#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“এখানে এসেছেন কেন?”
আরশির প্রশ্নে রৌদ্র আকাশের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরশির দিকে শান্ত চোখে তাকালো। সব সময়ের মতো এবারও শীতল কন্ঠে বললো-
“এই জায়গায়টা খুব শান্ত নিরিবিলি তাই যখন ব্যস্ততার বাহিরে একা সময় কাটাতে ইচ্ছে করে তখনই এখানে এসে পরি।”
আরশি বেশ মনযোগ দিয়ে রৌদ্রর কথা শুনলো। রৌদ্রর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আশেপাশে তাকালো। ছোট্ট একটা খালের উপরে এই ব্রিজ। সত্যিই খুব সুন্দর জায়গা। মানুষের আনাগোনাও হয়তো খুব কম হয় এখানে। আরশি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে এই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির দিকে। আর রৌদ্র অপলক দৃষ্টিতে আরশিকে দেখতে ব্যস্ত। কিছুটা সময় পর রৌদ্র আচমকা আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-
“এতদিন কোথায় ছিলেন মিস আরু??”
হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে আরশি রৌদ্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। আরশি কোনো উত্তর দিচ্ছে না চুপচাপ মলিন মুখে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পুরনো কথা মনে পরায় অস্বস্তিতে হাত কচলাচ্ছে অনবরত। রৌদ্রর আরশির হাতের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো-
“অস্বস্তির কিছু নেই আমাকে ভরসা করলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন মিস আরু।”
আরশি মাথা তুলে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। খানিকটা সময় চুপ থেকে আরশি সব কিছু বলে দিল। আরশির চোখ পানিতে টলমল করছে মনে হচ্ছে এখনই গড়িয়ে পরবে। আরশির কাছে এসব কথা শুনে রৌদ্র রাগে চোখমুখ লাল হয়ে চোয়ালা শক্ত করে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। ভার্সিটির দারোয়ানের কাছে এক্সিডেন্টের কথা শুনে রৌদ্র খুব পেয়েছিল। কিন্তু আরশি সামনা-সামনি দেখে রৌদ্রর কেন যেন মনে হচ্ছিলো আরশির কোনো কার এক্সিডেন্টে হয়নি আর কোনো প্রকার ব্যথাও পায়নি। তাই রৌদ্রর মনে কিছুটা খটকা লাগছিলো। বার বার মনে হচ্ছিলো আরশির এতদিন গায়েব থাকার পেছনে অন্য কোনো ব্যাপার ছিলো। তাই আরশির কাছে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু আরশির সাথে যে এমন জঘন্যতম কিছু ঘটেছে সেটা রৌদ্র ভাবেনি।
“জানেন ডক্টর আমাদের চারপাশের মানুষ গুলো বড্ড ক্ষুদার্ত। খাবারের ক্ষুধা তাদের নেই তারা ক্ষুদার্ত মানুষকে ভেঙেচূরে খেতে। ক্ষুদার্ত পশুর মতো হিংস্র রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মেয়েদের উপর নিজেদের তৃপ্তি মেটাতে। সেদিন যদি কাসফি আর আমার বাকি ফ্রেন্ড গুলো না থাকতো হয়তো আমার গায়েও ধর্ষিতার সিল মেরে দিত এই সমাজ।”
কথা গুলো শেষেই আরশির চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো রৌদ্রর চোখ থেকে সেটা এড়ায়নি। আরশির চোখে পানি দেখে রৌদ্রর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। আরশির কান্না তার একদমই সহ্য হচ্ছে না। রৌদ্র কথা ঘুরানো জন্য গম্ভীর গলায় বললো-
“আচ্ছা মিস আরু আপনি আমাকে সাদা শার্টের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন?? বাই এনি চান্স আপনি কি সাদা শার্ট পরা কোনো ভূত দেখেছেন না-কি!!!”
সাদা শার্টের কথা শুনে আরশি তৎক্ষনাৎ মাথা তুলে রৌদ্রর দিকে তাকালো। নিখুঁতভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে পরোক্ষ করছে রৌদ্রকে। আরশি এখনো কাল রাতের ঘটনাটা নিয়ে কনফিউজড। ওটা কি সত্যিই রৌদ্রর ছিলো নাকি তার মনের ভ্রম কিছুই আরশি বুঝতে পারছে না। আরশি কিছু একটা ভেবে রৌদ্রর হাতে একটা চিমটি কাটলো। সাথে সাথেই রৌদ্র মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। হাত ঘষতে ঘষতে ভ্রু কুচকে আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-
“আপনি কি আমাকে চিমটি দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলবেন নাকি!! প্রতিবার কি আমাকে খামচি না দিলে আপনার শান্তি হয় না??”
আরশি একটা মেকি হাসি দিয়ে আমতা-আমতা করে বলল-
“দেখছিলাম আপনি ভূত না-কি মানুষ।”
রৌদ্র নিজের হাত আরশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
“এই যে দেখুন আমার রক্ত। জ্বিন ভূতের নিশ্চয়ই রক্ত থাকে না!!”
আরশি রৌদ্রর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই চামড়াটা হাল্কা ছিলে গিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে। আরশি দ্রুত রৌদ্রর হাত ধরে চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল-
“এইটুকু চিমটিতেই আপনার হাত দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেল!!”
রৌদ্র আরশির এমন বাচ্চামিতে মনে মনে হাসলো। কিন্তু মুখে গাম্ভীর্যতার ভাব এনে বলল_
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি আপনার নখ খুব ধারালো সব সময় কেটে রাখবেন। কিন্তু আপনি হয়তো আপনার এই ধারালো ছুরির মতো নখ দিয়ে খামচেই আমাকে হত্যা করার চেষ্টায় আছেন।”
আরশি জ্বলন্ত চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে রাগী কন্ঠে বলল-
“আমার নখ একদমই ঠিক আছে। আর এতটুকু রক্ত বের হওয়াতে কেউ মরে যায়??? এক ফোটা রক্তও তো বের হয়নি।”
“বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে ঝগড়া না করে এখন চলুন।”
রৌদ্রর কথায় আরশির রাগে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। রেগেমেগে রৌদ্রর পায়ে পাড়া দিয়ে বলল-
“অসভ্য ডাক্তার।”
কথাটা বলেই আরশি রাগে গজগজ করতে করতে রৌদ্রর আগেই চলে গেল। রৌদ্র ব্যথায় লাফিয়ে উঠলো। দু একবার পা ধাড়া দিয়েই দ্রুত আরশির কাছে গিয়ে বলল-
“আপনি আসলেই একটা বাচ্চা তা না হলে কেউ এমন করে!!”
আরশি রৌদ্রর দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রৌদ্র চুপ হয়ে গেল। আরশির রাগ দেখে রৌদ্র মিটমিট করে হাসছে। আরশি পুরো রাস্তা আর কোনো কথা বলেনি। রিকশা আরশির ভার্সিটির কাছে আসতেই রৌদ্র আর আরশি নেমে গেল। আরশি সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। রৌদ্র পেছন থেকে শীতল কন্ঠে বললো-
“আপনি রেগে গেলে রুদ্রাণীর মতো জ্বলজ্বল করে ওঠেন মিস আরু।”
রুদ্রাণী নামটা শুনেই আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আরশি পেছন ফেরার আগেই রৌদ্র আরশির বাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আরশি ডান দিকে ঘাড় বাকিয়ে পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না।
“কি হলো মিস আরু!! কাউকে খুঁজচ্ছেন নাকি!!”
রৌদ্রর কথায় আরশি চমকে বাম পাশে তাকিয়ে রৌদ্রকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। আরশি চিন্তিত গলায় মিনমিনে বলল-
“আপনি এখানে তাহলে..”
“আচ্ছা মিস আরু একটা প্রশ্ন ছিল।”
আরশির কথা শেষ করার আগেই রৌদ্র কথাটা বলে উঠলো। আরশি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিতেই রৌদ্র বলল-
“এতটা সময় আপনি আমার সাথে একা ছিলেন আপনার ভয় করেনি??”
আরশি কোনো উত্তর দিলো না। নিজের মনে মনেই বলল- “আসলেই তো আমি ওনার সাথে ছিলাম আমার ভয় করেনি কেন!! উনি যদি আমাকে ওখানে নিয়ে মেরে ফেলতো?? ছিঃছিঃ এইসব কি ভাবছি!!”
“কিছু কথা অজানাই থাকা ভালো। এখন আপনি বলুন আপনি কি কাল আমার বাসায় এসেছিলেন!! আর আমি এতদিন এখানে ছিলাম না এটা আপনি কি করে জানলেন??”
“সময় হলেই সব জানতে পারবেন। আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর হ্যাঁ এখন বাসায় যান ভার্সিটি যেতে হবে না। সাবধানে যাবেন আর নিজের খেয়াল রাখবেন আসছি।”
রৌদ্র আর একমিনিটও দেরি না করে বাইকের কাছে গিয়ে বাইক নিয়ে দ্রুত চলে গেল। আরশি এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আরশির কাছে সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।
—————————
নীলা আদ্রাফের কাছ থেকে যতটা দূরে যেতে চাইছে নীলা তার থেকেও বেশি আদ্রাফের প্রতি দূর্বল হয়ে পরছে। এতদিন আদ্রাফের সাথে সময় কাটিয়ে এখন নীলার মন বড্ড বেশিই ছটফট করছে আদ্রাফের সাথে কথার জন্য। তাই আদ্রাফকে ফোন দিল কোনো একটা বাহানায় দেখিয়ে কথা বলার জন্য। ফোন রিসিভ হতেই নীলা ইতস্তত করে বলল-
“হ্যালো আদ্র।”
“কি হয়েছে হঠাৎ ফোন দিলি কেন নিলু!!”
নীলা নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো-
“কেন তোকে ফোন দিয়ে কি পাপ করেছি না-কি!!”
আদ্রাফ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“ধুর গাধি আমি কি সেটা বলেছি নাকি!! কি বলবি বল।”
“তুই কি কাল ভার্সিটি যা…”
নীলার কথা পুরো শেষ হওয়ার আগেই আদ্রাফের ফোন আসলো। আদ্রাফ কান থেকে ফোন সামনে এনে কাসফিয়ার নাম্বার দেখে নীলাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
“নিলু তোর সাথে একটু পর কথা বলছি। কাসফি ফোন দিয়েছে হয়তো কোনো দরকার আছে।”
আদ্রাফ এক দমে কথা গুলো বলেই ফোন কেটে দিল। নীলা ফোন হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রাফের এমন ব্যবহারে নীলার বুক ফেটে কান্না আসছে। তার চোখ আজ আর কোনো বাধ মানছে না। বাচ্চাদের মতো ডুকরে ডুকরে কেঁদে দিলো নীলা। কাদঁতে কাঁদতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলছে-
“আমার সাথেই কেন এমন হলো!! আমি কি তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না আদ্র?? তুই কেন এতদিনেও আমার ভালোবাসা বুঝতে পারলি না?? আমি মুখে কিছু বলেনি বলে কি তুই আমার ব্যবহারে কিছুই বুঝতে পারিস নি?? তোর চোখে অন্য কারও জন্য ভালোবাসা দেখে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে রে আদ্র!! আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা করছে তোর এইটুকু অবহেলায়। আমি কিভাবে তোকে ছাড়া থাকবো আদ্র?”
কথা গুলো বলতে বলতে নীলার কান্নার গতি যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আজ নীলাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। নিজের উপরই খুব রাগ হচ্ছে। নীলা মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও সব সময়-ই আদ্রাফকে নিজের ভালোবাসা বোঝানোর চেষ্টা করতো। নীলা ভেবেছিল আদ্রাফ হয়তো একদিন তাকে ভালোবাসবে। কিন্তু না নীলার ধারণা সব সময়ই ভুল ছিল। আদ্রাফ তো তাকে সব সময় একজন বন্ধুই ভেবে গেছে। বন্ধু ভেবেই সব সময় খেয়াল রেখেছে আর নীলা আদ্রাফের এইসব কেয়ার দেখেই দিন দিন আরও বেশি আদ্রাফের জন্য নিজের মনে ভালোবাসা সাজিয়ে রেখেছে। আর এখন আদ্রাফের জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা এই ভালোবাসা গুলাই তার কষ্টে কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
————————
“আদ্রাফ তুই কি আজ কলেজে গেছিস??”
কাসফিয়ার চিন্তিত গলা শুনে আদ্রাফ ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে বলল-
” নাহ যাইনি, কিন্তু কি হয়েছে তোর গলা এমন লাগছে কেন?? তোরা দুজন ঠিক আছিস তো??”
“আশু আমাকে না বলেই ভার্সিটিতে চলে গেছে একা একা। নীলকে ফোন করেছিলাম নীল আর নীলা কেউ-ই নাকি ভার্সিটিতে যায়নি। আশু তো আমার ফোনও রিসিভ করছে না। এমনিতেই ওর সাথে এমন একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে এখন আবার একা-একা বাহিরে গেছে। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে আদ্রাফ।”
“কাসফি তুই শান্ত হ চিন্তা করিস না। আমি দেখছি ভার্সিটিতে গিয়ে। এই মেয়েটার কখনো একটু বুদ্ধিও হবে না। আচ্ছা নীল কি বেরিয়েছে আশুকে খুঁজতে!!”
“হ্যাঁ নীল সাথে সাথেই বেরিয়ে গেছে। তুইও একটু গিয়ে দেখ প্লিজ।”
“আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তুই চিন্তা করিস না।
চলবে….