রংধনুর রঙ কালো পর্ব ৯

#রংধনুর_রঙ_কালো
৯.

অন্বয়ের সাথে একটা রেস্টুররেন্টের বাহিরের সাইডে বসে আছে অরিন। তাদের টেবিলের উপরে সাদা ছাতা। তাই গায়ে রোদ লাগছে না তেমন। গোল টেবিলের বরাবর চেয়ার দু’টিতে মুখোমুখি বসে দু’জন। ডানপাশেই বিশাল সমুদ্র। ঢেউয়ের আওয়াজ কানে আসছে হালকা-পাতলা। পরিবেশটা সুন্দর। কিন্তু আশেপাশে অর্ধনগ্ন মেয়েদের দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে অরিনের কাছে। সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে। তাই বার-বার শুধু নড়েচড়ে বসছে। অন্বয় তার মনের জমানো কথাগুলো অরিনকে এই নিয়ে তিন-চারবার বলে ফেলেছে। এখন আবারও বলছে। একই কথা সে এতোবার কেনো বলছে অরিন তা বুঝতে পারছে না। হয়তো সে চাইছে অরিন তার কথা শুনে কিছু পজিটিভ রেসপন্স করুক। কিন্তু সত্যি বলতে অরিনের এসব কথা শুনতেই ভালো লাগছে না। বরং সে একটা কথা ভেবে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। শ্যানিনের মতো বিশ্বসুন্দরীকে রেখে অরিনের মতো কৃষ্ণকলিকে অন্বয়ের মনে ধরলো? তাছাড়া অরিনকে দেখে কি অবিবাহিত মনে হয়? হতেই পারে। কানে দুল,নাকে ফুল কিছুই তো নেই তার। বিশ বছর বয়সেও সে নাক ফুঁটো করেনি। এতে তার আফসোসও নেই। নাকফুল জিনিসটা অরিনের অসহ্য লাগে। শায়িখ সাহেব অথবা নুসাইবার চেহারার সাথেও অরিনের চেহারার কোনো মিল নেই। তাহলে অন্বয় কিভাবে অরিনকে শায়িখ সাহেবের কন্যা ভেবে নিল? অবশ্য শ্যানিন আর অরিন একসঙ্গে দাঁড়ালে কেউ বলতে পারবে না যে তাদের মধ্যে কে ননদ আর কে ভাবী। শ্যানিনের মধ্যেই ভাবী ভাবী ভাব আছে। দীর্ঘকায় তার শরীর। আর অরিন একদম রোগা-পাতলা। অরিনকেই অল্পবয়সী মনে হয়। শ্যানিনকে দেখতে লাগে ম্যাচিউর গার্ল। আসলে ব্যাপারটা উল্টো। কিন্তু তাই বলে অন্বয় এতোবড় ভুল করবে? তাছাড়া এক দেখাতেই অন্বয় অরিনকে এতো পছন্দ করে ফেললো কিভাবে? অরিনের অবশ্য অন্বয়ের কথা তেমন বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্বয়ের মতো পাগলামী ইলহানও কি কম করেছিল? কিন্তু শেষমেষ কি হলো? অন্বয় হঠাৎ বললো,
” আপনি কি এখনও রেগে আছেন মিসেস অরিন?”
অরিন মিষ্টি করে হেসে বললো,” জ্বী না। আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই। কিন্তু কালরাতের ওই ঘটনায় আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। আপনি ইলহানের সামনে আমার হাত না ধরলেও পারতেন। আর তাকে ওইভাবে আঘাত করা আপনার উচিৎ হয়নি।”
অরিনের মলিন মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অপরাধী মনে হলো অন্বয়ের। সে দুঃখিত গলায় বললো,
” আই এম স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি আপনি এজন্য এতো কষ্ট পাবেন। কথা দিচ্ছি এইরকম আর কখনও হবে না। আমি আর কখনও আপনার হাসব্যান্ডের গায়ে হাত তুলবো না। কিন্তু একটা বিষয় আপনাকে মানতেই হবে। দোষ কিন্তু আপনার হাসব্যান্ডের। তিনিই প্রথমে আমার গায়ে হাত তুলেছেন। আমি শুধু প্রতিবাদ করেছি।”
” কিন্তু এর আগে আপনি আমার হাত ধরেছেন। এটা আপনার ভুল ছিল। এজন্যই সে আমাদের ভুল বুঝেছে।”
অন্বয় তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বললো,” আপনি কি বুঝাতে চাইছেন আপনার হাসব্যান্ড জেলাস? তিনি আপনাকে ভালোবাসেন? এটা ভালোবাসা না অরিন। এটা হিপোক্রিসি। নিজে একশোটা মেয়ের হাত ধরে ঘুরবে আর আপনি সাহায্যের জন্য কারো হাত ধরলেই দোষ? ”
অরিন মাথা নিচু করে বসে রইল। অন্বয়কে সে লজ্জায় বলতে পারছে না যে কালকের ওই ঘটনার জন্য বাসায় কতবড় ঝামেলা হয়ে গেছে। পরিবারের সবার কাছে অরিন এখন চোখের কাঁটা। এই ভয়টাই তো পেয়েছিল সে। নয়তো ইলহান তাকে ভালোবাসে এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে থাকার মতো বোকা সে নয়। হঠাৎ করেই অরিনের নজর গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাশ রঙের গাড়িটির দিকে। ইলহান গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে সাদা-নীলের মিশেলে একটা টিশার্ট, কালো প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সে অরিনদের দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিনের সাথে চোখাচোখি হতেই ইলহান পকেটে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকালো। অরিন তাকে এতোক্ষণ লক্ষ্য করেনি। এখন দেখতে পেয়েই একটু জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। অরিন চট করেই টেবিলে থাকা অন্বয়ের ডানহাতের উপর নিজের হাতটা রাখলো। অন্বয় চমকে উঠলো। বিস্ময়ে অভিভূত হলো। মিসেস অরিন তার হাত ধরেছে? একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় অন্বয়ের মন ভরে গেল। অরিন সামান্য হেসে মিষ্টি গলায় বললো,
” স্যরি অন্বয়সাহেব, কালরাতে আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা আমার একদম উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম। ইলহানকে না। আমি আমার পরিবারকে ভয় পেয়েছিলাম। ইলহান যদি আমাদের ব্যাপারটা বাবা-মায়ের কাছে ভুলভাবে প্রেজেন্ট করে সেই ভয়।”
অন্বয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো,” আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম মিসেস অরিন। ইটস ওকে। বিশ্বাস করুন কিচ্ছু মনে করিনি আমি।”
অরিন আরও ভালো করে অন্বয়ের হাতটা চেপে ধরে বললো,” থ্যাংকস।”
সে এমনভাবে হাত ধরেছে যাতে ইলহান তাদের হাতবন্ধন স্পষ্ট দেখতে পায়। অরিন আড়চোখে তাকিয়ে ইলহানের মুখের অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করলো। ইলহান চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেছে। সে হনহন করে হেঁটে এদিকেই আসছে। এতে অরিনের প্রাণপাখি ভয়ে ছোট হয়ে গেলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অবিরাম চেষ্টা করলো। ইলহানকে দেখেও না দেখার ভাণ করে অন্বয়ের সাথে খোশগল্পে ব্যস্ত রইল অরিন। কিন্তু এর পরিণতি হলো ভয়াবহ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইলহান এসে অন্বয়ের কালো শার্টের কলার ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে সড়কের মাঝখানে নিয়ে এলো। তারপর বুকে লাথি মেরে রাস্তায় ফেললো। একের পর এক কিল-ঘুষি বিরামহীন দিতে লাগলো। ইলহানের উন্মাদের মতো আচরণে প্রত্যেকে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। রাস্তার মাঝে জট সৃষ্টি হলো। চলন্ত গাড়িগুলো গতি থামিয়ে ভীড় জমালো। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে। ডানে-বামে দৌড় লাগাচ্ছে একেকজন। কিছু ছেলে ইলহানকে থামানোর চেষ্টায় কাছে এগিয়ে এলো। কিন্তু কেউ তেমন সুবিধা করতে পারলো না। ইলহানকে থামানো যেনো অসম্ভব কাজ। অরিন অন্বয়ের যে হাতটি ধরেছিল ইলহান সেই হাত মুঁচড়ে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করলো। এতে অন্বয়ের আর্তচিৎকারে পুরো শহর কেঁপে উঠলো। সমুদ্রের ঢেউ থেমে গেল। অরিন বেসামাল হয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে লাগলো। অদ্ভুত বিষয় হলো, অন্বয় একদমই ইলহানের গাঁয়ে হাত তুলছে না। অথচ চাইলেই সে নিজেকে রক্ষা করতে পারতো। তাও একবারও সে ইলহানকে আঘাত করলো না কেনো? অরিনের এরপর কিছু মনে নেই। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা স্বল্প পরিচিত রুমে আবিষ্কার করলো অরিন। যেই রুমের এক কোণে হাত থেকে গলা অবধি ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে আছে অন্বয়। শুধু হাতে না, কপালে, গালে, মাথায় আরও বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ। ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে রেখেছে সে। তার ছোট চোখগুলো আরও ছোট দেখাচ্ছে। গালের একপাশ ফুলে আছে। এই অবস্থাতেই সে হালকা গলায় অরিনকে প্রশ্ন করলো,
” মিসেস অরিন, আপনি উঠেছেন?”
এইটুকু শব্দ উচ্চারণ করতেই যেনো তার ভীষণ কষ্ট হলো। অরিনের খুব খারাপ লাগছে অন্বয়ের অবস্থা দেখে। কিন্তু এর পরমুহুর্তেই তার ইলহানের কথা মনে হলো। একলাফে বিছানা থেকে উঠে অরিন অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” ইলহান কোথায়?”
অন্বয় মনে মনে একটু আহত হলো। তার কি অবস্থা জিজ্ঞেস না করে মিসেস অরিন প্রথমেই স্বামীর খোঁজ করছেন? একটা ম্লান হাসি দিয়ে অন্বয় বললো,
” উনি ভালো আছেন। কিন্তু আপনি মনে হয় ভালো নেই। মারামারি দেখে ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছিলেন। সেন্স ফেরার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমিও আর ডাকিনি। প্রায় নয়ঘণ্টা ধরে আপনি এখানে শুয়ে আছেন।”
” আমি নয়ঘণ্টা ধরে এইখানে শুয়ে আছি? ইলহান কিছু বলেনি? ঝামেলা করতে আসেনি?”
” সে আসবে কিভাবে? সে তো হাজতে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে তাকে।”
অরিনের মাথায় যেনো বিস্ফোরণ হলো।
” কি? ইলহান হাজতে?”
” আমার এই অবস্থা করার পরেও মানুষ তাকে ছেড়ে দিবে ভেবেছেন? অস্ট্রেলিয়ার আইন অনেক স্ট্রিক্ট। বাংলাদেশের মতো না। বিশমিনিটের মধ্যেই পুলিশ চলে এসেছিল। নয়তো আজকে আমি মার্ডার হয়ে যেতাম।”
অন্বয় এমনভাবে হেসে কথা বলছে যেনো এটা কোনো মজার ঘটনা। অরিন অস্থির ভাব নিয়ে বললো,
” নয়ঘণ্টা ধরে ইলহান হাজতে? আমি থানায় যাবো।প্লিজ অন্বয়সাহেব আমাকে থানায় নিয়ে চলুন।”
” এতোরাতে যাওয়ার কি দরকার মিসেস অরিন? এখন গেলেও আমাদের ঢুকতে দিবে না। আমরা না হয় সকালে যাবো?”
অরিন উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো,” আমি এখনি যেতে চাই।”
অন্বয় বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বললো,” ঠিকাছে৷ অপেক্ষা করুন আমি তৈরী হয়ে আসছি।”
রাত দশটা বাজেই অন্বয় অরিনকে নিয়ে থানায় রওনা হলো। হাজতে বন্দি ইলহানকে দূর থেকে দেখলো অরিন। দুই হাঁটু ভাজ করে গম্ভীর ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছে। অরিন এক দৌড়ে বাহিরে চলে এলো। অন্বয় অরিনের পেছন পেছন বের হলো। অরিন মুখে হাত ঠেকিয়ে কাঁদছিল। সে কখনও কল্পনা করেনি এমন পরিস্থিতি দেখতে হবে। সব দোষ তার। কি দরকার ছিল অন্বয়ের সাথে দেখা করতে আসার? তার হাত ধরার? শুধু শুধু অন্বয় মার খেলো আর ইলহানকে হাজতে যেতে হলো। অন্বয় পেছন থেকে শব্দ করলো,
” মিসেস অরিন, আপনি কি কাঁদছেন?”
অরিন চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করলো,” এইখানে সে কতদিন থাকবে?”
” কমপক্ষে তিনমাস তো থাকতেই হবে।”
অরিন হু হু করে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ অন্বয়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,” প্লিজ অন্বয়সাহেব, আপনি তাকে হাজত থেকে বের করুন।”
অন্বয় অত্যাশ্চর্য হয়ে বললো,” আরে, আরে, এটা কি করছেন? আপনি আমার পায়ে কেনো ধরছেন?”
” আপনার পায়ে পড়ি ওকে হাজত থেকে বের করে দিন। আপনি তো একজন ব্যারিস্টার। আপনি চাইলে সব করতে পারবেন আমি জানি।”
” কিন্তু তাই বলে একজন অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি পাবে না?”
” আমি কিচ্ছু জানি না৷ আপনি আমার হাসব্যান্ডকে হাজত থেকে বের করে দিন মি. অন্বয়।”
অন্বয় ক্ষণকাল চুপ থেকে বললো,” আপনি আমার পায়ে ধরে এইভাবে কেঁদে কিছু চাইবেন আর আমি সেটা দিবো না তাই কি হয়? আপনার হাসব্যান্ড কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। আপনি শান্ত হোন।”
অরিন চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতার হাসি। মৃদু গলায় সে উচ্চারণ করলো,” থ্যাংকস। ”
অন্বয় টলমলে চোখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। পুলিশ স্টেশনের সদর দরজার কাছে গিয়ে একটু থেমে পেছন ফিরে পুনরায় অরিনের দিকে তাকালো অন্বয়। আগের সেই কৃত্রিম হাসি বজায় রেখেই বললো,” আজকে আপনি প্রমাণ করে দিলেন মিসেস অরিন, আপনি একজন খাঁটি বাঙালী নারী। যাদের মূলশক্তি, স্বামীভক্তি।”
অন্বয় কথাটা কটাক্ষ করেই বলেছে সেটা বুঝতে পেরেও অরিন চুপ করে রইল। একটু পর ইলহান সত্যি সত্যি হাজত থেকে বেরিয়ে এলো। অরিন আর অন্বয়কে একসাথে দেখে সে গরমচোখে তাকালো। তারপর গাড়িতে উঠে গেলো। অন্বয় বললো,
” আপনার হাসব্যান্ড তো আপনাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছেন মিসেস অরিন। আপনি যাবেন না তার সাথে?”
অরিন কঠিন গলায় বললো,” সে চলে যাক। আমি যাবো না।”

চলবে

-Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here