রংধনুর রঙ কালো পর্ব ১৮

#রংধনুর_রঙ_কালো
১৮.

সোফিয়ার অক্ষিযুগল উপচে টপাটপ পানি পড়তে লাগলো। ইলহান সোফিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে হুমকি দেওয়ার মতো বললো,” অনেক ভালোবাসি ওকে। ওর গাঁয়ে হাত তোলার কথা চিন্তা করলেও তোমার হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলবো৷ মাইন্ড ইট।”
তারপর সোফিয়াকে ধাক্কা মেরে ছেঁড়ে চলে গেল। সোফিয়া মেঝেতে বসে পড়েছে। মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। অশ্রুর চেয়েও তার চোখেমুখে বিষাক্ত ক্রোধের পরিমাণ অনেক বেশি। ইলহান রুমে গিয়ে দরজা আটকে বারান্দার রকিং চেয়ারে বসলো। আকাশের দিকে চোখ যেতেই চাঁদে অরিনের মুখটা দেখতে পেল। পরক্ষণেই ইলহান দেখতে পেল একটা নিষ্পাপ বাচ্চার মুখ। ইদানীং ইলহান আশেপাশে শুধু বাচ্চা দেখতে পাচ্ছে। বাচ্চার কান্নাও শুনতে পাচ্ছে। ফুটফুটে এক টুকরো নরম সোনালী আলোর মতো দেখতে একটা বাচ্চা মেয়ে আধো আধো স্বরে ইলহানকে ডাকে,” বাপ্পা,বাপ্পা। আমাকে কোলে নাও। আমি তোমার কাছে আসতে চাই বাপ্পা!”
ফুপিয়ে ফুপিয়ে বাচ্চাটা যখন এই কথা বলে, ইলহানের হৃদয়ে আষাঢ় মেঘের আকাশের মতো ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হয়। ওই মিষ্টি কণ্ঠে কত আক্ষেপ, কত তৃষ্ণা, আকাঙ্খা মিশ্রিত। আচ্ছা, বাপ্পাটা মানে কি? বাবা? বাবাকেই হয়তো বাচ্চাটা বাপ্পা উচ্চারণ করে। শুনতেও দারুণ মিষ্টি লাগে। ইলহান যখন সত্যিই বাচ্চাটাকে কোলে নিতে যায় তখন আর ছুঁতে পারে না। সোনালী আলো নিমিষেই অন্ধকারে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। তখন ইলহানের চেহারাও ঘন মেঘের মতো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়।স্বপ্নে ইলহান কয়েকবার বাচ্চাটার মুখ দেখেছে। অবিকল অরিনের মতো চেহারা। বাচ্চাটা ছোট্ট, ফোলা ফোলা আঙুল দিয়ে চোখ মুছে কিন্তু ওর চোখের জল ফুরোয় না। যেনো বুকভর্তি কষ্টের পাহাড়। ইলহানের বড্ড মায়া লাগে। আহারে! এখন বাচ্চাটার কথা চিন্তা করেই তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বুক পাজরে কেমন শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। ইলহানের ধারণা বাবুটা মেয়ে। অবশ্যই মেয়ে হবে। খুব সুন্দরী একটা মেয়ে হবে। মায়াবী, আদুরে মুখ, নরম- তুলতুলে তার ছোঁয়া, কোমল তার কন্ঠ। ফোলা ফোলা ঠোঁট দিয়ে সে ইলহানের কপালে চুমু দিবে। ইলহানের মনে হবে ঠিক ওই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। কল্পনাতেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে বাস্তবে যখন সত্যিই সোনালী আলোটা তার কোলে আসবে তখন কি হবে? ইলহানের এই কথা ভাবতে এতো ভালো লাগে! দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে যায়। সেই অশ্রুতে মিশে থাকে এক সমুদ্র সুখ। ইলহান মেয়েটির নাম ঠিক করেছে মায়াকন্যা। কারণ তার মুখভর্তি ঝলমলে মায়া। ইলহানের কতই না স্বপ্ন ছিল তার আর অরিনের সংসারে ঠিক এইরকম একটা মায়াকন্যা আসবে। সেই স্বপ্নটা অন্যরকম হয়ে গেল। মায়াকন্যা আসছে সোফিয়ার পেটে। কি আশ্চর্য! এমনটা সে কখনও কল্পনা করেনি। যখন সে প্রথম হসপিটালে গিয়ে সোফিয়ার প্রেগন্যান্সি নিউজ জানতে পারলো, তার মনে হচ্ছিল সাজানো দুনিয়াটা তছনছ করে ভেঙে যাচ্ছে। বুকফাটা কষ্টে ইলহানের কাঁদতে মন চেয়েছিল। সোফিয়াকে ছেঁড়ে দিতে পারলেও ইলহান তার সন্তানের মাকে তো আর ছেঁড়ে দিতে পারে না। আর যদি সোফিয়াকে নিয়েই থাকতে হয় তাহলে অরিনকে সে আটকে রাখতে পারবে না। ইলহান ভেবেছিল বাচ্চা আগমনের এই সুসংবাদ সে কাউকে জানতে দিবে না। যখন বাচ্চাটা হয়ে যাবে তখন সে নিজের বাচ্চা রেখে সোফিয়াকে চলে যেতে বলবে। কারণ সোফিয়ার তো এই বাচ্চার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। যদি আগ্রহ থাকতো তাহলে কি এই বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ইমারজেন্সী পিল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতো? সোফিয়ার মতো একটা মেয়ে আসলেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল এটা ইলহানের বিশ্বাস হয় না। সে ঔষধ খেয়েছিল এবোর্শনের জন্য। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এবোর্শন হয়নি। বাচ্চা এখনও সুরক্ষিত আছে। ইলহান বলেছে, এই বাচ্চার কোনো ক্ষতি হলে সে সোফিয়াকে খুন করে ফেলবে। তাই সোফিয়া বাধ্য হয়েই বাচ্চাটার জন্ম দিচ্ছে। নয়তো নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে পুরো নয়মাস সময় শুধু একটা বাচ্চার পেছনে কাজে লাগানোর মতো মা সোফিয়া নয়। সে তো এখনও তার মাতৃত্বের সুখ কি সেটাই জানে না। নিজের বাচ্চা নিয়ে সে একটুও সচেতন না। তার কোনো মাথাব্যথাই নেই! ইচ্ছামতো ড্রিংক করছে, জিম করছে, মেডিসিন নিচ্ছে, যখন যেটা ইচ্ছা সেটাই করছে। এতে বাচ্চার ক্ষতি হোক না হোক, তার কিছুই যায় আসে না। ইলহানেরও বুঝে আসে না একজন মা কিভাবে এমন হতে পারে। সোফিয়া আর নিজের আপন মায়ের মধ্যে ইলহান কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না। সোফিয়া যেমন জন্মের আগেই নিজ সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছে তেমনি ইলহানের মাও তাকে জন্মের পর ডাস্টবিনে ফেলে চলে গেছে। এই ধরণের উদাহরণ থাকার পরেও পৃথিবীতে নাকি মায়ের মতো মমতাময়ী আর কেউ নেই। কথাটা এমন হওয়ার দরকার ছিল, পৃথিবীতে মায়ের মতো পাষাণমূর্তি আর কেউ নেই।

অরিন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। তার চোখের ঘন পল্লব ধকধক করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে চেহারার রেখাও পাল্টে গেছে। অরিন চোখ দু’টো বড় বড় করে শুধু চিন্তা করছে, আজকে যদি অন্বয়সাহেব তাকে না বাঁচাতেন তাহলে কি অবস্থা হতে যাচ্ছিল। আজকে অন্বয় আর অরিন সন্ধ্যার পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে হাঁটতে যখন দু’জন গল্পে মশগুল তখনই ঘটনাটি ঘটলো। কোথ থেকে এক দলা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অরিনের দিকে ধেঁয়ে আসলো।কিছু বুঝে উঠার এক মুহুর্তও সময় ছিল না। চোখের পলক ফেলার আগেই অরিন বিস্ফোরিত হতো। সময়মতো অন্বয় তাকে টান দিয়েছিল বলেই সামনে থাকা বাবলা গাছটিতে দাবানল লেগে গেল। মানুষজন হৈহৈ করে ছুটে আসতে লাগলো। আর অরিন এতো কাছ থেকে আগুন দেখে সেখানেই অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরে দেখলো তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। ড্রাইভার বাবা আর সুন্দরী সেই হোটেল গার্ল তাকে ঘিরে বসে আছে। অন্বয় গিয়েছে আক্রমনকারীকে খুঁজতে। অরিন কথাটা শুনে বিস্মিত হলো।
” আক্রমণকারী মানে?”
বাবা বললো,” জ্বী ম্যাডাম, স্যার বলেছে এইটা কোনো দূর্ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে হত্যাকান্ডের চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেনো কেউ বুঝতেই না পারে এটা মার্ডার কেস। সবাই দূর্ঘটনা ভেবে ভুলে যেতো। কিন্তু স্যারের তো শকুনের চোখ। সে ঠিকই বুঝে গেছে যে এইখানে বড় কোনো কিন্তু আছে। আপনাকে যে আক্রমণ করেছে তাকে কি স্যার ছেঁড়ে দিবে ভেবেছেন? হা-হা! যদি স্যার একবার তাকে পায় তাহলে দেখবেন কি অবস্থা করে। শত হলেও আপনি হলেন স্যারের প্রথম ভালোবাসা। ফার্স্ট লভ। আপনার দিকে কেউ তাকালেও স্যার আগ্নেয়গিরি হয়ে যায়।”
অরিন সরু দৃষ্টিতে কটমট করে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। বাবা জীভ কেটে বললো,” স্যরি ম্যাডাম। রিয়েলি স্যরি। আর কখনও বলবো না। ছোটমানুষ ছোটমানুষের মতো থাকবো।”
” আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান বাবা ভাই।”
বাবা অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে হোটেল গার্লের দিকে তাকালো। বিদেশীনি তাদের কথা কিছু বুঝতে পারছে না। শুধু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
রাত ঠিক দেড়টা বাজে তখন। অন্বয় অরিনের রুমে এসে জানালো গুপ্তঘাতক ধরা পড়েছে। অরিন তখন বিছানায় একা শুয়ে ছিল। এই কথা শুনে প্রায় ধড়মড় করে উঠে বসলো। অরিনকে হত্যার চতুর্থতম চেষ্টা ছিল এটা। বাকি তিনবার বাংলাদেশে এইরকম দূর্ঘটনা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর এটা প্রথমবার হলো। অন্বয় বরাবরই ইলহানকে সন্দেহ করে। তাকে সন্দেহ করেই বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে। কিন্তু অরিনের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে ইলহান তাকে খুন করবে। ইলহানের কাজ মানুষের বিশ্বাস খুন করা। কিন্তু একটা জীবন্ত মানুষকে সে খুন করতে পারে না। অরিন আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” কে ধরা পড়েছে অন্বয়সাহেব?”
” ওইদিন সবুজ রঙের গাড়ির এক ভদ্রলোককে আপনি থ্রেট করেছিলেন না, আমাদের রেগুলার ফলো করতো বলে? সে আজকেও আমাদের ফলো করছিল। তারপরই এই দূর্ঘটনা। তাকে রিমাইন্ডে নেওয়ার পর যে সত্যি বেরিয়ে এলো সেটা শোনার জন্য আপনি এই মুহুর্তে প্রস্তুত না মিসেস অরিন।”
অরিন অধৈর্যের মতো বললো,” প্লিজ অন্বয়সাহেব আমাকে বলুন। আমার জীবনের এতোবড় শত্রু কে আমি জানতে চাই। আমাকে হত্যা করে কার কি লাভ?”
অন্বয় পকেটে হাত গুঁজে সোজা দাঁড়িয়ে আছে। নিচে তাকিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর হৃৎপিন্ডে গরম তেল ছুঁড়ে মারার মতো বললো,” ভদ্রলোক ইলহান মাহদীর পাঠানো গুপ্তচর। সে এইটা নিজমুখে স্বীকার করেছে।”
অরিন কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল। মুখের পেশী টানটান করে তাকালো। অন্বয় লক্ষ্য করলো অরিনের হাত থেকে হাঁটু পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। চোখ দু’টো জ্বলছে। অন্বয় চেয়ার টেনে অরিনের সামনে বসতে বসতে বললো,” আমি তো আগেই বলেছিলাম মিসেস অরিন। যে আপনাকে খুন করতে চায় সে অপরিচিত কেউ নয়। আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার কথা কি এখন বিশ্বাস হয়েছে?”
অরিন প্রশ্ন করলো,” আপনার কাছে রিভলবার হবে অন্বয় সাহেব?”
অন্বয়ের ভ্রুজোড়া বিকৃত হয়ে গেল এই প্রশ্ন শুনে।
” রিভোলবার কেনো?”
অরিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,” গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে খুন করার কি দরকার? আমি ওর হাতে রিভলবার দিয়ে নিজেই বুক পেতে দিবো। মেরে ফেলুক আমাকে। তাও অন্তত মুক্তি দিক হতাশার এই নিকৃষ্টতম জীবন থেকে।”
অরিন তার বক্তব্য শেষ করেই ঝটপট নীল নকশার একটি চাদর গাঁয়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলো। অন্বয় তাকে থামানোর সুযোগটুকুও পেল না। এক দৌড়ে গিয়ে সে অরিনকে পেছন থেকে ডাকলো। কিন্তু অরিন তার কোনো কথা না শুনেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। অন্বয় যে তাকে ফলো করবে সেই উপায়টাও নেই। কারণ গাড়ি একটাই ছিল। যেটা এইমাত্র অরিন নিয়ে চলে গেছে। এখন এইরাতের বেলা সে ট্যাক্সি কোথায় পাবে?
অরিন ইলহানের সেই বাগানবাড়িতে চলে এসেছে। যেখান দুইদিন আগে এংগেজমেন্টের আয়োজন হয়েছিল। অরিন গাড়ি থেকে নেমেই গটগট করে হেঁটে সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়োয়ান তাকে দেখেমাত্রই দরজা খুলে দিল। কিছু বলতেও হলো না। অরিন বাড়ির মেইন ডোরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলো। সে আশা করেছিল এখনি সোফিয়ার মুখটা দেখতে হবে। তাই বার-কয়েক শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো। সোফিয়ার অসহ্য সেই চেহারা দেখলেই অরিনের পক্ষে নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ইচ্ছে করে চুলের মুঠি ধরে তার মাথাটা ননস্টপ দেয়ালে ঠুঁকতে। দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো ইলহান। সে অরিনকে দেখে হতভম্ব। অরিন ইলহানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফটাফট ঘরে ঢুকে গেল। ইলহান বিস্ময় সামলে জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছো অরিন?”
অরিন কোনো উত্তর না দিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে গেল। চামচদানি থেকে ছুঁড়ি নিয়ে আবার ইলহানের কাছে ফিরে এলো। ইলহান হা করে তাকিয়ে আছে। অরিন ক্রোধে উন্মত্ত প্রায় কণ্ঠে বললো,” গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে এতো কসরত করার কি দরকার? সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছি। নাও মেরে ফেলো। এক আঘাতে ঝামেলা শেষ হয়ে যাক।”
ইলহানের নাকে ভাজ সৃষ্টি হলো।
” মানে?”
অরিন সাথে সাথেই ইলহানের বুকের টি শার্ট খামচে ধরে গর্জে উঠা গলায় বললো,” একদম নাটক করবে না। তোমার এই ভালো সাজার নাটক দেখতে দেখতে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি। আর কত নিচে নামবে? আর কত রূপ দেখাবে? তোমার মতো জঘন্য বহুরূপী মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি। আমাকে মেরে শেষ করার এতো ইচ্ছা? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি ইলহান। তাও কেনো এতো ক্ষোভ আমার উপর? আমার জীবনটা তো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কয়লা বানিয়েই দিয়েছো। এখন সেই কয়লাটুকুও নিঃশেষ করে ফেলতে চাও? তাহলে প্লিজ, শেষ করে ফেলো। আমার এখন নিজের বেঁচে থাকাকেও অনেক বড় বোঝা মনে হচ্ছে। আমি সত্যিই আর বাঁচতে চাইছি না। খুন করবে তো? এইযে নাও ছুঁড়ি। আমাকে মেরে ফেলো। মারো!”
অরিন শেষ শব্দটা চিৎকার করে বললো। ওর চোখ রক্তাক্ত, ভয়ানক। ইলহান ছুঁড়িটা হাতে নিতে নিতে বললো,” তোমাকে খুন করার ক্ষমতা যদি থাকতো তাহলে ভেবে দেখতাম। কিন্তু যেই ক্ষমতাই আমার নেই সেই বিষয়ে চিন্তা করাও অযৌক্তিক। তোমার কেনো মনে হলো আমি তোমাকে খুন করতে চাইবো?জীবনের সবচেয়ে দামী সম্পদ কি কেউ স্বেচ্ছায় হারাতে চায়?”
অরিন চোয়াল শক্ত করে হঠাৎই ইলহানের হাতের ছুড়ি ইলহানের গাঁয়েই গেঁথে দিল। রক্ত উপচে পড়তে লাগলো। কিন্তু ইলহান একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। শুধু তার ঠোঁট কাঁপছিল। চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। অরিন বিষাদভারাতুর গলায় বললো,” আমি আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই চমৎকার অভিনয়কারীকে শুধু ঘৃণা করে যাবো।”
ইলহান এতোক্ষণে খুব জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়লো। তার নিঃশ্বাসটা এতোক্ষণ বুকের কোথাও আটকে ছিল। অরিন রক্তাক্ত অবস্থাতেই ইলহানকে ফেলে রেখে বের হয়ে গেল। গাড়িতে উঠলো। ইলহান অরিনকে থামতে বলতেও পারছিল না। তার কোমড়ের একাংশ থেকে প্রচন্ড রক্তপাত হচ্ছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে ক্রমশ। ওই অবস্থাতেই ইলহান অরিনের পেছন পেছন গেল। কিন্তু ততক্ষণে অরিন গাড়ি নিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। ইলহান তাও হার মানলো না। বাড়িতে একটা মানুষ পর্যন্ত নেই। ইলহান বাইরে গিয়ে দাঁড়োয়ানকে বললো গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার ব্যবস্থা করতে। দাঁড়োয়ান ইলহানের অবস্থা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। মহিলা মানুষের মতো কাঁইকুঁই শুরু করলো। ইলহান খুব বিরক্ত হয়ে আদেশ দিল যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি বের করতে।
ইলহানের রক্তপাত বন্ধ হয়নি তখনও। সে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালাতে লাগলো। অরিনকে অনুসরণ কর‍তে করতে সে তাদের এপার্টমেন্টে পৌঁছে গেল। অরিন গাড়ি থেকে নামার পর ইলহানের আর আগাতে ইচ্ছে হলো না। টি শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। স্পঞ্জ করলে নিশ্চিত এক মগ রক্ত বের হবে।ইলহান গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল।অরিন এপার্টমেন্টের করিডোরের কাছে আসতেই অন্বয় আচমকা চড় মেরে বসলো অরিনের গালে। অরিন চরম মাত্রায় অবাক হলো। দুই-একজন আগন্তুক করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিল। তাদের সামনে অরিনের অপমানে মুখ ছোট হয়ে গেল। অন্বয় তীব্র গর্জন করে বললো,
” আপনার সাহস কিভাবে হলো আমাকে ছেঁড়ে একা বের হওয়ার? পা কেটে রেখে দিবো একদম। যদি কোনো বিপদ হয়ে যেতো?”
অরিন অন্বয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। ছলছল দৃষ্টিতে চারপাশ একবার দেখে রুমে চলে গেল।

চলবে

-Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here