#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
আমেনা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে শশী। দেয়াল ঘড়িতে বারবার দৃষ্টি যাচ্ছে। অপেক্ষা আহনাফের জন্য। দেশে ফেরার পর থেকে দু’দণ্ড সময় নিয়ে কথা বলা হয়নি। ব্যস্ততা অবশ্য তার নয়; আহনাফেরই বেশি। তবে আগামী দু’তিনদিনের মধ্যে সে নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। হাসপাতালে জয়েন করবে। তখন রোগী, বাড়ি আর আমেনা বেগমকে দেখেই তার সময় পার হয়ে যাবে। আহনাফের সাথে শশীর পরিচয় হয় ওর বেষ্টফ্রেন্ডের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। শশী তখন ডাক্তারি পড়ছিল। এরপর আহনাফের সাথেও তার ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্ক পরিণত হয় বন্ধুত্বে। বন্ধুত্বের সুবাদেই শশীর এই বাড়িতে যাওয়া আসা হয়। আমেনা বেগম শশীকে অনেক বেশি পছন্দ করেন। তার অবচেতন মন চাইত শশী আহনাফের বউ হোক। মায়ের ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিতে আহনাফও রাজি হয়েছিল।
“আপা, ভাইজান আইছে।”
শশী দরজায় দাঁড়িয়ে রেণুকে দেখতে পায়। আমেনা বেগমের গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে বলল,
“চলো।”
আহনাফ নিজের রুমে ছিল। দরজা হালকা চাপিয়ে রাখা। শশী দরজায় নক করে বলে,
“আসব?”
অর্ষাকে পৌঁছে দিয়ে এসেই বিছানায় গা এলিয়েছিল আহনাফ। মনটা কেমন যেন তিক্ত হয়ে আছে। কেন এমন লাগছে কে জানে! সে শোয়া থেকে উঠে বসল। বলল,
“এসো।”
শশী ভেতরে ঢোকে। একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,
“কী হয়েছে?”
“কার?”
“তোমার। মুখটা ওমন শুকনো লাগছে কেন?”
“কই? আমি তো ঠিক আছি।”
“একদম না।”
“তোমরা ডাক্তাররা শুধু শুধু সন্দেহ করো। টাকা ইনকাম করার ধান্দা না?”
“খবরদার! মিথ্যে অপবাদ দেবে না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। মা ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ। মাত্রই ঘুমালো।”
“খেয়েছ তুমি?”
“না। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। খাবে না এখন?”
“খিদে নেই।”
শশী মুখটা মলিন করে বলল,
“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি!”
“আচ্ছা রেণুকে বলো খাবার বাড়তে। আমি আসছি।”
“বেশি দেরি কোরো না। খেয়ে কিন্তু আমায় বাসায় যেতে হবে।”
“আচ্ছা।”
.
.
আত্মসম্মানে ঘেরা মানবীর যখন আত্মসম্মানে আঘাত লাগে তখন সেই যন্ত্রণা হয় তীক্ষ্ণ তীরের চেয়েও ধারালো। আহনাফের বলা কথাগুলো অর্ষা শুনছিল ঠিক কিন্তু যেই আঘাত সে পেয়েছে সেটা তার মনের আঘাতের চেয়েও প্রবল। দ্বিতীয়বার সে আহনাফের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি। কাঁদতে গিয়েও সে কাঁদতে পারেনি। অপমানে মনে হচ্ছিল সে শূন্যে ভাসছে। বাড়ির সামনে এসেও সে গাড়ি থেকে নেমে একটাবার পেছনে তাকায়নি। তবে পেছন থেকে আহনাফের বলা কিছু কথা শুনতে পেয়েছে,
“আমাকে ভুল না বোঝার অনুরোধ রইল অর্ষা। আমি আজ যা বলেছি, সেটা দুজনের ভালোর জন্যই বলেছি।”
অর্ষা ভালো-খারাপের ধার ধারতে পারছে না। বাড়ির ভেতর ঢুকে উঠোনের এক কোণে সে পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছে। তার মনে হচ্ছে সমস্ত দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র আহনাফের বলা কথাগুলোই তীরের ফলার মতো তাকে প্রহার করছে। সে ভাবে আহনাফের মুখোমুখি আর হবে না।যাবে না আর সে অফিসে। কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্যকিছুই ভেবে রেখেছে। অর্ষার সিদ্ধান্ত ঠিক মনঃপুত হয়নি নিয়তির নিকট। আর তাই তো সিদ্ধান্তের গোড়াতেই অর্ষাকে আরও একবার হার মেনে নিতে হয়।
অন্ধকারে বসে যখন সে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত তখন ঘর থেকে চাপা কান্না ও আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসে। অর্ষা দ্রুতপদে দৌঁড়ে রুমে প্রবেশ করে। ওমর রহমান র’ক্ত বমি করছেন। সকাল আর সেলিনা বেগম বিলাপ করে কাঁদছেন আর ওমর রহমানকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। এই দৃশ্য অর্ষার কাম্য ছিল না। সে দিকদিগন্ত ভুলে বসে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে। ওমর রহমান তখনও র’ক্ত বমি করে যাচ্ছেন। অর্ষা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে দৌঁড়ে বাইরে চলে আসে। একটা সিএনজি এনে ড্রাইভারের সাহায্যে ওমর রহমানকে সিএনজিতে এনে বসায়। তখনই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালের সকল ফর্মালিটি শেষ করে অর্ষা করিডোরের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় নানান রকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বাবা অসুস্থ। এমন অবস্থায় যদি সে চাকরিটা ছেড়ে দেয় তাহলে চলবে কীভাবে?
সকাল নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। অর্ষা ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“কিছু বলবি?”
“আব্বু সুস্থ হয়ে যাবে তো?”
অর্ষা আদুরেভাবে সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। বমির সাথে অনেক র’ক্ত বের হয়েছে বলে এখন র’ক্ত দিতে হচ্ছে।”
“হঠাৎ করে আব্বু এমন অসুস্থ হলো কেন?”
“পেটে আলসার হয়েছে। ডাক্তার তো বলে দিয়েছে ধুমপান একদম করা যাবে না! এবার যদি একটু শোধরায়।”
কয়েক সেকেণ্ড থেমে অর্ষা ফের বলে,
“মা কোথায়?”
“বাবার কাছে।”
“তুই আর মা বাড়িতে চলে যা। আমি হাসপাতালে থাকব।”
“আমরাও থাকব।”
“জেদ করছিস কেন?”
“জেদ করছি না। তোমার ঘুমানো দরকার। তুমি বাসায় চলে যাও।”
“পাকা পাকা কথা বলবি না। আমি না ঘুমিয়ে থাকতে পারব। আমার অভ্যাস আছে।”
“আমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।”
মা কিংবা সকাল কাউকেই বাড়িতে পাঠানো গেল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনজনই হাসপাতালে থেকে গেছে। সকাল থেকে তো গেছে তবে জেগে থাকতে পারেনি। অর্ষার কোলে মাথা রেখে বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। রাত্রি জেগে অর্ষাও তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। নিজের একার দিক ভাবলে শুধু চলবে না। তার ওপর এখন পুরো পরিবারের দায়িত্ব রয়েছে। এছাড়া বাবার এমন অসুস্থ অবস্থায় চাকরি ছাড়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে যেটা করতে পারে তা হচ্ছে, আহনাফকে এড়িয়ে চলা। আজ থেকে সে আহনাফ নামে কাউকে চেনেই না এমনভাবে অফিসে কাজ করবে!
.
অফিসে আসার পূর্বে অর্ষা আহিলকে ফোন করে সব জানিয়েছে। সবটা শুনে আহিল অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলেছে সে হাসপাতালে থাকবে। কোনো প্রয়োজন হলে সে দেখবে। আহিলের জন্য হলেও কিছুটা দ্বিধামুক্ত হয়ে অর্ষা অফিসে আসে।
অফিসের গেটে কলিগ স্মৃতির সাথে দেখা হয়।
“কেমন আছো?” জানতে চাইল স্মৃতি।
অর্ষা মলিনকণ্ঠে বলল,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে।”
“তেমন কিছু না। আব্বু একটু অসুস্থ।”
দুজনে কথা বলতে বলতে লিফ্টের কাছে চলে আসে। কিন্তু আহনাফকে সেখানে দেখে অর্ষা আর লিফ্টে প্রবেশ করে না। কিছু রেখে এসেছে এমন ভঙ্গিতে বলে,
“ওহহো! স্মৃতি তুমি যাও আমি আসছি।”
“আরেহ! কী হলো?”
“আসছি আমি। তুমি যাও।” বলতে বলতে পিছু চলে যায় অর্ষা।
অর্ষার সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিচক্ষণ আহনাফের। সে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নেওয়ার চেষ্টা করে।
কাজের জায়গায় একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এড়িয়ে চলা কতটা যে মুশকিল অর্ষা ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে। বিশেষ করে সে যার আন্ডারে রয়েছে তাকে কী করে ইগনোর করা যায়? এইযে সামনে কতগুলো ফাইল পড়ে রয়েছে। এগুলোতে আহনাফের সাইন লাগবে। আর এই সাইন আনতে যেতে হবে অর্ষাকে। প্রতিটা দিন তাকে মানুষটির মুখোমুখি হতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলতে হবে। এতকিছুর পরও কী করে সম্ভব এড়িয়ে চলার অভিনয়টুকু করা?
অর্ষা ঘড়ি দেখছে আর ভাবছে কী করবে। এর মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয় জিসান শিকদার। লোকটা ভীষণ রাগী এবং ব’দ’মে’জা’জি স্বভাবের। জুনিয়র সকল কর্মচারী তাকে ভয় পায়। আজ মিজান আসেনি। ছুটিতে আছে। তাই অর্ষার তৈরি করা ফাইলগুলো আজ জিসান শিকদার দেখবে। সে গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষার দিকে। অর্ষা তখনও তার উপস্থিতি টের পায়নি। ওর সরাসরি অন্য একটা ডেস্কে স্মৃতি বসে। সে নানানভাবে অর্ষাকে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। তাতে লাভ-ই বা কী! অর্ষার মনোযোগ তো অন্য ভুবনে।
জিসান শিকদার বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ধমকের সুরে বলে,
“অফিস কি চিন্তা-ভাবনা করার জায়গা?”
অর্ষা ভয়ে আঁৎকে ওঠে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় তবে কথা বলতে পারে না। আকস্মিকভাবে সে ভীষণ ঘাবড়েও গেছে। জিসান শিকদার আবারও ধমক দিয়েই বলে,
“চুপ করে আছো কেন?”
অর্ষা আমতা আমতা করে বলে,
“স..স্যরি স্যার!”
“কয়টা বাজে? ফাইলগুলো তৈরি করেছ? কাজ না করে উদাস হয়ে বসে আছো। কোম্পানী কি বসে থাকার জন্য তোমায় টাকা দিয়ে রেখেছে?”
অর্ষা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিসান শিকদার এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের ওপর থেকে ফাইলগুলো হাতে তুলে নেয়। উলটে-পালটে দেখে বলে,
“আহনাফ স্যারের সাইন কোথায়? এগুলো কি আমি গিয়ে নিয়ে আসব?”
অর্ষা নিরুত্তর। আবারও ধমকে ওঠে জিসান শিকদার,
“কথা বলো না কেন? সাইনগুলো কি আমি আনব?”
জিসানের গলার স্বর শুনে আহনাফ তার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ উপস্থিত সবাই জিসান এবং অর্ষার দিকে তাকিয়ে ছিল। আহনাফের আগমনে সবাই যার যার কাজ করতে শুরু করেছে।
আহনাফ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
জিসান তখনও রেগে ছিল। সে রাগ দমনের চেষ্টা করে বলল,
“ফাইলগুলো কমপ্লিট করার কথা সকাল দশটার মধ্যে। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। অথচ এখনও কাজ শেষ করেনি। উদাস হয়ে বসে আছে।”
“দশটার মধ্যে কমপ্লিট করার কথা বুঝলাম। তাহলে আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? সে তার কাজটা করেনি আমি এটাও মানলাম। কিন্তু আপনি কী করেছেন এতক্ষণ? আপনি কেন দশটা বাজার সাথে সাথে এসে খোঁজ করলেন না? এটা কি আপনার রেসপন্সিবিলিটির মধ্যে ছিল না?”
“স্যার আমি তো অন্য কাজ করছিলাম।”
আহনাফ হাত উঁচু করে বলে,
“আমি তো কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না। যেখানে আপনি নিজেই নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারছেন না সেখানে অন্যের ত্রুটি কী করে ধরছেন?”
জিসান নিশ্চুপ।
আহনাফ বলল,
“চুপ করে থাকবেন না। উত্তর দিন।”
জিসান মাথা নত করে বলল,
“স্যরি স্যার।”
“একজন এমপ্লয়ির সাথে রুড বিহেভ করার রাইট কি কেউ আপনাকে দিয়েছে? ভুল যে কারও-ই হতে পারে। এজন্য তার সাথে রুড বিহেভ করার রাইট আপনার নেই। আমারও না। আপনার নামে অনেক কমপ্লেইন আছে জানেন? শুধুমাত্র আপনার এই রুড আচরণের জন্য।”
সবাই নির্বাক। জিসান এবং অর্ষা দুজনই নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপচাপ। আহনাফ বলল,
“শুনুন মিস্টার জিসান, আপনাকে আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আজকের পর থেকে আপনি কোম্পানীর কোনো এমপ্লয়ির সাথে রুড বিহেভ করতে পারবেন না। এখন আপনার যদি মনে হয়, রুড বিহেভ ছাড়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয় তাহলে আপনি রিজাইন লেটার জমা দিতে পারেন।”
“স্যরি স্যার। আর এমন হবে না।”
“ফাইলগুলো নিয়ে আমার কেবিনে আসুন।”
অর্ষার উদ্দেশ্যে কথাটি বলে আহনাফ ফের নিজের কেবিনে চলে যায়। জিসানও চলে যায় নিজের কেবিনে। অর্ষা বসে পড়ে। তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। স্মৃতি অর্ষার কাছে আসে। কাঁধে হাত রেখে বলে,
“মন খারাপ কোরো না প্লিজ! জিসান স্যারটা এমনই। সবার সাথেই এমন ব্যবহার করে। তাও তো ভালো, আজ আহনাফ স্যার সব দেখেছে। সে তো যা বলার বলেই দিয়েছে। তুমি মন খারাপ কোরো না। কাজের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে স্যার, বসদের বকা একটু-আধটু খেতেই হয়। এসব মনে রাখলে চলবে না।”
অর্ষা মলিনভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ মোটিভেট করার জন্য। আমি ঠিক আছি।”
ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দেয় অর্ষা। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না অর্ষা। ইউ ক্যান, ইউ ক্যান!”
ওয়াশরুম থেকে স্বাভাবিক হয়ে বের হয়ে ফাইলগুলো নিয়ে আহনাফের কেবিনে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে নক করে,
“আসব?”
ভেতর থেকে উত্তর আসে,
“আসুন।”
অর্ষা ভেতরে প্রবেশ করে। ফাইলগুলো ডেস্কের ওপর রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আহনাফ এক এক করে ফাইল চেক করে। সাইন করা শেষ হলে ফাইলগুলো সে অর্ষার দিকে এগিয়ে দেয়। আহনাফ খেয়াল করে যে, অর্ষা তার দিকে আসার পর থেকে একবারও তাকায়নি। এমনকি ফাইলগুলো নেওয়ার সময়ও নয়! অর্ষা চলেই যাচ্ছিল সেই সময়ে আহনাফ বলে,
“এরপর থেকে জিসান কিছু বললে কিংবা অন্য কেউ কিছু বললে আমায় জানাবেন।”
অর্ষা এবার তাকালো আহনাফের দিকে। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন? আমি কি আপনার বিশেষ কেউ? আমি যতটুকু জানি, এখানে কোনো এমপ্লয়ির কোনো প্রকার সমস্যা হলে কিংবা অভিযোগ থাকলে সবাই এইচ.আর-এ জানায়। সরাসরি আপনাকে এসে জানায় এমনটা তো আমি কারও কাছে শুনিনি স্যার।”
আহনাফের দৃষ্টিতে বিস্ময়। অর্ষা বলে,
“এখানে বাকি এমপ্লয়ি যেমন, আমিও তেমন। আলাদা নই। সবাইকে যেভাবে এই অফিসে ট্রিট করা হয়,আমাকেও সেভাবেই ট্রিট করা হবে। আমার বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা দরকার নেই স্যার।”
অর্ষা তার কথা শেষ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আহনাফ তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। সে হতবাক এবং বিস্মিত। বলাই বাহুল্য অর্ষার কথাগুলো ভীষণ কঠিন ছিল।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১৪
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
“সকাল তোর কাছে বাচ্চারা প্রাইভেট পড়তে কখন আসে?” অফিস থেকে ফিরে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
সকাল পড়ছিল। সে অর্ষার প্রশ্ন শুনে পড়া থামিয়ে বলল,
“বিকেলেই। আমি কলেজ থেকে আসার পর। কেন?”
“এখন থেকে ওদেরকে বলবি সন্ধ্যায় ছয়টায় আসতে। আমি এক ঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টা পড়িয়ে দেবো। যারা আসতে পারবে না তাদের পড়ার দরকার নেই। আমি যেহেতু এখন জব করছি সেহেতু দু’একজন স্টুডেন্টস কম পড়লে সমস্যা নেই। তুই এখন থেকে কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট নিবি এক ঘণ্টার মতো। তারপর রাফিকে পড়াতে যাবি।”
“তুই আর রাফিকে পড়াবি না?”
“না।”
“কেন?”
“সব কেনর উত্তর হয় না সকাল। আর সবকিছুতে তোর এত কৌতুহল বন্ধ কর। আমি যেটা বলেছি বুঝেছিস?”
সকাল ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“বুঝেছি।”
“মানতে আপত্তি আছে?”
“না।”
“গুড। এখন সর। ঘুমাব আমি।”
“ঘুমাবি মানে? ফ্রেশ হবি না? খাবি না?”
“না, ভালো লাগছে না।”
সেই রাতে সত্যি সত্যিই অর্ষা ফ্রেশ হয়নি, খায়ওনি। আজ তিনদিন হবে সে রাফিকে পড়াতে যায় না। রেণুর নাম্বার থেকে কল এসেছিল। অর্ষা কোনো রেসপন্স করেনি। অনেক ভেবে-চিন্তে তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর ও বাড়িতে যাবে না।
সেলিনা বেগম অনেক ডেকেও অর্ষাকে ঘুম থেকে তুলতে পারল না।
.
.
রুমের মাঝে পায়চারি করছে আহনাফ। হাতে গরম কফির মগ। পায়চারির সঙ্গে সঙ্গে সে কফিতেও চুমুক দিচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে বোঝা যাচ্ছে। এই ভাবনাটা যে অর্ষাকে নিয়ে এটা সে অস্বীকার করতে পারবে না। সত্যি বলতে অস্বীকার করতে চায়ও না। মেয়েটা কেমন যেন হুট করে এসেই চিন্তার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। মনের একাংশে নিজের আধিপত্য তৈরি করে নিয়েছে। মেয়েটাকে দেখার পরই যেন সে ভুলে বসেছিল সে শশীর কাছে কমিটেড। মাথায় তখন শশীর বিষয়টা ছিল-ই না। অর্ষা নামক হঠাৎ আসা মেয়েটি অল্প অল্প করে মনে জায়গা করে নিতে শুরু করল। সে না চাইতেও জড়িয়ে গেছিল অর্ষার সাথে। অর্ষার এত টেক কেয়ার করা, সঙ্গ দেওয়া এসবই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল। তার অর্ষার প্রতি দুর্বল হওয়াটা যতটা না অনুচিত ছিল তারচেয়েও বেশি অনুচিত হয়েছে অর্ষার সঙ্গে মেশা। তার বারবার মনে হচ্ছে, তার জন্যই অর্ষা তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। সে যদি না অর্ষাকে সেভাবে বুঝতে দিত তাহলে হয়তো অর্ষাও তাকে ভালোবাসত না। সেদিন যেই কথাগুলো সে অর্ষাকে বলেছিল সেগুলো যে অর্ষাকে কতটা আঘাত করেছিল তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে না পারলেও কিছুটা তো অন্তত আন্দাজ করতেই পেরেছিল। কিন্তু এছাড়া তো আর তার কোনো উপায়ও ছিল না। সে চেয়েছিল এই আঘাত থেকেই অর্ষার মাঝে জেদ তৈরি হোক। আহনাফকে সে ঘৃণা করুক। তার চাওয়া হয়তো সত্যিই পূরণ হয়েছে। অর্ষা তাকে এড়িয়ে চলছে। বিষয়টা একদিকে তাকে সন্তুষ্ট করলেও অন্যদিকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। কষ্ট সে এজন্য পাচ্ছে না যে, অর্ষা তাকে এড়িয়ে চলছে; বরং সে এজন্যই কষ্ট পাচ্ছে কারণ সে জানে ঐ কঠোর মনের মাঝে কঠোরতার চেয়ে কষ্টের পরিমাণ বেশি। এই কষ্টের জন্য আহনাফ বারবার নিজেকে দায়ী মনে করছে। শতবার সে নিজেকে দোষারোপ করে চলেছে।
রাতে ডিনার শেষ করে চিন্তিত মনেই সে শুয়ে পড়ে। আজকাল ওভার থিংকিং বেশি করছে। এছাড়া কিছু করারও নেই। ফিরে যাওয়ারও দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। মন না চাইলেও আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না কিছুতেই। কী করবে উপায় না পেয়ে হাসিবকে ভিডিয়ো কল করে। হাসিব আহনাফের বেষ্টফ্রেন্ড। বর্তমানে সে কানাডায় জব করে। দু’বার রিং হওয়ার পর হাসিব কল রিসিভ করে বলে,
“কী অবস্থা তোর? এতদিন পর!”
আহনাফ শোয়া থেকে উঠে বসল। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
“এতদিন পর মানে? গতকালও তোর সাথে আমার কথা হয়েছে।”
“হয়েছিল নাকি? মনে নেই তাহলে। কাজের চাপে সব ভুলে যাই।”
“কাজের চাপ নাকি গার্লফ্রেন্ডের চাপ?”
হাসিব শব্দ করে হেসে ওঠে। বলে,
“ধুর শালা! আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই। আমি পিওর সিঙ্গেল।”
“চাপা মারিস না আর।”
“চাপা কেন মারব? তোর কাছে কি আমি মিথ্যা বলি নাকি। এনিওয়ে, ভাবির কোনো সিঙ্গেল কাজিন আছে নাকি জিজ্ঞেস করিস তো।”
আহনাফের চোখে-মুখে এতক্ষণ হাসি থাকলেও এবার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হাসিব ফ্রিজ থেকে জুসের বোতল বের করতে করতে বলে,
“কী হয়েছে? কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে।”
“সব কেমন যেন এলোমেলো লাগে রে! ভালো লাগে না আর কিছু।”
“বলবি তো শালা কী হয়েছে?”
“মেবি আই অ্যাম ইন লাভ।”
“সেটা আর নতুন কী? আগে থেকেই তো।”
আহনাফ রাগান্বিত স্বরে বলল,
“আগে থেকেই মানে?”
“কেন? শশী?”
“আমি কোনোদিন বলেছি শশীকে আমি ভালোবাসি?”
“বিয়ের পরে বাসতি। এখন তো বিয়ের আগেই ভালোবাসা হয়ে গেছে বললি।”
“হ্যাঁ, ভালোবাসা হয়েছে। তবে মেয়েটা শশী নয়।”
হাসিব জুসের বোতলে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে বলল,
“তাহলে কে?”
“অন্য একজন।”
“তুই কি একসাথে দুই নৌকায় পা রাখা শুরু করলি নাকি?”
“ফালতু কথা বলবি না। আমি ঐ টাইপ ছেলে?”
“ভালোবাসাটা হলো কীভাবে?”
“এই প্রশ্নের উত্তর কেউ কখনও দিতে পেরেছে?”
“শশী জানে?”
“কেউ-ই কিছু জানে না।”
“কী করবি তাহলে এখন?”
“কিছুই না। সব যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলবে।”
“তোর কথা শুনে এখন আমার নিজেরই হতাশ লাগছে।”
আহনাফ মলিন হেসে বলল,
“থাক তোর আর হতাশ হওয়া লাগবে না। রাখছি এখন। ঘুমাব।”
“আচ্ছা বেশি ভাবিস না। যা হওয়ার হবেই। ঘুমিয়ে পড়।”
“গুড নাইট।”
______________
অর্ষা অফিসে এসে নিজের ডেস্ক ঝেড়ে-মুছে আগে পরিষ্কার করে। ফাইলগুলো সব গুছিয়ে রেখে কম্পিউটারে রিপোর্ট করতে বসে। সেই সময়ে মিজান এসে বলে,
“অর্ষা কি ব্যস্ত?”
অর্ষা মিজানের দিকে তাকিয়ে দেখে তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আর ঘেমেনেয়ে শার্টও ভিজে গেছে। সে প্রশ্ন করল,
“না, কোনো কাজ আছে?”
“হ্যাঁ। একটু কষ্ট করে তোমায় আট তলায় যেতে হবে। এইচ.আর-এ গিয়ে সম্পা ম্যামকে বলবে মিজান স্যার ডকুমেন্ট আর ফাইলগুলো দিতে বলেছে।”
“আচ্ছা। কিন্তু আপনাকে এত টায়ার্ড লাগছে কেন?”
“লিফ্ট নষ্ট। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসলাম। হাঁপিয়ে গেছি। এখন আর আট তলায় যাওয়ার এনার্জি পাচ্ছি না। তুমি একটু কষ্ট করে যাও পিচ্চি।”
“সমস্যা নেই। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। কিন্তু আমি যখন আসলাম, তখন তো লিফ্ট ঠিক ছিল।”
“হ্যাঁ। দশ কি পনেরো মিনিটের মতো হবে লিফ্ট নষ্ট।”
“ওহ। আচ্ছা স্যার আপনি রেস্ট করুন। আমি গিয়ে নিয়ে আসি।”
মিজান খুশি হয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ পিচ্চি।”
প্রত্যুত্তরে অর্ষাও হাসল। উঠে চলে গেল ফাইলগুলো আনার জন্য। সে যখন ফ্লোরের মেইন দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলছিল, তখন অপর পাশ থেকে জিসানও দরজা টেনে খুলছিল। দুজনের টাইমিং আকস্মিক একসাথে হওয়ায় এবং দুজনেই মুখোমুখি হওয়াতে অর্ষা টাল সামলাতে পারে না। সে হুড়মুড়িয়ে গিয়ে জিসানের ওপর পড়ে। জিসান নিজেও এমনকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না বিধায় অর্ষাকে নিয়েই ফ্লোরে পড়ে যায়। অর্ষার কপালের সাথে জিসানের থুতনিতে বারি লাগে। এছাড়া জিসান নিজের মাথায়ও বেশ আঘাত পেয়েছে। সিঁড়িতে তখন অসংখ্য এমপ্লয়ি, স্টাফ, স্যাররা ছিল। তাদের মধ্যে আহনাফ নিজেও ছিল। সে সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’চোখ আটকে আছে অর্ষার দিকে। ভয়ার্ত অর্ষা কীভাবে জিসানকে আঁকড়ে ধরেছে এই দৃশ্যটাই তার চোখের দৃশ্যপটে আটকে রয়েছে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ পর্ব ছোটো হয়েছে এটা নিয়ে আফসোস/অভিযোগ না করে গল্প পেয়েছেন এতেই খুশি থাকুন।😴নেক্সট পর্ব তাড়াতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করব ইন-শা-আল্লাহ্।]