লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
#পর্ব ৪
** চৈতালী আর তার বাবার মাঝে অসহায় বোধ করলেন আসমাত শিকদার। আশেপাশে তাকিয়ে স্ত্রী পুত্র কে খুজলেন। পাশেই স্ত্রী আয়শা কে কারো সাথে কথা বলতে দেখলেন তবে ছেলেকে দেখলেন না। বুঝলেন ছেলে বাসায় চলে গেছে। এতহ্মণে ভয় লাগতে শুরু করলো তার। এখানে ছেলেকে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে নাটক করে, কেঁদে- কেটে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন। এমনকি বন্ধ ঘরের মধ্যে ছেলের পায়ে ধরার নাটকটাও করতে গিয়েছেন। এর পরিণতি কি তিনি জানেন না। তবে আজ তিনি বেশ শান্তি অনুভব করছেন। নিজের ছেলেকে ওরকম গম্ভীর,কঠোর ভাবে দেখতে কোন বাবা মায়ের ভাল লাগে না।তাদেরও লাগে নি। তাই এতকিছু। এরপর যা হয় দেখা যাবে। যদিও চৈতালীর রাজি হওয়া নিয়ে সংশয় ছিলো তবে রাজি হয়ে যাওয়ায় কাজ এগিয়ে গেছে। তবে চৈতালী যে জিদের বশে রাজি হয়ছে বোঝা যাচ্ছে। যা হবার হয়েছে এখন শুধু দুটোকে একসাথে রাখা দরকার। এতদিন যে সম্পর্কই থাক এখন তারা স্বামী-স্ত্রী। আগুন আর মোম পাশাপাশি থাকলে না গলে যাবে কই।
– বড়আব্বু
চৈতালীর ডাকে চিন্তা থেকে বের হলেন আসমাত শিকদার। বললেন হ্যাঁ মা বলো কি বলছো।
– বাড়ি চলো এত লোকজন আর ভাল লাগছে না।
– পাগল বাড়ি তো এটাই শুধু তোরা চার তলায় থাকতি আর আমরা দোতালায় এই যা।
– ঐ দোতালাতেই যেতে চাইছি চলো।
-দাড়া তোর বড় মা কে ডাকি।
আসমাত শিকদার স্ত্রী দিকে এগিয়ে গেলেন।
এই বাড়ির নাম শিকদার ভিলা। পাঁচতলা এই বাড়িটা চৈতালীর দাদা ওসমান শিকদারের বানানো। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েদের যত টাকা আর বাড়ি গাড়ি হোক না কেন তারা যেন একসাথেই থাকে। ভাই ভাই যেন মিলে মিশে থাকে। তার দাদার কথা রাখতেই তার বাপ-চাচারা সবাই একসাথে এই বাড়িতে থাকে।চৈতালির বাবারা তিন ভাই এক বোন। নিচতলা তে থাকে দারোয়ান, মালি ড্রাইভার,আর কাজের লোকজন, এছাড়া হলরুমের মত বড় রুম আছে সেখানে। রুমে টিভি, দাবা,লুডু, সরঞ্জাম দিয়ে ভরা। মূলত এখানে তারা ভাইবোনেরা আড্ডা মারে। বাবা চাচারাও মাঝে মাঝে আলাপ আলোচনা করেন। দরকারি মিটিং করেন।
২তলায় থাকে চৈতালির বড় চাচা। রাফসানের বাবা। রাফসান রা ১ ভাই ১ বোন। রাফসানের বোন রাফিয়া বিয়ে করে বর্তমানে স্বামীর সাথে জার্মানিতে বসবাস করছে। প্রতিবছর একবার সে বাংলাদেশে আসে।বয়সে রাফসানের চার বছরের ছোট।
তয় তলায় চৈতালীর ছোট চাচা আরমান শিকদার থাকেন। তার দুটো জমজ ছেলে। একজন আরিয়ান, অন্যজন আবির। দুজনই চৈতালীর বয়সি। পড়ালেখার সুবাদে দুজনই ঢাকা থাকে। তবে এইচ সি পরীহ্মা দিয়ে এখন দুজনেই বাড়িতে।
চার তলাতে চৈতালীদের বসবাস। চৈতালীর আর কোন ভাইবোন নেই। সে একা। তার বাবা মার বিয়ের ১৪ বছর পর তার জন্ম হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলেন তার মা সন্তান জন্মদানে অহ্মম। তবুও আল্লাহর অশেষ রহমতে সে দুনিয়াতে এসেছে। ছোট থেকে এমনটাই শুনেছে চৈতালী।
পাঁচতলা তার ফুফু আসমতারা শিকদারের জন্য বরাদ্দ। তার শশ্বুড় বাড়ি রাজশাহী। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই চলে আসেন। এছাড়া মেহমান বেশি হলে পাঁচতলা তে থাকতে দেওয়া হয়। প্রতিদিন কাজের লোক দিয়ে পরিষ্কার করে রাখা হয়।
মেহমান যখন বিদায় নিলো..#লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
পর্ব ৫
** মেহমান যখন বিদায় নিলো তখন রাত ১১ টা। আসমাত শিকদার চৈতালীকে নিয়ে দোতালায় এলেন। দোয়ায় ইউনুস পড়তে শুরু করলেন তিনি। আল্লাহ জানেন রাফসান এখন কি করবে। রাফসানের মায়ের অবশ্য কোন ভাবান্তর নেই। যা হবার হবে। তবে তার ধারণা রাফসান বেশি কিছু করবে না। বরং আগের থেকে একটু বেশি গম্ভীর হয়ে যাবে।তাদেরকে যা খুশি বলুক শুধু এই মেয়েটার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলেই হবে।
– বড় মা ঘুম পাচ্ছে কোথায় ঘুমাবো?
-রাফসানের রুমে ঘুমাবি কোথায় আবার।
– আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই রাফসানের রুমে হাটা দিলো চৈতালী। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সে কয়েকবার নক করলো। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে ফিরে গেলো।
– বড় মা রাফসান ভাই তো দরজা খুলছে না।
আয়শা বেগম একটু চিন্তুিত বোধ করলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি সোফাতেই ঘুমিয়ে গেছেন। তাকে না ঘাটিয়ে রাফসানের রুমের দিকে এগুলেন তিনি। দরজার কাছে গিয়ে কড়াঘাত করলেন। কয়েকবার ডাকলেন- রাফসান দরজা খোল চৈতালী ঘুমাবে।
ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না। বাধ্য হয়ে তিনি চৈতালীকে বললেন – মা রে ও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই অন্য রুমে ঘুমাবি??
চৈতালী মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আয়শা বেগম একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেের কাজে গেল।
**নিজের রুমে রিডিং টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে রাফসান। তার বাজে কোন নেশা নেই তা না হলে এখন একটা সিগারেট খেত সে। মন মেজাজ বিহ্মিপ্ত তার। এই মা বাবা গুলো এমন কেন হয়। ধরে বেধে হাটুর বয়সী একটা মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো? এই সেদিনের মেয়ে, গুনে গুনে তার থেকে ১৬ বছরের ছোট। চিন্তা করেই আর একবার মেজাজ হারালো সে। চৈতালী যখন জন্ম নিলো তখন সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বলতে গেলে ঐ সময় যদি সে বিয়ে করতো তাহলে চৈতির বয়সী একটা মেয়ে থাকতো তার। তার উপর চাচাতো বোন। আপন বোন আর চাচাতো বোনের কোন তফাৎ নেই তার কাছে। আর হাটুর বয়সী চাচাতো বোন কে তার বিয়ে করতে হলো? ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো তার। ওয়াশরুমের বেসিং এ গিয়ে হরহর করে বমি করে দিলো। মানুষ খালাতো,মামাতো, ফুফাতো বোন বিয়ে করে ঠিক আছে। তবে সে এটা মেলাতে পারলো না চাচাতো বোন আর আপন বোনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। তবে আশার আলো ছিলো চৈতি হয়তোবা রাজি হবে না। তা না মেয়ে নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলো? কেন যে ঢাকা থেকে আসতে গেলো। রাগে নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছা করলো। নিজেকে কন্ট্রোল করার আর কোন উপায় না দেখে ঔষধের পাতা থেকে একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো সে
ঘুমের কথা বলে শুয়ে পড়লেও ঘুম নেই চৈতালীর চোখে। চোখ বুঝলেই সে আশরাফের চেহারা দেখতে পাচ্ছে। যাবারই যখন ছিলো তখন চৈতালীকে এত স্বপ্ন কেন দেখালো। তার তো কোন পাপ ছিলো না। তবে সেই কেন প্রতারণার স্বীকার হলো? আবার কত সুন্দর করে বলেছে মাফ করে দিও। বললেই কি মাফ করা যায়?? ছোটবেলা থেকেই সে শক্ত ধাঁচের মেয়ে। ন্যাকামি, লুতুপুতু ভাব তার মধ্যে নেই। তাইতো ১৭ বছর বয়সেই তার মধ্যে ম্যাচুরিটি এসেছে। তবে শক্ত ধাঁচের মেয়েটাও আজ প্রথমবার কাউকে ভালবেসে না পাওয়ার কষ্টে বালিশে….লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৬
*সামিরা আক্তার
—-বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে চৈতালী। দরজার ওপাশে পৌছালো না তার চিৎকার। জানলো না কেউ তার কষ্টের কথা।
নিজের রুমে সোফায় চুপচাপ বসে আছে আসলাম শিকদার। মেয়ের অমতে বিয়ে দিয়ে রুমে আসার পরই সে চুপচাপ। সে এরকমটা চায় নি। বড়ভাই যখন তার সামনে ছেলের জন্য হাতজোড় করে দাড়ালো তখন তার কিছুই করার ছিলো না। এছাড়া তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা তার ভাই জানে। সে চায় না এই সত্য আর কেউ জানুক। বাকি আর যেন জানতো সে নেই। আসলাম শিকদার কে বাঁচিয়ে দেবার জন্যই হয়তো সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে। আর কিছু ভাবতে পারলো না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলো নিঃশব্দে কাঁদছে সে। মেয়েকে রাফসানের সাথে বিয়ে দেবার কোন ইচ্ছা ছিলো না রেবেকার। একে তো বয়স বেশি তার উপর ডিভোর্সি। কিন্তু স্বামীর মুখের উপর কিছু বলতে পারে নি।
**রাফসানের যখন ঘুম ভাঙলো তখন ১০টা বাজে। বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই।আজ ঘুমানোর কারণ কালকের ঘুমের ঔষধ বুঝতে পারলো। আর ঘুমের ঔষধের কথা মনে পড়তেই কালকের পুরো ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সাথে সাথে মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেলো। বসে বসে নিজের মাথার চুল সে নিজেই টানলো কিছুহ্মণ। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো আর থাকবে না এখানে। একটু পরই ঢাকা রওনা দিবে। ভাবতেই উঠে ফ্রেশ হতে গেলো সে। যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারবে ততোই মঙ্গল।
রাফসান ফ্রেশ হয়ে বের হতেই প্রথমে ডাইনিং এ দেখলো চৈতালী কে। সোফায় শুয়ে আপেল খাচ্ছে আর টম এন্ড জেরি দেখছে। মাঝে মাঝে হাঁসতে হাঁসতে সোফা থেকে পড়ে যাচ্ছে। পড়ে গিয়ে উঠে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে হাঁসছে। রাফসান কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। চৈতালীর সাথে তার কথা বার্তা কম। চৈতালী ভালমত দুনিয়া দারি বুঝে ওঠার আগেই সে বাড়ি ছেড়েছে। তাই সেও জানে না চৈতি আসলে কেমন। ভাবনার প্রহর থেকে বের হয়ে মাকে ডাকলো সে- মা নাস্তা দাও আমি বের হবো।
রাফসানের কথায় ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো চৈতালী। রাফসানকে সে কাল সকালে শেষ দেখেছিলো। তারপর আজ দেখলো। সে জানে রাফসান তাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তার খিদে পাওয়ায় সে বড়মাকে ডাকতে গিয়েছিলো সেখান থেকেই সবটা শুনেছে সে। তখন তার আশরাফের বলা কথা মনে পড়েছে যে আমাদের বাবা মা আর কিছু না পাড়ুক আমাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে খুব ভালো পারে। আহারে বেচারা রাফসান ভাই তোমার মত স্বাধীনচেতা মানুষ ও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হলে? মুখ দিয়ে আফসোসের একটা শব্দ করলো চৈতালী।
চৈতালী কে মিটিমিটি হাঁসতে দেখে একটু অবাক হলো রাফসান। এই মেয়ে এত স্বাভাবিক কি করে?? ওর কি মনে নেই ওর একটা আধবুড়ো লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। ভাবতেই খুশি হয়ে গেলো রাফসান। ভুলে যা চৈতি। সব ভুলে যা। তাহলে তুইও বাঁচিস আমিও বাঁচি।কিন্তু আসলেই কি ভুলে গেছে? মনে মনে ভাবলো রাফসান। একটু টেষ্ট করার উদ্দেশ্যে ডাকলো চৈতালীকে- চৈতি মা কোথায় রে?
রাফসান তাকে ডাকবে এটা ওর ভাবনার বাহিরে ছিলো। আসলেই ডাকছে? না কি ভুল শুনলো। চৈতালী পুরো কনফিউজড হয়ে গেলো। ওর ভাবনার সুতো ছিড়লো ওকে যখন আবার রাফসান চৈতী বলে ডেকে উঠলো….(ক্রমশ)
(ক্রমশ)
# সামিরা আক্তার
# সামিরা আক্তার