রাজমহল পর্ব -০৭

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

সন্ধির কেবিনে ঢুকে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম।
কারণ কেবিনটা একদম অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তবে বাহিরটা ঠিকেই আলোকিত ছিল।কেবিনের দরজার সামনে যেতেই মনে হলো আকাশটায় কোনো কালো বলয় এসে সূর্যটাকে গ্রাস করছে।নিমিষেই কেবিনের মতো চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে লাগল। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই যে যার মতো যে কাজে ছিল সে কাজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে পুরো হাসপাতালটা স্থির হয়ে গেছে আমরা চারজন ব্যতীত। আমার নিঃশ্বাসটা ক্রমে ভারী হতে লাগল। নাক দিয়ে যেন গরম নিঃশ্বাস বের হতে লাগল।হাসিব আমার অবস্থা দেখে আমার দুই বাহুতে জোরে ধরে রাখল। আবিদা ডাক্তার রাহনুমাকে বলল

– ম্যাম হঠাৎ করে হাসপাতালের এ অবস্থা কেন হলো। চারপাশ আন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। ক্রমশেই অন্ধকারটা বাড়তে লাগল। এখন কী করব ম্যাম।

ডাক্তার রাহনুমাও ভয় পাচ্ছিল সেটা তার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দে বুঝা যাচ্ছিল।ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে উনি আবিদাকে বললেন

– জানি না কী হচ্ছে এসব। তবে মনে হচ্ছে কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটবে। আমার জীবনে এই প্রথম এরকম ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের উচিত তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না করে দাঁড়িয়ে থাকা। আপাতত সবাই চুপচাপ থাকো। আর দেখতে থাকো কী হয়। কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তখন নিজেদের রক্ষা করাটাও দুর্লভ হয়ে যাবে। তাই চুপ করে সবটা দেখে যাওয়ায় শ্রেয়।

ডাক্তার রাহনুমার কথা অনুযায়ী আমরা কেউ কোনো কথা বাড়ালাম না। উনার কথা মতো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখার জন্য।তখন আমি পেছন ফিরে হাসপাতালের করিডোরের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশপানে তাকালাম।আমি লক্ষ্য করলাম কালো বলয়টা তখন সূর্যকে অর্ধেক গ্রাস করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। আস্তে আস্তে বাকি অংশও গ্রাস করতে লাগল। অদ্ভূত এক পরিস্থিতির দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি। যার শেষ কোথায় কেউ জানি না। শুধু জানি কিছু একটা হতে চলেছে।
কালো বলয়টা সূর্যকে যতই গ্রাস করছিল ততই চারদিকে ক্রমশ অন্ধকার বাড়তে লাগল। অন্ধকারে চারপাশটা বিদঘুটে হয়ে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে বলয়টা পুরো সূর্যকে গ্রাস করে ফেলল সেই সাথে নিকষ কালো অন্ধকার চারপাশে নেমে এলো। শুধু মাত্র সবার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল তবে কে কোথায় আছে কিছুই দেখছিলাম না। আমবস্যা রাতে কখনো বের হয়নি যদিও তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে এখনের অন্ধকার আমাবস্যার রাতের অন্ধকারকেও হার মানাবে।

সবাই চুপচাপ। হাসপালালটা যেন একটা কালো রাজ্যে পরিণত হয়ে গেল। এর মধ্যে সন্ধির কেবিনে একটা আলোক বিন্দু সৃষ্টি হলো। নিকষ অন্ধকারে আলোক বিন্দুটা চকচক করতেছিল। চারিদকে আলোকবিন্দুটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘুরপাক খেতে খেতে বিন্দুটা সন্ধির মুখে পড়ল। সন্ধির মুখে পড়ার সাথে সাথে আমরা চমকে গেলাম। কারণ সেটা সন্ধির মুখ ছিল না। অন্য কোনো নারীর মুখ অবয়ব ছিল। দাঁতে দাঁত কামড়ি দিয়ে সবাই দেখতে লাগলাম পুরো বিষয়টা কী হতে যাচ্ছে।

এদিকে আমার দম যেন আটকে যেতে লাগল।শরীরটা বেশ নিস্তেজ নিস্তেজ লাগছিল। ডাক্তার রাহনুমা ফিসফিস গলায় বলল

– সন্ধির বিষয়টাতে প্যারানরমাল কোনো রহস্য আছে মনে হচ্ছে। তবে রহস্যভেদ করা এত সহজ কাজ হবে না। আপাতত সবাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। মনোবল আর শক্তিটাই আসল। মনোবল নষ্ট হয় এমন কোনো কিছু করবেন না কেউ।অবশ্যই আলোর পথ দেখব তবে সেটা সময়সাপেক্ষ।

ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে মনে মনে একটু ভরসা পাচ্ছিলাম। অপরদিকে আলোকবিন্দুটা সন্ধির মুখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে নামতে পেটের কাছে আসলো। পেটের কাছে আসতেই সন্ধির পেটের কাপড়ে আবিদার বর্ণণাকৃত রক্তের দাগগুলে চকচক করতে লাগল।

এরপর আলোক বিন্দুটা সন্ধির পেটের উপর ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘুরপাক খেতে খেতে সন্ধির নাভি বরাবর আসলো। আর সন্ধির নাভির দিকটা ফেটে যেতে লাগল। এসব দেখে আমার মাথাটা আরও ঝিমঝিম করতে লাগল। আবিদা ঠিক যেমন বর্ণণা দিয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই সন্ধির পেট ভেদ করে একটা নবজাতক শিশু বের হলো। বিভৎস পুড়া এক নবজাতক শিশু। পঁচা গন্ধে যেন পুরু কেবিন মুহু মুহু করতে লাগল। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছিল। তবুও নাকটা চেপে দেখতে লাগলাম সবটা। নবজাতক শিশুটা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল

– আমি আসতে চাই। আমার প্রতিশোধের জন্য আমাকে আসতে হবেই।

বলেই আবার পেটে ঢুকে গেল। চারপাশ আবার আলোকিত হতে শুরু করল। কালো বলয়টা সূর্যের উপর থেকে সরে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে সবটা পরিষ্কার হয়ে আলোকিত হলো। আশে পাশের মানুষগুলো স্থির থেকে গতিশীল হতে লাগল। আমাদের সাথে যা ঘটেছে সেটা তাদের অন্তরালে রয়ে গেল। সবটা আলোকিত হওয়ার পর আমরা সন্ধির কাছে গেলাম। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি তার নিজের চেহারাতেই আছে একটু আগে অন্য যে চেহারাটা বা অবয়বটা দেখেছিলাম সেটা এখন নেই। খেয়াল করলাম সন্ধির পেটের দিকের কাপড়ে রক্তের লাল দাগ লেগে আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ডাক্তার রাহনুমা কাপড়টা তুলল। কাপড়টা তুলার পর লক্ষ্য করলাম সন্ধির পেটে কোনো ক্ষত নেই। সবাই যেন চমকে উঠলাম। বিষয়টাতে আমার মনটা আরও বিষন্ন হয়ে গেল।

তবে সেই সাথে আরেকটি বিষয় পরিলক্ষিত হলো। খেয়াল করলাম সন্ধির পেট ফুলে গেছে।সন্ধির পেট দেখে এবার মনে হচ্ছে সে গর্ভবতী। এখন সন্ধিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে সায়রা আপুকে কি জবাব দিব এটা ভেবে মনটা আরও বেশি হতাশ হতে লাগল।ডাক্তার রাহনুমা সন্ধির মাথায় ধরার সাথে সাথে সন্ধির চোখ গুলো কাঁপতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম সন্ধির জ্ঞান ফিরবে। সন্ধি চোখটা খুলে ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখটা বন্ধ করে দিল। ডাক্তার রাহনুমা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– ওর জ্ঞান ফিরতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে৷ সে পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান ফিরলে রোগীকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আপনাদের রোগীর চিকিৎসা আমি করতে পারব না।কারণ এ রোগীর সাথে প্যারানরমাল বিষয় জড়িয়ে আছে। যার চিকিৎসা আমার জানা নেই। এমন কেউ পরিচিত নেই যে এসব নিয়ে কাজ করে। থাকলে হয়তো সাহায্য করতে পারতাম। তবে আমিও যেহেতু এ বিষয়টাতে জড়িয়ে গেছি সেহেতু আমার জীবনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। আপাতত আমি কিছুই করতে পারছি না। আপনার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যাবেন কখনো কোনো উপায় পেলে সাহায্য করব। আর আমার সাথে তেমন কিছু হলেও জানাব। আপনারা এমন কাউকে খুঁজুন যে এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে বা জানে। এতেই আপনাদের ভালো হবে। আমার কাছে এমন কোনো চিকিৎসা নেই যে ওকে করব।

কথাগুলো বলে ডাক্তার রাহনুমা আবিদার দিকে তাকিয়ে বলল

– তুমি ওকে কাপড়টা পাল্টে দাও। আর হাসপতালের অন্য স্টাফ যেন বিষয়টা জানতে না পারে। তাহলে আমার চাকুরি এবং তোমার চাকুরির উপর প্রভাব পড়তে পারে৷ সেই সাথে হাসপাতালের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। তাই বিষয়টা গোপন রাখবে।

আবিদা দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল

– আমি একা ওর কাপড় পাল্টাতে পারব না ম্যাম।আমার বেশ ভয় করছে।

আবিদার কথা শোনে ডাক্তার রাহনুমা ধমক দিয়ে বলল

– দরজা লাগাতে হবে না শুধু পর্দা টেনে হাসপাতালের কাপড় পাল্টে ওর পরনে যা ছিল সেগুলো পড়িয়ে দাও। এত ভয়ের কিছু নেই।

আবিদা হাঁপাতে লাগল আর ঢুক গিলতে লাগল।আবিদার ভয় দেখে আমি চাপা গলায় বললাম

– আমি আপনার সাথে থাকব। আপনি চিন্তা করবেন না। ভয়ের কিছু নেই। আমার বোন তো ও।যা কিছুই হোক আমাকে ওর পাশে থাকতে হবে। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।

আবিদা আমার কথা শোনে একটা ভরসা পেল। হালকা দম নিয়ে বলল

– না মানে আমার তো ভয় লাগছে বিষয়টাতে তাই আর কী।

ডাক্তার রাহনুমা আমার কথা শোনে জবাব দিল

– আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আবিদার সাথে কাজ সেরে আমার কাছে আসবেন। বাকি কথা চেম্বারে বলব। এসব বিষয় খোলামেলা বলা উচিত না।

বলেই উনি হাসিবকে নিয়ে উনার চেম্বারের দিকে রওনা দিলেন।

অপর দিকে আমি আর মিসেস আবিদা মিলে সন্ধির কাপড় পাল্টে দিলাম। তারপর ডাক্তার রাহনুমার কাছে গেলাম। ডাক্তার রাহনুমা আমাকে দেখে চেয়ারটা ইশারা করে বসতে বলল। আমি চেয়ারটা টেনে বসলাম।তারপর উনি একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

– আপনার বোনের বিষয়টা নিয়ে তো আাপাতত কিছু করতে পারছি না। এ কাগজে আমার পারসোনাল নম্বর আছে কোনো সমস্যা হলে কল দিবেন। আর আমি আপনার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আপনার নম্বরটা নিয়ে নিয়েছি কোনো সাহায্য করতে পারলে করব অবশ্যই। বিকেল দিকে রোগীকে নিয়ে যেতে পারবেন। মানসিক মনোবল রাখবেন। আর বিষয়টা আপনার বড় বোনকে খোলাসা করে বলে দিন। যেহেতু সন্ধির পেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু আপনার বোনের কাছে বিষয়টা গোপন রাখলে আরও বেশি ঝামেলা হতে পারে। তাই বড়দের জানিয়ে দেওয়াই ভালো হবে।

আমি ডাক্তার রাহনুমার জবাবটা মাথা নেড়ে দিলাম। তারপর হাসিবকে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে সন্ধির কেবিনে সন্ধির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিকেল চারটায় সন্ধির জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে উঠে বসল। চারপাশ একটু চোখ বুলিয়ে বলল

– আপু এখানে কী করে আসলাম রে আমি?

আমি হতবাক গলার জবাব দিলাম

– তোকে গর্ভপাত করাতে এনেছিলাম ভুলে গেছিস?

– না…. তা তো ভুলিনি। তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাকে যখন ডাক্তার গর্ভপাতের জন্য রুমে ঢুকিয়েছিল তখন কেউ একজন রুম থেকে বের করে অন্য কোথায়ও নিয়ে গেছিল।

আমি সন্ধির কথা শোনে একটু আশ্চর্য হয়ে জাবাব দিলাম

– মানে?

– হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমি তো এতক্ষণ এ জগতে ছিলাম না মনে হচ্ছে। আমি তো ছিলাম অন্য একটা জায়গায় অন্য একটা জগতে।

আমি সন্ধিকে ধমক দিয়ে বললাম

– হেয়ালি রেখে খুলে বল কী হয়েছে?

সন্ধি মাথায় হাতটা চেপে ধরে বলল

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here