রংধনুর মিল পর্ব -১০

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ১০
#মাহিয়া_মুন

থানায় একজোট হয়ে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এর সামনে বসে আছে নুজহাত এর পরিবার এবং রাফির পরিবার। নুজহাতের বাবা শুরু থেকে শেষ অবধি পুরোটাই বিশ্লেষণ করেছে মিস্টার মাহফুজুর রহমানের সামনে। এখনও তারা তাদের মেয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছে নাহ। 24 ঘণ্টার আগে কোনো নিখোঁজ কেইস নেওয়া হয় নাহ। তবে নুজহাতদের পরিবারের সাথে থানার পুলিশ এবং ইন্সপেক্টর দের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যার কারণে মিস্টার মাহফুজুর রহমান জানিয়েছে যে তারা বসে আগে নিজেদের মাঝে সমস্যাটা মিটমাট করতে পারে কিনা সেটা দেখবে। তার কথায় দুই পক্ষই সম্মতি জানিয়েছে।
শুনশান নীরবতা কাটিয়ে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান মিস্টার হাসানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“তো মিস্টার হাসান। আপনার মতে রাফি আপনার মেয়েকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে এবং এখন সকলের সামনে কিছু না জানার অভিনয় করছে তাইতো।”
মিস্টার হাসান রাফির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“হ্যা স্যার। আমি একদম নিশ্চিত হয়ে বলছি যে এই ছেলেই এখন আমার মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে। এর কথাতেই আমার মেয়ে এর সাথে পালিয়েছে।”
রাফির বাবা আওয়াজ তুলে বলে উঠলেন,
“আমার ছেলেকে আমি গত সাত দিন পর্যন্ত যেখানে বাড়ীর বাহিরে বেরোতে দেই নি, আজ সকালেও সে আমাদের সাথে ছিলো। তাহলে আপনার মেয়েকে কি হাওয়ায় করে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। গিয়ে দেখেন অন্য কারোও সাথে পালিয়েছে কিনা। এক হাতে কখনো তালি বাজে না। আমার ছেলের দোষ দিচ্ছেন নিজের মেয়ে নিশ্চয়ই ফেরেশতা নয়।”
মিস্টার হাসান গর্জে বলে উঠলেন,
“মুখ সামলে কথা বলুন। আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে জোর জবরদস্তি করেছে তার সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়ানোর জন্য। জিজ্ঞেস করেন নিজের ছেলেকে।”
মিস্টার মাহফুজুর রহমান দুই জনকেই থামিয়ে বলে উঠলেন,
“এখানে এখন সম্পূর্ণ রুপে রাফিকেই দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আর কথা বার্তা শুনে এই মুহূর্তের নুজহাতের নিখোঁজের পিছনে সবাই রাফিকেই দোষারোপ করবে।”
“কিন্তু রাফি কোনো দোষ করে নি আংকেল। আমি নিজের ইচ্ছায় বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছি।”
সবাই কিছুটা চমকে দরজার দিকে তাকালো। সেখানেই নুজহাত বিরস মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই এখানে এসেছে। দরজার বাহিরে দাড়িয়ে সব কথাই শুনেছে।
মিসেস রিদিমা দৌঁড়ে মেয়ের শিয়রে গিয়ে দাঁড়ালেন। মেয়ে যত অন্যায় করুক তিনি তো মা। মেয়ের ভুলের জন্য তিনি কিছুদিন মেয়ের সাথে এরকম দুর্ব্যবহার করেছেন। কিন্তু মনে মনে তিনিও খুব কষ্ট পেয়েছেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন,
“কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই, ওই ছেলেটা তোকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে বল। আমাদের থেকেও ওই ছেলেটা তোর এতো আপন হতে গেল। একবারও আমাদের কথা ভাবলি নাহ।”
“মা, প্রতিটা কথায় রাফিকে টানা বন্ধ করো। আমি রাফির সাথে পালিয়ে যাই নি। তোমাদের করা মানষিক অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে আমি পালিয়ে গিয়েছি। আর এটা রাফি জানে নাহ।”
এই বলে নুজহাত নিজের মাকে উপেক্ষা করে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের সামনে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে নজর বুলাতেই রাফিকে নজরে আসলো। নিজের পরিবারের সাথে তাকিয়া কেও দেখতে পেল। সবার মতোই তারাও তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নুজহাত নজর ফিরিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিস্টার মাহফুজুর রহমানের ফোন বেজে উঠলো। মিস্টার রহমান নুজহাতের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় চেয়ে ফোনটি নিয়ে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। মিস্টার রহমান যেতেই নুজহাতের বাবা এবং সেই পুলিশ আংকেল নুজহাতের সামনে এসে দাঁড়ালো।
মিস্টার রহমানকে ভালোভাবে পরখ করে পুলিশ আংকেল নুজহাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“দেখো মামনি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমাদের দুইজনকে একত্রে দুই পরিবারের এক পরিবারও মেনে নিবে নাহ। তাই আমরা যেটা বলছি সেটা করো। তুমি স্যার এর সামনে গিয়ে বলবে যে রাফিই তোমাকে এতক্ষন আটকে রেখেছে। তার কথাতেই তুমি সকালে পালিয়ে গিয়েছ।”
নুজহাত অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো এই পুলিশ আংকেল এর দিকে। এরা যে তাকে কেন এসব বলতে বলছে তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় নি। এদের জন্যে মন গহীনে থাকা অল্প কিছু সম্মানও যেন নিমিষেই পাথর চাপা পড়ে গেল। টাকার জন্যে এরা নির্দোষ লোককেও দোষী বানাতে দুবার ভাবে নাহ।
নুজহাত নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তুমিও কি এটাই চাইছো বাবা।”
“হ্যা অবশ্যই। তুই স্যার এর সামনে এটাই বলবি। নারীদের কথাকেই সব থেকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়।”
নুজহাত এবার হাসতে লাগল। মন খুলে হাসতে লাগল। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখানে হাসির কি বলা হয়েছে যে এভাবে হাসছে।
মিস্টার রহমান ততক্ষনে পুনরায় নিজের আসন পেতে বসলেন। নুজহাত কে হাসতে দেখে কিছুটা অবাক হলেন। অবাকের রেশ নিয়েই নুজহাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে মামনি। তুমি এভাবে হাসছো কেন?”
নুজহাত হাসি থামিয়ে নিজের বাবার দিকে একবার ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিস্টার রহমানের সামনে গিয়ে বসলো। মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“আসলে আংকেল, বাবা আমায় অনেক্ষন পর দেখে হাসানোর জন্য অনেকগুলো জোকস শুনিয়েছেন। খুব ভালোবাসেন তো আমায়।”
“ওহ্ আচ্ছা, এটা তো খুব ভালো। তো মা এবার বলো তো তুমি কোথায় ছিলে। তুমি কি রাফির সাথে পালিয়েছো?”
নুজহাত কিছুক্ষন চুপ থেকে রাফির দিকে তাকালো। রাফিও ভ্রূ কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রাফিকে দেখে কেনো যেন নুজহাতের মনে হচ্ছে নাহ যে তার সাথে যোগাযোগ না থাকায় রাফি ঠিক তার মতোই দুঃখ পেয়েছে।
“হ্যা আংকেল রাফিই আমাকে বলেছে তার সাথে পালাতে। আমি তার সাথেই পালিয়েছি।”
মুহুর্তেই নুজহাত এর বলা কথাটি যেন পুরো কক্ষ জুড়ে বোমা ব্লাস্ট করেছে। সবাই অবাক চোখে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাফি এতটাই অবাক হয়েছে যে মুখ দিয়ে একটি আওয়াজও বের হচ্ছে নাহ। তাকিয়া বড় বড় চোখ করে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার হাতে থাকা ফোনের মাঝে আরও একজন মানুষের চেহারাও ভাসমান। সেও খুব অবাক হয়ে আছে। মূলত তাকিয়া তাকে ভিডিও কল এর মাধ্যমে এখানের বর্তমান অবস্থা দেখাচ্ছে।
নুজহাত সকলের মুখের এরকম অবস্থা দেখে পুনরায় হাসতে লাগলো। যাকে বলে উচ্চস্বরে হাসা। যেনো কতকাল পর মন খুলে হাসছে। মিস্টার রহমান কিছু একটা আন্দাজ করে নিজেও নুজহাতের সাথে সায় দিল। একপর্যায়ে নুজহাত নিজের হাসি থামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কি বাবা খুশি হয়েছ তো। তোমার শিখিয়ে দেওয়া কথাটাই বললাম।”
মিস্টার হাসান চমকে মেয়ের পানে তাকালেন। মেয়ে তাকে সকলের সামনে যে অপমান করতে চাইছে তা বেশ বুঝতে পারছে।
নুজহাত মিস্টার রহমান এর দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি কঠিন করে পুনরায় বলে উঠলো,
“আমি সবটা বলছি আংকেল আপনায়। রাফির এতে কোনো দোষ নেই। গত সাতদিন আমাদের মাঝে কোনরকম যোগাযোগ হয় নি। আর হবে কি করে বাবা তো আমার ফোন নিয়ে গেছে। এই সাতদিন আমি আমার পরিবার থেকে শারীরিক এবং মানষিক ভাবেই নির্যাতিত হয়েছি। তারা আমাকে প্রতিটি কথায় মানষিক আঘাত দিয়েছে। তাদের প্রতিটি কথা আমার অন্তরে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে। দিনে দুই তিন বার হলেও কথায় কথায় তারা আমার গায়ে হাত তুলেছে। আরোও নানারকম অত্যাচার তো আছেই। এসব অত্যাচারের প্রেক্ষিতে আমি আজ সকালে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম রাফিদের বাসায় যাবো। অথবা কোনো ভাবে রাফিকে বাসার বাহিরে ডেকে আনবো। এই উদ্দেশ্যে আমি আজ সকালে বাড়ি থেকে বের হই ঠিকই তবে। তবে মাঝ পথে আমার সিদ্ধান্ত বদলে যায়। আমার মাথায় আসলো যে আমি রাফিকে নিয়ে যেখানেই যাই নাহ কেন, বাবা আমাকে খুঁজে বের করবেই। এতে করে পরে রাফির ক্ষতি করে বসবে বাবা। আর তাছাড়া আমি জানতাম না যে রাফিও আমার সাথে পালিয়ে যেতে রাজি হবে কিনা। তাই ভাবলাম বাসায় চলে যাই। কিন্তু বাসায় করা অত্যাচারের কথা মাথায় আসতেই মন আর সায় দিল নাহ। তাই আমি আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরত্বে একটি খালি পরিত্যাক্ত বাসা আছে। সেখানেই ছিলাম বিকেল পর্যন্ত। বিকেলের দিকে ভাবলাম বাসায় চলে যাই। কিন্তু বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম সবাই এখানে। এই হচ্ছে পুরো কাহিনী আংকেল। এখানে রাফির কোনো দোষ নেই।”
সবাই অবাক চোখে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা যে কত কিছু সহ্য করছে তা যেন এক নিমিষেই সকলে একটু হলেও বুঝতে পেরেছে। কারও মুখেই কোনও কথা নেই। নুজহাতের বাবা মা মাথা নিচু করে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে যে তারা শাসনের নামে মেয়ের প্রতি অনেক বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে। এতটা করা তাদের একদমই উচিত হয় নি। মেয়েরা মোমের মত। সহজেই গলে যাওয়ার পাত্রী। এবং এদের যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের আকারই ধারন করতে হয়।
**”” আমাদের সমাজে মেয়েদের মধ্যে প্রায় মেয়েদের সঙ্গেই এরকমটা হয়ে থাকে। যেখানে নিজের পরিবারও তাদের বুঝতে চায়না। তারা নিজেরা যেটা বুঝে সেটাই মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। যা সইতেও পারা যায় নাহ আবার বইতেও পারা যায় নাহ। একপর্যায়ে রোবট এর ন্যায় সব কিছু মেনে নিতে হয়।”
মিস্টার মাহফুজুর রহমান কিয়ৎক্ষণ সকলকে পর্যবেক্ষণ করে নুজহাত এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“তো মামনি, তুমি কি চাও রাফির সাথেই থাকতে। মানে সম্পর্কটা স্থায়ী রাখতে?”
নুজহাত কিছু বলার পূর্বেই রাফি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
“ও চাক বা না চাক কিন্তু আমি আর ওর সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চাই নাহ।”
*
*
*
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here