধু যা না থাকলেই নয়। বুঝতে পারলো, ফারহান ছেলেটা একটু অন্যরকম ছিল। শুধু একটা মিল আছে, দুই ভাইয়ের হাসিমুখের ওই বড় ছবিটা এঘরেও লাগানো। কিন্তু এসব আয়োজন যদি ওই লোকটা করে থাকে, তাহলে উনি কোথায়? ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যিনি এতকিছু করতে পারেন, তার যে আজকের দিনে কতটা কষ্ট লাগতে পারে, কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে সিদ্রা।

এবার ওর নজর পড়ল ঘরের টি টেবিলটার ওপর। সেখানে একটা কেক রাখা, উপরের মোমবাতিগুলো গলে গলে একদম নিভু নিভু। পাশে কিছু র‍্যাপ করা গিফটও চোখে পড়ছে। আরে, ওইতো টেবিলের ওপাশে মাথা রেখে উল্টোদিকে মুখ করে কার্পেটের উপর বসে আছে লোকটা। এসময় আমাকে দেখলে তো উনার কষ্ট আরো বেড়ে যাবে, চলে যাবো নাকি? কিন্তু কেন যেন মনটা সায় দিলোনা ওর। মনে হলো, আমার উপর রাগ দেখিয়েই নাহয় উনার মনের কষ্ট একটু কমুক!

আরেকটু এগোল সিদ্রা। ঘরের চারদিকে সাজানো বাকি মোমবাতিগুলো একটু মোটা মোটা, কয়েকটা আবার কাঁচের জারের ভেতর রাখা। নিভে যায়নি ওগুলো, এখনো ভালোই আলো দিচ্ছে, আর সেই আলোতে লোকটার মায়াবী মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো বোজা, হয়তো ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, ভাবতেই বড্ড মায়া লাগল সিদ্রার। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ, এসিও চালায়নি লোকটা, কপালে ঘাম চকচক করছে।

কিছু করবে কি করবেনা খানিকক্ষণ ভাবল সিদ্রা। শেষমেশ থাকতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে জানালাগুলো খুলে দিল। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে ভরে গেল ঘর, মোমবাতির শিখাগুলো নেচে উঠলো, জানালার কাছের কয়েকটা নিভেও গেল। পায়ে পায়ে লোকটার কাছে এল সিদ্রা। কেকের মোমবাতিগুলো এখন একেবারে নিভে গেছে। দূরের মোমবাতিগুলোর আলোয় দেখা যাচ্ছে, মৃদু বাতাসে লোকটার চুলগুলো নড়ছে। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করল সিদ্রা, ওর খুব ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই এত লজ্জা লাগলো ওর, ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

***
বুবুর বাসা থেকে বের হতেই মেঘ গুড়গুড় করে উঠলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে খুশিতে মনটা নেচে উঠলো সিদ্রার। পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে ঘন কালো মেঘে, বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ও অনেক ভালবাসে। কিন্তু এখানে আসার পর যখনি বৃষ্টি হয়েছে, হয় লোকটা এখানে ছিল নাহয় ওর মন ভীষণ খারাপ ছিল, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছেই করেনি। কিন্তু আজ বৃষ্টিতে ভেজার একদম মোক্ষম সুযোগ। বুবুর সাথে গল্প করে মনটা ফ্রেশ হয়ে আছে আর লোকটাও বুবুর বাসায় যাওয়ার সময় ওদের সাথেই বেরিয়েছে, বলে গিয়েছে যে রাত হবে ফিরতে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা চকিতে দেখে নিয়ে খালার হাতটা শক্ত করে ধরে দৌড় লাগাল সিদ্রা বাংলোর দিকে, বৃষ্টির একটা ফোটাও মিস করতে চায়না। খালা তো হতভম্ব হয়ে ওর সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেল। বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমেই বোরকা খুলে ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে পরতে পরতেই বাগানের দিকে ছুটলো ও।

সিদ্রাও বাগানে পৌঁছলো আর বৃষ্টিও শুরু হল। দুহাত দুপাশে লম্বা করে ছড়িয়ে মুখ উপরে তুলে দুচোখ বন্ধ করে রইল সিদ্রা। মুখের ওপর টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার আনন্দ যে অনুভব করেনি, সে জীবনে অনেক বড় কিছু মিস করেছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির তেজ বাড়লো, খোপাটা আলগা করে দিল সিদ্রা। চোখ খুলে দেখে খালা বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

“খালা, আসেননা” ডাক দিল সিদ্রা, মাথা নাড়লো খালা।

“আরে আসেনতো, একা একা ভিজতে কোন মজা নাই” টেনে খালাকে নিচে নামাতে গেল সিদ্রা, না না করতে লাগলো খালা। খালার হাত আর মাথা নেড়ে জোর প্রতিবাদ জানানো দেখে হেসে ফেলল সিদ্রা। সিদ্রার হাসিমুখ দেখে মনটা ভরে গেলো খালার। আমি ওর সাথে ভিজলে যদি মেয়েটার মুখে একটু হাসি ফুটে, তবে ক্ষতি কি? হাসিমুখে যোগ দিল ওর সাথে।

***
রাইয়্যান বিরক্তমুখে ফোনটা পাশের সিটে ছুড়ে মারল। গাড়ি ড্রাইভ করছিল ও, অনেক জরুরী একটা প্রোগ্রামে যাবার কথা, যেখানে খোদ মন্ত্রীমশাই উপস্থিত থাকবেন। এখন শুনছে, মন্ত্রীমশাই নাকি প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছেন, কোন মানে হয়! গাড়ি ঘুরাল রাইয়্যান, ফিরে চলল বাংলোর দিকে।

গাড়ি পার্ক করতে গিয়েই মনে পড়লো, ওরা তো বুবুর বাড়ি গিয়েছে, আমিও ওখানে যাবো নাকি? নাহ! মেয়েটা বুবুর সামনে আমাকে নিয়ে বড্ড আনইজি ফিল করে, বুবুর চোখে কিছু ধরা পড়লে শেষে মিথ্যা বলতে বলতে জান যাবে, রিস্ক নিয়ে লাভ নাই।

নিজের ঘরে কাউচে বসে ল্যাপটপে মনযোগ দিয়ে কাজ করছে রাইয়্যান। হঠাৎ ভেজা বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। যাব্বাবা, বৃষ্টি কখন শুরু হল, খেয়ালই তো করিনি। ইশ! কাগজগুলো ভিজে গেলোতো, জানালা বন্ধ করতে উঠলো রাইয়্যান। হাসির শব্দ কানে আসতেই চোখ পড়ল বাগানের দিকে আর সেখানেই আটকে গেল।

মেয়েটা এত প্রাণ খুলে হাসতে পারে! আমার সাথে তো কোনদিনই না, খালার আর বুবুর সাথে কথা বলার সময় ওর মুখে একটু আধটু হাসির রেখা দেখেছি, কিন্তু এমন প্রাণখোলা হাসি এই প্রথম। ওর চুলগুলো এত লম্বা নাকি? হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে, আগে খেয়াল করিনি তো! কি আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে মেয়েটা।

সবুজ ড্রেসটাতে কি সুন্দর লাগছে ওকে! ড্রেসটাতো আমি নিতেই চাইছিলামনা, দোকানদার জোর করে দিয়ে দিল, বলে কিনা আপনার বউকে খুব মানাবে। বউ! শব্দটা মনে আসলে নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে রাইয়্যানের।

আমি তো কখনো বিয়েই করতে চাইনি, কিন্তু এই মেয়েটাকে বউ ভাবতে খারাপ লাগেনা। মেয়েটাতো বউ শব্দটা সহ্যই করতে পারেনা, যা রেগে উঠে। সিদ্রার রাগী চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মুখের হাসিটা চওড়া হল রাইয়্যানের। ধ্যান ভাঙল সিদ্রার হাসির আওয়াজেই। গাছে পানি দেওয়ার হোস পাইপটা নিয়ে খালার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে ও। খালা দুহাত দিয়ে পানি আড়াল করে পালানোর চেষ্টা করছে, সেটা দেখেই খিলখিল করে হাসছে সিদ্রা। হাসিতে তার মুক্তো ঝরে, কে যেন বলেছেন, তিনি কি এমন হাসি দেখেই লিখেছিলেন কথাটা?

বৃষ্টির তেজ একটু কমে এসেছে, এখন আরো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সিদ্রাকে। আজকে মেয়েটাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে না? সেটা কি বৃষ্টিতে ভিজেছে বলে? হতে পারে! ও আচ্ছা, গয়না পরেছে। আমিই তো ওকে বলেছিলাম, সবসময় কিছু না কিছু পরে থাকতে, যাতে আমার বউ হিসেবে মান থাকে। কিন্তু সেই গয়না পরা অবস্থায় সিদ্রাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওর। ওইদিনের কথা মনে পড়ে গেল রাইয়্যানের। নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছিল সিদ্রা, হাত খালি দেখে ধমকে উঠেছিল রাইয়্যান।

“আমি গয়না পরে আছি, যাদের দেখানো লাগবে তাদের দেখিয়ে দিব, আপনার দেখার দরকার নেই” ধমকের জবাব এভাবেই দিয়েছিলো সিদ্রা।

“কেন?”

“কারণ আমার গয়নাপরা হাত দেখার অধিকার আপনার নেই” জামার হাতার উপর দিয়ে চেপে চুড়ির অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল সিদ্রা, সেগুলোকে রাইয়্যানের সামনে জামার হাতার ভেতরে উপর দিকে উঠিয়ে রাখে ও। হতভম্ব রাইয়্যান সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি ওকে।

ছোট একটা লকেটওয়ালা চেইন, হালকা ঝোলান ছোট একজোড়া দুল, আর চিকন চিকন একগাছা চুড়ি, এগুলোই সবসময় পরে থাকে সিদ্রা। আর আজ সেগুলো পরেই ওকে দেখছে রাইয়্যান। বাহ! গয়নাগুলো দারুণ মানিয়েছে তো!! চয়েস কার দেখতে হবে তো? বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সোনার গয়না যেন ঝকঝক করছে। আর সাথে সিদ্রার চেহারাও, তা থেকে তো নূর বেরোচ্ছে, যে নূর রাইয়্যানকে তেড়ে বেড়ায় সবসময়, বলে যে ও নিষ্পাপ।

“তুমি অন্যায় করছো!” ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো রাইয়্যানকে। “ওই যে হাসি তুমি দেখছো, সে হাসি তুমিই কেড়ে নিয়েছো ওর থেকে। ও হাসছে, কারণ ও জানে তুমি এখানে নেই। ও যদি জানতো তুমি এখানে আছো, এমন হাসি ও কখনোই হাসতোনা। তাই এ হাসি দেখার কোন অধিকার নেই তোমার” কেঁপে উঠলো রাইয়্যান।

আরেকটা কথাও মনে হল ওর, যে মেয়ে আমার সামনে পর্দা করার প্রাণপণ চেষ্টা করে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছি, এটা ঠিক হচ্ছেনা, সত্যিই ভীষণ অন্যায় হচ্ছে। ও জানতে পারলে হয়তো আমার সামনে আসাই বন্ধ করে দিবে। সাথে সাথে জানালাটা বন্ধ করে দিল রাইয়্যান।

***
অসময়ে এতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভেজার ফল হল ভয়াবহ। সন্ধ্যার পর দুজনে বিশাল দুই মগ আদা চা নিয়ে বসে হাঁচি দিতে লাগল, একবার খালা তো একবার সিদ্রা। আর খালা তো একটু পর কাশিও দিচ্ছে। রাইয়্যান ওদের পালা করে হাঁচি আর কাশির আওয়াজ শুনে হাসবে না বিরক্ত হবে বুঝে পেলনা।

রাতের খাওয়ার পর সিদ্রাকে কফি বানাতে বলল রাইয়্যান। সিদ্রা কফি নিয়ে আসলে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল রাইয়্যান। ভ্রু কুঁচকাল সিদ্রা।

“কে বলেছিল অতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে? আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়া, তাহলেই বুঝবি কেন হাসছি”

আয়নার দিকে তাকিয়ে সিদ্রা নিজেও হেসে ফেলল, লজ্জাও পেল। হাঁচি দিয়ে আর বারবার সর্দি মুছে নাকটা পুরো লাল টকটকে হয়ে আছে। ওর ফর্সা মুখে বিশাল একটা টমেটোর মত হাস্যকর লাগছে দেখতে। ছি ছি! আগে জানলে লোকটার সামনেও যেতামনা।

পরদিন ভোরে দরজায় ক্রমাগত ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল রাইয়্যানের। আমার দরজায় ধাক্কা! নিশ্চয় গুরুতর কিছু হয়েছে, জলদি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলল রাইয়্যান। কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল।

(চলবে)

স্যরি ফর পুচকা পর্ব, কালকে ইন শা আল্লাহ তাড়াতাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবো 😷
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here