#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০২
#মাহিয়া_মুন
আমরা যে মুহূর্ত টাকে খুব করে অতিক্রম করতে চাই সেই মুহূর্ত বা সময়টা যেন কাটেই নাহ। হোক সেটা জীবনের কোনো যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্ত অথবা অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া কিছু বেমানান মুহূর্ত।
স্কুল জীবনে সকল ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এই মুহূর্ত টা তখনই আসে যখন স্কুলে তাদের সবচেয়ে অপছন্দের শিক্ষক বা শিক্ষিকার ক্লাস চলে। বার বার করে হাত ঘড়িতে সময় দেখা, কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়া, আলসেমি মুহূর্ত, সব টাই হয়ে উঠে এই মুহুর্তের সঙ্গী।
ঠিক এরকম একটা মুহুর্তের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে নুজহাত, আবিদ, তাকিয়া। নুজহাত এবং আবিদেরই প্রিয় বন্ধু তাকিয়া। তিন জনের বেশ ভালোই বন্ধুত্ব স্কুলে।
নুজহাত বার বার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। তৃতীয় পিরিয়ডে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের ক্লাস চলছে। এই বিষয়ের স্যার টাকে ক্লাসের কেউই খুব একটা দেখতে পারে নাহ। কারণ স্যার কথায় কথায় সকলকে অপদার্থ বলবে। ক্লাসে সবাই তো আড়ালে স্যার কে অপদার্থ বলেই ডাকে। একবার তো স্যার কে একজন বলেই দিয়েছিলো যে,
“স্যার আপনি যে সবসময় আমাদের অপদার্থ বলেন, আপনি কি জানেন নাহ যে সকল বস্তুর আকার, আয়তন, ওজন আছে এবং জায়গা দখল করে তাকে পদার্থ বলে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা নিজেরাই। তাহলে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও আমাদের অপদার্থ বলেন। এটা কি ঠিক স্যার।”
সেদিন স্যার এর মুখটা দেখার মত হয়েছিল। ক্লাসের সবাই তো এই কথা পুরো স্কুল রটিয়ে ছিলো। সে কি হাসি রে সবার।
“এই গাঁ*ধী। সারাদিন বাসায় বসে পুর্নের সাথে চ্যাট করিস তবুও মন ভরে নাহ এখন আবার ব্যাগের মধ্যে ফোন লুকিয়ে ক্লাস চলা কালীন সময়ে চ্যাট করছিস।”
তাকিয়ার কথায় নুজহাত ব্যাগের মধ্যে ফোন রেখে তাকিয়ার দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ এখন এদের রাগালে তারই লোকসান। মুহুর্তেই মুখটাকে অবুঝ বালিকার ন্যয় করে তাকিয়ার হাত ধরে বলে উঠলো,
“দোস্ত এবারই শেষ। প্লীজ টিফিন টাইমে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দে নাহ তোরা দুজন।”
তাকিয়া কিছু বলার আগেই আবিদ রেগে বলে উঠলো,
“কষে একটা চড় মারবো গাঁ*ধী। আজ তিন মাস ধরে এরকম করে যাচ্ছিস। এই তুই বলতো পূর্নের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর তুই টিফিন টাইমের পর কয়দিন ক্লাস করেছিস। আর বলি, ওই পূর্নের কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এই সময়ে দেখা করার কথা বলে। কি এমন তাবিজ করছে শুনি।”
নুজহাত মন খারাপ করে বলে উঠলো,
“আমাকে যা বলার বল, ওকে নিয়ে একদম কিছু বলবি নাহ। ও খুব ভালো ছেলে।”
“ভালো না ছাই। ও কেমন ছেলে সেটা তো তোকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কি মেয়েকে তিন মাসে কি বানিয়ে দিলো। এখন তো আমাদের বন্ধুদের জন্যেও তোমার সময় থাকে নাহ। আমি আজই আন্টি কে জানাবো সব। তার মেয়ে যে সকালে রহিম স্যার এর কাছে পড়তে যাওয়ার নাম করে একটা ছেলের বাইকে বসে ঘুরে বেড়ায়, টিফিন টাইমের পর তাকে আর স্কুলে পাওয়া যায় নাহ, এটা সেটার নাম করে বাবার থেকে টাকা নিয়ে ওই ছেলেকে কতো কি কিনে দেয়। সবটাই জানাবো আজকে দেখিস। আহ্হা কি আদিক্ষেতা। স্কুল, কোচিং থেকে বের হলে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে বাবুকে। তা নুজহাত বাবু তুমি কি বাসা চিননা। তো আজকে তিন মাস পূর্ণ হলো তো তোমাদের প্রণয়ের, তাকে কি দিবে ভেবেছো কিছু।”
আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল আবিদ। তার আজ ভীষন রাগ হচ্ছে। রাগ যেন সপ্তম আকাশে। যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে সে মানুষটা তার সামনে দিয়ে অন্য একজনের সাথে ঘুরে বেড়ায়। আবার কিনা তাকেই সাহায্য করতে হয়।
তাকিয়া আবিদের কাধে হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো শান্ত হতে। নুজহাতের দিকে ইশারা করতেই আবিদ নুজহাতের দিকে তাকালো।
নুজহাতের চোখ ছলছল করছে। আবিদ সর্বশেষ কবে তাকে এভাবে বকেছে সেটাও মনে নেই তার। কি এমন বলেছে যে তাকে এত্তোগুলো কথা শুনিয়ে দিল। কথাই বলবে নাহ আর তার সাথে।
ভাবনার মাঝেই টিফিন টাইম শুরু হয়ে গেছে। স্যার ক্লাস থেকে চলে যেতেই আবিদ নুজহাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নুজহাত ফিরেও তাকালো নাহ আবিদের দিকে। একমনে বই এর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই মুহুর্তে পড়া ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় নেই।
আবিদ কিছুক্ষন চুপ থেকে কান ধরে উঠ বস করতে লাগলো।
“কেউ একজন যে এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছে, সেকি জানে এভাবে গাল ফুলালে তাকে একেবারে পেঁচার মত লাগে দেখতে।”
আবিদের কথায় নুজহাত কিছুই বললো নাহ। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে জানে যে এই ছেলে কিছুক্ষনের মাঝেই তার রাগ ভাঙিয়ে ফেলবে।
তাকিয়া পাউরুটি তে জেলি লাগাচ্ছে আর দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। এরকমটাই হয়ে এসেছে সব সময়। আবিদ দোষ করুক আর না করুক নুজহাতের রাগ তাকেই ভাঙাতে হবে। কান তাকেই ধরতে হবে। ছেলেটা বুঝার বয়স হওয়ায় পর থেকেই নুজহাত কে ভালবেসে আসছে। শুধু বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আজ পর্যন্ত না নিজে নুজহাত কে জানিয়েছে আর না তাকিয়াকে জানাতে দিচ্ছে। কিভাবে যে পারে।
আবিদ পুনরায় বলে উঠলো,
“কেউ একজন বলেছিলো তাকে টিফিন টাইমে বের হওয়ার সুযোগ করে দিতে। আর কিন্তু দশ মিনিট সময় বাকি আছে। আবার যেন না বলে আমরা বের হতে সাহায্য করি নি।”
নুজহাত তবুও কিছু বললো নাহ।
আবিদ পুনরায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,
“আচ্ছা ছোটো বউ সরি, আর এরকম হবে নাহ। এই কানে ধরেছি আর বকবো নাহ। আমার কিন্তু পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। পরে রাতে পা টিপে দিবে কে শুনি। ছোটো বউ তো আর আমার কাছে থাকে নাহ।”
আবিদের কথা শেষ হতেই নুজহাত হেসে উঠলো। আবিদকে হাঁপাতে দেখেই হেসে ফেলেছে নাহলে সত্যিই এই ছেলের পা ব্যাথা হতো কিন্তু তবুও কান ছাড়তো নাহ্।
“হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। এখন আমাকে বের হওয়ার সুযোগ করে দে।”
আবিদ মলিন হেসে তাকিয়ার হাত থেকে জেলি মাখানো পাউরুটি নিয়ে নুজহাতের মুখের সামনে ধরলো। নুজহাত নাক মুখ কুচকে বলে উঠলো,
“আমি এখন খাবো নাহ হাতে একদম সময় নেই। পূর্ণ নিশ্চয়ই এসে দাড়িয়ে আছে।”
আবিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নুজহাত আবিদের হাতেই পাউরুটি তে কামড় বসিয়ে দিলো। এই ছেলে নাহলে তাকে কিছুতেই যেতে দিবে নাহ।
“প্লীজ প্লীজ এবার বের কর আমায়।”
আবিদ মাথা নেড়ে নুজহাতকে নিয়ে স্কুলের পিছনের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে দেখে নিল কেউ আছে নাকি। অনেকেই আছে তবে কারোই এদিকে খুব একটা নজর নেই। দারোয়ান কেও দেখা যাচ্ছে নাহ। যাক ভালোই হলো খুব একটা কষ্ট করতে আর হবে না। প্রতিদিন তো কতো কি করে দারোয়ানকে গেটের সামনে থেকে সরায়।
সুযোগ বুঝে নুজহাতকে বাহিরে বের করে দিল। নুজহাত বাহিরে গিয়েই আবিদের দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসি দিল। আবিদও বিনিময়ে হেসে ইশারায় দ্রুত যেতে বললো। নুজহাত চলে যেতেই আবিদের হাসি মুখ একেবারেই মিলিয়ে গেল। এরকমটাই আজ তিন মাস হয়ে এসেছে।
*
*
লেকের পাশে কাপল বেঞ্চে বসে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে ইশতিয়াক পূর্ণ। অপেক্ষায় আছে নুজহাতের। বেঞ্চের এক প্রান্তে একটি ফুলের তোড়া রাখা। নুজহাতের জন্যই এনেছে। আজ তাদের সম্পর্কের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে। এই বা কম কি।
“সরি সরি সরি, আসলে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। আজকে ক্লাস থেকে স্যার অনেকটা দেরি করে বের হয়েছে। যার কারণে……”
নুজহাত কে আর কিছু বলতে না দিয়ে পূর্ণ হাসি মুখে বলে উঠলো,
“আরেহ সমস্যা নেই তুমি বসো। খুব একটা দেরি হয় নি।”
নুজহাত হেসে পূর্ন বরাবর বসে পড়লো।
“আজও আসতে আবিদ সাহায্য করেছে নাকি।”
“হ্যা। ও আর তাকিয়া সাহায্য না করলে তো আসতেই পারতাম নাহ্।”
পূর্ণ মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“তাকিয়ার সাথে কথা বলো সমস্যা নেই কিন্তু আবিদের সাথে খুব একটা কথা বলো নাহ। আমার মনে হয় সে তোমায় অন্য নজরে দেখে।”
নুজহাত ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
“একদমই নাহ। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। আমাকে বন্ধুর নজরেই দেখে।”
“একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারে নাহ নুজু। হয় ছেলেটার প্রতি মেয়েটার অনুভুতি তৈরি হবে নয়তো মেয়েটার প্রতি ছেলেটার অনুভূতি তৈরি হবে।”
“আমার ক্ষেত্রে এই কথা বলছো তাহলে নিজের ক্ষেত্রে এই কথা মানছো না কেন। তোমার ওতো একটা মেয়ে বন্ধু আছে। কি যেন নাম, যাই হোক।”
পূর্ণ হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
“তুমি এখনও সেই তিন মাস আগের কথা ধরে বসে আছো। ওইদিন তো তোমাকে ঈর্ষান্বিত করার জন্যে সেই মেয়ের কথা বলেছিলাম। দেখেছিলাম আমার প্রতি অনুভূতি কতোটুকু।”
“যাই হোক বাদ দেও, তোমার হাতের ঘড়ি টা খুলো তো।”
“কেন?”
নুজহাত চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার ঘড়ি টা বিক্রি করে চানাচুর খাবো। খুলো,,,,,”
পূর্ণ হাত থেকে ঘড়িটি খুলে নুজহাতের হাতে দিয়ে বলে উঠলো,
“সোজা ভাবে কোনও কথা বলতে পারো নাহ তাই নাহ।”
“নাহ্ পারি নাহ।”
এই বলে নুজহাত নিজের ব্যাগ থেকে একটা নতুন ঘড়ির বক্স বের করে সেটা নিজের হাতে খুলতে লাগলো। এক পর্যায়ে বক্সটি খুলে তার ভিতর থেকে একটি ব্ল্যাক ঘড়ি বের করে পূর্নের হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,
“আজ আমাদের সম্পর্কের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে। আর আমার তরফ থেকে এটাই তোমাকে দেওয়া প্রথম উপহার। কেমন হয়েছে বলো তো।”
পূর্ণ মলিন হেসে বলে উঠলো,
“কিন্তু আমি তো তোমার জন্যে শুধু একটা ফুলের তোড়া এনেছি।”
নুজহাত হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
“তাতে কি হয়েছে, তুমি তো আমাকে প্রায় কতো কি কিনে দেও। বিশেষ করে কতো গুলো হাতের চুড়ি দিয়েছো। আর এই মুহুর্তে এই ফুলের তোড়া টাই অনেক আমার জন্যে। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো ভুলেই গেছো।”
পূর্ণ নিজেও হেসে গানের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“নিজেকে ভুলতে পারি, তোমাকে ভুলবো নাহ।”
*
*
*
#চলবে