রঙ বেরঙের খেলা পর্ব -১০

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১০

হাত পায়ে কম্পন শুরু হয়ে গেছে সাবিহার। মাথায় ভেঙে পরলো যেন সমস্ত আসমানটা। পায়ের নিচে এক টুকরো মাটি বিহীন চারদিকে যেন গভীর খাদ। যেদিকেই চোখ পরে শুধু অসহায়ত্ব সুদূর হতে ছুটে এসে তাকে জাপ্টে ধরে। রিপোর্ট নেওয়া হলো না। হনহন করে এলোমেলো পায়ে সাবিহা বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। বেশ কিছু দূর। চার তলা হতে দু তলা আসতেই পায়ে অদৃশ্য বেড়ি পরলো। চোখ ঝাপসা হচ্ছে বারংবার। হাঁটা যাচ্ছে না। কেমন কষ্ট! অসহ্য, উপায়হীন লাগছে নিজেকে। মেরে ফেতলে ইচ্ছে করছে সভ্য নামক মানুষটাকে। সাবিহা দিশেহারা হয়ে পরলো। হুট করে থমকে গিয়ে সে হসপিটালের বারান্দায় একটা পিলারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখলো। তারপর আচমকা হাতের ব্যাগ থেকে বের করলো মুঠোফোন। ফোন করলো কাউকে। এলোমেলো, পাগল পাগল লাগছে সাবিহার।

— হ্যালো কুসুম, আমার না কেমন যেন দুঃখ দুঃখ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে দোস্ত। একটা উপায় বল তাড়াতাড়ি। কি করলে আমার বুকের উপর থেকে এত্ত বড় কষ্টের একটা পাহার সরে যাবে? তুই না অনেক বই পড়িস। একটা উপায় বল। আমার সহ্য হচ্ছে না। এই কষ্টের পাহার সরানো দরকার। নয়তো আমি মরেই যাবো। কিন্তু আমার মরলে চলবেনা। অনেক হিসাব বাকি।

উদভ্রান্তের মতো ব্যাকুলতা নিয়ে বলে ওঠা কথা সাবিহার। ফোনের ওপাশের মেয়েটা বুঝি বড়সড় একটা ঝটকা খেলো। সামলে উঠতে সময়ের দরকার। সাবিহা এমন করে কথা বলছে? কেমন খাপছাড়া, বেসামাল দশা।

— আমি এক জায়গায় পড়েছিলাম নির্জন, নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে চিৎকার করে, মন প্রাণ উজাড় করে কান্না করলে নাকি দুঃখ কমে। কষ্ট নীলিন হয়।

অবাকতা নিয়ে বলে উঠলো ফোনের ওপাশে থাকা মেয়েটা। সাবিহা গভীর মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো কুসুমের কথাগুলো। তারপরই তড়াক করে কেটে দিলো ফোন। একটা ছুট লাগালো ভাঙা, অপদস্ত হওয়া মন নিয়ে। পারলে যেন উড়ে যায় সাবিহা। তার মন বলল কুসুম ঠিক বলেছে। বহু কষ্ট জমে পাহাড় ছাড়িয়ে গেছে। কান্নাও জমে জমে পুঁজিভূত। এদের মন থেকে বের না করলে সাবিহা দম আটকে মারা যাবে। ঠিক আকস্মিক! হুট করে মরবে। একটা চিৎকার দেওয়ার সাধ্যও তার হবে না।

ভাবনা চিন্তা পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্থির করে দাড় করালো সিলেটকে। হ্যা, সিলেটের নিঃশব্দ, জীবন্ত প্রকৃতির মাঝে কান্না করে দুঃখ ঝড়ানো যাবে। সাবিহা উন্মাদ হয়ে বাসে উঠে পরলো। তার সিলেট যেতে হবে। অনেক কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশি। বিবশ হয়ে অবুঝের মতো বাসে উঠার পর সাবিহার কষ্ট গুলো তড়তড় করে বেড়ে গেলো। গত রাতেই কারো সাথে বাসে এলো। পাশে, গা ঘেঁসে বসে। বারংবার মনে সভ্যর প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে। ঘৃণা হচ্ছে অতিরিক্ত। তার চেচিয়ে সভ্যর মুখোমুখি দাড়িয়ে এই মুহূর্তে বলতে ইচ্ছে হলো

” আপনি একটা কাপুরুষ। না হলে আপনি ওমন করতে পারতেন না আমার সাথে। ”

এইটুকুতেই সাবিহার ভাবনা বিচারণ করলো। একবারও আর একটু এগিয়ে গিয়ে তার ভাবা হলো না সে কি করেছে সভ্যর সাথে? নিজের দোষ সম্পূর্ণ ধোয়ায় আড়াল হলো।

.
প্রায় তিন ঘন্টা বা তারও বেশি সময় পর সাবিহা পৌঁছালো সিলেট। বড্ড বেশি হাশফাশ করছে সে। চেনা আছে সিলেটের প্রায় পুরোটা জায়গা। চলে এসেছে পাহাড় আর চা বাগানের মাঝে। কিন্তু কান্না আসছে না। আশ্চর্য! সাবিহার অসহায়ত্ব আরো বেড়ে বেগবান হলো। গলায় বুকে পিঠে যেন তারা শক্ত করে অস্তিত্ব গড়ে নিয়েছে। সাবিহা পাগলের মতো আবারও ফোন করলো কুসুমের কাছে। একবারের বেলাতেই ফোন তু লল মেয়েটা। সাবিহা উগ্রতা নিয়ে শুধালো

— তুই আমাকে মিথ্যে বলেছিস? আমি সিলেটের চা বাগানে এসেছি। তবুও কান্না আসতেছে না।

কুসুম মেয়েটা এবার সত্যিই অসীম আশ্চর্যের ভুবনে প্রবেশ করলো যেন। সাবিহা যে সত্যিই মাত্র কয়েক ফোটা চোখের পানি ক্ষরণ করার জন্য রাজশাহী থেকে সিলেট যাবে ক্ষণিকের মাঝেই তা ভাবনাতীত। কুসুম রয়ে সয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো সাবিহাকে

— তুই কি মেন্টালি ডিপ্রেসড? এমন পাগলের মতো করার কারণ কি সাবিহা?

এই একটা প্রশ্নেই যেন ছিল সমুদয় আকুলতা। কান্না আটকে, খিল দিয়ে রাখা দরজার চাবি। খট করে খুলে গেলো সাবিহার বুকের দ্বার। মুহুর্তেই আচমকা হু হু করে বেড়িয়ে এলো কান্না। সাবিহা ভিজে জল গড়িয়ে পরা চোখ নিয়ে ভাঙা গলায় বলল

— হয়তো! আমি পাগল হয়ে গেছি।

কথাটা বলেই সাবিহা কেটে দিলো ফোন। ধপ করে বসে পরলো ভূমির বুকে জড়িয়ে থাকা সবুজের মাঝে। দু’হাটু ভাজ করে মুখ ডুবে দিলো তাতে। ফুপিয়ে অসাড় হয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে দিলো অশ্রু। তার এখন কি হবে? পড়ালেখা হবে? সভ্যকে ছাড়িয়ে সেও মিডিয়া জগতে নাম লিখতে চেয়েছিল স্বর্ণাক্ষরে। সভ্য দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। পড়ালেখা তো সভ্য শেষ করেছে জাবি থেকে। শিক্ষাতেও উঁচুই রয়ে গেলো। সাবিহাকে শুধু করে দিলো দশ দিক থেকে নিচু। সাবিহা হাঁটু থেকে মুখ তুলে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। বলে উঠলো গলা ছেড়ে সমস্ত রাগ ঝেড়ে

— আপনি আমার দু চোখের বিষ সভ্য ভাই। আমার দুইটা চোখের বিষ।

মুখের বাণী ব্যাক্ত হতেই তারা ছুটে গেলো পাহাড়ের পানে। প্রতিধ্বনি তুলে পাহাড় ছুড়ে দিলো দ্বিতীয় বার তা গগনে, পবনে। সাবিহা কান্না করছে। কাকে এই সর্বনাশের কথা জানাবে? নাকি না জানিয়ে হুট করে অপারেশন করে নেবে সবার আড়ালে? নব এই ভয়ংকর ভাবনা মনে জমতেই সাবিহা ঝট করে মাথা তুলল। অস্তিত্ব হয়ে ওঠার আগেই কি সভ্যর চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেবে সাবিহা?

কল্প জগৎ আর বাড়তে দিলো না সাবিহা। নিপুনতার সঙ্গে এক ধারালো কাজ করে বসলো সে। আচমকা পাশে একটু আগে অনাদরে ফেলে দেওয়া ফোন কুড়িয়ে নিলো। ঝটপট ফোন লাগালো রাহেলা ইসলামকে। বাচ্চা নিয়ে তাদের অভিমত কি হতে পারে? এক বার অতিক্রম হলো, দুবার পেরিয়ে গেলো তিনবারই বেলায় ফোন ওঠানো হলো। সাবিহা বেপরোয়াভাবে হুড়মুড় করে বলে উঠলো

— আম্মা, আমি সভ্য ভাই

এর অধিক কথা মস্তিষ্ক সাজাতে পারছে না। আচ্ছা, মা’কে কিভাবে বলা যায় এই খবর? লজ্জা দ্বিধা আর সঙ্কোচের হেতু যে এখবর। সাবিহা কিয়ৎক্ষণ ভাবলো। এর নিমিত্তে তার ভাবনায় বিশেষ কোনো মুনাফা যোগ হলো না। ওপাশে সাবিহার মা সাড়া চেয়ে যাচ্ছেন মেয়ের থেকে। অবশেষে সাবিহা বলে উঠলো

— আম্মা, আমি যদি কনসিভ করি মানে বড় মার নাতি নাতনি যদি আমার পেটে আসে তাহলে পরিস্থিতি কেমন হবে?

সাবিহার প্রশ্ন ছোড়ার সাথে সাথে ওপাশ হতে জবাব এলো না। বেশ সময় লাগলো। রাহেলা ইসলাম উত্তেজিত না হয়ে হিমালয়ের মতো অটুট আর হিম লাগা কন্ঠে বললেন

— তোর বাবা হলো জেলা প্রশাসক। তুই আর সভ্য সিনেমা শুরু করছিস। সংসার টিকবে কিনা এটাই বড় কথা। এর মাঝে আবার বাচ্চা! সভ্য যদি স্বীকৃতি না দেয় এই বাচ্চার? সে তো তোর উপর জেদ করে টিভিতে উঠে যাচ্ছে। তুই বাচ্চা নিয়ে কোথায় দাঁড়াবি? তোর বাবার সম্মান কি হবে?

এরপর এক মিনিট নীরবতা। যেন হাপিয়ে গেছেন সাবিহার মা। সাবিহার হঠাৎ মনে হলো মা বুঝি সব অবলোকন করে নিয়েছেন। বুঝে গেছে বোধ হয়।

— আমি তোর মা হয়েও কোনো সিদ্ধান্ত দিতো পারবো না। তুই জগত পরিবেশ বুঝিস। অনার্স পাশ করবি এক বছর পর। একবার ঠান্ডা মাথায় নিজেকে মায়ের আসনে বসিয়ে ভাবিস আর একবার পরিস্থিতির আসনে। তারপর মন যা চায় করিস।

কথাগুলো বলেই ওপাশ হতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো। মা নিজেই ফোন কাটলো নাকি আচমকা নেট প্রবলেম হলো তা আর ঠাহর করা হলো না সাবিহার। দ্বিতীয় বারের মতো ফোনটা পায়ের নিকট বিছিয়ে থাকা থোকা থোকা ঘাসের উপর অযত্নে রাখলো সাবিহা। মা যে তাকে এক পৃথিবী সম চিন্তা মাথার উপর দিয়ে দিলো। ভাবনারা এসে ভির জমিয়েছে মনও মস্তিষ্কে। ইতিমধ্যে চা বাগানে কাজ করতে এসেছে কিছু মেয়েরা। সোরগোল কানে আসছে মৃদু মৃদু। সাবিহা উদাসী ভাবের দখলদার হয়ে ফিরে চাইলো পেছন দিকে। দু একজন মা মত মেয়ে আছে। পিঠে ঝুড়ি বুকে বাচ্চা। কিনা যত্নে আগলে রেখে চা পা সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এতো মূল্যবান একটা সন্তান? মা এতো কেন আদর করে তার বাচ্চাকে? কি হতো ঘরের মাঝে বাচ্চ রেখে কাজ করতে আসলে? একটু কান্নাকাটিই তো করবে। কিন্তু তা না করে বাচ্চার চাহিদায় অবহেলা না করে বুকে রেখেছে। যেন সাত রাজার ধন! ঐ ছোট শরীরেই মায়ের বড় দেহের শক্তি লুকায়িত। সাবিহার চোখ ভিজে এলো। বুকভরা কষ্ট, দুঃখ, রাগ নিয়ে সে চাইলো নিজের পেটের দিকে। মিনিট গড়িয়ে গেলো পাঁচ। ওভাবেই তাকিয়ে রইলো। একটা সময় হুট করে বলে উঠলো

— আমি সত্যিই হেরে যাচ্ছি। সভ্যই জিতে যাচ্ছে।

চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here