যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ২২+২৩

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

২২.
পরদিন ভোরে দরজায় ক্রমাগত ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল রাইয়্যানের। আমার দরজায় ধাক্কা! নিশ্চয় গুরুতর কিছু হয়েছে, জলদি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলল রাইয়্যান। কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সিদ্রা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। ভয় পেয়ে গেল রাইয়্যান।

“এই, কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

কিছু বলতে গিয়েও কান্নার চোটে বলতে পারলোনা সিদ্রা। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে ওর দু’কাঁধে হাত রাখল রাইয়্যান।

“শান্ত হয়ে বল আগে কি হয়েছে, নাহলে বুঝবো কি করে?”

“খালার অনেক জ্বর….কিছুতেই কমছেনা… সব আমার জন্য হয়েছে… আমি ভিজতে না বললে এসব কিছুই হতনা… সব আমার দোষ…. প্লিজ আপনি কিছু করেন…. খালাকে বাঁচান” সিদ্রার কান্নার মাঝে থেকে এই কথাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হল রাইয়্যান।

“আরে পাগলী! সেজন্য তুই এভাবে কাঁদছিস? জ্বর হলে কি মানুষ মরে যায় নাকি! কান্না থামা, চল দেখি কি হয়েছে”

রাইয়্যানের প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হল সিদ্রা, ব্যাপারটা উনি এত হালকাভাবে নিচ্ছেন কিভাবে? আসলে ও প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে। জঙ্গলেও খালার জ্বর হয়েছিল ওর জন্য। আর এখন আবার, সেটাও ওরই পাগলামির জন্য, এটাই ও মানতে পারছেনা। তাও একটু আধটু হলে হয়। কি প্রচণ্ড তাপ! সারারাত ধরে জলপট্টি দিয়ে, মাথায় পানি ঢেলেও কমছেনা। ভয় পাবেনা?

রাইয়্যান ঘরে ঢুকে দেখল খালার কপালে জলপট্টির কাপড়। সেটা সরিয়ে হাত দিতেই চমকে উঠলো, পুরো আগুন! মেয়েটা অহেতুক ভয় পায়নি। চুল ভেজা খালার, নিচে বালতিও দেখা যাচ্ছে। মাথায় পানিও ঢেলেছে দেখছি।

“তুই থাক এখানে, আমি বুবুকে ফোন করে দেখি” মাথা নেড়ে সায় দিল সিদ্রা।

ফোন হাতে নিয়ে ফিরে আসল রাইয়্যান, দেখল সিদ্রা খালার হাতপা মুছে দিচ্ছে। চেয়ারে বসে বলল, “বুবু আসছে এখনি, কখন থেকে এ অবস্থা?”

“মাঝরাত থেকে”

“কি? এখন তো ছয়টা বাজে! কিন্তু…… তুই তো শুয়ে পড়েছিলি, কিভাবে বুঝলি?” হতভম্ব দেখাচ্ছে রাইয়্যানকে।

“শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ আমার আগেরবারের কথা মনে পড়ে, সেদিন ওইটুক ভেজাতেই খালার এত জ্বর এসেছিল, আর আজ তো এতক্ষণ ধরে ভিজেছে, তাই দেখতে এসেছিলাম আমি”

“তারপর থেকে একা একা এসব করছিস! আমাকে ডাকিসনি কেন?”

“ওইদিন তো শুধু জলপট্টি দিয়ে আর গামুছিয়েই কমে গিয়েছিল জ্বর, আজ তো মাথায় পানিও ঢেলেছি। আমি ভেবেছিলাম কমে যাবে”

“ঔষধ খাইয়েছিস?” উপর নিচে মাথা ঝাঁকাল সিদ্রা।

“চিন্তা করিসনা। খালার বৃষ্টির জল কোনকালেই সহ্য হয়না। কিচ্ছু হবেনা, ভাল হয়ে যাবে। এর আগেও হয়েছে এমন” যদিও আজকেরটা যে সামান্য না, ভালভাবেই বুঝতে পারছে রাইয়্যান। কিন্তু সেটা এখন এই মেয়েকে বলা যাবেনা, এমনিতেই তো কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে আবার জলপট্টি দেয়া শুরু করেছে সিদ্রা। আবার ওকে চোখ মুছতে দেখল রাইয়্যান। ওর মন এত নরম যে ওর জন্য খালার সামান্য জ্বর হয়েছে, সেটাই ও মানতে পারছেনা। অথচ একটা ছেলে ওর জন্য মারা গেছে, সেটা তাহলে কিভাবে এত সহজে মেনে নিচ্ছে!? এই পরিস্থিতিতেও আরেকটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো ওর মাথায়। আচ্ছা, যদি আমি কোন কারণে অসুস্থ হই, সিদ্রা কি আমারও এভাবে সেবা করবে?

কলিংবেলের আওয়াজে চিন্তার জাল ছিন্ন হল রাইয়্যানের। দরজা খুলতে গেল ও, ফিরে এল বুবুকে নিয়ে।

“জ্বর মেপেছিস?” ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল বুবু।

“না, থার্মোমিটার খুঁজে পাইনি” উত্তর দিল সিদ্রা।

আর কিছু না বলে বুবু থার্মোমিটার বের করে খালার মুখে ঢুকাল।

চোখ কপালে উঠলো বুবুর, “১০৪! শিগগির গাড়ি বের কর ভাইটু, হসপিটালে নিতে হবে” খালার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাইয়্যান বের হয়ে গেছে ঘর থেকে।

খালাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলল রাইয়্যান। সিদ্রাকে তো লক করে যেতে পারবেনা বুবুর সামনে, তাহলে এখন কি করবে, সেটা ভাবতে গিয়েই ও দরজায় দাঁড়ানো সিদ্রার দিকে তাকালো। আগে বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন বাইরের আলোয় সিদ্রার মুখটা একটু অস্বাভাবিক লাগল ওর কাছে। কি মনে করে এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলো রাইয়্যান। বুবুকে ডাক দিল, “বুবু, ওরওতো জ্বর এসেছে, যদিও খালার মত এত বেশি না। কি করি বলোতো?”

“না না, আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি ঠিক আছি, আপনারা খালাকে নিয়ে যান” প্রতিবাদ করল সিদ্রা।

“নারে, জ্বর অবস্থায় তোকে একা রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা, শেষে আরেকটা বিপদ বাঁধবে। ভাইটু, আমিই খালাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। আর দরকার পড়লে আমি ফোন করে নিব, তুই সিদ্রার খেয়াল রাখ” কথাগুলো বলে চাবি নিয়ে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসল বুবু।

“সাবধানে চালিও বুবু” চিৎকার করে বলল রাইয়্যান।

সিদ্রাকে কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিতে বলল রাইয়্যান কিন্তু কথা কানে তুললনা সিদ্রা, সোফায় গিয়ে বসে রইলো। বাধ্য হয়ে রাইয়্যান নিজেই ঢুকল রান্নাঘরে। দেখল ইন্ডাকশনের উপর একটা সসপ্যানে স্যুপ। খালার জন্য করেছিল সিদ্রা, বুঝল ও। সেটাকেই গরম করে নিয়ে গেল সিদ্রার কাছে।

সিদ্রা সোফায় হেলান দিয়ে আছে, চোখ বোজা। ঘুমিয়ে গেল নাকি! আবার কপালে হাত দিল রাইয়্যান। চোখ খুলল সিদ্রা, দুর্বল কন্ঠে বলল, “আমার কিছু হয়নি, আপনি খালার কাছে যান প্লিজ”

কোন উত্তর দিলনা রাইয়্যান। তাপ আগের থেকে বেশি মনে হচ্ছে, জ্বর বাড়ছে নাকি? তাড়াতাড়ি করে খালার ঘরে গেল ও থার্মোমিটার আনতে। থার্মোমিটার এর সাথে প্যারাসিটামলের পাতাটাও নিয়ে এল।

জ্বর মেপে দেখল, একশোর একটু বেশি। যাক, এত বেশি না, হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান। স্যুপ খাওয়ার জন্য উঠে বসতে বলল সিদ্রাকে। “আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা, নরমাল জ্বর, এমনিই কমে যাবে, আমার জন্য এত ব্যস্ত নাইবা হলেন! আপনি বুবুকে ফোন দিয়ে দেখুন খালার কি খবর”

“বুবু ওখানে আছে, খালাকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবেনা। আচ্ছা বেশ, তুই স্যুপ খেয়ে ঔষধ খেলে আমি বুবুকে ফোন দিব”

একথায় চট করে সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। রাইয়্যান খাইয়ে দিতে যাচ্ছিল ওকে, বাধা দিল সিদ্রা। নিজেই বাটি নিয়ে আস্তে আস্তে খেয়ে নিল স্যুপটুকু। তারপর ঔষধ খেয়েই বলল, “এবার ফোন করেন”

হাসল রাইয়্যান, ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল। কথা বলার পর সিদ্রাকে বলল, “টেনশনের কিছু নাই, ওরা এডমিট করে নিয়েছে। জ্বর কমার জন্য সাপোজিটরি দিয়েছে আর টেস্ট করার জন্য ব্লাড নিয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর, ইন শা আল্লাহ্‌ টেস্ট রিপোর্ট ভালই আসবে” সিদ্রার দিকে এগিয়ে আসল রাইয়্যান, “সারারাত ঘুমাসনি, এখন ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নে কিছুক্ষণ। দেখবি, ঘুম থেকে উঠে শুনবি যে খালার জ্বর ভাল হয়ে গেছে”

“ইন শা আল্লাহ্‌” বলে উঠে পড়ল সিদ্রা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে যেন টলে উঠলো একটু, রাইয়্যান ছুটল ওকে ধরার জন্য। কিন্তু সিদ্রা হাতের ইশারায় নিষেধ করলো ওকে, নিজেই রেলিঙ ধরে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেলো। আর মনে মনে বলল, বললেই হল নিশ্চিন্তে ঘুমা, গোটা বাড়িতে আপনি আর আমি একা, জীবনেও ঘুম আসবেনা আমার। কিন্তু ওই বলা পর্যন্তই, শরীর এত ক্লান্ত হয়ে ছিল, বিছানায় শুয়ে চোখ বুজতেই সিদ্রা হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে।

***
এক ঘুমে দুপুর পার করে দিল সিদ্রা। রাইয়্যান মাঝে মাঝে এসে চেক করে গিয়েছে। ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়ে গিয়েছে, আর আসেনি।

ঘুম ভেঙে সিদ্রা বুঝলো যে ওর জ্বর নেই, সকালের ভারী মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগছে। জানালার দিকে চোখ পড়তেই বুঝলো যোহরের ওয়াক্ত যাই যাই করছে। তড়াক করে উঠে বসলো ও। এদিকে জর ছাড়ার সময় ঘামে ভিজে জামা টামা সব চ্যাটচেটে হয়ে আছে। শুধু অজু করে নামাজ পড়া সম্ভব না। যত দ্রুত সম্ভব ফ্রেশ হয়ে শরীর মুছে ড্রেস চেঞ্জ করে নিল, গোসল করার ঝুঁকি আর নিলনা। বের হয়েই দেখল, লোকটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই সকালবেলার অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল। বাসায় আর কেউ নেই, ভাবতেই ভয় লাগছে সিদ্রার। লোকটা মানুষের সামনে তো খালি বউ বউ করে, এখন ফাঁকা বাড়িতে যদি কিছু করে বসে, কি করব আমি? নাহ! আল্লাহ্‌ আছেন, তিনিই রক্ষা করবেন, মনে মনে ভরসা পেল সিদ্রা।

“খালা কেমন আছে?” সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল সিদ্রা।

“জ্বর কমেছে, ডাক্তাররা বলেছে, চিন্তার কিছু নাই” হাসিমুখে উত্তর দিল রাইয়্যান।

লোকটা অকারণে হাসছে কেন? কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেইতো? একি, আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন?
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

২৩.
রাইয়্যান কাছে আসতেই পিছু হটলো সিদ্রা, কিন্তু ভুলে গেল যে বাথরুমের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। তার ফলে যা হবার তাই হলো, চৌকাঠে পা লেগে উলটে গেল পেছন দিকে, আ…… করে চিৎকার করে উঠলো সিদ্রা। ঠিক সময়ে ওর একটা হাত ধরে ফেলল রাইয়্যান, বাঁচিয়ে দিল আছাড় খাওয়ার হাত থেকে। পরমুহূর্তেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে সোজা করলো ওকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় মোটামুটি হা হয়ে গেছিলো সিদ্রা। সেই হা করা মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো রাইয়্যান। সিদ্রার ভীত চোখমুখ দেখে মজা করে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল ও, কিন্তু সেটা যে এতখানি কাজে দিবে ভাবতেও পারেনি।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থার্মোমিটার মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিদ্রা। ভীষণ লজ্জা পেল ও, উনি আমার জ্বর মাপতে আসছিলেন আর আমি এমন উদ্ভট চিন্তা করছিলাম! ছি!! ছি!!!

এক মিনিট পর রাইয়্যান নিজেই ওর মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিলে সম্বিৎ ফিরল ওর।

“যাক, নরমাল” স্বস্তির সুর রাইয়্যানের কন্ঠে। বিড়বিড় করে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলল সিদ্রা।

“আচ্ছা, তুই বাসায় একা থাকতে পারবি, আমি তাহলে খালাকে দেখে আসতাম”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন সিদ্রা, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পারবোনা?”

“ঠিক আছে, আমি বেরোচ্ছি তাহলে”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা, রাইয়্যান দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবার।

“বুবুর বাসা থেকে খাবার আনিয়েছি, নিচে টেবিলে ঢাকা দেয়া আছে, খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি”

“আপনি খেয়েছেন?” বলেই জিভে কামড় দিল সিদ্রা। উনি খেলো কি খেলোনা, তাতে আমার কি, নিজের ওপর বিরক্ত হল ও।

“হুঁ” মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রাইয়্যান।

***
বুবুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে খালার কাছে রয়েছে রাইয়্যান। খালার জ্বর অবশেষে ছেড়েছে, এখন ঘুমাচ্ছে। টেস্ট রিপোর্ট এসে গেছে, নিউমোনিয়া হয়েছে খালার। কয়েকদিন এখানে ভর্তি থাকতে হবে খালাকে। সেটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে রাইয়্যান। সিদ্রা মুখে কিছু না বললেও একা বাসায় ওর সাথে থাকতে সিদ্রা অস্বস্তি বোধ করবে এটা ভালই বুঝতে পারছে ও। বুবুর বাসার কাজের মেয়েটাকে বাসায় এনে রাখা যায়, কিন্তু ওর আর সিদ্রার আলাদা থাকার বিষয়টা চোখে পড়ে যাবে ওর। কাজের উসিলা দিয়ে ঢাকায় চলে যাবো? নাহ! খালা আর সিদ্রা দুজনেই অসুস্থ, এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া খারাপ তো দেখাবেই, আমারও মন মানবেনা। কি করি আমি এখন?

খালার ঘুম ভাঙলো এসময়। আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে নার্স কে ডাক দিল রাইয়্যান। নার্স এসে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে যাবার পর খালা ওকে সিদ্রার কথা জিজ্ঞেস করলো। সত্যি কথাই বলল ও। শুনে চিন্তিত হয়ে গেল খালা, ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলল।

“কেন খালা?” অবাক হল রাইয়্যান।

খালা জানালো, সিদ্রার দিনের বেলায় জ্বর ছেড়ে যায় আর রাতের বেলা আসে, আগেরবার খেয়াল করেছেন উনি। এবার রাইয়্যানও টেনশনে পড়ে গেল। এসময় ঝড়ের বেগে কেবিনে ঢুকল বুবু, পেছনে ঢুকল বুবুর বাসার কাজের মেয়েটা।

“এই তুই সিদ্রাকে বাসায় আটকে রেখে এসেছিস কেন?” ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল রাইয়্যানের, বুবু কিভাবে বুঝলো!

“কি বলছো বুবু? আটকে রেখেছি মানে?” এমনভাবে তাকাল যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

“আমি ওকে দেখতে গেলাম, মেয়েটা দরজা খুলতে পারলোনা, বলল তুই নাকি চাবি নিয়ে গেছিস!”

“ও এই ব্যাপার! আসলে ও তো রেস্ট নিচ্ছিল, দরজা লাগাতে গেলে শুধুশুধু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হবে তাই আমি বাইরে থেকে লাগিয়ে এসেছি” সাবধানে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল রাইয়্যান।

“আচ্ছা, তা তুই ওকে ফোন কিনে দিসনি?” বুবুর কন্ঠে জেরার সুর।

“দিতে চেয়েছিলাম তো, ও নিজেই নিতে চায়নি, মোবাইল হাতে পেলেই নাকি ওর মন মানবেনা, বাসায় ফোন দিতে ইচ্ছে করবে, আর ওর আব্বু আম্মু ওকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবে। কি অদ্ভুত মেয়ে, বুঝো”

“হুম, কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, ও তোর সাথেও কেমন গুটিয়ে থাকে, ভালোবেসে বিয়ে করলে এমন তো হওয়ার কথা না। সত্যি করে বল, তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস নাতো?”

“ছি ছি বুবু, তুমি আমাকে আবার সন্দেহ করছো! আরে, একবার ভেবে দেখো, ওর মত মেয়ের কি এমন কাজ করা সাজে? ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছে। এখন বেচারি অনেক গিল্টি ফিল করছে, কিছুতেই সহজ হতে পারছেনা। আর এর খানিকটা দোষ তো আমারও, সেজন্য আমাকেও শাস্তি দিচ্ছে”

“আহারে, এত ভাল মেয়েটা। ওর ফ্যামিলি যে কেন মানলোনা তোকে। যাকগে, তুই কষ্ট পাসনা। ওর দিকটা একটু বুঝার চেষ্টা কর। তোকে ভালবাসে বলেইতো এতকিছু ত্যাগ করেছে। ওকে যেন কোনদিন পস্তাতে না হয়। তুই অন্তত ওকে কোনদিন কষ্ট দিসনা” অবশেষে বুবুর কন্ঠ থেকে সন্দেহের সুর দূর হতে দেখে হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান।

“না না, কোনদিন দিবনা, দেখো তুমি” বুবুকে পটানোর মত একটা হাসি উপহার দিল ও।

“দিবিনা তো, এখন কি করছিস? ওকে একা বাসায় রেখে এখানে বসে আছিস কেন?” ধমকে উঠলো বুবু, হাসি বন্ধ হয়ে গেল রাইয়্যানের।

“ওর জ্বর তো ভাল হয়ে গেছে, ও-ই তো জোর করে পাঠাল আমাকে”

“গাধা, ও পাঠাল আর তুই ড্যাঙড্যাঙ করে চলে এলি! আমি মুক্তাকে নিয়ে এসেছি সাথে করে, ও খালার কাছে থাকবে। তুই চল আমার সাথে। অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে এতক্ষণ এখানে বসে আছে! ইরেস্পন্সিবল ইডিয়েট একটা!!” মাথায় জোরে একটা ঠোকনা মারল বুবু।

ড্রাইভ বুবুই করছিলো, রাইয়্যানের বাংলো আগে পড়ে, ওকে নামিয়ে দিয়ে বুবু চলে গেল নিজের বাংলোর দিকে। অসুস্থ সিদ্রাকে দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বুবুর। কিন্তু রাইয়্যানের সাথে কথা বলার পর বুবুর মনে হয়েছে, ওদের একটু স্পেস দেওয়া দরকার। বাসায় কেউ নেই, ওরা বরং নিজেদের মত একটু সময় কাটাক। আমার ভাইটা একটা আস্ত গাধা! প্রেম করেছে, কিন্তু রোমান্স বুঝেনা। নতুন বউকে নিয়ে হানিমুন তো দূরের কথা, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার নাম পর্যন্ত নিচ্ছেনা। এবার মেয়েটা সুস্থ হলে আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি পার্ক করতে করতে এসবই ভাবছিল বুবু।

***
হাত উঁচিয়ে বুবুকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান, পুরো বাড়ি অন্ধকার। মাত্র তো রাত নটা বাজে, সত্যি সত্যি আবার জ্বর আসলোনা তো? সিদ্রার ঘরে ঢুকে দেখল, শুয়ে পড়েছে ও। আলো জ্বালাতেই চোখ মেলল সিদ্রা, উঠে বসল বিছানায়। বিছানার কাছে এসে কপালে হাত দেয়ার আগেই কথা বলে উঠলো সিদ্রা।

“জ্বর আসেনি আর”

“কখন মেপেছিস?” জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।

“আমার কথা বাদ দেন, খালা কেমন আছে সেটা আগে বলেন”

রাইয়্যান ওর কথার উত্তর না দিয়ে ঔষধের পাতাটা হাতে নিল, একটা কম। যাক, ঔষধ খেয়ে নিয়েছে তাহলে, স্বস্তি পেল ও।

“উত্তর দিচ্ছেন না কেন?” অস্থির কন্ঠে বলল সিদ্রা।

“বলছি বলছি” বিছানার পাশের সোফাটাতে বসল রাইয়্যান, “খালার নিউমোনিয়া হয়েছে”

“আল্লাহ্‌! আমি কি করলাম এটা!!” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সিদ্রা।

“আরে, আবার কাঁদে। এটা এত ভয়ংকর কিছু না, বয়স্ক মানুষদের ঠাণ্ডা লেগে হয়েই থাকে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে”

“সত্যি বলছেন?” মুখ তুলল সিদ্রা।

“শুধু শুধু মিথ্যা কেন বলব? রাতের খাবার খেয়েছিস?”

“হুঁ”

“বেশ, তাহলে আর কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়। অন্তত একজন সুস্থ হয়ে আমাকে ধন্য কর” সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাইয়্যান।

সিদ্রা কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমানোর জন্য নয়। লোকটা যাওয়ার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে ও, শুধু দুইবার নামাজের জন্য উঠেছে। ও আন্দাজ করতে পারছিলো, খালা হাসপাতালে থাকলে এই গোটা বাড়িতে ওই লোকটার সাথে একা রাত পার করতে হবে ওকে। তাই রাতে কিছুতেই ঘুমানো যাবেনা, জেগে থাকতে হবে। সেজন্য মাগরিবের পর কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে খেয়েছে আর বাগান থেকে একটা লাঠিও কুড়িয়ে এনে রেখেছে কম্বলের নিচে। এখন এই ভয়ংকর রাত ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়!

লোকটা লাইট অফ করে দরজা টেনে চলে যাওয়ার পর কতক্ষণ পার হয়েছে জানেনা সিদ্রা, হঠাৎ দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে। লোকটা লাইট না জ্বালিয়েই এগিয়ে আসছে কেন? কম্বলের নিচে লাঠিটা শক্ত করে ধরল সিদ্রা, কোন তেড়িবেড়ি দেখলে সোজা বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকলো। লোকটা বিছানার কাছে আসতেই ঘুমের ভান করে চোখ বুজল সিদ্রা।

কপালে হাত দিল লোকটা, ভয়ে সিদ্রার গোটা শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই হাতটা সরে গেল। হালকা করে চোখ ফাঁক করে সিদ্রা দেখল লোকটা চলে যাচ্ছে। ও, শুধু জ্বর দেখতে এসেছিলো! আলহামদুলিল্লাহ্‌!! এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সাবধানে ছেড়ে দিল সিদ্রা।

***
প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় গিয়ে রাইয়্যান দেখে আসছে সিদ্রাকে, আর তার ফাঁকে ল্যাপটপে কাজ করছে। সারাদিনে ধকল তো আর কম যায়নি, বারোটার দিকে হাই তোলা শুরু করল ও। আর কিছুক্ষণের মধ্যে কাউচে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েও পড়লো। ঘুম ভাঙল একেবারে চারটার সময়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো রাইয়্যান। ততক্ষণে মনে পড়ে গেছে সিদ্রার জ্বরের কথা, তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটলো ও সিদ্রার ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে কম্বল সরিয়ে আরেকদফা চমকে গেল রাইয়্যান, বিছানা ফাঁকা। বাথরুমে গিয়েছে মনে হয়, নাহ! বাথরুমের দরজা খোলা। বারান্দা, সেখানেও নেই।
ড্রয়িংরুম, বাগান, রান্নাঘর, লাইব্রেরি সব জায়গা খুঁজে ফেলল রাইয়্যান, সিদ্রা কোথাও নেই। মাথার চুল খামচে ধরল দুহাত দিয়ে, মেয়েটা গেল কোথায়!?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here